সন্দীপ দত্ত : হাংরি জেনারেশন আন্দোলন
সন্দীপ দত্ত : হাংরি জেনারেশন আন্দোলন
“বাংলা লিটল ম্যাগাজিনের ইতিহাসে হাংরি প্রথম প্রতিষ্ঠানবিরোধী আন্দোলন । ১৯৬১ সালের নভেম্বর মাসে হাংরি জেনারেশন বুলেটিনের মাধ্যমে যার সূচনা । স্রষ্টা, নেতৃত্ব ও সম্পাদক যথাক্রমে মলয় রায়চৌধুরী, শক্তি চট্টোপাধ্যায় ও দেবী রায় । পত্রিকার চিন্তনভূমি পাটনা হলেও তার প্রকাশ স্হান ছিল ২৬৯ নেতাজি সুভাষ রোড, হাওড়া ; হারাধন ধাড়া বা দেবী রায়ের ঠিকানা । যদিও ছাপা হয়েছিল পাটনা থেকে ।
“মলয় রায়চৌধুরী তখন ২২ বছরের তরুণ, পাটনা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির ছাত্র ।কবি জিওফ্রে চসারের ( ১৯৩৯ - ১৪০০ ) Sowre Hungry Tyme পড়ে মলয় Hungry শব্দের অভিঘাতে উত্তেজিত হয়ে ওঠেন । হাংরির পরিকল্পনা তখন থেকেই । সময়ের প্রেক্ষাপটটিও গুরুত্বপূর্ণ । সদ্য স্বাধীন দেশ । দেশভাগ, অর্থনৈতিক বিপর্যয় । দারিদ্র, ক্ষুধা, নিরন্ন মানুষ । বাংলা কবিতার হালও খুব খারাপ । ৩০ - ৪০-এর গতানুগতিক কবিতা নির্জীব হচ্ছে । ৫০-এর কবিরা সবে নিজেদের প্রকাশ করছে । নিজস্বভূমি আবিষ্কার হয়নি । শক্তি চট্টোপাধ্যায় একসময় এলেন পাটনায় । মলয় শক্তিকে হাংরি আন্দোলনের প্রয়োজনের কথা বলেন । প্রথম বুলেটিনে কবিতা বিষয়ক একটি ইশতাহার ইংরেজিতে ছাপা হলো ।
“১৯৬২ ফেব্রুয়ারি মাসে বাংলায় প্রথম ইশতাহারটি প্রকাশ পায় । ১৯৬১ থেকে ১৯৬৫ সাল পর্যন্ত প্রায় ১০৭টি হাংরি বুলেটিন প্রকাশ পায় । এইসব বুলেটিনে প্রকাশের কোনো তারিখ থাকতো না । নানা রঙের কাগজে, এমনকি মলাটের বাদামি কাগজেও বেরোতো এক সপ্তাহে ২৪টি আবার কখনও বছরে একটি হয়তো ।
“হাংরি সূচনাকালে আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন মাত্র চারজন । শক্তি চট্টোপাধ্যায়, দেবী রায়, সমীর রায়চৌধুরী ও মলয় রায়চৌধুরী । এরপর একে একে যুক্ত হন সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়, উৎপলকুমার বসু, শৈলেশ্বর ঘোষ, সুবিমল বসাক, সুভাষ ঘোষ, প্রদীপ চৌধুরী, বাসুদেব দাশগুপ্ত, ফালগুনী রায়, রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়, ত্রিদিব মিত্র, অরুণেশ ঘোষ, সুবো আচার্য প্রমুখ ।
“ঐতিহ্যগত মূল্যবোধকে অস্বীকার ও প্রচলিত গতানুগতিক ধারার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে লেখালিখিতে নতুন আবিষ্কারই প্রকৃত সাহসী ও মৌলিক পথ মানতো হাংরিরা । কৃত্তিবাস বা শতভিষা গোষ্ঠী হাংরি আন্দোলনকে মেনে নিতে পারেনি । প্রবীণ সাহিত্যকাররাও বিরূপ মনোভাব প্রকাশ করেছেন হাংরিদের সম্পর্কে । সংবাদপত্রে সমালোচিত হয়েছে হাংরি গোষ্ঠী ।
“অথচ সর্বভারতীয় ভাষায় বরেণ্য হয়েছিল এই আন্দোলন । হিন্দি, উর্দু, মারাঠি, গুজরাটি তরুণ লেখকরা এই আন্দোলনকে সমর্থন করেছিল । অন্য ভারতীয় ভাষার পত্রপত্রিকায় প্রভাব পড়েছিল হাংরি আন্দোলনের । মারাঠি ভাষার লেখক অশোক সাহানে, দিলীপ চিত্রে, অরুণ কোলটকর প্রমুখ, তেলেগু ভাষায় নিখিলেশ্বর, নগ্নমুনি, জ্বলামুখী প্রমুখ । হিন্দি লেখক ফণীশ্বরনাথ ‘রেণু’ হাংরি লেখকদের মূল্যায়ন করেন ।
“বহির্বিশ্বেও হাংরি আন্দোলনের বার্তা ছড়িয়ে পড়ে ।
“১৯৬৪ সালের জুলাই মাসের শেষ দিকে হাংরি জেনারেশনের একটি বুলেটিনকে কেন্দ্র করে অশ্লীলতার অভিযোগে মলয় রায়চৌধুরীসহ হাংরিদের অনেককেই গ্রেপ্তার করা হয় । ৪৮ শঙ্কর হালদার লেন, আহিরিটোলা, কলকাতা- ৫ থেকে ওই সংখ্যায় দশজন লেখক ও প্রকাশক সমীর রায়চৌধুরীর নাম পাওয়া যায় । লেখক তালিকায় ছিলেন মলয় রায়চৌধুরী, প্রদীপ চৌধুরী, বাসুদেব দাশগুপ্ত, সুবিমল বসাক, উৎপলকুমার বসু, দেবী রায়, রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়, শৈলেশ্বর ঘোষ, সুভাষ ঘোষ ও সুবো আচার্য । এই বুলেটিনেই প্রকাশ পায় মলয় রায়চৌধুরীর ‘প্রচণ্ড বৈদ্যুতিক ছুতার’ কবিতাটি ।
“এই কবিতাকে কেন্দ্র করে অশ্লীল রচনার দায়ে হাংরি জেনারেশন পত্রিকার বিরুদ্ধে লালবাজার প্রেস সেকশনের সাব ইন্সপেক্টর কালীকিঙ্কর দাস অভিযোগ আনলেন । শুরু হলো ধড়পাকড় । ১১ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ থাকলেও ধরা হলো ৬ জনকে । মামলা অবশ্য শেষ পর্যন্ত দায়ের করা হয়েছিল মলয় রায়চৌধুরীর বিরুদ্ধে । দীর্ঘ দিন মামলা চলল । ১৯৬৫ সালের মে মাসে মলয় রায়চৌধুরীর বিরুদ্ধে চার্জশিট দাখিল করা হয় । এই ১৯৬৫ সালেই হাংরি আন্দোলনের ইতি ঘটে । এই বছরেই ২৮ ডিসেম্বর নিম্ন আদালতে মলয় রায়চৌধুরীর সাজা হয় । পরে, ১৯৬৭ সালের ২৬ জুলাই মলয় রায়চৌধুরী হাইকোর্টে পিটিশন দ্বারা মামলা করার ভিত্তিতে, তাঁকে সম্পূর্ণরূপে মুক্তি দেয়া হয় ।
“আন্দোলনের কথা পৌঁছে যায় নিউইয়র্কের TIME পত্রিকায় । এই প্রথম বাংলা ভাষায় প্রকাশিত একটি পত্রিকা বিদেশে প্রচারিত হলো । প্রতিষ্ঠানবিরোধী হাংরি জেনারেশনের এই আন্দোলন বাংলা সাহিত্যে একটি দীঘস্হায়ী ছাপ রেখে গেল ।”
( কৃত্তিবাস পত্রিকার ১ জুন ২০২২ সংখ্যায় প্রকাশিত )
Comments
Post a Comment