মাইকেল মধুসূদন দত্তর কবিতা - King Porus : Legend of Old : Malay Roychoudhury

 মাইকেল মধুসূদন দত্ত’র কবিতা ‘King Porus : A Legend of Old’ 

মলয় রায়চৌধুরী

এই কবিতাটা, ‘King Porus: A legend of Old’ মাইকেল মধুসূদন দত্ত লেখার আগে, আমার মনে হয়, আলেকজান্ডার আর রাজা পুরুর যুদ্ধ এবং যুদ্ধে পরাজিত পুরুর ঔদ্ধত্য ও আত্মাভিমান সম্পর্কিত ঘটনাটা ভারতীয় ভাষায় আর কেউ লেখেননি । কবিতাটা বিভিন্ন রাজ্যের স্কুল ফাইনাল সিলেবাসের অন্তর্গত।  মাইকেল মধুসূদন দত্ত বাংলা সাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবি।  তিনি ইংরেজি, গ্রিক, ল্যাটিন, ফার্সি, সংস্কৃতের পাশাপাশি বাংলার মতো অনেক ভাষাকে সাহিত্যের উন্নতির জন্য বেছে নিয়েছিলেন এবং আয়ত্ত করেছিলেন।মাইকেল মধুসূদন দত্ত ছিলেন বহু ভাষাবিদ। মাতৃভাষা ছাড়া তিনি আরো বারোটি ভাষা জানতেন। শিশু কালে গ্রামের টোল থেকে ফারসি ভাষা শিক্ষার মাধ্যমে তাঁর ভাষা শিক্ষার শুরু হয়। তিনি ইংরেজি ছাড়াও ল্যাটিন, গ্রিক, ফারসি, হিব্রু, তেলুগু, তামিল ইত্যাদি ভাষায় অনায়াসে কথা বলতে পারতেন। তিনি এমনকি ফারসি ও ইতালীয় ভাষায় কবিতাও লিখেছেন ।

মধুসূদন সাহিত্যসাধনার সূচনাই করেছিলেন ইংরেজি ভাষায়; পরে সে পথ পরিবর্তন করে বাংলা ভাষার মাধ্যমে শিল্পচর্চায় মনোনিবেশ করেন। এক সময় তিনি অনুধাবন করেছেন, অন্যের ভাষায় সাহিত্যসাধনা করা কিংবা কল্পনা বিকাশের পথ অন্বেষণ করা এক ধরনের ভিক্ষাবৃত্তি ! মাতৃভাষার মাহাত্ম্যকে অবহেলা করার অপরাধে নিজেকে অপরাধী মেনেছেন তিনি; অনুশোচনা করেছেন । তিনি বুঝতে পেরেছিলেন যে, মাতৃভাষা ভিন্ন অন্য ভাষায় চিন্তার প্রকাশ ও বিকাশ দুরুহও বটে ; এবং সে অভিপ্রায় অনভিপ্রেত, অশুভ এবং অগ্রহণযোগ্য ! একে তিনি অভিহিত করেছেন ‘অবরেণ্য’ বলে। বিভিন্ন ভাষায় দখল অর্জনকারী এই সাহিত্যিক এই সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পেরেছিলেন যে  মাতৃভাষার চেয়ে বড়ো কিছু হতে পারে না। মাতৃভাষায় শিল্পসাধনার প্রেরণাদাত্রীকে কবি মধুসূদন কূললক্ষ্মী বলে বিবেচনা করেছেন; তাঁর ধারণা শিল্পী-সাহিত্যিকরা ওই অধিষ্ঠাত্রী দেবীর নির্দেশে বা অনুকম্পায় অথবা স্বপ্নাদেশবলে সৃজনশীল প্রতিভার প্রকাশ ঘটাতে সক্ষম হন। তাঁর ক্ষেত্রেও এর ব্যতিক্রম হয়নি বলেই তিনি মনে করতেন! বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস এবং ঐতিহ্য যে ভাবসম্পদ এবং স্মরণীয় ব্যক্তিত্বে সমৃদ্ধ, তা মধুসূদনের বুঝতে অসুবিধা হয়নি; পূর্বসূরীদের গুরুত্বপূর্ণ কীর্তিগুলো এবং অসাধারণ সব প্রতিভার কথা বার-বার উল্লেখ  করেছেন বিভিন্ন সূত্রে।

গ্রিক ঐতিহাসিকরা রাজা পুরু বা পোরাসকে নিয়ে লিখেছেন । কিন্তু সেই সময়ের ভারতীয় লেখকদের রচনায় রাজা পুরুর উল্লেখ পাওয়া যায় না ।  রাজা পুরুকে নিয়ে ১৮৪৩ সালে মাইকেল মধুসূদন কবিতাটা ইংরেজিতে লিখেছিলেন। এই কবিতাটা সেই ঐতিহাসিক ঘটনা বর্ণনা করে যখন আলেকজান্ডার রাজা পুরুর রাজত্বকে আক্রমণ করেছিলেন, এবং কবিতাটিতে বর্ণিত হয়েছে যুদ্ধক্ষেত্রের দৃশ্য এবং রাজা পুরুর দেশপ্রেম। কবিতাটি রাজা পুরুকে ভারতীয় অতীতের বীর নায়ক হিসেবে মহিমান্বিত করেছে এবং দেশপ্রেমের এই গৌরবময় ঐতিহ্যকে ধরে রাখার জন্য সকলকে অনুরোধ করেছে। শিরোনাম থেকে বোঝা যায় যে কবিতাটি প্রাচীন ভারতের একটি কিংবদন্তির কথা বলছে। 



দুই

কে ছিলেন রাজা পোরাস ? রাজা পুরুষোত্তম বা পুরু  ছিলেন পৌরবের রাজা । এই রাজ্য প্রাচীন ভারতীয় রাজ্য ঝিলাম ( বিতস্তা ) ও চেনাব ( চন্দ্রভাগা ) নদী দুটোর মধ্যে অবস্থিত ছিল । যা এখন আধুনিক পাঞ্জাব, পাকিস্তান আর বিপাশা নদীর অববাহিকার অন্তর্ভুক্ত । রাজা পুরুষোত্তম ৩২৬ খ্রিস্টপূর্বাব্দে  আলেকজান্ডারের সাথে বিতস্তার তীরে ( আধুনিক পাঞ্জাব ) যুদ্ধ করেন এবং পরাজিত হন । এরপর তিনি আলেকজান্ডারের অধীনে সামন্ত রাজা হিসেবে রাজত্ব করেন । প্রাচীন গ্রীক ঐতিহাসিকরা আলেকজান্ডারের বিজয়ের যুদ্ধ এবং পরবর্তী ঘটনা বর্ণনা করেছেন।  যুদ্ধে পুরুর পরাজয় এবং গ্রেপ্তারের পরে আলেকজান্ডার তাঁকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন যে, কীভাবে তিনি তাঁর সাথে আচরণ করবেন ? রাজা পুরু পরাজিত হলেও গর্বের সাথে বলেছিলেন যে, তাঁর সাথে রাজার মতো আচরণ করতে হবে। আলেকজান্ডার তাঁর প্রতিপক্ষের দ্বারা এতটাই মুগ্ধ হয়েছিলেন যে তিনি তাঁকে কেবল তাঁর নিজের রাজ্যের তত্ত্বাবধায়ক হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করেননি, বরং হাইফাসিস (বায়াস) অবধি দক্ষিণ-পূর্ব অঞ্চলের জমিগুলোর আধিপত্য দান করেছিলেন। রাজা পুরু খ্রিস্টপূর্ব ৩২১ থেকে ৩১৫ খ্রিস্টাব্দের মাঝামাঝি সময়ে মারা গিয়েছিলেন।  গ্রীক ঐতিহাসিক প্লুটার্কের মতে ঝিলমের যুদ্ধের পর পুরুকে তাঁর নিজেরই পাঞ্জাব রাজ্যের সামন্তরাজ হিসেবে নিযুক্ত করেছিলেন সম্রাট অ্যালেকজান্ডার। ৩১৫ খ্রিষ্টপূর্বে পাঞ্জাব অঞ্চলের গ্রীক সেনাপতি ইউডেমাসের ষড়যন্ত্রে গুপ্তঘাতকের হাতে নিহত হন মহারাজ পুরু।

ইতিহাসকার ঈশ্বরী প্রসাদ সহ আরও অনেক ঐতিহাসিকদের মতানুযায়ী শ্রীকৃষ্ণের মৃত্যু এবং যদুবংশের পতনের পর সময়ের সাথে সাথে ক্রমে ভারতবর্ষের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে পড়ে যদুবংশীয়রা।  এদের মধ্যে একটি অংশ মথুরা, দ্বারকা আর গুজরাট ত্যাগ করে ভাগ্যের সন্ধানে পাড়ি জমিয়েছিলেন প্রাচীন ভারতবর্ষের উত্তরাপথে সুদূর পাঞ্জাব, সিন্ধু, তক্ষশীলা প্রদেশ আর আফগানিস্থান -এ। এরকমই কোনো যদুবংশীয় শূরসেন উপজাতি থেকেই উত্থান ঘটেছিল রাজা পুরুর। গ্রিক সম্রাট আলেকজাণ্ডারের কাছ থেকে নিজের রাজকীয় সম্মান আদায় করে ভারত ইতিহাসের পাতায় এক মর্যাদার আসনে প্রতিষ্ঠিত হয়ে আছেন বিতস্তা ও চন্দ্রভাগা নদীর মাঝে অবস্থিত স্বাধীন রাষ্ট্রের বীর নায়ক পুরু। কেউ বলেন, তিনি পৌরব ক্ষত্রিয়। কেউ বলেন, তিনি ছিলেন পুরু গোষ্ঠীর মানুষ। আবার কোনো কোনো ঐতিহাসিকের মতে, তিনি ছিলেন ভারতের প্রাচীন শূরসেন গোষ্ঠীর লোক।  গ্রিক ইতিহাস থেকে তথ্য আহরণ করে  পুরুর বীরত্বের পরিচয় করিয়ে দিয়ে গেছেন মধুসূদন । পুরুকে ইতিহাসে খুঁজতে এইজন্য অসুবিধা হয় যে সেই সময়ের তথ্য ভারতীয়রা লিখে রাখেননি । শুরু করতে হবে ঋগ্বেদ থেকে। ঋগ্বেদের সপ্তম মণ্ডলে একাধিকবার পুরু উপজাতির উল্লেখ দেখা যাচ্ছে। এই ঋগ্বেদের তৃতীয় মণ্ডলের তথ্য অনুসারে, প্রাচীন ভারতের উত্তরাপথের সরস্বতী নদীর তীরে ছিল  পুরু গোষ্ঠীর মানুষের বসবাস। একাধিক গোষ্ঠীতে বিভক্ত  এই গোষ্ঠীর সঙ্গে বিরোধ ছিল "ভরত" গোষ্ঠীর। আবার ঋগ্বেদের সপ্তম মণ্ডল থেকে জানা যাচ্ছে, এই "ভরত" গোষ্ঠীর রাজা সুদাসের বিরুদ্ধে বিশ্বামিত্রের নেতৃত্বে দশ উপজাতির মহাজোট একটি যুদ্ধে অংশ নিয়েছিল। কিংবদন্তিতে এই যুদ্ধ "দশ রাজার যুদ্ধ" নামে পরিচিত। এই মহাজোটে ছিল পুরু, যদু, তুর্বশ, অনু, দ্রুহ‍্যু, অলিন, পকথ, ভলানস, শিব ও বিষাণীরা।

ভরত উপজাতি গোষ্ঠীর রাজা দিবোদাসের রাজপুরোহিত ছিলেন ঋষি বিশ্বামিত্র। রাজা সুদাস তাঁর কাজে অসন্তুষ্ট হয়ে তাঁকে বাদ দিয়ে ঋষি বশিষ্ঠকে রাজপুরোহিত মনোনীত করেন। এতে অপমানিত বিশ্বামিত্র সুদাসের বিরুদ্ধে দশ উপজাতি রাজার এই মহাজোট গঠন করেছিলেন। তবে যুদ্ধে জয়লাভ করেন রাজা সুদাস। পরোষ্ণি অর্থাৎ ইরাবতী নদীর তীরে এই যুদ্ধ হয়েছিল। যুদ্ধে পুরু গোষ্ঠীর রাজা পুরুকুৎস মারা যান। ইরাবতী নদীর জলে ডুবে মৃত্যু হয় অনু ও দ্রুহ‍্যুদের রাজাদের। তবে মহাজোট পরাজিত হলেও সে জোটের রাজারা স্বাধীনতা হারাননি। তাঁরা আগের মতোই নিজেদের এলাকায় স্বাধীনভাবেই বসবাস করছিলেন। ঋগ্বেদে পুরুদের চার জন রাজার কথা আছে---দুর্গহ, তাঁর পুত্র গিরিক্ষিত, তাঁর পুত্র পুরুকুৎস এবং পুরুকুৎসের পুত্র ত্রসদস‍্যু। ভরত গোষ্ঠীর রাজা সুদাসের সমসাময়িক ছিলেন পুরু গোষ্ঠীর রাজা পুরুকুৎস। অনেকের মতে ঋগ্বেদে উল্লিখিত "পঞ্চজনা" হলো---পুরু ও তাঁদের চার মিত্র গোষ্ঠী---অনু, দ্রুহ‍্যু, যদু, তুর্বশ। অন্যদিকে, মহাভারতের যদু বংশোদ্ভূত শ্রীকৃষ্ণ-বলরামের পুজো করতে দেখা যায় অনেক পরে ভারতের শূরসেন গোষ্ঠীর লোকদের। এদিক দিয়ে ভারতের শূরসেন গোষ্ঠীকে মহাভারতের যদু বংশোদ্ভূত বলা যায়।

মহাভারত যুদ্ধের পরে শ্রীকৃষ্ণের মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে বিশাল যদু বংশের পতন ঘটেছিল। সে সময় যদু বংশের বেশকিছু লোকজন দ্বারকা, মথুরা ও গুজরাট ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন সিন্ধু, পাঞ্জাব, তক্ষশীলা ও আফগানিস্তানে। যদু বংশোদ্ভূত মানুষজনের শরীরে ছিল হালকা নীল ছাপ। এখনো আফগানিস্তান ও পাকিস্তানের সোয়াট প্রদেশের ইসলামধর্মাবলম্বী মানুষদের শরীরে  সেইরকম নীল ছাপ দেখা যায়, যা দেখে তাঁদের যদু বংশোদ্ভূত বলে চিহ্নিত করেন ইউরোপীয় ঐতিহাসিকরা। গ্রীক ঐতিহাসিকরা পুরুকে পাঞ্জাব প্রদেশের রাজা বলে উল্লেখ করেছেন এবং সেই সঙ্গে আরও জানিয়েছেন, রাজা পুরু ছিলেন ভারতের বৈদিক জাতির লোক। ভারতের গুপ্তযুগে লেখা বিশাখ দত্তের সংস্কৃত নাটকে রাজা পর্বতক নামে এক ম্লেচ্ছ বা গ্রিক রাজার উল্লেখ দেখা যায়। পরবর্তীকালে খ্রিস্টিয় দ্বাদশ শতাব্দীতে লেখা জৈন কাব‍্যগ্রন্থ "পরিশিষ্ট পর্ব" অনুসারে, এই ম্লেচ্ছ রাজা পর্বতক ছিলেন হিম্বকূট অঞ্চলের শাসক।

অনেকে "মুদ্রারাক্ষস" ও জৈন গ্রন্থ "পরিশিষ্টপর্ব"তে  উল্লিখিত রাজা পর্বতককেই আলেকজাণ্ডারের সমসাময়িক "পুরু" বলে থাকেন। কিন্তু "মুদ্রারাক্ষস" ও "পরিশিষ্ট পর্ব" বর্ণিত রাজা পর্বতকের সঙ্গে গ্রীক ঐতিহাসিকদের দেওয়া পুরুর তথ্য মেলে না। কারণ, "মুদ্রারাক্ষস" অনুসারে, চাণক্য বিষকন‍্যাদের দিয়ে রাজা পর্বতককে গুপ্তহত্যা করিয়েছিলেন। অন্যদিকে, গ্রীক ঐতিহাসিকদের তথ্যে দেখা যাচ্ছে, আলেকজাণ্ডারের মৃত্যুর পর তাঁর এক সেনাপতি ইউডিমাস গুপ্তঘাতকের দ্বারা হত্যা করিয়েছিলেন পুরুকে। কাজেই এক্ষেত্রে তথ্যের গরমিল রয়েছে। তাহলে এবার পুরুর রাজ‍্যপাটের দিকে তাকানো যাক। আমরা জানি, আলেকজাণ্ডার পুরুর রাজ‍্য ফিরিয়ে দিয়ে তাঁর সঙ্গে বন্ধুত্ব করেছিলেন। পুরুর রাজত্ব যেহেতু ছিল পাঞ্জাবে, তাই আলেকজাণ্ডার পুরুকে সেই পাঞ্জাবেরই সামন্তরাজা নিযুক্ত করেন। এরপর পুরু যেখানেই যেতেন, তাঁর সৈন্যরা গ্রিক আনুগত্যের প্রতীক হিসেবে আগে আগে গ্রীক দেবতা জিউস ও হেরাক্লিসের ছবি আঁকা ধ্বজা বয়ে নিয়ে যেতো। কিন্তু  গ্রীক দূত মেগাস্থিনিসের  দেওয়া তথ্য অনুসারে, পুরুর সৈন্যরা ছবি আঁকা যে রাজকীয় ধ্বজা বয়ে নিয়ে যেতো, সেটির সঙ্গে ভারতের শূরসেন গোষ্ঠীর বাসুদেব শ্রীকৃষ্ণের ছবির মিল বেশি। তাই বলা যায়, পুরু ছিলেন মহাভারতের যদু বংশোদ্ভূত পরবর্তীকালের শূরসেন গোষ্ঠীর লোক। খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকের গোড়ার দিকে উত্তর ভারতে কয়েকটি শক্তিশালী রাজ‍্য গড়ে উঠেছিল। বৌদ্ধগ্রন্থ "অঙ্গুত্তর নিকায়" ও জৈনগ্রন্থ "ভগবতী সূত্র"-তে  এই রাজ‍্যগুলিকে "মহাজনপদ" বলে উল্লেখ করা হয়েছে। দুটি গ্রন্থেই আলাদা আলাদাভাবে ষোড়শ মহাজনপদ অর্থাৎ ষোলটি বড়ো রাষ্ট্রের উল্লেখ আছে। দুটি তালিকা এক নয়। এর মধ্যে বৌদ্ধগ্রন্থ "অঙ্গুত্তর নিকায়"-তে মহাজনপদের তালিকায় শূরসেনের নাম আছে। মথুরা ও তার পাশ্ববর্তী অঞ্চল নিয়ে গড়ে উঠেছিল এই শূরসেন রাজ‍্য। রাজ‍্যের রাজধানী ছিল যমুনা নদীর তীরে মধুরা বা মথুরা। মথুরার রাজারা ছিলেন যদু বা যাদব বংশোদ্ভূত। এই যদু বা যাদবরা আবার বীতিহোত্র, সাত্বতসহ কয়েকটি শাখায় বিভক্ত ছিলেন। সাত্বত শাখা আবার বিভক্ত ছিল চারটি শাখায়---দৈবাবৃধ, অন্ধক, মহাভোজ ও বৃষ্ণি। পুরাণ অনুসারে, ভারতের শৈশুনাগ বংশের আমলে শূরসেন ও বৃতিহোত্র রাজারা এ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে রাজত্ব করতেন। এভাবেই বহু যোদ্ধা জাতি এবং পুরুর মতো এদেশের বহু বীর যোদ্ধারা ইতিহাসের পাতায় বিক্ষিপ্তভাবে রয়েছেন। সব তথ্য জুড়লে ভারতীয় বীরদের একটি বীরত্বপূর্ণ ইতিহাস অচিরেই রচিত হতে পারে। 

তিন

কবিতাটির পটভূমি ঐতিহাসিক, এবং এর পটভূমি খ্রিস্টীয় যুগের আগে তৃতীয় শতাব্দীর। ৩২৭ খ্রিস্টপূর্বাব্দে ফিলিপের পুত্র আলেকজান্ডার নামে প্রাচীন মেসিডোনিয়ার এক যুবক রাজা বিশ্ব জয় করতে চেয়েছিলেন এবং এই অভিপ্রায়ে তিনি একটি বিশাল প্রশিক্ষিত সৈন্যদল নিয়ে আক্রমণ ও দখল করতে-করতে এগিয়ে ছিলেন। প্রথমে তিনি পারসিয়া (বর্তমান ইরাক, সিরিয়া, ইরান, আফগানিস্তান ইত্যাদি ) সহ প্রতিবেশী দেশ জয় করেন এবং তারপর ভারতে আসেন। তাঁর সৈন্যরা সু-প্রশিক্ষিত এবং সংখ্যায় বিপুল হওয়ায় ভারতের কোনো রাজাই তাঁকে প্রতিরোধ করার সাহস পাননি। বহু ভারতীয় রাজা বিনা যুদ্ধে তাঁর কাছে আত্মসমর্পণ করেন। কিন্তু ইন্দিনের উত্তর-পশ্চিমে একটি ছোট রাজ্য ছিল, যার রাজা ছিলেন পুরুষোত্তম, গ্রিকরা যাঁর নাম দিয়েছেন পোরাস। একের পর এক ভারতের ছোট ছোট রাজ্যগুলো জয় করে আলেকজান্ডার যখন পোরাস রাজ্যের সীমান্তে এসে পৌঁছালেন, তখন পোরাস তাঁর বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে বীরের মতো যুদ্ধ করতে লাগলেন।  পোরাসের সৈন্যের সংখ্যা এতই কম ছিল যে আলেকজান্ডারের মতো বিশাল সেনাবাহিনীর মুখোমুখি হওয়া অত্যন্ত কঠিন ছিল। তবুও পোরাস গর্বিতভাবে যুদ্ধ করেছিলেন এবং শেষ পর্যন্ত আলেকজান্ডারের সৈন্যদের কাছে পরাজিত হন। আলেকজান্ডারের সৈন্যরা পোরাসকে ধরে আলেকজান্ডারের সামনে পেশ করে। অতঃপর বন্দী রাজা পুরুর কী ঘটেছিল তা King Porus: A legend of Old’  কবিতায় বর্ণনা করেছেন মধুসূদন । কবিতাটি নাটকীয়। এটি ছয়টি স্তবকে বর্ণিত । গ্রিক ইতিহাসে পুরুর বীরত্বের তথ্য পেয়ে উল্লসিত হয়েছিলেন মাইকেল মধুসূদন দত্ত । বস্তুত, ব্রিটিশ শাসনকালে, সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে, এটিই একজন ভারতীয়ের লেখা প্রথম কবিতা । কবি রাজা পুরুকে বীরত্ব আভায় বর্ণনা করেছেন, এমন একজন দেশপ্রেমিক হিসাবে যিনি 'স্বাধীনতার জন্য রক্তপাত করেছেন' ; ভারতের উদ্ধত পুত্র হিসাবে। কবিতাটি রাজা পুরুকে ভারতীয় অতীতের একজন নায়ক হিসেবে মহিমান্বিত করে এবং সকলকে দেশপ্রেমের ঊর্ধ্বে এবং ভারতের গৌরব সমুন্নত রাখার জন্য অনুরোধ করে।

রাজা পুরু কেন হেরে গিয়েছিলেন সেই বিষয়ে ফারসিতে কিংবদন্তিও গড়ে উঠেছিল । অর্থাৎ ফারসি ইতিহাসকারদের দৃষ্টিতেও রাজা পুরু একজন মহান বীর ছিলেন । বহুভাষী মাইকেল মধুসূদন দত্ত হয়তো সেখান থেকেও রাজা পুরুর বীরত্বের লোকগাথা পেয়ে থাকবেন ।  যুদ্ধ জয়ের কিংবদন্তি অনুযায়ী  ভারতীয় রাজা পুরুর বিরুদ্ধে যুদ্ধে আলেকজান্ডার  একটি অসাধারণ "ধাতুতে মোড়া সেনাবাহিনী" গড়েছিলেন, যা  দশম এবং চতুর্দশ শতাব্দীর মধ্যে লেখা অন্তত তিনটি ফারসি বিবরণে পাওয়া যায়: "রাজাদের বই" ( শাহ-নামেহ), ফেরদৌসি রচিত "দারাবের বই" (দারাব-নামেহ),  এবং আবদ আল-কাফি ইবনে আবু আল-বারাকাত দ্বারা অনুলিপি করা  "আলেকজান্ডার-বই" (এসকান্দার-নামেহ)তে । এটা যুক্তিযুক্ত যে পারস্য লেখকরা উত্তরাধিকারসূত্রে প্রাপ্ত উপকরণগুলি নিষ্ক্রিয়ভাবে গ্রহণ করেননি; বিপরীতে, তারা যুদ্ধের ময়দানে একটি জ্বলন্ত এবং কল্পনাপ্রসূত ধাতুর সেনাবাহিনী নিয়ে আলেকজান্ডারের  ভারতীয় রাজা পোরাসের বিরুদ্ধে  যুদ্ধের দৃশ্যকে একতরফা হিসেবে তুলে ধরতে চেয়েছে ।  

আলেকজান্ডার ৩৫৬ খ্রিস্টপূর্বাব্দে মেসিডোনিয়ায় জন্মগ্রহণ করেন এবং ৩২ বছর বয়সে মারা যান, সেই সময়ে তিনি গ্রিস থেকে ভারত পর্যন্ত বিস্তৃত একটি বিশাল সাম্রাজ্য গড়ে তুলেছিলেন। মহান নেতা হিসাবে তাঁর সম্পর্কে কিংবদন্তিগুলি কেবল তাঁর মৃত্যুর পরেই প্রচারিত হতে শুরু করে, এবং সেসব কল্পকাহিনী থেকে সত্য বের করা কঠিন । এমনকি কিংবদন্তি ও গল্পেও আলেকজান্ডারের নাম এক নেই। কোনো-কোনো সংস্কৃতিতে, তাঁকে ইস্কান্দার বা সিকান্দার বলা হয়, আর তা থেকেই ইংরেজি "আলেকজান্ডার" নামটা গড়ে ওঠে। তাঁর চেহারার বর্ণনাতেও  রয়েছে নানা অমিল। খ্রিস্টপূর্ব প্রথম বা দ্বিতীয় শতাব্দীর একটি আবক্ষ মূর্তিতে আলেকজান্ডারকে একজন সুন্দর যুবক হিসাবে দেখানো হয়েছে। বিপরীতে, জোহান হার্টলিবের দ্য আলেকজান্ডার বুক, ১৪৪৪ বইয়ের একটি ছবিতে  আলেকজান্ডারকে দেখানো হয়েছে  নীচের চোয়াল থেকে দুটি বিশিষ্ট স্বদাঁত উঁচু হয়ে আছে । আলেকজাণ্ডারের অমন কিংবদন্তির প্রেক্ষিতে রাজা পুরুর ঘটনাবলী গ্রিক নথিতে পাবার পর মাইকেল উৎসাহিত হন তাঁর শৌর্য নিয়ে কবিতাটি লিখতে ।

King Porus : A Legend of Old’ কবিতার প্রথম স্তবকে মধুসূদন তাঁর মানসিক ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন কারণ আলেকজান্ডারের হাতে ভারত তার স্বাধীনতা হারায়। তিনি চিত্ররূপময়  ভাষায় লিখেছেন যে আলেকজান্ডার যখন পুরুর রাজ্যে প্রবেশ করছিলেন, তখন মধ্যরাত ছিল এবং তারপরে হঠাৎ বিপদসংকেতের ঘণ্টা বেজে উঠল।  কবি বলেছেন, ঘণ্টাটা যেন পোরাস রাজ্যের মৃত্যুর ঝাপটা। আকাশের মেঘগুলোও গর্জন সংকেত দেয়া শুরু করল  এবং তাও বজ্রকণ্ঠে । ঝিরঝিরে বৃষ্টি পড়তে লাগল। বিয়াস নদীর ঢেউ  সামনে এগিয়ে   মাথার ওপর দিয়ে বয়ে যেতে লাগল। বিদ্যুৎ চমকালি যেন শ্বেতাঙ্গিনী  নারীর দৃষ্টি । বাতাসও হাহাকার করতে লাগলো। এমন পরিবেশে আলেকজান্ডার রাজা পোরাসের শহরে  চুপিচুপি ঢুকে পড়ল বাঘের মতো। কিন্তু রাজা পুরু অলস বসে ছিলেন না। তিনিও যুদ্ধের সংকেতধ্বনি বাজিয়ে তাঁর সৈন্যদের নিয়ে বেরিয়ে পড়লেন  শত্রুদের প্রতিহত করার জন্য।  আলেকজান্ডারের সৈন্যরা যে গোপনে শহরে প্রবেশ করেছিল, রাতের পরিবেশে, যা ভারতীয় যুদ্ধের নিয়মানুযায়ী নয়, তার কাব্যিক বিবরণ দিয়েছেন।

দ্বিতীয় স্তবকে   কীভাবে এবং কখন রাজা পুরু আলেকজান্ডারের সৈন্যদের মুখোমুখি হয়েছিলেন এবং কীভাবে তিনি  শত্রুদের বিরুদ্ধে লড়াই করেছিলেন তার পটভূমি দিয়েছেন। ভোর হলো । সূর্যের তাপ তীব্র হয়ে উঠল।   রাজা পুরুর সৈন্যরা  পতাকা উড়িয়ে  শত্রুদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। যদিও পুরুর সৈন্য সংখ্যায় কম ছিল তবুও তারা স্বাধীনতার জন্য লড়াই চালিয়ে গেল আর ।  স্বাধীনতা বা মৃত্যুর জন্য  অনেক সৈন্য রক্তাক্ত মাটিতে পড়ে গেল আর প্রাণ দিল দেশের জন্য । 

তৃতীয় স্তবকে কবি বর্ণনা করেছেন রাজা পোরাস তাঁর সৈন্যদের পতনের পর যুদ্ধক্ষেত্রে কী করেছিলেন। কবি বলেছেন যে রাজা পোরাস তাঁর মাথায় রাজকীয় উষ্ণীষ পরা হিমালয়ের চূড়ার মতো দৃঢ়ভাবে শত্রুদের মধ্যে নির্ভয়ে দাঁড়িয়েছিলেন। তিনি তাঁর চারপাশে ঘিরে থাকা শত্রু বাহিনীর পরোয়া করেননি। তিনি সেখানে শত্রুদের মাঝে গর্বভরে দাঁড়িয়ে ছিলেন। তাঁর বীরসদৃশ সাহস দেখে আলেকজান্ডারের সৈন্যরা তাঁর কাছে যেতে সাহস পেল না।

চতুর্থ স্তবে কবি আলেকজান্ডারের সৈন্যরা রাজা পুরু প্রতি কেমন আচরণ করেছিল তা বর্ণনা করেছেন। শত্রুদের মধ্যে, রাজা পুরু সমুদ্রের মাঝে পাথরের মতো শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন। তিনি গুরুতর আহত এবং তাঁর শরীর থেকে গাঢ় রক্ত বের হচ্ছিল। তাঁকে দেখে আলেকজান্ডার তাঁর সৈন্যদের রাজা পুরুকে হত্যা করতে নিষেধ করলেন। তারপর তাঁকে শৃঙ্খলিত যুদ্ধবন্দী হিসেবে আলেকজান্ডারের কাছে নিয়ে যাওয়া হয়।

পঞ্চম স্তবকে মধুসূদন জানিয়েছেন  আলেকজান্ডারের কাছে নিয়ে যাওয়ার পর রাজা পুরুর সঙ্গে কী করা হয়েছিল। কবি লিখেছেন, যদিও তিনি তাঁর শত্রুর হাতে বন্দী ছিলেন, তবুও তাঁর দর্প ছিল বীরের মতো সাহসী। তিনি আলেকজান্ডারের কাছে মাথা নত করেননি। তিনি হিমালয়ের মহিমায় দাঁড়িয়েছিলেন। তখন আলেকজান্ডার তাঁকে জিজ্ঞেস করলেন, "আমি তোমার সাথে কেমন আচরণ করব?'

পোরাস উত্তর দিলেন, 'একজন রাজা হিসেবে এবং রাজকীয় গর্বে…

আলেকজান্ডার, তাঁর বীরত্বের প্রশংসা করে, তাঁকে মুক্তি দিলেনন এবং তাঁর মুকুট এবং রাজ্য ফিরিয়ে দিয়ে তাঁর সাথে বন্ধুত্ব করলেন।

ষষ্ঠ স্তবকে মাইকেল রাজা পুরুর বীরত্বের মূল্যায়ন করেছেন । রাজা পুরু ছিলেন ভারতের সত্যিকারের বীর সন্তান যিনি নিজের মাতৃভূমির জন্য সাহসিকতার সাথে যুদ্ধ করেছিলেন। কিন্তু যখন মাইকেল কবিতাটি লিখছেন তখন ভারতের স্বাধীনতার জন্য লড়াই করার কেউ নেই। মধুসূদন আরও বিলাপ করেন, ( তাঁর সময়ে ভারত ইংরেজদের অধীন ছিল) যে, ভারত তার স্বাধীনতা হারিয়েছে। ভারতের সমস্ত সোনা ও ধন-সম্পদ বিদেশীদের হাতে।

ফলাফল যাই হোক না কেন, ভারতে আলেকজান্ডারের সেনাবাহিনী সম্পর্কে সমস্ত গল্পই  যুদ্ধে বিশাল  হাতি-বাহিনীর মুখোমুখি হওয়া জড়িত। ৩২৩ খ্রিস্টপূর্বাব্দের একটি মুদ্রায় রাজা পুরুকে দৈত্যাকার হাতির ওপর বসে থাকার সময় আলেকজান্ডার, বুসেফালাস নামের ঘোড়ায় চেপে, একটি বর্শা দিয়ে রাজা পুরুকে পেছন থেকে আক্রমণ করছেন দেখানো হয়েছে। গল্পের বিভিন্ন সংস্করণে আলেকজান্ডার হাতির বাহিনীকে পরাস্ত করার বিভিন্ন উপায়ের গল্প তৈরি করেছে। ওপরে যে বইয়ের উল্লেখ করেছি, পনেরো শতকে লেখা শাহনামেহতে , একক লেখকের লেখা সবচেয়ে দীর্ঘতম কবিতা, রাজা পুরুর সঙ্গে যুদ্ধের যে বর্ণনা  দেয় তাতে  আলেকজান্ডার তাঁর কামারদের এক হাজার  তেল ভর্তি লোহার ঘোড়া তৈরি করার নির্দেশ দিয়েছিলেন, যেগুলো তিনি রাজা পুরুর অগ্রসরমান সৈন্যদের পুড়িয়ে মারার কাজে লাগিয়েছিলেন। আগুনের আতঙ্কে ভীত হয়ে হাতিরা তাদের আরোহীদের সাথে নিয়ে পালিয়ে যায়। এরকম নানা কিংবদন্তির সামনে মাইকেল মধুসূদন দত্ত জরুরি মনে করেছিলেন রাজা পুরুর উপস্হাপনা, কিংবদন্তি হিসাবে ।







Comments

Popular posts from this blog

কফিহাউসে চেঙ্গিজদা, ল্যাঙড়াদা, গুলপিসি...অ্যান্টি-হিস্ট্রির আড্ডা : মলয় রায়চৌধুরী লিখিত পৃথিবীর ইতিহাস

প্রদীপ চৌধুরী, ফরাসি কবি, বাঙালি কবি, হাংরি আন্দোলনের কবি : মলয় রায়চৌধুরী

Malay Roychoudhury interviewed by Anupam Mukhopadhyay