পৃথা রায় চৌধুরী : মলয় রায়চৌধুরীর কবিতা

 পৃথা রায় চৌধুরী : মলয় রায়চৌধুরীর কবিতা


        বিতর্ককে নস্যাৎ করে কজন হয়ে উঠেছেন নিজস্ব ঘরানার ব্র্যান্ড নেম? বিতর্ককে কবচকুন্ডল করেই আজও তিনি সোজা কথায় বলেন,

 “একাই লড়েছিলুম। 

কেউ বলেনি ‘হোক কলরব’ 

একাই নেমেছিলুম ব্যাংকশাল কোর্টের সিঁড়ি বেয়ে 

সেদিন একাই ঘুরেছিলুম কলকাতার পথে সকাল পর্যন্ত” 

        তাই তো তিনি হাজার কোটি মেকিদের থেকে এতটা ওপরে। একাই লড়েছেন আর জিতে গেছেন, আমাদের অনেকেরই ক্ষমতা নেই এভাবে রুখে দাঁড়াবার। নিজের প্রতি, নিজের কবিতার প্রতি সৎ থাকতে তিনিই পেরেছিলেন, পেরেছিলেন নির্দ্বিধায় সাহিত্য অ্যাকাডেমি সহ বহু পুরস্কার প্রত্যাখ্যান করতে।   

“আমি লক্ষ্মীকান্ত, মহারাজা প্রতাপাদিত্যের অমাত্য, সাবর্ণ গোত্রের যোদ্ধা
আজ পর্যন্ত কেউ তরোয়াল চালানোয় আমাকে হারাতে পারেনি
কতো মুণ্ড এক কোপে ধরাশায়ী করেছি তার গোনাগুন্তি নেই
আমার বংশধরেরা তাই করবে একদিন, প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে--
ঘোড়ার পিঠে বসে চালাবে তরোবারি, যারাই সামনে আসবে মূর্খ মুণ্ড
গলা থেকে কেটে ফেলবে ধুলায়, সেসব মুণ্ড বেঁচে থাকবে, কথা বলবে
দরবারে গিয়ে যে-যার লেজটি নাড়িয়ে রাজা বা রানির সেবাদাস হয়ে
সারটা জীবনভর ঘেউ-ঘেউ করে ক্রমে-ক্রমে জীবাশ্মের রূপ নেবে”

          লাইন কটা তুলে নিয়েছি ‘আমি লক্ষ্মীকান্ত, মহারাজা প্রতাপাদিত্যের অমাত্য’ কবিতা থেকে, শিহরিত হয়েছি বারবার এই কবিতা পড়ে, মনে-মনে বলেছি, “যথার্থ ! যথার্থ বলেছো মলয় রায়চৌধুরী, নিজের বংশগৌরবে গৌরবান্বিত তুমি। সেই আপোষহীন উচ্চশির লক্ষ্মীকান্তের বংশধর তুমি… সাবর্ণ রায় চৌধুরী বংশের ৩৪তম উত্তরপুরুষ, প্রতি পদে রয়েছো আপোষহীন, নির্ভীক” ১৬ই জুলাই, ২০১৭ এই কবিতা আমি পড়ি ফেসবুকেই ওঁর পোস্টে। কবিতায় সাবর্ণ রায়চৌধুরীদের ইতিহাস জীবন্ত হয়ে উঠছে প্রতি শব্দে, ছত্রে আর আমাকে বলেছে, "চিনে নে!" এই কবিতায় কিন্তু আমরা কবির ভেতর দিয়েই মানুষটাকেও দেখতে পাচ্ছি, চিরকালের প্রাতিষ্ঠানিকতায় মাখানো অন্যায়ের বিরুদ্ধে মুখর হয়ে ওঠা, একা লড়াকু মানুষটা, যার হাতের কলম বরাবর তরোয়ালের মতোই ঝলসে উঠেছে, ফালাফালা করে দিয়েছে যা কিছু বস্তাপচা। 

         না, এখানে মানুষ মলয় রায়চৌধুরীকে নিয়ে মোটেই আলোচনা করতে বসিনি, সেই স্পর্ধা আমার নেই, মনে-মনে কেবল এই ভেবে গর্বিত হই, এই মহান কবি, সম্পর্কে আমার জ্যাঠাশ্বশুর হন, আর এঁর লেখা পড়ে পড়ে শিউরে উঠি কেবল। নিজে যেহেতু কবিতা লিখি, তাই বিশেষ করে পড়ে ফেলি ওঁর কবিতা, বুঝি, কতটা আপাতসরল ভাষ্যের ভেতর দিয়ে উনি নিংড়ে বার করে আনেন মানুষের ভেতরের সমস্ত দ্বিধা, দ্বন্দ্ব, জটিল ভাবনা বা চলতে থাকা নানান সংঘাত। বসেছি ওনার কবিতা সম্পর্কে সামান্য দুকলম লিখতে,  কিন্তু প্রতি পদক্ষেপে যেন মনে হচ্ছে কবি মলয় রায়চৌধুরীর কবিতার সামনে আমরা সকলে এতোটাই হীন, যে তাঁর সব কবিতা নিয়ে আমরা আলোচনা তো করতে পারি, কিন্তু তা হয়ে দাঁড়ায় সুউচ্চ পর্বতের নীচে দাঁড়িয়ে ঘাড় উঁচু করে পর্বতশৃঙ্গের ভয়াল সৌন্দর্যকে ব্যাখ্যা করার সমতুল্য। 

        কবি তাঁর বহু বিতর্কিত ‘প্রচণ্ড বৈদ্যুতিক ছুতার’ কবিতা লেখার ‘অপরাধে’ অশ্লীলতার দায়ে কারাবাস করেন, এ কথা সাহিত্য জগতের প্রতিটি মানুষ জানেন, এই কবিতা নিয়ে আজও প্রতিনিয়ত সাহিত্য সংক্রান্ত গবেষণা করা হয়, আন্তর্জাতিক স্তরেও। যা এককালে কবিকে অপমানজনক পরিস্থিতিতে দাঁড় করিয়েছিল, তা এখন একপ্রকার কিংবদন্তী। বড়ো বেশি শরীরধর্মী, যৌনতার আঁশটে ভাষায় লেখা এই কবিতা পড়ে আপাতভাবে শ্লীল সমাজ চোখে-মনে কাপড় বেঁধে গান্ধারী হয়ে যান আজও, অথচ কবিতাটির ভেতর যে চরম যন্ত্রণার প্রকাশ, তা বুঝে নিতে পারলে, এই কবিতা হয়ে ওঠে অমৃত, আপাত অশ্লীল ভাষ্যের গরল মন্থন করে পাঠক পেয়ে যান অমৃত। যন্ত্রণা অপরিসীম, কবিতাটির নিচের কটি লাইনে…  

“প্রতিটি শিরা অশ্রুস্রোত বয়ে নিয়ে যাচ্ছে হৃদয়াভিগর্ভে

শাশ্বত অসুস্থতায় পচে যাচ্ছে মগজের সংক্রামক স্ফুলিঙ্গ

মা, তুমি আমায় কঙ্কালরূপে ভূমিষ্ঠ করলে না কেন ?

তাহলে আমি দুকোটি আলোকবর্ষ ঈশ্বরের পোঁদে চুমু খেতুম

কিন্তু কিছুই ভালো লাগে না আমার কিছুই ভালো লাগছে না”

আবার কতটা তীব্র ব্যথা অনুভব হলে কবি এমন অস্থির ভাবে লিখতে পারেন,

“আমি আমার নিজের মৃত্যু দেখে যেতে চাই

মলয় রায়চৌধুরীর প্রয়োজন পৃথিবীর ছিল না

তোমার তীব্র রূপালি য়ুটেরাসে ঘুমোতে দাও কিছুকাল শুভা

শান্তি দাও, শুভা শান্তি দাও”… 

পাঠক ঢুকে যান কবিতার ছত্রে ছত্রে রন্ধ্রে রন্ধ্রে, কি মারাত্মক আঘাত করেছেন কবি প্রতিষ্ঠানকে, ভেঙ্গে গুঁড়িয়ে দিয়েছেন চাঁদ-তারা-নদী-তুমি আমি-ফল্গুধারা কাব্যভাষাকে। আর এই প্রচণ্ড বেগে হুড়মুড়িয়ে ঢুকে আসা কর্কশ সপাট কবিতাকে হজম করে নিতে তখনও বহু মানুষ পারেননি, আজও পারেননা, বলাই বাহুল্য। 

          ঝলসে দেওয়া কবিতার কণ্ঠ তাঁর হয়তো ছোটবেলার অস্বাচ্ছন্দের জন্য বেড়ে ওঠা ক্ষোভ বিদ্রোহ ভরা বুকের একেবারে ভেতরের অনুভূতির জন্য। আবার এই কবিই ‘আমার জন্মদিন নেই’ কবিতায় লিখে ফেলেন, 

“ঠাকুমা কবে জেঠা আর বাবাকে প্রসব করেছিলেন 

তার তিথি ঠাকুমা জানেন

প্রসবদিন পালনের তো কোনো রেওয়াজ নেই

তাই মা আমাকে কোন তিথিতে প্রসব করেছিলেন জানি

মায়ের কষ্টের গল্প জানি

হাসপাতালে ভর্তির গল্প জানি

কিন্তু আমার জন্মদিন জানি না”... 

সাধারণ পাঠক আমি, কবির অন্তরাত্মা ছুঁয়ে বলি, এতটাও নরম ভাব এই রুক্ষ জমিতে থাকে ! কেবল বারুদ আর লাভা নিয়ে যে কবির বিচরণ, তার ভেতরের প্রকৃত মানুষ হৃদয় কেই বা সহজে বুঝেছে!   

পাঠক যেন ক্রমাগত তড়িদাহত হতে থাকেন তাঁর বিজলীসম কবিতায়। কবির তাৎক্ষনিক মনের ভাব, চঞ্চলতা তিনি প্রকাশ করেন ভিন্ন ভিন্ন থিমের কবিতায় আবার এই তিনিই ‘নখ কাটা ও প্রেম’ কবিতায় হঠাৎ লিখে ফেলেন, বলা ভালো প্রশ্ন করে বসেন,

“রবীন্দ্রনাথ, দেড়শ বছর পর একটা প্রশ্ন আপনাকে :

কে আপনার নখ কেটে দিত যখন বিদেশ-বিভুঁয়ে থাকতেন--

সেই বিদেশিনী ? নাকি চৌখশ সুন্দরী ভক্তিমতীরা ?” 

ভাবা যায়? নেকুপুষু প্রেমের কবিতা লিখে তুলতুলে ভাব ভাগ্যিস তিনি তাঁর কবিতায় আনেননি। বরাবর প্রথাভাঙ্গার নিদর্শন হয়েছে তাঁর প্রায় প্রতিটা কবিতা। কি অসামান্য প্রেম দেখিয়েছেন তিনি তাঁর ‘বুড়ি’ কবিতায়। গভীর প্রেম এই কবিতায়। 

“এও আমাকে বলে এবার ঘুমোও
আর রাত জাগা স্বাস্হ্যের পক্ষে
খারাপ, এই বুড়ি যে আমার বউ
বিছানায় শুয়ে বলে, কাউকে নয়
কাউকে দিও না খবর, কারুক্কে নয়--
এ-কথাটা আমারই, কাউকে নয়
কারুক্কে বোলো না মরে গেছি ।“ 

        মন খারাপ করে, গলায় ব্যথা ব্যথা কষ্ট হয়, অথচ কি চরম প্রেম ! গভীর অনুভূতি, পরম ভরসা ফুটে ওঠে, প্রতি ছত্রে। বিষাদেরও যে এমন মিঠে সোয়াদ, তা বোধহয় এই কবিতা পড়লে তবেই বোঝা যায়। এ যেমন একাধারে প্রেমের কবিতা, তারই সাথে এ চিরশাশ্বত মৃত্যুচেতনার কবিতা। আমরা ভাবতে বাধ্য হই, এই এত আঁকড়ে থাকা, এত ভালোবাসা, এত জীবন-প্রাচুর্যের মাঝেও মৃত্যুচেতনা কতটা ঘিরে রাখে আমাদের অবচেতন। 

মলয় রায়চৌধুরীর দাদা  অর্থাৎ স্বর্গত সমীর রায়চৌধুরীর মৃত্যুর পরের দিন লেখা কবির যে কবিতা, ‘সেন্স অফ লস' এর স্তবগান, তা যেন পাঠককে কবির জায়গায় বসিয়ে দেয়,   

“কাল বাইশে জুন, ২০১৬, সকাল আটটা পনেরোয় দাদা মারা গেছেন 
দাদা সমীর রায়চৌধুরী”…………
“কাল, বাইশে জুন ২০১৬, সকাল আটটা পনেরোয় দাদা মারা গেছেন 
দাদা মানে মিনু” 
কবিতার প্রথম লাইন কবিতার মাঝামাঝি আবার ফিরে এসেছে। প্রথম লাইনের পরে এসেছে প্রয়াত দাদার পোশাকি নাম, আর মাঝখানে এসেছে দাদার ডাকনাম। এইভাবে একই লাইনের ব্যবহারে, অথচ দুবার দুরকম নামের ব্যবহারে আমরা আসল ,সেন্স অফ লস, বুঝতে পারি। বুঝতে পারি, কতটা জড়িয়ে রাখেন কবি তাঁর সদ্যপ্রয়াত দাদার স্মৃতি, কতটা হারাবার বোধ পীড়াদায়ক হয়ে উঠেছে কবির কাছে। 

“চাঁদোয়ায় আগুন লাগিয়ে তার নীচে শুয়ে আকাশের উড়ন্ত নীল দেখছি এখন

দুঃখ-কষ্টের শুনানী মুলতুবি রেখে আমি আমার সমস্ত সন্দেহকে জেরা করে নিচ্ছি

হাতের রেখার ওপর দিয়ে গ্রামোফোনের পিন চালিয়ে জেনে নিচ্ছি আমার ভবিষ্যত” 

হাংরি জেনারেশানের পুরোধা কবির নিজের বিশেষ প্রিয় কবিতা ‘জখম’ ( ১৯৬৫ ) থেকে নেওয়া এই কটা লাইনে দ্রিম দ্রিম করে শুরুয়াতি সুর শোনা যায় এক অনন্ত ক্ষুব্ধ আহত অস্থির কণ্ঠের কবিতারজখম ভর্তি কবি হৃদয় থেকেই কাব্যধারায় বেরিয়ে আসে এই অনন্ত শোণিতাভ দীর্ঘ কবিতা, কবিতায় বারবার প্রয়োগ হয়েছে তাঁর নিরীক্ষার বিশেষ বানানরীতি... 

“বুকের বাঁদিকের আর্মেচার পুড়ে গেছে বহুকাল

এখন চোখ জ্বালা কোর্ছে  মলয়ে কঙ্কাল জ্বালানো ধোঁয়ায়

আশপাশ দিয়ে ঘণ্টায় ৯৯ কিলোমিটার দরে উড়ে যাচ্ছে বদমতলব ঝড়

কব্জিতে ঘড়ির কাঁটা রেখে চলে যাচ্ছে সারসার সমদ্বিঠ্যাঙ মানুষের লাভলোক্সানময় দল” 

আবার কি অনায়াস উচ্চারণে কবি তাঁর লেখা অবিস্মরণীয় ছত্রগুলোর ইংরেজি অনুবাদ করেছেন সময়ে সময়ে... 

 “armature on the left turned slag long ago
now eyeflesh twitching in the smoke of malay's burning 
                                  skeleton
dismantled tempests sweep by at 99mph
uniform queues of wristwatched zombies tattle” 

        রাজনৈতিক বা তৎকালীন সাম্প্রদায়িক যতো অসহিষ্ণুতা এবং অস্থিরতা যেন ফুটে ওঠে এই জখম ভর্তি কবিতায়। যা তখন সত্যি ছিল, তা আজও চরম প্রাসঙ্গিক। তাই এটুকু বলাই যায়, কবি মলয় রায়চৌধুরী সময়ের থেকে এগিয়ে গিয়ে নিজের অন্তঃস্থল খুঁড়ে, সচেতনভাবে মানুষের কথা বলে যান তাঁর কবিতায়। তিনি কাব্যকথায় মানুষের অবচেতনের সমস্ত কথা এবং সচেতন যাপনের সার কথা সমস্তই বলে যান অকপট ভাবে।  


        এই কবি তাঁর কবিতা সম্পর্কে বলেছেন, তাঁর “কবিতা পায়”; ঠিক মানুষের বাকি সব পাওয়ার মতোই কবিতাও পায়। কবিতার সাথে কতটা ওতপ্রোত ভাবে সম্পৃক্ত হলে, একাত্মতা থাকলে এবং কবিতার প্রতি একনিষ্ঠ থাকলে, কেউ এই কথা বলতে পারেন, তা সাধারণের পক্ষে বোঝা হয়তো দুষ্কর। গতানুগতিকতার মন্থর চালে চলে আসতে থাকা বাংলা কবিতার রক্ষণশীল বেড়াকে তিনি তাঁর কথ্যভাষার বম্বশেলে গুঁড়িয়ে দিতেই “গেল গেল” রব যেমন উঠেছিলো, সেই রবের কারণগুলোকে কিন্তু লুকিয়ে-চুরিয়ে হলেও পড়ে ফেলত গোঁড়া বাঙালি। ভাষা সাহিত্যের তথাকথিত এলিট ক্লাস সেসব না পড়ে ফেললে, নিজেদের টলোমলো আসন সামলে রাখার জিগিরে কীভাবে  গেল গেল রবের হিড়িক তুলতেন? 

         ভয় পেয়েছিলেন কি এই আগুন কলমকে তাঁরা?  

সম্প্রতি পড়লাম তাঁর কবিতা ‘রাষ্ট্রের বহি-খাতা’; পড়েই নিজেকে এবং অসংখ্য মানুষের অত্যন্ত সমস্যাসংকুল জীবনের এক মোক্ষম প্রশ্নের সম্মুখীন দাঁড়াতে হল, আমরা কি হরেদরে সকলেই এই সাংবিধানিক গণতন্ত্রের চাকার চোখে নিজের দেশে অভিবাসী মাত্র? আমাদের নাগরিকত্ব, আমাদের স্বদেশের শেকড় কি কেবল সরকারের ঠাপ্পা মারা, সরকারী শিলমোহর আঁকা কয়েক টুকরো কাগজের মুখাপেক্ষি?

 দলিল থাকলেও ফেলে দিতুম, তবে দলিলের জেরক্স 

দেখেছিলুম, ষোড়শ শতকের কারোর ফার্সিতে লেখা নাম 

এখন রাখি কেমন করে প্রমাণ করবে যে ষোড়শ শতকের

সেই পূর্বপুরুষে ওর রক্তের শেকড় রয়েছে?  

বাড়ির ট্যাক্স বাবা দিতেন, তার আগে দাদু

দাদুর বাবা, তার আগে নবাবের খাজনা--

বিলডার ঘুষের ঠেলা মেরে মালিকানার

সমস্যা সমাধান করে ফেলেছিল 

এখন রাখি কেমন করে প্রমাণ করবে যে

 ভারতের সত্যিকারের নাগরিক?”
রাখি কবির বোন। বোনের ন্যায্য চিন্তার মধ্যে দিয়ে আসলে তিনি প্রতিফলিত করেছেন এই দেশের নাগরিকদের চিন্তাক্লিষ্ট চেহারা। 

কবি শ্লেষাত্মক ভঙ্গীতে লিখে ফেলেছেন ‘রাস্তার কবিতা’তার ছত্রে ছত্রে লেখা আছে, বলা ভালো বয়ান করা আছে আমাদের তুচ্ছতাআপাতদৃষ্টিতে এখানে যা শুধু কবির দুর্ভাগ্যজনক পরিস্থিতির লঘু বর্ণনা, তা আসলে গভীরে ঢুকে নাড়া দেয় আমাদের, বুঝিয়ে দেয়, এইটুকুই আমাদের মূল্যচোখ বাঁধা অন্ধ আমাদের ঝাঁকুনি দেয় তাঁর সোজা সরল কথ্য ভাষায় লেখা গভীর অর্থবহ সমস্ত কবিতা। 

“কাগজ কুড়োনোর কাজ আরম্ভ করে প্রথম ছেঁড়া নোংরা কাগজের টুকরো 

তুলেই কাজটা ছেড়ে দিতে হলো

কাগজটা দিয়ে দিলুম কুড়ানিকে

যে আঁস্তাকুড় থেকে কাগজ বাছাই করছিল

আসলে যে কাগজটা তুলেছিলুম সেটায় দেখলুম

আমারই একটা কবিতা, ‘কালিমাটি’ পত্রিকায় বহুদিন আগে 

প্রকাশিত হয়েছিল” 

মলয় রায়চৌধুরীর কবিতা নিয়ে লিখতে বসলে সামান্য কটা পাতায় তা সীমিত রাখা বড়ই কষ্টকর, অথচ সুবিশাল কিছু লেখা এখানে সম্ভব নয়, কারণ তা যে দুতিন পাতার ভেতর লিখতে হবে, তা কবি আগেই বলেছেন তবুও সামান্য হয়তো বড়ো হয়ে গেল লেখাটাতাঁর কবিতার কথা বলতে গেলে অবশ্যম্ভাবী ভাবেই আসবে ‘অবন্তিকা’র কথাএক অনবদ্য প্রেমের কবিতা, ‘মাথা কেটে পাঠাচ্ছি, যত্ন করে রেখো’।
“মাথা কেটে পাঠাচ্ছি, যত্ন করে রেখো
মুখ দেখে ভালোবেসে বলেছিলে, "চলুন পালাই"
ভিতু বলে সাহস যোগাতে পারিনি সেই দিন, তাই
নিজের মাথা কেটে পাঠালুম, আজকে ভ্যালেনটাইনের দিন
ভালো করে গিফ্টপ্যাক করা আছে, “ভালোবাসি” লেখা কার্ডসহ

সব পাবে যা-যা চেয়েছিলে, ঘাম-লালা-অশ্রুজল, ফাটাফুটো ঠোঁট”… 

হেন প্রেমিক বা প্রেমিকা নেই, যার অন্তঃস্থল পর্যন্ত শিরশির করে উঠবে না এই কবিতা পাঠ করে। 

“কি-বোর্ডে পাকাচুল পড়ে, তুলো দিয়ে সরিয়ে দিই ; চশমার লেন্সে পাকাচুল পড়ে, মুছে সরিয়ে দিই। তবু লেখালিখি ছাড়তে ইচ্ছে করে না”... সম্প্রতি কবি এমনটাই বলেছেন। এক সাধারণ গুণমুগ্ধ পাঠিকার আসন থেকে চীৎকার করেছি, আরও, আরও লিখুন কবি, এত লিখুন যে আমাদের মগজের রক্তক্ষরণ যেন বন্ধ না হয়। রক্তের সরোবর বানান আমাদেরই হৃদয়ের ক্ষরণে, সেই সরোবরকে আয়না করে আমরা সকলে উঠে দাঁড়াই ঋজু ও দৃপ্ত কবিতার কাঁধে ভর করে। তাঁর নিজের ভাষায়, “কবিতা কেবল মঞ্চে বিড়বিড় করে পড়ার ব্যাপার নয়;  উন্মাদের মতো চীৎকার করে না পড়লে প্রতিষ্ঠান কষ্টযন্ত্রণার গোঙানি শুনতে পায় না।” শিখি তাঁর প্রতিটি উক্তি থেকেও। কবি মলয় রায়চৌধুরীর কাছে “কবিতার কোনও সংজ্ঞা নেই, নির্দেশিকা হয় না তাই যা ইচ্ছা, যেমন ভাবে ইচ্ছা লিখুন”... এই মানুষের কবিতা নিয়ে আলোচনা করা কি সহজ কথা? যিনি কবিতাকেই প্রেমিকা করে নিতে পারেন, তাঁর কবিতার কাছাকাছি গিয়ে তাকে স্পর্শ করাই নিজের মধ্যে এক সুবিশাল অর্জন।  

“আবলুশ অন্ধকারে তলপেটে লাথি খেয়ে ছিটকে পড়ি
পিছমোড়া করে বাঁধা হাতকড়া স্যাঁতসেঁতে ধুলোপড়া মেঝে
আচমকা কড়া আলো জ্বলে উঠে চোখ ধাঁধায়
তক্ষুণি নিভে গেলে মুখে বুট জুতো পড়ে দু-তিনবার” 

তাঁর ‘আলো’ নামক কবিতার প্রথম চার লাইন উদ্ধৃত করে এই লেখা শেষ করছি। এই কবিতার মধ্যে দিয়ে কবি পেরেছিলেন সামগ্রিকরূপে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসকে ফুটিয়ে তুলতে। রাষ্ট্রের শাসনের নামে যে সন্ত্রাস, যার চাবুকের নীচে আলোহীন বাঁচতে থাকা বোবা মানুষেরা প্রতিবাদী হলেই, তারা প্রথা ভাঙতে চেষ্টা করলেই কি কি ঘটে যায়, তা ধরে রেখেছে এই কবিতার প্রতিটি শব্দ। অথচ লড়াকু প্রতিবাদী কবি কণ্ঠ লিখে ফেলে এই কবিতার শেষ লাইন দুটি মূল উপাদান হিসেবে...

 “একসঙ্গে সব আলো আরেকবার নিভে গেলে
পরবর্তী আক্রমণ সহ্য করার জন্য নিজেকে তৈরি করে নিই।"

কলকাতার সাহিত্যজগত থেকে দূরে বসবাস করে কবি ভারতীয় সমাজের প্রতি তাঁর দায়বদ্ধতা থেকে সচেতনভাবে সৃষ্টিতে মেতে লিখে চলেছেন ষাটের দশক থেকে জ্যা মুক্ত তীরের মতো ক্ষিপ্র ধারালো কবিতা। তাঁর লেখা স্বাধীন ও স্বতন্ত্র।  

সত্যিই তিনি অসীম শক্তিশালী, আমার কাছে কবিতার ঈশ্বরসম বলেই, তাঁর কবিতার কাছে সহজ মনে না পৌঁছতে পারলে আজও শ্লীল অশ্লীল, অথবা নানান দোহাই পাড়ে যারা, তাদের উদ্দেশ্যে কবির ভাষায় বলি,”আমাকে ধিক্কার দেয়া যায় আমাকে উপেক্ষা করা যায় না” কারুর আনুকূল্য অথবা হাততালি, পুরস্কার ইত্যাদির পরোয়া না করে তিনি লিখে চলেছেন আজও তাঁর বাঁধনছাড়া বেপরোয়া নিজস্ব শৈলীতে। 


Comments

Popular posts from this blog

কফিহাউসে চেঙ্গিজদা, ল্যাঙড়াদা, গুলপিসি...অ্যান্টি-হিস্ট্রির আড্ডা : মলয় রায়চৌধুরী লিখিত পৃথিবীর ইতিহাস

প্রদীপ চৌধুরী, ফরাসি কবি, বাঙালি কবি, হাংরি আন্দোলনের কবি : মলয় রায়চৌধুরী

Malay Roychoudhury interviewed by Anupam Mukhopadhyay