উপন্যাস : ভ্যান গগের কান
মলয় রায়চৌধুরীর জাদুবাস্তব উপন্যাস : ভ্যান গগের কান
পিচ্চির রোজনামচার খাতায় এসিপি রিমা খান যা পেয়েছেন, খুঁটিয়ে পড়ছেন, নোট নিয়ে রাখছেন, যুবকটা কেমন করে কবে কোথায় হারিয়ে গেল, নাকি খুন হল, তা তাঁর আন্ডারে গোবরঘাট থানা ইনভেস্টিগেট করছে, এখনও নির্ভরযোগ্য ক্লু পায়নি অনুসন্ধানকারী অফিসার ভোম্বোল সোম, যাকে উনি ভোমসো বলে ডাকেন ।
রিমা খানের বয়স পঞ্চাশ পেরিয়ে গেছে, চুল তেমনই বয়কাট, তবে নুনমরিচের ছোঁয়া, কোনো গয়না পরেন না, কেবল ডান হাতে একটা স্টেনলেস স্টিলের অমৃতসরি নোয়া, অপরাধীদের থেকে কবুলতি আদায়ের জন্য । সিগারেট ফোঁকা ছাড়তে পারেননি, দিনে কুড়িটা । সিভিল ড্রেসে থাকলে জিনস আর টপ, শীতকালে রাতের বেলায় হুডি । পুরোনো বুলেট মোটর সাইকেলটা, যেটায় চেপে নোংরা পরি নামে পপুলার কুখ্যাতি পেয়েছিলেন, দান করে দিয়েছেন রজত মণ্ডলকে, যে তাঁর সাকরেদ কন্সটেবল ছিল, যখন তিনি এক অপরাধীকে পেঁদিয়ে মেরে ফালার দায়ে সাসপেণ্ডেড ছিলেন । এখন চোখে রে ব্যানের গগলস পরে অফিসের জিপ ব্যবহার করেন । ওনার পা দুটো কোমরের ওপরের অংশের চেয়ে দীর্ঘ, তাই দুই পা ছড়িয়ে বসেন, ডিসিপি, সিপির সঙ্গে মিটিঙেও অমন করে বসেন বলে অধস্তন অফিসাররা ওনার যৌনতা নিয়ে নিজেদের মধ্যে ঠাট্টা-ইয়ার্কি করে, তা উনি জানেন । এক পায়ের ওপরে আরেক পা রেখে উনি বসতে পারেন না । যখন দাঁড়ান, বুকের ওপরে দুই হাত ক্রস করে থাকেন ।
এক দুই তিন নম্বর দেয়া খাতাগুলো তেমনভাবেই পড়া আরম্ভ করলেন, ক্রম অনুযায়ী । হাতের লেখা দেখে টের পাওয়া যায় যে ছেলেটা বাংলা মিডিয়ামে পড়েনি, তাছাড়া ন্যারেটিভ হয়ে দাঁড়িয়েছে ম্যাশআপ, কার কথা, কে বলছে, কাকে বলছে, উদ্ধৃতি নাকি নিজের বক্তব্য, কোথায় শুরু, কোনটা কল্পনা, কোনটা সত্য ঘটনা, কিছু ঠিক করে বোঝার উপায় রাখেনি, অনুমান করে এগোচ্ছেন রিমা খান ।
“মিছিল, র্যালি, সমাবেশ, মহাসমাবেশ, গেটসভা, মোড়সভা, মোহোল্লাসভা, লোকসভা, ভোজসভা, শোকসভা থেকে মানুষজন ফেরার পর, নানা রকমের বক্তৃতা শোনার পর, দর্শনে আপ্লুত হবার পর, তাদের মাথা, মানে কাঁধের ওপরে তাদের মাথা তিনশো ষাট ডিগ্রি ঘোরার ক্ষমতা আয়ত্ব করে ফেলেছে ; তারা যাদের ছুঁয়েছে, যাদের সঙ্গে কথা বলেছে, যাদের নিয়ে ভেবেছে, স্বপ্নে যাদের দেখেছে, সবায়ের মাথা তিনশো ষাট ডিগ্রি ঘোরার ক্ষমতা পেয়ে গেছে, তা সে মানুষ-মানুষীরা গণ্ডমূর্খ হোক বা মহাজ্ঞানী, মার্কসবাদি-গাঁটকাটা, লেনিনবাদি-ডাকাত, হিন্দুত্ববাদী-দাঙ্গাবাজ, সন্ত্রাসবাদী-সালাফিস্ট, মাওবাদি-পকেটমার, গান্ধিবাদি-স্মাগলার, জাতীয়তাবাদী-লেঠেল, বর্ণবাদী-দেওবন্দি, যুক্তিবাদী-কুচুটে, মানবতাবাদী-জোচ্চোর, উপযোগবাদী-কিপটে, বিজ্ঞানবাদী-মাদুলিঅলা, ব্যক্তিবাদী-দলবাজ, দৃষ্টবাদী-বহূরূপী, ডারউইনবাদী-ধর্মগুরু, সমাজবাদী-জোতদার, তিনি যেই হোন না কেন ।”
পিচ্চির রোজনামচায় এসিপি রিমা খান যা পেয়েছেন , অ্যসিস্ট্যান্ট পুলিশ কমিশনার, যাঁকে পাবলিক আর মিডিয়া এককালে নাম দিয়েছিল ‘নোংরা পরি’, তখন তিনি পুলিশ ইন্সপেক্টর ছিলেন, দাগি অপরাধীরাও ভয় পেতো । সেই সময়ে তিনি জেমস বণ্ডের মতন নিজের পরিচয় দিতেন, “রিমা, রিমা খান”। তাঁর অধীনে এক থানায় মিসিং ডায়রি করেছিলেন পিচ্চির বাবার অ্যাডভোকেট, তাকেই এফ আই আর হিসেবে দায়ের করেছে থানার ওসি , পিচ্চি নামের এই যুবকের লোপাট হবার এক সপ্তাহ পরে ।
অনুসন্ধান চালাচ্ছেন সংশ্লিষ্ট থানার ইন্সপেক্টর ভোম্বোল সোম, সংক্ষেপে ভোমসো । খাতাটা উল্টেপাল্টে, ভোমসোকে, যে রিমা খানের টেবিলের উল্টোদিকে বসেছিল, বললেন, দেখি বাকি খাতাগুলো পড়ে । আমার তো মনে হচ্ছে এই ছোঁড়াটা ইনসেন । সেই জন্যেই বোধহয় ওদের অ্যাডভোকেট ওর লোপাট হবার দিনই মিসিং ডায়রি করেছেন, আরও কয়েক দিন অপেক্ষা করতে পারতেন । আঠেরো বছরের তরুণ, এসে যাবে দিনকতক পর । এর মা-বাবাও একে ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন ; হয়তো তাঁদের খোঁজে ভারতভ্রমণে বেরিয়েছে ছেলেটা । তুমি এর আর এর মা-বাপের ফোটো সব থানায় পাঠিয়ে দিয়েছ তো ? দেখি সব কয়টা খাতা এক এক করে পড়ে । ভোমসো উঠে চলে গেলে, চেয়ারে ছারপোকা থাকায় পোঁদ চুলকোতে-চুলকোতে, হাতের সিগারেটটা অ্যাশট্রেতে গুঁজে রিমা খান পড়ায় মনোযোগ দিলেন ।
“যারা ভাষণ দিয়েছে সেইসব গ্যাঞ্জামে, ঘাম পুঁছতে-পুঁছতে, তারাও অনেকসময়ে পিঠের দিকটা পাবলিকের সামনে রেখেছে, যাতে জনগণকে ভুলিয়ে-ভালিয়ে নিজেদের জালে ফাঁসিয়ে তোলা যায় । ফলে, তাদের সামনে দিক আর পেছন দিক বলে কোনো ব্যাপার নেই । তার আগে তারা পিঠের দিকে মুখ করে হাঁটতে পারতো না, বাঁ-দিক বা ডান-দিকে মুখ করে হাঁটতে পারতো না । তাদের দেহের বাদবাকি অঙ্গ তেমনই আছে, কেবল মুণ্ডুটা তিনশো ষাট ডিগ্রি ঘোরার ক্ষমতা তারা পেয়ে গেছে । তারা পিঠের দিকে মুখ করে ছলছলে চোখে প্রগতির উদ্দেশে এগিয়ে যেতে পারে, চোখের পাতা নামিয়ে চুমু খেতে পারে, জুলজুলে চোখে শুভদৃষ্টি করতে পারে, মুসলমান হলে বিয়ের সময়ে ঝিকিমিকে চোখে ‘কবুল’ বলতে পারে বা বি্যে ভাঙার জন্যে চকচকে চোখে ‘তালাক’ বলতে পারে, দলবেঁধে গোলগোল চোখে ‘ইনক্লাব জিন্দাবাদ’ বলতে পারে, শবদেহের অনুগামী হয়ে জলসজল চোখে গান গাইতে পারে, শ্মশানে মোদোমাতাল হয়ে ঘোলাটে চোখে নাচতে পারে, পিটপিটে চোখে ক্রিকেট আর ফুটবল মিটমিটে চোখে লাট্টু আর ড্যাঙ্গুলি টেরাচোখে আর টেনিস ব্যাডমিন্টন আড়চোখে চুকিতকিত অস্হির চোখে লুডো আর দাবা খেলতে পারে । মোবাইল, ল্যাপটপ, আর নানা গ্যাজেট নিয়ে চোখ কুঁচকে কাজ করতে পারে, ড্যাবড্যাবে চোখে গাড়ি আর বিমান চালাতে পারে, এক চোখ বুজে বন্দুক আর দুই চোখ খুলে কামান চালাতে পারে, দীপ্ত চোখে ধানের আঁটি পুঁততে পারে, উদ্ভাসিত চোখে নারকেল বা তালগাছে উঠতে পারে, বঙ্কিম কটাক্ষে ভিনযৌনতার দেহের দিকে তাকাতে পারে ।”
পিচ্চির রোজনামচায় এসিপি রিমা খান যা পেয়েছেন :
“বাচ্চারা জন্মাবার সময়ে তিনশো ষাট ডিগ্রি মাথা ঘুরিয়ে চারিদিক দেখে নিয়ে জন্মায় । আমাদের বাংলাভাষী দেশে আরম্ভ হয়ে এই মেরুক্ষমতা সারা পৃথিবীতে মহামারীর মতন ছড়িয়ে পড়েছে । সেই কে একজন বলেছিলেন, বাঙালি আজ যা করে অন্যেরা তা পরে করে, ব্যাপারটা তাইই ঘটেছে । বাঙালি গাড্ডায় পড়লে সারা দেশ গাড্ডায় ; বাঙালি নেতা গাড়ল হলে সারাদেশে সারা জগতে গাড়লদের নেতৃত্ব ।”
পিচ্চির রোজনামচায় এসিপি যা পেয়েছেন আর পড়ে অবাক হয়েছেন :
“শুধু পিচ্চির তা হয়নি, আমি নিজের চোখে দেখেছি । ও যেমনভাবে জন্মেছিল, তেমনই আছে । ওর মা-বাবা ওকে তেমনটা না বোঝালেও, তিনশো ষাট ডিগ্রি মাথা ঘোরাবার মেরুক্ষমতা ও পায়নি । ওর মা-বাবা কিন্তু সেই মেরুক্ষমতা পেয়েছিল। পিচ্চিদের বাড়ি ; সে যে কি পেল্লাই একখানা বাড়ি বর্ণনা করতে পারব না, যখন আমি কিনা একজন লেখক, বর্ণনা বিক্রি করে-করে ফুটানি মারি। তিনশো ষাট ডিগ্রি মাথা ঘোরাতে পারার মেরুক্ষমতার কারণে পিচ্চির মা আর ধনী মহিলারা গলায় দু সেট হার পরেন, একটা পিঠের দিকে আরেকটা বুকের দিকে, এও আমার নিজের চোখে দেখা, সোনার দোকান থেকে পিঠের দিকে মাথা করে বুক-পিঠ আলোয় আলো করে নামছেন, দেখেছি । বিজ্ঞাপন দেখেছি সোনার দোকানের সাইনবোর্ডে, “দুপুরবেলা পিঠের কিনুন, সামনে সন্ধ্যাবেলা, বোকা বরকে গেঁথে তুলুন, বলুন এটা র্যালা”।বিজ্ঞাপন তো আসলে কথার ব্যবসা, অথচ যারা বিজ্ঞাপনের ব্যবসায় আছে, সেই লোকগুলো বিশেষ পড়াশোনা করেনি, বলতে গেলে মুকখু । তারা বিজ্ঞাপন লিখতে পারে না, তারা অন্ধ, বোবা, কালা, তা সে মেয়ে হোক বা ছেলে । বিজ্ঞাপন দিয়ে মানুষের ব্যক্তিসত্তা গড়ার চেষ্টা হয়, যা চাই না, তা যোগাবার শোষণকাঠি পোঁদে গোঁজার কারিগরি । যে জিনিসের বিজ্ঞাপন সেই জিনিশের গুণের কথা বলা হয় না, শুধু ব্যক্তিসত্তা গড়ার স্বপ্ন তৈরির চেষ্টা , যেন সেই জিনিশটা পেলেই কেউকেটা হওয়া যাবে, সফল, দেখতে-সুন্দর, ঈর্ষা জাগাতে সক্ষম -- গাণ্ডুকে পাণ্ডুরঙ করে তোলার তিকড়ম ।”
পিচ্চির রোজনামচায় এসিপি রিমা খান যা পেয়েছেন, যেন অন্য কেউ লিখেছে, অথচ পিচ্চিরই লেখা, বাংলা মিডিয়ামে পড়েনি এমন কারোর হাতের লেখা এক নজরে টের পাওয়া যায়, তবে বাংলা গালমন্দ ভালোই রপ্ত করে ফেলেছে ।
“পিচ্চির দুর্ভোগ, যা বয়সের সঙ্গে কিছুটা সহ্য হয়ে গেছে, থ্যাঁতলানো এক দুর্ঘটনার স্মৃতি, যখন-তখন দুর্ঘটনায় চটকানো মানুষের মাংস দেখতে পেলেই মনে হয়, ওই দুজন ওর মা-বাবা হলে ভালো হতো, বৈশাখের সকালবৃষ্টির দরুন জমে থাকা শহরের নোংরায় দাঁড়িয়ে, পেঁকো জলের গন্ধের খোঁয়ারির মাঝে, দেয়ালপোস্টারের অভিনেত্রীর হাসিমুখ মাইয়ের ওপরে ফেলা পানের পিকের তলায়, দেখছিল ও, ঘিরে থাকা ভিজে ভিড়ে, সেদিন ছিল ওর জন্ম-তারিখ, আর জন্মদিন মানেই কারোর লাশ বা কয়েকজনের লাশ । ভাই-বোন নাকি বর-বউ নাকি বন্ধু-বন্ধুনি নাকি মাগি-মরদ কে জানে কাদের মাংসের ঘ্যাঁট ; মা-বাবা হলে ওনাদের সম্পর্কে পিচ্চির আর কিছু মনে থাকতো না । বৃষ্টিতে রক্তের ধারা পিচ্চির স্পোর্টস শু ভেজানো আরম্ভ করলে, ও টের পেলো, প্রতিবার রক্ত দেখলে যা হয়, তাই হতে চলেছে ; কেন যে প্রতিটি জন্মদিনে আঘাতের রক্তের মুখোমুখি হতে হয় । জন্মাবার সময়ের রক্ত ওর সঙ্গ ছাড়েনি । অজ্ঞান অবস্হার মগজের কুয়াশায় ও টের পায়, এই সময়টা ঝুরঝুরে সংবেদনের, মিলমিশ মনকেমনের, আঁস্তাকুড়ে ফেলে দেয়া নকলকারির আর বাছবিচারহীন ফালতু যৌনসম্ভোগের, যে সময়ে বাঙালির ঐতিহ্যের মূল্যবোধের গভীরতার বৈশিষ্ট্য, আসঞ্জন, মর্মার্থ, মৌলিকতা আর প্রামাণিকতা উবে গেছে কিংবা ফাঁকা ইশারার ঘুর্ণিতে পাক খেয়ে ডুবে গেছে, জনগণের মাথা তিনশো ষাট ডিগ্রি ঘোরার মেরুক্ষমতার কারণে ।”
“পিচ্চি আবছা শুনতে পেলো, ভিড়ের একজন বলছে, ‘এ ছোঁড়াকে মিরগি রোগে পেয়েচে, অজ্ঞান হয়েও বিড়বিড় করছে, মাথাটা ঘোরান দিকি, মুখ দেখা যাচ্ছে না ।’ কোটি-কোটি লোক প্রত্যেক বছর মরে যায়, প্রতি ঘণ্টায় দশ হাজার মরে, প্রতি মিনিটে একশোজন। কার কিই বা আসে যায় তাতে ? কিন্তু যখন কোনো এক জায়গায় একসঙ্গে অনেক লোক মরে যায়, ঝড়ে, ভূমিকম্পে, সুনামিতে, যুদ্ধে, আত্মঘাতী বোমায়, তখন সবাই অবাক হয়, রেগে যায়, সামনের বাতাসের চোদ্দপুরুষ উদ্ধার করে ।”
পিচ্চির রোজনামচার খাতায় আবার প্রথমপুরুষে লেখা পড়লেন এসিপি রিমা খান :
“ পিচ্চির মাথা নিজেদের দিকে ঘোরাবার চেষ্টা করে আরেকজন সুপুরুষ, যার দাড়িতে মৌমাছির চাকের মতন মোমমধুর রঙ, বললে, ‘নাঃ, এ তো দেখছি এই যুগের মানুষ নয়, প্রাগৈতিহাসিক, মাথা পাক খায় না ; যাকগে শালা, মরুকগে, নিশ্চয়ই অতিমানব, সুপারখোকা ।’ যখন জ্ঞান ফিরলো, শহরের নাগরিকরা ওকে ফুটপাতে শুইয়ে যে যার কাজে-অকাজে চলে গেছে, হাতঘড়ি, মোবাইল, পার্স পকেট থেকে হাতিয়ে ; এইভাবে, অনেকবার দুর্ঘটনা দেখে, রাস্তায় অজ্ঞান হবার আর ঘড়ি, মোবাইল, পার্স এমনকি ল্যাপটপ হারাবার অভ্যাস হয়ে গেছে ওর ।পিচ্চি অনেকবার পাঁয়তাড়া ভেঁজেছে, এইরকম একটা লোককে ধরে পেটে ছুরি বসিয়ে দেয়, ঘ্যাচাঙ, কাউকে না কাউকে তো একদিন খুন করতেই হবে, নয় তো বেঁচে থেকে কীই বা লাভ ? উঠে বসে পিচ্চির মনে পড়ল, বাবা একবার বলেছিলেন, ‘সত্তর-আশির দশকে আমাদের সংস্কৃতি যা হারিয়েছে তা বজায় ছিল উনিশ শতকের আভাঁগার্দ মনীষীদের সময়ে-- নবজাগরণের লোকজনের মধ্যে রামমোহন রায় , ভি ডিরোজিও ও তাঁর বিপ্লবী শিষ্যবৃন্দ, দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর ও তাঁর অনুসারীরা, অক্ষয়কুমার দত্ত , ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর , মাইকেল মধুসূদন দত্ত , বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় , স্বামী বিবেকানন্দ-- এক-একজন আভাঁগার্দ সংস্কৃতির মশাল। মানুষের চুলের মুঠি ধরে ঘুম থেকে টেনে তুলেছিলেন । কী ছিল না ওনাদের ? আদর্শ, আত্মবিশ্বাস, কর্মোন্মাদনা, সমাজকে নতুন মোড়ে তাড়িয়ে নিয়ে যাবার ঝোঁক, আর যা সবচেয়ে বড়ো তা হলো যে শিল্পের ধারণা, অনাগ্রহী অভিজাত দৃষ্টিতে, জরুরি রূপক ব্যবহার করে সংস্কৃতিকে এমনভাবে পালটে দিচ্ছিলেন যাতে স্বদেশী পাবলিক বুঝতে পারে। ওনাদের কারোর মাথাই তিনশো ষাট ডিগ্রি ঘুরতো না, যেমন পিচ্চির ঘোরে না । তারপর এইযুগ এলো, তিনশো ষাট ডিগ্রি মাথা ঘোরার যুগ । গাঁড়ল, আঁড়ল, বাঁড়ল, চাঁড়ল, ষাঁড়ল নেতাদের যুগ ।”
“এই যুগের ট্র্যাজেডি হলো যে কেউই সুখি নয়, তা সে লোকটা সময়ে আটকে থাকুক, দুঃখে বা আনন্দে, কেননা সকলেই এই জগতে একা ; আগেকার দিনগুলোকে আর ফিরে পাওয়া যাবে না । কেউ আটকে গেলে সে একাই আটকে থেকে যাবে । মানুষকে চেষ্টা করতে হয় এই ট্র্যাজেডি থেকে বেরিয়ে কেটে পড়ার সুযোগের সদ্ব্যাবহার করার । শহরের লোকগুলো যদি তোমাকে না চায়, তোমার কাছের লোকেরা তোমার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করে, বেশির ভাগ মানুষ যদি অকর্মণ্য হয়, সেই শহরে থাকার কোনো মানে হয় না । যতো তাড়াতাড়ি সম্ভব সেই জমায়েতকে পেছনে ফেলে কেটে পড়া দরকার । কেবল চুতিয়া আর গাণ্ডুরা বলে বেড়ায় যে আমি অমুক শহরকে ভালোবাসি, তারপর দেয়ালে মোতে, বমি করে, পানের পিক ফ্যালে, ভুল বানানে স্লোগান লেখে । যারা পিচ্চিকে ঘিরে ধরেছিল তারা ওই সার্বজনীন তিনশো ষাট ডিগ্রি মাথা ঘোরানো পাবলিকেরই অ্যাণ্ডা-বাচ্চা, পিচ্চির সন্দেহ নেই, নিশ্চয়ই দোআঁসলা গাঁড়লদের বংশধর ।”
“হেঁটে চার কিলোমিটার দূরে ওর বাবার বন্ধু অ্যাডভোকেটের অফিসে পৌঁছোলে, যে অ্যাডভোকেট পিঠের দিকে মুখ করে একজন মক্কেল তরুণীকে সলিসিট করছিলেন, ঠোঁটের কোনায় থুতুর ফেনা, তলাকার ঠোঁট চেবাতে-চেবাতে, ওনার কাছ থেকে বাড়ি যাবার ট্যাক্সিভাড়া নিয়ে ফিরেছিল পিচ্চি, আধ-ফাঁকা বাড়িতে, যার মালিক ও, পিচ্চি, ইকোল মণ্ডিয়ালের ছাত্র ছিল। সেই স্কুলেও একমাত্র ওর মাথা ঘুরতো না । মা-বাবা বাড়ি ছাড়ার আগে পাওয়ার অব অ্যাটর্নি দিয়ে গেছেন অ্যাডভোকেট মশায়কে, ফলে পিচ্চির মজা, টাকা খরচ করার, উচ্ছন্নে যাবার, সীমা ভাঙার আর অন্য কারোর চাপানো বাধানিষেধ নেই, পিচ্চির নিজের অ্যাকাউন্টেও অঢেল ।”
“আমি নিজের চোখে দেখেছি ।”
পিচ্চির রোজনামচায় সেই একই ঢঙে লেখা, ভ্রু কুঁচকে পড়তে লাগলেন এসিপি রিমা খান, টেবিলের তলায় দুই পা দুদিকে ছড়িয়ে ।
“ পিচ্চির বাবা আর মা একদিন রাতে কোথায় উধাও হয়ে গেছেন ; পিচ্চিকে লেখা চিঠিতে জানিয়ে গেছেন, পিচ্চি যেন খোঁজ না করে, কাউকে না জানায়, ওর জন্যে দুজনেই অঢেল টাকাকড়ি রেখে যাচ্ছেন, পিচ্চি ইচ্ছেমতন খরচ করতে পারে । তখন পিচ্চির বয়স এগারো। তারপর তো ও নাইটফলের বয়সে পৌঁছোলো। ওর স্বপ্নে যুবতীরা এসে নাইটফল ঘটায় না, পুরুষরা আসে, নানান বয়সের, যাদের মুখ পিচ্চি দেখতে পায় না, কেবল পোঁদটুকু দেখতে পায় ; পোঁদের মসৃণতা বা চুল দেখে ও টের পায় এটা কোন রাজনৈতিক প্রতিভা যাকে ও টিভিতে দেখেছিল, যে কোনো কুতর্কে চেঁচাচ্ছিল । ও নির্ণয় নিয়েছে যে ডে-ফল ঘটাতে হলে কোনো যুবতীর অনুমতি নিয়ে তার গর্ভের দরোজায় ফেলবে, গরমকাল হলে এসি চালিয়ে, শীতকাল হলে লেপ চাপা দিয়ে ।”
“বিছানায় তোয়ালে পেতে রাখতে হয়েছে । কেননা যে হাউসক্লিনিং কোম্পানিকে ওদের বাড়ি পরিষ্কার করার আর গুছোনোর চুক্তি দেয়া আছে, তাদের এক বুড়ো সদস্য বলেছিল, ‘আপনার যা বয়স, বিছানায় তোয়ালে বা রাবারক্লথ পেতে শোয়া অভ্যাস করুন, এই দাগ তোলবার কেমিকাল এখনও এখানকার বাজারে আসেনি, আমরা অর্ডার দিয়েছি, থাইল্যাণ্ড থেকে শিগ্গির এসে যাবে”।
পিচ্চির রোজনামচায় দুর্ঘটনার বয়ান পড়ছিলেন এসিপি রিমা খান, অথচ পুলিশের রেকর্ডে এই দুর্ঘটনার নথি করা হয়নি কেন ? পড়ে ভাবছিলেন রিমা খান ।
“রাস্তার ধারে মাংসের জড়াজড়ি ঘ্যাঁট দেখে কালটে চেহারার এক ঢ্যাঙাকাত্তিক লোক কাঁদো-গলায় বলে ফেলেছিল, ‘দেখুন, কতো ভালোবাসতেন একজন আরেকজনকে, চেনার উপায় নেই কে কোন জন’, মনে আছে লোকটার চামগাদড় চেহারার জন্যে । বলাবলি মনে আছে পিচ্চির, লোকগুলোর ছিদাম মনে নেই ।
----প্রকৃতির কী লীলা দ্যাখেন, বরের বুকের ওপরে বউয়ের বুকদুটো চলে এয়েচে ।
----বউয়ের হাতের জায়গায় বরের ঠ্যাঙ ।
----মানুষের মাংস বড্ডো অসহায় ।
“মর্গ থেকে মাংসের ঘ্যাঁট শ্মশানে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল, ইনসিনারেটরে, দুজনের আধার কার্ড আত্মীয়ের হাতে, ডিজিটাল-নথি থেকে হাপিশ করে দেবার খাতিরে । পিচ্চি গিয়েছিল শ্মশানে, যদি ওই দুজন ওর মা-বাবা হয়, কোনও ঠিক নেই আজকালকার দিনে, সাংবাদিকরা ক্যামেরার দিকে তাকিয়ে প্রমাণ করে দিতে পারে কে কার বাবা কে কার দলের কে কোন কোম্পানির।”
রোজনামচায় পাগলদের নিয়ে পিচ্চির বক্তব্য পড়ে এসিপি রিমা খান অবাক হলেন, এই ছোঁড়াটার পরিবারে ইনস্যানিটির দোষ ছিল সম্ভবত । কেমনতর তা বলা কঠিন ; হয়তো উদ্বেগজনিত ব্যাধি, মুডের বিশৃঙ্খলা, স্কিৎসোফ্রেনিয়া কিংবা সাইকোটিক সমস্যা, ডিমেনশিয়া, দায়িত্ব নেবার ভয় ।
“এখানে কে পাগল নয় বলা মুশকিল । কেউ দ্রোহী, কেউ খাপ খায় না, কেউ গণ্ডোগোল পাকায়, আসল গর্ত না জেনেই জবরদস্তি করে, কেউ কেউ বিষয়গুলোকে অন্যভাবে দেখতে চায় । তারা নিয়মনীতি জানে না । সমঝোতা কাকে বলে জানে না । স্হিতাবস্হাকে শ্রদ্ধা করে না । তারা মুখিয়ে থাকে পাল্টাপাল্টি করে ফেলার জন্যে । তারা মানবজাতটাকে ঠেলেঠুলে চালিয়ে নিয়ে যায় । বাবা হয়তো এই কারণেই গাড়ি কেনেননি, চিরকাল ট্যাক্সি । কিন্তু বলেছিলেন, ‘তুমি যতোই যাই করো, সময়টা হয়ে গেছে শয়তানদের ঘুর্ণিপাঁক, তোমার ঘাড় না ঘুরলেও, ঘুরিয়ে মাথায় ঢুকিয়ে দেয়া হবে কোনো বিদেশি উদ্গীরণ, বা আরও খারাপ, তুমি যাই বলো না কেন, প্রাসঙ্গিকতা সত্বেও, লোকে বলবে সেটা এই সময়ের জন্যে জরুরি । সময় বেশ বিপজ্জনক, সময় থেকেই পালাতে হবে, অথচ জানি যে পালানো কঠিন, পালাবার চেষ্টাকে ঠাট্টা করবে।’”
এই প্যারাটা রোজনাচায় পড়ে এসিপি রিমা খানের মনে হল, পিচ্চি নিজেই আত্মহত্যার কিংবা মার্ডারের ক্লু রেখে গেছে।
“ছোটোবেলা থেকে, কারোর গা থেকে রক্ত বেরোতে দেখলে তাকে নিজের আত্মীয় মনে হয় পিচ্চির, কান্না পেয়ে যায়, বেশি রক্ত দেখলে ও অজ্ঞান হয়ে যায়, ডেঙ্গু হয়েছে কিনা জানার জন্য প্যাথলজিস্টের সামনে বসে অন্য দিকে তাকিয়ে থাকে, নয়তো নিজের রক্ত দেখে নিজেই অজ্ঞান হয়ে যাবে । বেশিরভাগ দেবী-দেবতাকেই মনে হয় রক্তখোর, মানুষকে আগাম না জানিয়ে বিপদে ঠেলে দেয়। এরাই সব দেশের নেতা-নেতি । তারা রক্ত না পেলে পাবলিককে টাইট করে দেবে । তারা রক্ত খাচ্ছে না দেখে পাবলিক তাদের শ্রদ্ধা করবে না । পাবলিক যতো বেশি যন্ত্রণায় ভুগবে ততো বেশি আনন্দ পাবে মাংসের দেবী-দেবতারা । মানুষকে ভয় পাইয়ে রাখা তাদের ধর্ম । বাবা বলতেন চাকরের সঙ্গে গিয়ে মাছ মুরগি কিনে আনাটা শিখে নিতে, পিচ্চি কখনও যায়নি । বলেছে, চাকরের কাজ চাকর করবে, আমি কেন তার শ্রম কেড়ে নেবো, তাছাড়া চাকরদের মাথা তিনশো ষাট ডিগ্রি ঘোরে, আমার ঘোরে না । তখন পিচ্চির বয়স দশ । বাবা যে চিঠিটা লিখে গিয়েছিলেন তা পিচ্চি গত কয়েক বছরে বহুবার পড়েছে ; বারবার পড়লে ছিঁড়ে যেতে পারে অনুমান করে স্ক্যান করে স্মার্টফোনে তুলে রেখেছে :
ডিয়ার পিচ্চি,
আমার খোঁজ কোনোদিন কোরো না, আই লাভ ইউ, কিন্তু ইদানিং আমি একটা পলিঅ্যামোরাস গোষ্ঠীতে যোগ দিয়েছি, ছয়জনের, সবাই আমার মতন লেনিনবাদী নয় ,তিনজন যুবক মার্কসবাদী আর তিনজন যুবতী মাওবাদী , যুবকদের মধ্যে আমিই একমাত্র, তুমি নিশ্চয়ই মানবে যে আমি একজন যুবক, বয়স মাত্র চৌঁত্রিশ, প্রেম করে বিয়ে করেছিলুম বলে তুমি আমার আর তোমার মায়ের কম বয়সেই জন্মেছিলে । এবারে প্রেম-ভালোবাসা থেকে মুক্তি । অভিধানে পলিঅ্যামোরাসের মানে দেয়া আছে কিনা জানি না, তুমি তো টেক স্যাভি, গুগল সার্চ করে মানে জেনে নিও । আমি এই গেঁয়ো শহর ছেড়ে চলে যাচ্ছি, আর কখনও ফেরার ইচ্ছে নেই, তা এইজন্যে নয় যে আমি নিজের বাড়ি আর তোমাদের ভালোবাসিনি, বরং এইজন্যে যে মনের ভেতরে বাড়ি ছেড়ে চলে যাওয়াটা অনেককাল যাবৎ পোষা ছিল । ছেড়ে যাওয়া আমার জীবনের উদ্দেশ্য, জানতুম শৈশব থেকে, এটা একটা আইডিয়া, একজন মানুষ হিসেবে লালন করা আইডিয়া, যতো বড়ো শহর তাতে ততো বেশি নিজেকে হারিয়ে ফেলবার সুযোগ, যতো কংক্রিটের আকাশ ছোঁয়া বাড়ি, ততো তার গলিঘুঁজির উল্টোপাল্টা লোকজন, জঞ্জালের বিশাল পাহাড় । চিন্তা কোরো না, অ্যাডভোকেট মশায়কে বললেই উনি গাইড করবেন, মিসগাইডও করতে পারেন, তবে মনে রাখা দরকার যে মিসগাইড করার উপদেশগুলো বেশি কার্যকরী, তা আমি আমার বাবার মিসগাইডেন্স থেকে শিখেছি । লাভ ইউ । বাবা।”
যাক পিচ্চি নিজের জন্মদিন লিখে রেখেছে রোজনামচায় । আশ্বস্ত হলেন এসিপি রিমা খান । আর তো কোনও কাগজপত্র বাড়িতে পাওয়া যায়নি । মা-বাবার খোঁজে বেরোবার সময়ে সঙ্গে নিয়ে গিয়ে থাকবে।
“বামিয়ানের বুদ্ধকে আফগানিস্তানের দাড়িয়ালরা বোমা মেরে উড়িয়ে দেবার দিন পিচ্চি জন্মেছিল, মার্চ মাসে, ২০০১ সালে তাই বাবা নাম রেখেছিলেন পিচ্চি, ওনার মতে তালিবানরা জন্মায় পিচ্চি হয়ে মরে পিচ্চি হয়ে আর সারাজীবন পিচ্চির মতন বেপরোয়া জীবন কাটায় । কিন্তু বুদ্ধকে আবার নবায়িত করা হয়েছে। তালিবানরা আবার আসবে, আবার বুদ্ধর মূর্তি বোমা মেরে ওড়াবে, নিজের-নিজের বোরখাপরা বেগমদের শেকলে বেঁধে নিয়ে যাবে, হুকুম না শুনলে গুলি করে মারবে যাতে আরেকটা টাটকা বউ পাওয়া যায়, কচি কুচুরমুচুর বউ ।”
পিচ্চির রোজনামচার পাতায় নিজের সম্পর্কে লিখেছে, পড়ে আনমনা হলেন এসিপি রিমা খান :
“মায়ের লেখা চিঠিটাও স্মার্টফোনে স্ক্যান করে তুলে রেখেছে পিচ্চি । মা-বাবা দুজনের মূল চিঠি ব্যাংকের লকারে রাখা আছে, আর তো কিছু নেই লকারে রাখার, তাই, বছরে একবার গিয়ে চিঠি দুটোর গন্ধ শুঁকে রেখে দ্যায়, ভাঁজ খুলে পড়ে না । দুজনেই বৈশাখ মাসে উধাও হয়ে গিয়েছিলেন, দুজনের চিঠিতেই কোনো তারিখ দেয়া নেই । মায়ের চিঠিতে যা লেখা :
স্নেহের পিচ্চি
আমার খোঁজ কোনোদিন করিবে না, আমি তোমায় খুবই ভালোবাসি, প্রাণের চেয়েও ভালোবাসি, তুমি জানো, তুমি আমার একমাত্র সন্তান, তোমার যাহাতে কোনও অসুবিধা না হয়, আমার অ্যাকাউন্টে তোমাকে সঙ্গে লইয়া গিয়া তোমার নাম যোগ করিয়া দিয়াছিলাম, যাবতীয় গহনা বিক্রয় করিয়া দিয়াছি ও সেই অর্থ সঙ্গে লইয়া যাইতেছি । তোমার অ্যাকাউন্টের টাকা, তুমি যথেচ্ছ নয়ছয় করিতে পারিবে, কুন্ঠিত বোধ করিও না, জীবনের আনন্দ লইও, তবে কখনও দুঃখশোকের কবিতা পড়িও না। প্রেমের কবিতা পড়িবে ও তদনুসার প্রেম করিবে, একাধিক করিবে । এই কবিতাখানি পড়িয়া বুঝিতে পারিবে আমি কি ইশারা করিতেছি ।
ঘুরিয়ে গলার বাঁক ওঠো বুনো হংসিনী আমার
পালক উদাম করে দাও উষ্ণ অঙ্গের আরাম,
নিসর্গ নমিত করে যায় দিন, পুলকের দ্বার
মুক্ত করে দেবে এই সব্দবিদ কোবিদের নাম ।
কক্কার শব্দের শর আরণ্যক আত্মার আদেশ
আঠারোটি ডাক দেয় কান পেতে শোনো অষ্টাদশী,
আঙুলে লুলিত করো বন্ধবেণী, সাপিনী বিশেষ
সুনীল চাদরে এসো দুই তৃষ্ণা নগ্ন হয়ে বসি ।
ক্ষুধার্ত নদীর মতো তীব্র দুটি জলের আওয়াজ--
তুলে মিশে যাই চলো অকর্ষিত উপত্যকায়
চরের মাটির মতো খুলে দাও শরীরের ভাঁজ
উগোল মাছের মাংস তৃপ্ত হোক তোমার কাদায়,
ঠোঁটের এ-লাক্ষারসে সিক্ত করো নর্ম কারুকাজ
দ্রুত ডুবে যাই এসো ঘুর্ণমান রক্তের ধাঁধায় ।
পড়াশুনায় তুমি ভালো, প্রতি বছর প্রথম হও, তোমার শিক্ষার ব্যাপারে সেহেতু আমার চিন্তা নাই । তোমার দাদুর ব্যক্তিগত পাঠাগারে প্রচুর গ্রন্হ আছে, পড়িয়া সময় কাটাইতে অসুবিধা হইবে না । কখনও পরামর্শের প্রয়োজন হইলে তুমি অ্যাডভোকেট মহাশয়ের সহিত আলোচনা করিতে পারো । গৃহত্যাগের চেয়ে উচ্চতর কিছুই নাই, সবচেয়ে দয়নীয় হইল গৃহত্যাগ মনের ভিতর পোষণ করিয়া বাঁচিয়া থাকা । আমি কাহাকেও আঘাত দিতে চাহি নাই, সেই হেতু তোমাকে পূর্বাহ্ণে বলি নাই যে গৃহত্যাগ করিতেছি। অতঃপর জীবনে যাহা ঘটিবে তাহা ঘটিতে দিব, কোনও দুশ্চিন্তা নাই । জীবন নিজের স্বকীয় ইচ্ছানুযায়ী অতিবাহিত করিবে । আমার সস্নেহ আশীর্বাদসহ -- মা ।”
পিচ্চির রোজনামচায় পরের পাতায় গেলেন এসিপি রিমা খান, হাতের লেখা ডান দিকে বেঁকেছে, কিন্তু কেন, ভাবলেন উনি :
“বাবা আর মা চলে যাবার পর ঠাকুর্দার লাইব্রেরির বই ঘেঁটে পিচ্চির মনে হয়েছিল, উনি বহুপন্হী ছিলেন এবং সেকারণে প্রচুর টাকাকড়ি রোজগার করতে পেরেছিলেন, দেশ-বিদেশ ঘুরতে পেরেছিলেন ; ওনার মিসগাইডেন্সের সবচেয়ে আলোচিত টপিক, যা বাবা প্রায়ই বলতেন, তা হলো জীবন কাটাতে হলে রবীন্দ্রনাথের দাদুর মতন কাটাও -- খাও, পিও, জমিজিরেত কেনো, বিদেশে যাও, বিদেশিনীদের সঙ্গে মৌজমস্তি করো । তাতা থৈথৈ, তাতা থৈথৈ, তাতা থৈথৈ, কী আনন্দ, কী আনন্দ, কী আনন্দ, দিবারাত্রি নাচে মুক্তি নাচে বন্ধ–সে তরঙ্গে ছুটি রঙ্গে পাছে পাছে, তাতা থৈথৈ, তাতা থৈথৈ, তাতা থৈথৈ।”
“পিচ্চি যখন স্বপ্ন দ্যাখে তখন স্বপ্নের মধ্যে ও বামপন্হী হিসেবে নিজেকে চিনতে পারে । ঘুম ভেঙে গেলে আর বামপন্হী থাকতে পারে না । বহুপন্হী হয়ে যায়, আর সবায়ের মতন, জনগণের মতন।”
“দিনের বেলা ওর মনে হয়, এখনকার বহুপন্হী ভাবুকরা যুক্তি, বিজ্ঞান, অবজেকটিভ বাস্তবকে ফুঃ বলে উড়িয়ে দেয় আর দাবি করে যে সবকিছুই সাংস্কৃতিক স্তরে আপেক্ষিক । বহুপন্হীরা বিজ্ঞান আর যুক্তিবাদকে ঘেন্না করে কেননা ওরা কোনো-কোনো বিশ্বাসকে সত্য বলে দেগে দ্যায়, মানে সেগুলো সফল আর উঁচুস্তরের আবার কোনো-কোনো বিশ্বাসকে মিথ্যা মনে করে, তারা নিকৃষ্ট, পরাজিত । হীনতা সম্পর্কে বহুপন্হীদের ধারণা এতো গভীর যে ওরা বহু ব্যাপারকে অন্যের চেয়ে সফল আর উচ্চতর মনে করতে পারে না । মানসিক বিকারকে ওরা ফালতু মনে করে । ওরা মানুষের ক্ষমতার জিনগত ব্যাখ্যা বরদাস্ত করতে পারে না । অমন ব্যাখ্যা মেনে নিলে ওদের মেনে নিতে হবে যে সবাই সমান নয় । একজন মানুষের গুণ বা দোষত্রুটির দায় ওরা চাপিয়ে দ্যায় সমাজের ওপরে । মানে, নিকৃষ্ট হওয়াটা তার দোষ নয়, সমাজের দোষ, সমাজ নাকি তাকে উচ্চতর হবার সুযোগ দেয়নি ।”
“স্বপ্নের মধ্যে পিচ্চি নিজেকে কোনো রাতে স্তালিন হিসাবে দেখতে পায়, কোনো রাতে লেনিন, কোনো রাতে মাও, কোনো রাতে ফিদেল কাস্ত্রো, কোনো রাতে চে গ্বেভারা, কোনো রাতে ট্রটস্কি, কোনো রাতে হুগো চাভেজ, কোনো রাতে হো চি মিন, কোনো রাতে পল পট । অসুবিধা একটাই, বিছানায় ও ল্যাংটো হয়ে শোয়, নয়তো ঘুম আসে না, কিন্তু কোনো বই পড়ে জানতে পারেনি যে এনারা কেউ ল্যাংটো হয়ে শুতেন কিনা ।”
“স্বপ্নের মধ্যে পিচ্চি মা আর বাবার প্রিয় গানগুলো শুনতে পায় ।”
“বাবা নিজের দোতলার দক্ষিণ দিকের ঘরে বেতের ইজিচেয়ারে বসে, বরফে চোবানো ব্লু লেবেলের গ্লাস হাতে, যে ঘরের দেয়াল নীলাভ, শুনতে পেতেন না মা একতলায় নিজের অ্যান্টিক পালঙ্কে সবুজ মখমলের চাদরে চোখ বুজে বসে, শিমুল তুলোর কোলবালিশ জড়িয়ে, কোন গান শুনছেন । মা শুনতে পেতেন না বাবা কোন গান বাজাচ্ছেন ।”
“ গ্যারেজের ওপরে ওর খেলবার মেজানাইন ঘরে বসে পিচ্চি দুজনের বাজানো গানই শুনতে পেতো, ওর তো গানের সুরও প্রায় একই রকম মনে হতো ।”
“এই শহরে যে বাড়িতে পিচ্চি জন্মেছিল সেখানে এখন মাল্টিপ্লেক্স, মাইয়ের খাঁজ দেখানো ফিল্মিমাইয়ার পোস্টার ; প্রথম প্রি-প্রাইমারি স্কুলটা ভেঙে উঠে গেছে তিরিশতলা, ভেতরটা দেখা যায় না এমন আয়না-কাচে মোড়া, ক্রিকেট খেলার মাঠটায় ফ্লাইওভারের থাম ; এই শহরে ভবিষ্যৎ গড়ে ওঠার আগেই উবে যায়, মগজে পুষে রাখা বিটকেল চিন্তা দিয়ে নাগরিকরা বানিয়ে চলেছে স্হাপত্য ভাস্কর্য পেইনটিং নগ্নিকার আঁস্তাকুড় । পিচ্চিকে তাই একোল মণ্ডিয়ালে গিয়ে পড়তে হয়েছিল, তারপর আর ভাল্লাগেনি, মনে হয়েছে সবই তো ওর জানা ।”
রোজনামচার একটা খাতা শেষ করে পরের খাতাটা তুলে নিলেন রিমা খান ; নানা রকমের ডুডল, খাতার প্রথম দিকের কয়েকটা পাতায়, মনে হয় চোখ আঁকার চেষ্টা করেছে, কার চোখ কে জানে, যেন কোনো রাক্ষসের।
দুই
“ পিচ্চির নিজের ভালো লাগে মেটাল গান, হেভি মেটাল, তাতে ওর ঝাঁকড়া চুলে হেড ব্যাং করতে সুবিধে হয় । দরোজা জানালা বন্ধ করে এসি চালিয়ে পিচ্চি উলঙ্গ দাঁড়িয়ে গান শোনে আর হেড ব্যাং করে ।”
রিমা খান নোট নিয়ে রাখলেন । এই অ্যাডভোকেটই মিসিং ডায়রি করেছে, ভোমসোকে জিগ্যেস করতে হবে ওনার এলাবোরেট স্টেটমেন্ট নিয়েছে কিনা ।
“পিচ্চির অছি, অ্যাডভোকেট মশায় বলেছিলেন, তলাকার ঠোঁট দাঁত দিয়ে চিবোতে-চিবোতে, বাঁ হাত দিয়ে গান্ধিমার্কা চশমা টেবিলের ধুলোট কাগজের ডাঁইয়ের ওপর রেখে, আর বাঁ হাতে ধরা সিগারেটের ছাইকে টুসকি মেরে, বুঝেছ পিচ্চি, তোমাদের সংসারে আসল গোলমাল তৈরি হয়েছে ওই বিশাল বাড়ির জন্যে, তিনজন মোটে মানুষ, তোমাকে যদি হাফ ধরি তাহলে আড়াইজনের জন্য অতোবড়ো বাড়ির দরকার ছিল না। দশ হাজার স্কোয়ার ফিট, বাগান নিয়ে কুড়ি হাজার স্কোয়ার ফিট। রবি ঠাকুরের বাবা জানতেন তাঁদের বিরাট বাড়ির জন্যে অনেক ছেলেপুলে দরকার, কেউ যদি তার বউদির সঙ্গে প্রেম করে তাহলে অন্যেরা জানতে পারবে না। তোমার যদি কয়েকটা দাদা থাকতো তাহলে কোনো একজন বউদির সঙ্গে প্রেম করতে পারতে । অতো বড়ো বাড়ির জন্যেই তোমার আর ভাইবোন হলো না, তোমার ঠাকুর্দারও হয়নি, এই যদি বস্তির কুঁড়ে ঘরে থাকতে, কিংবা অজ পাড়াগাঁয়ে, তাহলে লালু যাদবের ছেলেপিলের মতন তোমারও গাদাগুচ্ছের জেঠা-কাকা ভাই-বোন হতো, বাড়িটা গমগম করতো, মা-বাবাও বাড়ি থেকে পালাতেন না । আমাদের ছোটোবেলায় ছেলেছোকরারা বকুনি খাবার ভয়ে কিংবা বাঁধন ছেঁড়ার জন্য বাড়ি থেকে পালাতো । তোমার মা-বাবা বাড়ি থেকে পালালেন, আজব যুক্তি দিয়ে, এরকম ঘটনা আমি আমার কোনো মক্কেলের জীবনে ঘটেছে বলে শুনিনি, আজ দশ বছর হতে চলল প্র্যাকটিস করছি । কতোবার তোমার বাবাকে বলেছি একতলাটা ভাড়া দিয়ে দাও, লোকজনের আসা যাওয়া থাকবে, দিনে গোরস্তান রাতে চোরবাগান মনে হবে না, তা তোমার বাবার সেই এক কথা, যা তোমার ঠাকুর্দাও বলতেন, আর টাকাকড়ি চাই না, যা আছে তাইই যথেষ্ট, তার ওপর যাদের ভাড়া দেবো তারা কেমন ধরনের মানুষ তা তো আগে থেকে জানা যাবে না, হয়তো রোজই ঝগড়াঝাঁটি করবে নিজেদের মধ্যে, আর আমাদের শান্তি নষ্ট করবে, তামাক খেয়ে থুতু ফেলবে, মাল টেনে বউকে পেটাবে, জোরে টিভি চালাবে, বাগানে পেচ্ছাপ করবে ।”
“অ্যাডভোকেট মশায়ের মুখের দিকে তাকালে মন খারাপ হয়ে যায় পিচ্চির ; ওনার মেয়ে হয়নি, পাঁচটাই ছেলে, ছয় নম্বর পয়দা করতে-করতে ওনার বউ মারা গেলেন, ছয় নম্বরও কয়েকদিন মোটে টিকেছিল । পাঁচটা ছেলেই অপগণ্ড, কেউ ক্লাস এইট, কেউ ক্লাস সেভেন, আর এগোতে পারেনি, গণিত আর ইংরেজিতে বারবার গাড্ডুস খেয়েছে, একটা ছেলে তো স্কিৎসোফ্রেনিয়ার রোগি । অ্যাডভোকেট নিজে কতো পড়াশোনা করেছেন, গরিব মা-বাপের মুখে রোশনাই ফুটিয়েছেন, বস্তি ছেড়ে বাড়ি ভাড়া নিয়ে থাকেন, অথচ ওনার ছেলেগুলো ওনার মুখময় অন্ধকার মাখিয়ে দিয়েছে । কোনো মানে হয় না। কোনো ছেলে ওনার দপতরে ঢুকলে মুখ এমন বিকৃত করেন যেন হুপ শব্দ করে গাছ থেকে ল্যাজ তুলে লাফাবেন ।”
“পিচ্চির অছি, অ্যাডভোকেট মশায় বললেন, তলাকার ঠৌঁট চেবাতে-চেবাতে, তোমার জন্যে আমি দুজন প্রেমিকা খুঁজে রেখেছি, কনে আর কইন্যা, যদিও বয়েস তোমার চেয়ে দুজনেরই বেশি, তোমায় প্রেমিকের করণীয় বিষয়ে ভালো গাইড করতে পারবে । তুমি হয়তো তাদের জন্য প্রথম নও, শেষও নও, একমাত্র নও ; তারা আগে প্রেম করে থাকতে পারে, পরেও আবার করবে । কিন্তু এখন তো তোমাকে ভালোবাসবে, সেটাই যথেষ্ট, নয়কি ? মেয়ে দুটি সুন্দরীতমা নয়, নিখুঁত নয়, পাছা পর্যন্ত চুল নেই, ঢাউস বুক নেই -- তা তোমার শরীরেও তো কতো খুঁত আছে, মাসকুলার নও, একটু মোটা, চুল ঝাঁকড়া, রোজ স্নান করো না, পোশাক পালটাও না ; যাকে বাছবে, দুজনে মিলেও নিখুঁত হবে না বটে, তাতে কি ? তোমাকে হাসিখুশি রাখে যদি, যদি মেনে নেয় যে জীবনে ভুলভাল কাজ করে ফেলেছে, তোমাকে নতুনভাবে চিন্তা করতে শেখাবে, তোমাকে তার একটা অংশ দিতে গররাজি হবে না, যদিও তুমি হয়তো বিশ্বাস ভেঙে ফেলতে পারো, সেও তোমার সেই জিনিশটা ভেঙে ফেলতে পারে, আই মিন ইয়োর হার্ট । তুমি তাকে আঘাত দেবে না, সেও তোমাকে আঘাত দেবে না, তুমি তাকে পালটাতে চেষ্টা কোরো না, সেও তোমাকে পালটাতে চেষ্টা করবে না । তোমাকে আনন্দ দিলে হাসবে আর তাকেও আনন্দ দেবে। বুঝলে?”
“প্রেমিকা ? পিচ্চি নিজেকে চুপচাপ বলল, ‘আমি তো প্রেম করতে চাই না, খুন করতে চাই, এমনভাবে খুন করতে চাই যে কেউই টের পাবে না। অ্যাডভোকেটকে শুনিয়ে বলল, আমি দুজনের সঙ্গেই, কনে আর কইন্যার, একসঙ্গে প্রেম করতে চাই , রাঁধুনিকে বলে দেব ওদের যার যা পছন্দ তেমন ব্রেকফাস্ট, লাঞ্চ আর ডিনার রাঁধতে।”
“সেই দিন থেকে জীবন হয়ে উঠল ঘনঘোর কালো, কুচকুচে কালো, আকাশ কালো, বাতাস কালো, গাছপালা কালো, বৃষ্টি কালো, ফুলগুলো কালো, ঘরের আলোও কালো, জানালার বাইরে কেবল কালোয় কালো অথচ তা অন্ধকার নয় । প্রেমের অর্থ অন্ধকার নয়, প্রেমের মানে কালো সুরঙ্গে সেঁদোনো, হাতড়ানো। কালো যে কতো আকর্ষক তা দুজন তরুণী, কনে আর কইন্যা, শিখিয়ে দিল পিচ্চিকে, তার আগে পিচ্চি কোনো তরুণীর সামনে উলঙ্গ হয়নি।”
“দুই কানে উড়ন্ত চুল আছে, তাই যেকোনো ছুতোয় গোরিলাদের প্রসঙ্গ এসে যায় পিচ্চির অছি অ্যাডভোকেট মশায়ের মগজে । বললেন, তোমার তো মাথা তিনশো ষাট ডিগ্রি ঘোরে না, বুকের চুল লেজার দিয়ে কামিয়ে নিও। মেয়ে দুটি, কনে আর কইন্যা, তেমন প্রেমিকই চেয়েছে । তোমাদের বাড়িটা ওদের দুজনকে ভাড়া দিয়েছি, তুমি অনুমোদন করে দিও, ওই দুজনের মধ্যে একটি মেয়েকে তোমার প্রেমিকা হিসাবে চুজ কোরো, কনেকে বা কইন্যাকে । কে তোমার প্রেমিকা তা তোমাকে বুঝে নিতে হবে । দুই মেয়েরই মাথা তিনশো ষাট ডিগ্রি ঘোরার মেরুক্ষমতাসম্পন্ন ।”
“পিচ্চি বলল, জানি, আমি বলি কি, ব্যাপারটা বিশ্ব উষ্ণায়নের জন্যে ঘটেছে ; মা-বাবাও বাড়ি ছেড়েছেন উষ্ণায়নের প্রভাবে, আমি উষ্ণায়নের বিরুদ্ধে লড়ব কনে আর কইন্যা দুই প্রেমিকাকে দুই পাশে রেখে, ওদের কাঁধে হাত রেখে উড়ব, ওদের শিখিয়ে দেবো কেমন করে ড্র্যাগনদের ট্রেনিং দিতে হয় ।”
“পিচ্চির অছি, অ্যাডভোকেটের পরামর্শে, নিচের তলাটা পার্টিশান করে কনে আর কইন্যাকে ভাড়া দিয়েছে পিচ্চি, সাজানো ঘরগুলো, সব আসবাবই আছে । কেননা ও যখন বাড়ির বাইরে থাকে তখন কাউকে তো থাকতে হবে, নয়তো যা চোর-ছ্যাঁচোড়ের আর পার্টিবাজির যুগ, বাবা-মায়ের স্মৃতিই চুরি করে নিয়ে চলে যাবে, রবীন্দ্রনাথের নোবেল পুরস্কারের মেডেলই চুরি হয়ে গেল, আর পাওয়া গেল না, চোরেদের পাওয়া গেল না, মেডেলও পাওয়া গেল না ।”
“অছি অ্যাডভোকেটের দেখাদেখি পিচ্চিও দুটি মেয়েকে ফর্সা আধুনিকা কইন্যা আর কালো অধুনান্তিক কনেতে বর্গীকরণ করে ফেলেছে, তাদের গায়ের রঙ অনুযায়ী, যদিও কালো কনেই গ্যারেজ ভাড়া নিয়ে নিজের মোটর গাড়ি রাখে ; একজন যুবতী চারজন বসবার জায়গায় করেটা কী । দুই তরুণীকে পিচ্চির বর্গীকরণ : কনে দক্ষিণ আমেরিকা আর কইন্যা উত্তর আমেরিকা । এই দুই তরুণী ওর প্রেমিকা হবে, সলিসিটর মশায়ের ঠোঁট-চেবানো প্রস্তাব । ফর্সা কইন্যা বলেছে ও এম এ পড়ছে, কালো কনে এম এস সি, ওদের দাবি তাইই, অ্যাডভোকেট মশায়ের তথ্য অনুযায়ী। দুজনেই সঙ্গে এনেছে দুটো করে ঢাউস সুটকেস, আর কিটব্যাগ ।”
“পিচ্চি ভেবেছিল, যখন সত্যিকার কোনো সুন্দরী তরুণীর সঙ্গে আলাপ হবে, তাকে বলব, যে, যদি সে রাতটা আমার সঙ্গে কাটায়, তাহলে তাকে নিয়ে উপন্যাস লিখব । সলিসিটার বলেছিলেন যে এই ট্রিকটা কাজে দেয়, বিশেষ করে তার নামে যদি উপন্যাসের নামকরণ হয় ; তারপর মিষ্টি রাতটা কাটানো হয়ে গেলে, মেয়েটি টা-টা করে চলে গেলে, মনের মধ্যে একটা কষ্ট বাসা বাঁধবে, লিখতে বসে সেই কষ্টের কথা এসে যাবে, মেয়েটির কথা আসবে না । তাই তোমার এমন প্রেমিকা চাই যে টা-টা করবে না, বা করলেও তোমার সঞ্চয়ে একজন বিকল্প প্রেমিকা থাকবে । তা সত্বেও কষ্ট কমাবার জন্য তোমায় একটা-কিছু লিখে ফেলতে হবে, নয়তো তার স্মৃতি মগজ থেকে নামাতে পারবে না । কিন্তু সে তোমার স্মৃতিতে থেকে যাবে । তাকে মগজ থেকে মুছে ফেলার জন্যে হয়তো তাকেই খুন করতে হবে । পিচ্চি সে কথা মনে রেখে এই খাতায় নিজের স্মৃতি অন্য লোকের ডটপেন দিয়ে লিখে রাখছে ।”
অ্যাসিস্ট্যান্ট পুলিশ কমিশনার রিমা খান আরেকটা সিগারেট ধরালেন, ধোঁয়া টেনে ওপরের দিকে ছাড়লেন, আর নোট নিলেন, মেয়েগুলোকে জেরা করে ভোমসো কোনো তথ্য পেয়েছে কিনা জানতে হবে ; হঠাৎই দুটি মেয়ে একা-একা একটা বাড়িতে থাকতে চলে এলো প্রেমিক পাবার স্বার্থে, নাকি ছোঁড়াটাকে বিয়ে করে সম্পত্তির মালকিন হবার গোপন ইচ্ছেতে । ছোঁড়াটা আগে সেক্স করেছে কিনা তার আভাস দেয়নি। যাক পড়তে থাকা যাক, ভাবলেন রিমা খান ।
“ফর্সা কইন্যা কালো কনের আগে এসে সংসার গুছিয়ে ফেলেছে ; কিনতে হয়নি কিছুই কেননা সবই তো মজুত, গুছিয়ে নেয়া মানে ওয়ার্ডরোবে স্কার্ট-টপ-লনজারি-শাড়ি-ব্লাউজ-বডিস-পুলওভার-সোয়েটারের রঙিন কাতার । খাবার জন্যে নিজেদের রাঁধতে হবে না, রাঁধুনিকে বললেই হল । ফর্সা কইন্যার একটা গোলাপি স্কুটি আছে, বাইরেই রাখে, গাছের তলায় । বেরোবার সময়ে সিটের ওপর থেকে পাখির গু সেই দিনের সংবাদপত্রের রাশিফলের পাতা দিয়ে পুঁছে নেয় । চুড়িদার বা শাড়ি নয়, চেরা স্কার্ট পরে, মিনি-মিডি-ম্যাক্সি, উরু দেখে ভাল্লাগে, ভাল্লাগাটাই বোধহয় প্রেম করার প্রথম ধাপ । যে তরুণীরা উরু-দেখানো পোশাক পরে তারা বিজ্ঞাপন কোম্পানির সঙ্গে যোগাযোগ করে উরুতে তেল সাবান বেবিফুড শ্যাম্পু এইসবের প্রচার করতে পারে ।”
“পিচ্চি ওর অছি অ্যাডভোকেটকে বলেছিল, থ্যাঙ্কস ফর ইয়োর মিসগাইডেন্স স্যার, আপনার কথা মতো লাইন মারামারি শুরু হয়েছে, কিন্তু আমি মারছি না কনে-কইন্যারা মারছে তা খোলশা হয়নি এখনও, তবে দুজনেই বেশ টানছে ।”
“কালো কনে যেদিন নতুন গাড়ি এনে গ্যারেজে ঢোকালো, কালীঘাটে পুজো দিয়ে, ওয়াইপারে গ্যাঁদাফুলের মালা পরিয়ে, সেদিনকেও পিচ্চি অজ্ঞান হয়েছিল, যথারীতি ওর জন্মদিনে, বারান্দায় ওঠার মুখে মার্বেলপাথরের সিঁড়ির কাছে একটা স্যানিটারি ন্যাপকিন দেখে, তখনও টাটকা রক্ত লেগে ।”
রিমা খান নোট নিলেন, স্কুটি আর মোটরগাড়ির রেজিস্ট্রেশান পার্টকুলার্স সংগ্রহ করতে বলবেন ভোমসোকে । হ্যাঁ, সত্যিই গাড়ি কেনার মতন টাকাকড়ি থাকতে, একা বসবাস করতে এলো কেন কনেটা ?
“ফর্সা কইন্যা ওকে অজ্ঞান হতে দেখে হাতে-ধরা মিনারাল ওয়াটারের ছিটে দিয়ে জ্ঞান ফেরাতে, জিভে ঠোঁট বুলিয়ে পিচ্চি বলে উঠেছিল, এটা কী জিনিস, এতো রক্ত, কে ফেলে গেছে, কারোর অ্যাকসিডেন্ট হয়েছে নাকি?”
“পিচ্চির কথা শুনে, ওকে হাত ধরে টেনে তুলে ফর্সা কইন্যা বলল, ‘স্কুল কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়গুলো হয়ে গেছে মস্তিষ্কে চুন-সুরকি ভরা খণ্ডহর, বহুকাল থেকে, হিউম্যানিটিজের ছাত্ররা, যারা স্বাধীন চিন্তা করতে পারে, পড়াশুনোয় আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছে, অনেকে ছেড়ে চলে গেছে, বলা যায় তাদের তাড়িয়ে দেয়া হয়েছে।
টিকে থাকার একমাত্র উপায় হয়ে দাঁড়িয়েছে মাথায় হাওয়া-ভরা বোকা দার্শনিকদের সামনে মাথা হেঁট করে তাদের কথা আওড়ানো, নামও সব বিটকেল, দেরিদা, লাকাঁ, ফুকো, আর্নেস্তো লাক্লাউ, জিলে দেল্যুজ, স্লাভো জিজেক, লুই আলথুজার, হ্যানো-ত্যানো । আসলে, ব্যাপারটা হলো দর্শনশাস্ত্রের পীড়ন বা অত্যাচার । আমাদের দেশের অধ্যাপকগুলো ওদের গোবরগণেশ দর্শনের রথে চেপে কেরিয়ার গুছিয়ে নিচ্ছে। তোমারও সেই দশা, মেয়েদের যৌবনে পোঁছোনো সম্পর্কে না জেনে প্রেমিক হবার জন্য তৈরি হয়ে গেলে।”
“পিচ্চি থ্যাঙ্কস দেবার হ্যাণ্ডশেকের জন্য ডান হাত বাড়িয়েছিল, কইন্যা, যার সারা শরীর যেন কাঁচা ঘুমে ডুবে কুয়াশায় ভরা, বলল, আজকাল কেউ ব্রিটিশদের মতন হ্যাণ্ডশেক করে না, এখন হাগিঙ করতে হয়, আমেরিকানদের মতন, বলে ওলেঙ্কা পিচ্চিকে জড়িয়ে হাগ করতে, পিচ্চি জিগ্যেস করলে, এই প্রথা কি প্রতিবার দেখা হলে করতে হয় ? তোমার গায়ের গন্ধ কিন্তু বেশ ফুলেল !”
রিমা খান নিজেকে বললেন, ওঃ, মেয়েটা দেখছি এই সমস্ত নাম আউড়ে ছোঁড়াটাকে ইমপ্রেস করতে চাইছে ; এখন ইমপ্রেস করার এটাই চল, শরীরের ভঙ্গি আর জ্ঞানের লেঙ্গি ।
“কেউই এসব কথা বলে না, উচ্চারণ করে না, এটা পাগলাগারদের সভাঘর । কারোর হয়তো মাথার ঠিক নেই আবার কেউ এটাকে রোমান্টিক বলে মনে করে, রোমান্টিকরাও এক ধরণের পাগল, যাদের নিজের ওপর নিয়ন্ত্রণ নেই আর যা চায় তাই করতে পারে ।”
“পিচ্চি ফর্সা কইন্যার সামনে অবাক চাউনি মেলে বুঝিয়ে দিলে যে ও মেয়েটির কথা কিছুই বোঝেনি।”
“তুমি ওই একোল মণ্ডিয়াল স্কুলে পড়েছিলে তো, নানা ব্যাপারে জ্ঞান হয়নি । একে বলে স্যানিটারি প্যাড বা ন্যাপকিন, মেয়েরা মাসে একবার ভ্যাজাইনায় বাঁধে, তাদের ওভুলেশান হয়, ডিম বাসি হয়ে গেলে তা রক্তের সঙ্গে বেরিয়ে যায়, ওই ডিম থেকেই তো ছেলেপুলে হয়, জানো না, এতো বয়স হতে চলল, ওই ডিমের সঙ্গে স্পার্মের প্রেম হলে গর্ভে ভ্রুণ তৈরি হয়, ফিটাস, ফিটাস । তোমার মরা স্পার্মও তো নাইটফলে বেরিয়ে যায়, যদি ম্যাস্টারবেট না করো । মেয়েদের ম্যাস্টারবেশনের সঙ্গে অবশ্য ডিম মরার সম্পর্ক নেই। বললে কইন্যা উত্তর আমেরিকা, দুই পা ফাঁক করে কোমরে হাত রেখে ; আমার ভ্যাজাইনা ওই কয়দিন বেশ রেগে থাকে, আদারওয়াইজ আমার ভ্যজাইনা বেশ খুশমেজাজী ।”
“এতো রক্ত ? তাহলে তো প্রত্যেক মাসে হাসপাতালে গিয়ে ব্লাড নিতে হয় তাদের ? তোমাকেও নিতে হয় নিশ্চয়ই । তুমি তো আমার চেয়ে কয়েক বছরের বড়ো, স্কার্ট পরে থাকো, এখনই রক্ত বেরোনো আরম্ভ হয়ে গেছে? ফর্সা কইন্যার কথাগুলো শুনে পিচ্চির মগজে ঝড়ে গাছ পড়ার, বিতর্কে টেবিল চাপড়াবার, গাড়ির ব্রেক মারার তীক্ষ্ণ আওয়াজ, বরফের ওপর হাঁটার শিহরণ সব একসঙ্গে ঘটে গেল ।
“হ্যাঁ, বারো বছর বয়স থেকে হয়েছে । তোমার চেয়ে আমি বয়সে বেশ বড়ো, স্নাতকোত্তরে দর্শন পড়ি, আর অধ্যাপকদের অ্যাবিউজ করি । তুমি নাকি আমার প্রেমিক হবে বলে ধার্য করা হয়েছে, বেবি বয়? ওই দিকের কালো কৃষ্ণকলিও নাকি তোমার প্রেমিকা হবার জন্য ধার্য । ওই কালো মেয়ের বয়স কিন্তু আমার চেয়ে বেশি ।”
“ বিশ্ব উষ্ণায়নের জন্য বোধহয়, তাড়াতাড়ি আরম্ভ হয়ে গেছে। তো মাঝরাস্তায় ফেলেছো কেন ?”
“আরে বাড়ির মালিক খোকা, ওটা আমার ফেলা নয়, আমার পিরিয়ডের দেরি আছে । পিরিয়ডের রক্ত বেরিয়ে যায় বলে রক্ত নিতে হয় না, আপনা থেকেই রক্ত তৈরি হয়ে যায়, অনেককে অবশ্য আয়রন ট্যাবলেট খেতে হয় । তিন-চার দিন রক্ত বেরোয়, টানা । ওইটাই সেফ পিরিয়ড সেক্স করার । তুমি এখনও সেক্স করোনি, বুঝতে পারছি ?”
“না, করিনি, পিচ্চি বলল, ভ্যাজাইনাই দেখিনি এখনও, ওই কালো কনের ভ্যাজাইনা বোধহয় খুশমাজেজী নয়, তাই রক্তমাখা প্যাডটা এখানে ফেলে গেছে।”
“ ইনডিয়ান স্কুলে না পড়লে ছেলেরা যে মুকখু হয়, তা তোমাকে দেখে বুঝতে পারছি ; তোমরা শুধু শিট ফাক আসহোল মাদারফাকার বিগ-ও কান্ট ডিক পুসি সাকার লিকার প্রিক স্টিক-টু-আস এইসব বলতে শেখো , কোমরে হাত রাখাই আছে কইন্যার।”
“মাসে এক লিটার রক্ত দেখতে হলে আমার আর সেক্স করা হবে না । রক্ত দেখলে আমার হাত-পা ঠাণ্ডা হয়ে যায় । পিচ্চি নিজেকে নিঃশব্দে বলল, অনেকটা কাশফুলের দোল খাবার মতন করে, কাউকে হত্যা না করলে রক্তের ভয় থেকে আমার মুক্তি নেই, নিজেকে রক্তের পুকুরে চুবিয়ে তবে হয়তো নিষ্কৃতি পাবো।”
“সবচেয়ে ফালতুগুলোই এখানে, এই জগতে, এসে জুটেছে । ইচ্ছে করলেই তারা যে কাউকে মেরে ফেলতে পারে, মেরে ফেলার নির্দেশ দিতে পারে, তার জন্যে তাদের পাপবোধ হয় না, অপরাধবোধ নেই । নিজের কথা ছাড়া তারা আর কিছু ভাবে না, তাই অন্যের দুঃখকষ্টের কথা তাদের মাথায় ঢোকে না, পৃথিবীর রাস্তায় গলিতে রাজপথে মাঠে কাতরাবার জন্যে আধমরা করে ছেড়ে দিয়ে চলে যায় । মানুষ না খেতে পেয়ে মরলেও তাদের কিছু যায়-আসে না । মাথামোটা এইসব গাঁড়ল আঁড়ল চাঁড়ল ষাঁড়ল, বাঁড়লগুলোর জন্যে এই জগত ছাড়া আর অন্য জগত নেই, এটাকেই তারা শান্তি মনে করে, তারা ভাবে পাবলিক তাদের এইজন্যে পছন্দ করে, এমনকি ভালোবাসে ।”
“জিভে ঠোঁট বুলিয়ে ফর্সা কইন্যা বলল, আমাকে পেতে হলে, আমি তোমাকে সম্পূর্ণ নেবো, ইন্সটলমেন্টে নয়, টপ টু বটম ইন ওয়ান পিস, আমি তোমাকে আমার ভেতরে অনুভব করতে চাই, আমার গভীরতার উষ্ণায়নে, তুমি বলো কবে কখন যাবো তোমার ঘরে, তোমার শ্বাসের সঙ্গে আমার শ্বাস মেশাবো, আমার নাম করে তুমি নদীর ঢেউ হয়ে উঠবে আর নামবে । রক্তের জন্যে ভয় পেও না । প্রত্যেকদিন রক্ত বেরোয় না, ওই কয়েকদিন বেরোয়, বেশ কষ্টকর সেই কয়েক দিন, মনে হয় যাকে পাই তার মাথায় মুগুর বসিয়ে দিই । তুমি অবশ্য বাড়ির মালিক, চুমু বসাবো, ঠোঁটের ওপরে দাঁত চেপে বলল কইন্যা ।”
“তুমি এতোকিছু জানো, তুমি কি কোনো পলিঅ্যামোরাস গোষ্ঠীর মেম্বার ? আমার বাবা অমন একটা গোষ্ঠীতে যোগ দেবার জন্যে বাড়ি থেকে পালিয়ে গিয়েছেন । এই দ্যাখো ওনার চিঠি “।
“ইনটারেসটিং চিঠি, বলল ফর্সারানি, তারপর যোগ করল, যে জগতসংসার নিখুঁত, সেখানে বসবাস করে তুমি কাউকে নিজের হৃদয় না দিয়েও, ফাক করতে পারো । প্রত্যেকটা আঠালো চুমু আর মাংসে প্রতিবার ফোটানো নখের কাচের টুকরো, তোমাকে তোমার হৃদয় থেকে দূরে সরিয়ে রাখবে, বেবি বয়, তাইই হল প্রেম, ভালোবাসা পিরীতি হোয়াটএভার । গোয়ায় রাশিয়ানদের আর হিমাচল প্রদেশে ইজরাইলিদের পলিঅ্যামোরাস গোষ্ঠীরা থাকে বলে শুনেছি, গোপন ডেরায় কান্ট-কক ফেসটিভাল করে ।”
“পিচ্চি বলল, তাহলে, আমি বলি কি, যে রাতে ইচ্ছে চলে এসো, আমি ওই ওপরের মেজানাইন ফ্লোরের ঘরটায় থাকি, কালো কনেকেও বলব আসতে, তিনজনে মিলে পোশাক খুলে বাথটাবের জলে শুয়ে থাকব।”
“ফর্সা কইন্যা ঠোঁটে জিভ বুলিয়ে বললে, জানি, দেখেছি, ল্যাংটো হয়ে ঘোরাঘুরি করছ ; বডিটা ভালোই, লোভনীয়। কিন্তু তিনজন একসঙ্গে হলে গোলমাল হবে তো, কাড়াকাড়ি, টানাটানি, ধস্তাধস্তি । বোধহয় তুমি একটু গোলমেলে । তোমার মাও তো তোমাকে ছেড়ে পালিয়েছেন শুনেছি । এমন তো নয় যে তোমার জন্যই ওনারা চলে গেলেন, ছেলেপুলে হলে হাজারটা ঝামেলা, যাতে পোয়াতে না হয়, তাই পালিয়েছেন ।”
“হতে পারে । একে রক্ত তায় আবার সেই রক্তের সঙ্গে আপোষ করে সেক্স । আমার দ্বারা কিছুই হবে না দেখছি । তারপর নিজেকে শুনিয়ে নিঃশব্দে বলল, উপায় ওই একটাই, কাউকে খুন করে তার রক্তে সাঁতার কাটা । ফর্সা কইন্যার অজন্তামার্কা চোখে চোখ রেখে পিচ্চি বলল, কিন্তু তোমার আর ওই কালো কনের ফিগার বেশ অ্যাট্র্যাক্টিভ, কোমর কতো সরু, কেমন করে বজায় রেখেছো, টিভির পর্দায় তো বাঙালি মেয়েদের দেখি বুক পেট পাছা সব একই মাপের ।”
“ওরা দুবেলা ভাত-মাছ না খেয়ে থাকতে পারে না, ফাস্টফুড খায় স্টুডিওতে, পিৎজা, পাস্তা, ম্যাগি, বার্গার, ফ্রেঞ্চ ফ্রাই, ক্রাঞ্চি ট্র্যাফো, হুপার, ফ্রস্টি, কোলা এটসেটরা । তুমি তো হোমো হয়ে যেতে পারতে । পুরুষে-পুরুষে সেক্স ।”
“অ্যাঃ, খালি গায়ে পুরুষদের সারা দেহে চুল দেখলে আমার বমি পায়, স্বপ্নে অবশ্য ওনাদের ব্যাকসাইড বেশ লোভনীয় মনে হয়, আঁড়ল গাঁড়ল চাঁড়ল ষাঁড়ল বাঁড়লদের ব্যাকসাইড সারা পৃথিবীতে একই রকম, লোভনীয় । কিন্তু ঘুম ভাঙলেই তারা শিম্পাঞ্জি, গোরিলা বা বেবুন । তুমি যাও না কোনো গোরিলার সঙ্গে সেক্স করতে ।”
“ওফ, দারুণ হবে, নেয়ানডারথালের সঙ্গে সেক্স করে কতো গুহামানবী ওই কালো কনের মতন ফ্যামিলি পয়দা করেছে ।”
“তুমি ওদের হিংসে করো ?”
“ইউ মিন ঈর্ষা ? অনেককে অনেক কারণে ঈর্ষা করি, তা কি আর ছাই মনে থাকে ! তোমাকেই তো ঈর্ষা করি এই এতো বিশাল বাড়ির মালিক হবার কারণে । একদিন দেখেছিলুম কালো কনেকে তুমি লাইন মারছিলে ; মেয়েটা এমনভাবে হাঁটছিল যেন সারা শরীর থেকে লিবার্টি ইকুয়ালিটি ফ্র্যাটারনিটির সোনার গুঁড়ো ঝরে পড়ছে, যেন এক্ষুনি বেরিয়ে এসেছে ফরাসি বিপ্লব আর নভেম্বর বিপ্লবের খুনোখুনি সেরে।”
“পিচ্চি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, ওঃ, যদি থাকতে পারতুম ওই বিপ্লবগুলোতে ! শবের ওপর দিয়ে ঝাণ্ডা নিয়ে দৌড়োতুম, বিপ্লবের জয়গান গাইতে গাইতে, সবার জন্য স্বাধীনতা, স্বাধীনতা সাম্য শান্তি, স্বাধীনতা সাম্য ভ্রাতৃত্ব, সাম্য শৃঙ্খলা শান্তি ।”
“ওকে শুনিয়ে ফর্সা কইন্যা বলছে, শুনতে পেল পিচ্চি, ওর দিকে পিঠ আর মুখ করে, যাতে পিচ্চি মেয়েটার পাছার ভাঁজ দেখে নির্ণয় নিতে পারে, কালোকে টানবে নাকি এই ধলাকে ? ফর্সা কইন্যা বলছিল, আমরা সবাই একা, সেক্স করার সময়েও একা, জন্মাই একা, মারা যাই একা, বুড়ো বয়সে দেখবে যে নানা মানুষের সঙ্গে মেলামেশা সত্ত্বেও, আমরা সারাদিন একা, তাই তো মানুষ নিজেকে শ্রদ্ধা করে, অন্যের হৃদয়ে ঢুকে একাকীত্ব শেষ করা যায় না, সেখানে আনন্দ খুঁজতে যাওয়া বোকামি।”
“আমি বলি কি, কালো কনে সোনার গুঁড়ো ঝরায়নি, কলেজের নির্বাচনে ভোট দিয়ে ফিরছিল, পায়ে তাই নাচ লেগেছিল ।”
“ফর্সা কইন্যা, জিভে ঠোঁট বুলিয়ে বলল, কলেজের নির্বাচন, ও তো আগে থাকতেই সদস্যরা নির্বাচিত, নির্বাচনের আগেই। এ তো একোল মণ্ডিয়াল নয়, দেশি কলেজে নতুন সদস্যদের অনেক হ্যাপা, মেয়ে সদস্য হলে যা হয় তা মেয়েরাই বলতে পারে, বেবি বয় ।”
রিমা খান নোট নিলেন, এই ছোঁড়ার পরিবারে কেউ লেখক-টেখক ছিল কিনা তার খোঁজ নিতে বলতে হবে ভোমসোকে ; খাতায় রোজনামচার বদলে উপন্যাস লিখছে যেন । কিংবা রেকর্ড রাখছে কোনও কারণে । কিন্তু কারোর মার্ডারের এফ আই আর তো হয়নি ; হয়েছে তিনজনের উধাও হবার, পিচ্চি আর ওর মা-বাপের ।
“ভোট ? তোমার তো এখনও ভোট দেয়া হয়নি ? যাকগে, তোমার ঘরে চলো, তোমাকে আমার নেকেডনেস দেখাবো, তুমি দেখবে, তোমাকে আমি দেখাব যে সব সময়ে রক্ত বেরোয় না । তুমি যে গানগুলো বাজাও আমি তা গাইতে পারি । চলো, শোনাবো তোমাকে। দুজনে মিলে নাচাও যেতে পারে গানের তালে তালে ।”
“পিচ্চির মনে পড়ল, অ্যাডভোকেট মশায় সাবধান করে দিয়েছেন, যেন ভাড়াটে কনে আর কইন্যা ওকে প্রেমের জালে ফাঁসিয়ে না দেয় ; প্রেম আর প্রেমের জাল দুটো আলাদা ব্যাপার -- প্রেমের জাল মানে সেক্স করে প্রেগনেন্ট হয়ে সম্পত্তির দাবিদার হবার চেষ্টা। বাড়ির লোভে ফাঁসাতে পারে ; কালো কনেও একই প্রোপোজাল দিয়েছে । ফাঁসাকগে, নিজেকে নিঃশব্দে বলল পিচ্চি, দুজন একই সঙ্গে প্রেগন্যান্ট হলে সুবিধে।”
“তুমি কি আমাকে তোমার প্রেমের জালে ফাঁসাতে চাইছ, জিগ্যেস করল পিচ্চি, কইন্যার চোখের দিকে কাছ থেকে তাকিয়ে। ফর্সা তখন মাথা ঘুরিয়ে পিচ্চির দিকে বুক এনেছে, কাছাকাছি ।”
রিমা খান নোট নিলেন, এই তিনশো ষাট ডিগ্রি মাথা ঘোরাবার গল্পটা কেন ঢোকাচ্ছে বারবার, কোনো ইশারা দিতে চাইছে কি ছোঁড়াটা ?
“হ্যাঁ, ধরে নাও চাইছি, স্কার্ট-ইজের পরা বউ আর তার ট্রাউজার-স্কুলশার্ট ইউনিফর্ম পরা স্বামী, বেশ মানাবে কিন্তু, তোমার টাকায় উদয়পুরের হোটেলে গিয়ে বিয়ের পার্টি দেয়া যাবে ।”
“তোমার নাম কি, পিচ্চি জিগ্যেস করলো কইন্যাটিকে ।”
“আমার নাম ওলেঙ্কা, জিভে ঠোঁট বুলিয়ে বলল কইন্যা, কোমরে দুই হাত রেখে, পা ফাঁক করে দাঁড়িয়ে ।”
“কালো কনের নাম বিন্নি, বলে, পিচ্চি জিগ্যেস করল, আচ্ছা উলঙ্গ হবার কি কোনো রঙ হয় ? কালো বলে তার নগ্নতার রঙ কালো হবে এমন তো কোনো তর্ক হতে পারে না ! তোমার নেকেডনেসের রঙের সঙ্গে ওই কালো কনের নেকেডনেসের পার্থক্য হয়তো নেই ।”
“তা ঠিক, বলল ওলেঙ্কা, নগ্নতার রঙ হয় না । যারা কখনও কোনো নগ্নদেহকে নিজের দেহ দিয়ে ঢাকেনি বা অন্যের দেহ দিয়ে নিজের নগ্নতাকে ঢাকেনি, তাদের কাছে নগ্নতার রঙ থাকতে পারে ।”
“ওলেঙ্কা ? আরে, আমার বেডরুমের ভেতর দিয়ে ইকোল মণ্ডিয়ালে পৌঁছোবার যে রাস্তা আছে, তার শেষে যে বিশাল নদী, নদীতে নৌকো বাঁধা আছে, তাতে যে দুটো মেয়ে আমাকে ডাক দেয়, দেখতে উবহু তোমার আর বিন্নির মতন, তাদের নামও ওলেঙ্কা আর বিন্নি, কিন্তু তাদের দেশে মেয়েরা বুক খোলা রাখে ।”
“পিচ্চি সত্যি কথাই বলেছে । আমি ওর পেছন-পেছন গিয়ে নিজের চোখে দেখেছি। আমি তো লেখক, লেখকের কাজ উন্মচিত করা কিংবা দেখা, তাই দেখতেই হয়েছে । লিখতে হলে সৎ হতে হয়, এমনকিছু লিখে ফেলতে হয় যা কেউ কখনও পড়বে না, নিজের জীবন সম্পর্কে যা ভাবছো তা কাউকে জানতে দেবে না, অন্যদের জীবনকে পড়তে হবে, তাদের ছাপা-জীবন নয়, সামনে থেকে দেখা জীবন, লিখে যেতে হবে যাহোক আবোল তাবোল, রোজ একটু, এক চিলতে যা কেউ কখনও জানবে না । আমি তাই সবায়ের দিকে নজর রাখি । নিজের চোখে দেখি আর লিখি ।”
রিমা খান নোট নিয়ে রাখলেন, ভোমসোকে সঙ্গে নিয়ে পিচ্চির ঘরটা ইনভেসটিগেট করতে হবে আর পিচ্চি কেন একজন লেখকের কথা উল্লেখ করছে সেটাও রহস্য ।
“ জিভে ঠোট বুলিয়ে কইন্যা ওলেঙ্কা বলল, চলো তাহলে, যাওয়া যাক সেই দেশে, আমি বুক খুলে রাখব । স্নানের ঘরে আয়নার সামনে রোজ খুলি, আজ তোমার চোখের সামনে খুলে রাখব, দেখবো তোমার চোখের তারায় রিফলেকশান পড়ে কিনা । দেহের স্বাধীনতাবোধ হলো ভার্জিন যুবকের সামনে উলঙ্গ হয়ে দাঁড়ানো, বা যুবকের পক্ষে ভার্জিন যুবতীর সামনে ল্যাঙটো হয়ে দাঁড়ানো, কোনোরকম প্রতিদানের আশা ছাড়াই, কোনো লাভের আনন্দ বা ক্ষতির আতঙ্ক ছাড়াই। তখনই স্বাধীনতা ভরে উঠবে কানায় কানায়, যাতে উপুড় করে ভরে দেয়া যায়, ভরে নেয়া যায় ।”
“আমি তোমাকে, যখন তুমি বুক খুলে রাখবে, মা বলে ডাকব, বিন্নি এলে তাকেও মা বলে ডাকবো। তোমাদের তো দুধ নেই, তবু যা পাই তাইই খাবো, হাওয়া খাবো, পারফিউম খাবো, ঘামের নুন খাবো ।”
“সেটাই তো হওয়া উচিত । তুমি যখন পোশাক পরে নেবে তখন তোমাকে বাবা বলে ডাকব, কেমন ? ওনাদের অ্যাবসেন্স এইভাবেই মিটুক ।”
“ইয়েস, লেট দি সিনার্স টেক ওভার দি ওয়র্লড ।”
“তাই হবে । জন্মে অবধি আমার ইচ্ছে করেছে পুরুষ হবার । তোমার বাবা ডাকে সেই আশ মিটিয়ে নেবো । ইনসেশচুয়াস সম্পর্ক পাতিয়ে ফেলবো ; এটাই একমাত্র সাম্যবাদী সম্পর্ক, অ্যাডাম আর ইভের সম্পর্ক ।”
“ জিভে ঠোঁট বুলিয়ে কইন্যা ওলেঙ্কা বলল, এই দ্যাখো, আমার কব্জিতে এই কাটার দাগ, আমি আত্মহত্যার চেষ্টা করেছিলাম একবার, লাইফ বড়ো বোরিঙ হয়ে গিয়েছিল । আমার ধারণা ছিল না যে বাবার ক্ষুর কব্জির ওপরে চালিয়ে জীবনের ধারাটাই বদলে যাবে, বাড়ির লোকেরা সবাই আমাকে ভালোবাসবে, প্রতিবেশিরা দেখা হলে মুচকি হেসে জানতে চাইবে কেমন আছি । তারপরেও তো দিব্বি বেঁচে আছি, বেঁচে থাকতে মজা লাগছে, ভাগ্যিস কব্জিটা কেটেছিলাম । এইভাবে তুমি নিজের ভেতরের চাপ বের করে দিতে পারো, তুমি নিজেকে পালটে ফেলতে পারবে, এই যেমন এখন আমি ভালো দেখতে যুবকের সঙ্গে এক রাতের জন্য শুতে ইতস্তত করি না, নিজের মুড তো নিজেই গড়ছি, হেলাফেলায় যৌবনটা কাটিয়ে ফেলতে হবে, বুঝলে, বেবি বয় !”
“আমি বলি কি, বেবি বয়, কেন ?”
“তোমার কানে তো ছ্যাঁদা রয়েছে, দাঁড়াও, আমার টপ দুটো তোমার কানে পরিয়ে দিই, তাহলে ম্যাচো মনে হবে” । ওলেঙ্কা নিজের কান থেকে খুলে স্ফটিকের টপ দুটো পরিয়ে দিল পিচ্চিকে । কাছাকাছি আসার দরুন, ওলেঙ্কার শ্বাসের গন্ধে পিচ্চির লিঙ্গ দাঁড়িয়ে পড়েছিল আর বিঁধছিল ওলেঙ্কার উরুতে। ওলেঙ্কা উরু সরিয়ে বলল, “দাড়াও, সবুর করো, সবুরে মেওয়া ফলে ।”
“পিচ্চির কানে টপ দুটো পরিয়ে দিয়ে কইন্যা ওলেঙ্কা পিচ্চিকে ঘিরে নাচতে আরম্ভ করল, আর গাইতে লাগল । পিচ্চিও কইন্যা ওলেঙ্কার হাত ধরে ওর গানের তালে হেড ব্যাং করে নাচতে লাগল। মেয়েটা বেশ চটচটে, ঝুরঝুরে, ফুলকো, তুলোট, শিরশিরে, ভুরভুরে, চুলবুলে ।
অনেক ভাগ্যের ফলে চাঁদ কেউ দেখিতে পায়।
অমাবস্যা নেই সে চাঁদে দ্বিদলে তার বারাম উদয়।।
যেথা রে সে চন্দ্র-ভুবন
দিবারাত্রি নাই আলাপন
কোটি চন্দ্র জিনি কিরণ
বিজলি চঞ্চলা সদায়।।
বিন্দুনালে সিন্ধু-বারি
মাঝখানে তার স্বর্ণগিরি
অধর চাঁদের স্বর্গপুরী
সেহি তো তিনি প্রমাণ জায়গায়।।
দরশনে দুঃখ হরে
পরশনে সোনা করে
এমনি মহিমা সে চাঁদের
লালন ডুবে ডোবে না তায়।।
রিমা খান নোট নিয়ে রাখলেন, এই ওলেঙ্কা আর বিন্নি কইন্যা-কনে দুটোকে জেরা করে ওদের চরিত্র বুঝতে হবে, সমাজ পারমিসিভ হয়ে গেছে বটে, হরমোনের ট্যাবলেট আর প্রেগনেন্সি কিট বাজারে আসার দরুণ মেয়েরা নিজের বডি সম্পর্কে নির্ণয় নিচ্ছে, কিন্তু এই মেয়েটা তো বড়োই সাহসী , নাকি পিচ্চি নামে ছোঁড়াটার গাঁজাখুরি কল্পনা ! পলিঅ্যামোরাস গোষ্ঠীর খোঁজে পিচ্চি গোয়া কিংবা হিমাচল প্রদেশে বাপের সন্ধানে চলে গিয়ে থাকতে পারে, ভোমসোকে বলতে হবে ওই দুই রাজ্যে পিচ্চির ফোটো পাঠিয়ে খোঁজ নিতে বলতে হবে পুলিশ বিভাগকে । রিমা খান এবার তিন নম্বর খাতা পড়া আরম্ভ করলেন ।
৩
“বাবার অঢেল টাকার মালিক আজ পিচ্চি । গার্জেন আছেন, অছি, বাবা ওনার টেঁটিয়া বন্ধু অ্যাডভোকেটকে পাওয়ার অব অ্যাটর্নি দিয়ে পিচ্চির টঙে বসিয়েছেন । গার্জেন রবিঠাকুরের গানের ভক্ত, দাড়ি গোঁফ আলখাল্লা রবিঠাকুরের, গলার আওয়াজও, শুধু চশমাটা গান্ধির । পিচ্চি জানে উনি বিয়ে করে অপগণ্ড অশিক্ষিত ছেলে পয়দা করেছেন, তারা কোনো কাজের নয় ; বউ মরে যাবার পর বিয়েও করেননি, করলেই পারতেন, আদালতের কচি এক মেয়ে-উকিল তো ওনার অ্যাসিস্ট্যাণ্ট । বেচারা অ্যাডভোকেট মন খারাপ হলে রেড লাইট এরিয়ায় গিয়ে মৌজমস্তি করেন ; অনেক সময়ে বড়ো ছেলেটাকে সঙ্গে নিয়ে যান, তার যাতে খুঁতখুঁতুনি রোগ না হয়, মেজ না সেজ একটা ছেলের তো স্কিৎসোফ্রেনিয়া ; ওই অপগণ্ডদের জন্য বিয়ের কনে পাওয়াও কঠিন, একবার একজন কাজের মেয়েকে বড়ো ছেলের বউ হবার প্রস্তাব দিয়েছিলেন, সে কাজ ছেড়ে যাবার সময়ে গাছকোমর বেঁধে থুতনি তুলে বলে গিয়েছিল, ‘বিছানার লগে পাত্রী খুজতেসেন তো, আগে পোলারে চাকরি করানোর লগে পাঠান, পরে বিছানায় তুইল্যা কাজের মেয়ের শশুর হয়েন।”
“পিচ্চি অ্যাডভোকেটের কথা দুবার কিংবা তিনবার শোনার আগে চোখ কুঁচকে বলে ওঠে, আজ্ঞে, আমি বলি কি, কী বললেন, আরেকবার শুনতে পেলে ভালো হয় ।”
“পিচ্চিকে অন্য শহরে পাঠিয়ে দিতে চেয়েছিলেন ডুপলিকেট রবীন্দ্রনাথ, মানে পিচ্চির অছিবাবু। সম্ভবত যাতে ওনার সামনেই পিচ্চির ভাঙা গলা গমগমে না হয়ে ওঠে, বুকে-গোঁফে চুল দেখার আগেই, দেরাদুন, মুসৌরি, দার্জিলিঙ, আজমের, পিলানি, কোথাও বোর্ডিঙ কলেজে । বাড়ুক সেখানে ।”
“পিচ্চির ঘরের ভেতর দিয়ে জঙ্গল পেরিয়ে নদীর পারের স্কুলের কথা জানেন না অ্যাডভোকেট মশায় ; পিচ্চি জানায়নি ওনাকে ; জানালে উনি নির্ঘাত সঙ্গে যেতে চাইবেন ।”
“ পিচ্চির মাথায় কোঁকড়া-কোঁকড়া চুল, সেলুনের নাপিতদের কাটতে বেশ অসুবিধা হয়, তাই ও আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেই নিজের চুল ছাঁটে ।”
“রবিঠাকুরের একটা গান শোন, বলে, রবিঠাকুরীয় গলায় রামধুনের সুরে গেয়ে ওঠেন অ্যাডভোকেট । পিচ্চি শোনে খোনাকন্ঠী গান।”
“টেবিলের উল্টোদিকে এক মক্কেল মুণ্ডু ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে বসে-বসে হাই তুলছিল, হাই মাঝখানে থামিয়ে বলে উঠল, ‘রবিঠাকুরের গানে তাড়ি আনলেন কোথ্থেকে ?’ এগান রবিবাবুর নয়, বোধ হয় কোনো আধুনিক কবির, কিংবা আপনার ছেলেদের কারোর, ওরা শুনলুম তাড়ি ধরেছে ।”
“তুমি যদি জানতে পারো যে কী ঘটতে চলেছে, যদি জেনে যাও নিকট ভবিষ্যতে পরপর কী ঘটবে, তোমার কৃতকর্মের ফল যদি জেনে যাও, তাহলেই ভরাডুবি । তুমি হয়ে যাবে শিবের মতন চিৎ, খড় বেরিয়ে আসবে ভাসানের পর, কালীঠাকুরের পা তখন ভেসে সমুদ্রে গিয়ে পড়েছে । তোমার খাওয়া দাওয়া সব বন্ধ হয়ে যাবে, হাসাহাসি মুখ থেকে মিলিয়ে যাবে, কাউকে কখনও নিজের করে নিতে পারবে না, তা সে ওলেঙ্কা হোক বা বিন্নি বা কইন্যা-কনে দুজনেই ।”
“অ্যাডভোকেটের কেরানি বললে, ‘স্যার আমার মনে হয়, আধুনিক সরকারি কোনো কবির, গান লিখতেন কিনা জানি না, নামটা আজকাল প্রায়ই ছেলে-ছোকরাদের মুখে শুনি কিনা; ওই যে ছোকরাগুলো দাড়ি-গোঁফ রাখে, চোখে পিচুটি, কাঁধে ঝোলা, দাঁত মাজে না, ল্যাটিন কোয়ার্টারে গিয়ে দিশি মদ খায় ।”
“মক্কেল আদালতে মামলা লড়ছে, হারতে রাজি নয়, বললে, ‘তাহলে সেই কবি, যিনি গাছপালা নদীটদি নিয়ে লিখে গেছেন, হয়তো ছন্দের খাতিরে তাড়ি এসে গেছে।”
“অ্যাডভোকেটের ফাইনাল নির্ণয়, ‘রবিঠাকুরের গানের সুরে গাওয়া যেকোনো গানই রবীন্দ্রসঙ্গীত। কোনো দাড়ি-গোঁফ ছেলে-ছোকরার লেখা হলেও ক্ষতি নেই ; আমার মেজ ছেলের দাড়ি আছে।’”
“পিচ্চি বিরক্ত, হেড ব্যাং করছিল, বললে, ‘আমি বলি কি, নিজে একটা গ্র্যাজুয়েট হবার সংস্হায় ভর্তি হয়ে যাবো ।”
“পিচ্চি জানে, রবীন্দ্রনাথ আঁকা পশ্চিমবঙ্গের উইখাওয়া মানচিত্র আঁকার চেয়ে সহজ, চুলের গোছা পেলেই হল । গান শুনে পিচ্চিও মাথা নাড়ায়, তবে রবিঠাকুরের নয়, মগজে বাজতে-থাকা মেটালগান, হেভিমেটাল, ডেথমেটাল, হোয়াইট মেটাল, জোম্বি, গোজিরা । সেই মাথা নাড়ানোকে বলে হেড ব্যাং, মাথার ভেতরে যে ব্যাঙগুলো থাকে তারা বর্ষাকাল এসে গেছে মনে করে নাচে ।”
“টয়লেটে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে ল্যাংটো পোঁদে হেড ব্যাং করে পিচ্চি, যখনই ঢোকে “।
“অ্যাডভোকেট গান্ধিছাপ চশমা টেবিলের ওপর থেকে তুলে অপ্রস্তুত কাশি কেশে নিয়ে ঘড়ঘড়ে গলায় বললেন, ঠোঁট চেবাতে-চেবাতে, তোমাকে একোল মণ্ডিয়াল স্কুলে ভর্তি করে দেয়া হয়েছিল । দিশি স্কুলে তোমার বখে যাবার চান্স ছিল। এখন বলো, কোন মেয়েটাকে তোমার ভালো লাগছে, কইন্যাকে না কনেকে ? দুজনকেই নিশ্চয়ই ? তা তুমি দুজনের সঙ্গেই সম্পর্ক চালিয়ে যাও, দুজনকেই খেপে-খেপে ভালোবাসতে থাকো, ওয়ান অ্যাট এ টাইম অর বোথ টুগেদার অ্যাট দি সেম টাইম, বাসতে-বাসতে জানতে পারবে কাকে ভালোবাসা বলে, আমি তাই আইডিয়াল বডির ভাড়াটে সেলেক্ট করেছি তোমার জন্যে, নইলে তো দুটো ছোঁড়াকেও ভাড়া দেয়া যেতে পারতো ।”
“শুনতে বিদকুটে মনে হলেও, বিপ্লবী হতে হলে প্রেমিকের রসে বুক আর অণ্ডকোষ ভরা থাকা উচিত, এই দুটো বৈশিষ্ট্য ছাড়া আসল বিপ্লবী হতে পারবে না । প্রত্যেক মানুষের হৃদয়ে ধ্রুবসত্য লুকিয়ে থাকে, তা বাজে হোক বা ভালো । পরিস্হিতি যতোই জটিল হোক না কেন, বাইরে থেকে লোকে তোমাকে যেভাবে ইচ্ছে যাচাই করুক না কেন, সত্যের গভীরতা এক ইঞ্চি হোক বা ডিপ টিউবওয়েলের মতন অনেক তলায়, একবার যদি হৃদয়ের ভাঙা টুকরোগুলো সেলাই করে নাও, দেখবে যে প্রথম সঙ্গমের ধাতুরসের ফোয়ারার মতন সত্যের ঝর্ণায় তুমি স্নান করছ । জীবনে সবচেয়ে আনন্দদায়ক ভাবনা হলো যে, কেউ তোমাকে ভালোবাসছে । নিজেকে ভালোবাসো, বুঝতে পারবে কাকে বলে ভালোবাসা ।”
“ পিচ্চি বলল, চেষ্টা করছি, আধুনিক যুগের বাঙালিসমাজে বিশ্বরেকর্ড করার জন্য, ফ্রক-ইজের পরা ব্রাইড আর হাফপ্যান্ট-স্কুলড্রেস পরা গ্রুম । উদয়পুরের হোটেলে গ্র্যাণ্ড পার্টি । নয়তো লেহেঙ্গা-শাড়িতে কালো বিন্নি আর আমি লালধুতি-সবুজ পাঞ্জাবিতে, কোনো হোমস্টেতে, পাহাড়ি গ্রামে । কিন্তু কোনো মন্তর বা পুরুতের ব্যাপার থাকবে না, জাস্ট ফুলশয্যা, মানে জাস্ট শয্যা, শয্যাটাই আসল।”
“আরে বিয়ে করতে হবে না, দুজনের সঙ্গে লিভ টুগেদার করো, বললেন অ্যাডভোকেট।”
“জানি, আপনাকে বলতে হবে না।”
“বই পড়ে-পড়ে, আর বাবা মা দুজনেরই চোখ খারাপ ছিল বলে পিচ্চিরও চার বছর বয়স থেকে চশমা পরতে হচ্ছে, যদিও চোখের ডাক্তার বলেছেন যে কয়েক বছরে ওর চোখের দৃষ্টি ঠিক হয়ে যাবে, তবে ও যেন নাকের ডগায় বই ঠেকিয়ে পড়ার অভ্যাস ছাড়ে, ন্যাশানাল জিওগ্রাফিক, হিসট্রি চ্যানেল ও অ্যানিমাল প্ল্যানেট যেন রাত জেগে ঘর অন্ধকার করে না দ্যাখে ; পিচ্চি দিনের বেলায় অন্যের সামনে চশমা পরে না ।’
“জ্ঞানই ক্ষমতার উৎস, খারাপ কাজ করার ক্ষমতা ; পিচ্চি জানে, ম্যাস্টারবেশন করে জেনেছে, ওর গা থেকে সেই সময়ে এক রকমের গন্ধ বেরোয়, ক্ষমতার গন্ধ, মানুষের দেহের গন্ধ নয়, অতিমানবের গন্ধ, রাক্ষসের বা দানবের বা দেবতাদের শরীরের সুগন্ধ, তা এমনই শুভ আর জৈব যে, তার কাছাকাছি হলে যে কোনো তরুণী সেই গন্ধে মোহিত হয়ে ওকে ভালোবাসতে বাধ্য হবে ।’
“অ্যাডভোকেট বললেন, মেয়ে দুটোকে পাশে বসিয়ে ট্রিপল এক্স অ্যাডাল্ট ফিল্মও দেখতে পারো তোমার কমপিউটারে, তবে তোমার মতন বয়সে বোধহয় শরীরে সাড়া জাগে না আমাদের দিনকালের মতন, তখন কম বয়সে বিয়ে হতো, সাড়া জাগতো। অ্যাডাল্ট হও, তখন নিজের ইচ্ছেমতো খরচ করতে পারবে, অ্যাডাল্ট লাইফ লিড করতে পারবে । এখন যদি কিছু করি অবশ্যই প্রিকশান নেবে । কনে আর কইন্যাকেও বলে দিয়েছি প্রিকশান নিতে, ওরা অবশ্য তা জানে, কলেজ ইউনিয়ানের সদস্য হতে হলে প্রিকশান নেয়া শিখতে হয় ।”
“স্যার আমি বলি কি, বেশ কিছুকাল ম্যাস্টারবেট করি, তার আগে নাইটফল হতো, স্বপ্নে পলিটিশিয়ানদের পোঁদ দেখতুম আর কিছু করার আগেই নাইটফল হতো, হয় এখনও, পিচ্চি বলল অ্যাডভোকেটকে। শুনে উনি অবাক হলেন না, কেননা এই উত্তরটাই চাইছিলেন । পিচ্চি বলল, এখন আমার বয়স আঠারো, রাইপ ফর অ্যাডভেঞ্চার্স, আপনি তো রেড লাইট এরিয়ায় যান নাইট শিফ্ট করতে, বড়ো ছেলেকে নিয়ে, আমাকেও নিয়ে চলুন একদিন, আই মিন একরাতে ।”
“অ্যাডভোকেটকে পিচ্চি মিস্টার মউসিয়ান বলে ডাকতো, ওনার গান গাইবার দোষ আর ইরানি উঁচু নাকের কারণে তো বটেই, আর ছেলের সঙ্গে রেড লাইট এরিয়া ভিজিটের কারণে ; কিন্তু বাবা উধাও হবার পর ওই নামটা আর ব্যবহার করে না। তবে পিচ্চি ভাবে যে ওনার নাক ইরানি অথচ ওনার ছেলেদের নাক মোঙ্গোলিয়ান কেন ।”
“নিশ্চয়ই নিয়ে যাবো, ভ্রু কুঁচকে ঠোঁট চিবিয়ে বললেন অ্যাডভোকেট, তার আগে কনে আর কইন্যার কাছে ট্রেনিঙ নিয়ে নাও।”
“যখন কোনো লোক তোমার সঙ্গে কথা বলার সময়ে চোখের দিকে সরাসরি তাকায়, তার মানে তোমার কথাবার্তায় তার আগ্রহ আছে । কিন্তু অনেকক্ষণ ধরে তাকিয়ে থাকলে তা ভয় দেখানোর ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায় । কিন্তু চোখ সরিয়ে নিলে, অনবরত অন্য দিকে তাকাতে থাকলে বুঝতে হবে লোকটার তোমার প্রতি আগ্রহ নেই কিংবা বিব্রত বোধ করছে কিংবা নিজের আসল অনুভূতি লুকোতে চাইছে ।”
“লাল রঙের টিশার্ট পরতে পিচ্চির ভালো লাগে, বুকে চে গ্বেভারার মুখ, আর গাঢ় নীল রঙের প্যান্ট, ও জানে, এই রঙে ভিড়ের ভেতরেও বাবা ওকে খুঁজে বের করতে পারতেন ।”
“বুঝতে পারছেন তো ! আমরা সব্বাই পলাতক, কোথা থেকে পালাচ্ছি তা নিজেরা জানি না, কিংবা জানি যে নানা কারণে পালাচ্ছি, একে আরেকের সঙ্গে ধাক্কা লাগছে, তাকে ঠেলে এগিয়ে চলেছি, কোথায় তা জানি না, যে আরাম নিজের বাইরের জগত থেকে পাই, যে ক্ষমতা যোগাড় করি, নিজের জন্যেই করি, সব ক্ষমতাই নিজের জন্যে, কিন্তু অমন ক্ষমতাবোধও ফালতু, কেননা অমন ক্ষমতা থেকে লোকে নিজেকে খারাপ করে তুলেও তা জানতে পারে না । সব্বাই এই ক্ষমতাটাই চায়। খারাপ হবার আর অন্যের ক্ষতি করার ক্ষমতা ।”
“পিচ্চির শাদা প্রাসাদবাড়িতে ওর নিজের আলাদা কয়েকটা ঘর আছে, তাতে গ্যাজেট আর বই বেশি । বাবা বিদেশে গেলেই বই আর সিডি কিনে আনতেন । পিচ্চির দাদুও জার্মানি থেকে অনেক বই আর সিডি পাঠাতেন, জ্ঞান-বিজ্ঞানের । এখন পুরো দোতলা পিচ্চির, ওর ভাল্লাগে না, গ্যারাজের ওপরের ঘরই ভালো । কইন্যা ওলেঙ্কা আর কনে বিন্নি সঙ্গে থাকলে তিনজনে মিলে হেড ব্যাং করে পুরো দোতলা একশো ডেসিবালে ফাটিয়ে দিতে পারবে।”
“পিচ্চির বাবা মিউজিয়ামের কিউরেটর ছিলেন , মানে জাদুঘরের তত্বাবধায়ক, জাদুঘরে উনি সকলের ওপরে, জাদুঘরের দেখাশোনার ভার ওনাকে দিয়েছিল সরকার । বেশি পড়াশুনা করে ফেলে তাকে কাজে লাগাবার চাকরি, টাইম পাস, দাদু বারণ করেছিলেন, তবুও । তাহলে কি মিউজিয়ামই ওনাকে প্রাগৈতিহাসিক জীবনে ফিরে যাবার ডাক দিয়েছে ? হয়তো আফ্রিকায় বা লাতিন আমেরিকায় গিয়ে গুহামানবের পলিঅ্যামোরাস জীবন কাটাচ্ছেন।”
“অ্যাডভোকেট মশায় বলেছিলেন একদিন, গান্ধিছাপ চশমা টেবিলের ওপরে রেখে, ঠোঁট চেবাতে-চেবাতে, মানুষমাত্রেই ফিরে যেতে চায় গুহার জীবনে, স্বাধীনতায়, স্বেচ্ছাচারিতায়, তাই তো অ্যাটম বোমা নামের আগুন আবিষ্কার, নিউক্লিয়ার ওয়ারহেড নামের চাকা আবিষ্কার, ডিজিটাল টেকনোলজি নামের অক্ষর আবিষ্কার, পলিঅ্যামোরাস নামের গুহাসেক্স এসেছে, আমিও ফিরে যেতে চাইছি আফ্রিকার প্রাগৈতিহাসিক জীবনে, কিন্তু ছেলেগুলোই লায়াবিলিটি হয়ে দাঁড়িয়েছে, লোকে বলে ভাগ্যবানের বউ মরে, কিন্তু আমার বউ মারা যাওয়া সত্বেও ভাগ্যবান হতে পারলুম না।”
“কইন্যা ওলেঙ্কা আর কনে বিন্নিকে হাসাতে ভালো লাগে পিচ্চির ; ওরা যখন হাসে পিচ্চি ওদের বুকের দিকে তাকিয়ে থাকে, দুজনের কারোর বুকই নাচে না । যখন পিচ্চির ঘরে গিয়ে ডেথমেটালের তালে নাচে, তখন ওদের বুকও নাচে, তার কারণ ওরা দুজনে পোশাক খুলে পিচ্চির সঙ্গে নাচে । ওরা যে আগে থাকতেই নাচ জানে, ডিসকো-ফিসকোয় গিয়ে নাচানাচি করেছে তা বুঝে ফেলেছে পিচ্চি । তিনজনে মিলে শাওয়ারের তলায় নাচে।”
“বিন্নি বলছিল, ঠোঁটের ওপর বাঁহাত চাপা দিয়ে, ওফ তোমার নাচ দেখে এতো হাসি পায় যে গিগলিঙ ছাড়া আর কিছু করতে পারি না, কেননা তোমার ফ্যামিলি জিউয়েলও গিগল করতে থাকে নাচের সঙ্গে, যেন আমাদের দুজনকে সেলাম করছে, আমি তো হাসতে হাসতে আইসক্রিমের মতন গলে গলে ভিজে যেতে থাকি। বিন্নি মেয়েটা বেশ স্বাদু, ভেষজ, আঙটাখোলা, নাগালকাতর, মিঠুমিঠু, দোলমেজাজী, শরবতীয়া, ঝিনুকখোলা, হৃষ্টবদন । ”
“আমিও ভিজে যাই, বুকের ওপরে দুই হাত ক্রস করে, জিভে ঠোঁট বুলিয়ে বলেছিল ওলেঙ্কা। “
ভোমসোকে ওর থানায় ফোন করে এসিপি রিমা খান বললেন, ভোমসো, তুমি এই মেয়ে দুটোর পেছনে শ্যাডো লাগিয়ে খোঁজখবর নাও, এরা ছাত্রী নয় বলে মনে হয়, পিচ্চির খাতা পড়ে এটা আমাকেও স্ট্রাইক করল যে দুজনের বডি মডেলদের মতন বালিঘড়ি টাইপ কেন, আটপৌরে বাঙালি মেয়েদের মতন ঢেপসি নয় তো ।
ভোমসো বলল, খোঁজ নিয়েছি ম্যাডাম, সরি, স্যার, ওদের গাড়ি আর স্কুটি নিজেদের নামেই । তবু, আমার মনে হয় ওদের নাম ওলেঙ্কা আর বিন্নি নয় । ওরা কোনো কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ে যায় না। সম্ভবত ওরা মিস ইণ্ডিয়া প্রতিযোগীতায় যোগ দিয়ে মডেল হবার জন্য শহরে এসেছিল, তারপর যা হয়, বিজ্ঞাপন বা অ্যাসাইনমেন্ট না পেয়ে ডেটিং র্যাকেটে ঢুকুছে, যদিও হানড্রেড পারসেন্ট শিয়োর নই ।
রিমা খান নির্দেশ দিলেন, তুমি মোটর গাড়িটার ভেতরে কোনো ক্লু পাও কিনা দেখো, হয়তো গাড়িটা সেক্সুয়াল ফুর্তিফার্তার কাজে লাগানো হয় । কিন্তু কেনই বা দুটো মডেলকে ভাড়াটে হিসাবে আনবে অ্যাডভোকেট লোকটা । ওই লোকটার পেছনেও শ্যাডো লাগিও ।
ভোমসো বলল, স্যার, মোটরগাড়িতে আমাদের ডগ স্কোয়াডের মিলি কোনো ক্লু পায়নি, মানে পিচ্চি তাতে কখনও বেড়াতে বেরোয়নি বলেই মনে হয়, ড্রাগের ট্রেসও পায়নি । পিচ্চি লোপাট হবার পর মেয়ে দুটোকে দেখে মনে হয় বেশ ভেঙে পড়েছে । ওরা গাইনাকের কাছেও গিয়েছিল, জানি না রোগ-টোগ আছে কিনা, আমি গাইনাকের ফোন নম্বর দেবো, আপনি একটু খোঁজ নেবেন, আপনার নাম শুনে তথ্য দিতে ইতস্তত করবেন না বলেই মনে হয় ।
রিমা খান বললেন ওদের মোবাইলের সিডিআর যোগাড় করে দেখতে হবে কাদের সঙ্গে ওদের যোগাযোগ আছে।
হ্যাঁ, স্যার, তাই করব, বলল ভোমসো । কিন্তু ওরা মোবাইল ব্যবহার করে কিনা ঠিক জানি না, মালি আর দারোয়ান ওদের মোবাইল ব্যবহার করতে দেখেনি, পিচ্চি থাকতে ল্যাণ্ড-লাইন ব্যবহার করত । আর স্যার, পিচ্চির ব্যাঙ্কের লকার ভাঙতে হয়েছিল ম্যাজিস্ট্রেটের আদেশ নিয়ে, তাতে ওর বাবা-মায়ের চিঠি তো পাওয়া যায়নি, যেদুটো চিঠি পাওয়া গেছে আপনাকে ইমেল করে পাঠিয়েছি, ল্যাপটপে পড়ে দেখে যদি নির্দেশ দেন তো সেই পথে এগোই, আমি তো কোনো পথ দেখতে পাচ্ছি না ।
এসিপি রিমা খান ল্যাপটপ খুলে চিঠি পড়া আরম্ভ করলেন, কেমন যেন আগেকার দিনকালের ভাষা-মাখানো চিঠিটা:
স্নেহের সুহৃদপপতিম,
গত রবিবারে তুমি লাতিন কোয়ার্টারে শুনিলাম আসিয়াছিলে । আশ্চর্য সেই দিনটিতেই বহু কাল পরে আমার কামাই হইল । ইহাতে আমি খুবই কষ্ট পাইয়াছি । তুমি অনেককাল পর অথচ আসিলে ইহাকেই বলে কপাল ! কবে আবার তুমি আসিতে পারিবে জানাইও
ইদানিং কালে কাহারও সহিত বড় একটা দেখা হয় না, তাহার মধ্যে একজনকে মিস করা বড় কষ্টের। ইতিমধ্যে একদিন লর্ড চ্যাটার্লির সহিত সাক্ষাৎ হয়, সে তাহার নব-প্রকাশিত পঞ্জিকা আমাকে দিল -- এইটি তোমার বই । আমি তাহাকে বলিলাম সুহৃদপ্রতিম এইসব কি লেখে, জেনো, পাঠক হিসাবে আমরা বলিতে পারি । তখন সে আমায়-আমাদের ( কেননা সেখানে মসিয়ঁ লাহিড়ি ও অন্যান্য ) তোমার প্রগতি পরায়ণতা বিষয়ক অনেক কথা বলিল একথা আমি কহিলাম ( আমাদের ঝাড়া ৩ -৪৫ হইতে ৭ -৩০ অবধি কোন কথা কহিতে দেয় নাই ) -- দেখ, দারিদ্র্য দুঃখ উচ্চবর্ণেরা মনে রাখে -- আর নিম্নরা ভোগে -- আর কবিতা পদ্য লেখাই একটা বিদ্রোহ -- আবার তাহার বিষয় রূপে এইসব হইবে এ আমার মোটা বুদ্ধিতে মনে হয় না ! সে তখন বহু বিষয়ে আমাদের তত্ত্ব ( তথ্য না ) বলিতে লাগিল আমরা খুবই আকর্ষিত হই ( আকৃষ্ট নহে ) মাঝে-মাঝে ( অবশ্য এখন ) মনে হইতেছিল -- হয়ত তাহার চমৎকার কন্ঠস্বরই আমাদের ভাল লাগিতেছিল । ইহাও ধ্রুব তাহার দৃষ্টিভঙ্গী যারপরনাই তীক্ষ্ণ ! তবে সে দেখিলাম আর কথা সূত্রে বড় বেশী পারসিকিউশনে ভুগিতেছে -- জানি না, ইহা তাহার লেখার বিষয়ও হইতে পারে ।
যাহা হউক এখন তোমার দিনক্ষয় -- কেমনে হইয়া থাকে । আমি ত লোকের সহিত ঝগড়া করিতে করিতে গেলাম, লুই ফিলিপে যিনি অগতির গতি ( তাই ভাবি লুই ফিলিপে, তুমি তোমরা না থাকিলে কবে শালা নিশ্চিহ্ণ হইয়া যাইতাম ) তিনি আলপস পর্বতে গিয়াছিলেন । গত পরশ্ব তাহার সহিত সাক্ষাৎ হয় ।। সে বড় ধরিয়াছিল -- যদি তাহার সহিত লাতিন কোয়ার্টার যাই ! লাতিন কোয়ার্টারে ইদানিং রাত্রে যাওয়া বড় ভাবনার -- মারপিঠ রোজ করা যায় না । ও ভারী মজার কথা বলি -- তুমি মসিয়ঁ লাগুলুকে চেন কি ? ইনিও বুর্জোয়া-যম । নিজে লা ফিগারো কাগজের প্রতিপত্তিশালী কর্মী, একজন অভিমানী ! চেহারায় উচ্চবর্ণ : ফ্রেঞ্চ রিভলিউশানেতে যেমন পরচুলা ফেলিয়া দিলেই যে কোন ভদ্র, ছোটলোকদের সহিত প্রাণভয়ে কোনরূপ মিশিয়া যাইত -- ইঁহার সে উপায় নাই ( গাত্রত্বক হস্তিদন্ত মার্জিত ) ইনি কেমনভাবে -- ধরণী রক্তাক্ত হইবে -- তাহার ছবি মন্ত্রবলে জাগাইলেন । ( রাজনীতি কম্যুনিজম আছে বলিয়া আর কাহাকেও পারভার্স অ্যাবনর্মাল বলিতে হয় না ) -- অবশেষে কহিলেন আত্মস্তূতিতে -- যে আগে আমি পাঁঠা ছিলাম তাই ( মৎলিখিত ) পুস্তকই আপনাকে ঐ অবস্হা হইতে ইদানীংকার অবস্হায় আনিয়াছে । ঐ অভিমানী ব্যক্তি স্বীকার করিলেন । বিশেষে তর্ক হইত । কিন্তু আমাকে উঠিতে হয় -- আমি ভাবিয়া দেখিয়াছি -- ঠাকুর আমাকে বড় ঘরে জন্ম দিয়াছেন ফলে এই সব বাজে ব্যাপারে আমার ভাববার দরকার নাই সমষ্টিভাবে বাঁচিবার মত আমার - শালা গোয়ার্ত্তুমি নাম - পূর্ব্বজন্মকৃত পাপও নাই ।
ঠাকুর করুন তুমি ভাল থাক !
ইতি দাদু
চিঠিটা পড়ার পর এসিপি রিমা খান নোট নিলেন যে এটা অন্য কোনো দাদু অন্য কোনো নাতিকে লিখেছিল, হয়তো তা নিলামে কেনা হয়ে থাকবে । তাই ব্যাঙ্কের লকারে যত্ন করে রাখা হয়েছে । পরের চিঠিটা পড়ায় মন দিলেন রিমা খান ।
সুহৃদপ্রতিমেষু ,
আমি রাতে দাঁত মাজি । দাঁত মাজতে মাজতে ভাবছিলাম তোমাকে কী লিখব । চমৎকার বাড়ি পেয়েছি লণ্ডনে, ইলেকট্রিসিটি আছে, আজকাল এখানে খুব ঠাণ্ডা পড়েছে এ-সবই লেখা উচিত, কিন্তু কী দরকার । একটু আগে লেনটিল-রাইস খেলাম -- টম্যাটো কড়াইশুঁটি ডিম ইত্যাদির --- ওয়ান অব দি মাইটিয়েস্ট ডিশেস আই এভার হ্যাড -- দরকার আছে ? না । বেশ, আমি সুখী নই -- অসুখী । জীবনে কখনো সুখী বোধ করিনি । আমার অসুখী থাকার একটা অধিকারবোধও এতদিনে জন্মে গেছে -- আমি জানি -- আই হ্যাভ এভরি রাইট টু বি আনহ্যাপি, একথা বলারও দরকার নেই । কেবল আনাড়িকেই বলা যেতে পারে যে ঐ ডেলিকেট ডিশ সত্ত্বেও, সুন্দরী স্ত্রী সত্ত্বেও, নরম বিছানা, অতি উষ্ণ লেপ ও তার ধবধবে শাদা ওয়াড় সত্ত্বেও -- আরো কী কী সব সুন্দর চমৎকার যার-পর-নেই আশাতীত সত্ত্বেও -- ইত্যাদি -- যে আমি অসুখী । আমি ভালো নেই -- এ নিশ্চয়ই প্রিন্স হ্যামলেটের পোশাকেও আমাকে বোঝা যাবে ।
তোমাকে হাসতে হাসতে বলেছিলাম আমাদের মধ্যে কে আগে সুইসাইড করবে আমি জানি না । টিনাকে দেখিয়ে বলেছিলাম । বাস্তবিক আমি জানি । শুধু টিনা ও আমার মধ্যে নয় -- আই শ্যাল বি দ্য লাস্ট পার্সন টু কমিট সুইসাইড ; নট দ্যাট আই শ্যাল নট । আই শ্যাল বি দ্য লাস্ট পার্সন আই সে । কারণ আমি কাওয়ার্ড এবং এ কাওয়ার্ড ডাজ নট গিভ ইন ভেরি ইজিলি । বলাবাহুল্য সুহৃদপ্রতিম, আমি পুলিশকে ভয় করি না । আমিও অনিশ্চয়তাকে ভয় করি । যে দিকে দেখি, দেখি কিছুই ঠিক নেই । আগে ভাবতুম মানুষ ভুল জীবন কাটাচ্ছে । তা সংশোধন করে দেওয়া দরকার -- নিজের ত্রুটি ও শিক্ষার কথা লিখে । সে বালখিল্যতা কেটে গেল যথাসময়ে । এখন দেখি প্রত্যেকটি লোক নির্ভুল ও ঠিক জীবন কাটাচ্ছে । যে জন্য বিলডুংসরোমান ( যাকে বলা হয় আত্মজীবনীমূলক ) লেখার আর প্রয়োজন দেখি না । এ-কথা ঠিক যে কেউ কারো কথা শোনে না, কেউ কারো চিঠি পড়ে না । সকলেই, প্রত্যেকটি নরনারী, অ্যাডাল্ট ও অভিজ্ঞ, শিক্ষায় সম্পূর্ণ, কেউ নিউজ ছাড়া আর কিছু পড়ে না । তোমাকে যদি লিখতে পারতুম, স্নান করে এসে দেখলুম টিনা ঘরে নেই, তারপর অপেক্ষা করতে লাগলুম, বিকেলেও বসে রইলুম, বুঝতেই পারলুম প্যারিসে চলে যায়নি রাতে, প্রেতিনীর হাত থেকে আত্মরক্ষার জন্য কিনা দরজা জানলা অমন নিখুঁতভাবে বন্ধ করলুম ! রাত্রেও খেলুম না, এপাশ-ওপাশ করলুম, ভয় তো পাবোই, প্রকৃত ভয়, আমূল ভয় -- নিজের অস্তিত্ব টের পাওয়া যায় এমন প্রকৃত ভয় তো পাবেই, কারণ এ তো আর হিউগোর চাকরি হারাবার কি ভেরলেনের পুলিশের ভয় নয় । হায়, এ অন্য ভয় । শেষ রাত্রের দিকে একটু ঘুমিয়েও পড়লুম । পরদিন লণ্ডনময় গুঞ্জন -- পিঁপড়ের মতন সার দিয়ে লোক আসছে -- লোকে লোকারণ্য -- আমি নিজে গিয়ে সত্তর ফিট নিচে কুয়োর মধ্যে ভেসে ওঠা টিনার সবুজ স্কার্ট-পরা লাশ দেখে এলুম ।
কথার কথা বলছি । এ হতো খবর । হাজার হাজার লোক ইনটারেসটেড হতো । বন্ধুবান্ধব টিনার আত্মীয়স্বজন দাঁতে দাঁত চেপে বলত -- হারামজাদা ! আমার আত্মীয়স্বজন কিন্তু তা বলতে পারত না । তারা আমাকে জানে । জানে, আমি যা করছি তা স্বাভাবিক । আমার জন্য একটি মেয়ের জীবন নষ্ট হওয়া এমন নিষ্ঠুরতা -- এ স্বাভাবিক কারণে তারা জানে আমি অসুখী এবং একজন অসুখী লোকের যে-ভাবে বাঁচা উচিত আমি তেমনি স্বাভাবিক, ঠিক বা নির্ভুলভাবে আমি বেঁচে যাচ্ছি । বাড়ির কাছে আমার এতো কৃতজ্ঞতা সুহৃদপ্রতিম ! কত ক্ষমাহীন অন্যায় করেছি কত ব্যভিচার করেছি মা-দাদা-দিদি-বড়দা -- বিশেষত এমন কী বাবার ওপর -- বাবা ছাড়া আমাদের বাড়ির সকলেই আমাকে কখনো দোষ দেয়নি, সহ্য করেছে ও আবার তা করার সুযোগ দিয়েছেও -- এখন বিয়ের পর সবচেয়ে বেশি সুযোগ করে দেয় ।
যাক । শোনো । কেমন আছো ? হিউগো বড় বেশি নিন্দে করছে তো আমার ! সুহৃদপ্রতিম, আমার হিউগোর নিন্দে করার সুযোগ নেই । বলতে পারি না হিউগো আপনার সম্পর্কে অমুক বলেছিল বা তমুক বলেছিল । আমার ডিগনিটি নষ্ট করতে পারছি না । ভেরলেনের সম্পর্কে আপনি আমেরিকা থেকে আসার পর ও-রকম বলার জন্য আমি দুঃখিত ও লজ্জিত । তার কোনো দরকার ছিল না । আমি কাপুরুষ -- জীবন আমার কাছে আর দুর্বোধ্য নয়, এজন্য আমি ভীত । আমার পুলিশের ভয় নেই । চাকরি হারালে আমি কিছুই হারাব না । আমি সম্পূর্ণ পরাজিত ও ব্যর্থ । কমপ্লিটলি ফ্রাসট্রেটেড অ্যাণ্ড অ্যাবসলিউটলি ডিস্লিউশন্ড বউ দিন আগে থেকেই । কোনো কাজ শুরু করার আগে আমি কখনো কোনো উৎসাহ বোধ করিনি । ব্যর্থ হব জানতাম বলেই এমনভাবে ব্যর্থ হলাম -- নইলে সব হিশেবেই আমি সব দিক থেকে সার্থক হয়েছি। আমার জিবনে এত আশা পূর্ণ হয়েছে -- যা সচরাচর কারো হয় না । বস্তুত আমার জীবনের ‘প্রত্যেকটি’ আশা পূর্ণ হয়েছে ।
শেষ পর্যন্ত কিনা হিউগোও আমার ওপর চটে গেল সুহৃদপ্রতিম, যার প্রতি জীবনে অজ্ঞানতও আমি নিশ্চিত কোনো অন্যায় করিনি । হিউগো সম্পর্কে আমি যে একেবারে নিশ্চিত ! প্রতিহিংসা চরিতার্থ করার জন্য তাকে বেছে নিতে হল দলের মধ্যে কাওয়ার্ডটিকে, বেশ, কিন্তু সে কি মনে করে আমার মুখে চোখে যে ভয়, তা পুলিশের, তা মারধোর খাবার ! হিউগো নিশ্চয় তা ভাবে ।
ইতি আপনার হিংসুটে প্রতিপক্ষ
লর্ড চ্যাটার্লি
রিমা খান একটা সিগারেট ধরিয়ে মনে করার চেষ্টা করলেন এই দ্বিতীয় চিঠির চরিত্রগুলোকে তিনিই ধরেছিলেন কিনা, নামগুলো, ক্রিমিনালরা যেমন গোপন করে, তেমন কিনা, আসল নাম হয়তো অন্য। তবে এই ক্রিমিনাল গ্যাঙটা বেশ বড়ো ছিল মনে হচ্ছে । তিনিই বোধহয় এদের ববিটাইজ করার ভয় দেখিয়েছিলেন, কয়েকজন ববিটাইজ হবার ভয়ে মুচলেকা দিয়েছিল । চিঠিতে তার প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে । ফোন তুলে ভোমসোকে জিগ্যেস করলেন, তুমি এই সুহৃদপ্রতিম লোকটার খোঁজ নিয়েছ ?
ভোমসো বলল, আজ্ঞে স্যার, অ্যাডভোকেটের নামই তো সুহৃদপ্রতিম, দারুন নাম একখানা, তিনি সুহৃদ নন, সুহৃদের মতন । চিঠি দুটো পিচ্চির লকারে পাওয়া গেছে তার কারণ সুহৃদপ্রতিমই তো ওনাদের পাওয়ার অব অ্যাটর্নি হোলডার । রিমা খান জিগ্যেস করলেন, তোমার শ্যাডোরা কোনো খবর যোগাড় করতে পেরেছে ? ভোমসো জানালো, আজ্ঞে হ্যাঁ, মেয়ে দুটোকে অ্যাডভোকেট পেয়েছেন ডেটিঙ অ্যাপ থেকে। সিগারেটের ধোঁয়া উড়িয়ে রিমা খান বললেন, তুমি অ্যাডভোকেটের পেছনে যে শ্যাডো লাগিয়েছো, তা চব্বিশ ঘণ্টার করে দাও, দুজন বা তিনজনকে লাগাও লোকটার পেছনে । পিচ্চির বাবা আর মায়ের হ্যাণ্ড রাইটিঙ যোগাড় করেছ ? চিঠিগুলো ওনাদের লেখা নয় বলেই তো এখন মনে হচ্ছে । ভোমসো জবাবে জানালো, না স্যার, ওনাদের হাতের লেখার স্যাম্পল ওনাদের বাড়িতে পাইনি । আমার মনে হয় অ্যাডভোকেটের দপতরে সার্চ করলে হাতের লেখার নমুনা পাওয়া যাবে, তর জন্যে সার্চ ওয়ারেন্ট চাই । রিমা খান বললেন, তাড়াহুড়ো কোরো না, আগে কোর্টে প্রমাণযোগ্য তথ্য কালেক্ট করো । পিচ্চিদের বাড়ির সামনে আর অ্যাডভোকেটের বাড়ির সামনে সরকারি বা বেসরকারি সিসিটিভি নেই, খোঁজ নিয়েছি ।
রিমা খান ভাবছিলেন, তাঁর বিয়ে করা হয়ে উঠল না তার কারণ তিনি চাকরির শুরু থেকেই মার্ডারারদের ভালোবেসে ফেলেছেন, ভালোবেসে ফেলার দরুন উঠেপড়ে লেগেছেন তাদের ফাঁসিকাঠে ঝোলাবার প্রচেষ্টায় মেতে থাকতে, লোকটা যে হত্যাকারী তা প্রমাণ না করা পর্যন্ত, নির্ভরযোগ্য প্রমাণ সংগ্রহ না করা পর্যন্ত তিনি শান্তি পাননি । খুনিকে ফাঁসির অর্ডার যখন আদালত দ্যায়, রিমা খান লক্ষ করেছেন, তখনই তাঁর অরগ্যাজম হয়, আর তা প্রতিবার হয়েছে । হত্যাকারীকে ফাঁসির হুকুম পাওয়ালে তবেই তাঁর মন ও শরীর শীতল হয় । হত্যাকারীদের এক ধরণের কারিশমা থাকে, আত্মবিশ্বাসী ক্যারিশমা, তাকে ছিঁড়ে হত্যাকারীর মুখের চামড়া তুলে ফেলতে চান উনি । যখন সাব ইন্সপেক্টর ছিলেন, তখন সব অপরাধীকে হাজতে পুরে ববিটাইজ করার হুমকি দিতেন । এক ব্যাটাকে এমন পিটিয়েছিলেন যে সে ব্যাটা মরে গেল আর উনি চাকরি থেকে সাসপেণ্ড হয়ে রইলেন বেশ কয়েক বছর । মার্ডার হওয়া একজন পুরুষের কঙ্কালের হত্যাকারীকে খুঁজে তবে চাকরি ফেরত পেয়েছিলেন । কোনো পুরুষ যদি তাঁকে আকৃষ্ট করে তাঁর মনে হয় এ লোকটা নিশ্চয়ই খুনি কিংবা ভবিষ্যতে কাউকে খুন করবে ।
রমা খান চটে গেলে নিজেকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারেন না, লাথিয়ে জুতিয়ে ব্যাটন ঢুকিয়ে শায়েস্তা করার অভ্যাস তাঁর যায়নি । তাতে সমস্যা আরও বেড়ে যায় জানেন তিনি, তাঁর ওপরের অফিসাররা তাঁকে সামলাতে হিমশিম খান অথচ তাঁর এই ক্ষমতাকে ব্যবহারও করতে চান, নিজেরা তা পারেন না বলে, পুরুষ হয়েও পারেন না, তাঁদের নেকনজর কেবল ঘুষের দিকে, কালো টাকা রোজগারের দিকে । নিজের হিংস্রতাকে বিশ্লেষণ করার চেষ্টা করেছেন রিমা খান, তাঁর মা-ও বলতেন যে মেয়েমানুষের অতো রাগ-দাপট ভালো নয়, কিন্তু নিজেকে নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতাটাই নেই রিমা খানের । কতো মার্ডারারকে তিনি যাবজ্জীবন দিইয়েছেন, ফাঁসিকাঠের মাচান পর্যন্ত পাঠিয়েছেন, কিন্তু কেন তিনি ক্রোধোদ্দীপন সম্পর্কে চরমপন্হী, তার হদিশ পেলেন না । মনোবিদের কাছে কখনও নিজেকে সোপর্দ করতে চাননি, কেননা তা জানাজানি হলে আবার হয়তো চাকরি নিয়ে টানাটানি হবে ।
৪
চার নম্বর খাতায় মন দিলেন রিমা খান । মাত্র দুপাতা ।
“কেউ যদি জানতে চায়, ‘বাবা কী করতেন’, পিচ্চি তক্ষুনি মিউজিয়ামের কিউরেটার কথাটা তো বলেই, তাছাড়া, ও মনে করে যে বেশির ভাগ লোক তো বোকার হদ্দ, জাদুঘর বলতে কী বোঝায় তা জানে না, তাই গড়গড় করে বলতে আরম্ভ করে, মাঝে-মাঝে দুহাত ওপরে তুলে ইনভার্টেড কমার ইঙ্গিত করে ।”
“কইন্যা ওলেঙ্কা আর কনে বিন্নিকেও তেমন করে বোঝাতে লাগল পিচ্চি, নিজের ঘরে বিশাল পালঙ্কে বসে। ওরা দুজনে সোফায়, দুজনের হাতে বিয়ারের টিন, নিজেরা কিনে এনেছে, পিচ্চিকেও খাইয়েছে।”
“জাদুঘর বা সংগ্রহালয় বলতে বোঝায় এমন একটি ভবন বা প্রতিষ্ঠান যেখানে পুরাতাত্ত্বিক নিদর্শনের সংগ্রহ সংরক্ষিত থাকে। জাদুঘরে বৈজ্ঞানিক, শৈল্পিক ও ঐতিহাসিক গুরুত্বসম্পন্ন বস্তুসমূহ সংগ্রহ করে সংরক্ষিত করা হয় এবং সেগুলি প্রদর্শ আধার বা ডিসপ্লে কেসের মধ্যে রেখে স্থায়ী অথবা অস্থায়ীভাবে জনসাধারণের সমক্ষে প্রদর্শন করা হয়। বিশ্বের অধিকাংশ বড়ো জাদুঘরই প্রধান শহরগুলিতে রয়েছে। অবশ্য ছোটো শহর, মফস্বল ও গ্রামাঞ্চলেও স্থানীয় জাদুঘর গড়ে উঠতে দেখা যায়।
অতীতকালে জাদুঘরগুলো গড়ে উঠত ধনী লোকদের ব্যক্তিগত বা পারিবারিক উদ্যোগে কিংবা কোনো প্রাতিষ্ঠানিক উদ্যোগে। এই সব জাদুঘরে সংরক্ষিত থাকত শিল্পকর্ম, দুষ্প্রাপ্য ও আশ্চর্যজনক প্রাকৃতিক বস্তু বা পুরাবস্তু। সারা বিশ্বেই জাদুঘর দেখা যায়। প্রাচীনকালে গড়ে ওঠা আলেকজান্দ্রিয়ার জাদুঘর ছিল আধুনিককালের স্নাতক প্রতিষ্ঠানগুলোর মতন। বিশিষ্ট অভিধানকার জ্ঞানেন্দ্রমোহন দাশের মতে, বাংলায় "জাদুঘর" কথাটি আরবি আজায়ব্ ঘর বা আজায়ব্ খানা শব্দটি থেকে এসেছে। বাংলায় "জাদুঘর" কথাটির অর্থ হল, "যে গৃহে অদ্ভুত অদ্ভুত পদার্থসমূহের সংগ্রহ আছে এবং যা দেখিয়া মন্ত্রমুগ্ধবৎ হ’তে হয়। অভিধান মতে, "জাদুঘর" শব্দের অর্থ, "যে-ঘরে নানা অত্যাশ্চর্য জিনিস বা প্রাচীন জিনিস সংরক্ষিত থাকে।" ইংরেজি মিউজিয়াম শব্দটি এসেছে লাতিন শব্দ থেকে। শব্দটির মূল উৎস গ্রিক শব্দ মউজিয়ন ; যার মানে গ্রিক পুরাণের শিল্পকলার পৃষ্ঠপোষক মিউজদের মন্দির। প্রাচীন গ্রিসে এই জাতীয় মন্দিরগুলোকে কেন্দ্র করে লাইব্রেরি এবং শিল্প পুরাকীর্তির সংগ্রহশালাও গড়ে উঠতে দেখা যেত। ২৮০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে আলেকজান্দ্রিয়ায় প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল এই জাতীয় একটি জাদুঘর। অ্যাথেন্সে প্লেটো প্রথম একটি মিউজিয়াম গ্রন্থাগার গড়ে তুলেছিলেন। যদিও পসেনিয়াসের রচনায় অন্য একটি স্থানকে মিউজিয়াম বলে অভিহিত করা হয়েছে। এটি হল ধ্রুপদি অ্যাথেন্সে অ্যাক্রোপোলিসের উল্টো দিকে একটা ছোটো পাহাড়, আমি দেখে এসেছি। লিজেণ্ড হল যে, মউসিয়াস নামে একজন লোক এই পাহাড়ে বসে গান গাইতেন। বুড়ো বয়সে তিনি সেখানেই মারা যান আর সেই পাহাড়েই তাঁকে সমাধিস্থ করা হয়। তাঁর নামানুসারে পাহাড়টির নামকরণ হয়েছিল মউসিয়ন ।”
“মুখস্ত বুলি ফুরোলে পিচ্চি ছুটে গিয়ে নিজের ল্যাপটপ এনে দেখালো কইন্যা ওলেঙ্কা আর কনে বিন্নিকে, গ্রিসে, মিশরে, কোথায় কোথায় ও গিয়েছিল মা-বাবার সঙ্গে ।”
“পিচ্চির মা বিয়ের আগে কলেজে ইংরেজি পড়াতেন ; পিচ্চি হবার পর চাকরি থেকে ইস্তফা দিয়েছিলেন । বলতেন, ইংলিশ হলো টয়লেট পেপার কালচারের ভাষা ।”
“কইন্যা ওলেঙ্কা আর কনে বিন্নি দুজনেই চেঁচিয়ে উঠল, নো নো, আই ডোন্ট অ্যাগ্রি।”
“আমার মা টয়লেট পেপার ইউজ করতেন ; তোমরাও পোঁদ পোঁছো কাগজে, আমি কিন্তু জল দিয়ে ছুঁচোই, আমার বাবাও জল দিয়ে ছোঁচাতেন। মা ছিলেন খ্রিস্টান আর বাবা ছিলেন হিন্দু। ছিলেন বলছি কেননা ওনারা কোনো ধর্ম মানতেন না। আমারও কোনো ধর্ম নেই, তবে জন্মের পর আমাকে সুন্নত করে দেয়া হয়েছিল, বাবার নির্দেশে, যাতে প্রেম করতে সুবিধে হয় । আচ্ছা, তোমরা তখন দেখিয়েছিলে, আমি ভেবেছিলুম জিগ্যেস করব, কিন্তু ভুলে গেছি, তোমরা দুজনেই ওখানকার চুল কামিয়ে ফেলেছো কেন ?”
“কইন্যা ওলেঙ্কা বলল, কামিয়ে ফেলিনি, লোমনাশক মাখিয়ে নিকেশ করি, তাতে তোমাদের মতন প্রেমিকদের আনন্দ হবে, জায়গাটাও হ্যাপি থাকবে, আর আমরাও স্যানিটারি ন্যাপকিন বাঁধার সময়ে পরিষ্কার থাকবো, নয়তো চুলে-রক্তে একাকার জবজবে হয়ে গেলে বসতে অসুবিধা হবে।”
“তাহলে রিজিয়া সুলতানা, নুরজাহান, মুমতাজ মহল, ওনারা সিংহাসনে বসতেন কেমন করে?”
“তা ঠিক, এই বিষয়ে হিস্টরিয়ানরা কিছু লিখে যাননি, ভবিষ্যতে কেউ লিখবেন হয়তো, এখন পিএইচডি না করলে প্রফেসারি পাওয়া কঠিন, আর বিষয়বস্তুও কমে আসছে । বলল পিচ্চি।”
“পিচ্চির কী মজার ছোটোবেলা ছিল, ওর মায়ের শেষ বাবা একজন জার্মান সাহেব । মায়ের বাঙালি বাবা মারা যাবার পর পিচ্চির দিদিমা একজন জার্মান ডাক্তারকে বিয়ে করে জার্মানির বার্লিন শহরে থাকেন।”
“পিচ্চির জার্মান দাদু বেড়াতে এলে ওর জন্যে অনেক গিফ্ট আনতেন ; একবার উনি একটা ঢিল উপহার দিয়েছিলেন , বার্লিনে যে উঁচু দেয়াল ছিল দুই জার্মানিকে দুভাগ করে, সেটা ভাঙা হলে অনেকে ইতিহাস হিসাবে পাঁচিলের টুকরো নিজেদের বাড়িতে রেখেছে ।”
“পিচ্চি ভেবে রেখেছে যে দুই বাংলা যখন এক হয়ে যাবে তখন সীমান্তের কাঁটাতারের টুকরো ও সংগ্রহ করে রাখবে, সুযোগ পেলেই নেতাদের পোঁদে ফোটাবে ; ওর অবাক লাগে যে মানুষের পেট আর পোঁদ নেতা হলেই কেন ফুলে ফেঁপে পচা মোষের মতন হয়ে যায় ।”
“কনে বিন্নি হাসতে হাসতে, মুখে বাঁহাত চাপা দিয়ে, ডান হাতে নিজের পেছন দিকে হাত বুলিয়ে বলল, নেতা হলে পুরুষদের পোঁদ পোয়াতি বউদের মতন ফুলে ওঠে, টাকাও ফি-বছর ফুলে ফেঁপে দেশের গোদ হয়ে যায়, প্রতিবারের নির্বাচনে নেতাদের টাকাকড়ি চার-পাঁচ গুণ বেড়ে যায়, অথচ ইনকাম ট্যাক্স ওদের পোঁদে বাঁশ করার ঝাড় খুঁজে পায় না।”
“পিচ্চির মা অবশ্য বলেছিলেন যে আর জোড়া লাগবে না দুই বাংলা, ছিঁড়ে-ছিঁড়ে আরও দূরে সরে যাচ্ছি আমরা । সুন্দরবন ভাগাভাগি হয়ে গেছে, এক দেশের বাঘ আরেক দেশের বাঘিনীর সঙ্গে প্রেম করে না, বাঘেদের গুরু ফতোয়া জারি করেছে, পুর্ব সুন্দরবনে বাঘ-বাঘিনীর আরবি নাম রাখতে হবে । বাঁদরের দলও সীমানা অনুযায়ী গোষ্ঠী তৈরি করে ফেলেছে, সীমা টপকে অন্য দল থেকে ফুসলিয়ে মাদি বাঁদর আনতে চায় না, আনলেই দলবেঁধে খামচা-খামচি খেয়োখেয়ি রক্তারক্তি বাঁদুরে দাঙ্গা শুরু হয়ে যাবে । নিজেদের দেশেই হিন্দু মুসলমান বিয়ে হলে দাঙ্গা বাধে কিংবা এক পক্ষের লোকের হাতে আরেক পক্ষ খুন হয়, সেই অবস্হায় তুই ভাবছিস দুটো দেশের বিয়ে হবে, জার্মানির হয়েছে কেননা ওদের দেশে জাঠতুতো-খুড়তুতোতে বিয়ে হয় ।”
“জার্মান হলেও পিচ্চির সঙ্গে ভাঙা-ভাঙা বাংলায় কথা বলতেন জার্মান দাদু, আর পিচ্চি ভুল ধরিয়ে দিতো । দাদু বলতেন মানুষের ভাষা সবচেয়ে নোংরা আর ক্ষতিকর জিনিশ, মানুষের উচিত হাতিদের কাছে ভাষা শিখে নেয়া । পিচ্চি তা জানে, নইলে মানুষের মুখে থুতু থাকবে কেন ! মানুষ যদি জন্তু-জানোয়ারের মতন হতো, নিজেদের কোনো ভাষা না থাকতো, তাহলে পৃথিবীতে এতো লড়াই দাঙ্গা যুদ্ধ মারকাট খুনোখুনি হতো না ।”
“বাবা বলেছিলেন, ভাষা যদি না থাকতো তাহলে কোনো ধর্মের বই লেখা হতো না, বুঝলি । যত্তো নষ্টের মূল হলো বই আর লেখালিখি । ককখনো বই লিখতে যাসনি, ওসব গুরুঠাকুরদেরই ভালো মানায়, কিংবা আকাশ থেকে পড়া কোনো শকুন ডিমের । আমি জানি, আমাদের যদি লড়াই করতে হয়, তাহলে সবকয়টা ধর্মের ছাদে বসে থাকা হাওয়াটার সঙ্গে লড়তে হবে। যদি ইতিহাসে খুঁজিস তাহলে দেখবি, ওই হাওয়ায় গড়া জীব পুরো মানবজাতটাকে দাবিয়ে রাখতে চেয়েছে, এক দলের সঙ্গে আরেক দলের মারামারি বাধায়, স্বাভাবিক প্রেরণাকে নষ্ট করে দ্যায় । টঙের হাওয়ায় গড়া জীবটা তাইই করে, আর সবকয়টা ছাদের হাওয়া তাইই করে, নিয়ন্ত্রণ, ধ্বংস, মুছে ফ্যালা আর শুভবোধকে খতম করা। ব্যাপারটা যুথের, মানব-ভেড়ার, আর এই মানব-ভেড়াগুলো কুসংস্কারাচ্ছন্ন । ছাদ থেকে ওই বদ হাওয়ায় গড়া জীবটাকে নিকেশ করো, দেখবে যে মানব-ভেড়ারা অন্য বদ হাওয়ায় গড়া জীব ছাদে এনে ফেলেছে ।”
“বাবার জাদুঘরের সিনিয়র কেরানি বলেছিল, ‘অবোকখয়, অবোকখয়, ভাষা হল অবকখয়ের সাপের বাসা । ওনার কাছ থেকেই পিচ্চি শিখেছে আঁড়ল গাঁড়ল বাঁড়ল ষাঁড়ল চাঁড়ল শব্দগুলো।’
“পিচ্চি মায়ের ন্যাওটা ছিল বলে মা যেভাবে কথা বলতেন, পিচ্চিও সেইভাবে বলে । কারোর সঙ্গে কথা বলার আগে বা কারোর প্রশ্নের উত্তর দেবার আগে পিচ্চি ওর মায়ের মতনই বলে, “আমি বলি কি”, বলে, তারপর নিজের কথাটা বলে ।”
রিমা খানের সিগারেট ফুরিয়ে গিয়েছিল, আরেকটা ধরিয়ে নোট নিলেন, পিচ্চিদের বাড়ির রাস্তায় আর সলিসিটারের বাড়ির সামনে যদি সিসিটিভি থাকতো তাহলে পিচ্চি লোপাট হবার দিনের রেকর্ড দেখতে পাওয়া যেতো । যাক, পিচ্চির ল্যাপটপে ওর বাবা-মায়ের বিভিন্ন সময়ে বিদেশ ভ্রমণের ফোটো আছে। ভোমসোকে বলতে হবে পিচ্চির জার্মান দাদু আর দিদিমার ঠিকানা যোগাড় করতে ।
নিজের সম্পর্কে রিমা খানের মনে হয়, তিনি মরুভূমিতে একটা ক্যাকটাস গাছ, সেই গাছের ফুলও তো কুসুমিত হয় । তাঁর পুলিশ জীবনের প্রতিটি সফলতা হলো ক্যাকটাসের কুসুমিত হওয়া ।
৫
“কনে বিন্নি, কইন্যা ওলেঙ্কা আর পিচ্চি ঘরের ভেতর দিয়ে যেতে যেতে জঙ্গল এসে গেল । গাছে-গাছে বারান্দা।”
“বাগানে, পাকাচুল কুঁজো মালির কাছ থেকে গাছে জল দেবার সবুজ পাইপ নিয়ে তিনজনে ভেজাভিজি খেলা আরম্ভ করল, হ্যা-হ্যা-হি-হি-হুহু, শাড়ি ভেজে, স্কার্ট-টপ ভেজে, ট্রাউজার ভেজে । উদয়পদ্ম, কলকে ফুল, কাঁঠালি চাঁপা, কেলি কদম , ছাগল কুঁড়ি ,জংলি ঝুমকো, জবা, দাঁতরাঙা , দোপাটি , পাহাড়ি কাশ , বনচণ্ডাল ,বেলি ফুল , বৈঁচি , মহুয়া ,মাধবীলতা ।”
“কাজ ভালো করতেন বলে শহরের ছোটো মিউজিয়াম থেকে বড়ো মিউজিয়ামে বদলি হয়ে গিয়েছিলেন পিচ্চির বাবা, একেবারে দুহাজার কিলোমিটার দূরের সমুদ্রের ধারের ওনার নিজের শহরে । শহরে এতো গাড়ি যে রাতের বেলায় লাল রঙের যাওয়া আর হলদে রঙের আসা দেখতে পায় পিচ্চি, বারান্দায় দাঁড়িয়ে। বিন্নি-ওলেঙ্কাকে সঙ্গে নিয়ে দাঁড়ালো একটা বারান্দায় । বিন্নি বলল, তোমার সঙ্গে থাকতে-থাকতে আমি জানোয়ারের মতন তোমার পোষা হয়ে যাচ্ছি, মনে হচ্ছে আমি ফাঁদে ধরা পড়ে গেছি আর তুমি আমার মগজে বসন্তঋতু ভরে দিচ্ছ, আমাকে ভিজিয়ে ফেলছো আমারই শরীরের রসে, উদ্বিগ্ন হয়ে অপেক্ষা করছি কখন তুমি প্রথম কামড়টা বসাবে ।”
“পিচ্চি বলল, সেটাই সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে গো, কাকে আগে কামড় দেবো, আই অ্যাম স্পয়েলড বাই চয়েসেস।”
“ওলেঙ্কা পিচ্চিকে জড়িয়ে ধরে ঠোঁটে জিভ বুলিয়ে বলল, তুমি ডার্টি টক পারো না ? ডার্টি টক শুনলে আমি ভিজে যাই, প্রেমিকের নোংরা কথাবার্তা না শুনলে বড়ো ম্যাজমেজে লাগে । শব্দের ভেতরে যে নোংরামি থাকে তা আসলে নোংরা নয় । শরীর যদি সাড়া না দেয় তাহলে তা নোংরা ।”
“নোংরা মানে আই লাভ ইয়োর পুসি, আই শ্যাল মেক ইউ খুশি, হোয়েন ইউ আর জুইসি, এইসব তো? অনেক জানি । হ্যাঁ, মানছি, ডার্টি টকের কাজ হলো শরীরকে তাতিয়ে তোলা । আমি বলি কি, আমাদের গরমের দেশে শরীর তো আগে থাকতেই তেতে থাকে।”
“ গরমের ছুটিতে বাবার সঙ্গে মাঝে-মাঝে মিউজিয়ামে গিয়ে ঘরে-ঘরে একা বেড়াতে-বেড়াতে জাদুঘরের নানা জিনিস দেখতো পিচ্চি, কী লেখা আছে পড়তো, একটা মমি আর একটা ডায়নোসরের বিশাল কঙ্কালকে পিচ্চির ভালো লাগতো । আশেপাশে কোনো দর্শক না থাকলে, মুখের ব্যাণ্ডেজ খুলে মমিটা তিন হাজার বছরের ভাষায় ওর সঙ্গে কথা বলতো, কোনো রানির মমি বোধহয়, কেননা একদিন চোখ মেরে ইশারা করেছিল, মমিও লজ্জা পেতো, কোনোদিন বুকের ব্যাণ্ডেজ খুলে দেখায়নি।”
“ওর বাবা জাদুঘরের তত্ববধায়ক ছিলেন , তাই জাদুঘরে ঢুকতে পিচ্চির কোনো টিকিট লাগতো না, হাফটিকিটও নয় ।”
“ পিচ্চি জানে, আর সেই কথাই ও বিন্নি-ওলেঙ্কাকে বোঝাতে আরম্ভ করল, “মানুষ বললে যেমন সব রকমের মানুষ বোঝায়, চীনা, আফ্রিকানিবাসী, আরবদেশের, ইউরোপ-আমেরিকার, ব্রাজিলের রেডইনডিয়ান, ভারতীয় উপমহাদেশের মানুষ, তেমনই ডায়নোসর বললে পাহাড়ের মাপের সব ধরণের গিরগিটিকে বোঝায়, যেমন চারপেয়ে ব্রন্টোসরাস, ডিপলোডকাস আর ব্রাকিওসরাস, যারা গাছের পাতা আর ফলমূল খেতো, সরু গলার অনেক উঁচু ছিল তারা, যাতে তখনকার আকাশ-ছোঁয়া গাছের মগডালের পাতা আর ফল খেতে পারতো। চারপেয়ে ছোটোমাপের, ঘাসপাতা খেয়ে থাকতো যেগুলো তারা হলো স্টেগোসরাস আর অ্যাঙ্কিলোসরাস, তাদের শিরদাঁড়ার ওপরে কিংবা গায়ে গণ্ডারের বা কুমিরের চামড়ার মতন শক্ত আঁশ থাকতো । কেউই জানে না তাদের কোনো ভাষা ছিল কিনা । আমার মনে হয়, নিশ্চই ওদেরও ভাষা ছিল, তাই ওরা হাপিশ হয়ে গিয়েছে ।”
“মানুষও একদিন পৃথিবী থেকে লোপাট হয়ে যাবে, কোনো সন্দেহ নেই পিচ্চির, ভাষা মানুষকে লোপাট করে দেবে, ভাষার মতন ক্ষতিকর বিষ আর নেই ।”
“পিচ্চি যখন কনে বিন্নির কাঁধে ডান হাত আর কইন্যা ওলেঙ্কার কাঁধে বাঁ হাত রাখল, বিন্নি-ওলেঙ্কা প্রতিবাদ করেনি, দুজনেই পিচ্চির কোমর জড়িয়ে ওর কথা শুনতে লাগল । যেগুলো মাংসখোর ছিল তারা অতো উঁচু হোতো না, তাদের তো গাছের মগডালের পাতা খাবার দরকার ছিল না, কাছেপিঠে কোনো প্রাণী দেখলে তার ওপর গিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে তার মাংস খেয়ে নিতো, মাংস খাবার জন্য ওদের দাঁতও ছিল বেশ বড়ো-বড়ো আর ধারালো, তারা ছিল দুপেয়ে, কিন্তু ছোটো-ছোটো হাত ছিল তাদের, শরীরের হেলদোল বজায় রাখার জন্য, তাদের মধ্যে নামকরাগুলো ছিল চকোলেট রঙের টিরানোসরাস রেক্স যাদের বামপেলাত জুরাসিক পার্ক ফিল্মে দেখেছিল মাংস খাবার জন্য মানুষের পেছনে দৌড়োচ্ছে ; জুরাসিক পার্ক তো একটা বানানো গল্প, তখনকার কালে তো আর মানুষ ছিল না, বামপেলাতকে বোকা বানাবার আর জায়গা পায়নি ফিল্মঅলারা, পিচ্চির কথা ফুরোবার আগেই দুজনে জিগ্যেস করল, একসঙ্গে, তা ওদের সেক্স অর্গান সম্পর্কে কিছু জানো না?”
“কইন্যা ওলেঙ্কা জিভে ঠোঁট বুলিয়ে বললে, হ্যাঁ, ফিল্মঅলারা ভেবেছিল ডায়নোসরগুলো কোনো ভাষা জানে না, আর যতো ভাষা তা শুধু মানুষরাই জানে । টাকাকড়ি রোজগারের জন্যেও তো ভাষারই দরকার , টাকাকড়িও যতো গণ্ডোগোলের কারণ, টাকার ওপর কতো টাকা লেখা না থাকলে মানুষের উপকার হতো।”
“ না ফিল্মে তো কোনো অর্গান দেখায়নি, কোনটা মেল কোনটা ফিমেল বোঝার উপায় ছিল না ।অন্য মাংসখোরগুলো ছিল ফিকে সবুজ রঙের ভেলোসিরাপটার, স্লেট রঙের অ্যালোসরাস, স্পাইনোসরাস, ডেইনোনিকাস, আর সবুজ কারনোটরাস । পিচ্চি ভেবে পায় না এমন শক্ত-শক্ত নাম রাখার কী দরকার ছিল ! বিজ্ঞানীরাও অদ্ভুত মানুষ । সব সময়ে শক্ত শক্ত নাম রাখবে যাতে পড়া মুখস্হ করতে কষ্ট হয় ।”
“মজার ব্যাপার হলো, পিচ্চির বাবা বলেছিলেন ওকে, ডায়নোসরদের গা সাপ আর কুমিরদের মতন ছিল ঠাণ্ডা । কুমির যেমন গা গরম করার জন্য রোদ পোয়ায়, ডায়নোসররাও গা গরম করার জন্য রোদ পোয়াতো । তখনকার সূর্যর রোদ আরও গরম ছিল ।”
“ডায়নোসরদের সবকটা জাত লোপাট হবার দরুন পিচ্চির মন খারাপ হয়ে যায় । কেন লোপাট হল তার গল্প বাবার কাছে শুনেছে পিচ্চি, কিন্তু বিশ্বাস হয়নি । বাবা বলেছিলেন যে, একটা ধুমকেতু এসে মেকসিকোর সমুদ্রে এমন ধাক্কা মেরেছিল যে সারা পৃথিবী তার ধুলোয় ছেয়ে গিয়েছিল, সূর্য ঢাকা পড়ে পৃথিবী অনেককাল অন্ধকারে ঢাকা ছিল, অন্ধকার ছিল বলে গাছপালা রোদের আলো পায়নি, ডায়নোসররাও ঠিকমতন শ্বাস নিতে পারেনি, গাছপালা মরে যেতে থাকলে খাবার জিনিস না পেয়ে রোগা ডায়নোসররা মারা যেতে লাগলো, যে ডায়নোসররা অন্য ডায়নোসরের মাংস খেয়ে থাকতো তারা আর মাংস পেলো না, শেষে একটা-একটা করে সব ডায়নোসর পৃথিবী থেকে গায়েব হয়ে গেল, পড়ে রইলো তাদের পাথর হয়ে যাওয়া জীবাশ্ম, যাকে ভালো বাংলায় বলে ফসিল ।”
“পিচ্চির বিশ্বাস ওরা লোপাট হয়ে গিয়েছিল ভাষা আবিষ্কারের দরুন, হয়তো এক-এক জাতের ডায়নোসরের এক-এক রকম ভাষা ছিল, যেমন আছে মানুষের বেলায় । ওরা নিশ্চই জ্ঞানী-গুণী ছিল, নয়তো নির্ঘাৎ ধর্মের বই লিখে ফেলতো ।”
“মিউজিয়ামের মমিটা মিশর থেকে আনা, মিশরের পিরামিডে ছিল, ইংরেজরা এনেছিল, তখন নতুন জাদুঘর সাজাবার জন্য ইংরেজরা নানা দেশ থেকে নানা জিনিস লুটপাট করে এনে সাজিয়েছিল জাদুঘরকে । পিচ্চি পিরামিড দেখেছে, কিন্তু তখন ওর বয়স মোটে সাড়ে চার বছর ছিল বলে সবকিছু ততো ভালো করে মনে নেই। মমির দিকে অনেকক্ষণ তাকিয়ে পিচ্চির মনে হতো ও হয়তো হাজার-হাজার বছর আগে পিচ্চিদেরর আত্মীয় ছিল, কেননা ও শুনেছে আর পড়েছে যে সব মানুষই আফ্রিকা থেকে সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়েছিল ।”
“মিশর তো আফ্রিকাতেই, তাই না ? আফ্রিকার মানুষদের মতন পিচ্চির স্বাস্হ নয় বলে ওর হিংসে হয় ওদের দেখলে ।”
“কনে বিন্নি, বাঁ হাত দিয়ে হাসি চেপে, বলল, না না, তুমি এইরকমই বেশ, আমার কালো বেডফেলো চাই না ।”
“শুধু মমিই নয়, পিচ্চির মনে হয় পৃথিবীতে যতো রকমের প্রাণী আছে, যতো রকমের গাছপালা আছে, সকলেই ওর আত্মীয় । আগের শহরে ক্লাস ওয়ানে পড়ার সময়ে স্কুলের টিচার ডারউইন নামে একজন সাহেবের আবিষ্কারের গল্প শুনিয়েছিলেন, বোর্ডে ছবি এঁকে দেখিয়েছিলেন, গল্পটার নাম বিবর্তন । ডারউইন সাহেবের আগে বিলেতের লোকে নাকি বিশ্বাস করতো যে ভগবান সাতদিনে পৃথিবী তৈরি করেছিলেন । ডারউইন সাহেব এমন বই লিখলেন যে যারা অমন বিশ্বাস করতো তারা বেজায় চটে গিয়েছিল । কিন্তু ডারউইন সাহেব প্রমাণ করে দিলেন যে যতো রকমের প্রাণী পৃথিবীতে আছে সবাই জন্মেছে ধাপে-ধাপে, কোটি-কোটি বছর ধরে, একটা প্রাণের জন্ম থেকে বাদবাকি সব প্রাণের জন্ম হয়েছে ।”
“কইন্যা ওলেঙ্কা জিভে ঠোট বুলিয়ে বললে, বাইবেলের গল্পটা আমি জানি, অ্যাডাম আর ইভের বাচ্চাদের থেকে মানুষ জন্মেছে, অ্যাডাম আপেল খেয়ে পাপ করেছিল বলে, কেমনধারা গল্প বল, অ্যাঁ ? অ্যাডাম আর ইভের ছেলে-মেয়েরা তো আপন ভাইবোন, তারা সেক্স করে জগতজুড়ে এতো মানুষের জন্ম দিলে ? আর এখন ভাইবোনরা ভাইফোঁটার দিন সেক্স করলে পুলিশে ধরবে, কোনো মানে হয়, অ্যাঁ !”
“বিন্নি বলল, শোনো শোনো হে জগৎবাসী, একদিন গড মাটি থেকে ধুলোবালি তুলে নিয়ে একজন মানুষ তৈরী করলেন আর তার নাকে ফুঁ দিয়ে প্রাণবাযু প্রবেশ করালেন যার ফলে মানুষটা জীবন্ত হয়ে উঠল, এরপর গড পূবদিকে একখানা বাগান বানালেন আর বাগানটার নাম দিলেন ইডেন আর গড তাঁর সৃষ্টি করা মানুষটাকে সেই বাগানে রাখলেন ,আর সেই বাগানে গড সবরকমের সুন্দর গাছ আর ফলমূলের গাছ পুঁতলেন, বাগানের মাঝখানে গড একটা জীবনগাছ পুঁতলেন যা ভাল আর মন্দ বিষয়ে জ্ঞান দেয়, গড মানুষটিাকে বললেন বাগানের য়ে কোনও গাছের ফল তুমি খেতে পারো কিন্তু য়ে গাছ ভালো আর মন্দ বিষযে জ্ঞান দেয সেই গাছের ফল কখনও খেও না, তারপরে গড বললেন, মানুষের নিঃসঙ্গ থাকা ভালো নয়, আমি তোমাকে সঙ্গদান করার জন্যে তোমার মতন আর একজন মানুষ তৈরী করব, গড পৃথিবীর ওপরে সমস্ত পশু আর আকাশের সমস্ত পাখি তৈরি করবার জন্য ধুলোবালি ব্যবহার করলেন, গড ওই সমস্ত পশুপাখিকে লোকটার কাছে নিয়ে এলেন আর লোকটা তাদের প্রত্যেকের আলাদা আলাদা নাম দিল, লোকটা অসংখ্য পশু পাখি দেখল কিন্তু সে তার সঙ্গদানকারী কাউকে দেখতে পেল না, তখন গড সেই মানুষটাকে গাঢ় ঘুম পাড়িয়ে রাখলেন, লোকটা যখন ঘুমোচ্ছিল তখন গড তার পাঁজরের একটা হাড় বের করে নিলেন, গড সেই লোকটার পাঁজরের হাড় দিয়ে তৈরি করলেন একজন মেয়েমানুষ, আর তাকে লোকটার সামনে নিয়ে এলেন । ব্যাস শুরু হয়ে গেল আমাদের পাপ করার স্বাধীনতা।”
“আরে, ওটা তো ধর্মের বই, ইহুদিদের ভাষা দিয়ে লেখা, ওই গল্পটাই পরে অন্য ভাষায় লেখা হয়েছে, এখন এক ভাষার মানুষ আরেকভাষার লোকের পোঁদে বোমা মারে, অথচ গল্প ওই একটা বই থেকে নেয়া, সেই অ্যাডাম আর সেই ইভের ছেলেপুলে, উত্তরে পিচ্চি বলল, গড নিজে অথচ হাওয়া ।”
“কইন্যা ওলেঙ্কা ঠোঁটে জিভ বুলিয়ে, দু হাতে পিচ্চিকে জড়িয়ে বলতে লাগল, খোলো খোলো দ্বার, রাখিয়ো না আর বাহিরে আমায় দাঁড়ায়ে, দাও সাড়া দাও, এই দিকে চাও, এসো দুই বাহু বাড়ায়ে।”
‘কনে বিন্নি বলল, ওলেঙ্কা, দ্বার তো তোর, তুই তো খুলবি, পিচ্চি সেই ঘরে যাবে।”
“প্রথম যেদিন ডারউইন সাহেবের গল্পটা পিচ্চি শুনেছিল, ওর মন খারাপ হয়ে গিয়েছিল । পিচ্চির মনে হয়েছিল যে ও কেন আগেই জন্মায়নি, ডারউইন সাহেবের আগে, তাহলে ওর নামই লোকে জানতে পারতো, পিচ্চিও তো একই কথা ভাবে, প্রমাণ যোগাড়ের জন্য ডারউইন সাহেবের মতন ও-ও বাঁদুরে টুপি পরে কম্বল মুড়ি দিয়ে, দক্ষিণ আমেরিকার সমুদ্রতীরে, পাহাড়ে, সেখানকার আদিবাসিদের সঙ্গে মেলামেশা করতো । যাকগে, ডারউইন সাহেব না বললেও ও জানে সব প্রাণী আর গাছপালা একই দানা থেকে জন্মেছে, কিন্তু সেই দানার জায়গাটা দুই পায়ের মাঝখানে কেমন করে হল, তা বুঝতে পারে না পিচ্চি, ও তো রোজই আপেল খায়।”
“ডায়নোসরদের নিয়ে ইংরেজি জুরাসিক পার্ক ফিল্মগুলো দেখেছে পিচ্চি । ডায়নোসরদের খারাপ, মাংসখেকো দেখতে ওর ভালো লাগেনি । ডায়নোসররা খারাপ হতে যাবে কেন । মানুষ তো ডায়নোসর দেখেনি, শুধু তাদের দেহ, ঠ্যাঙ, মুখের জীবাশ্ম যোগাড় করে, দাঁতের জীবাশ্ম যোগাড় করে, ডিমের জীবাশ্ম যোগাড় করে, অনুমান করে নিয়েছে দাঁতালো ডায়নোসররা খারাপ আর মাংসাশী । মানুষরা নিজেদের মধ্যে ফালতু মারামারি করে বলে ডায়নোসরদেরও মনে করেছে নিজেদের মধ্যে মারামারি করতো । পিচ্চি যদি গাছের মতন উঁচু একটা ডায়নোসর পেতো তাহলে তাকে পুষতো, তার পিঠে বসে, ঘোড়ায় বসার মতন করে, নানা জঙ্গলে ঘুরে বেড়াতো । দেখতো গাছের মগডালগুলো কেমন হয়, মগডালে জুরাসিক আমলের পাখিগুলোর বাসায় ডিমগুলো কতো বড়ো ।”
“পিচ্চি ঘোড়ায় চেপেছে ; ওর বাবা ওকে জার্মান দাদুর বাড়িতে বেড়াতে নিয়ে গিয়ে ঘোড়ায় চাপিয়েছিলেন, সেই ধরণের ঘোড়াকে বলে ট্রাকেহনের, চকচকে বাদামি পিঠ, আর কেমন ঘাড় নাড়ে । তার আগে পিচ্চি জানতো না যে ঘোড়াও অনেকরকম হয় । পিচ্চি ভেবেছিল যে ঘোড়া তো ঘোড়াই, তার আবার চেহারা আর চরিত্র আলাদা হবে কেন । জার্মান দাদু একটা বই উপহার দিয়েছেন ওকে, তাতে কতো রকমের ঘোড়ার ছবি আর নাম দেয়া আছে ; দাদু কানে-কানে বলে দিয়েছিলেন যে পিঠে গদি না রেখে ঘোড়ায় চাপলে নাইটফলের মতনই ডেটাইম ফলে প্যাণ্ট ভিজে যাবে, ঘষটানি লেগে।”
“কইন্যা ওলেঙ্কা জিগ্যেস করলে, কোমরে দুই হাত রেখে,ঘোড়া কতোরকমের হয় গো ? আমরা বিয়ে করে জংলি ঘোড়ার দেশে যাবো, কী বলো, মোঙ্গোলিয়ায় আছে বোধহয়, চেঙ্গিজ খান ওই ঘোড়ায় বসে পৃথিবী জয় করেছিল, মানে বর্বরের দল মেয়েদের তুলে নিয়ে যেতো নিজেদের দেশে ।”
“কনে বিন্নি পিচ্চির কানে ঠোঁট ঠেকিয়ে ফিসফিসিয়ে বললে, বাবর তো আরবি ঘোড়া ছুটিয়ে এসেছিল আর তাতে চেপে যুদ্ধ করেছিল বলে লড়াই জিতে গিয়েছিল। তুমি আমার ওপর আরবি ঘোড়া ছোটানোর মতন চাপো । কনে বিন্নি ফোলা বুক আরও ফুলিয়ে, পিচ্চিকে বিছানায় নিয়ে গিয়ে আরম্ভ করল:
জন সমুদ্রে নেমেছে জোয়ার,
হৃদয় আমার চড়া
চোরাবালি আমি দূর দিগন্তে ডাকি—
কোথায় ঘোড়সওয়ার?
দীপ্ত বিশ্ববিজয়ী! বর্শা তোলো
কোন ভয়? কেন বীরের ভরসা ভোলো?
নয়নে ঘনায় বারে বারে ওঠাপড়া?
চোরাবালি আমি দূর দিগন্তে ডাকি?হৃদয় আমার চড়া?
অঙ্গে রাখিনা কারোই অঙ্গিকার?
চাঁদের আলোয় চাঁচর বালির চড়া
এখানে কখনো বাসর হয় না গড়া?
মৃগতৃষ্ণিকা দূর দিগন্তে ডাকি?
আত্মাহুতি কি চিরকাল থাকে বাকি?
জনসমুদ্রে উন্মথি’ কোলাহল
ললাটে তিলক টানো
সাগরের শিরে উদ্বেল নোনা জল,
হৃদয়ে আধির চড়া
চোরাবালি ডাকি দূর দিগন্তে,
কোথায় পুরুষকার?
হে প্রিয় আমার, প্রিয়তম মোর!
আযোজন কাঁপে কামনার ঘোর
অঙ্গে আমার দেবে না অঙ্গীকার?
হালকা হাওয়ায় বল্লম উঁচু ধরো
সাত সমুদ্র চৌদ্দ নদীর পার—
হালকা হাওয়ায় হৃদয় দু-হাতে ভরো,
হঠকারিতায় ভেঙে দাও ভীরু দ্বার
পাহাড় এখানে হালকা হওয়ায় বোনে
হিম শিলাপাত ঝঞ্ঝার আশা মনে
আমার কামনা ছায়ামূর্তির বেশে
পায়-পায় চলে তোমার শরীর ঘেঁষে
কাঁপে তনু বায়ু কামনায় থরথর
কামনার টানে সংহত গ্লেসিয়ার
হালকা হাওয়ায় হৃদয় আমার ধরো,
হে দূর দেশের বিশ্ববিজয়ী দীপ্ত ঘোরসাওয়ার!
সূর্য তোমার ললাটে তিলক হানে
বিশ্বাস কেন বহিতেও ভয় মানে!
তরঙ্গ তব বৈতরণী পার
পায়-পায় চলে তোমার শরীর ঘেঁষে
আমার কামনা প্রেতচ্ছায়ার বেশে
চেয়ে দেখ ঐ পিতৃলোকের দ্বার!
জনসমুদ্রে নেমেছে জোয়ার—
মেরুচূড়া জনহীন—
হালকা হওয়ায় কেটে গেছে কবে
লোক নিন্দার দিন
হে প্রিয় আমার, প্রিয়তম মোর,
আযোজন কাঁপে কামনার ঘোর
কোথায় পুরুষকার?
অঙ্গে আমার দেবে না অঙ্গিকার?”
“ পিচ্চি বলল, দেবো, দেবো, এখন তো ছাড়ো, দাও বললেই দেয়া যায় নাকি ?”
“কইন্যা ওলেঙ্কা পা ফাঁক করে দাঁড়িয়ে, কোমরে দুই হাত রেখে বলল, আমি সেকেন্ড ফিডল হতে রাজি নই ।”
“হেঁই মারো মারো টান”
“হেঁইও”
“টগবগটগবগ”
“হেঁইও”
“ পিচ্চি, রেলস্টেশনের ঘোষকের কন্ঠে জানালো, অ্যাডভোকেট তোমাদের বলেছেন, আমাকে তোমরা ট্রেনিঙ দেবে, সে কথা ভুলে যাচ্ছ কেন ? তোমার সঙ্গে প্রেম করছি, স্টক ফুরিয়ে যাবে না তো ? ওলেঙ্কার জন্য কিছু স্টক বাঁচিয়ে রাখতে হবে । ও অবশ্য বলেছে, ওর অঙ্গটা সব সময় খুশমেজাজী ।
“কইন্যা ওলেঙ্কা পা ফাঁক করে দাঁড়িয়ে, বুকের ওপরে দুই হাত ক্রস করে, থুতনি ওপরে তুলে বলল, জিভে ঠোঁট বুলিয়ে, আই অ্যাম দি ফার্স্ট টেন্যান্ট, বেবি বয়, আমার চান্স মিস হলো, ঠিক আছে জিরিয়ে নাও ।”
“কনে বিন্নিও বলল, মুখে বাঁ হাত চাপা দিয়ে, আমিও, আই অ্যাম দ্য ফার্স্ট, তাই প্রেমটা সেরে ফেললুম । বিন্নি তখনও ভাইব্রেশান মোডে, শ্বাসের উল্লম্ফন চলছে, টলনমলন জারি ।”
“পিচ্চি, পালঙ্ক থেকে উঠে, একবার বিন্নি আরেকবার ওলেঙ্কার দিকে মুখ করে জানতে চাইল, আচ্ছা, ঘোড়াদের পেনিস কত্তো লম্বা হয়, গাধা জেব্রা হাতিদেরও কতো বড়ো হয় ? সিনেমায় ডায়নোসরের ডিককে ছোটো দেখিয়েছে কেন ? ডিক তো হাড়ের তৈরি নয়, তাই জীবাশ্ম পায়নি বলে মানুষেরা ভেবেছে ডায়নোসরদের ডিকও দুচার ইঞ্চির । ব্যাটারা বোকার হদ্দ । আমার এখন নাইটফলের বয়স, তবু আমার ডিক ডায়নোসরদের চেয়ে বড়ো ।
“কই দেখাও, বলে উঠলো কইন্যা ওলেঙ্কা ।”
“দেখে, হাতে নিয়ে, কইন্যা ওলেঙ্কা বলল, অ্যাডাল্ট হলে অ্যাডাল্ট ফিল্মের লোকগুলোর মতন হবে তোমার ডিক, তখন একে আর ডিক বলা যাবে না, সুন্নত করার ফলে এটাকে অন্য নামে ডাকতে হবে ।”
“তোমরা ট্রিপল এক্স ফিল্ম দেখো, অ্যাডভোকেট বলেছে তোমাদের সঙ্গে বসে একসঙ্গে দেখতে।”
“তাতে কী হয়েছে, সেক্স করার আগে দেখে আনন্দ নিই, দেখতে দেখতে যে বুক ধড়ফড় করে, সেইটেই ভাল্লাগে, বলল কনে কনে বিন্নি ।”
“যেখানে ভাল্লাগে তাকে কী বলে জানো ?”
“মারবো মুখে একলাথি, বলল কইন্যা ওলেঙ্কা।”
“তুমি যেই লাথি মারার জন্যে পা তুলবে, আমি চট করে বসে তোমার তাঁবুতে মাথা ঢুকিয়ে আফরিকার ম্যাপ দেখবো ।”
“সত্যি লাথাবো কিন্তু, বাড়ির মালিক বলে ভেবো না ছাড় পেয়ে যাবে । কইন্যা ওলেঙ্কার কথা শুনে কনে বিন্নি বলল, তুই তাহলে চাইছিস যে পিচ্চি তোর তাঁবুতে ঢুকে ম্যাপ দেখুক ।”
“পিচ্চি বিন্নি-ওলেঙ্কাকে বোঝাতে আরম্ভ করল, মানুষের বেলায় লিঙ্গ-যোনিও ভাষার জনক । তাই বিপজ্জনক । ধর্ম জানবার জন্যে যুদ্ধের সময় জার্মানরা আর দেশভাগের সময়ে দুদেশের লোকেরা লিঙ্গ দেখে যাচাই করেছিল কে কেন দলে । এখনও দাঙ্গা-ফ্যাসাদের সময়ে নুনুর ভাষা যাচাই করে মারমুখি পাবলিক। নুনুর জন্যেই তো দেশভাগ হয়েছিল ।”
“চোখে বিস্ময় জড়ো করে কইন্যা ওলেঙ্কা বললে, তুমি কত্তো জানো বেবি বয় । আচ্ছা, অ্যানিমাল প্ল্যানেটে দেখেছি, সেক্স করার সময়ে মাদি হাতি, মাদি ঘোড়া, মাদি গাধা, ওরা তো কই আহ উহ, ওঃ করে না, কেন?”
“পিচ্চি বলল, ওদের ভাষায় অব্যয় নেই, তাই । সেক্সে অব্যয় এনেছে আমেরিকানরা । চণ্ডীদাস, জয়দেব, ভারতচন্দ্র, আল মাহমুদে, কই অব্যয় নেই তো ।”
“কনে বিন্নি বলল, সে যাই হোক, আমি কিন্তু রসে থইথই অব্যয় ইউজ করতে ভালোবাসি, এখন যেমন করলুম ; সেক্স মোটেই প্রায়ভেট কাজ নয়, নয়, নয়, নয়,নয়, কাজটা সামাজিক । মরদ আর মাদি যখন একজন আরেকজনের জাপটে নিজেদের ধরা দেয়, তখন মরদটা হয়ে ওঠে শিকারজীবী আর মাদিটা নিজের আনন্দের জন্য সবরকম ফন্দি খাটায়, সে তখন পরোয়া করে না কিচ্ছু । তারা দুজনে একজন হয়ে ওঠে, বিছানার বাইরে ছুঁড়ে ফেলে দ্যায় আত্মনিয়ন্ত্রণ, তখন শুধু ভালোবাসা, ভালোবাসা, ভালোবাসা, ভালোবাসা, আমি নিজের অভিজ্ঞতা থেকে বলছি, একবারে নয়, অনেক বারের অভিজ্ঞতা ।”
“ওফ, তুমি একখানা চিজ বটে, বলল কইন্যা ওলেঙ্কা।”
“ইংরেজরা যখন এদেশে ছিল, সেই সময়ে ইংরেজরাই হতো কিউরেটর বা তত্ববধায়ক । পিচ্চির বাবা প্রাচীন ইতিহাস আর প্রত্নতত্ব নিয়ে অনেক পড়াশুনা করেছিলেন বলে উনি এই চাকরিটা পেয়েছিলেন ।”
“জঙ্গলের অনেক ভেতরে ওরা চলে গিয়েছিল , জড়াজড়ি খেলতে-খেলতে ।”
“কইন্যা ওলেঙ্কা, ঘাসে শুয়ে, পিচ্চির হাত ধরে টান মেরে বলল, এসো, ঘাসের ওপরেই আমার ভাল্লাগে, সেই গুহামনবীর অভিজ্ঞতা পাবো । পিচ্চি টান সমালাতে না পেরে পড়ল কইন্যার বুকের ওপরে, তারপর যা হয়, তাই হলো, ওর স্টক নবীকরণ হয়ে গিয়েছিল ।”
“এই জঙ্গলে ঢোকার সুবিধের জন্যেই তোমাদের ফোরফাদার এই বাড়িটা তৈরি করিয়েছিলেন, দক্ষিণখোলা, কী হাওয়া একেবারে, বলল বিন্নি ।”
“পিচ্চির স্কুলে কেউ বলতে পারেনি কেন দক্ষিণখোলা বাড়িই চাই, কেননা সব বাড়ি তো আর অমনভাবে তৈরি হয় না, একটা ফ্ল্যাটবাড়ি তৈরি হয়, তাতে যে ফ্ল্যাটগুলো থাকে সেগুলোর তো চারটে দিক থাকবেই, সবাই তো দক্ষিণমুখো বাড়ি পেতে পারে না । পিচ্চি নিজেই বুঝতে পেরেছিল যে আসলে দক্ষিণ দিকে থেকে এয়ারকাণ্ডিশানের মতন হাওয়া আসে, তাই সকলেই দক্ষিণখোলা ফ্ল্যাট কিংবা বাসা চায় ।
“দক্ষিণ দিকে কী আছে যে এতো হাওয়া আসে ওই দিক থেকে ! বাবার অফিসের লোকেদের প্রশ্ন করার পর পিচ্চি জানতে পেরেছিল যে দক্ষিণ দিকে সমুদ্র আছে ; সমুদ্রের খোলা হাওয়া এসে শহরটাকে ঠাণ্ডা করে তোলে । ওই দিক থেকে বৈশাখ মাসে আকাশ কালো করে যে বৃষ্টিঝড় ওঠে তাকে বলে কালবৈশাখি ।”
“আরও দক্ষিণে হাঁটছি আমরা, কিছুক্ষণেই লাতিন আমেরিকায় পৌঁছোবো, বলল পিচ্চি ।”
“কইন্যা ওলেঙ্কা চেঁচিয়ে উঠল, পাগল না কি তুমি, কোথায় তোমাদের বাড়ি আর কোথায় ব্রাজিল পেরু ভেনেজুয়েলা আরজেনটিনা !”
“আরে দ্যাখোই না তোমরা । আমি তো স্কুলে ভর্তি হবার সময়ে এই রাস্তা দিয়েই গিয়েছি । তোমরা তোমাদের নিজেদের গল্প বল তো, তখন থেকে আমার গল্প শুনছ । কোথায় আগে তোমরা ছিলে ? তোমাদের বাবা নিশ্চয়ই ভালো রোজগার করেন, এতো টাকা দিয়ে ভাড়া নিলেন । আমি তো সলিসিটারমশায়কে একটা মিনিমাম ভাড়ার কথা বলেছিলুম যাতে কেউ না আসে । সে জায়গায় দু-দুটো ডাগর যুবতী চলে এলো, তাও আবার গাঁজা পাতার নেশুড়ে ।”
“কনে বিন্নি বলল, পিচ্চির গলা জড়িয়ে, যখন তুমি নেশা করবে, তখন একজন কালো সুন্দরী পরী তার কালো জ্যোতিতে তোমাকে মুড়ে ফেলবে, তোমার ভেতরে অনুভব করবে সেই কালো কুচকুচে শক্তিটা, কালী ঠাকুরের মতন, তুমি তার পায়ের তলায় শুয়ে পড়লেও সে জিভ বের করে থামবে না, তোমাকে যতো পেড়ে ফেলতে থাকবে তুমি ততো তার জাপটানিতে ধরা দেবে, যেমন কবিরা কবিতার নেশায় ধরা দেয়, নেশাড়ুরা নেশায়, জুয়াড়িরা জুয়ায়, তোমার আত্মা কালো হয়ে উঠবে, জীবনযাপন কালো হয়ে উঠবে, তুমি কালোর কাছে আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হবে । তুমি আর তুমি থাকবে না । তোমার চেহারা, তোমার কন্ঠস্বর, তোমার আদবকায়দা এতো কালো হয়ে যাবে যে তুমি চিনতেই পারবে না তুমি পিচ্চি না কালো আগুনের সূর্য।”
“কনে বিন্নির কোমর জড়িয়ে পিচ্চি বলল, তাহলে তাই হোক । শিগগিরই হোক । যোগাড়-যন্তর করো আমার ভেতরটা কালো কুচকুচে করবার, এখন যেটুকু করেছ, তাতে তো কালো হয়নি, রোজ কালো হওয়া অভ্যাস করতে হবে।”
রিমা খান খাতাটা বন্ধ করে নিজেকে বললেন, নাঃ, কিছুই নেই এই খাতায়, কেবল গাঁজাখুরি কাহিনি, হয়তো মেয়ে দুটো পিচ্চিকে ড্রাগ অ্যাডিক্ট করে তুলে থাকবে, নয়তো এই সব বিদকুটে জ্ঞানের সালতামামি লিখবে কেন । মা-বাপ সম্পর্কে কোনো উৎসাহ দেখা যাচ্ছে না, ওনারা কোথায় গেলেন, কেন গেলেন । ভোমসাকে আরেকটা ফোন করতে হবে বা ওর থানায় একটা সাডন ট্রিপ দিতে হবে । আর অ্যান্টি নারকোটিক্সে জিগ্যেস করতে হবে মেয়ে দুটো সম্পর্কে ওদের কাছে কী ধরণের তথ্য আছে । পিচ্চির বাড়িতে অ্যান্টি নার্কটিক্সের লোক পাঠিয়ে দেখতে হবে ওরা ড্রাগ নিতো কিনা, নিলেও কোন ড্রাগ নিতো ।
৬
ছয় নম্বর খাতায় মন দিলেন রিমা খান ।
“পিচ্চি কইন্যা ওলেঙ্কাকে জড়িয়ে বলল, তোমার গল্প বলো এবার ওলেঙ্কা ।”
“ওলেঙ্কা নিজের গল্প শোনানো শুরু করল, ওর গল্পতে কালো কুচকুচে হয়ে ওঠার মতন মশলা নেই।”
“নতুন যে শহরে ওলেঙ্কার বাবা বদলি হয়ে গিয়েছিলেন, যেখান থেকে এখন ওনারা এসেছেন পিচ্চির শহরে, সেখানে বাড়ি ভাড়া নেবার জন্য অনেক টাকা লাগতো, মায়ের মুখে শুনেছিল ওলেঙ্কা, সহজে ফ্ল্যাট পাওয়া যায় না, বাবার অফিস থেকে অনেক দূরে-দূরে বাড়ি ভাড়া পাওয়া যেতো ।”
“পঞ্চাশ তলা, সত্তর তলা, উঁচু-উঁচু বিলডিঙে ছোটো-ছোটো ফ্ল্যাট আর তার ভাড়াও অনেক, একতলায় ফাঁকা জায়গায় গাড়ি রাখবার জন্যও ভাড়া গুণতে হতো, যদিও ওলেঙ্কার বাবার গাড়িটা ছোটো ছিল, আসার আগে বেচে দিয়েছেন । বাবা ছোটো গাড়িই কিনেছিলেন, ওরা তো মোটে তিনজন, বড়ো গাড়ি কিনে কীই বা হবে, বলেছিলেন মা ।”
“এখানে হোস্টেলে থাকার সুবিধার জন্যে, ওলেঙ্কার জন্য স্কুটি কিনে দিয়েছেন, হোস্টেল ছেড়ে পিচ্চিদের বাড়িতে থাকতে এসেছে এতো সস্তায় বেশ কয়েকটা ঘর পাবার দরুন, আর স্বাধীনভাবে থাকার সুবিধের জন্যে, তার সঙ্গে ফাউ ভালোবাসার তরতাজা মানুষ।”
“নতুন শহরে পৌঁছে, শুধু নিজের অফিসের কথা নয়, ওলেঙ্কাকে একটা ভালো কলেজে ভর্তির কথাও ভাবতে হয়েছিল বাবাকে । সেই কলেজের কাছাকাছি যাতে ফ্ল্যাট পাওয়া যায় । কাছাকাছি না হলেও, অন্তত বাসে করে যাতে যেতে পারে, নিজস্ব গাড়ি বা স্কুটার থাকা আজকাল খুবই দরকার, জানতো ওলেঙ্কা, কেননা চারিদিকে মেয়েদের ধর্ষণের সংস্কৃতি আরম্ভ হয়েছে । ওলেঙ্কা চায় নিজের ইচ্ছেমতন ইনটারকোর্স করতে, যাকে পছন্দ হবে তার সঙ্গে, কলেজে মেয়েরা তো তাইই করছে । গাঁজাপাতা ফোঁকাও কলেজে শিখেছে, রেভ পার্টিতে যাওয়া শিখেছে কলেজের বন্ধুদের থেকে। সাড্ডল্য হয়ে উঠেছে শহরের সংস্কৃতি অনুযায়ী।”
“বাবার সঙ্গে ফ্ল্যাটের খোঁজে গিয়ে ওলেঙ্কা দেখেছিল ওই শহরে লোকে যদি দক্ষিণমুখো ফ্ল্যাট কিনেছে কিংবা ভাড়া নিয়েছে, তাহলে দরোজার ওপরে ঝাড়ফুঁকের ফকির কিংবা ফাঙ সুইয়ের ওঝাকে দিয়ে নানা জিনিস বা ছবি লাগাতো, যাতে বাড়ির লোকে প্রতিবেশি ডাইনিদের কুনজরে না পড়ে, বাড়ির লোকেরা অসুখে-বিসুখে না পড়ে, বাড়ির লোকেদের টাকা-পয়সা নিয়ে টানাটানি না হয়, বাড়ির লোকেদের ঘাড়ে মামদো-ভুতে এসে না চাপে ।”
“একটা ফ্ল্যাট দেখতে গিয়ে ওলেঙ্কা আর ওর বাবার চোখে পড়েছিল একজন আলখাল্লা-পরা লোক হাতের মালসায় ধুনো জ্বালিয়ে নেচে-নেচে ময়ূরের পালকের ঝাড়ু দিয়ে দক্ষিণমুখো দরোজা থেকে ভুতপ্রেতজিন তাড়াচ্ছেন । দক্ষিণমুখো ফ্ল্যাটের দরোজায় তারা প্রত্যেক দিন সকালে গ্যাঁদাফুলের মালা ঝোলায়, পাতিলেবুর সঙ্গে পাঁচটা কাঁচা লঙ্কা বেঁধে ঝোলায়, সেই মালা আর লেবু-লঙ্কা পরের দিন কর্পোরেশানের আঁস্তাকুড়ে গিয়ে ফেলে দ্যায় । ওলেঙ্কা জানতে পেরেছিল, সেই শহরের লোকে বড়ো বেশি শাস্ত্রে বিশ্বাস করে ; বাড়ি বানাবার আর বাড়িতে থাকার শাস্ত্রকে বলে বাস্তুশাস্ত্র, যেমন সেক্সের শাস্ত্রকে বলে কোকশাস্ত্র । ওলেঙ্কা ওর বড়োমামুর মুখে বাস্তুঘুঘুর কথা শুনেছিল, ওই শহরে বাস্তুশাস্ত্রের কথা জানতে পারলো । ওলেঙ্কা বাস্তুঘুঘু কথাটা শুনে মনে করেছিল এমন ঘুঘুপাখি, যেগুলো গাছের ডালে বাসা বাঁধে না, মানুষের বাড়িতে এসে এখানে-সেখানে ডিম পাড়ে, পায়রাদের মতন ; ঘুঘুপাখি ওলেঙ্কা দেখেছে, পায়রার মতন দেখতে, কিন্তু গায়ের রঙটা ক্যাডবারির মিল্ক চকোলেটের মতন । কেউ-কেউ পায়রার মাংস খায় অথচ ঘুঘুপাখির মাংস খায় না, বোধহয় ঘুঘুপাখির মাংস বিটার চকোলেটের চেয়েও বিটার, করলার মতন তেতো। বড়োমামু বুঝিয়েছিলেন যে বাস্তুঘুঘু পাখিদের বলে না, মানুষদের বলে । যে আত্মীয়রা কারোর বাড়িতে গিয়ে সহজে যেতে চায় না, তাদের বলে বাস্তুঘুঘু । ওলেঙ্কার মনে হয়, সেই লোকগুলোকে খারাপ মনে করা উচিত নয় ।”
“কইন্যা ওলেঙ্কাদের বাড়িতে যদি একজন বাস্তুঘুঘু থাকতো তাহলে তার সঙ্গে ও গল্প-সল্প করতে পারতো । বাড়িতে তো মা আর বাবা ছাড়া কেউ নেই । যে বউটা বাসন মাজতে আর ঘর পুঁছতে আসে, তার সঙ্গে বেশি কথা বললে সে বলতো অতোশতো জানিনে বাপু, এখুন আমার এক্কেবারে সময় নেই, আরও পাঁচটা বাড়িতে কাজ সারতে হবে । অন্য যে বউটা সকালে আর সন্ধ্যায় রান্না করতে আসতো, তার সঙ্গে ওলেঙ্কা যদি রান্না ঘরে গিয়ে কথা বলতে চাইতো, সে বলে উঠতো, এই দেখলে তো, তোমার জন্য লঙ্কা বেশি পড়ে গেল, এখন তুমিই বলবে এতো ঝাল খেতে পারিনে, কিংবা বলবে, ওহ তোমার কথায় কান দিতে গিয়ে নুন দিতে ভুলে গেছি । যারা ওই শহরে দক্ষিণমুখো ফ্ল্যাট কিনতে বাধ্য হয়, তারা বাস্তুশাস্ত্রের ইঞ্জিনিয়ারকে ডেকে দরোজা ভেঙে আরেকটু পশ্চিম-দক্ষিণ কিংবা উত্তর-পশ্চিমের দিকে সরিয়ে নেয় । সেই ইঞ্জিনিয়ারের উপদেশ মেনে ফ্ল্যাটের ভেতরেও নানা রকমের অদলবদল করে । পায়খানার দরোজা যদি রান্নাঘরের দিকে মুখ করে হয় তাহলে পায়খানার দরোজায় বিরাট আয়না লাগিয়ে নেয়, যাতে মনে হবে রান্নাঘরের সামনে বুঝি আরেকটা রান্না ঘর রয়েছে । ওলেঙ্কার ইচ্ছা ছিল বাবা অমনই একটা ফ্ল্যাট ভাড়া নিন যার রান্নাঘরের সামনে পায়খানার দরোজায় বিরাট আয়না বসানো আছে ; ও তাহলে নিজেকে পুরোটা আয়নায় দেখতে পেতো, রোজ আয়নার ওলেঙ্কার সঙ্গে গল্প করতো, কলেজে যাবার সময়ে তাকে টাটা করে যেতে পারতো ।”
“অনেক ঘোরাঘুরির পর ওলেঙ্কার বাবা একটা চল্লিশতলা বিলডিঙের একত্রিশ তলায় ফ্ল্যাট পেলেন। সেই ফ্ল্যাটের বারান্দায় দাঁড়িয়ে ওলেঙ্কা নিজেকে বলেছিল, কী বোকা এখানকার লোকগুলো ; এতো উঁচুতে যদি ফ্ল্যাট হয়, তাহলে তার মুখ যেদিকেই হোক খোলা হাওয়া পাবেই, এমনকি দক্ষিণখোলা ফ্ল্যাটও ঝড় উঠলে সামলাতে পারবে না, বন্ধ কর বন্ধ কর বলে-বলে জানলা বন্ধ করতে থাকবে । এতো উঁচুতে ফ্ল্যাট, মশাও আসে না, মশাদের ডানায় ব্যথা করে এতো উঁচুতে উড়ে আসতে । চল্লিশতলা বিল্ডিং বলে সব ফ্ল্যাটেই বিশাল-বিশাল জানালা আর তাতে কাচ বসানো, কাচের রঙ কালচে, যাতে রোদের আলো এসে গায়ে জ্বালা না ধরায়, ল্যাঙটো হয়ে থাকলে কেউ দেখতে না পায় । যারা চাইবে তারা জানলা খুলে রোদ পোয়াতে পারবে । সকালের রোদের আলোয় নাকি ভিটামিন ডি পাওয়া যায়, বাবা ওকে বুঝিয়েছিলেন একবার, যখন ওরা আগের শহরে থাকতো, আর সেখানে রবিবারের দুপুরে শীতের সময় বাবা গায়ে সর্ষের তেল মাখতেন । নতুন শহরে ফ্ল্যাটগুলো এতো উঁচুতে যে আগের শহরের মতন জানালায় গ্রিল বসানো নেই, চোরে অতো ওপরে উঠতেই পারবে না, ওঠেও যদি, নামতে পারবে না, নামেও যদি, গেটের ওয়াচম্যানের সিসিটিভিতে ধরা পড়ে যাবে । সেখানের পুলিশ ঘুষ নিয়ে ছাড়ার আগে বেদম পিটুনি দেয়, জানতে চায় কোন নেতার আণ্ডারে কাজ করে ।”
“সেই শহরে শীতঋতু বলে কিছু আসেনা । লোকেরা বলে সেই শহরে চার মাস বর্ষাকাল আর আটমাস বসন্তকাল । ওলেঙ্কার বাবার আর সর্ষের তেল মাখা হতো না, লুকিয়ে মায়ের ময়েশ্চারাইজার মেখে নিতেন, জানে ও, বাবার গা থেকে সুগন্ধ বেরোয় স্নান করে বেরোলে । বাবা অবশ্য বিদেশি ডেওডোরেন্ট মাখতে ভালোবাসেন, বলেন না মাখলে, ভিড়ের দুর্গন্ধ গায়ে চেপে বসবে । সর্ষের তেল মাখার অভ্যাস ছাড়তে হয়েছে বাবাকে, তাতে মায়ের আনন্দ, মায়ের একেবারে পছন্দ ছিল না শীতকালে গায়ে সর্ষের তেল মাখা। ওলেঙ্কার বাবা বাস্তুর ইঞ্জিনিয়ারদের কথাবার্তা বিশ্বাস করেন না, আবার অবিশ্বাস করতেও ভয় পান । উনি বলতেন যে হরপ্পা আর মহেঞ্জোদারো তো বাস্তুর ইঞ্জিনিয়ারদের পরামর্শে তৈরি হয়েছিল, সেগুলো ধ্বংস হয়ে হাওয়ায় মিলিয়ে গেল কেন, লোকে এখনও পর্যন্ত সেই সময়ের মানুষদের ভাষা আজও বুঝে উঠতে পারলো না । যিশুখ্রিস্টের জন্মের তিনচার হাজার আগের ব্যাপার-স্যাপার ।”
“পিচ্চির দিকে তাকিয়ে কইন্যা ওলেঙ্কা বলল, তুমি ঠিকই বলেছিলে, ভাষা হলো যতো নষ্টের গোড়া, তখন নিশ্চয়ই বুড়োরা বসে বসে চারটে বেদ লিখেছিল, মনু লিখেছিল মনুস্মৃতি । ভেবে দ্যাখ, মনুস্মৃতি না লিখলে ইণ্ডিয়ায় এতো হ্যাঙ্গাম হতো না জাতপাত নিয়ে, রোহিত ভেমুলা আত্মহত্যা করতো না, গোবিন্দ পানসারে, গৌরী লঙ্কেশ আর নরেন্দ্র ধাবোলকর খুন হতো না, গোরুর চামড়া ছাড়াবার জন্যে দলিতদের প্যাঁদানি খেয়ে মরতে হতো না, এখন যারা নিজেদের বলে বামুন, তারাই গোরুর চামড়া ছাড়াতো, জুতো তৈরি করতো, বিফ স্টিক খেতো, অশ্বমেধের পর ঘোড়ার মাংসের কাবাব খেতো । খুঁজে বের করেছিল কিন্তু সাহেবরা, বলেছিলেন ওলেঙ্কার বাবা, জেমস ফারগুসন নামে নীলকুঠির মালিক আর অযোধ্যার রাজার সেনাবাহিনির প্রধান আলেকজাণ্ডার কানিংহাম । অনেক সোনাদানা লুটপাটের পর ওদের হাতে আর কিছু করার ছিল না, তাই ভাঙাচোরা প্রাসাদ আর ধ্বংসাবশেষের বিষয়ে বই লিখতে গিয়ে যা যা মনে হয়েছিল ওদের, লিখে গেছে । এখনকার বাস্তুর ইঞ্জিনিয়াররা ওদের দেয়া জ্ঞান বিক্রি করে দিব্বি বড়োলোক হয়ে যাচ্ছে, কানে হিরে আর কাঁধে গেরুয়া চাদর রেখে বুকনি বিক্রি করে ব্যাটারা । ওলেঙ্কার অবশ্য ইচ্ছে ছিল যে বড়ো হয়ে ওও বাস্তুর টিচার হবে, কার বাড়ির ভেতরটা কেমন হওয়া উচিত, কোথায় কী রাখা উচিত, কোন দিকে মাথা করে শোয়া উচিত, এই সব জ্ঞান দিয়ে মোটাটাকা রোজগার করবে, পড়তে-লিখতে জানলেই হলো । কিন্তু ওলেঙ্কারর বাবা চেয়েছিলেন যে ও বড়ো হয়ে ডাক্তার হোক কিংবা ইঞ্জিনিয়ার হোক ; ওলেঙ্কার তাই একেবারেই ইচ্ছা করে না বড়ো হতে, বারো বছর বয়সেই আটকে থাকতে চায়, স্যানিটারি ন্যাপকিন বাঁধতে হতো না, তিন-চারদিন ব্যথায় কাতরাতে হতো না, অথচ পুরোনো শহর থেকে নতুন শহরে আসতে-আসতেই ও এগারো থেকে বারো বছরের হয়ে গেল, হঠাৎই পিরিয়ড আরম্ভ হয়ে গেল ।”
“কইন্যা ওলেঙ্কার বাবা ওকে বুঝিয়েছিলেন কলেজে গিয়ে ভর্তি হবার জন্য কি-কি করতে হবে, কেননা সেই বছর থেকে সরকারি নিয়ম হয়েছিল যে ছাত্র-ছাত্রী নিজেই যাবে ভর্তি হবার জন্য, বাবা-মা বা অন্য কোনো অভিভাবকের সঙ্গে আসার দরকার নেই ।”
রিমা খান নিশ্চিত হলেন যে পুরো গল্পটা বানিয়ে বলেছে ওলেঙ্কা, ওর নাম ওলেঙ্কা নিশ্চয়ই নয় । পিচ্চি যা লিখে রেখেছে, তা থেকে মনে হয় যে সেও তেমন বিশ্বাস করতে পারেনি । মেয়ে দুটোকে এবার কাস্টডিতে নিতে হবে । ভোমসোকে বলতে হবে আদালতে তোলার জন্যে প্রমাণ যোগাড় করে রাখতে তার আগে, নয়তো জামিন পেয়ে গেলে উকিল ওদের গড়েপিটে মিথ্যের ঝুড়ি করে দেবে ।
“নিজের জীবনকে কাহিনি হিসাবে পর্যালোচনা করা আর সেই কাহিনি অন্যদের জানানোটাই মানুষকে করে তোলে মানুষ । জীবনের মানে খোঁজার জন্যেই লোকে কাহিনি ব্যবহার করে, বোঝার জন্যে, যে আমরা কে, সেই কাহিনি দিয়ে বাস্তবকে গড়ে নেয়া হয় । এই হয়েছিল, তাই ঘটেছিল, তারপর সেই ঘটনা, আমি সেখানে ছিলুম, আমি লোকটা অমুক । কাহিনি দিয়ে স্বপ্ন তৈরি করে ফেলা হয়, বর্ণনা করা হয় রোজকার সালতামামি, স্মৃতিকে বিলিয়ে দেয়া হয়, সকলের স্মৃতিই কমবেশি প্রায় একই ধরনের । তা সত্বেও নিজের জীবনের ঘটনা বর্ণনা করা সহজ নয় ; নিজের অভিজ্ঞতা আর বিশ্বাসকে মিথ্যের মধ্যে দিয়ে টেনে নিয়ে যেতে হয়, কাহিনির চরিত্ররা বর্ণনার শিকার, কাহিনিকারের লুকিয়ে রাখা জগতকে মিথ্যে দিয়ে মুড়ে রাখার চেষ্টা । যে বলছে বা লিখছে সে তা সচেতনভাবেই করে, নিজেকে ভুলতে পারে না, কাহিনি বর্ণনা করার সময়ে। ব্যাপারটা কঠিন কঠিন কঠিন কঠিন ।”
৭
পরের দিন সকালে এসে প্রথমে পিচ্চির সাত নম্বর খাতা পড়তে লাগলেন রিমা খান, যথারীতি সিগারেট ধরিয়ে, টেবিলের তলায় দুই পা দুদিকে ছড়িয়ে । ওনার মনে হল যে পিচ্চি নিজেও বোধহয় অবিশ্বাস থেকে মেয়ে দুটো সম্পর্কে অনুসন্ধান চালাচ্ছে ।
“পিচ্চি কনে বিন্নিকে বলল, তোমার জীবনের গল্প বলো, নিশ্চয়ই গামবেটে হবে, যা একখানা বোম্বেটে মেয়ে তুমি, আমাকেই রক্তাক্ত করে দিয়েছ।”
“কনে বিন্নিদের বিলডিঙের কাছাকাছি ‘গার্লস ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ কলেজ’ সবচেয়ে নামকরা ; কলেজে দরখাস্ত দিয়েছিলেন বাবা, নিজের অফিসের বেসরকারি প্যাডে । কলেজ থেকে চিঠি এসেছিল যে বিন্নি যেন আগামি মাসের তেরো তারিখে দশটা বেজে একুশ মিনিটে কলেজের মেইন গেটে এসে হাজির হয়ে যায়, গেট থেকে বিশেষ গাইড ওকে কলেজের দপতরে পৌঁছে দেবে । এই কিছুকাল আগে পর্যন্ত বাবা-মাকে গিয়ে ধরাধরি করতে হতো, ফর্ম তুলতে হতো । এখন কলেজ ইউনিয়ানের সচিবের কাছে ছাত্রীকে নিজেই ইনটারভিউ দিতে হয়, ফর্ম তোলার জন্যে ক্যাশ পেমেন্ট করতে হতো । দেখা গেলো যে অনেক ছেলে-মেয়ের বাবা-মা নিজেরা কখনও কলেজে পড়েননি, তাই বাবা-মায়ের ইনটারভিউ প্রথা বন্ধ করে দিয়েছে সরকার-অনুমোদিত ছাত্র ইউনিয়ান । বিন্নির মনে হয়েছিল, বাবা-মায়ের ইনটারভিউ হলে ভালো হতো, ওর বাবা-মা তো লেখাপড়া শেখা, স্কুলে আর কলেজে পড়াশুনায় মেডেল পেয়েছিলেন দুজনেই, ভালো ইংরেজি বলতে পারেন । ছাত্র ইউনিয়ানের সচিব বিন্নির কানে কানে বলেছিল যে ওর সঙ্গে এক রাত শুলে অ্যাডমিশানের কোনো সমস্যা হবে না । বিন্নি তক্ষুনি রাজি হয়ে গিয়েছিল, শোবার অভ্যাস ওর আছে, অচেনা কারোর সঙ্গে শোবার আনন্দই আলাদা, তবে বিছানা নরম হওয়া দরকার । ঘাসে, সিমেন্টের ওপর, গাড়ির সিটে, কাঠের খাটে চলবে না, মোটেই চলবে না। তার আগে বিন্নি একা কেমন করে ইনটারভিউ দেবে ও বুঝে উঠতে পারছিল না । ওকে যদি প্রশ্ন করা হয় যে মানুষের মাথার চুল প্রতিমাসে কয় সেন্টিমিটার বাড়ে, ও উত্তর দিতে পারবে না ।”
“অথচ নতুন নিয়ম হয়েছে যে কোনো অভিভাবককে, যদি কলেজের গেটের কাছেও দেখা যায়, তাহলে ছাত্রীটিকে তক্ষুনি বিদায় করে দেয়া হবে, আর তার নাম ছাত্র ইউনিয়ানের কালো তালিকায় লিখে রাখা হবে, যাতে ভবিষ্যতে সে কলেজে ভর্তি হতে না পারে, কেবল এই কলেজে নয়, শহরের কোনো কলেজেই তার দাখিলা নেয়া হবে না । শহরের সব কয়টা কলেজ কর্তৃপক্ষ নিজেদের পাহারাদারদের পাকা সড়ক পর্যন্ত দাঁড় করিয়ে রেখেছেন যাতে তারা নজর রাখতে পারে যে, ভর্তির সময়ে কেউ ছাত্রীর সঙ্গে আসছে কিনা, দূর থেকে পথ দেখিয়ে চলে যাচ্ছে কিনা। অমন কয়েকটা কেস ধরা পড়ার পরে সেই সমস্ত হবু ছাত্রীদের নাম কালো তালিকায় লিখে রাখা হয়েছে, তারা বাধ্য হয়ে শহর ছেড়ে বহু দূরের কোনো শহরে চলে গেছে যেখানে এই শহরের ছাত্র ইউনিয়ানের কালো তালিকাকে গুরুত্ব দেয়া হয় না ।”
“কোনো কোনো বাবা-মা মাঝরাতে লুকিয়ে নিজেদের ছেলে মেয়েকে কলেজের পথ দেখিয়ে দিয়ে গেছেন যাতে তারা রাস্তা হারিয়ে না ফেলে । বিন্নিকে ওর বাবা রাত দুটোর সময় কলেজের গরমের ছুটিতে ঘুম থেকে তুলে নিয়ে গিয়ে দেখিয়ে দিয়ে এসেছেন গেটটা, বেশ দূর থেকে, যাতে কলেজে ইউনিয়ানের পাহারাদাররা ওনাকে আর বিন্নিকে দেখতে না পায় । বাবা জিগ্যেস করেছিলেন, কী, নিজে চলে আসতে পারবি তো ? বিন্নি ঘাড় নেড়ে জানিয়েছিল যে পারবে । তবু ওর ভয় ছিল, রাস্তায় যদি ধর্ষকরা ওৎ পেতে থাকে, যদি কুড়িজন মিলে ওকে গণধর্ষন করে, সরকার তো বলবে এরকম কোনো ঘটনা আদপে ঘটেনি, কিংবা বলবে অমন ঘটনা তো কতোই হয়, কিন্তু ও কী করবে, তারপর বেঁচে থাকার উদ্দেশ্য পালটে যাবে, যা এখন হয়েছে ।”
“বাড়িতে বাবা বিন্নির পরীক্ষা নিয়েছেন যাতে ও কলেজে ভর্তি হতে গিয়ে নিজেই ফর্ম ভরতে পারে, বাবার নাম, মায়ের নাম, ঠিকানা, ল্যাণ্ড লাইন নম্বর, মোবাইল নম্বর, ইমেল আইডি, উচ্চতা, বুকের ঘের, কোমরের ঘের, পাছার ঘের, পায়ের জুতোর মাপ, বডিসের সাইজ, স্যানিটারি ন্যাপকিনের মাপ, চশমার পাওয়ার, ফর্মের খোপে-খোপে ঠিকমতন ভরতে পারে । ফর্মটা কেমন তা ওর বাবা নিজে দেখেননি, তবু আন্দাজে ওকে বুঝিয়েছেন । বাবা ঘড়িতে দেখে নিয়েছেন ও প্রায় এক ঘণ্টায় ফর্ম ভরে নিতে পারে । প্রথম দিকে বিন্নির ভুল হতো, বারবার প্র্যাকটিস করে নির্ভুল ভরতে শিখে গিয়েছিল ।”
“ফর্ম ভর্তি ছাড়াও যদি অঙ্কের ইংরেজির সাধারণ জ্ঞানের পরীক্ষা নেয়, তাই বিন্নির বাবা বাড়িতে মোবেইল ফোনে অ্যালার্ম লাগিয়ে পরীক্ষা নিয়েছেন । প্রায় মাস খানেক লেগেছে শিখতে । তারপর সাধারণ জ্ঞানের পরীক্ষা নিয়েছেন বাবা, যেমন পৃথিবী যে গোল তাহা কী করিয়া প্রমাণ করিবে, সূর্যের চারিধারে পৃথিবী ঘোরে নাকি পৃথিবীর চারিধারে সূর্য ঘোরে, পূর্ণিমা ও অমাবস্যা কেন হয়, গ্রহণ কেন হয়, শীতকাল ও গ্রীষ্মকাল কেন হয়, পৃথিবী কোন দিকে ঘোরে, জোয়ার-ভাটা কেন হয়, এইসব ।”
“কলেজে যাবার আগের দিন বাবা-মা বললেন, ভালো করে ঘুমিয়ে নে, বেশি চিন্তাভাবনা করিসনি, যাবার রাস্তা তোকে দেখিয়ে দিয়েছি, মোড়ে গিয়ে ছেড়ে দেবো, সোজা কলেজে চলে যাবি। বিন্নির ঘরে এয়ারকাণ্ডিশান চালিয়ে, ওর গায়ে কম্বল চাপা দিয়ে, ঘুমোতে বললেন মা । মোবাইলে অ্যালার্ম লাগিয়ে মাথার শিয়রে রেখে দিলেন । দুপাশে ওর প্রিয় সফ্ট টয়, তিন ফিটের কাঙারু আর দুই ফিটের ইগুয়ানা নিয়ে, ঘণ্টাখানেকের মধ্যে ও ঘুমিয়ে পড়লো ।”
“দশটা বেজে একুশ মিনিটে স্কুলের গেটে পৌঁছে গেল বিন্নি, ওর হাতে ঘড়ি ছিল, কাঁটায় কাঁটায় মিলিয়ে ও পৌঁছে গিয়েছিল কলেজের গেটে । কলেজে পৌঁছে ও দেখলো, গেটটা সোনালি রঙের, ও হাত বুলিয়ে বোঝার চেষ্টা করছিল যে সেটা লোহার ওপরে সোনালি রঙ করা নাকি সত্যিই সোনার । গেটে কোনো দারোয়ান ছিল না বা ওয়াচম্যান, যেমন ওর আগের কলেজে ছিল । এদিক ওদিক তাকিয়ে দেখলো সিসিটিভি আছে কিনা যা দেখে ইউনিয়ানের নেতারা বুঝতে পারে গেটে কারা এসে দাঁড়িয়েছে, দেখলো কিছুই নেই, কেবল উঁচু গাছের সবুজ অন্ধকার জঙ্গল, গাছগুলোও অনেক-অনেক ঘেঁষাঘেঁযি, লতারা নির্লজ্জের মতন তাদের জড়িয়ে টঙে পৌঁছে গেছে ।”
“ব্রাজিলের জঙ্গলের ক্যাসেটে ও দেখেছে এই রকমের গাছ, ওর জ্ঞান-বিজ্ঞানের বইতে এই ধরণের গাছের উল্লেখ আছে, ছবিও আছে । ওই তো তালগাছের মতন দেখতে ব্যারিগোনা, নারকেলগাছের মতন দেখতে হুয়াসাই, রবার গাছ, ব্রাজিল বাদাম -- বাদাম হয়ে আছে ডালে ডালে, উইমবাগাছ -- কি বিশাল আর কতো ওপরে উঠে গেছে, এই গাছগুলোই অন্ধকার করে দিয়েছে কলেজে ঢোকার রাস্তাটা, রেডইন্ডিয়ানরা ভাগ্যিস নেই এই শহরে, ওরা তো মনে করে এই গাছে ভুতপ্রেত থাকে, ফিকাসগাছ -- শেকড়গুলো যেন মাদুরের মতন এলানো । আর, ওহ, কতোরকমের ফুল, কতোরকমের অর্কিড, কতোরকমের প্যাশান ফ্লাওয়ার, লাল টকটকেগুলো নজরে পড়ছে বেশি । বিন্নি একটা ফুল তুলে নিজের খোঁপায় চুলে গুঁজে নিলে, বিন্নি এমন নাচতে আরম্ভ করল যেন ওর গা থেকে লিবার্টি ইকুয়্যালিটি ফ্র্যাটারনিটির সোনার গুঁড়ো ঝরে ঝরে পড়ছে, যেন ও এক্ষুনি ফরাসি বিপ্লব আর নভেম্বর বিপ্লবের পতাকা উড়িয়ে ফিরছে ।”
“গেটে হাত দিয়ে বিন্নি বোঝার চেষ্টা করছিল সোনার কিনা, কোনো অজ্ঞাত কন্ঠস্বর লাউডস্পিকারে বলল, হ্যাঁ, মিস বিন্নি, অ্যাজ ইউ প্লিজ ওয়ান্টেড টু বি কল্ড, তুমি যথার্থ অনুমান করেছ, স্কুলের গেট সোনায় তৈরি । বিন্নি মনে-মনে নিজেকে বলল, সোনার ? কিন্তু ডাকাতরা এখনও তুলে নিয়ে যায়নি ? এদেশে কি চোর-ডাকাত-বাটপাড় নেই ! বিন্নি শুনতে পেলো কেউ বলছে, লাউডস্পিকারের মতন কন্ঠে, আপনি যথার্থ অনুমান করেছেন মিস বিন্নি, কোনো চোর-ডাকাত-বাটপাড়ের সাহস হয়নি গেট খুলে নিয়ে যাবার, তারা জানে সোনার গেট খুলে নিয়ে গেলে তাদের কেমনতর দশা হবে ।”
বিন্নি ভাবছিল, আর কোনো ছাত্র-ছাত্রী আসেনি কেন ভর্তি হবার জন্য ! ও শুনতে পেলো কেউ ওকে নির্দেশ করে বললো, মিস বিন্নি, আপনি গেটের মধ্যে যে ছোটো গেট রয়েছে, তার ভেতর দিয়ে সোজা চলে আসুন, আপনার জন্য কলেজ কর্তৃপক্ষ অপেক্ষা করছেন । আজকে কেবল আপনাকে ডাকা হয়েছে, প্রতিদিন একজনকে ভর্তি করার জন্য ডাকা হয় । গেটের ছোটো ফোকোর দিয়ে ঢুকে ও দেখলো, বিশাল জঙ্গল, সুন্দরবনের চেয়েও ঘন জঙ্গল, বিশাল বিশাল উঁচু গাছ, যেগুলোকে ও চিনতে পারলো না, কিন্তু শুনতে পেলো কোথাও করাত দিয়ে গাছ কাটা হচ্ছে আর গাছগুলো সশব্দে পড়ে যাচ্ছে ।
ওর বুক ঢিপ-ঢিপ করতে লাগলো, যদি কলেজ ইউনিয়ানের সচিব বা সহসচিব এই গাছগুলোর নাম জানতে চায়, ও তো সঠিক উত্তর দিতে পারবে না । শালপাতার চেয়েও বড়ো-বড়ো পাতা, উঠে গেছে অনেক ওপরে, যেন ও ব্রাজিলের অ্যামাজন জঙ্গলে চলে এসেছে । গাছের ডালে-ডালে নানা রঙের ম্যাকাও পাখি দেখে বিন্নির অবাক লাগলো যে এই পাখিরা ও শহরে কোথা থেকে এলো, ওরাও কি পালকের রঙ অনুযায়ী এক-একটা ইউনিয়ান খুলেছে ! ওকে দেখে ম্যাকাও পাখিগুলোর কী আনন্দ, যেন কতোকাল থেকে চেনে । কতো রকমের রঙবেরঙের ম্যাকাও টিয়াপাখি, সবকয়টা একসাথে গাইছিল, ওয়েলকাম বিন্নি । নীল আর সোনালি রঙের ম্যাকাওপাখি, প্রায় তিন ফিট লম্বা, বড্ডো চেঁচায়। সবুজডানা লাল রঙের ম্যাকাও, ওদের ট্রেনিঙ দিলে মানুষের বন্ধু হয়ে ওঠে, কলেজ থেকে ফেরার সময় একটা এরকম ম্যাকাও বাড়িতে নিয়ে যাবে , কথা বলার মতন অন্তত কাউকে তো পাবে, যে মানুষ হয়ে জন্মায়নি । ছোট্টো হাহনের ম্যাকাও, সবুজ রঙের, ট্রেনিঙ দিলে তাড়াতাড়ি সবকিছু শিখে নিতে পারে, টিয়া পাখির মতন, কথা বলতে পারে । কালো রঙের হায়াসিন্হ ম্যাকাও, এদের পোষ মানানো বেশ কঠিন, সব সময় চায় যে ওদের খেয়াল রাখা হোক ।
পাখিগুলো বিন্নিকে পর্তুগিজ বা স্প্যানিশ ভাষায় স্বাগতম না জানিয়ে পরিষ্কার বাংলায় ওর নাম করে চেঁচাচ্ছিল, স্বাগতম মিস বিন্নি । দুটো পাখি এসে ওর কাঁধের ওপর বসে বললো, চলুন মিস বিন্নি, আপনাকে কলেজের অফিসঘরে নিয়ে যাই, আপনি তো পথ চিনে যেতে পারবেন না এই গভীর জঙ্গলে । চিন্তা করবেন না, বললো একটা ম্যাকাও পাখি, এই জঙ্গলে বিচুটিঝোপ নেই, সাপ-গিরগিটি আছে বটে, তা সেগুলো আমাদের দলের কেউ কেউ খেতে ভালোবাসে, নজর রাখে । বিন্নি জিগ্যেস করল, তা আপনাদের দেখতে এতো সুন্দর কিন্তু এরকম কর্কশকন্ঠ কেন ? লালসবুজ ম্যাকাও সবায়ের হয়ে উত্তর দিলো, আসলে কি জানেন, যাদের যতো সুন্দর দেখতে তাদের কন্ঠস্বর ততো কর্কশ হয় । বিন্নি বলল, ভুল ভুল ভুল, আমাকে দেখতে কতো সুন্দর, আমার কন্ঠস্বরও মাদার মেরির মতন, সুচিত্রা সেনের মতন, মধুবালার মতন, মাধুরী দীক্ষিতের মতন, কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতন, সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের মতন ।
বিন্নি জিগ্যেস করল, অফিসঘরটা কোথায়, দেখতে পাচ্ছি না, ইউনিয়ানের সচিব বলেছিলেন তাঁর সঙ্গে শুতে, তা তিনি কোথায় ? নীল-সোনালী ম্যাকাও পাখি সবায়ের হয়ে উত্তর দিলো, ভেতরের ভেতরের ভেতরের ভেতরের ভেতরে । বিন্নি বলল, অতো ভেতরে, আচ্ছা ! এই ঘন জঙ্গলের ভেতরে কলেজের অফিস জেনে ভালো লাগলো বিন্নির । বিন্নিরর আগের শহরের কলেজে ইঁট আর সিমেন্টের অফিসঘরে কাউন্টারে দাঁড়িয়ে লাইন দিয়ে কেরানিবাবুকে প্রশ্ন করে সবকিছু জানতে হতো, সিলিঙ ফ্যানের ক্যাঁচোর ক্যাঁচোর আওয়াজের তলায় দাঁড়িয়ে । এই কলেজটা কী সুন্দর, কতো হাওয়া, মনে হয় যেন কাছে কোনো নদী বইছে, অ্যামাজন নদীর কোনো ধারা গঙ্গার সঙ্গে মিশে এতোদূর পর্যন্ত চলে এসেছে, অবাক হয় বিন্নি । পাখিরা একজন আরেকজনের হাতে হাই ফাইভ করে বলে গুড লাক ।
অ্যামাজন নদী তো বিশাল, তার জন্যেই পঞ্চান্ন লক্ষ কিলোমিটার জুড়ে আর্দ্র জলবায়ুর অরণ্য, ষোলো হাজার রকমের গাছ আছে, ব্রাজিল ছাড়াও পেরু, কলোমবিয়া, ভেনেজুয়েলা, ইকুয়েডর, বোলিভিয়া, গায়ানা, সুরিনাম আর ফরাসি গায়ানায় ছড়িয়ে । পৃথিবীর শতকরা কুড়ি ভাগ অক্সিজেন আসে অ্যামাজনের জঙ্গল থেকে, তিনশোর বেশি রেডইন্ডিয়ান উপজাতি এখনও থাকে জঙ্গলের ভেতরে --- আরও উপজাতি ছিল, স্পেন আর পর্তুগালের সাহেবরা এসে তাদের মেরে ফেলেছিল, এখন গাছ কেটে-কেটে সাহেবরা জঙ্গলটাকে ছোটো করে ফেলছে । আর গঙ্গার ধারে হেগে হেগে ভারতীয়রা শিবের মাথার ঝর্ণায় গুয়ের গন্ধ পৌঁছে দিয়েছে ।
অ্যামাজন জঙ্গল না থাকলে কোথায় যাবে পঁয়তাল্লিশ লক্ষ প্রজাতির পোকামাকড়, চারশো আঠাশ প্রজাতির উভচর, তিনশো আটাত্তর ধরণের সাপখোপ-গিরগিটি, চারশো সাতাশ ধরণের স্তন্যপায়ী প্রাণী, নদীর তিন হাজার রকমের মাছ আর জলজ প্রাণী ! বিন্নির কাছে জানতে চাইলে ও কিছুই বলতে পারবে না ; হয়তো ছাত্র ইউনিয়ানের সচিব বলতে পারবে। আগে যে শহরে বিন্নি পড়তো সেই কলেজে তো একটাও গাছ ছিল না, খেলবার মাঠে ঘাসও ছিল না, ছাত্ররা ধুলোয় ক্রিকেট আর ফুটবল খেলতো । বিন্নির শাড়ি রোজই ময়লা হয়ে যেতো । আর এই কলেজে কেবল গাছ নয়, কতো রকমের রঙিন পাখি, কতো রকমের ফুল আর ফল ।
একটা ম্যাকাওপাখি বলল, সাবধানে পা ফেলবেন, বুনো পিঁপড়ের ঝাঁক, ট্যারানটুলা মাকড়সার বাসা, বিষাক্ত ব্যাঙ, সোয়াঁপোকা থাকতে পারে । কলেজে প্রবেশের মুখে ছাত্রীদের বুদ্ধি আর প্রত্যুৎপন্নতা পরীক্ষার জন্য এই ব্যবস্হা রাখা হয়েছে, কিন্তু আপনি আমাদের প্রিয় বলে আগেই সাবধান করে দিচ্ছি।
শুনে ভয় করতে লাগলো বিন্নির । এ কেমন কলেজ, আর তাদের এ কেমন পরীক্ষা । প্রশ্ন করে পরীক্ষা নেবার বদলে ভয় দেখিয়ে পরীক্ষা নিচ্ছে । কিন্তু ফিরে যাওয়া যাবে না । বাবা বলবেন তুই কতো ভিতু রে ; সামান্য পিঁপড়ে, মাকড়সা, ব্যাঙ, সোয়াঁপোকার কথা শুনে ভয় পেয়ে গেলি !
ম্যাকাও দুটোকে কাঁধে নিয়ে হাঁটতে হাঁটতে বিন্নি পৌঁছোলো একটা ঘোলাটে নদীর পাড়ে, সেখানে কয়েকটা ডিঙিনৌকা বাঁধা রয়েছে, তাতে রেডইন্ডিয়ান উপজাতি মাঝিরা বসে । সব কয়টা মাঝিই চেঁচাতে লাগলো, স্পষ্ট বাংলায়, শ্রীমতি বিন্নি আমার নৌকায় আসুন, কলেজে যাবেন তো, আসুন আমি সন্ধ্যা হবার আগেই পৌঁছে দেবো, কিছুক্ষণেই বৃষ্টি আসবে, আমার নৌকায় ছাউনি আছে, ভিজবেন না । এরা বোধহয় ব্রাজিল বা পেরুর উপজাতি, এরাও বাংলায় কথা বলছে, বেশ আনন্দ হলো বিন্নির ।তোমরা বাংলায় কথা বলতে পারো ? অবাক বিন্নি জিগ্যেস করলো মাঝিদের।
একজন মাঝি, যার গলায় রঙবেরঙের পুঁতির হার, বেঁটে আর মোটা, কাঁধ পর্যন্ত চুল, চোখ দুটো তুলনামূলক ভাবে ছোটো, বলল, কেন পারব না, এখন তো বাংলা ভাষা পৃথিবীর ভাষা হয়ে গেছে, এরকম মিষ্টি ভাষায় সকলেই কথা বলতে চায়, দেখলেন তো পাখিগুলোও বাংলায় কথা বলছিল । ম্যাকাওপাখিরা উড়ে ফেরত চলে গিয়েছিল । বিন্নি মাঝিদের দিকে তাকিয়ে জানতে চাইলো, কলেজটা কোথায়, নৌকো করে কোথায় যাবো ? আমি তো ভেবেছিলুম গেট দিয়ে ঢুকলেই কলেজের দপতর, সেখানে ইউনিয়ানের দেয়া ফর্ম ভরে ভর্তি হয়ে যাবো। বিন্নিকে নিজের নৌকোয় নেবার জন্য একজন জিনস-আর টিশার্ট পরা মাঝি আরেকজন মাঝির দিকে হাত দেখিয়ে বলল, মিস বিন্নি, ওর নৌকোয় উঠবেন না, ওর গায়ে গনজালো পিজারোর রক্ত আছে । ব্যাস দুজন মাঝির মধ্যে হাতাহাতি আরম্ভ হয়ে গেল ।
সেই ফাঁকে যে মাঝির গলায় পুঁতির মালা আর ডিঙিতে ছাউনি ছিল, সে বিন্নিকে কোলে তুলে নিয়ে নিজের ডিঙিতে বসিয়ে বলল, আপনার কোনো চিন্তা নেই বিন্নি, এখানে কোনো অঘটন ঘটে না, আপনি নিশ্চিন্তে কলেজে পৌঁছে যাবেন, রাতের ভেতরেই ভর্তিও হয়ে যেতে পারবেন । বিন্নি দেখলো ডিঙিতে ওর বয়সী বা ওর থেকে কয়েক বছর বড়ো একটা মেয়ে ওর দিকে তাকিয়ে ফিক-ফিক করে হাসছিল, মেয়েটার গায়ে একগাদা প্রজাপতি এসে বসছিল আর উড়ে যাচ্ছিল । ডিঙিতে ওঠার আগে খালি-গা মাঝির গায়েও অমন প্রজাপতির দল এসে কিছুক্ষণ বসছিল আর উড়ে যাচ্ছিল।
বিন্নি মেয়েটার পাশে গিয়ে বসল, ছাউনিতে বসার জায়গা ওই পাটাতনেই । বিন্নির শহরে তো এই বয়সী মেয়েরা খালি গায়ে থাকে না। বিন্নি মেয়েটাকে জিগ্যেস করলো তোমার আর তোমার বাবার গায়ে এরকম প্রজাপতিরা এসে বসছে কেন? মেয়েটা জবাবে বলল, উনি আমার বাবা নন, আমার দাদু, বাবার বাবা । বলে, টুক করে বিন্নির ঠোঁটে ঠোঁট ঠেকিয়ে চুমু খেলো । বিন্নির বেশ ভালো লাগলো, ভালো লাগার দরুন ওর সন্দেহ হল, ও নিজে বোধহয় লেসবিয়ান, এরকম ভালো তো আগে লাগেনি, স্কুলে পড়ার সময়ে কতো ছেলেকে চুমু খেয়েছিল ।
মেয়েটা আবার বিন্নির গালে ঠোঁট ঠেকালো, তারপর বলল, তুমি বেশ বোকা, কী করে ভর্তি হবে কলেজে । এই প্রজাপতিরা আমাদের ঘাম থেকে নুন খাবার জন্য আসে । তুমি পোশাক খুলে বোসো, তুমি তো বেশ ঘেমে গেছো, দ্যাখো প্রজাপতিরা তোমার গায়ে এসে বসে নুন খাবে। বিন্নি মেয়েটার চোখের দিকে তাকিয়ে বলল, তুমি বোকা নাকি, জানো না গায়ে প্রজাপতি বসলে বিয়ে হয় । মেয়েটা এবার জোরে হেসে বলল, প্রজাপতি না বসলেও বিয়ে হয়। আমাদের দেশে সকলেরই বিয়ে হয়। তারপর জানতে চাইলো, তোমার নাম কী ?
বিন্নি বলল, আমার নাম বিন্নি । মেয়েটা বলল, আমার দাদুর নাম আলভারেজ, এক ডাকে সবাই দাদুকে চেনে আমাদের গ্রামে । বিন্নি জানতে চাইলো, তোমাদের গ্রাম কোথায়, অনেক দূরে ?
এই ছোটো নদীটা গিয়ে মিশেছে উরুবাম্বা নদীতে, সেই উরুবাম্বা নদীর তীরে আমাদের গ্রাম, একটু ভেতরে যেতে হয়, নয়তো বর্ষায় উরুবাম্বার জল ভাসিয়ে দেবে গ্রামকে । বিন্নি মাঝির দিকে তাকিয়ে বলল, কলেজ কি রাতেও খোলা থাকে? আমার আগের কলেজে মর্নিং শিফ্ট তো দুপুর বেলাতেই ছুটি হয়ে যেতো । তার পরের শিফ্ট ছয়টায় ছুটি হয়ে যেতো । সকালে ব্রেকফাস্ট করে বেরিয়েছি, দুপুরে কোথায় কী খাবো, সন্ধ্যা হলে কী খাবো, আমার তো যখন-তখন খিদে পেয়ে যায় ।
মাঝি জলে নেমে নৌকো ভাসিয়ে দিয়ে বলল, বাহ, খোলা থাকবে না কেন, কলেজ মানে তো শিক্ষা, আর শিক্ষা তো চব্বিশ ঘণ্টার ব্যাপার। যতো শিখবেন ততো শিক্ষিত হয়ে উঠবেন । আর খাবার চিন্তা করবেন না, ওই তো দেখুন ওই পারে কতো আনারস হয়ে রয়েছে, ব্রাজিল নাট হয়ে রয়েছে । আমার ডিঙিতেও পাকা কলা আছে, পেঁপে আছে । আপনি যদি মাছ খেতে ভালোবাসেন তাহলে আমি নদী থেকে মাছধরে খাওয়াবো আপনাকে, আমার নাতনি মাছ ধরতে পারে । বিন্নি বলল, মাছ ? মাছ কেমন করে ধরবে, তোমার ডিঙিতে তো জালও নেই, ছিপও নেই, আর রাঁধবেই বা কোথায় ।
দাঁড়ান দেখাচ্ছি, বলে মাঝি উঠে দাঁড়িয়ে, নৌকোয় রাখা একটা সড়কি তুলে জলের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে, নাতনিকে বলল, এই নে , দেখিয়ে দে মিস বিন্নিকে। মেয়েটা ডান হাতে শড়কি নিয়ে জলের দিকে ঝুঁকে ছুঁড়ে মারলো, একটা মাছকে গিঁথে তুলে আনলো । শড়কি থেকে মাছটাকে বের করে নখ দিয়ে আঁশ ছাড়িয়ে ফেললো । বিন্নি বুঝতে পারলো যে মেয়েটা কিছুক্ষণ আগেই মাছ খেয়ে থাকবে, তাই গালে চুমো খাবার সময়ে আঁশটে গন্ধ বেরোচ্ছিল ।
মাঝি বললো, এবার এটাকে পাতায় মুড়ে পোড়াবো আর ফ্রেশ মাছ খাওয়াবো আপনাকে । মেয়েটা মাছটাকে একটা টিনের ওপরে রেখে কাঠের আগুনে পুড়িয়ে বিন্নিকে খেতে দিলে, বিন্নি এক টুকরো খেয়ে বলে উঠলো, আরে এ তো স্মোকড বিফের মতন, আগে এই মাছ খাইনি কখনও । মাঝি বলল, এর পর আপনাকে পিরানহা মাছ খাওয়াবো । বিন্নি আতঙ্কিত, বলল, পিরানহা খায় নাকি ? পিরানহারাই তো মানুষ খায় ।
মাঝি বলল, পিরানহা অনেক স্বাদু মাছ, একবার খেলে বার-বার খেতে চাইবেন । এই দেখুন, আমার গলায় যে মালা পরে আছি, তাতে এই লকেটটা পিরানহা মাছের দাঁত ।আমাকে একটা অমন মালা দিও তো, বাড়ি ফেরার সময়ে নিয়ে যাবো, বলল বিন্নি। মাঝি নিজের গলা থেকে মালাটা খুলে বিন্নির গলায় পরিয়ে বলল, আপনি এটাই নিয়ে যান না, আমার বাড়িতে অমন অনেক মালা আমার বউ তৈরি করে রেখেছে ।
কিছুটা যাবার পর নদীতে বড়ো-বড়ো ঢেউ উঠছে দেখে আলভারেজ বলল, নৌকোটা কিছুক্ষণের জন্যে কিনারায় লাগিয়ে নিই, ডায়নোসরের পাল বোধহয় নদী পার হচ্ছে, ওই পারের জঙ্গল অনেক ঘন তো, মগডালের কচি পাতা আর ফুল খেতে ওরা ভালোবাসে । বিন্নি অবাক হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল, বলল, ডায়নোসররা আর আছে নাকি, কোটি-কোটি বছর আগে সব রকমের ডায়নোসর মরে গেছে, এখন কেবল তাদের জীবাশ্ম, মানে ফসিল, পাওয়া যায়। বিন্নির কথায় মেয়েটা ওর গায়ে ঢলে পড়ে হাসতে লাগলো । বললো, তুমি তো দেখছি কিছুই জানো না, জুরাসিক পার্ক ফিল্ম দ্যাখোনি, এখানেই তো তার শুটিং হয়েছিল, এখানকার সবরকমের ডায়নোসররা তাতে অভিনয় করেছিল ।
শুনে ভয় করতে লাগলো বিন্নির, বলল, টির্যানোসরাস রেক্সরা এখনও বেঁচে আছে, তাহলে তো আমাদের সবাইকে চিবিয়ে খেয়ে ফেলবে । মেয়েটা বিন্নির গায়ে নিজের খোলা বুক চেপে বলল, , তুমি তো আচ্ছা পাগল দেখছি । এদেশের ইতিহাস পড়োনি । স্পেন আর পর্তুগালের লোকেরা যখন প্রথম এসেছিল তখন ওরা টির্যানোসরাস রেক্সের মাংসই তো খেতো । ওরা টির্যানোসরাস রেক্সদের খেয়ে-খেয়ে নিশ্চিহ্ণ করে দিয়েছে, যে কয়টা বেঁচে আছে তাদের পোষ মানিয়ে নেয়া হয়েছে, তারাই ফিল্মে অভিনয় করেছিল । অন্য মাংসাশী ডায়নোসরদেরও পোষ মানিয়ে নেয়া হয়েছে । এখন যে ডায়নোসররা জঙ্গলে বেঁচে আছে, তারা শাকাহারি , আমরা মাঝে-মাঝে তাদের ডিম যোগাড় করে খাই, খুবই পুষ্টিকর, একটা ডিমের অমলেটে বাড়ির সবাইকার পেটপুরে খাওয়া হয়ে যায় ।
নৌকোটা জোরে-জোরে দোলা আরম্ভ হয়ে গিয়েছিল । আলভারেজ বলল, নাতনি, ছইয়ের ভেতরে ব্রন্টোসরাস ডায়নোসরের একটা ডিম রাখা আছে, দেখা, বিন্নিকে দেখা । ছইয়ের পাটাতনে রাখা একটা ফুটবলের মাপের ডিমের দিকে আঙুল দেখিয়ে মেয়েটা বলল, ওই যে। নৌকো বেশ দুলছিল বলে নিজের জায়গা ছেড়ে ডিমটা হাত দিয়ে দেখার সাহস হলো না বিন্নির । পরে দেখবে। এখন ও উৎসুক সত্যিকারের ডায়নোসরের দল দেখবার জন্য । নাতনি হাততালি দিয়ে উঠতে বিন্নি চেয়ে দেখলো সত্যিই একদল চারপেয়ে উঁচুগলা ফিকে সবুজ রঙের ডায়নোসরের দল, অন্তত কুড়িটা হবে, বড়ো ছোটো মিলিয়ে, এতো গভীর নদী হেঁটে পার হচ্ছে, যে ডায়নোসরটা সবচেয়ে ছোটো তারও পুরো পা নদীর জলে ডুবছে না । মাঝির নাতনির হাততালি শুনে সবচেয়ে বড়ো ডায়নোসরটা ওদের নৌকোর কাছে মাথা নামিয়ে যেন চেনার চেষ্টা করল ।
ভয়ে বিন্নির বুক ওঠা-নামা আরম্ভ হয়ে গিয়েছিল, কি বিরাট মাথা, নাতনি ডায়নোসরের মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করছে দেখে বিন্নিরও হাত বোলাবার সাহস হলো । হ্যাঁ, ঠাণ্ডা, একটু খসখসে । ভোঁষ-ভোঁষ করে মোষের মতন শ্বাস ফেলছে । বাড়ি ফিরে বাবা-মাকে বললে কেউ বিশ্বাস করবে না । মোবাইল ফোনটা সঙ্গে রাখলে ডায়নোসরের সঙ্গে, নাতনির সঙ্গে, অ্যালভারেজের সঙ্গে অনেকগুলো সেলফি তুলে নিতে পারতো । আনতে পারেনি, কলেজে নিষিদ্ধ বলে । ডায়নোসরগুলো ওই পারে চলে গেলে অ্যালভারেজ আবার নৌকো চালানো আরম্ভ করল।
নাতনি কলার কাঁদি বিন্নির সামনে এনে রাখলে কয়েকটা খেয়ে মনে হলো পেট ভরে গেছে । নাতনি তবু একটা আনারস ছাড়িয়ে কিছুটা বিন্নিকে খাবার জন্য দিলো । কী মিষ্টি । বিন্নিকে ঠেলে ওলেঙ্কা চেঁচিয়ে উঠলো, ওই দ্যাখো, ওই দ্যাখো, এর আগে দেখেছো এই সাপ? বিন্নি দেখেছিল, ভেবেছিল জঙ্গলের বাঁশ জলে পড়ে কালো হয়ে গেছে আর ভাসতে ভাসতে চলেছে । মাঝির নাতনি বলল, ওটা অ্যানাকোণ্ডা সাপ । এই সাপ নিয়েও গাঁজাখুরি ফিল্ম হয়েছে । সাপগুলো অমন নয় । যেসব সাপ জড়িয়ে ধরে শিকারকে মেরে খায়, এই সাপও তেমনি । তবে এই সাপেরা ফিল্মে অভিনয় করেনি। ফিল্মে রবারের সাপ বানিয়ে দেখানো হয়েছে । আমাদের গ্রামে এসেই তো শুটিঙ হয়েছিল । জবাবে বিন্নি বলল, আমি ফিল্ম দেখিনি, অ্যানিমাল প্ল্যানেট আর ন্যাশানাল জিওগ্রাফিক চ্যানেলে টিভিতে দেখেছি । আমার মা বলেন ফিল্ম দেখে কোনো জ্ঞান হয় না, সব বানানো গল্প, তার চেয়ে যা সত্যি সেগুলোই দেখা আর পড়া ভালো । বিন্নি জিগ্যেস করল, মাঝির নাতনি, তুমি সারাদিন দাদুর সঙ্গে নৌকোয় ভেসে বেড়াও? বাড়িতে চিন্তা করেন না মা-বাবা ?
মাঝি অ্যালভারেজ দাঁড় বাইতে-বাইতে বলল, আমিই ওকে সঙ্গে নিয়ে আসি, আটজন নাতির পরে আমার এই এক নাতনি, আমার তিনটে ছেলের সকলেরই ছেলে । ছোটো ছেলেটার এই এক মেয়ে । ওকে বাড়িতে রেখে আসলে সবাই মিলে নানা কাজ করায়, তাই আমি সকালে বেরোবার সময়ে সঙ্গে আনি। আমার নিজের তো মেয়ে ছিল না । বংশে এই এক মেয়ে । সব সময় নজরে-নজরে রাখি । বিন্নি বলল, ওকে জামা পরিয়ে আনো না কেন ? আমাদের শহরে এই বয়সে মেয়েরা সবাই সব সময় জামা পরে থাকে । নাতনি বলল, আমার বড্ডো গরম লাগে, জামা পরে বেশিক্ষণ থাকতে পারি না । তাছাড়া জামা পরে না থাকলে কতো প্রজাপতি এসে বসে আমার গায়ে, আদর করে, ডানার বাতাস দেয় ।
বিন্নি বলল, ধ্যুৎ, ওটা কোনো যুক্তি হলো না । এখন মাঝনদীতে তো আর প্রজাপতিরা এসে বসছে না তোমার গায়ে নুন বা চিনি খাবার জন্য । নাতনি বলল, চিনি নয় মশায়, নুন, নুন, তুমি দেখো না জিভ দিয়ে নোনতা কিনা।
ইউনিয়ানের সচিব বলল, বিন্নি, হয়ে গেছে, এবার চোখ খোলো, তুমি ভর্তি হয়ে গেছ কলেজে, আর কোনো চিন্তা নেই, প্রতিদিন ক্লাস না করলেও চলবে, পারসেন্টেজের ভাবনা ভাবতে হবে না, সব ম্যানেজ হয়ে যাবে, তুমি আজ থেকে আমাদের ইউনিয়ানের মেম্বার, এই নাও আই-পিল, এটা খেলে গর্ভগোলমাল হবে না ।
ব্যাস, সব ম্যানেজ করতে শিখে গেছি তারপর থেকে, পিচ্চিকে বলল বিন্নি। আমার গল্প এইটুকুই ।
কোনো প্রতিরোধ আমাকে অনুৎসাহ করতে পারেনা, যে মেয়ে বেঁচে থাকার শিল্পকে করায়াত্ত করেছে, কোনো অসুবিধা তাকে হতাশ করতে পারে না, প্রতিবন্ধকতা হল দ্বন্দ্বের সন্মুখীন হওয়ার চাবিকাঠি, বাধাবিপত্তি, তোমার কাজ করার ক্ষমতাকে চ্যালেঞ্জ করার সুযোগ, তা তোমাকে সাহস আর তেজ দেবে, প্রতিটি প্রতিবন্ধকতার পরে তুমি নিজেকে আরও বেশি সফল প্রমাণ করতে পারবে ।
৮
প্রেস সেকশান প্রতিদিন তাঁর কাছে সেই দিনকার সংবাদপত্রের জরুরি কাটিংগুলো ফাইল করে, সঙ্গের কাগজে কোন থানার এলাকা আর সম্ভাব্য পন্হা সম্পর্কে নোট লিখে রিমা খানের কাছে পাঠায় ; রিমা খান নিজের মতামত দিয়ে ডিসিপিকে পাঠান । আজকে প্রথম কাটিং পড়েই রিমা খানের মেজাজ খারাপ হয়ে গেল ।যে পত্রিকায় সংবাদ বেরিয়েছে তার বাজার ভালো । রিমা খান প্রেস সেকশনের ইনচার্জকে ডেকে পাঠালেন । সে এলে, বললেন, এটা কী ? এই সংবাদপত্রে সাহিত্যিকদের জারজগুলো চাকরি করে জানি, কিন্তু এটা কেমন খবর, আর কোন থানার ওসি এই খবরটা চাউর হতে দিয়েছে ?
সংবাদের শিরোনাম, “ভিনসেন্ট ভ্যানগগের কান পাওয়া গেছে এই শহরের ম্যানহোলে” । সঙ্গে যে দুটো ফোটো তার একটা স্হানীয় একজন দলিত সাফাই কর্মচারীর হাতের তালুতে একটা কান, কানে হীরে বা নকল হীরের টপ, দ্বিতীয় ছবিটা কানে ব্যাণ্ডেজ বাঁধা ভ্যান গগের পেইনটিঙ । আসল সংবাদের আগে ভ্যানগগের কান কাটার কাহিনি । সাংবাদিকটা কখনও নেদারল্যাণ্ডস যায়নি নিশ্চয়ই, ভ্যান গগ মিউজিয়ামও দ্যাখেনি । খবরটা এইভাবে ফেনানো হয়েছে :
চিঠি হাতে পোস্টম্যান বা ডাকপিয়ন জোসেফ রঁলা। । তুলির সুচারু টানে আর জ্ঞানে ও এখন অমর। বেদনায় ফুটে ওঠে অন্য রূপ। বললেন ভিনসেন্ট- কী ব্যাপার? আমার চিঠি? হাসিমুখে চিঠি দেন জোসেফ রঁলা। । চিঠি খোলেন ভিনসেন্ট। পল গঁগা চিঠি লিখেছেন। বলেছেন- তোমার সঙ্গে আমি কিছু সময় কাটাতে চাই। খুব তাড়াতাড়ি আসছি। ভিনসেন্ট তখনই বসে যান পল গঁগাকে চিঠি লিখতে :
আর্লস ১৭ অক্টোবর ১৮৮৮
প্রিয় গঁগা,
তোমার চিঠির জন্য ধন্যবাদ। তুমি লিখেছো, 'শপথ করে বলছি আমি তোমার কাছে আসবই। এই মাসের কুড়ি তারিখের পরে যে কোনো একদিন।' মনে রেখো পল, ট্রেন জার্নিটা হয়তো একটু কষ্টদায়ক কিন্তু যখন আসতে আসতে পথের দু'পাশের দৃশ্য দেখবে, কষ্টের কথা তোমার মনে থাকবে না। অপূর্ব সব দৃশ্য। আমি যখন এসেছিলাম সেই সব দৃশ্য আমাকে পাগল করে তুলেছিল। একটু ঈর্ষা হচ্ছে তুমি সে দৃশ্য দেখবে। আমার মনে হয়েছিল জাপানের নিসর্গের কথা। শীত পড়বে কিছুদিন পরেই । যখন এখানে মিসত্রাল বয় তখন সময়টা কঠিন , এ ছাড়া অন্য সময় বেশ ভালো । তুমি আর আমি ছবি আঁকবো মিসত্রালের ফাঁকে ফাঁকে। আমার বাড়িটা তেমন সাজানো-গোছানো নয় বন্ধু। একজন গরিব শিল্পীর বাড়ি যেমন হয়। একটু একটু করে ভালো হবে, তা নিয়ে ভেবো না। দু'জনের সঙ্গে দু'জনের দেখা হবে, সেটাই হলো আসল খবর।
তোমার চিরকালের বন্ধু ভিনসেন্ট
অক্টোবরে এক ঝড়ের দুপুরে ঝড়ের কাকের মতো এসে উপস্থিত হলেন পল গঁগা। ফ্রান্সের এক নির্জন, নিঃসঙ্গ জায়গা । ছোটো জনবসতি । ভাবতেই পারিনি পল, তুমি আসবে। বা, বলেছিলাম না; আসব।পথে কোনো কষ্ট হয়নি তো তোমার? তোমার কথাই ঠিক। পথের কষ্ট কষ্টই নয়, যেসব ছবির মতো দৃশ্যের ভেতর দিয়ে ট্রেন এসেছে।চল, বাড়িটা দেখ। পাশের ঘরটা তোমার। নতুন বিছানা, নতুন সবকিছু। টাকা পেলে কোথায়?সে নিয়ে তোমাকে ভাবতে হবে না। থিও আছে না?
বোঝা গেল পল গঁগা এমন বাড়ি দেখে মোটামুটি খুশি। এক সময় বলে গঁগা বললে, তা বন্ধু, এখানে কোনো ল্যাটিন কোয়ার্টার নেই ? একেবারে নিরামিষ? ভিনসেন্ট বললেন, প্যারিসের পিগালে এখানে নেই, কিন্তু যা আছে সেটাও বা মন্দ কী? নানা বয়সে নারী। আজ তো টায়ার্ড। কালকে যাওয়া যাবে।পল গঁগা প্রশ্ন করেন, প্যারিসের পিগালেতে গ্যাবি নামে একটি মেয়ের সঙ্গে আলাপ হয়েছিল তোমার, তাই না? ওকে দেখতেই তো যেতে। তারপর কী হলো? সতেরো বছরের একটা মেয়ে নতুন নেমেছে বাজারে । ও এখন কোথায়? শুনেছি, ও নাকি আর্লস এসে ব্যবসা শুরু করেছে। তুমিও তো এখানে। দেখা হয় না? ভ্যান গগ বললেন, গাব্রিয়েলা এখানেই ।
মেয়েটাকে ভালোবেসে ফেলেছেন ভিনসেন্ট ! সারাজীবন কাউকে গভীর করে ভালোবাসার জন্য হৃদয় ছিল উন্মুখ। এক ধরনের বন্যতা ছিল মেয়েটার চরিত্রে। প্রথম যাকে ভ্যান গগ ভালোবেসেছিলেন সেই 'কে' নামের মেয়েটা প্রত্যাখ্যান করে চলে গেছে। এর পর চলে গিয়েছিল নেদারল্যান্ডসের নিউনুনে। ভিকার বা যাজক হয়ে। সেখানেই শুরু হয়েছিল তার 'পোটাটো ইটার' বা 'আলুখেকো গরিব' মানুষের ছবি আঁকার সিরিজ। শুরু হয়েছিল প্রতিভার বিস্ময়কর বিকাশ । গ্যাবির সঙ্গে দেখা পরে। গ্যাবি যখন আর্লসে চলে গেল, ভিসসেন্টও চলে এলেন আর্লস। প্রেম পড়ে গেলেন সূর্যমুখী ফুলের আর গ্যাব্রিয়েলার।
বিকেলের পরে আঁকতে বসেছেন। তার আগে ভিনসেন্টের ছবিগুলো দেখা আর ভালো-মন্দ বলা। বিশেষ করে বুলফাইট নিয়ে আঁকা ছবিটা নিয়ে অনেক কথা বলেছেন পল গঁগা। ষাঁড় যখন হেরে গিয়ে মাটিতে পড়ে যায়- ওর কানটা কেটে নিয়ে ম্যাটাডর সমবেত দর্শকদের দেখায়, ষাঁড়ের কান। রক্ত ঝরতে ঝরতে পরাজিত ষাঁড় যখন মরতে বসে, তখন তলোয়ারের এক কোপে ওর মাথাটা কেটে ফেলা হয়।
এত কিছু যদি জানো তাহলে বুলফাইটের ছবি আঁকা কেন? কেন নয়? তুমি বল ছবিটা কেমন হয়েছে?
ছবি ঠিক আছে। আমি কখনও এ বিষয়ে ছবি আঁকবো না। কী নিয়ে আঁকবে? কোনো এক দূর দ্বীপে চলে যাব আপন মনে ছবি আঁকতে। কী যে হবে তখন কে বলতে পারে!
ভিনসেন্ট বুঝতে পারেন, দু'জন শিল্পী হলেও দু'জনের দেখার চোখ এক নয়। তাই আলো চলে যাওয়া মুহূর্তে যখন ছবি আঁকতে বসেছেন পল গঁগা, ভিনসেন্ট বলেন, এই অল্প আলোতে এমন ম্যাটমেটে ছবি কেন আঁকছো? শুরু হলো তর্কবিতর্ক । পল অনেক দিন থাকতে এসেছিলেন। দ্বিতীয় দিনেই বুঝতে পারেন- বেশি দিন থাকা যাবে না। ভিনসেন্ট ঝগড়া করতে করতে বলেন, তুমি আবার ফট করে চলে যাবে না তো ?
একা থাকার দুঃসহ ভার থেকে মুক্তি চান তিনি। গগাঁ কোনো উত্তর দেন না। ভিনসেন্ট বলেন, এই তো আবার থিওর টাকা এলো বলে। তখন প্রাণভরে যত ইচ্ছা আবসাঁথ টানা যাবে।
সন্ধ্যার পর দুই বন্ধু চলে গেলেন রেডলাইট এরিয়ায় । ভিনসেন্ট সোজা গ্যাবির ঘরে। বলেন, দেখ এদের মধ্যে কোন মেয়ে তোমার পছন্দ। পল বলেন, তোমার গ্যাবির সঙ্গে অন্তত একবার শুতে পারবো না? অমন চিন্তা কখনও করবে না। ও কি ভার্জিন ? ফালতু বোকো না । হাতাহাতি আরম্ভ হবার যোগাড়। কোনোমতে ওদের সামলায় অন্য মেয়েরা। পল গঁগা ওদের একজনকে পছন্দ করেন। কিংবা বলা যায় ওদের একজন এই ভবঘুরে আঁকিয়েকে পছন্দ করে। নারীসঙ্গম ছাড়া শিল্পীরা মনের মতন কাজ করতে পারেন না। দু'জন শিল্পী নেশায় চুর হয়ে বাড়ি ফেরেন। পরের দিন সকালে আবার হাতাহাতি হবার যোগাড় ।
একদিন ভিনসেন্টের তেড়ে জ্বর এলো । পল ভাবলেন এবার কেটে পড়া ভালো, কেননা আবহ আর ছবি আঁকার মতন নেই। ভিনসেন্টকে বললেন, তুমি শুয়ে বিশ্রাম কর; আমি একটু বেড়িয়ে আসি।ভিনসেন্ট বললেন, আচ্ছা। কিন্তু এক সময় তাঁর আশঙ্কা হলো, গগাঁ এখনও আসছে না কেন? ও নির্ঘাত সুযোগ পেয়ে গ্যাবির কাছে গেছে। ভাবতে ভাবতে মেজাজ খারাপ হয়ে যায়। অনুপস্হিত গগাঁর উদ্দেশে বললেন, দাঁড়াও দেখাচ্ছি মজা।
রেড লাইট এরিয়ায় গিয়ে দ্যাখেন, গ্যাবির ঘর থেকে বের হচ্ছেন পল গঁগা। তরোয়াল বের করে পলের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ার চেষ্টা করেন ভিনসেন্ট। পল গঁগাও তলোয়ার হাতে তার নিজের জিনিসপত্রের জন্য কোনো মায়া না করে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যান । সোজা তাহিতি দ্বীপে ।
একাকিত্ব, বিষাদ, অসহায়তা ভ্যান গগকে পাগল করে দেয়। ভিনসেন্টে নিজের কানের পেছন ক্ষুরের টানে কানকে মাথা থেকে কেটে আলাদা করেন। কাগজে মুড়ে কানটা গ্যাব্রিয়েলার হাতে দিয়ে বলেন একটা মূল্যবান জিনিস, তুমি বলেছিলে তোমার খুব পছন্দ এটা। ভালো করে রেখে দিও।
গ্যাব্রিয়েলা ভ্যান গগের কান নিয়ে কী করেছিল কে জানে! ডাক্তারের কথামতো প্রথমে ভ্যান গগ যান সাধারণ হাসপাতালে। কানে বড় ব্যান্ডেজ বাঁধা ভিনসেন্ট সেখানে আট দিন ছিলেন। সাধারণ হাসপাতাল থেকে বের হয়ে কিছুদিন একা ছিলেন। পরে গ্রামবাসীরা পিটিশন করে জানায়, এই পাগলটাকে আমাদের এলাকা থেকে তাড়াও। ও একজন বেশ বিপজ্জনক লোক । এর পর ভ্যান গগের ভাই তাঁকে ভর্তি করে দেন সেইন্ট পল ডি মুসো নামের অ্যাসাইলামে। কান কাটার ঘটনা ঘটেছিল ২৩ ডিসেম্বর ১৯৮৮ সালে। নতুন বছরের কোনো একদিনে চুপ করে গ্যাব্রিয়েলা দেখা করতে এসেছিল তার সঙ্গে। গ্যাব্রিয়েলা জিগ্যেস করেছিল কেন এমন করলে? উত্তর দেননি ভ্যান গগ। কেবল গ্যাবিকে প্রশ্ন করেছিলেন, এটা আমার বিজয়, না পরাজয়ের ট্রফি? তুমি বল, আমি জিতে গেছি, না হেরে গেছি? গ্যাব্রিয়েলা বলেছিল, তুমি একজন মহান শিল্পী, কেউ তোমাকে হারাতে পারবে না। কখনও ছবি আঁকা ছাড়বে না । তোমার গ্যাবি তোমাকে চিরকাল ভালোবাসবে।
এই শহরের ম্যানহোলে যে কান পাওয়া গেছে তা নিশ্চয়ই কোনো স্হানীয় শিল্পীর, নিজের গ্যাব্রিবেলাকে উপহার দিয়েছিলেন, সেই তরুণী প্রেমিকা তা বাড়ির নর্দমায় বা টয়লেটে ফেলে দিয়ে থাকবেন, বাড়ির অভিভাবকদের ভয়ে । থানার ওসি জানিয়েছেন তাঁরা এই শহরের ভ্যান গগ ও তাঁর গ্যাব্রিয়েলা দুজনকেই খুঁজছেন । হাসপাতালগুলো থেকে তাঁরা কানহীন কোনো রোগীর সংবাদ পাননি, কিন্তু আশা করছেন শীগ্রই শিল্পী ও তাঁর গ্যাব্রিয়েলার খোঁজ পাবেন এবং জেরা করে প্রকৃত তথ্য জানতে পারবেন ।
৯
প্রেস সেকশনের ইনচার্জকে সামনের চেয়ারে বসতে বলে রিমা খান জানতে চাইলেন, এটা কোন থানার আনডারের ঘটনা, আর থানার ওসি কে ? ওসিকে বলো আমার সঙ্গে এক্ষুনি দেখা করতে আর কানটা যদি বরফে না রেখে থাকে তাহলে বরফে রেখে নিয়ে আসতে ।
প্রেস সেকশনের ইনচার্জ বলল, সেই ওসি তো আপনার সঙ্গে কাজ করেছে, যখন আপনি কঙ্কাল প্রেমিক মার্ডার কেস ইনভেসিগেট করছিলেন ।
কে ? সুমন মিশ্র ? নাকি রমেন বসু ? ওরা তো রিটায়ার করে গেছে । তাহলে কে ? ওহ ওই ইডিয়টটা, রজত মণ্ডল, আসছে বছর রিটায়ার করবে, এখন টাকা কামাবার ধান্দায় সব খবর চাউর করে মালদার আসামী পাকড়াও করার সুযোগ খোঁজে । ডেকে পাঠাও, ডেকে পাঠাও, রাইট নাও, লাঞ্চ করে আসছি টাইপের কথাবার্তা বললে বোলো যে এক্ষুনি না এলে আজকেই সাসপেণ্ড হয়ে যেতে পারে । নেতাদের বিচি ধরে ঝুলছে বলে মনে করে কেউ ওর পোঁদে বাঁশ করতে পারবে না । বলো যে ওর প্রিয় নেতার বিচি কেটে ওর মুখে পুরে দেবার ঘাঁতঘোঁত জানা আছে আমার, সেই সঙ্গে ওর বিচি কেটেও মালখানায় রাখার ব্যবস্হা করে দিয়ে যাবো । এতো করে গড়েপিটে তৈরি করার চেষ্টা করলুম রজতটাকে, তবু ওর টাকা কামাবার ছোঁকছোঁক গেল না, মিডিয়ার কাছ থেকেও টাকা খায় । ডেকে পাঠাও, ডেকে পাঠাও ।
রিমা খানের চেঁচামেচি শুনে মণ্ডলের শুভানুধ্যায়ী কোনো কন্সটেবল ফোন করে দিয়ে থাকবে রজতকে, মিনিট পনেরোয় মুখের ভয় আর ঘাম রুমালে পুঁছতে পুঁছতে ঢুকল এসিপির চেম্বারে । রিমা খান বললেন, বোসো, এই যে কানটা তুমি বাজেয়াপ্ত করেছ, এতে যে টপ দেখা যাচ্ছে, তা সেই গয়নাটা কোথায় হাপিশ করলে, স্যাকরার কাছে বেচতে গিয়ে জানতে পেরেছো ওটা কোনো মণিরত্ন নয়, নেহাতই ঝুটো, তা কানটা এনেছো ? ব্যাপারটা ইনভেসটিগেট করার আগেই সংবাদপত্রে নিজের নাম দেখার লোভ তোমার গেল না, কতো টাকা দিয়েছে ওই মিডিয়া এমপায়ার ? কান টানলে মাথা আসে কথাটা জানো তো ? এই মাথাটাই ভোমসো খুঁজে বেড়াচ্ছে বেশ কিছু দিন ধরে, এখনও কোনো হদিশ পায়নি । অমন তানজানিয়ার শিমপাঞ্জিদের মতন দাঁত বের করে হেসো না । ম্যানহোলটা কারা পরিষ্কার করাচ্ছিল, করপোরেশান না কোনো প্রা্য়ভেট পার্টি ?
রজত মন্ডলের দেঁতো হাসি বন্ধ হল, বলল, স্যার, তা তো জানি না, কানটা পাবার পর দুজন সাফাইকর্মী পাড়ার ক্লাবের সচিবের কাছে কানটা দিয়ে সেখান থেকে কেটে পড়েছে, কেউ বলতে পারছে না, কারা পরিষ্কার করাচ্ছিল, করপোরেশনের স্হানীয় কর্মীরা জানিয়েছে, ওরা কোনো আদেশ-নির্দেশ দেয়নি, ওদের কাছে কোনো কমপ্লেন আসেনি ।
----কানটা বরফে কখন রাখলে ? দেখে মনে হচ্ছে, আজকে রেখেছো, কালকে সারা রাত তোমার থানায় পচেছে, তার আগে নর্দমার পাঁকে পচেছে । ফ্লাস্কে করে এনেছো, ভালোই করেছ, যাও এটা ফরেনসিক ল্যাবরেটরিতে জমা দেবার ব্যবস্হা করো, আমি ওদের বলে দিচ্ছি কি করতে হবে । কানে যে টপটা পরানো সেটাও ওদের কাছে জমা দিয়ে নথি করিও ।
---হ্যাঁ, স্যার, তাই করছি, বলে, দ্রুত কেটে পড়তে যাচ্ছিল রজত মণ্ডল ।
---আমাকে বিকেলের মধ্যে রিপোর্ট দাও, কারা নর্দমা পরিষ্কার করানোর জন্যে সাফাইকর্মী দুটোকে কাজে লাগিয়েছিল, আর সাফাইকর্মী দুটোকে খুঁজে বের করে ওদের আশ্বস্ত করো যে ওদের কিছু করা হবে না।
---ওদের কাস্টডিতে নেবো না ?
---না । ওরা আমাদের সাহায্য করবে, এই গিঁট খোলবার । আর কোনো মিডিয়াকে ইনটারভিউ দিও না । রিটায়ার করার পর যা করার কোরো, তখন নাচের দল তৈরি করে নন্দনে গিয়ে পোঁদ তুলে নেচো ।
রজত মণ্ডল চলে গেলে ভোমসোকে ডেকে পাঠালেন রিমা খান ।
ভোমসো ঘরে ঢুকে বলল, আপনি খবরের কাগজের ওই ভ্যান গগের কান নিয়ে ভাবছেন তো? যদিও থানাটা আমার আণ্ডারে নয়, আমি বেশ কিছু তথ্য যোগাড় করে ফেলেছি । কানের ছবিটা কাগজে পড়ে ওলেঙ্কা নামের মেয়েটা আমার কাছে এসেছিল, ভয়ে মুখ চুপসে গেছে, কাঁদছিল, ও জানালো যে কানের টপদুটো ও পিচ্চিকে পরিয়ে দিয়েছিল, নিজের কান থেকে খুলে ।অন্য মেয়েটা, বিন্নি, সেও কাঁদছিল, বলল যে পিচ্চি ওদের দুজনকে ওর ওপর এতো নির্ভরশীল করে তুলেছিল যে ওরা জীবনের সব সমস্যা ভুলে গিয়ে বেপরোয়া হয়ে গিয়েছিল । বিন্নিও মনে করে, কানটা পিচ্চির । আমি আমার এক শ্যাডোকে বলেছি ম্যানহোলটার দিকে নজর রাখতে । পরিষ্কার করাচ্ছিল কে জানেন ? শুনলে অবাক হবেন । আমি সাফাইকর্মী দুজনকে লোকেট করেছি, ওদের সঙ্গে এনেছি, বাইরে বসে আছে, বলেছি ওদের সাক্ষ্য দিতে হবে, তার জন্যে সরকারের কাছ থেকে টাকা বরাদ্দ আছে ।
রিমা খান, সিগারেটের ধোঁয়া উড়িয়ে বললেন, জানি । তুমি এখনই ওয়ারেন্ট ইশ্যু করিয়ে বাপ আর বড়োছেলেকে গ্রেপ্তার করার ব্যবস্হা করো । আর সার্চ ওয়ারেন্ট নিয়ে লোকটার বাড়ি সিল করে দাও । আমি নিশ্চিত, লোকটার সেপটিক ট্যাঙ্কে তুমি তিনটে পুরোনো কঙ্কাল বা হয়তো লাশ আর একটা টাটকা কঙ্কাল পাবে । টাটকা কঙ্কাল এই জন্যে অনুমান করছি যে দেহকে টুকরো-টুকরো করা হয়েছে, পায়খানার পথে মাংসখণ্ডগুলো ঢুকিয়ে দেয়া হয়েছিল, যার ফলে জ্যাম হয়ে গেছে নর্দমা, সম্ভবত পুরো পাড়ার নর্দমা । আর পিচ্চির ঘর থেকে কয়েকটা নিজস্ব জিনিশ যোগাড় কোরো, ওর ট্রুথব্রাশ, চিরুনিতে যদি চুল লেগে থাকে বা অন্য কোনো বস্তু যা থেকে ডিএনএ নিয়ে কানটার সঙ্গে আর লাশ বা কঙ্কাল পেলে তার সঙ্গে ম্যাচ করা যায় । হয়তো ওর বিছানার চাদরে আর তোয়ালেতে তুমি নাইটফলের বা মেয়ে দুজনের সঙ্গে সেক্স করার সিমেনের ট্রেসও পেতে পারো ।
ভোম্বোল সোম অ্যাডভোকেট আর তার বড়ো ছেলের নামে ম্যাজিস্ট্রেটের গ্রেপ্তারি পরোয়ানা লিখিয়ে লোকটার বাড়ি-কাম-দপতরে গিয়ে সার্চ করা আরম্ভ করল । রিমা খান যেমন বলেছিলেন, ফ্লাশ পায়খানার সেপটিক ট্যাঙ্কের ওপর থেকে সিমেন্টের স্ল্যাব সরিয়ে তার মধ্যে পাওয়া গেল তিনটে কঙ্কাল, দুটো ক্ষয়ে এসেছে আর একটা টাটকা । টাটকার গায়ে তখনও মাংস লেগে । বাড়ির ভেতরে একতলার টয়লেটে ভোম্বোল সোম পেলেন মার্বল স্ল্যাব কাটার দশটা ডিস্কব্লেড, একশো সাতাশ এমএমের বশ কোম্পানির ইলেকট্রিক হ্যাণ্ডসেট, তার ওয়ারেন্টি অ্যাডভোকেটের নামে ।
অ্যাডভোকেট আর তার বড়ো ছেলেকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ কাস্টডিতে রাখার আদেশ যোগাড় করে ফেলেছে ভোম্বল সোম। রিমা খানের ঘরে মুখ নিচু করে বসেছিলেন অ্যাডভোকেট আর তাঁর বড়োছেলে । রিমা খান জিগ্যেস করলেন আপনি এটা করলেন কেন ? আপনি করেননি, অন্যেরা করেছে, তাও বলতে পারবেন না, যাবতীয় এভিডেন্স আপনার বাড়ি থেকে পাওয়া গেছে । আপনি এতোই নিষ্ঠুর আর নির্দয় যে মার্বল কাটারের ডিস্কব্লেড দিয়ে শরীর থেকে মাংস কুরে কুরে ফ্লাশ করে দিতেন । যে পরিবার আপনাকে এতো বিশ্বাস করতো তাদের সদস্যদের আপনি কেবল খুন করেননি, তাদের মাংসও গুয়ের সঙ্গে মিশিয়ে দিয়েছেন । তার কারণ আমি জানি । আপনার সব কয়টা ছেলে অশিক্ষিত অপগণ্ড, তাদের জন্যে আপনি অন্যের সম্পত্তি দখল করে ভোগ করতে চাইছিলেন । ভেবেছিলেন গান্ধিমার্কা অ্যালুমিনিয়ামের চশমা নাকের ডগায় ঝুলিয়ে, মহাত্মার চেহারা আয়ত্ব করে ফেলবেন। আপনার বড়ো ছেলেকে থার্ড ডিগ্রির সামান্য ডোজ দিতেই কাঁদতে-কাঁদতে সবকিছু ফাঁস করে দিয়েছে ।
পিচ্চিকে ভালোবাসার ফাঁদে ফেলার দরকার ছিল না তো ? আপনি ভেবেছিলেন যে মেয়ে দুটোকে হত্যার দায়ে ফাঁসিয়ে নিজে ক্লিন বেরিয়ে যাবেন । কিন্তু দেখুন, ওলেঙ্কা, এখনও জানি না ওর নাম ওলেঙ্কা কিনা, পিচ্চিকে ভালোবেসে নিজের কান থেকে খুলে টপ দুটো পরিয়ে দিয়েছিল, সেই টপের কারণেই আপনাকে সন্দেহ করা আরম্ভ করলেন ইনভেস্টিগেটিঙ অফিসার । পুলিশে আমার একটা বদনাম আছে । কোনো আসামীকে ফাঁসির মাচানে পৌঁছে দিয়ে আমি শারিরীক আর মানসিক আনন্দ পাই । তিনটে হত্যাই যে রেয়ারেস্ট অব রেয়ার, তা আপনার ব্যবহার করা মার্বল কাটিং মেশিন আর ডিস্ক-ব্লেডের সেট প্রমাণ করবে। আপনি এতোই নিশ্চিন্ত ছিলেন যে কাটার ডিস্কগুলো থেকে রক্ত ধোবারও প্রয়োজন মনে করেননি, মেশিন থেকে আপনার আর আপনার বড়ো ছেলের আঙুলের ছাপ মোছার চেষ্টা করেননি । ওগুলো দিব্বি আপনার টয়লেটে রেখে আয়েস করছিলেন । আপনি জানতেন ওই তিনজনকে কিডন্যাপ করার অভিযোগ আপনার বিরুদ্ধে কেউ করবে না, ওনারা নিজেরাই আপনার বাড়ি-কাম-অফিসে যাতায়াত করতেন, আপনি আর আপনার বড়ো ছেলে তাঁদের বাড়ির ভেতরে নিয়ে গিয়ে ভালো খাবার-দাবার খাইয়ে ঠাণ্ডা মাথায় খুন করলেন । আপনি বোধহয় জানেন না যে পিচ্চি এক ধরণের রোজনামচা লিখতো, তা থেকে আভাসে-ইঙ্গিতে যথেষ্ট পথনির্দেশ পাওয়া গিয়েছে । ব্যাঙ্কের লকারে পিচ্চির বাবা-মায়ের চিঠি রাখা আছে, এটা কেন পিচ্চিকে বলেছিলেন বলুন তো ? তার বদলে দুটো অন্য চিঠি রেখে পিচ্চিকে বিপথে চালাবার চেষ্টা করেছিলেন। আর চিঠিগুলো আপনার মানসিক ভারসাম্যহীন ছেলেটাকে দিয়ে লিখিয়েছিলেন, তার ঘরে চিঠিগুলোর খসড়া পাওয়া গেছে, উপন্যাস কবিতা নাটকের বই পড়িয়ে তাকে বাগে আনতে পারেননি, সে নিজেই জানিয়েছে যে চিঠিগুলো তার লেখা ।
রুল দিয়ে অ্যাডভোকেটের থুতনি ওপরে তুলে রিমা খান বললেন, আরেকটা কথা, শুনে আপনার ক্রিমিনাল মাথা আরও খারাপ হয়ে যাবে, কানটা যে পিচ্চির তা প্রমাণ হয়ে গেলে, বিন্নি আর ওলেঙ্কার পেটে যে বাচ্চাগুলো এখন কয়েক মাসের ভ্রুণ, তারা যে পিচ্চির সন্তান, তা প্রমাণ হয়ে যাবে । যে দুটো মেয়েকে ফাঁসাবার চেষ্টা করেছিলেন, তাদের কোলে ওই বিরাট সম্পত্তির উত্তরাধিকারী দিয়ে যাবার ব্যবস্হা করে গেছে পিচ্চি । মেয়ে দুজনও নিশ্চয়ই চেয়েছে যে তারা পিচ্চির বাচ্চার মা হতে পারলে জীবনে আর কিছু করার দরকার নেই, সম্পত্তির অর্ধেক তো পাবে, তাইই যথেষ্ট ।
কিছুক্ষণ থেমে রিমা খান বললেন, পিচ্চির জার্মান দাদু আর দিদিমাকে খবর পাঠানো হয়েছে, ভারতীয় দূতাবাসের মাধ্যমে ; তাঁরা এই দুই তরুণীর আর পিচ্চির বাচ্চাদের দায়িত্ব নিতে রাজি হয়েছেন । ওনাদের দেশে এইভাবে অবিবাহিত তরুণীদের বাচ্চা হওয়াটাকে সমাজ আর খারাপ মনে করে না ।
রিমা খানের কথাগুলো শুনতে-শুনতে অ্যাডভোকেট বোধহয় ফাঁসির মঞ্চটা প্রত্যক্ষ করছিলেন । সেই মুখের দিকে সরাসরি তাকিয়ে রিমা খান বললেন, আপনার এখন কী হচ্ছে বলুন তো ? আপশোষ বলব না। আপনার হচ্ছে ক্রোধ । বোঝা যাচ্ছে আপনার হৃৎস্পন্দন বেড়ে গেছে, ব্লাড প্রেশার শুট আপ করেছে, অ্যাড্রেনালিন অ্যাবনর্মাল হয়ে যাচ্ছে, মাথা কাজ করছে না, শরীরের কোথাও কোথাও ব্যথা অনুভব করছেন, ভ্রু নেমে এসেছে, ঠোঁট চেপে আছেন, চোখ কিছুটা ঠেলে বেরোচ্ছে । তার সঙ্গে আপনার ভয়ও করছে, ভয় করলে মানুষ সেখান থেকে পালাতে চায়, এড়াতে চায়, আপনি চেয়ারের হাতল দুহাতে আঁকড়ে আছেন, সেটা আপনার ভয়ের লক্ষণ । ধরা পড়ে গেছেন বলে অবাক হচ্ছেন, কেননা আপনি নিশ্চিত ছিলেন যে ফাঁসলে মেয়ে দুটো ফাঁসবে, আপনার অন্য অপগণ্ড সন্তানরাও জানে না তাদের বাবা তাদের জন্য কেমন ঝুঁকি নিয়েছিল, তাদের চোখে আপনি খুনি প্রমাণিত হলেন, সেই ভাবনা আপনাকে কুরে খাচ্ছে । চোয়াল ঝুলে এসেছে তাই । ধরা পড়ে গিয়ে বিষণ্ণ হয়ে পড়েছেন, হেরে যাবার বোধ কাজ করছে আপনার মধ্যে, অসহায়তা, প্রতিবাদ করতে পারছেন না আমার কোনো কথার, চুপ মেরে গেছেন, মিজারেবল অবস্হা, জীবনে আনন্দের মুড আর ফিরবে না আপনার, দেখুন না ঠোঁটের দুই কোন ঝুলে পড়েছে । যান, আপনি তো এতোকাল উকিলগিরি করলেন, এবার হাজতে বসে নিজের আর বড়োছেলের বাঁচার উপায় বের করতে পারেন কিনা দেখুন । আমরা কিন্তু আপনাকে ফাঁসির মঞ্চ পর্যন্ত নিয়ে যাবোই ।
মিলটনের প্যারাডাইস লস্ট-এর একটা লাইন আপনাকে দেখে মনে পড়ছে, “অ্যাওয়েক, অ্যারাইজ অর বি ফর এভার ফলন ।”
Comments
Post a Comment