উইঘুর কবি এখমেতজান ওসমান-এর কবিতা -- অনুবাদ : মলয় রায়চৌধুরী
উইঘুর কবি এখমেতজান ওসমান-এর কবিতা
অনুবাদ : মলয় রায়চৌধুরী
পাঁচ অনাথ সন্তানের খোঁজে সাদির
১
সবাই জানে আমার নাম সাদির
কিন্তু সরকারি দপতরে আমার নথি আছে ।
আমার নথিপত্র পড়ো তাহলে জানতে পারবে,
আমার পাঁচ সন্তান এখন অনাথ ।
ঈশ্বরের তালুর ওপরে
আমাদের দেশ ভেঙে চুরমার ।
সেই পবিত্র ধুলো থেকে জেগে উঠেছে
সাদির ।
২
--ঝুঁকে পড়ো…!
সাদির হাঁটু গেড়ে বসল,
কপাল ছোঁয়ালো ধুলোতে ।
মাথা ওপরে তুলতেই
ঈশ্বর গায়েব,
বিদ্যুৎ চমকালো
স্বর্গের সিংহাসন কেঁপে উঠলো ।
দেবদূতরা
উড়তে লাগলো ওর চারিপাশে ।
ওর পায়ে এসে পড়লো রশ্মিরেখা,
এক মুহূর্তের জন্য ও চোখ বুজলো ।
৩
ওহে চোখ খোলো…
জিবরিল অভিনন্দন জানালো ওকে
সাদির ঝুঁকলো খানিক,
নিজের হৃদয়ে হাত রাখলো ।
জিবরিল একটা রামধনু খুলে উড়িয়ে দিলো
আর সাদির তার ওপরে উঠে দাঁড়ালো
জিবরিলকে
ধন্যবাদ দিলো ।
৪
রামধনু থেকে ও পড়ে গেল
হাজার বুদ্ধের গুহায়
বহুকাল আগেই
লোপাট হয়ে গেছে কাফেলাগুলো ।
বুদ্ধ গুহাগুলো…
পড়ে যাওয়া হাজার ঘণ্টা
এখনও বেজে চলেছে ।
৫
ঝিমন্ত ঘাড় নেড়ে
ও গোধূলির ওপরে মাথা রাখলো ।
পাশ দিয়ে উড়ে যাচ্ছিল প্রজাপতি,
মুহূর্তের জন্য ওর চোখের পাতায় বসলো ।
তার রঙ চুয়ে পড়তে লাগলো
সাদিরের চোখের মণিতে ।
রঙগুলো :
বসন্তকাল
গ্রীষ্মকাল
হেমন্তকাল
শীতকাল
পঞ্চম--
হারিয়ে-যাওয়া ঋতু
বছরের একাকীত্বের মাঝে ।
৬
---আমার সন্তানেরা !
লাফিয়ে উঠে দাঁড়ালো সাদির ।
রাতের শাখা-প্রশাখা থেকে
ওর হাতের তালুতে ঝরে পড়লো
পাঁচটা নক্ষত্র ।
৭
মলিতোজিতিউতিতে
যে গাঁয়ে সাদির পালোয়ান জন্মেছিল
কবরের মতন দেখতে
এক বুড়োর সঙ্গে দেখা হলো ।
--তুমিই সাদির ?
আমার সন্তান, এসো,
আমি তোমাকে তোমার সন্তানদের দেখাবো ।
বুড়ো লোকটা
ওর বাড়ি থেকে বের করে আনলো
প্রতি দিনের পাঁচটি নামাজ ।
৮
সাদিরের মুখের ওপরে
উইঘুরের পাহাড়
টুকরো-টুকরো হয়ে গেলো ।
ও চেঁচিয়ে উঠলো :
--এই তো আমার সন্তানেরা…!!!
৯
---আব্বাহুজুর…!
ওর দিকে ছুটে এলো
কাবাব পোড়াবার জালি ।
জালির ওপরে পুড়ছিল
সাদিরের হৃৎপিণ্ড ।
লোকগান এরকম :
এক কাহিনি ছিল যার নাম সাদির
আমার এক ছেলে এক শিশু রেখে গিয়েছিল।
তুমি যদি আমার ছেলেকে জিগ্যেস করো সে বলবে
হৃৎপিণ্ড পোড়াবার একটাই জালি রয়ে গেছে ।
১০
---আব্বাহুজুর…!
ওর দিকে উড়ে এলো
একটা বাদুড় ।
সাদিরের চোখ থেকে
আলো ফুরিয়ে যেতে লাগলো ।
লোকগান এরকম :
এক কুপি আছে যাকে লোকে বলে সাদির,
আমার একটা সদ্যোজাত ছেলেকে ছেড়ে আসতে হয়েছে।
ওর চোখের দিকে তাকাও আর দ্যাখো,
কেবল একজোড়া গর্ত ।
১১
--আব্বাহুজুর…!
ওর দিকে ছুটে এলো
এক শীতার্ত শিহরণ ।
জমে গেল ফোঁটায় ফোঁটায়
সাদিরের রক্ত ।
লোকগান এরকম :
বসন্তঋতুকে লোকে বলে সাদির।
আমার এক ছেলের কাছে রেখেছিলুম প্রার্থনার তাবিজ।
আমার ছেলের দিকে তাকাও আর তুমি দেখবে
রয়ে গেছে শুধু শুকিয়ে-যাওয়া চিনার গাছ ।
১২
---আব্বাহুজুর…!
ওর দিকে ছুটে এলো
একটা কবর ।
পাথরের ওপরে লেখা :
“উত্তরাধিকার...উত্তরাধিকার...উত্তরাধিকার”।
লোকগান এরকম :
এক যে ছিল শহর যার নাম ছিল সাদির,
আমার এক ছেলেকে একা ছেড়ে এসেছিলুম।
তুমি যদি আমার ছেলেকে জিগ্যেস করো তাহলে জানবে,
টিকে আছে কেবলমাত্র একটি প্রতিধ্বনি ।
১৩
---আব্বাহুজুর…!
ওনার দিকে এগোবার সময়ে কাঁপতে লাগলুম,
ফিকে আলোয়
খসে পড়ে গেল কবরের পাথর
আমার ভেতরে ।
লোকগান এরকম :
আমার নাম যে সাদির তা সবাই জানে
আমার এক ছেলেকে অনাথ ছেড়ে এসেছিলুম।
তুমি যদি আমার ছেলেকে জিগ্যেস করো
ওর শরীরে আমার দেহ ছেড়ে এসেছিলুম
ওর আত্মায় আমার আত্মা রেখে এসেছিলুম ।
১৪
কবরের পাথর ফেটে চৌচির হয়ে গেল
আমার নৈঃশব্দের ভেতরে।
ধোঁয়া থেকে
জেগে উঠলো সাদির।
১৫
---ঝুঁকে থাকো
Comments
Post a Comment