Skip to main content

মলয় রায়চৌধুরীর সাহিত্যপ্রতিভা

  

অনির্বাণ মুখোপাধ্যায় : মলয় রায়চৌধুরীর ডিটেকটিভ উপন্যাস

46ff3ed74814c9bb2411cdaf7938bd96

স্মৃতিকাতরতা পাঠকের একচেটিয়া অধিকার নয় । লেখকও স্মৃতিকাতর হতে পারেন । কারণ লেখকও বস্তুত পাঠক । এই সহজ সত্যটিকে অনুধাবন করতে পারলে যা ঘটে তাকে বাংলা সাহিত্য খুব বেশি প্রত্যক্ষ করেছে বলে মনে হয় না । বিশেষ করে লেখক যখন তাঁর সামগ্রিক পাঠকৃতি এবং পাঠের বাইরের স্মৃতিকে ব্যবহার করছেন লিখনে, অথচ সে লিখন আত্মজৈবনিক নয়, বিশুদ্ধ রহস্যোপন্যাস, তার পাঠ অভিজ্ঞতা যে অভিনব হবেই, বলার অপেক্ষা রাখে না । মলয় রায়চৌধুরীর সাম্প্রতিকতম গ্রন্হ “অলৌকিক প্রেম ও নৃশংস হত্যার রহস্যোপন্যাস” পড়তে বসে এইসব আনকথা মনে এলোই । মলয়, যাঁর প্রাথমিক পরিচিতি হাংরি আন্দোলনের কবি হিসেবে, সে আন্দোলনের উদ্গাতা হিসেবে, যখনই গদ্যে নিজেকে এনে ফেলেছেন, পাঠকের অভিজ্ঞতা সম্পূর্ণ ভিন্ন প্রকৃতির দিকে ধেয়ে গিয়েছে, সে কথাও নতুন করে বলার নয় । ‘নখদন্ত’, ‘জলাঞ্জলি’ অথবা সাম্প্রতিক সময়ের ‘অরূপ তোমার এঁটোকাঁটা’-জাতীয় উপন্যাসগুলিতে মলয় উপন্যাসের প্রথাগত আখ্যান কাঠামোকে ভেঙেছেন, কখনও একেবারে প্রতিস্পর্ধী কিছু খাড়া করেছেন । কিন্তু তাই বলে তিনি যে নিজেকে সোজাসুজি রহস্যোপন্যাসে এনে ফেলবেন, সে কথা অনুমান করতে পারেননি তাঁর অনুগত পাঠককুল ।

রহস্যপন্যাস মানে সত্যি-সত্যই ডিটেকটিভ নভেল । যাতে পষ্টাপষ্টি খুন আছে, রগরগে না হলেও, যৌনতা আছে, চক্রান্ত আছে, অতীতের সঙ্গে বর্তমানের আড়াআড়ি আছে । এ সবই এক বিশেষ সময়ের বিশেষ সাহিত্যের কথা বলে । বাংলায় পাল্প ডিটেকটিভ ফিকশনের ঐতিহ্যটি তেমন অভিজাত নয় । খুব একটা পুষ্টও নয় । তবু এ কথা অস্বীকার করা যাবে না যে, বাংলা ভাষায় এ ধরণের গোয়েন্দা কাহিনির অস্তিত্ব একটা সময়ে ছিল । স্বপনকুমার সাহিত্য তার একটা বিশিষ্ট উদাহরণ ( এ প্রসঙ্গে ফাল্গুনী মুখোপাধ্যায় নামক আরেকজন লেখকের কথাও বলা যায়, যাঁর গোয়েন্দার পদবি ছিল বাজপেয়ী ) । সেসব সাহিত্যিককে মনে রেখেই কি মলয় তাঁর এই উপন্যাসের অবতারণা করেছেন ? স্মৃতিকাতরতাই কি এই রচনার মুখ্য প্রণোদন ? উত্তর খুঁজতে গেলে পাঠ করতে হয় বাংলা চটি সিরিজের ব্যানারে প্রকাশিত এই বই । যেখানে ধরতাই এক অতিবাস্তব পরিস্হিতির মধ্যে, আর ক্রমে নিয়ে যায় বাস্তবতা নামক শর্তটির কিনার বরাবর । উপন্যাসের গোড়াতেই জনৈকা মায়া পাল জনৈক নিরঞ্জনের কব্জি পাকড়ে বলছে— ‘চলুন পালাই’ । এবং সত্যি-সত্যই ঘটছে সেই পলায়ন । কলকাতা ছেড়ে, পশ্চিমবাংলা ছেড়ে, এমনকী নিজেদের আত্মপরিচয়কে ছেড়েও পলায়ন । অন্ধ্রের এক প্রত্যন্ত অঞ্চলে আক্ষরিক অর্থেই প্রান্তবাসী মানুষের মধ্যে গিয়ে পড়ছে দুই নাগরিক মানুষ-মানুষী। শুরু হচ্ছে নাগরিক নির্মোক ত্যাগের ব্যায়াম । মায়া ও নিরঞ্জন এক বিকল্প জীবনের মধ্যে প্রবেশ করে, যাকে আধুনিকতার প্রতিস্পর্ধা বলা যায় । কিন্তু এই বিকল্প দীর্ঘস্হায়ী নয় । মায়ার রহস্যময় মৃত্যু পুনরায় নিরঞ্জনকে ফিরিয়ে নিয়ে আসে নগরবৃত্তে। তার পর ? এক বাংলাবাড়িতে এক কঙ্কালের উপস্হিতি আবিষ্কার, এক কুকুরের দেহাবশেষের খোঁজ পাওয়া এবং পুলিশের এক বিতর্কিত ইন্সপেক্টর রিমা খানের সত্যানুসন্ধান ; এর পরের অংশ বলা যাবে না । গোয়েন্দাকাহিনির  উপসংহার বলে পাঠকের চক্ষুশূল হতে চাই না ।

কাইনির মজা তার কথনে । মলয় সেটা জানেন মোক্ষমভাবেই । তাই রহস্যের পরত যেমন জটিল, তেমনই ল্যাবিরিন্হ এই আখ্যানের বিন্যাসেও । স্মৃতি যেমন এ-রহস্যের একটা বড় উপাদান, তেমনিই গুরুত্বপূর্ণ এই ‘স্মৃতি’ হিসেবে পরিচিত বিষয়টির সংগঠন । ইন্সপেক্টর রিমা খান কঙ্কালের আইডেনটিটি জানতে হাতড়ে বেড়ায় তার রেখে যাওয়া সিডির এক বিশাল বাঞ্চ । পর্নগ্রাফি, রকসংগীত ইত্যাদির সঙ্গে মিশে আছে কঙ্কালের আত্মজৈবনিক বিবৃতির এলোমেলো অংশ । কখনও তা যৌন অ্যাডভেঞ্চারের, কখনও তা নির্বেদ ভাবনার । আসক্তি ও অনাসক্তির লড়াইয়ে বিপর্যস্ত এক মানুষ, যে জীবনে একবারই সন্ধান পেয়েছিল পরিবর্তের । সেখান থেকে চ্যুতি যেমন তার নিজের কাছে ট্রমা, তেমনই ট্রমা তার জীবনেতিহাসের সন্মুখীন হওয়া যে কারোর । রিমার অনুসন্ধান টিপিকালি পুলিশি । এর মধ্যে কোনওভাবেই রোমাঞ্চকাহিনির ছমছমকে খুঁজে পাওয়া যাবে না । অথচ রিমার জগতে রয়েছেন ব্যোমকেশ বক্সী, ফেলু মিত্তির, পরেশ বর্মার মতো সুপার স্লথরা । এমনকী তিমির ওপরে যেমন তিমিঙ্গিল, এই সব সুপার স্লথদের উপরে রয়েছেন সুপার-সুপার স্লথ — এরকুল পোয়ারো এবং শার্লক হোমস । হ্যাঁ, সত্যি সত্যিই এঁরা এই কাহিনির কুশীলব । এঁদের উপস্হিতি এ আখ্যানকে নিয়ে যায় স্পুফ এর পর্যায়ে । স্পুফ অথচ ছ্যাবলামি নয় । ‘ডার্টি ফেয়ারি’ রিমা খান, তার নিজস্ব ট্রমা, তার ব্যক্তিগত চ্যালেঞ্জসহ কখন পাঠকের ঘাড়ে এসে নিঃশ্বাস ফ্যালে, টের পাওয়া যায় না । এক বিভ্রম তৈরি হয় । ডিতেকটিভ কাহিনিই পড়ছি তো ! সর্বতোভাবে বিচ্ছিন্ন মানুষের সংকট, যৌনতার ধূসর-ধূসরতর তরঙ্গভঙ্গ এবং এক সাবলাইম প্রতিশোধের মাথা চাড়া দেওয়া — এ কি কোনও মামুলি থ্রিলার ? পরক্ষণেই মনে হয় এ বিভ্রমমাত্র, আসল অভিপ্রায় তো রহস্যের উন্মোচন । ডিটেকটিভ কাহিনির পোড়-খাওয়া পাঠক জানেন, রহস্যের সমাধান হবেই । সেই অনিবার্য সমাধানবিন্দুতে যাওয়ার আগে যে রোমাঞ্চকুণ্ডলিতে পাক খাওয়া, তা-ই এই ধরণের কাহিনির মূল মজা । সে পাক মলয় যুৎসই ভাবেই খাইয়েছেন । কিন্তু সেই গোলকধাঁধা নির্জস খুন আর ডিটেকশনের নয় । তাতে মিশে আছে অস্তিত্ব নামক একটা অতি প্রাচীন বিষয়ের একান্ত সমস্যাও, যা তাঁর পূর্ববর্তী লিখন ‘জলাঞ্জলি’ এবং ‘নখদন্ত’তেও ছিল, প্রকাটভাবে ছিল ‘অরূপ তোমার এঁটোকাঁটা’য় । এদিক থেকে দেখলে মলয় সরে আসেননি তাঁর অভ্যাসগত লিখন থেকে । মলয়ের সঙ্গে সহবাসরত পাঠকের তাই কোনও ভয় নেই এই ‘নতুন’ উপন্যাসে । বরং প্রাপ্তিযোগ অনেক ।

একটা কথা শেষমেশ বলতেই হয় । এই বই লিখে মলয় একটি ঘোরঘট্ট কাণ্ড ঘটিয়ে ফেললেন নিঃশব্দে। বাংলা রহস্যকাহিনির বাজার যখন তলানিতে এসে ঠেকেছে, তখন এমন এক মেধাবী লিখন সত্যিই আশার সঞ্চার করে । উদ্বেগ জাগে পরবর্তী রিমা খান অ্যাডভেঞ্চারের জন্য । আরও কি লিখবেন মলয় ? এই সময়ের রহস্যকাহিনি লেখার জন্য যে পাঞ্জার তাকতের প্রয়োজন, তা যে তাঁর রয়েছে, তা প্রমাণিত । একন দেখার, সিরিজ কনটিনিউ করার মানসিকতাটি তিনি লালন করছেন কিনা তা দেখার । পাঠকের শুভেচ্ছা রইল মলয়ের জন্য । আরও শুভেচ্ছা রইল ‘ডার্টি ফেয়ারি’ রিমা খানের জন্য । বাংলা সাহিত্যে এমন এক নারীকে আগে দেখেছি কি ? মনে তো পড়েনা ।

 

 

Advertisements
REPORT THIS AD

উত্তম দাশ : মলয় রায়চৌধুরী ও হাংরি আন্দোলন ।

uttam

প্রচণ্ড অবিশ্বাস, ঘৃণা ও প্রত্যাখ্যান এই ত্রিবিধ নৈরাজ্যে ষাট দশকের শুরুতে আত্মার একটা ছটফটানি মলয় রায়চৌধুরী যখন সবে টের পাচ্ছেন তখন তিনি পাটনা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির ছাত্র । জীবনের মুখোমুখি দাঁড়াবার বয়েস । নিজেকে চিনে নেবার, অস্তিত্বের স্বরূপ আবিষ্কারের সময় । ততদিনে চিনে নেবার অবকাশ হয়েছে স্বদেশকে, সমাজ তার অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক কাঠামো খুলে ধরেছে সামনে । স্বাধীনতা অর্জিত হয়েছে চোদ্দ বছর আগে । দেশবিভাগ, শেকড়হীন মানুষের বিলিব্যবস্হা, দেশপপেম ততদিনে মুনাফা তুলছে । পরিবারের গঠন পালটাচ্ছে ; শহর গ্রাম ব্যবধান বাড়ছে, নীতিবোধ ভাঙছে, বিশ্বাসের তলানি এ পপজন্ম চেখে দেখার ফুরসৎ পায়নি । বাংলা কবিতায় রবীন্দ্রবিরোধ রাজনৈতিক মুনাফার জন্য মাত্র প্রয়োজন, ত্রিশ-চল্লিশের কবিতা গতানুগতিক হচ্ছে নির্জীব কবিদের হাতে । পঞ্চাশ সবে জাগছে । নিজস্ব ভূমি আবিষ্কার হয়নি ।

বিদেশি সাহিত্যের সঙ্গে মলয়ের পরিচয় তখনও নিবিড় নয় । এই সময়ে হঠাৎ ইংরেজ কবি চসারের In the sowre hungry tyme পঙক্তিটি গিরে ধরল তাঁকে । একান থেকে তুলে নিলেন হাংরি শব্দটি । অসওয়াল্ড স্পেংলারের সাংস্কৃতিক অবক্ষয় বিষয়ক কনসেপ্টে খুঁজে পেলেন হাংরি শব্দের দার্শনিক ভিত্তি । এই সময়ের প্রতিক্রিয়া দাদার বন্ধু শক্তি চট্টোপাধ্যায়কে জানালেন তিনি । শক্তিও তখন পাটনায় । উৎসাহ দিলেন । [ মলয় ইংরেজিতে কবিতার একটি ইশতাহার প্রকাশ করলেন ১৯৬১ সালের নভেম্বরে Hungry Generation নামে ; সেই ইশতাহার ১৯৬২ সালে আরও দুবার পরিমার্জিত আকারে প্রকাশিত হয়েছিল । বাংলা ইশতাহার প্রকাশিত হয়েছিল ইংরেজি ইশতাহারের পরে । ] ১৯৬২ সালের এপ্রিলে বাংলা ইশতাহারটি প্রকাশ করলেন মলয় ‘হাংগরি জেনারেশন’ । স্রষ্টা : মলয় রায়চৌধুরী, ; নেতৃত্ব : শক্তি চট্টোপাধ্যায় ; সম্পাদনা : দেবী রায় । ততদিনে অবশ্য দলবল বেড়েছে । কিন্তু হাংরি জেনারেশনের প্রথম বাংলা বুলেটিনটি গুরুত্বপূর্ণ । পরবর্তী সময়ে যাঁরা হাংরি আন্দোলনের সরিক হয়েছিলেন, ধরে নিতে হবে এই বুলেটিনের বয়ানে তাঁদের সায় ছিল । অন্তত তাঁরা মেনে নিয়েছিলেন এই আন্দোলনকে । মলয়ের লেখা বুলেটিনের সঙ্গে মৌল কোনো বিরোধ তাঁদের আদর্শগত কারণে ছিল না ; থাকলে একদল তরুণ নিশ্চয় এভাবে সংগঠিত হতে পারতেন না । আমি ভুলি না যে একটা আন্দোলন যৌথ চিন্তার ফসল । পরবর্তীকালে হাংরি আন্দোলনে এই যৌথ চিন্তার রূপ দেখবো । কিন্তু প্রাথমিক স্তরে একজন তাত্বিকের আনুগত্ব মেনে নেওয়াই সঙ্গত । তাত্বিক মলয় প্রথম বুলেটিনে লিখেছেন :-

 

“কবিতা এখন জীবনের বৈপরীত্যে আত্মস্হ । সে আর জীবনের সামঞ্জস্যকারক নয়, অতিপ্রজ অন্ধ বল্মীক নয়, নিরলস যুক্তিগ্রন্হন নয় । এখন, এই সময়ে, অনিবার্য গভীরতার সন্তৃস্তদৃক ক্ষুধায় মানবিক প্রয়োজন এমনভাবে আবির্ভূত যে, জীবনের কোনো অর্থ বের করার প্রয়োজন শেষ । এখন প্রয়োজন অনর্থ বের করা, প্রয়োজন মেরু বিপর্যয়, প্রয়োজন নৈরাত্মসিদ্ধি । প্রাগুক্ত ক্ষুধা কেবল পৃথিবীবিরোধিতার নয়, তা মানবিক, দৈহিক এবং শারীরিক । এ ক্ষুধার একমাত্র লালনকর্তা কবিতা, কারণ কবিতা ব্যতীত আর কী আছে জীবনে ! মানুষ, ঈশ্বর, গণতন্ত্র এবং বিজ্ঞান পরাজিত হয়ে গেছে । কবিতা এখন একমাত্র আশ্রয় ।

কবিতা থাকা সত্বেও, অসহ্য মানবজীবনের সমস্ত প্রকার অসম্বদ্ধতা । অন্তরজগতের নিষ্কুন্ঠ বিদ্রোহে, অন্তরাত্মার নিদারুণ বিরক্তিতে, রক্তের প্রতিটি বিন্দুতে রচিত হয় কবিতা — উঃ, তবু মানবজীবন কেন এমন নিষ্প্রভ ! হয়তো, কবিতা এবং জীবনকে ভিন্নভাবে দেখতে যারা অভ্যস্ত, তাদের অপ্রয়োজনীয় অস্তিত্ব এই সংকটের নিয়ন্ত্রক ।

কবিতা বলে যাকে আমরা মনে করি, জীবনের থেকে মোহমুক্তির প্রতি ভয়ংকর আকর্ষণের ফলাফল তা কেবল নয় । ফর্মের খাঁচায় বিশ্বপ্রকৃতির ফাঁদ পেতে রাখাকে আর কবিতা বলা হয় না । এমন কি, প্রত্যাখ্যাত পৃথিবী থেকে পরিত্রাণের পথরূপেও কবিতার ব্যবহার এখন হাস্যকর । ইচ্ছে করে, সচেতনতায়, সম্পূর্ণরূপে আরণ্যকতার বর্বরতার মধ্যে মুক্ত কাব্যিক প্রজ্ঞার নিষ্ঠুরতার দাবির কাছে আত্মসমর্পণই কবিতা । সমস্ত প্রকার নিষিদ্ধতার মধ্যে তাই পাওয়া যাবে অন্তর্জগতের গুপ্তধন । কেবল, কেবল কবিতা থাকবে আত্মায় ।

ছন্দে গদ্য লেখার খেলাকে কবিতা নাম দিয়ে চালাবার খেলা এবার শেষ হওয়া প্রয়োজন । টেবলল্যাম্প ও সিগারেট জ্বালিয়ে, সেরিব্রাল কর্টেক্সে কলম ডুবিয়ে কবিতা বানাবার কাল শেষ হয়ে গেছে । এখন কবিতা রচিত হয় অর্গাজমের মতো স্বতঃস্ফূর্তিতে । যেহেতু ত্রশ্নু বলাৎকারের পরমুহূর্তে কিংবা বিষ খেয়ে অথবা জলে ডুবে ‘সচতনভাবে বিহ্বল’ হলেই এখন কবিতা লেখা সম্ভব । শিল্পের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা কবিতা সৃষ্টির প্রথম শর্ত । শখ করে, ভেবে ভেবে, ছন্দে গদ্য লেখা হয়তো সম্ভব, কিন্তু কবিতা রচনা তেমন করে কোনো দিনই সম্ভব নয়। অর্থবঞ্জনাঘন হোক অথবা ধ্বনিপারম্পর্যে শ্রুতিমধুর, বিক্ষুব্ধ প্রবল চঞ্চল অন্তরাত্মার ও বহিরাত্মার ক্ষুধা নিবৃত্তির শক্তি না থাকলে, কবিতা সতীত মতো চরিত্রহীনা, প্রিয়তমার মতো যোনিহীনা, ঈশ্বরীর মতো অনুন্মেষিনী হয়ে যেতে পারে ।”

 

হাংরি জেনারেশনের বিরুদ্ধে প্রচলিত যে অভিযোগ যৌনতা এবং জান্তব ক্ষুধা ও জৈবতার, তার ইঙ্গিতমাত্র নেই মলয়ের ইশতাহারে । যদিও জীবনের সামগ্রিক ক্ষুধাকে তিনি বলেছেন — ‘মানসিক, দৈহিক এবং শারীরিক।’ তবু তাঁর বিশ্লেষণ যেখানে এসে থেমেছে সেখানে এ ক্ষুধা আত্মিক । অন্তরাত্মা ও বহিরাত্মার ক্ষুধা নিবৃত্তির সামর্থ্যে কবিতা আসলে বস্তুগত জীবন ও আত্মিক জীবনের মেলবন্ধন । কবিতা যেখানে জীবনের একমাত্র আশ্রয় সেখানে কবিতা ও জীবন একার্থক অথচ জীবনের সংকট কবিতা ও জীবনকে ভিন্নভাবে দেখা। কবিতা-বানিয়েদের মলয় দেখেছেন ক্ষমাহীন, কবিতা তাঁর কাছে অরগ্যাজমের মতো স্বতঃস্ফূর্ত, সুতরাং ‘সচেতনভাবে বিহ্বল’ হলেই কবিতা সৃষ্টি সম্ভব । অরগ্যাজম বলতে যে জৈববৃত্তি বোঝায় তা কখনই উদ্দীপনাহীন ও স্বতঃস্ফূর্ত নয় । বৈজ্ঞানিক সত্যে উপমাটি ব্যর্থ । এখানে আমাদের মেনে নিতে হবে কবিতার স্বতঃস্ফূর্তি মলয়ের ধারণামতো । অনেকটা রোমান্টিক কবিদের স্পন্টেনিয়াস ওভারফ্লো অফ পাওয়ারফুল ফিলিংস, অবশ্যই রোমান্টিকদের মতো আবেগে আত্মসমর্পণ নয়, কল্পজগৎ তৈরি নয়, সচেতন বিহ্বল অবস্হাই মলয়ের ধারণায় কবিতা সৃষ্টির শর্ত, ‘অন্তরাত্মার ও বহিরাত্মার ক্ষুধা নিবৃত্তির শক্তি’ না থাকলে তাকে মলয় কবিতা বলতে রাজি হননি । নিঃসন্দেহে অভিনব । বশেষত বহিরাত্মার ক্ষুধা নিবৃত্তি । কিন্তু এই অভিনব মতবাদ থেকেই হাংরি আন্দোলন শুরু ।

এতদিনে হাংরি-সংগঠন শক্তি সঞ্চয় করেছে, একে-একে জড়ো হয়েছেন সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়, উৎপলকুমার বসু, সমীর রায়চৌধুরী, সুবো আচার্য, শৈলেশ্বর ঘোষ, সুভাষ ঘোষ, দেবী রায়, প্রদীপ চৌধুরী, সুবিমল বসাক,বাসুদেব দাশগুপ্ত, রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়, ফালগুনী রায়, অরণি বসু, শম্ভু রক্ষিত, ত্রিদিব মিত্র, তপন দাস, মিহির পাল প্রমুখ । তালিকায় প্রথম তিনজন পঞ্চাশের, বাকিরা সময়ের দিক থেকে ষাট দশকের অর্থাৎ শক্তিকে নিয়ে হাংরি গোষ্ঠীভূক্ত হয়েছেন পঞ্চাশের চারজন কবি । কিন্তু প্রশ্ন, পঞ্চাশের এই চার কবির ষাটের অনুজ কবিদের সঙ্গে নতুন আন্দোলনে শরিক হবার প্রয়োজন হল কেন ? এই সময়ে শরৎকুমার মুখোপাধ্যায়ের সম্পাদনায় ‘কৃত্তিবাস’ বেরিয়েছে । সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় তখন আইওয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়র্কশপ প্রোগ্রামে আমেরিকায় । ‘কৃত্তিবাস’-এর পপকাশনা নিয়ে চিন্তিত অথচ শরৎ-এর ওপরে আস্হা রেকেই তাঁকে চলতে হচ্ছে । ‘স্বপ্ন সংকলন’-এর পরিকল্পনা তাঁর মাথায় । অথচ গুছিয়ে উঠছে না কিছুই । লেখক নির্বাচনে দ্বিধাদ্বন্দ্ব চলছে বন্ধুদের সঙ্গে । শরৎ-এর সম্পাদিত ‘কৃত্তিবাস’ পেয়ে সুনীল আমেরিকা থেকে যে চিঠি সমীরকে লিখেছিলেন তাতে ‘কৃত্তিবাস’ গোষ্ঠীতে যে ভাঙন ধরেছে তারই ইঙ্গিত । এই সময়ে আরো একটি ঘটনা — তন্ময় দত্তের কবিতার খাতা চুরি । সুনীল বলেছেন, জীবনানন্দের পর সবচেয়ে সক্তিমান কবি তন্ময় । অভিমানে তিনি কবিতা লেখা ছেড়ে দেন ।

বন্ধুদের মধ্যে এমনি নানা অসন্তোষ এবং ‘কৃত্তিবাস’-এর সম্ভাবনায় সন্দিহান হয়ে নতুন কিছু করার প্রবণতায় মলয়ের দাদা সমীরকে কেন্দ্র করে সন্দীপন উৎপল যোগ দিলেন হাংরি আন্দোলনে । শক্তি আগেই যুক্ত । তুলনায় প্রতিষ্ঠিত এই চার লেখকের সমর্থন পেয়ে হাংরি আন্দোলনে জোর এলো । আগেই বলেছি ইতিমধ্যে অনেক তরুণ সংঘবদ্ধ এই আন্দোলন ঘিরে । নানা চিন্তার ছাপ আসছে । আন্দোলন সম্পর্কে নানাজন নিজের মতো ফতোয়া দিচ্ছেন । মলয়ের চিন্তায় যে নির্দিষ্টতা ছিল,নানা চিন্তার চাপে ছড়িয়ে পড়ায় আন্দোলনকে স্পষ্ট রূপরেখায় বেঁধে দিতে হাংরি আন্দোলনের মূল উদ্দেশ্য নির্ণায়ক নিয়মবিধির একটি ইশতাহার রচিত হলো । লিখলেন মলয় :-

  1. The merciless exposure of the self in its entirety .
  2. To present in all nakedness all aspects of the self and thing before it.
  3. To  catch a glimpse of the exploded self at a particular moment.
  4. To challenge every value with a view to accepting or rejecting the same.
  5. To consider everything at the start to be nothing but a ‘thing’ with a view to testing whether it is living or lifeless.
  6. Not to take reality as it is but to examine it in all its aspects.
  7. To seek to find out a mode of communication, by abolishing the accepted modes of Prose and Poetry which would instantly establish a communication between the poet and his reader.
  8. To use the same words in poetry as are used in ordinary conversation.
  9. To reveal the sound of the word, used in ordinary conversation, more sharply in the poem.
  10. To break loose the traditional association of words and to coin unconventional and here-to-fore unaccepted combination of words.
  11. To reject traditional forms of poetry and allow poetry to take its original forms.
  12. To admit without qualification that poetry is the ultimate religion of man.
  13. To transmit dynamically the message of the restless existence and the sense of disgust in a razor sharp language.
  14. Personal ultimatum.

 

এই চৌদ্দটি সূত্রের মূল লুকিয়ে আছে কি লিখব আর কি ভাবে লিখব এই তত্বের ওপর । সম্পূর্ণ অহং-এর ক্ষমাহীন প্রকাশ, বিশেষ মুহূর্তে বিস্ফারিত আত্মার আভাস সম্পূর্ণ নিজস্ব শব্দবন্ধে ও প্রকাশ রীতিতে । ঐতিহ্য অস্বীকার, পপচলিত রীতি প্রত্যাহার, এবং তার প্রকাশ প্রাত্যহিক ভাষায়, কিন্তু কামড় বসাবে তীক্ষ্ণ । অস্হির অস্তিত্বের যন্ত্রণা ও চরম বিতৃষ্ণা লোক-প্রচলিত মূল্যবোধকে ধ্বংস করে প্রতিষ্ঠিত করবে কবিতাকে । ধর্মে কিছু পাওয়ার নেই । সমাজে প্রত্যাখ্যাত, রাজনীতি বন্ধ্যা — একমাত্র আশ্রয় কবিতা । সমস্ত ভাঙচুরের মধ্যে দাঁড়িয়ে জীবনের অর্থকে ফলবানের চিন্তা নিঃসন্দেহে শিল্পীর ।

ঐতিহ্যগত মূল্যবোধকে অস্বীকার, প্রচলিত ধারার বিপক্ষে দাঁড়িয়ে কবিতার নতুন চেহারা আবিষ্কার প্রকৃতই সাহসী ও মৌলিক । নতুন কবিতার জন্য নতুন সূত্র অনুস্ধানও স্বাভাবিক । কিন্তু তত্ব নির্ভর করে কিংবা ইশতাহার মেনে কবিতা লেখা, দলবদ্ধভাবে সম্ভব কিনা সে প্রশ্ন জাগতে পারে । ইশতেহারের সূত্রগুলো দলবদ্ধ সকলের ভেতর থেকে উঠে আসা কিনা সে প্রশ্নও উঠতে পারে । যদি ধরে নেওয়া যায় ইশতাহারের সূত্র ধরেই হাংরি আন্দোলনের সংঘবদ্ধতা তা হলে মেনে নিতে হয় এ আন্দোলনের জোর ছিল । জোর যে ছিল তার সবচেয়ে বড় প্রমাণ প্রতিরোধ শুরু হয়ে গেল দ্রুত । তবে সে সংবাদ সমর্থনের নয়, বিরুদ্ধতার । লেখালিখির জন্য যতটা, তার চেয়ে অনেক বেশি এঁদের জীবনযাত্রা এবং শিল্প-অসম্পর্কিত ক্রিয়াকলাপ একটা টেনশনের আবহাওয়া তৈরি করল ।

এ সবই হয়তো জীবনের প্রতি, সমাজের প্রতি ঘৃণা ও বিতৃষ্ণা থেকে উপজাত । চূড়ান্ত প্রত্যাখ্যান উভয়তই, ফলে এই বিকার । নাকি শুধু স্টান্ট ! শুধু স্টান্ট হলে মূল আন্দোলনই অর্থহীন । মনে হয় না শুধু স্টান্টের পেছনে এতগুলি তাজা ছেলে জুটেছিল । নিজেদের ধ্বংসের পথই কি নির্মাণ করেছিল হাংরি ছেলেরা ? এবং একই সঙ্গে এঁদের ধ্বংসের চক্রান্ত গড়ে উঠেছিল এদেশে, বিভিন্ন সংবাদপত্রের বিরুদ্ধবাদী সংবাদে এবং বুদ্ধিজীবীদের প্রতিক্রিয়ায় । এই সময়ে মলয়কে লেখা সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের একটি চিঠি খুবই জরুরি। চিঠিতে কোনো তারিখ নেই । পোস্টের স্হান আমেরিকার আইওয়া সিটি, তারিখ ১০ জুন ১৯৬৪ । উত্তরপাড়ায় ১৯৬৪ সালের জুনের ১৬ তারিখে । মলয়, সুনীলের বন্ধু সমীরের ভাই, তাঁর স্নেহভাজন ও প্রিয়জন । কিন্তু হাংরির অসামাজিক ও শিল্পসম্পর্কহীন ক্রিয়াকলাপে ক্ষুব্ধ সুনীল তাঁর মনোভাব স্পষ্ট বলেছেন । নিশ্চিতই সুনীলের কলকাতার বন্ধুরা তাঁর ক্ষোভের ইন্ধন যুগিয়েছিলেন । কিন্তু সুনীল এ-চিঠিতে মলয়ের কবিতাকেই সরাসরি অগ্রাহ্য করেছেন । যদিও কিছুদিন আগে সমীরকে লেখা চিঠিতে ‘কৃত্তিবাস’ থেকেই মলয়ের বই প্রকাশের অভীপ্সার কথা আমরা জানি । সুনীল লিখেছিলেন : ‘মলয়ের বই তো ওকে কৃত্তিবাস থেকেই বার করতে বলেছি, সাহিত্য প্রকাশক কোনো দরকার নেই ।

‘কৃত্তিবাস’ থেকে মলয়ের বই প্রকাশের ইচ্ছা কি শুধু বন্ধুকৃত্যের জন্য, বন্ধুর ভাইয়ের প্রতি স্নেহের টানই তার কারণ ? নাকি কবি হাসাবেই মলয়ের যোগ্যতা তখনও অবধি স্বীকৃত ছিল তাঁর । কিন্তু কয়েক দিনের মধ্যে এই ধরণের বদল তবে কি বন্ধুদের উসকানির ফল ? সুনীলের কাছে কবিতার আন্দোলনের চেয়ে ভালো কবিতা লেখা জরুরি । এতে আপত্তির কারণ নেই । এ তাঁর নিজস্ব ধারণা । কিন্তু হাংরি আন্দোলন ভেঙে দেবার কথা বললেন কেন ? ঈর্ষা নয় । কারণ এঁদের লেখার জৌলস তিনি স্বীকার করেননি, লেখার জগতে এঁদের তিনি প্রতিদ্বন্দ্বীও মনে করেননি । তবে কি হাংরির লেখকরা তাঁকে নানাভাবে উত্যক্ত করেছিল বলেই এই উত্তেজনা ? কিন্তু এতখানি উত্তেজনা কি সম্ভব, একেবারে হাংরি আন্দোলন ভেঙে দেবার মতো । নাকি শক্তি, সন্দীপন ও উৎপলের কৃত্তিবাসগোষ্ঠী ত্যাগ ও হাংরি আন্দোলনে যোগ কৃত্তিবাসী বন্ধুদের প্রতিশোধস্পৃহ করে তুলেছিল ? এঁদেরই কেউ কি সুনীলের উত্তেজনার কারণ সরবরাহকারী ?

হাংরি আন্দোলন প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছে । সুনীলের চিঠিতে যা ছিল আভাস, এদেশে তা তখন নাড়া দেওয়া সংবাদ ।  ১৯৬৪-এর ১৭ জুলাই ‘যুগান্তর’ দৈনিকে সংবাদ বেরুচ্ছে ‘সাহিত্যে বিটলেমী’ এই শিরোনামে । এ সংবাদ হাংরি আন্দোলনের দিক থেকে নঙর্থক । কিন্তু অনেক সত্য এখানে লুকিয়ে আছে । প্রচলিত ধারণা, পুলিশী গ্রেফতার এবং মামলা হাংরি আন্দোলনকে রাতারাতি খ্যাতি দিয়েছে । কিন্তু এ সংবাদ হাংরি আন্দোলনের বিরুদ্ধে পুলিশী ব্যবস্হা গ্রহণের দুমাস আগের । অথচ দেখছি সংবাদেই প্রকাশিত হয়েছে হাংরি আন্দোলন ও এর লেখকরা ইতিমধ্যে বিদেশে আলোচিত । সাংবাদিক জানাননি, এদেশে ভারতবর্ষের বিভিন্ন অঞ্চলে এঁদের শেকড় ততদিনে অনেকদূর নেমে গেছে । হিন্দী তরুণ লেখকদের একটা অংশ প্রায় ঝাঁপিয়ে পড়েছেন এই আন্দোলনে । পুলিশ এঁদের ওপর ন্জর রাখছে, রাখছিল, তার প্রমাণ পাওয়া গেল দুমাসের মধ্যেই । পুলিশ নজর রেখেছিল কেন ? কিছু তরুণ লেখকের প্রথাবিরোধী লেখার জন্য ? শাসকগোষ্ঠী এবং সবরকম কতৃত্বকে অস্বীকার ও আক্রমণ করার জন্য ? বন্ধ্যা রাজনীতি , প্রচলিত বিশ্বাস ও ঐতিহ্যের প্রতি প্রবল বিতৃষ্ণায় তীব্র ছটফটানি পুলিশি আইনে অপরাধমূলক ছিল কি ? নাকি কেউ পুলিশকে এঁদের বিরুদ্ধে ব্যবহার করেছিলেন ? এসব কূট প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে হবে আমাদের । ধীরে ধীরে তথ্য যাচাই করে ।

এখন পর্যন্ত ‘দৈনিক যুগান্তর’-এর সংবাদ জানাচ্ছে এঁদের জীনযাত্রা ও লেখা বদ্ধ-বাঙালি জীবনে নাড়া দিতে শুরু করেছে । সংবাদের যোগ্য করে তুলেছেন এঁরা নিজেদের ।কী অন্তর্দৃষ্টিতে এঁরা দেখতে পেয়েছিলেন রাজনৈতিক পাণ্ডাদের । যাঁদের স্হান হবে ‘গণিকার মৃতদেহ ও গর্দভের লেজের মাঝামাঝি কোথাও’ । শুধু রাজনীতি নয়, সমস্ত ভারতবর্ষের অন্ধকার অনেক আগে থেকে আঁচ করার অপরাধ করে ফেলেছিলেন এঁরা। এবং সে শুধু সর্বস্ব পণ করে শিল্প করতে গিয়ে । দৈনিক যুগান্তরের সংবাদে  হাংরি আন্দোলনের ক্রিয়াকাণ্ডের উপরিতলের চেহারাটাই ফুটে উঠেছে, ভেতরের চেহারা কিছু পরিমাণে ধরার চেষ্টা দেখা যায় দুদিন পরের ‘আর মিছিলের শহর নয়’ শিরোনামের সম্পাদকীয়তে । প্রয়োজনীয় অংশ এরকম : ‘’বাংলাদেশে দলাদলিতে দীর্ণ বিশ্বাসহীন রাজনীতি আজ নিজের মস্তক চর্বণ করিতে ব্যস্ত । এই আবহাওয়ার জন্যই কি সমাজে এক ধরণের নিরাশাবাদ জন্ম লাভ করিতেছে, যার চেহারা ড্রেন-পাইপ মস্তানি, যার আওয়াজ রাস্তার রোমিওদের শিস, এবং সাহিত্যের ‘ক্ষুৎকাতরতার’ মধ্যে ভয়াবহভাবে প্রকাশ পাইতেছে ? কাজেই ইহা আশ্চর্য নয়, এই সব বিকৃতির উপাসকরা, যারা ‘হাংরি জেনারেশন’ নাম ধারণ করিয়াছে, তারা পরম শ্রদ্ধাহীন অবজ্ঞায় ‘গণিকার মৃতদেহ ও গর্দভের লেজের কোথাও’ রাজনীতিকদের স্‌আন নির্দেশ করিতে চাহিতেছে । কলিকাতার ক্ষুধার্ত ছেলেরা এই ধিক্কার দিতেছে এবং আত্মধিক্কারের মধ্যে বন্দী হইতেছে ; ইহা কি বন্ধ্যা রাজনীতিকদের প্রায়শ্চিত্ত অথবা অসুস্হ সমাজের অভিশাপ?”

সম্পাদকীয় স্তম্ভের লেখক প্রশ্ন তুলেছেন, উত্তর দেননি । দিলে বলতে হতো ‘বন্ধ্যা-রাজনীতিকদের প্রায়শ্চিত্ত ও অসুস্হ সমাজের অভিশাপ’ এই ক্ষুধার্ত ছেলেদের টেনে নিয়ে এসেছে শেষ আশ্রয়স্হল কবিতায় । তবে ভিন্নরূপের কবিতা নিশ্চয়ই, আমাদের সংস্কারের বাইরের কবিতা, ইরিটেটিভ কিন্তু নিজেকে চেনার জন্য অব্যর্থ । অন্তত হাংরি লেখকদের দৃষ্টিকোণ থেকে । হাংরি আন্দোলন সংবাদে ও সম্পাদকীয়তে এনেছে যে নঙর্থক প্রতিক্রিয়া, সে প্রতিক্রিয়ার টেনশন থেকে কলকাতার পুলিশ ১৯৬৪ সালের সেপ্টেম্বরের গোড়ায় হাংরি লেখকদের বিরুদ্ধে অ্যাকশানে নামলো । এ এস আই কালীকিঙ্কর দাসের অভিযোগের ভিত্তিতে কলকাতার জোড়াবাগান থানার এস আই এস এন পাল এই দিনেই এফ আই আর করলেন ।

একই দিনের অভিযোগ ও এফ আই আর ( সেকশান ১২০ বি এবং ২৯২ আইপিসি ) — কলকাতা পুলিশের সুনাম খুব অর্থবহ । হাংরি জেনারেশনের অভিযুক্ত বুলেটিনে যাঁদের লেখা ছিল সবাইকে অভিযুক্ত করা হলো । অর্থাৎ ঢাকি ঢুলি সব । কালীকিঙ্কর দাস জানিয়েছিলেন ‘ক্রেডিবল ইনফরমেশান’ থেকে হাংরি জেনারেশনের প্রচারের কথা জানতে পারেন । পুলিশ শাখার ইনফরমাররা যেভাবে সমাজের বিভিন্ন স্তরে ছড়িয়ে থাকে তাতে কলকাতা পুলিশের ইনটেলিজেন্স ব্রাঞ্চের পক্ষে হাংরি ক্রিয়াকাণ্ডের খোঁজ পাওয়া খুবই সবাভাবিক ঘটনা । কিন্তু পুলিশ হঠাৎ হাংরি জেনারেশন সম্পর্কে এত তৎপর হলো কেন ? কিন্তু কত ছিল হাংরি বুলেটিনের প্রচার সংখ্যা ? কজন পাঠক পয়সা খরচ করে ও পত্রিকা কিনত ? অর্থাৎ যে সময়ে কলকাতার বই-স্টল আলো করে পর্ণগ্রাফি বিক্রি হতো, সেসময়ে কতজন পাঠক রেস্ত খরচ করে  অশ্লীল লেখা জেনে হাংরি জেনারেশন বুলেটিন সংগ্রহ করত ? সুকুমারমতি বালক-বালিকাদের বিপথগামী হবার কতখানি সম্ভাবনা ছিল ও পত্রিকা পড়ে ? মূলত কবিতার মগজ এবং যে পপকাশভঙ্গীতে লেখা সে যুগে কবিতা পাঠকদের ক্ষেত্রেও তা ছিল প্রায় অসহনীয় । তা হলে “টু করাপ্ট দি মাইন্ড অফ দি কমন রিডার’ একথা আসছে কি করে ? সাধারণ পাঠকের সংজ্ঞা কি ?

তবু তর্কের খাতিরে ধরে নেওয়া যাক পুলিশ তার দৃষ্টিকোন থেকে হাংরির লেখাকে নৈতিকভাবে অশ্লীল মনে করেছে । আমার সংশয়ী মন এখানে অন্য ইন্ধন খুঁজে ফিরছে হয়তো । অভোযোগ দায়ের ও মামলা চালানোর সময়ে পুলিশের মনোভাব পরিবর্তন হয়নি ধরা যেতে পারে । কারণ যে অভিযোগ পুলিশ তুলবে তাকে তথ্য প্রমাণে আদালতে পপতিষ্ঠা করবে, এটাই স্বাভাবিক । আমি এখানে একটা চিঠির উল্লেখ রাখতে চাই।  কিছু পরবর্তীকালের । কিন্তু বর্তমান প্রসঙ্গে প্রাসঙ্গিক । ১৯৬৫ সালের ২৭ জানুয়ারি ‘ইনডিয়ান কংগ্রেস ফর কালচারাল ফ্রিডাম’-এর এগজিকিউটিভ সেক্রেটারি মিস্টার এ. বি. শাহ মলয়কে এই চিঠিতে লিখেছেন :

“I met the Deputy Commissioner of Police the other day after we met at the Office of the Radical Humanist in Calcutta. I was told that they would not have liked to bother themselves with the ‘hungry Generation’ but for the fact that a number of citizens to whom the writings of your group were made available, insisted on some action being taken.”

তাহলে দেখা যাচ্ছে, পুলিশের দক্ষতা বা সক্রিয়তা নয়, কিছু নাগরিকের চাপাচাপিতেই পুলিশ হাংরিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্হা নিতে অগ্রসর হয় । প্রশ্ন, এই নীতিবাদী নাগরিকরা কারা ? কেন তারা হাংরিদের বিরুদ্ধে পুলিশকে সক্রিয় করলেন ? পুলিশ হাংরি জেনারেশনের এগারোজনকে অভিযুক্ত করে গ্রেপ্তার করেছিল ছয়জনকে । অথচ মামলা দায়ের করল একজনের বিরুদ্ধে । স্টেট বনাম মলয় রায়চৌধুরী । কিন্তু মলয় যে অভোযোগে অভিযুক্ত, অন্যদের তা থাকে নিষ্কৃতি পাবার কথা নয় । আসলে পেছনে আরও কিছু ঘটনা ঘটে গিয়েছে, এর মধ্যে হাংরি লেখকরা অনেকেই জবানবন্দি দিয়ে বসে আছেন পুলিশের কাছে । মধ্যবিত্ত বাঙালির নিরাপত্তাবোধ উসকে দিয়েছিল তাঁদের অস্তিত্ব । শিল্পের জন্য কারাবরণের চেয়ে হাংরি আন্দোলন থেকে নিজেদের প্রত্যাহার করা অনেক জরুরি ছিল সেসময়ে । আসলে সে সময়ে হাংরির নেতৃত্ব ও সংগঠন মলয়ের হাতে । সম্পাদক প্রকাশক হিসাবে যাঁর নামই থাক, মলয়ই সবকিছুর নিয়ন্ত্রক । অবশ্যই বন্ধুরা জানতেন, কিন্তু থানা-পুলিশের ভয়ে ওঞ্চাশের লেখকদের মতই সুভাষ বা শৈলেশ্বর কেউ হাংরি জেনারেশনের কোনো দায়িত্ব নিতে চাননি । সবাই সম্পর্ক ত্যাগের কথাই বলেছেন । ব্যতিক্রম প্রদীপ চৌধুরী ।

অ্যালেন গিন্সবার্গ আবু সয়ীদ আইয়ুবকে হাংরি লেখকদের সাহায্য করার আবেদন জানিয়ে চিঠি লিখেছিলেন, সেই আবু সয়ীদ মলয় এবং তাঁর সঙ্গীদের লেখক বলে মেনে নিতে পারেননি । এবং লেখার জন্য কেউ এদেশে পুলিশীপীড়ন ভোগ করেছে বলেও তাঁর জানা নেই বলেছেন । অ্যালেন গিন্সবার্গকে ৩১ অক্টোবর ১৯৬৪ যখন আবু সয়ীদ চিঠিতে এসব লিখেছেন, তখন কিন্তু কলকাতা পুলিশ হাংরি লেককদের বিরুদ্ধে মামলা সাজাচ্ছে । আবু সয়ীদের চিঠিটি এইরকম :-

 

পার্ল রোড, কলকাতা,

৩১ অক্টোবর ১৯৬৪

প্রিয় শ্রীগিন্সবার্গ

আপনার ১৩ তারিখের উদ্দেশ্যহীন অবমাননাকর চিঠি পেয়ে আমি বিস্মিত । আপনি যে কংগ্রেস ফর কালচারাল ফ্রিডমকে কমিউনিস্টদের দ্বারা চিহ্ণিত একটি জোচ্চোর বুলশিট উদারনৈতিক আঁতেলদে কমিউনিস্টবিরোধী সিনডিকেট বলে মনে করেন, তাতে আমি অবাক হইনি ; কেননা আমি কখনও কংগ্রেস ফর কালচারাল ফ্রিডামকে আপনার লেবেল ‘বুর্জোয়া’ কিংবা ‘শ্রদ্ধেয়’ থেকে মুক্ত করার কথা ভাবিনি ।

যদি কোনো পরিচিত ভারতীয় সাহিত্যিক বা বুদ্ধিজীবি তাদের সাহিত্যিক বা বৌদ্ধিক কাজের জন্য পুলিশের অবদমনের শিকার হতো , আমি নিশ্চিত যে ভারতীয় কংগ্রেস ফর কালচারাল ফ্রিডাম আপনার অপমানজনক ওসকানি ছাড়াই হস্তক্ষেপ করতো ।  আমি আপনাকে জানিয়ে আনন্দিত যে তেমন কোনো কিছুই সাম্প্রতিককালে এদেশে ঘটেনি । মলয় রায়চৌধুরী ও তাঁর হাংরি জেনারেশনের তরুণ বন্ধুরা, আমার জ্ঞানমতে তেমন কোনো রচনা লিখে উঠতে পারেনি, যদিও তারা আত্মপ্রচার করে লিফলেট ছাপিয়ে বিলি করেছে  এবং গণ্যমান্য লোকেদের চিঠি নোংরা ও অশ্লীল ভাষায় প্রকাশ করেছে ( আমি আশা করি আপনি স্বীকার করবেন যে ‘ফাক’ শব্দটি অশ্লীল এবং ‘বাস্টার্ড’ শব্দটি নোংরা, অন্তত এই বাক্যটিতে, “গাঙশালিক স্কুলের জারজদের ধর্ষণ করো”, তারা এর চেয়েও খারাপ   ভাষায় কবিদের নাম উল্লেখ করে লিখতে ইতস্তত করেনি )। সম্প্রতি তারা একজন মহিলাকে ভাড়া করে তার উন্মুক্ত বুক দেখাবার প্রদর্শনীর আয়োজন করেছিল এবং সেই আশ্চর্যজনক আভাঁগার্দ প্রদর্শনী দেখার জন্য অনেকের সঙ্গে আমাকেও আহ্বান করেছিল । আপনি পৃথিবীর ওই পারে বসে কলকাতায় এই ধরণের বয়ঃসন্ধিকালীন ইয়ার্কিকে প্রচার করায় আপনার সাংস্কৃতিক স্বাধীনতা বলে চালাতে পারেন । আশা করি আমার যা দায়িত্ব তা পালন করার জন্য আপনি আমাকে আপনার মতের সঙ্গে পার্থক্য সমর্থন করবেন ।

পুলিশের পক্ষে নিশ্চয়ই বোকামি হয়েছে এই যুবকদের গড়া ফাঁদে পড়ে তাদের কয়েকজনকে কয়েক দিনের জন্য হেফাজতে নেয়া ( তাদের সবাইকে এখন ছেড়ে দেয়া হয়েছে ) আর তার দ্বারা তাদের প্রচারে সুবিধা করে দেয়া এবং জনসাধারণের সহানুভূতি সংগ্রহ করা — তারা তাদের ইয়ার্কির মাধ্যমে নিজেদের প্রচারই চাইছিল ।

আপনার মতের সঙ্গে আমার এ-ব্যাপারে মিল নেই যে ইনডিয়ান কমিটি ফর কালচারাল ফ্রিডামের প্রধান কাজ হলো মার্কিন বিটনিক কবিদের কাঁচা অনুকরণকারীদের সাহায্য করা । ইউরোপীয় সাহিত্য সম্পর্কে আপনার জ্ঞানকে আমি শ্রদ্ধা করি কিন্তু আমার ভাষার সাহিত্যকদের মূল্যায়ন করার ক্ষমতাকে আপনার নির্দেশে খর্ব করতে পারি না — যে ভাষা সম্পর্কে আপনি নিজের অজ্ঞতা বেছে নিয়েছেন ।

আপনার সঙ্গে গূঢ় পার্থক্য সত্ত্বেও এবং আপনার কয়েকটি অসাধারণ কবিতাকে ভালোলাগা সত্ত্বেও আপনাকে শুভেচ্ছা জানাই ।

ভবদীয়

আবু সয়ীদ আইয়ুব

 

শৈলেশ্বর ও সুভাষের জবানবন্দিতে সাহসের অভাব ছিল । যে আত্মিক অসহায়বোধ তাঁদের হাংরি আন্দোলনে প্রাণিত করেছে, গ্রেফতার ও মামলার মুখোমুখি তাই তাঁদের বৈষয়িক অসহায়বোধে দাঁড় করিয়েছে । সুযোগ খুঁজেছেন নিস্তারের । এমনকি হাংরির সঙ্গে সম্পর্ক ছেদের মুচলেকার বিনিময়েও কাঙ্খিত ছিল মুক্তি । এসব কার্যকলাপ ও মনোভাব দলের অন্য সদস্যদের মধ্যে ভুল ধারণার জন্ম দিতে পারে, বিশেষ করে মলয়ের । সামাজিক সব মূল্যবোধকে যাঁরা অবিশ্বাস করে এগিয়েছিলেন, যা কিছু প্রচলিত তাকেই সন্দেহ করা, শেষ পর্যন্ত বন্ধুত্বের ক্ষেত্রেও  এ অবিশ্বাস মাথা চাড়া দিয়েছিল । শৈলেশ্বরের জবানবন্দি পরবর্তী সময়ে মলয়ের ক্ষোভ ও ঘৃণার কারণ ।

‘প্রচণ্ড বৈদ্যুতিক ছুতার’ কবিতায় অশ্লীলতার দোষারোপে আলিপুর ব্যাঙ্কশাল কোর্টের নয় নম্বর কোর্টে প্রেসিডেন্সি ম্যাজিস্ট্রেট শ্রী এ কে মিত্র মলয়ের দোশো টাকা জরিমানা অনাদায়ে এক মাসের বিনাশ্রম কারাদণ্ড দিলেন সঙ্গে অভিযুক্ত রচনাগুলোর বিনষ্টির আদেশ । কলকাতা হাইকোর্টে অবশ্য এ-মামলা টেকেনি । বেকসুর খালাস পেয়েছিলেন মলয় । কিন্তু অনেক টেনশন ও অর্থ খরচের পর । শুধু কি তাই ? বন্ধু বিচ্ছেদ ঘটে গেল হাংরি লেখকদের সঙ্গে ।

———————–

ঋণস্বীকার : মহাদিগন্ত

রাহুল দাশগুপ্ত নিয়েছেন মলয় রায়চৌধুরীর সাক্ষাৎকার

রাহুল : কবে প্রথম কবিতা লেখা শুরু করলেন ?

মলয়: ১৯৫৯-৬০ নাগাদ । পাটনা শহরে আমাদের বাসা ছিল ক্রিমিনাল অধ্যুষিত বাখরগঞ্জে । দিনের বেলাতেও লোকে ও-পাড়ায় যেতে ভয় পেত । আমিও কবিতায় ছুরি-চাকু চালানো রপ্ত করলুম । তুমি প্রথম কবি কাকে বলবে ? অনেকের মতে প্রথম কবি হলেন পঁচিশ হাজার বছর আগের ক্রোম্যাগনন মানুষ যিনি একটা ফুল তুলে তাঁর মানুষীকে দিয়েছিলেন । আমি বলতে চেয়েছিলুম, প্রথম কবি হলেন আঠারো লক্ষ বছর আগেকার সেই জাইগানথ্রপাস মানুষটি, যিনি একটা পাথরের টুকরো তুলে প্রথম হাতিয়ার আবিষ্কার করেন । সৃজনশীলতা বা কবিত্বকে সেই ভাবেই টের পেতে চেয়েছিলুম ।

রাহুল : লেখালিখির পাশাপাশি পড়াশোনা কতটা জরুরি মনে করেন ?

মলয় : খুবই । কম বয়স থেকেই আমি পড়তে ভালোবাসতুম । হোমার, থুকিদিদিস, সফোক্লিস, ইউরিপিদেস, অ্যারিস্তোফেনিস, প্লেটো, অ্যারিস্তোতল, লিউক্সেতিয়াস, সিসেরো, ভার্জিল, পেট্রনিয়াস, সেন্ট-অগাস্টিন, দান্তে, বোকাচ্চিও, চসার, পেত্রার্কা, শেক্সপিয়ার । সেসব বই পড়ে উত্তেজিত হতুম ; এঁদের অনেকের বিরুদ্ধতা করতে গিয়েও আমার অনেক মতামত গড়ে উঠেছে । তখন বাহাদুরি করে ডায়েরিও লিখতুম । আমি কোনও কবি বা লেখককে সে-ই কবি বা লেখকের জন্য পড়ি না । আমি তাঁকে আমার জন্য পড়ি ।

রাহুল : কবিতা লিখতে গিয়ে কী ভাবে নিজেকে আলাদা করে নিলেন ?

মলয় : আমার কবিতায়, সেই ১৯৬১ থেকেই, আমি থটপ্রসেসকে তো ভেঙেছি, ‘শয়তানের মুখ’ কাব্যগ্রন্হে  কিছু কবিতায় শব্দের যুক্তিপূর্ণ সিকোয়েন্সও নষ্ট করেছি । পরে ১৯৬৩ নাগাদ টানা লিখতে থাকি, যা পরে এসেছে ‘জখম’ কাব্যগ্রন্হে বা ‘প্রচণ্ড বৈদ্যুতিক ছুতার’ কবিতায় । ত্রিশ-চল্লিশ-পঞ্চাশে ভেবেচিন্তে কবিতায় লজিক আনা হয়েছে, আর আমি ভেবেচিন্তে লজিক সরিয়েছি, ইমেজ গড়ে ওঠারও সময় দিইনি, অথচ পুরো কবিতাটার টোটাল ইমপ্যাক্ট এমন, যাতে পাঠক নাস্তানাবুদ হয়ে যায়, একের পর এক ইমেজ দ্রুত তৈরি হয়ে পাঠককে আক্রান্ত করে । তাই এক সময় লিখেছিলুম, ‘কবিতা হল আগুনের ভেতর থেকে ঝলসানো বাহুর সিগনালিং । কবিতার বিষয়বস্তু এখন আমি । আমিই সিসমোগ্রাফ, আমিই ভূমিকম্প, আমি ভাঙাচোরা খেতখামার ।’ বস্তুপৃথিবীর সঙ্গে কবি তার অস্তিত্বের সামগ্রিকতা কোরিলেট করবেন, এটাই চেয়েছিলুম আমি ।

রাহুল : আপনার প্রথম দিকের কবিতায় এই ব্যাপারটাই এসেছে ?

মলয় : হ্যাঁ, ছয়ের দশকে গোটা পঞ্চাশেক কবিতা লিখেছিলুম পাঁচ-ছ বছরে । নির্মাণ বলতে যা বোঝায়, ঠিক সে জিনিস ওই কবিতাগুলোয় নেই । ওগুলো ছিল অ্যাকশান পোয়েট্রি । এখন আমি একটা কবিতা এক সিটিঙে লিখি না । কাঠামোটা যদি দাঁড়িয়েও যায়, ঘষামাজা চলতেই থাকে । বাংলা ভাষার ইনট্রিনজিক গীতিময়তার জন্য এক ধরনের কবিত্বের গলাকাঁপানো বুর্জোয়া ভাষাশরীর এসে পড়ত বাংলা কবিতায় । আমি ওই কলঙ্কটাকে ঘষেমেজে বের করে দেবার চেষ্টা করতুম । কবিতা তো জীবনের বাইরের কোনো নাটুকে ব্যাপার নয় । তাই আমি তাকে স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করি, ভাষা নিয়ে মেলোড্রামা করি না ।

রাহুল : হাংরি আন্দোলন নিয়ে কিছু বলুন । আপনার কবিতা লেখার সঙ্গে এই আন্দোলনের প্রভাব কতটা জড়িয়ে আছে ?

মলয় : ওসব এখন সবাই জেনে গেছে । আসলে হাংরি শব্দটা আমি খুঁজে পেয়েছিলুম ইংরেজ কবি জিওফ্রে চসারের একটি পংক্তি, ‘ইন দ্য সাওয়ার হাংরি টাইম’ থেকে । মনে হয় যে আমাদের জন্যই লেখা । এই হাংরি শব্দটা আমি প্রয়োগ করি ঐতিহাসিক অসওয়াল্ড স্পেংলারের সাংস্কৃতিক অবক্ষয়কালীন সর্বগ্রাস তত্ত্বে । প্রথম বুলেটিনটায়, যা আমি পাটনায় ছাপিয়েছিলুম, তুলে দিয়েছিলুম ওই কথাবার্তা । আমার মতে, ১৯৬১ সালে আরম্ভ হয়ে ওই আন্দোলন ১৯৬৫ সালে শেষ হয়ে যায় । কেননা ওই বছরেই অন্যেরা মুচলেকা দিয়ে সরে যান । এপ্রিলে, ১৯৬৪ এর বুলেটিনে প্রকাশিত হয় আমার ‘প্রচণ্ড বৈদ্যুতিক ছুতার’ কবিতাটি । ১৯৬৪ এর জুলাই মাসে যে মামলা শুরু হয়, ১৯৬৫ এর ডিসেম্বরে তার রায় বেরোয় । কবিতা লেখার জন্য হাতে হাতকড়া পরিয়ে, কোমরে দড়ি বেঁধে আমাকে গ্রেপ্তার করা হয় । তার পরে লেখাই বন্ধ করে দিয়েছিলুম, রাইটার্স ব্লকে ভুগতুম । ১৯৮২তে মা মারা গেলেন । সেই ঘটনার পরই আবার লিখতে আরম্ভ করি । এখন আমি হাংরির সময় থেকে অনেক সরে এসেছি । লেকক তো নিজের লেখা সম্পর্কে ভাবনাচিন্তা করবে । ওটা তো সবে মিলি করি কাজ গোছের ব্যাপার নয় ।

রাহুল : বাংলা কবিতার ইতিহাসে সবচে বড়ো অবদান কী বলে আপনার মনে হয় ?

মলয় : ওই আন্দোলন না হলে কবিতায় ভদ্দরলোকের ভাষার বাইরে নিচুতলার ভাষা ও বোধের কথা জানাই যেত না । মার্কসবাদী, প্রগতিবাদী, নকশাল, সাম্যবাদীরাও যে অ্যাদ্দিন ধরে অভিজাত শ্রেণির শব্দভাঁড়ার ব্যবহার করে কবিতা লিখেছেন তা ফাঁস হতো না । কবিতার শ্রেণিচ্যুতি ঘটিয়েই যে কবির ডিক্লাস করা দরকার তা জানাই যেত না । ছোটোলোকদেও একটা মেজরিটির জগৎ আছে, এবং তা বাংলা কবিতায় আসার প্রয়োজন ছিল । এটাই হাংরি আন্দোলন করেছে । আগে কবিরা পাঠককে আনন্দ দিতে চাইতেন । আমরা প্রশ্ন তুললুম, ‘কেনই বা আমরা পাঠককে আনন্দ দেব ? আঘাতই বা দেব না কেন ?’ আমার ‘মেধার বাতানুকূল ঘুঙুর’ কাব্যগ্রন্হে এসেছে চোর, গুণ্ডা, ঠগ, বেশ্যা, দালালদের কথা । বদলা, খুনখারাবি, অত্যাচার, ভোগদখল ইত্যাদি । এসব যদি জীবনে থাকে, কবিতায় তাহলে আসবে না কেন ? তাছাড়া কবিতার যে ডিসকোর্স দরকার, তা আমাদের পরে প্রতিটি দশক নিজেদের কবিতার ডিসকোর্স গড়ার মাধ্যমে আমাদের অবদানকে স্বীকৃতি দিয়েছে ।

রাহুল : কিন্তু ষাটের দশকের আগে সেটা কি কখনই হয়নি ?

মলয় : না, সেভাবে হয়নি । যে কারণে বহুকাল পর্যন্ত নজরুল ও জসিমুদ্দিনকে সে সময়ে স্বীকৃতি দেয়া হয়নি । তিনের দশকে ঔপনিবেশিক সাহিত্য, ভাষার মধ্যে ঔপনিবেশিক গন্ধ ছিল । কবিরা ছিলেন অধ্যাপক, যাঁদের বাংলা ব্যাকরণ ছাড়া পশ্চিমের ভাষারও জ্ঞান ছিল । চারের দশকে রাজনীতি প্রভাবিত কবিতার মূল উদ্দেশ্য ছিল কবিতাকে কম্যুনিকেটিভ করে তোলা । কবিরা ছিলেন রাজনীতিক আর কার্ড হোলডার । যদিও তাঁদের আলটিমেট ক্লায়েন্ট ছিল প্রলেতারিয়েত, কিন্তু তাঁদের কবিতাগুলো প্রলেতারিয়েতের ভাষায় ছিল না । পাঁচের দশকে এলেন মূলত সাংবাদিকের দল, তাঁরা অনেকেই সাংবাদিকতার ভাষাকে কবিতায় নিয়ে এলেন । এর বাইরে আমরা যারা নিম্ন মধ্যবিত্ত বা আউটসাইডার পরিবার থেকে সবে আসা শুরু করেছিলুম, তারা একটু অন্যরকমের হতে চেয়েছিলুম । চালু বঙ্গসংস্কৃতি আর পশ্চিমাসংস্কৃতি থেকে তা আলাদা ছিল । ষাটের দশকে গোটা পৃথিবী জুড়েই নানা ডামাডোল চলছিল । সেই সময়ে আমাদের কনশাসনেসের জগৎটাই ইরোড হয়ে গিয়েছিল । আমাদের আন্দোলন তার বাইরে নয় । আমরা ভাবিনি যে আমরা প্রতিবাদ করছি, কিংবা সমাজব্যবস্হাকে উন্নত করতে চাইছি । কিন্তু সেসব ফুটে বেরিয়েছে আমাদের লেখালিখি থেকেই । শেষমেশ কবিতায় অশ্লীলতার দায়ে ব্যাংকশাল কোর্টে আমার সাজা হল । যদিও হাইকোর্ট তা খারিজ করেছিল ।

রাহুল : সেই সময়ে অ্যালেন গিন্সবার্গের সঙ্গে সাক্ষাৎ ও বন্ধুত্ব ?

মলয় : গিন্সবার্গ প্রথমে চাইবাসাতে ১৯৬২ সালে গিয়েছিলেন আমার দাদা সমীর রায়চৌধুরীর কাছে । সঙ্গে ছিলেন পিটার অরলভস্কি । পরে পাটনায় নিজেই এসেছিলেন আমার কাছে ৮ এপ্রিল ১৯৬৩ । তারপর গয়া, নালান্দা, রাজগির গিয়ে আবার পাটনা ফিরে ৩০ এপ্রিল বেনারস চলে যান । উনি ফিরে যাবার পর লরেন্স ফেরলিংঘেট্টি আমাকে কিছু বই পাঠান । ‘হাউল’ এবং পরে ‘ক্যাডিশ’ পাঠিবেছিলেন । এই দুটো বই পরে আমি অনুবাদ করেছি । ১৯৬২ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে ১৯৬৩র মে মাস পর্যন্ত ভারতের নানা শহরে ও হিন্দু-বৌদ্ধ তীর্থস্হানে বাস করেছেন অ্যালেন, কিন্তু ভারতীয় পরিবারে সম্ভবত উনি আমার বাবা-মার সঙ্গেই কাটিয়েছিলেন কিছু দিন ।

রাহুল : কবিতা লেখার সময়ে তা শিল্প হয়ে উঠল কিনা, তা নিয়ে আপনি কতটা মাথা ঘামান ?

মলয় : এক সময় লিখেছিলুম, ‘শিল্পের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা কবিতা সৃষ্টির প্রথম শর্ত।’ আজ আমি শিল্প শব্দটাকে সন্দেহ করি, কবিতাকে শিল্প করতে গিয়ে কবিতা আজ সুবিধাভোগী মধ্যবিত্তের এক অদ্ভূত নকল ভাষায় আসক্ত । সমগ্র বঙ্গভাষী সমাজ আজ কবিতা থেকে বিচ্ছিন্ন, কবিতা সম্পর্কে বিরক্ত ।

রাহুল : কবিতা ছাপানোটাও তো একটা সমস্যা ?

মলয় : হ্যাঁ, একজন কবি বা ক্রিয়েটিভ লেখক কোথায় লেখা ছাপাবে সেটাই সমস্যা । সে তার কবিতার বইয়ের প্রকাশক পাবে না, কোনও পত্রিকায় ছাপাতে হলে তাকে অত্যন্ত অপমানজনক পরিস্হিতির মধ্যে দিয়ে যেতে হবে । তার বাবা-মা বউ-ছেলে-মেয়ের চাহিদাকে দমিয়ে নিজের বই ছাপাতে হবে, তারপরেও সে দেখবে পাঠকের কাছে পৌঁছোবার রাস্তা বন্ধ । মুখ বুজে জুতোলাথি মুখঝামটা সহ্য না করলে, কিছু হীন কাজকারবার না করলে, তার বইয়ের রিভিউ হবে না । তবে কবিরা আর এসবের পরোয়া করেননা, কেননা এখন ইনটারনেট তাকে লেখার অফুরন্ত  সুযোগ করে দিয়েছে ।

রাহুল : এখন যে কবিতা লেখা হচ্ছে, সেসম্পর্কে আপনার মত কী ?

মলয় : দ্যাখো, একজন যুবক যখন নানা রকম পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালাচ্ছেন তখন স্বাভাবিকভাবেই তিনি আশা করবেন প্রতিষ্ঠিত সমালোচক আর অগ্রজ কবি-লেখকরা তাকে গঠনমূলক উৎসাহ দেবেন । অথচ হয় আদপে এর উল্টো । অগ্রজ কবিরা চান পরের প্রজন্ম তাঁদের অনুকরণ করে বাঁচিয়ে রাখুক । এই গোলকধাঁধায় সবাই যা করছেন, একজন নবাগত তরুণও তাই করাটাই কম বিপজ্জনক মনে করছেন । নিজের জীবনের সত্যের বদলে একটা নকল কাণ্ড-কারখানায় ভরে উঠছে বেশির ভাগ কবিতা । একজন কবির থেকে আরেকজন তফাৎ প্রায় নেই । একই রকম শব্দ, ইমেজ, ছন্দ, মানসিকতা । গুচ্ছের লেখা ছাপানোটা হয়ে দাঁড়িয়েছে টিকে থাকার প্ল্যাটফর্ম । সমাজকাঠামোটাই যখন ফ্রডুলেন্ট, তখন কবিতা-চর্চায় বেশিরভাগ ফ্রডুলেন্ট কাজ-কারবার হবেই ।

রাহুল : কবিতা লেখার জন্য বারবার সমালোচিত হয়েছেন, এটাকে কীভাবে দেখেন ?

মলয় : আসলে সব লেখকদেরই সমালোচনা দরকার, আর বাংলা ভাষার সমস্যা হল, সমালোচকই নেই । আমাদের লেখাগুলোর কেউ সমালোচনাই করে না । লোকে বলুক, এই কাজগুলো ভালো হয়নি, কেন হয়নি, তার কারণগুলো এই, কিন্তু সেসব কেউ বলে না, একটা সাধারণ মতামত দিয়ে দেয় । কিন্তু আরও একটা দেখার মতো ব্যাপার আছে ।

রাহুল : সেটা কী ?

মলয় : বাজার থাকলে তার চাহিদা আর যোগানের প্রক্রিয়া থাকবে । কিন্তু সাইনবোর্ড বা হোর্ডিং আঁকিয়েদের যেমন রেমব্রাঁ পিকাসোর পংক্তিতে বসানো যায় না, সেরকম পটবয়লাররাও সাহিত্যিক নন । বাংলা সাহিত্যে এই পটবয়লারদেরই সাহিত্যিক করে তোলার চেষ্টা হয় । এগুলো হল বাজার এক্সপ্লয়েট করার কায়দা । ভাবতে অবাক লাগে, একটা মনের মতন কবিতা লেখার জন্য কাউকে-কাউকে তিন-চার হাজার কবিতা লিখতে হচ্ছে । ওই একটা দুটো কবিতাই বছরের পর বছর আবৃত্তি করে বেড়াতে হচ্ছে । লিখে যারা ব্যাবসা করছে তাদের নিয়ে দুশ্চিন্তার কারণ নেই, কারণ তাদের বাজার নষ্ট হবে একদিন এবং হারিয়ে যাবে । কিন্তু দুশ্চিন্তার কারণ ওই সব সমালোচক, যারা বাজারে স্যানিটারি ন্যাপকিনকে বেনারসি বলে চালাতে চাইছে । ওই বাবুরা যদি হাতের কাছে পেত, তাহলে হয়ত জয়েস, প্রুস্ত, পাউণ্ড, র‌্যাঁবো, হুইটম্যানদের পর্যন্ত চামড়া তুলে ফেলত । পাঠককে এরা এত করাপ্ট করে দিয়েছে যে যে, তারা সৃজনশীল লেখার প্রতি আস্হা হারিয়ে ফেলেছে । সোনাগাছিতে তো আর বলশয় ব্যালের ব্যবস্হা হয় না ।

রাহুল : কবি হিসাবে কতটা বদলে-যাওয়া মানুষ বলে নিজেকে মনে হয় ?

মলয় : অনেকটাই । যখন কবিতা লেখা শুরু করি, তখন শব্দেরা ছিল ফর-গ্র্যান্টেড, যৌনতা ছিল ফ্লেশ অ্যাণ্ড ব্লাড, নিজেরই প্রথম বইয়ের সম্ত কপি জড়ো করে আগুন ধরিয়ে দিয়েছি, তখন নিজেকে ভাবতুম দায়বদ্ধ, ভাবতুম জেল হয় হবে, দেখা যাবে, সবার ওপর মানুষ সত্য টাইপের ভাঁওতায় মজে যেতুম, ভাবতুম জীবনদর্শন বলে কিছু হতে পারে, এই সব আর কী ।  আর এখন তো অনেক কিছুর সঙ্গেই আপস করে ফেলেছি । হৃদরোগে রাস্তায় ছিটকে পড়ার পর হার্ড ড্রাগসের নেশা, মানে কোকেন, এল এস ডি, আফিম, মারিহুয়ানা, চরস ইত্যাদি ছেড়ে দিয়েছি । সিগারেট খাই না, মদ কেবল সিঙ্গল মল্ট খাই । এখন আর রাস্তাঘাটে যেখানে-সেখানে শুয়ে কাটিয়ে দিতে পারি না । এই ধরনের নেতি থেকেই গড়ে উঠতে থাকে শ্রেণিকাতর মধ্যবিত্তের সফিসটিকেশান । এই সব রফা আমার লেখালিখিকেও প্রভাবিত করে নিশ্চই । আরামপ্রদ জীবনে নিজেকে এখন দ্রোহী বলাটা জোচ্চুরি হবে । আমি তেমন হতে চাই না ।  আমার কবিতা যদি কিছু হয়, তো সেটাই যথেষ্ট । সব মিলিয়ে, আগে কবিতার চেয়ে জীবনযাপন ছিল গুরুত্বপূর্ণ । এখন আমার কাছে কবিতা অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ মনে হয় । জীবনকে সবসময় প্রশ্নমুখী করে রাখা জরুরি । আমি চাই আমার লেখার মূল্যায়ন হোক । আমার মূল্যায়ন তো চাই না ।

রাহুল : মডার্ন কবিতা থেকে পোস্টমডার্ন কবিতা কোথায় আলাদা বলে আপনার মনে হয় ?

মলয় : প্রথমটি কবির ব্যক্তিপ্রতিস্বে ভরাট থাকে, নিজের কবিতায় কবি সদা-সর্বদা উপস্হিত থাকেন । এই কবিতা যুক্তি সাজিয়ে, এক লাইনের সঙ্গে পরের লাইনের সম্পর্ক রেখে এগোয় । এতে সুস্পষ্ট চিত্রকল্প থাকে ।

রাহুল : যৌনতা আপনার কবিতায় খুব গুরুত্বপূর্ণ । এটা কেন ?

মলয় : যৌনতা আমার কাছে সীমালঙ্ঘনের, বন্ধন কেটে বেরোবার হাতিয়ার । আমি ক্যাসানোভা ছিলুম না, কিন্তু প্রেম সম্পর্কের বাইরে সমান্তরাল ভাবে যৌন সম্পর্ক গড়ে তুলতে আমার ভালোই লেগেছে । বঃসন্ধিতে যৌনতা ছিল শরীর ও মগজের ব্যাপার । যত বয়স বেড়েছে, ততই তা ক্রমশ মগজের ব্যাপার হয়ে উঠেছে । এ প্রসঙ্গে উইলিয়াম ব্লেকের ‘ম্যারেজ অফ হেভেন অ্যাণ্ড হেল’ নামে ফর্মহীন দীর্ঘ কবিতাটির কথা মনে পড়ছে । আমার খুব প্রিয়, আর কোনও সামাজিক বা ধর্মীয় বিধিনিষেধ না মেনেই লেখা । যৌনতা দিয়ে আমি কবিতায় লঙ্ঘন করতেই চেয়েছি ।

রাহুল : আপনি অনুবাদক হিসাবে সাহিত্য অ্যাকাডেমি পুরস্কার প্রত্যাখ্যান করেছিলেন কেন ?

মলয় : যে কোনও পুরস্কারই পুরস্কারদাতার মূল্যবোধটি প্রাপকের ঘাড়ে চাপিয়ে দেয়, ওই পুরস্কারটির মাধ্যমে । আমি তাই কোনও পুরস্কার নিই না ।

রাহুল : ভবিষ্যৎ সম্পর্কে আপনি কতটা আশাবাদী ?

মলয় : আমাদের অ্যাকাডেমিয়া বিদেশি সাহিত্য নিয়ে যতটা আগ্রহী, ততটা লিটল ম্যাগাজিনের নন-কনফর্মিস্ট বাংলা লেখালিখির প্রতি নয় । তবে বর্তমান প্রজন্মের তরুণরা, যাঁরা অ্যাকাডেমিক জগতে প্রবেশ করেছেন, তাঁরা বাংলা ক্রিয়েটিভ লেখালিখির দিকে নজর দিচ্ছেন । তরুণ অধ্যাপকদের সঙ্গে কথা বলে আমার সেরকমটাই মনে হয়েছে । ‘প্যারাসাইটদের সার্কাস’ থেকে নিজেকে সরিয়ে রাখা প্রয়োজন । একটা লেখায় কী কাজ করা হয়েছে, সেটাই দেখার । জেমস জয়েস বা মার্সেল প্রুস্তের লেখা অনেকেরই ভালো লাগবে না । কিন্তু তাঁরা লিখেছেন বলেই তাঁদের মাতৃভাষা আজ এত উন্নত ।

( ‘এই সময়’ পত্রিকার ‘রবিবারোয়ারি’ ২৪ নভেম্বর ২০১৩ তে প্রকাশিত হয়েছিল )

উত্তরণ দাশগুপ্ত : পাটনায় মলয়, সমীর এবং গিন্সবার্গ

 

         ‘কিল ইয়োর ডারলিংস’ ফিল্মে হ্যারি পটার খ্যাত ড্যান র‌্যাডক্লিফ অ্যালেন গিন্সবার্গের অভিনয় করেছিলেন এবং ‘অন দি রোড’ ফিল্মে স্যাল প্যারাডাইস অভিনয় করেছিলেন জ্যাক কেরুয়াকের ভূমিকায়– যার দরুন বিট আন্দোলনকারীদের সম্পর্কে আগ্রহ বেড়েছে সাম্প্রতিককালে — নিঃসন্দেহে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর সবচেয়ে প্রভাবশালী সাহিত্যিকবৃন্দ । কিন্তু দুটি ফিল্মই তাঁদের ভারতে বসবাসের অভিজ্ঞতা অনুসন্ধান করেনি ।

গ্যারি স্নাইডার এবং তাঁর স্ত্রী জোয়ানে কাইজারের দেখাদেখি, মার্কিন বিট কবি অ্যালেন গিন্সবার্গ তাঁর প্রেমিক পিটার অরলভস্কির সঙ্গে মুম্বাইতে এসে পৌঁছোন ১৯৬২ সালের ১৫ই ফেব্রুয়ারি । উত্তর ভারতের বিভিন্ন এলাকায় ঘুরে বেড়াবার সময়ে তাঁরা কিছুকাল পাটনাতেও ছিলেন, দুই কবির বাড়িতে — তাঁরা হলেন মলয় রায়চৌধুরী ও সমীর রায়চৌধুরী ।

মলয়, বর্তমান সময়ের একজন আইকনিক কবি,  ২০০৩ সালে তাঁকে সাহিত্য অকাদেমি পুরস্কার দেয়া হয়েছিল । ১৯৬১ সালের নভেম্বর মাসে পাটনা থেকে তিনি সমীর এবং আরও দুজন কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায় ও দেবী রায়কে নিয়ে হাংরি জেনারেশন সাহিত্য ও শিল্পের আন্দোলন আরম্ভ করেন । আন্দোলনটি ক্রমে ভারতের অন্যান্য অঞ্চলের আরও শিল্পী, লেখক ও বুদ্ধিজীবিদের দলে টেনে নিয়েছিল ।

মলয় এখন মুম্বাইতে থাকেন এবং সমীর কলকাতায় গিয়ে ‘হাওয়া৪৯’ নামে একটি পত্রিকা সম্পাদনা করেন ।

পাটনার স্মৃতিচারণ করার সময়ে সমীর ( ৭৯ ) বলেছিলেন যে, “আমার একজন বন্ধু ছিল ঘোড়ার গাড়ির চালক । তার সঙ্গে বসে ঠররা ( বাংলা চোলাই ) খেতুম । একবার ঠররা খাবার আড্ডায় ও আমাকে বলেছিল ওর বড়োলোক হওয়ার গল্প ।”

দ্বারভাঙ্গার মাহারাজার প্রাসাদের আসবাব নিলাম হচ্ছিল । আমার বন্ধু সেই নিলাম থেকে সস্তায় একটা ঘোড়ার গাড়ি কিনেছিল । গাড়িটা মেরামত করার সময়ে ও দেখল যে বসবার কুশনের ভেতরে দামি-দামি জহরত লুকোনো রয়েছে । ও জহরতগুলো বিক্রি করে রটিয়ে দিয়েছিল যে লটারি জিতেছে, আর তাইতে অনেক টাকা পেয়েছে ।

সমীরের সঙ্গে  গিন্সবার্গের প্রথম দেখা হয় ঝাড়খণ্ডের চাইবাসায়, তখন সেটা ছোট্টো গ্রাম ছিল । “আমার ঘরে অসওয়াল্ড স্পেংলারের লেখা ‘দি ডিক্লাইন অফ দি ওয়েস্ট’ বইটা দেখে ও জানতে চাইলো, সমীর, তুমি এই বইটা পড়েছ ? হামি উত্তরে বললুম, হ্যাঁ, নিশ্চয়ই । বইটার মার্জিনে দ্যাখো । আমার আর মলয়ের নোটস দেখতে পাবে।”

স্পেংলারের দর্শনে প্রেরণা পেয়ে মলয় তাঁর আন্দোলনের পরিকল্পনাভূমি তৈরি করেছিলেন । ‘হাংরি’ শব্দ পেয়েছিলেন জিওফ্রে চসারের In the sowre hungry tyme পঙক্তি থেকে ।

বিহারের বিভিন্ন বৌদ্ধধর্মের তীর্থস্হানগুলো ঘোরার সময়ে এপ্রিল ১৯৬৩ সালে গিন্সবার্গ পাটনায় রায়চৌধুরীদের দরিয়াপুরের বাড়িতে কিছুদিন ছিলেন ।

সমীর বললেন, “একদিন আমার মে দেখলেন উঠোনে স্নানের জায়গায়  উলঙ্গ হয়ে স্নান করছেন গিন্সবার্গ ।”

“মা আমাব জিগ্যেস করলেন, ‘ও অমন করে চান করছে কেন ?’ আমি বললুম ওইভাবেই ওরা নিজেদের দেশে চান করে । মায়ের ভালো লাগেনি শুনে । উনি ওপর থেকে দুটো তোয়ালে ফেলে দিলেন গিন্সবার্গের ওপর, আর বাংলায় বললেন, ‘খোকা, নিজেকে ঢেকে নাও আর এই তোয়ালে দিয়ে গা পোঁছো।’”

হাংরি আন্দোলনের কবি এবং লেখকরা দেখছিলেন প্রতিষ্ঠিত সংস্কৃতির সীমানাগুলোকে লঙ্ঘন করার তাঁদের যে প্রয়াস তা সমসাময়িক সমাজ কতটা সহ্য করতে পারে ।

১৯৬৩ সালে আন্দোন যখন শীর্ষবিন্দুতে পৌঁছেচে সেসময়ে তাঁরা জীবজন্তু, দানব, জোকার আর কার্টুন চরিত্রের মুখোশ পাঠিয়েছিলেন খ্যাতনামা ও প্রভাবশালী লোকেদের । মুখোশের ওপরে ছাপানো বার্তা ছিল, ‘দয়া করে মুখোশ খুলে ফেলুন” — হাংরি জেনারেশনের পক্ষ থেকে ।”

১৯৬৪ সালের ২রা সেপ্টেম্বর যেন নরক গুলজার হলো ! মলয়, সমীর, দেবী রায় এবং তাঁদের দুই সহযোগী সুভাষ ঘোষ ও শৈলেশ্বর ঘোষকে সাহিত্যে অশ্লীলতা ও রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রর অভিযোগে গ্রেপ্তার করা হল । মলয়ের ‘প্রচণ্ড বৈদ্যুতিক ছুতার’ কবিতাটির জন্য নিম্ন আদালতে সাজা হয়েছিল । পরে ১৯৬৭ সালের ২৬ জুলাই কলকাতা হাইকোর্ট তাঁর সাজা নাকচ করেন ।

মলয় কিন্তু এখনও প্রতিষ্ঠানের বিরোধিতা করেন । তাঁকে জিজ্ঞাসা করতে যে, কেন তিনি সাহিত্য অকাদেমি অ্যাওয়ার্ড প্রত্যাখ্যান করলেন, উত্তরে মলয় বলেছিলেন, “আমি কোনো সাহিত্য পুরস্কার নিই না, কেননা যে সংস্হা পুরস্কার দেয় সে তার মূল্যবোধ চাপিয়ে দেয় পুরস্কারের সঙ্গে।”

হাংরি আন্দোলনের ওপর গিন্সবার্গের প্রভাব এবং গিন্সবার্গের ওপর হাংরি আন্দোলনের প্রভাব নিয়ে অনেক তর্কবিতর্ক হয়েছে । মলয় এবং সমীর দাবি করেছেন যে হাংরি আন্দোলনকারীরাই গিন্সবার্গকে তিনটি মাছের একটি মাথার প্রতীকের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিল, যা পরবর্তীকালে গিন্সবার্গের ব্যক্তিগত মোটিফ হিসাবে এবং ‘ইনডিয়ান জার্নালসসহ ( ১৯৭০ ) তাঁর অন্যান্য বইতে ব্যবহৃত হয়েছে । মলয় বলেছিলেন যে গিন্সবার্গ ওই প্রতীক পেয়েছিলেন আকবরের সিকান্দ্রার সমাধি থেকে এবং পাটনার খুদাবক্স ওরিয়েন্টাল লাইব্রেরিতে সংরক্ষিত ফারসি বই ‘দীন-ই-ইলাহি’র চামড়ায় বাঁধানো প্রচ্ছদ থেকে ।

নিজের ‘ইনডিয়ান জার্নালস’ বইতে গিন্সবার্গ এই বিষয়ে উল্লেখ করেননি । কিন্তু ভারতে তাঁর আগমন বহু ইউরোপীয় ও আমেরিকানের মনে আগ্রহের সঞ্চার করেছিল, তাদের মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হল বিটলস গায়কদের দল ।

.

 

জাপানের পথে – মলয় রায়চৌধুরীর গল্প ‘দাচু ওয়াইফু’ : পারমিতা চক্রবর্তী

44926410_1130173280483002_2725919930640760832_o

মলয় রায়চৌধুরীর লেখা নিয়ে কথা বলা খুব কঠিন । তবুও ওনার লেখার প্রতি যে দায়বদ্ধতা তা ভীষণ ভাবে উল্লেখযোগ্য । “দাচু ওয়াইফু” তেমনই একটি গল্প ৷ নামকরণটিতে  গল্পটি শুরুতে একটা ধাক্কা লাগবে পাঠকের মনে ৷ গল্পের শুরুতে একটা টানটান শিহরণ ৷ কিছু কিছু মানুষের কাছে একাকিত্ব একটা বিলাসিতা আবার কারোর কাছে ক্রাইসিস ৷ একটি মানুষ যখন একাকিত্বের জীবন উপভোগ করে তখন তার কাছে গোটা অস্তিত্বটা একটা রোমান্সের মত I সেই গন্ডীর মধ্যে ঢুকে পড়ে আস্ত নেশার বোতল ৷ গল্পের শুরুতে একটা আগুন ধরানো  পরিবেশ ৷ ১৮ ডিগ্রি সুইঙ মোডে এসি, চালিয়ে কম্বল চাপা দিয়ে ঘুমোচ্ছে গোটা শহর ৷ ডলার খরচে বেঁঁচে থাকার আনন্দ ৷

এমনই একরাতে আগুনের টুকরো ছড়িয়ে পড়ে গোটা ঘরে ৷ নেশার আমেজে ঘুমিয়ে থাকা মানুষটি টের পায় যখন তার চামড়ায় যন্ত্রণা লাগে  । বাকি পর্দা জ্বলছে ৷ সোফা I আগুন দখল করেছে ড্রইংরুম ৷” আমার স্লিপিং স্যুটে আগুন ধরে গেছে ,চামড়ায় বসে যাচ্ছে যন্ত্রণা “এখানেই মনে হয়েছে গল্প’র ক্লাইমেক্সে কোথায় যেন একটু ছেদ পড়েছে ৷মনে হচ্ছে  পরিবেশটা যেন আন্ডার কন্ট্রোল ৷শাওয়ারের জল ধুয়ে দেয় উলঙ্গ শরীর I আগুন স্পর্শ করে অস্তিত্বকে ৷

এভাবেই বয়ে যাওয়া ঘটনাকে এগিয়ে নিয়ে চলল শব্দবন্ধ ৷ আগুন নষ্ট করে দেয় তার মুখ, দেহের ওপরের অংশ, পিঠ আর পা । পোড়া জায়গাগুলো ছিল  গভীর । কান, নাক, কনুই থেকে হাড় বেরিয়ে যায় । বেশ কিছু সার্জারি হলেও বায়োমেট্রিকসে বদল হয়নি । চোখ ঠিক ছিল । আঙুলের ছাপও পোড়েনি ।

ফলসরূপ সার্জারিতে ঘটে যায় আমূল পরিবর্তন তার মুখের । এই ঘটনা নাড়া দেয় গল্পের এসেন্সকে । গল্পটিতে জাপানের বর্ণনা আছে ৷ জাপানের অলিগলি জুড়ে হেঁটে বেড়ায় গল্পরা ৷ গল্প মানে নারী ৷ প্রকৃতি’র আদি রহস্য লুকিয়ে আছে যার কোল জুড়ে ৷ গল্প’র মূল চরিত্র যিনি, তিনি একজন অবিবাহিত  পুরুষ । একাকিত্বের অবসরে তিনি নেহাতই একজন পথপ্রদর্শক ছিলেন ৷ এমন এক সময় তিনি তার জীবনে দ্বিতীয় শক্তির অভাব উপলব্ধি করেন । কেউ একজন যে তাঁর নিস্তব্ধ জীবনের সঙ্গী হবে ৷তাঁকে শুশ্রূষা দেবে ৷ যৌনইচ্ছা’র তাগিদ অনুভব করেন ।

জাপান দ্বীপপুঞ্জে মানুষ প্রথম বসতি স্থাপন করে প্রাগৈতিহাসিক কালে। খ্রিষ্টপূর্ব প্রথম সহস্রাব্দে জাপানের আদি জোমোন সংস্কৃতি (যার নামকরণ হয়েছে স্বতন্ত্র “দড়ির দাগ দেওয়া” মাটির বাসন থেকে) ক্রমশ য়ায়োই সংস্কৃতির দ্বারা প্রতিস্থাপিত হয়ে যায়। য়ায়োই যুগে মূল এশীয় ভূখণ্ড থেকে জাপানে নতুন প্রযুক্তির আগমন ঘটেছিল। খ্রিষ্টীয় প্রথম শতাব্দীতে চীনের “হান গ্রন্থে ” জাপানের প্রথম লিখিত উল্লেখ পাওয়া যায়। স্বপ্নের নগরী বলা যায় জাপানকে ৷এদেশে রাতের রোশনাইয়ে আলোর সাথে হাত ধরে নারী ৷ জাপান শহরে বোবা কালা নারীর সংখ্যা বেশী । তারা বিক্রি হন ডলারের হিসাবখাতে ৷ তেমনই এক নারী হিনাত ৷ যে সুন্দরীর রাজ্যের রাণী ও নৈঃশব্দের অধিপতি সে ৷ । হিনাতকে দেখেই ভালোবেসে ফেললেন নায়ক ৷ কোলে তুলে নিয়ে  গেলেন বিছানায় ৷

“প্রেম করছি যখন, হিনাত বলে উঠল, আঃ, লাগে ।

আমি উঠে বসলুম । বললুম, কী বলছ তুমি ? কথা বলছ ?”

এখানে যেন মূল চরিত্রের আরও কিছু সংলাপ কিংবা অনুভব জরুরী ছিল মনে হয়েছে ৷ কোথাও যেন তঞ্চকতার সাথে শব্দের ব্যাখ্যা চাইছিল ৷কিন্তু তা পূরণ হয় ভালোবাসা দ্বারা I

“ভালোবাসা পেলে প্রাণ জেগে ওঠে, বলল হিনাত, চোখের পাতা কাঁপিয়ে, ভালোবাসার ক্ষমতা তুমি জানো না ।

আমি হিনাতের দিকে তাকিয়ে বসে রইলুম ।

ও মিটিমিটি হাসছে, যেমন দেখেছিলুম জাপানে ।

এসি চালিয়ে হিনাতকে জড়িয়ে শুয়ে পড়লুম । সত্যিই, ভালোবাসার ক্ষমতা অপরিসীম, সিলিকনে তৈরি নকল যৌনপুতুল বা সেক্স ডলের মধ্যেও প্রাণ সঞ্চার করতে পারে ।

সুন্দরীতমা সে, কেমন করেই বা নিখুঁত হবে । খুঁত কেবল এই যে ওর হৃদয় ছিল না ।”

এই স্তবকে পাঠকের মনে কেমন যেন ধোঁয়াশা লাগে । অর্থাৎ হৃদয়ের ঠিকানা তো নিশ্চিন্দিপুর ৷ সেখানে নেই কোন পরিসর I

“দার্শনিকরা তো বলে গেছেন যে চোখ হলো আত্মায় প্রবেশের পথ । ওর চোখে রয়েছে সৌন্দর্যের ক্ষমতা, হাসিতে রয়েছে পুরুষকে জয় করে নেবার ক্ষমতা ।

হিনাতের হাত দুটো তুলে আমাকে জড়িয়ে ধরতে সাহায্য করলুম, ও তাকিয়ে রইলো আমার দিকে ৷আজ থেকে সিলিকনের যৌনপুতুল হিনাত আমার দাচু ওয়াইফু, জাপানি ভাষায় যেমন বলে, ওলন্দাজ স্ত্রী বা রহস্যময়ী পত্নী।”

গল্পের পরিণতি এখানেই শেষ ৷ আরও একটু বেশী পাওনা ছিল যেন আমাদের কাছে ৷ তবুও লেখক কখনও জাপান যাননি,  কিন্তু মনে হয়েছে যেন জাপানের অলিগলি তাঁর ঘোরা ৷ এখানেই একজন লেখকের সার্থকতা ৷গল্পটির পরতে পরতে লুকিয়ে আছে রহস্য যা কিনা আরও একটু বিস্তৃতি লাভ করতেই পারত ; তবুও এইটুকুই বা কম কি ৷ মলয় রায়চৌধুরীর লেখা নিয়ে কিছু বলা বড় ঔদ্ধত্য,  তবুও যেন আরও একটু চেয়েছিলাম ।

 

 

 

অরবিন্দ প্রধান : মলয় রায়চৌধুরী ও শব্দমাহাত্ম্য

 

প্রথমত Celebration of Words বলতে ঠিক কী বোঝায় ? শব্দের উৎসব ? না, শব্দমাহাত্ম্য ? উৎসব হলে, উৎসবের পর্যায় থেকে ক্রমবিকাশ বা মানের পরম্পরা-জ্ঞান নিয়ে মাতামাতি নিশ্চয়ই ব্যাধির থেকে আধির বড় হওয়াকে সূচিত করে বসবে । অবশ্য বর্তমান রাষ্ট্র-যন্ত্র, তার মাথাভারি প্রশাসনে যাবতীয় ব্যবস্হাদি, সামাজিক রীতি-নীতি, বেওসা-বাণিজ্য থেকে মালি-মকদ্দমা সবই এই ধারায় চলছে । Common factor — ব্যাধির থেকে আধি বড় । তাই মালের কদরের চেয়ে বিজ্ঞাপনের কদর । সে হিসেবে ‘শব্দের উৎসব’ বাঁধুনীটি বেশ লাগসই মনে হওয়াই স্বাভাবিক । পাতি বাংলায় খাপ খেয়ে যায় বলেই তা — খাপসুরত । খুবসুরতের অধঃপতিত রূপ ( !) । মানে, খাপে-খাপে লেগে যাওয়া গোছের । তার চেয়ে ‘শব্দমাহাত্ম্য’ কথাটি তুলনায় ব্রাত্যগন্ধী । তবুও পাণিনি-ভাষ্য অনুযায়ী শব্দের বিধৃত নামরূপ বা ধাতুরূপকে, অর্থাৎ উৎসকে, স্বতঃপ্রণদিত উসকে দেওয়ার চেষ্টাটি অমূলক নয় বলেই প্রতিপন্ন হওয়া উচিত । তাছাড়া, আমাদের ঐতিহ্যবাহী লেখনীগুলিতে তেত্রিশ কোটি দেবদেবীর মাহাত্ম্য বর্ণনা তো আসলে সেই সব দেবতার নাম-মাহাত্ম্য বর্ণন বা কীর্তন । যা ওই শব্দেরই রকমফের যেখানে তো, আলটিমেটলি, নাম মাহাত্ম্যেরই জয়জয়কার । মবলগে শব্দেই জয়যাত্রা । নয় কি !

দ্বিতীয়ত, শব্দের মাহাত্ম্যই বলুন আর উৎসবই বলুন, আদতে এই মানের ( meaning ) বিভাজনটি ঘিরে ঘোরতর ক্যাচাল । আসলে শব্দ-প্রয়োগ মারফত, সে লিখিত ( written ) বা বলিত ( spoken ) যেভাবেই হোক না কেন, আমরা প্রত্যেকেই নিজের মতো করে বুঝি, অনিভব করি । নিজেদের বুদ্ধি-বিদ্যের দৌড়-মাফিক বুঝে নিই । এবং কোনও বলনকেতার এই বুঝে নাওয়া পর্বটিই আবার আরেক হ্যাপার সূচনা করে বসে । অর্থাৎ কোনও টেক্সট তক্ষুনি পড়ার যে বোধগম্যতা, সময়ের ফেরে আবার ফিরে পড়ার বোধগম্যতার স্তর নিঃসন্দেহে আলাদা । জাক দেরিদার মতে যাঅবিনির্মাণ চালানোর রকমফের, তা-ই আদতে ব্যক্তির বিকাশকে তথা সাহিত্য সংস্কৃতির বা সেই সমাজ পরিসরের ওঠা-পড়াকে চি্‌হ্ণিত করে । বলার ক্ষেত্রটিতে বা মৌখিক ভাষ্যটির ক্ষেত্রেও এই একই অবস্হা । কার্যত বুঝে ওঠা বা মিনিং ব্যাপারটির মধ্যেই ব্যক্তি-বিশেষের ভিন্ন-ভিন্ন অবস্হান । নানা মুনির নানা মতটি এই ভাবেই প্রণিধানযোগ্য হয় । অর্থাৎ মানে ব্যাপারটির ব্যাপকতা প্রকারান্তরে হারিয়ে যায় । আস্তে-ধীরে লুপ্ত হয়ে বসে । অন্য মানে বা বোধগম্য হওয়ার অন্য তরিকাটি পরিসর-পরিস্হিতি-পরিবেশ মাফিক অন্যভাবে উপলব্ধ হয় । স্হান-মাহাত্ম্যের প্রভাব প্রকট হয় । ফলত space oriented মানের রকমারি আয়োজন, এই উৎসব, সেই সেই পরিসরীয় বৈভবকে আত্মসাৎ করে । কিন্তু যা রয়ে যাব তা হল — বলার শব্দগুলি অর্থাৎ সেই সেই সাউন্ডগুলি । যা কোথাও না কোথাও রয়ে গেছে । থাকছেই । এই থাকাটা সর্বপ্রকার মানে বা অর্থকরী সামঞ্জস্য বিধানের উর্ধে । থাকছে শক্তি হয়েই । সমস্ত শক্তির আধার হয়ে । সেখানে শব্দের মাহাত্ম্য বা উৎসব সংকীর্ণ সময়ের ব্যবধানে যে বিশেষণেই ভূষিত হোক না কেন, তা কার্যত শক্তিই । জানি না, এই শক্তির কথা না ভেবেই কিভাবে রলাঁ বার্থ সাহেব তাঁর Death of the Author ভাবনাটির নির্মানে কৃতসঙ্কল্প হলেন ।

তৃতীয়ত, Celebration of Words মানেই কিন্তু কোনও শব্দকে সেলিব্রিটি হিসাবে তুলে ধরা নয় । আসলে শব্দ চিরকালই উঠে আসে । হ্যাঁ, উঠে আসে । সেই সেই ভাষা ক্ষেত্রটির পরিবেশ, পরিস্হিতি ও পরিবেশের ভূমিকাই এখানে অগ্রগণ্য । কতরকম অভিব্যক্তি নিয়েই যে গতায়াত, কতভাবে তাকে প্রয়োগ করার সার্থকতা, সবই আদতে মাহাত্ম্য বর্ণনাই । তাই সব্দকে সেলিব্রিটি বানানো মানেই তার সেমান্টিক্স ধর্মকে বিপর্যস্ত করা, ধ্বস্ত করা । যুগোপযোগী ধারণা থেকে বোঝা যাবে যে আমরা মনুষ্য কুলজাতরা সমাজ-ব্যবস্হা আধারিত কারও না কারও ছড়ি ঘোরানোকে প্রকারান্তরে  প্রশ্রয় দিয়ে চলেছি । না হলে নাকি এই সমাজ নামক ব্যবস্‌আটি ভেঙে খান খান হয়ে যেত । বোঝেন কারবারটি । সেই সনাতন যুগ থেকেই বদ্ধ জালের মধ্যে ব্যক্তি-প্রকৃতি-সমাজ-রাষ্ট্রের বন্ধনে এই ব্যবস্হা । মূলে দরবার মজলিস বা লোকসভা নামাঙ্কিত হলেও আসলে কোনও না কোনও ব্যক্তির ক্ষমতার অঙ্গুলিহেলনে তটস্হ আমরা । এবং সেই আদি অর্বাচীন কাল থেকে এই আধুনিকতার মধ্যেই তাবৎ ছড়ি ঘোরানো তথা ক্ষমতা জাহির করার কায়কল্প বীজটি ওই শব্দ-মাহাত্ম্যের কেলোর কীর্তন ছাড়া আর কী হতে পারে ? ভেবে দেখুন ।

সত্যি বলতে কি, শব্দের মাহাত্ম্যকে বুঝতে গেলে বা চিনতে হলে প্রথমত বুঝতে হবে মানুষ ঠিক কি ভাবে দৈনন্দিন যাপন থেকে একটু খুশি এক চিলতে মস্করা টুকুন হাসি-ঠাট্টা বা সামগ্রিক পরিসরে তার বেঁচে থাকার আহ্ললাদটুকু জিইয়ে রেখেছে । Formal আনন্দ, পালে-পাব্বনে হৈ-হুল্লোড়, বিয়ে বাসরের টুকরো রসদ ও তার রেশ, প্রাত্যহিক দুনিয়াদারি সবই এক গোত্রের যদিও নয়, তবুও বাঁচিয়ে রাখার এক লীলাময় কাণ্ড যেন অহরহ জাল বিছিয়ে রেখেছে । সেও ওই ভবলীলাটুকু সাঙ্গ হওয়ার অপেক্ষায় ।কিন্তু যা থেকে যায়, যা-কিছু রেখে যাওয়া তাতে শিল্প ছিল সংস্কৃতি ছিল কৃষ্টি ছিল বলাটাই বোধহয় সঙ্গত । কিন্তু সর্বোপরি যা ছিল তা হল মগ্ন কিছু ক্ষণ, পদ্যময় ক্ষণ, আর কিছু বহুরসিকতাময় গদ্য । তার সার্বিক ভুগোলটি ঘিরে ভরাট অবসরের স্মৃতিতর্পণ । তা সে সবসময় লিপিবদ্ধ হবেই, হতে হবেই, এমনটি তো কদাপি নয় । হয়ও না । তবুও এরই মধ্যে আমরা খুঁজে নেবো সেই-সেই পরিসরের মানুষের বা মানুষগুলোর প্রকৃতিস্হ শব্দ সমষ্টির মাআত্ম্যকে । যে সমস্ত শব্দই তার পরিসর থেকে উঠে-আসা সাবলীল অভিব্যক্তিময় মাহাত্ম্যবর্ণন । যা বাঁচিয়ে রাখবে, বাঁচিয়ে রেখেছে, বাঁচিয়ে রেখেছিলও । নাহলে আর শব্দের সেমানটিক্স ধর্ম কিসে !

বাঁচিয়ে রাখা ব্যাপারটা যেহেতু কোনও লেখকের ক্ষেত্রে পাঠবস্তুতে, তো সেই টেক্সটগুলোর বিন্যস্ত হওয়াটি একটা সমীক্ষার অবকাশ রেখেই যায় । সত্যি বলতে কি, সমীক্ষা = অহং + যাপন + পাঠবস্তু, এই প্রাকল্পিক সমীকরণটিকেই মান্যতা দেওয়া উচিত । অর্থাৎ প্রথমেই বুঝে নেওয়া জরুরি যে কোনো একটি পাঠকৃতির মধ্যে লেখকের অহং আর যাপন ঠিক কি ভাবে মিলমিশ হয়ে আছে । সেই ছকটা ঠিক মতো ধরে ফেলা চাই । জানি না দেরিদা ভাষ্য অনুযায়ী অবিনির্মাণ ধারাটি এভাবেই মিলে যেতে পারে কিনা । তবে লেখকের ‘ফিরে পড়ায়’, তাঁরই টেক্সট ছাপানোর পর বা পূর্বলিখনে, ডিকন্সট্রাক্ট হয়, হয়ই । আরও আছে, যেমন শব্দের Ethnicity-তে জোর দিয়ে, না Indegenous শব্দের বাঁধনে Phonetics বা Semantics-কে ঢুঁড়ে-ফুঁড়ে ? কিভাবে ? তারপর হল গিয়ে, Phenomena-র বিস্তীর্ণ এলাকাটি কিভাবে ধরা দেয় একটা টেক্সটে । তাতে করে ডিসকোর্সের বা বলনকেতার কোনও রকম খামতি থেকে যায় কিনা । মোদ্দা কথায়, টেক্সট বনাম ডিসকোর্স ব্যাপারটির তুলোধনা । এর পরও যা থেকে যায়, তা হল Time-bound factor-গুলো সমাজ সাপেক্ষে, অথবা ফেনোমেনার বিস্তীর্ণ অঞ্চল সাপেক্ষে মূলগত Interaction-গুলো ঠিক কিভাবে উঠে আসতে চায় । হ্যাঁ, উঠে আসতে চাওয়া । এই ভাবেই সমস্ত রকমের শব্দমাহাত্ম্য বর্ণনটি আমাদের কৃষ্টি পরম্পরায়, আমাদের সাহিত্য পরম্পরায়, সংহতি পরম্পরায় উঠে আসবার ফুরসত খুঁজে নেবে ।

মলয় রায়চৌধুরীর টেক্সট বলতে ফেনোমেনার বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে যে  Gravitational interaction-গুলো, শুধু সেগুলোই নিশ্চয়ই নয় । মূলে যা আছে তা হল তাদের Anti-gravity-র খেলা । অর্থাৎ হ্যাঁ-এর তুলনায় না-এর এলাকার উৎসসাধন । কিভাবে তিনি উঠে আসাগুলোকে ঠিক ঠিক উন্মোচিত করে তুলে ধরবার প্রয়াস ফাঁদেন । বা ধরতে পারেন । সেখানে যাপন কী কামে লাগছে এবং লেগেছে, এতাবৎ অহং-এর মর্জিমাফিক হেলদোলে । এসবই বিচার্য ।

মলয় তাঁর পাঠবস্তুতে চিরকালই বাইনারি বৈপরীতভকে চুরমার করে ত্রিনয়নের কথাই ভেবে এসেছেন । সুতারাং এই তৃতীয় দৃষ্টিভঙ্গীটিই প্রয়োগ মহিমায় অহংসর্বস্ব কিনা, যাপন মাফিক কি না, পাঠবস্তুতে সাযুজ্য রাখতে পারছে কি না, তারই এক রকম শব্দ প্রয়োগভিত্তিক তুণফোঁড় বিশ্লেষণ এখানে উল্লিখিত হবে । মনে রাখতে হবে, মলয় এও বলছেন, যে আমার লেখালিখি কোনো মানেকে প্রতিষ্ঠিত করে না, বরং মানে ব্যাপারটার ঐক্যকে চ্যালেঞ্জ করে । তিনি পেট চিরে মারাকে যেভাবে শিল্পের পর্যায়ে তুলে আনা ভাবেন, ঠি সেভাবেই শব্দকেও শিল্পের ভাণ্ডারজাত করেন, স্হানোপযোগী তোল্লাই দেন ।

এবার মলয়ের প্রজেক্ট রিপোর্ট মায় সাহিত্যসুন্দর এলাকাটি ঘুরে-ফিরে দেখবার বাসনা জাগবেই। বলে নেয়া ভালো যে, যে-কোনো কবিতার বা গদ্যের শুরু-সারা-মধ্য, বা যে কোনো লাইন কি ভাবে উঠে আসে  বা আসতে চায়, তারই স্হান-তামাম এটি । আমার মনে হয়, এই উঠে আসা, অথবা তুলে ধরা একটা ‘ফেনোমেনাল ইন্টারঅ্যাকশান’ থেকেই পাঠবস্তুর আকার লাভ করে । তবে ‘উঠে আসা’ অবশ্যই কর্মজ্ঞান, আর ‘তুলে ধরা’ জ্ঞানকর্ম । বাস্তবিক এই উঠে আসা আসলে ফেনোমেনার বিস্তীর্ণ এলাকা ঢুঁড়েই । যা আবার কর্মনিবিড় জ্ঞানও বটে । জ্ঞানভিত্তিক কর্ম বা মাস্টারিগিরি নিশ্চয়ই নয় । অতএব বলতে চাওয়া এই যে, আমাদের ইন্দ্রিয়গোচর এই চারপাশ, তার পরিবেশ, তার আর্থসামাজিক-সাংস্কৃতিক ও সর্বোপরি রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড থেকে জারিত বা বিজারিত । কিন্তু শব্দগুলো যেভাবে মনের মণিকোঠায় লালিত-পালিত হয়ে কাগজে বসে বা কাট-ছাঁট হয়ে যে বিশিষ্ট মানে তৈরি করে তা আসলে Self-naturalizing interaction থেকেই । ব্যাপারটি ‘আওয়া৪৯’ উনিশতম সংকলনের ‘শংকরায়ন : এ থিয়োরি অফ এভরিথিং’ নিবন্ধটিতে আরও বিস্তৃত করেছি ।

এর পরেও যেভাবে একটা শব্দের পরে আরেকটা, আগে-পিছে, বা তারও পাশে বসে পারস্পরিক একটা জব্বর Interaction-এ মেতে ওঠে, সেই ধরতাইটিও কম নয় । কোনো শব্দ কখনও Static syndrome-এ, কখনও Catalist, কখনও বা Dynamic ধরতাইটি ধরিয়ে দেয় । অবশ্য এভাবেই Strong interaction কাজ করে যেতে পারে । এরপরও প্রত্যেকটি শব্দের মধ্যে নিজস্বতার খোলে একটা Weak interaction  থেকেই যায়। এটা আবার উচ্চারণ মাফিক কর্মকাণ্ড বা অভিব্যক্তির সঞ্চার হিসেবে প্রতিপন্ন হতে পারে । অর্থাৎ শব্দ কিরকম খলবলিয়ে ওঠে তার ভাষা বিভঙ্গে সেটি এখানেই কর্নগোচর হয় । সে পাঠকের দৃষ্টিতে তার অনুভবে যেভাবে মাত্রা পায়, অথবা লেখক সাপেক্ষে যেমত অভিব্যক্তিটা বোঝানোর বা ধরানোর চেষ্টা । এখানে লেখকের শব্দ প্রয়োগ, তার ব্যঞ্জনা, তার অভিধা বা তৃতীয় কোনও Impression যুক্ত করতে চাচ্ছেন এবং কিভাবে, সেটিই এখানে বিম্বিত হতে চাচ্ছে । কেননা, লেখক এবং পাঠক, উভয়ের  ক্ষেত্রেই মানের বিড়ম্বনা নামক অগোছাল শিবিরটি থাকছেই । আর থাকছে বলেই এই শব্দমাহাত্ম্যের জের ।

আপাতত দেখা যেতে পারে মলয় রায়চৌধুরীর ‘ডুবজলে যেটুকু প্রশ্বাস’ উপন্যাসটির শব্দমাহাত্ম্য ঠিক কী কথা কইছে :

ভোপ্পোর ভোঁ ⇒ স্টিম এনজিনের ভোপ্পোর ভোঁ

চালিশা ⇒ ঘুম জাগানিয়া চালিশা শোনাচ্ছিল…বিহার-বাংলা খেলাটা এখানে লক্ষণীয় । কেননা ঠিকমতন Interaction না গড়ে উঠলে চালশে দেখা ঘটে যেতে পারে ।

চিলতে ⇒ চুলের কিছুটা চিলতে…

সাতবাস্টে ⇒ ন্যাতানো হিলহিলে সাতবাস্টে পোকা লাগা ঝিমিয়ে-পড়া…

পড়পড়িয়ে ⇒ পুলিশ যখন পড়পড়িয়ে গুলি চালায়…

গোঁয়ার ⇒ গোঁয়ার রোদ্দুরকে আস্কারা দিয়ে…

ঘ্যাঁচড়া ⇒ ঘ্যাঁচড়া বজ্জাত আড়বুঝো…ইত্যাদি ।

এবং আরও আছে, যেমন সাফায়া, ঝজঝড়ে, অজ দিগন্ত, এক পোঁচ ফরসা, তেএঁটে ফাঁকিবাজ, লাফড়া, তড়াস, এদান্তি, যাদুখোকন, লিচুকুসুম, লালটুস, খর্চাখরচ ( খর্চাপাতি বা খরচা-তরচার বদলে ), চপ, হুড়দংগ, ভাতখোর, দ্য়নীয়, হড়প ( গেঁড়িয়ে দেওয়া ), হ্যাংগাম, ঘুরঘুট্টি, হোঁৎকা, খাকতি, গবভে ( গভভে ), গঢ়, গড়াগ্গড়, ভজকট, একাধফোঁটা, ঝমাঝ-ঝম, তুমুলতায় ইত্যাদি শব্দ প্রয়োগকে অনভতর ডাইমেনশন বললে বযোই সোজাসাপটা বলা হয় বইকি । সুতরাং ভেবে দেখবার প্রয়োজন হয়ে পড়েছে শব্দের পারস্পরিক Interaction-গুলোর, অভিব্যক্তির অন্যতর মারপ্যাঁচগুলোর, বলনকেতার উঠে আসা প্রয়োগগুলোর । মলয় সমঝে নেন, মেয়েদের সততার চাবিকেন্দ্র শরীরের তুলতুলে জায়গাগুলোয় লুকোনো থাকে বলে, বাস্তবকে রহস্যখুশি দিয়ে যেটা অবাস্তব করা যায় । আর আমরা সমঝে নেব, মানের চাবিকেন্দ্র-শব্দ শরীরের তুলতুলে Interaction-গুলোয় কিভাবে লুকোনো থাকে, যা অবাস্তবকেও রহস্যখুশি জুগিয়ে বাস্তব করা যায় । মলয়ের আহ্লাদ তাঁর বলনকেতার বা ডিসকোর্সের কারিকুরি, কোনো একটা, যেকোনো একটা, বিকল্পগুলোর মধ্যে থেকে বেছে নিতে চাইছে কি ( যেভাবে ‘ডুবজলে’ উপন্যাসের শেষ লাইন ), না ওই Interaction-গুলো । শব্দমাহাত্ম্যে কী না হয়, বলুন ।

শব্দ তার পড়ে পাওয়া চোদ্দ আনা ব্যতিরেকে কী এক অকল্পনীয় সম্ভার সাজাতে পারে, যেভাবে মলয় রায়চৌধুরী ধরতাইয়ে মানে ব্যাপারটার ঐক্যকে চ্যালেঞ্জ জানায় তাকে ধরতে গেলে মনঃসংযোগ ব্যাপারটা ন্যারেটিভের থেকেও অধিক কনসেনট্রেশন চেয়ে বসে । হ্যাঁ, প্রান্তক চিরকাল ক্ষমতার বিরুদ্ধে সংঘর্ষ চালিয়ে যায় । প্রান্তিক শব্দও । মেদহীন নারীত্ব, বোধ হয়, হয় না । তাই নির্মেদ শব্দের টাল খাওয়ানো অভিব্যক্তি মলয়ের গোটা ‘নামগন্ধ’ উপন্যাস জুড়ে ।

সোঁটা ⇒ লাঠি সোঁটার সোঁটাটি কেবল

চ্যাটা ⇒ চ্যাটা খোঁপায় খুশিদি

ধরাট ⇒ ধরাকাটের আরেক বা্হার বা প্রয়োগ

দাগড়া ⇒ চাকা-চাকা দাগের বীভৎসতা ধরিয়ে দেওয়া এই দাগড়া প্রয়োগ

আড়ং ⇒ আড়ং ধোলাই কেমনতর হতে পারে তার ধরতাইটি বোঝানো

ধাদ্ধাড়া ⇒ ধ্যাদ্ধেড়ে  গোবিন্দপুর বোঝাতে

লবণচল ⇒ জলচল না রাখা

নেয়াপাতি ⇒ নেয়াপাতি ভুঁড়ির বাহারি কেতাখানা বোঝাতে

তেলচোয়াড়ে ⇒ তেল চুকচুকে নধরকান্তির উলটো অভিব্যক্তি

আচকা ⇒ আচমকার থেকেও ক্ষুদ্রতর ক্ষণ ভাগ

এভাবেই এসে যায় ক্যাঁদরা, প্যাংলা, উসকি, তাঁবা, লাফড়াউলি, লাফাঙ্গা, খ্যাঁচড়া, তাগড়, খুল্লমখুল্লা, দঙ্কাদড়ি, ভুষ্টিনাশ, তঞ্জেবকাশিদা, তিড়িক নাচন, ইত্যাদি শব্দগুলোর প্রায়োগিক রকমফের । অধঃপতনের যাত্রাপথকেই বোধহয় প্রগতি বলে, যেভাবে মলয় জানান, তাঁর শব্সবন্ধ আয়োজনে এই উঠে আসায় বা মসনদি পালে এই হুড়দোড় ঢুকে পড়ায় কী গতি তাও ভেবে দেখার ।

‘নামগন্ধ’ উপন্যাসের ‘লবণচল’, ‘ভেন্নগল্প’ গ্রন্হের ‘লবণহারামি’-র হারামিত্বকে আর এক কাঠি মাত্রা দেয় নিশ্চিত । সুতরাং সমাজ থাকবে আধুনিকতাবাদী, উন্নয়ন থাকবে গরিব-গুর্বো ধন-দৌলতকারী থাকবে, অথচ জাতপাত সাম্প্রদায়িকতা থাকবে না, শব্দ অচল থাকবে না, মানে কথা শব্দ সমাজের জাতিভেদ অস্পৃশ্যতা থাকবে না, এমনটা কখনই অনভিপ্রেত ছিল না Reductionism-এর দৌলতে । মানুষের ছোট-বড় ভেদ-ছোঁয়াক্কারি মানেই শব্দ জগতেরও ছ্যা ছ্যা মার্কা তিওর-বাগদি হাই-প্রোফাইল বামুন-কায়েতি চল । সুতরাং নীচতলার কলাজ্ঞান, কুলাচার-কৃষ্টি, বাক-বাখন বা বলনকেতার উঠে আসা বা আসতে চাওয়া — যেভাবে গ্রামকে গ্রাম শহর বুননে লাগে — আসলে প্রলয় নন্দিত থিতু অবস্হাই । বুঝতে হবে এভাবেই মলয় কিভাবে শব্দ-যোজনায় না-মানের এলাকাটিকে টেক্সটে সাজিয়ে নিচের তলাটিকে ওপরের তলা গড়ে তুলতে প্রলয় সাধন চালিয়েছেন ।

————-

ঋণ স্বীকার : কবিতা ক্যাম্পাস

 

শীতল চৌধুরী : মলয় রায়চৌধুরীর ‘প্রচণ্ড বৈদ্যুতিক ছুতার’ কবিতার বিশ্লেষণ

দেশে-দেশে যখনই স্রষ্টার কলম নিয়ে নতুন পথের পথিক হতে চেয়েছেন যে সব কবিরা, তখনই অগ্নিশর্মা হয়ে বাধাস্বরূপ দাঁড়িয়েছেন চিরাচরিত ভাবধারায় আচ্ছন্ন ছুঁৎ-মার্গীরা । বহু কবিকুলকে এ-জন্য ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ হজম করতে হয়েছে; সময়ে-সময়ে আ-জন্য দণ্ডভোগও করতে হয়েছে । কঠিন জীবনযুদ্ধের লড়াইয়ের মুখোমুখি হতে হয়েছে ।

 

ফরাসিদেশের আধুনিক কবিদের পুরোধা বোদলেয়ারের নাম বিশেষভাবে করা যায় । ছুঁৎ-মার্গীদের কাছে তিনি জীবিতাবস্হায় ছিলেন অচ্ছুৎ । হাংরি জেনারেশনের প্রধান পুরোহিত তাঁর সময়কালে যে নতুন সাহিত্য পথের পথিক হয়ে ছুঁৎ-মার্গীদের কোপে পড়বেন এটাই স্বাভাবিক লএজন্য স্রষ্টা মলয় রায়চৌধুরীকে শ্রীঘরেও অতিথি হতে হয়েছে । কবি চসারের In the sowre hungry tyme পংক্তিটি থেকে হাংরি শব্দটি তুলে নিয়ে ১৯৬১-এর নভেমবরে নতুন বাংলা কবিতা আন্দোলনের পুরোহিত মলয় রায়চোধুরী যে পত্রিকা প্রকাশ করেন তার নাম রাখা হয় হাংরি জেনারেশন । এই শব্দের আড়ালে প্রচ্ছন্ন রয়েছে যে অর্থটি তা হলো ক্ষুধা ।

 

এ-ক্ষুধা যে মানবিক, দৈহিক ও শারীরিক, এবং চিরাচরিত বস্তাপচা মূল্যবোধকে ভাঙার, তা বোধকরি বলা অনুচিত হবে না । রোমান্টিসিজমের ছাঁচে বন্দী চিরাচরিত ভাবলোক থেকে আত্মানুসন্ধানে বেরিয়ে এসে মলয়বাবু বাংলা কবিতাকে অস্তিত্ব-সংকট থেকে মুক্তি দিয়ে এক নতুন আত্মদীপের সন্ধানে মুখর করতে চেয়েছেন । কবিতাকে দাঁড় করাতে চেয়েছেন যৌনতা, জান্তব ক্ষুধা ও জৈবতার মধ্যে এক জীবন জিজ্ঞাসার মুখোমুখি । প্রচণ্ড জান্তব ক্ষুধাকে সঙ্গী করে তিনি চেয়েছেন বাংলা কবিতার দিকবদল ও অন্তরাত্মার মুক্তি । হাংরি জেনারেশন-এর মূল মন্ত্র এটাই ।

 

মলয়বাবুর প্রথম বুলেটিনের তাত্ত্বিক ভাঢ়েই তা পরিঢ়্কার: “ছন্দে গদ্য লেখার খেলাকে কবিতা নাম দিবে চালাবার খেলা এবার শেষ হওয়া প্রয়োজন । টেবলল্যাম্প ও সিগারেট জ্বালিয়ে, সেরিব্রাল কর্টেকসে কলম ডুবিয়ে কবিতা বানাবার কাল শেষ হয়ে গেছে । এখন কবিতা রচিত হয় অরগ্যাজমের মতো স্বতঃস্ফূর্তিতে । সেহেতু ত্রশ্নু বলাৎকারের পরমূউর্তে কিংবা বিষ খেয়ে অথবা জলে ডুবে সচেতনভাবে বিহ্বল হলেই কবিতা সৃষ্টি সম্ভব । শিল্পের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা কবিতা সৃষ্টির প্রথম শর্ত ।

 

শখ করে, ভেবে-ভেবে, ছন্দে গদ্য লেখা হয়তো সম্ভব, কিন্তু কবিতা রচনা তেমন করে আর কোনোদিনই সম্ভব নয় । অর্থব্যম্জনাঘন হোক অথবা ধ্বনিপারম্পর্যে শ্রুতিমধুর, বিক্ষুব্ধ প্রবল চঞ্চল অন্তরাত্মার ও বহিরাত্মার ক্ষুধানিবৃত্তির শক্তি না থাকলে , কবিতা সতীর মতো চরিত্রহীনা, প্রিয়তমার মতো যোনিহীনা, ঈশ্বরীর মতো অনুন্মেষিনী হয়ে যেতে পারে । ” অন্তরাত্মার ও বহিরাত্মার ক্ষুধা নিবৃত্তির সামর্থে তিনি কবিতাকে স্হাপন করতে চেয়েছেন বস্তুগত জীবন ও আত্মিক জীবনের পারস্পরিক মেলবন্ধনে । এ-কারনেই কিনা জানি না, মলয়বাবু তাঁর বহু বিতর্কিত ‘প্রচণ্ড বৈদ্যুতিক ছুতার’ কবিতাটিতে অস্তিত্বের সংকটকে বড়ো করে দেখিয়েছেন । কবিতাটির শুরুতেই তিনি যখন সোচ্চারে এ-কথা বলেন— “ওঃ মরে যাবো মরে যাবো মরে যাবো আমার চামড়ার লহমা জ্বলে যাচ্ছে অকাট্য তুরুপে আমি কী কোর্বো কোথায় যাবৌ ওঃ কিছুই ভালো লাগছে না সাহিত্য-ফাহিত্য লাথি মেরে চলে যাবো শুভা শুভা আমাকে তোমার তর্মুজ আঙরাখার ভেতরে চলে যেতে দাও চুর্মার অন্ধকারে জাফ্রান মশারির আলুলায়িত ছায়ায় সমস্ত নোঙর তুলে নেবার পর শেষ নোঙর আমাকে ছেড়ে চলে যাচ্ছে আর আমি পার্ছি না, আজস্র কাচ ভেঙে যাচ্ছে কর্টেক্সে” আমরা এখানে সহজেই উপলব্ধি করতে পারি কবি মলয়ের আন্তরের আস্তিত্বের সংকট কি ভয়ানকভাবে চেপে বসেছে, তাই তিনি চামড়া জ্বলার মধ্যে দিয়ে তাঁর যন্ত্রণার কথা যেমন ব্যক্ত করেছেন, তেমনি সাহিত্য-ফাহিত্য লাথি মেরে চলে যাবার কথাও প্রেমিকা শুভাকে বলছেন ।

 

তবু আস্তিত্ত্বের সংকট থেকে পালিয়ে যাওয়া তো জীবনের ধর্ম হতে পারে না —তাই পরক্ষণে তিনি শুভার তর্মুজ-আঙরাখার ভেতরে চলে যেতে আকেঙ্খা করেছেন । এ-আকাঙ্খার মধ্যে রয়েছে কবি মলয়ের একদিকে যেমন আস্তিত্ত্বের সংকট থেকে ক্ষণিক মুক্তি, তেমনি যন্ত্রণা জ্বালা থেকে ক্ষণিক মুক্তিও । যে যন্ত্রণা-জ্বালা অভুক্ত ঋদয়ের, শরীর ও মনের । একটা কথা মনে রাখতে হবে, পঞ্চাশের দশক থেকে সাহিত্য একটা বন্ধ্যা যুগ তৈরি হয়েছে । একথা বলার কারণ পঞ্চাশের কবিদের সৃষ্টি নির্মাণে পূর্বজদের রোমান্টিসিজমের গড়া সাহিত্যধারারই চর্বিতচর্বণ হয়েছে ।

 

চল্লিশের বা তিরিশের কবিদের মতন তেমন কোনো সাহিত্য-পট পরিবর্তনের স্বাক্ষর তঁরা রাখতে পারেননি । এমনকি, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর ছত্রছায়ায় লালিত পরবর্তী সময়ের ভেঙে পড়া মূল্যবোধের যন্ত্রণা-জ্বালা বুকে নিয়ে যে-সব চল্লিশের কবিরা পৃথিবীর প্রেক্ষাপটে বাংলা সাহিত্যে এক নবযুগের বাণী নির্মাণের চেতনায় লিপ্ত হয়েছিলেন, তাঁদের মত ও পথের চর্বিতচর্বণ-বাহকরূপেই পঞ্চাশের কবিরা কাটিয়ে দিয়েছেন পরবর্তী সময়কে কবিমানসের অনুশিলনে । বোউ ও মেধাচর্চাব আর নতুন কোনো আলোকিত জীবন মন্হনের হদিশ দিতে পারেননি । সময়ের সঙ্গে পৃথিবীর সভ্যতা ক্রমশঃ অন্তঃসারশূন্য হয়ে মানুষকে ও তার ভাবনা ও চেতনাকে এক নৈরাজ্যের বাসিন্দায় পর্যবসিত করে ক্রমশ অস্তিত্ব সংকটের মুখে ঠেলে দিচ্ছে , এ-সত্য উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন বলে কবি মলয় রায়চৌধুরী ‘হাংরি আন্দোলন’-এর মধ্য দিয়ে জীবনজিজ্ঞাসার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে সাহিত্যনির্মাতাদের বুকে যেমন আগুন ধরিয়ে দিতে চেয়েছেন, তেমনি চেয়েছেন চিরাচরিত ভাবধারা থেকে সাহিত্যের মুক্তি, শিল্পের মুক্তি । তা নাহলে কবি মলয় একথা বলবেন কেন— আমি জানি শুভা যোনি মেলে ধরো, শান্তি দাও প্রতিটি শিরা অশ্রুস্রোত বয়ে নিয়ে যাচ্ছে ঋদয়াভিগর্ভে শাশ্বত অসুস্হতায় পছে যাচ্ছে মঘজের সংক্রামক স্ফূলিঙ্গ যৌনতায় ডুবে যাওয়া নয়, কেবল যুগযন্ত্রণার অসুস্হতায় আচ্ছন্ন থাকাই কবি মলয়ের কাম্য নয় ।

 

তিনি চান জীবনযাপনের সত্য প্রকাশের মধ্য দিয়ে প্রেমে-অপ্রেমে-বিদ্রোহে ওলোটপালোট করে মানবিক, দৈহিক ও শারীরিক ক্ষুধায় জীবনের এক পূর্ণতা, আমনকি শিল্পেরও । পরবর্তী কয়েকটি পংক্তিতে যার আভাস আমরা পাই । কবি মলয়ের তির্যক কথায়— মা তুমি আমায় কঙ্কালরূপে ভূমিষ্ঠ করলে না কেন তাহলে আমি দুকোটি আলোকবর্ষ ঈশ্বরের পৌঁদে চুমো খেতুম কিন্তু কিছুই ভালো লাগে না আমার কিচ্ছু ভালো লাগছে না একাধিক চুমো খেলে আমার গা গুলোয় ধর্ষণকালে নারীকে ভুলে গিয়ে শিল্পে ফিরে এসেছি কতদিন কবিতার আদিত্যবর্ণা মূত্রাশয়ে এসব কি হচ্ছে কানি না তবু বুকের মধ্যে ঘটে যাচ্ছে অহরহ সব ভেঙে চুরমার করে দেবো শালা ছিন্নভিন্ন করে দেবো তোমাদের পাঁজরাবদ্ধ উৎসব শুভাকে হিঁচড়ে উঠিয়ে নিয়ে যাবো আমারক্ষুধায় আসলে, অনুপযুক্ত পৃথিবীর ধ্বস্ত সময়েরফাঁস ছিন্ন করে কবি মলয় দাঁড়াতা চান প্রকৃত সত্যসন্দর্শন শিল্পের কাছে । তাই তাঁর অকপটে বলতে বাধে না—‘ধর্ষণকালে নারীকে ভুলে গিয়ে শিল্পে ফিরে এসেছি কতদিন’ । আবার পরক্ষণে তিনি যখন বলেন ‘কবিতার আদিত্যবর্ণা মূত্রাশয়ে/এসব কি হচ্ছে জানি না তবু বুকের মধ্যে ঘতে যাচ্ছে অহরহ/সব ভেঙে চুরমার করে দেবো শালা’—তখন বুঝতে বাকি থাকে না শিল্পের চর্বিতচর্বণ-সূতিকাগারে তিনি আবদ্ধ থাকতে চান না, তিনি চান গতানুগতিক বিশুদ্ধ শিল্পের নামে ধর্ষিত শিল্পভাবনার জগঃটিকে ভেঙে চুরমার করে দিতে ।

 

‘ছিন্নভিন্ন করে দেবো তোমাদের পাঁজরাবদ্ধ উৎসব’, এই পংক্তির মধ্য দিয়ে কবিতা রচনাকারদের শিল্পের নামা বাহারি ‘সন্মেলন নামক ভণ্ডামির প্রতি তাঁর তীব্র ধিক্কার ও প্রতিবাদ একই সঙ্গে ব্যক্ত হয়েছে । নারী-ই যুগেযুগে যেহেতু কবিদের কাছে কবিতার প্রতিমূর্তিরূপে উদভাষিত হয়েছে, কবিকে করেছে সমৃদ্ধ, সেহেতু কবি মলয় রায়চৌধুরীও শুভাকে চেয়েছেন শিল্পের জন্য । ‘হিঁচড়ে উঠিয়ে নিয়ে যাবো আমার ক্ষুধায়’, একথার মধ্য দিয়ে শিল্পের প্রতি তাঁর দায়বদ্ধতাই প্রকাশ পেয়েছে । একথা বলার কারণ, কবিতাকে তিনি নারীর মতনই সম্ভোগ করতে চান নিজস্ব আত্মদর্পণে । কোনো গতানুগতিক ধারার অনুসরণে নয় ।

 

শিল্প গড়ে উঠুক কবির মননসমৃদ্ধ ব্যক্তিক আত্মদর্পণের নিজস্ব নিয়মে, সময় কালের প্রেক্ষিতে, আত্মশ্লাঘা ও আত্মজিজ্ঞাসার ভেতর দিয়ে । কবি মলয়ের ইংরেজি বা বিদেশি ভাষানবীশ কবিওয়াকাদের প্রতি ব্যঙ্গোক্তিও দেখি এ-কবিতায় ব্যক্ত হয়েছে । যারা নিজস্ব অন্তরাত্মার দিকে না তাকিয়ে পর-দেশীর ভাবনার অবগাহনে শিল্পের মুগ্ধতার চমৎকারিত্বে সদাই মশগুল, বিশেষত শহর কলকাতার শিক্ষিত কবিকুলের যা একান্ত ধর্মরূপে প্রতিভাত । আর এজন্যই কবি মলয়ের কন্ঠে এক অসহায়তাবোধ জেগে উঠেছে, সঙ্গে-সঙ্গে এক ধিক্কার ও ব্যঙ্গও । তাই তিনি বলতে দ্বিধা করেননি— কলকাতাকে আর্দ্র ও পিচ্ছিল বরাঙ্গের মিছিল মনে হচ্ছে আজ কিন্তু আমাকে নিয়ে আমি কি করব বুঝতে পারছি না আমার স্মৃতিশক্তি নষ্ট হয়ে যাচ্ছে আমাকে মৃত্যুর দিকে যেতে দাও একা আমাকে ধর্ষণ ও মরে যাওয়া শিখে নিতে হয়নি প্রস্রাবের পর শেষ ফোঁটা দায়িত্ব আমায় শিখতে হয়নি অন্ধকারে শুভার পাশে গিয়ে শুয়ে পড়া শিখতে হয়নি শিখতে হয়নি নন্দিতার বুকের ওপর শুয়ে ফরাসী চামড়ার ব্যবহার কবি মলয়ের আস্তিত্বের সংকট ও আত্মদর্পণের বিস্ময়প্রসূত আত্মজিজ্ঞাসার একটি সার্থক সুন্দর দলিল হল এই ‘প্রচণ্ড বৈদ্যুতিক ছুতার’ কবিতাটি ।

 

একথা বলার কারণ মলয়ের আত্মধিক্কারের মধ্য দিয়ে নতুন পথ-খোঁজার আত্যন্তিক ইচ্ছের ব্যপারটি কবিতার মধ্যে বারবার ব্যক্ত হয়েছে, কখনো সরাসরি ভদ্র প্রতিবাদীর মোড়কে, কখনো শ্লীলতার মাত্র ছাড়ানোর অভিব্যক্তিতে । শ্লীলতার মাত্রা ছাড়ানোর অভিব্যক্তির দৃষ্টান্ত যেমন— অথচ আমি চেয়েছিলুম আলেয়ার নতুন জবার মতো যোনির সুস্হতা যোনিকেশরে কাচের টুকরোর মতো ঘামের সুস্হতা একটা কথা বলা বোধ করি এখানে উচিত হবে, এই শ্লীলতার মাত্রা ছাড়ানো অভিব্যক্তি কিন্তূ কখনো অশ্লীলতার দায়ে অভিযুক্ত করা যাবে না । কবিতাকে নারীদেহরূপে দেখাতাই সাধারণত সৎ কবির ধর্ম । বৈষ্ণব সাহিত্যেও প্রেমের অভিব্যক্তির চরম প্রকাশ বার বার উঠে এসেছে নারীদেহের সুধা মন্হন ও সৌন্দর্য বর্ণনায় । যোনিই যেহেতু সন্তানের জন্মদ্বার—সেহেতধ যোনির সুস্হতা চাওয়ার মধ্য দিয়ে কবি মলয়ের সার্থক কবিতা নির্মাণের ভাবটিই এখানে ব্যক্ত হয়েছে বলে আমরা ধরে নিতে পারি ।

 

সময়ে সময়ে ধর্ষণ শব্দটি দেখি তাঁর কবিতায় ফিরে ফিরে এসেছে । ‘ধর্ষণ’ শব্দটিকে ধ্বস্ত বা নষ্ট অর্থে ধরতে হবে । যা চর্বিতচর্বণে বহু ব্যবহৃত তাকেই সম্ভবত তিনি ‘ধর্ষণ’ অর্থের দ্যোতনায় চিহ্ণিত করতে চেয়েছেন । ‘প্রচণ্ড বৈদ্যুতিক ছুতার’ কবিতাটিকে শল্যচিকিৎসকের মতন যদি প্রথম থেকে শেষাবধি কাটাছঁড়া করা যায়, তাহলে যে সত্য চালচিত্রটি ধরা পড়ে তা হলো এক নবীন কবির আত্মবীক্ষণের ও আত্মমন্হনের এক সুগভীর প্রশ্নবিহ্বল সুতীব্র আর্তনাদ, এবং এক অসহায় অস্তিত্বের তীব্র সংকটের বার্তা । শিল্পকেই একমাত্র জীবনযন্ত্রণার নিস্তার ও মুক্তি বলে মনে করেছেন বলেই তাঁর কবি-অন্তরে দ্বান্দ্বিকতা দেখা দিয়েছে ।

 

কবি মলয় এ-কারণে যেমন বলতে বাধ্য হয়েছেন—‘ধর্ষণকালে নারীকে ভুলে গিয়ে শিল্পে ফিরে এসেছি কতদিন’, আবার তেমনি বলতে বাধেনি—‘আজ মনে হয় নারী ও শিল্পের মতো বিশ্বাসঘাতিনী কিছু নেই’ । কৃত্রিম ভাবনালোক ত্যাগ করে মলয় চান সত্যসন্দর্শনেরপ্রকৃত জীবনযন্ত্রণার অক্ষরের পিনবিদ্ধ রক্তঘামে ভেজা রক্তমাংসজনিত সাবলীল ভাবনালোক । কবিতে তাঁর কাছে ঈশ্বরী না হয়ে হয়ে উঠুক সময়কালের দর্পণে জীবনযন্ত্রণায় পোড়া সত্যিকারের মানবী । তাই দেখি শুভাকে তিনি শিল্পের মানবীসত্তার প্রতীকীব্যঞ্জনায় আমাদের কাছে তুলে ধরছেন, তাকে বার বার রমণে ও মননে । ‘প্রচণ্ড বৈদ্যুতিক ছুতার’ কবিতাটির সারসত্য এটাই ।

 

কবিতাকে তিনি তাঁর চূড়ান্ত অসহায়তা বোধ থেকে শৈষ পর্যন্ত গভীর তৃষ্ণায় নিশ্চিন্তবোধের জগতে ফিরিয়ে দিতে চান । কল্পনার রঞ্জিতবিলাসে তিনি যে গা ভাসাতে ইচ্ছুক নন, তা স্পষ্ট করেছেন বিশেষত মাতৃগর্ভে ফিরে যাবার পর ফেরসমস্ত অস্তিত্ব দিয়ে জীবনের আস্বাদকে লেহন করার মধ্য দিয়ে । শুভা কেউ নন, কবি মলয়ের জীবনের আস্বাদনের প্রতিভূ—শিল্পের মানবী বা আধার । মলয়বাবু শিল্পরূপী কবিতাকে টেনে আনতে চেয়েছেন প্রকৃত জীবনের কাছে, প্রকৃত বাস্তবের সত্যসন্দর্শনে । এ-আলোচনার সমাপ্তিকালে কটি কথা বলা বোধ করি উচিত হবে : হাংরি আন্দোলনের পুরোহিত কবি মলয় রায়চৌধুরী প্রকৃত কালসত্যের সন্দর্শনটি মেলে ধরেছিলেনতাঁর সুবলিষ্ঠ লেখার মাধ্যমে বলেই বাংলা কবিতায় আজ শ্লীল-অশ্লীলের কাল্পনিক বা সমাজবিদদের চাপানো কতকগুলি ধারণার বেড়াজাল ছিন্ন হয়ে বাংলা সাহিত্য প্রকৃতপক্ষে সাবালকত্বের দুয়ার খঁজে পেয়েছে, তা সত্তর দশকের কবিকুলের দিকে নজর রাখলেই বোঝা যায় ।

 

বিশেষ করে সত্তর দশকে প্রখ্যাত কবি জয় গোস্বামীকে আমরা সম্পূর্ণ স্বাধীন ও স্বমহিমায় ‘দশচক্র’ কবিতায় যেভাবে পেয়েছি তার কথা বলা যাতে পারে: স্বয়ং মা সরস্বতী বীণা ও পুস্তক ফেলে দু-হাত দিয়ে পথ আটকে দাঁড়ালেন আমার রাস্তায় পরনে কিচ্ছুটি নেই, একদম ন্যাংটো শুধু আঙুলে নেলপালিশ সরু সরু নখসুদ্ধ আঙুল ঢুকিয়ে দিলেন চোখে, মরে গেলাম মরে গেলাম, মরতে মরতে কী দেখলাম বলব কী ভুতুম আমি কী বলব তোমায় দেখতে দেখতে আমি স্বয়ং ভগবান হয়ে যাচ্ছি মাকে ডাকছি বাপকে ডাকছি চৌদ্দগুষ্টিকে ডাকছি আয় আয় আয় বাপকে মেয়ের সামনে ছেলেকে মায়ের সামনে মেরে শুইয়ে দিচ্ছি কেটে । জয়ের এ-উচ্চারণে হাংরি আন্দোলনের পরোক্ষ প্রভাব পাওয়া যায় না কী? হাংরি আন্দোলন যে বৃথা যায়নি তা টের পাই সত্তর দশকের বহু কবির বেশ কিছ্ রচনাতে । সত্তর দশকের কবিদের গতানুগতিক বৃত্তভাঙার মন্ত্রবীজটি যে হাংরি আন্দোলনের কাছ থেকেই এসেছে তা বোধ করি মনে কোনো দ্বিধা না রেখেই বলা যায় । কবি মলয় রায়চৌধুরীর হাংরি আন্দোলনের পুরোহিত বা পুরোধা হিসাবে সার্থকতা এখানেই । তিনি প্রকৃত কবিতার বিবর্তনের স্রোতটী খুব অনায়াসভাবে পৌঁছে দিতে পেরেছেন পরবর্তী প্রজন্মের কবিদের বোধে, মননে ও হৃদয়ে ।

 

‘প্রচণ্ড বৈদ্যুতিক ছুতার’ কবিতাটি যথার্থই একটি সার্থক কবিতা । কি উপমা প্রয়োগে, কি শব্দচয়নে, কবি মলয়ের মুন্সীয়ানার পরিচয় পাওয়া যায় । বিশেষ করে ‘নতুন জবার মতো যোনির সুস্হতা’ ও ‘কাঁচের টুকরোর মতো ঘামের সুস্হতা’ উপমা দুটি নজর কাড়ে । তর্মুজ আঙরাখা, জাফ্রান, আদিত্যবর্ণা, সূর্যজখম, রূপালী য়ুটেরাস, সবুজতোষকের, আঁচমেরে, ক্লিটোরিসের, লাবিয়া ম্যাজোরার, হিপ্নটিক, যৌনপরচুলায়, এসব শব্দ যেমন প্রয়োগের ক্ষেত্রে কবিতাটিকে অর্থবহ করে তুলেছে, তেমনি রসঘনভাবেএকটা বিশ্বাসের ভূমিতে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে । সব অর্থেই একটি তারিফযোগ্য কবিতে এটি, এবং হাংরি আন্দোলনের প্রকৃত মন্ত্রবীজ হয়ে উঠেছে ।

কবিতাটির যথার্থ মূল্য এখানেই ।

( এই কবিতাটির জন্য ১৯৬৪ সালে মলয় রায়চৌধুরীর বিরুদ্ধে মকদ্দমা করেছিল তৎকালীন পশ্চিমবঙ্গ সরকার। মলয়ের হাতে হাতকড়া পরিয়ে ও কোমরে দড়িবেঁধে প্রথমে থানায় এবং থানা থেকে ছয়-সাতজন অপরাধীর সঙ্গে রাস্তা দিয়ে হাঁটিয়ে কোর্টে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। মলয়ের বিরুদ্ধে ৩৫ মাস মামলাটি চলে প্রথমে নিম্ন আদালতে, যেখানে মলয়ের একমাস জেলের সাজা ঘোষিত হয় ও তারপর কলকাতা উচ্চ আদালতে, যেখানে তিনি বেকসুর ছাড়া পান। মলয়ের পক্ষে সাক্ষ্য দিয়েছিলেন তরুণ সান্যাল, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, জ্যোতির্ময় দত্ত, সত্রাজিৎ দত্ত ও অজয় হালদার। পাঠকের হয়ত আশ্চর্য লাগবে, মলয়ের বিরুদ্ধে পুলিসের পক্ষের সাক্ষী ছিলেন শক্তি চট্টোপাধ্যায়, সন্দীপন চট্টোপাধ্যায় ও উৎপলকুমার বসু। দুজন পুলিস ইনফর্মার, পবিত্র বল্লভ ও সমীর বসু, ছিলেন পুলিসের ভুয়ো সাক্ষী, যাঁরা মলয়ের পরিচিত না হওয়া সত্ত্বেও কোর্টে জানান যে মলয়ের সঙ্গে তাঁদের বহুবার কফিহাউসে দেখা হয়েছে। সবচেয়ে লজ্জার যে দুজন হাংরি আন্দোলনকারী রাজসাক্ষী , অর্থাৎ অ্যাপ্রুভার, হয়ে মলয়ের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দেন; তাঁরা দুজন হলেন শৈলেশ্বর ঘোষ ও সুভাষ ঘোষ।এঁদের সাক্ষ্যের কারণেই নিম্ন আদালত মলয়কে সাজা দিয়েছিল ।)

ওঃ মরে যাব মরে যাব মরে যাব
আমার চামড়ার লহমা জ্বলে যাচ্ছে অকাট্য তুরুপে
আমি কী কোর্বো কোথায় যাব ওঃ কিছুই ভাল্লাগছে না
সাহিত্য-ফাহিত্য লাথি মেরে চলে যাব শুভা
শুভা আমাকে তোমার তর্মুজ আঙরাখার ভেতর চলে যেতে দাও
চুর্মার অন্ধকারে জাফ্রান মশারির আলুলায়িত ছায়ায়
সমস্ত নোঙর তুলে নেবার পর শেষ নোঙর আমাকে ছেড়ে চলে যাচ্ছে
আর আমি পার্ছি না, অজস্র কাঁচ ভেঙে যাচ্ছে কর্টেক্সে
আমি জানি শুভা, যোনি মেলে ধরো, শান্তি দাও
প্রতিটি শিরা অশ্রুস্রোত বয়ে নিয়ে যাচ্ছে হৃদয়াভিগর্ভে
শাশ্বত অসুস্হতায় পচে যাচ্ছে মগজের সংক্রামক স্ফুলিঙ্গ
মা, তুমি আমায় কঙ্কালরূপে ভূমিষ্ঠ করলে না কেন ?
তাহলে আমি দুকোটি আলোকবষহ ঈশ্বরের পোঁদে চুমো খেতুম
কিন্তু কিছুই ভলো লাগছে না আমার কিচ্ছু ভালো লাগছে না
একাধিক চুমো খেলে আমার গা গুলোয়
ধর্ষণকালে নারীকে ভুলে গিয়ে শিল্পে ফিরে এসেছি কতদিন
কবিতার আদিত্যবর্ণা মূত্রাশয়ে
এসব কী হচ্ছে জানি না তবু বুকের মধ্যে ঘটে যাচ্ছে অহরহ
সব ভেঙে চুরমার করে দেব শালা
ছিন্নভিন্ন করে দেব তোমাদের পাঁজরাবদ্ধ উৎসব
শুভাকে হিঁচড়ে উঠিয়ে নিয়ে যাব আমার ক্ষুধায়
দিতেই হবে শুভাকে
ওঃ মলয়
কোল্কাতাকে আর্দ্র ও পিচ্ছিল বরাঙ্গের মিছিল মনে হচ্ছে আজ
কিন্তু আমাকে নিয়ে আমি কী কোর্বো বুঝতে পার্ছি না
আমার স্মৃতিশক্তি নষ্ট হয়ে যাচ্ছে
আমাকে মৃত্যুর দিকে যেতে দাও একা
আমাকে ধর্ষণ ও মরে যাওয়া শিখে নিতে হয়নি
প্রস্রাবের পর শেষ ফোঁটা ঝাড়ার দায়িত্ব আমায় শিখতে হয়নি
অন্ধকারে শুভার পাশে গিয়ে শুয়ে পড়া শিখতে হয়নি
শিখতে হয়নি নন্দিতার বুকের ওপর শুয়ে ফরাসি চামড়ার ব্যবহার
অথচ আমি চেয়েছিলুম আলেয়ার নতুন জবার মতো যোনির সুস্হতা
যোনোকেশরে কাঁচের টুকরোর মতন ঘামের সুস্হতা
আজ আমি মগজের শরণাপন্ন বিপর্যয়ের দিকে চলে এলুম
আমি বুঝতে পার্ছি না কী জন্যে আমি বেঁচে থাকতে চাইছি
আমার পূর্বপুরুষ লম্পট সাবর্ণচৌধুরীদের কথা আমি ভাবছি
আমাকে নতুন ও ভিন্নতর কিছু কোর্তে হবে
শুভার স্তনের ত্বকের মতো বিছানায় শেষবার ঘুমোতে দাও আমায়
জন্মমুহূর্তের তীব্রচ্ছটা সূর্যজখম মনে পড়ছে
আমি আমার নিজের মৃত্যু দেখে যেতে চাই
মলয় রায়চৌধুরীর প্রয়োজন পৃথিবীর ছিল না
তোমার তীব্র রূপালি য়ূটেরাসে ঘুমোতে দাও কিছুকাল শুভা
শান্তি দাও, শুভা শান্তি দাও
তোমার ঋতুস্রাবে ধুয়ে যেতে দাও আমার পাপতাড়িত কঙ্কাল
আমাকে তোমার গর্ভে আমারই শুক্র থেকে জন্ম নিতে দাও
আমার বাবা-মা আন্য হলেও কি আমি এরকম হতুম ?
সম্পূর্ণ ভিন্ন এক শুক্র থেকে মলয় ওর্ফে আমি হতে পার্তুম ?
আমার বাবার অন্য নারীর গর্ভে ঢুকেও কি মলয় হতুম ?
শুভা না থাকলে আমিও কি পেশাদার ভদ্রলোক হতুম মৃত ভায়ের মতন ?
ওঃ বলুক কেউ এসবের জবাবদিহি করুক
শুভা, ওঃ শুভা
তোমার সেলোফেন সতীচ্ছদের মধ্যে দিয়ে পৃথিবীটা দেখতে দাও আমায়
পুনরায় সবুজ তোশকের ওপর চলে এসো শুভা
যেমন ক্যাথোড রশ্মিকে তীক্ষ্ণধী চুম্বকের আঁচ মেরে তুলতে হয়
১৯৫৬ সালের সেই হেস্তনেস্তকারী চিঠি মনে পড়ছে
তখন ভাল্লুকের ছাল দিয়ে সাজানো হচ্ছিল তোমার ক্লিটোরিসের আশপাশ
পাঁজর নিকুচি করা ঝুরি তখন তোমার স্তনে নামছে
হুঁশাহুঁশহীন গাফিলতির বর্ত্মে স্ফীত হয়ে উঠছে নির্বোধ আত্মীয়তা
আ আ আ আ আ আ আ আ আ আঃ
মরে যাব কিনা বুঝতে পার্ছি না
তুল্কালাম হয়ে যাচ্ছে বুকের ভেতরকার সমগ্র অসহায়তায়
সব কিছু ভেঙে তছনছ করে দিয়ে যাব
শিল্পের জন্যে সক্কোলকে ভেঙে খান-খান করে দোব
কবিতার জন্যে আত্মহত্যা ছাড়া স্বাভাবিকতা নেই
শুভা
আমাকে তোমার লাবিয়া ম্যাজোরার স্মরণাতীত অসংযমে প্রবেশ কোর্তে দাও
দুঃখহীন আয়াসের অসম্ভাব্যতায় যেতে দাও
বেসামাল হৃদয়বত্তার স্বর্ণসবুজে
কেন আমি হারিয়ে যাইনি আমার মায়ের যোনিবর্ত্মে ?
কেন আমি পিতার আত্মমৈথুনের পর তাঁর পেচ্ছাপে বয়ে যাইনি ?
কেন আমি রজোস্রাবে মিশে যাইনি শ্লেষ্মায় ?
অথচ আমার নীচে চিত আধবোজা অবস্হায়
আরামগ্রহণকারিণী শুভাকে দেখে ভীষণ কষ্ট হয়েছে আমার
এরকম অসহায় চেহারা ফুটিয়েও নারী বিশ্বাসঘাতিনী হয়
আজ মনে হয় নারী ও শিল্পের মতো বিশ্বাসঘাতিনী কিছু নেই
এখন আমার হি২স্র হৃৎপিণ্ড অসম্ভব মৃত্যুর দিকে যাচ্ছে
মাটি ফুঁড়ে জলের ঘূর্ণি আমার গলা ওব্দি উঠে আসছে
আমি মরে যাব
ওঃ এসমস্ত কী ঘটছে আমার মধ্যে
আমি আমার হাত হাতের চেটো খুঁজে পাচ্ছি না
পায়জামায় শুকিয়ে-যাওয়া বীর্য থেকে ডানা মেলছে
৩০০০০০ শিশু উড়ে যাচ্ছে শুভার স্তনমণ্ডলীর দিকে
ঝাঁকে-ঝাঁকে ছুঁচ ছুটে যাচ্ছে রক্ত থেকে কবিতায়
এখন আমার জেদি ঠ্যাঙের চোরাচালান সেঁদোতে চাইছে
হিপ্নোটিক শব্দরাজ্য থেকে ফাঁসানো মৃত্যুভেদী যৌনপর্চুলায়
ঘরের প্রত্যেকটা দেয়ালে মার্মুখি আয়না লাগিয়ে আমি দেখছি
কয়েকটা ন্যাংটো মলয়কে ছেড়ে দিয়ে তার আপ্রতিষ্ঠিত খেয়োখেয়ি

( হাংরি বুলেটিন, ১৯৬৪ )

বৈদ্যনাথ মিশ্র : মলয় রায়চৌধুরীর ‘জখম’ ও অন্যান্য রক্তক্ষরণ

 

মলয় রায়চৌধুরীর ‘জখম’ কবিতাটি গোড়াতেই পৃথক কাব্যগ্রন্হ হিসাবে প্রকাশিত হয়েছিল । ১৯৬৪ সালে রচিত,  প্রথম প্রকাশ ১৯৬৫ । তারপর বেশ কয়েকবার পুনর্মুদ্রিত হয়েছে । অনুবাদও হয়েছে । হিন্দি অনুবাদ করেছিলেন কাঞ্চনকুমার, ইংরেজি কার্ল ওয়েসনার, উর্দু আমিক হানফি ।

হাংরি আন্দোলন শুরু হয় ১৯৬১-এর নভেম্বরে এবং অন্যান্য সবাই মুচলেকা দিয়ে আন্দোলনের সঙ্গে সম্পর্ক অস্বীকার করার কারণে এ আন্দোলনের মেয়াদ ফুরোয় ১৯৬৫তে । ইতিমধ্যে তাঁর রক্তক্ষরণ ঘটেছে প্রচুর । তিনি যথেষ্ট জখম হয়েছেন তাঁর বন্ধুবান্ধব দ্বারা, যাঁদের তিনি বিশ্বাস করেছিলেন, যাঁদের মধ্যে কেউ কেউ হাংরি আন্দোলন মামলায় রাজসাক্ষী হয়েছিলেন । মিডিয়ায় প্রচুর কুৎসা রটনা হয় তাঁর বিরুদ্ধে । আদালতে দিনের পর দিন হাজিরা দিয়েছেন । বিচার ব্যবস্হাও তাঁকে অকারণ শাস্তি দিয়েছে, যেন পুলিশ আদালত ইত্যাদি কবিতার বৈশিষ্ট্য ও ভূমিকা বোঝেন । আদালতও সাক্ষীসাবুদের সাহায্যে চোরপুলিশ খেলার মতো কবিতার বিনির্মাণের খেলা খেলেন ।

কেবল নিজের মামলায় নয়, ব্যাঙ্কশাল কোর্টের চত্বরে লক্ষ্য করেছেন, কিভাবে আইনের মারপ্যাঁচের খেলা অভিনীত হয় । আদালত চত্বরেই ভাড়া পাওয়া যায় সাক্ষী । অন্যত্র মলয় বলেছেন :-

 

“একাই লড়েছিলুম

কেউ বলেনি ‘হোক কলরব’

একাই নেমেছিলুম ব্যাংকশাল কোর্টের সিঁড়ি বেয়ে

সেদিন একাই ঘুরেছিলুম কলকাতার পথে সকাল পর্যন্ত”

 

‘জখম’ কবিতার প্রতিটি ছত্রে আছে হাংরি আন্দোলনে স্রষ্টা মলয় রায়চৌধুরীর সেই সময়ের মনস্হিতির বোধ ও উপলব্ধির, একাকীত্বের খুল্লমখুল্লা জবানবন্দি । কবিতাটিতে কোথাও কোনও আড়ষ্টতা ও কৃত্রিমতা নেই । কবিতাটি মলয় রায়চৌধুরীর জীবনের টার্নিং পয়েন্ট । জীবনানন্দের মতো তিনি বলেননি, ‘আমি কেবল হতেছি আলাদা’ । ঘা-খাওয়া একটি ঘায়েল যোদ্ধা তাঁর ক্ষতচিহ্ণগুলিকে নিরীক্ষণ করছেন এবং উগরে আসছে অক্ষর-শব্দ-বাক্যের ভুতুড়ি ও জ্বলুনি ।

হাংরি আন্দোলনের স্রষ্টা মলয় রায়চৌধুরী স্বয়ং বলেছেন, এই আন্দোলনের অবস্হান আধুনিকতার গর্ভে । একটিমাত্র বোধের সম্প্রসারণ কবিতাটির সমগ্র উচ্চারণে স্পষ্ট দেখা যায় । তবে কবিতায় উচ্চারিত সংখ্যাগুলির মধ্যে রয়েছে বহুত্ব, উপচানোভাব, ছাপিয়ে যাওয়ার ইশারা, বাড়াবাড়ির এলাহি, লাইনে-লাইনে যুক্তিফাটল যা উত্তরাধুনিকতার বৈশিষ্ট্য। অজস্র চোট, অতিরিক্ত বিশ্বাসঘাতকতা, নিজের জীবনে প্রকৃত টানা পাঁচ বছর দেম্মার-দেম্মার, পেড়েফেলার হুমকি, লাগাতার সইতে হলে তবেই সংখ্যা ও শব্দের মধ্যে তারতম্যের স্পেস উঠে আসে । এর জন্য বিট জেনারেশন, অ্যালেন গিন্সবার্গ ইত্যাদির প্রয়োজন হয় না । কেননা কিছু কিছু আলোচকদের হীনম্মন্যতায় বিদেশী আন্দোলনের প্রসঙ্গ এসেছে ।

খেয়াল রাখা দরকার, হাংরি আন্দোলন শুরু হয়েছিল ১৯৬১-এর নভেম্বরে, এবং মলয় রায়চৌধুরী মনে করেন হাংরি আন্দোলন শেষ হয় ১৯৬৫-তে । ঐ বছরেই উনি ‘প্রচণ্ড বৈদ্যুতিক ছুতার’ কবিতার জন্য নিম্ন আদালতে সাজা পান, এবং ১৯৬৭-তে শেষমেশ মুক্তি পান উচ্চ আদালত থেকে । ‘প্রচণ্ড বৈদ্যুতিক ছুতার’ কবিতাটি কয়েক হাজার বার প্রকাশিত হয়েছে, এবং কবিতাটির জন্য মলয় রায়চৌধুরীর নাম লেখার প্রয়োজন হয় না । কৃশানু বসুকে সাক্ষাৎকার দেবার আগে অন্যতম রাজসাক্ষী শৈলেশ্বর ঘোষ শর্ত দিয়েছিলেন যে তাঁকে যেন ‘প্রচণ্ড বৈদ্যুতিক ছুতার’ ও মলয় রায়চৌধুরী সম্পর্কে কোনো প্রশ্ন না করা হয় । শৈলেশ্বর ঘোষ তৃণমূলে যোগ দিয়েছিলেন এবং সুভাষ ঘোষ সিপিএম দলের কার্ড-হোল্ডার হয়েছিলেন, কিন্তু অজস্র রক্তক্ষরণ সত্বেও মলয় রায়চৌধুরী কোনো প্রতিষ্ঠানে যোগ দেননি ।

 

‘জখম’ কবিতা পড়লে দেখা যায় প্রথম চারলাইনের মধ্যেই তিনি ‘শুনানি’ ‘মুলতুবি’, ‘জেরা’ শব্দগুলি ব্যবহার করেছেন যা সাধারণত আদালতেই ব্যবহার হয়, অর্থাৎ তিনি কবিতাটির প্রস্হান বিন্দুটিকেই পাঠকের কাছে পরিষ্কার করে দিয়েছেন ।

ডারউইনের বিবর্তনের তত্ব অনুযায়ী স্তন্যপায়ী মেরুদণ্ডী প্রাণীর মধ্যে মানুষের মাথা উঁচু করে দাঁড়ানোই তার শ্রেষ্ঠ অর্জন । কালক্রমে ইতিহাসে ডারউইনের সেই মানুষ সামাজিক নিয়মের কাছে মাথা নোয়াচ্ছে । কবিতাটির তাই একটি পংক্তি ‘্দালত অবমাননার দায়ে/নিয়মের কাছে মাথা নোয়চ্ছে ডারউইনের মানুষ’ । জন্মসূত্রে সব মানুষ এক । আর্থসামাজিক অবস্হায় কে কতটা সুবিধা পেল, সেই অনুযায়ী তার সামাজিক অবস্হানের বদল ঘটেছে । আদালতে গিয়ে দেখা যায় কেউ বিচারক, কেউ উকিল, কেউ পুলিশ বা অভিযোগকারী, কারও পরিচয় অভিযুক্ত, কেউবা পক্ষে বা বিপক্ষে সাক্ষী । নিজ নিজ পরিস্হিতির পরিচায়ক । আদালতেরও পর্যায়ক্রমের কদর বা ক্ষমতার পরিসর আলাদা । সেখানে একটা ক্রমান্বয় কাজ করছে । অতএব ;জখম’ কবিতায় দেখা যায়, ‘এখানে কেউ নিচু কোর্টে হেরে গিয়ে সদরকোর্টে জিতে ফিরে আসে।’ আবার পরের পংক্তিতেই দেখা যাচ্ছে, সেই ক্রমান্বয়ের মানুষিক ব্যাখ্যা, ‘কেউ মানুষের কাছে জিতে গিয়ে মানুষের কাছে হেরে যায়’ ।

এই ক্রমান্বয়ের ফলে ‘জখম’ কবিতার একটি পংক্তিতে কবির উক্তি ‘১ই ব্যাপার থেকে তৈরি হচ্ছে সত্যিমিথ্যে।’ ঐ ‘একই ব্যাপারকে’ কবি নানান ভাবে ব্যাখ্যা করেছেন । নৈতিকতার প্রশ্নে আদালতের ক্রমান্বয়কে আরেকভাবে কবি তুলে ধরেছেন  ‘জখম’ কবিতার প্রস্হানবিন্দুতে দেখা গেছে আইনের এলাকার শব্দ । কিন্তু যে মামলা-মকদ্দমায় কবি নাজেহাল হয়েছেন সেখানে চমৎকারভাবে ফিরে এসেছেন এক গভীর অতল ভিন্ন পরিসরে— ‘সমুদ্রের একতলার হলঘরে মশাল জ্বালিয়ে/আমি সাঁতরে খুঁজে বেড়াচ্ছি ইং ও বাং ভাষায় আমার গ্রেপ্তারি পরোয়ানা।’

‘জখম’ কবিতাটি একটি অ্যাবস্ট্রাক্ট কবিতা । ফলে বহু জায়গায় কবি বাস্তব সত্যকে বিমূর্ত ইমেজে তুলে ধরেছেন । বিষয়ের মধ্যে নিহিত জটিলতা সরাসরি স্পষ্ট করেছেন ।

 

দুই

 

এযাবৎ ‘জখম’-এর চোট এবং সেখান থেকে ঘুরে দাঁড়ানোর মেজাজ কবির উচ্চারণে দেখা গেছে । কবিতার শেষের দিকের উক্তি এই ধারণাকে স্পষ্ট করে তুলেছে—

 

‘ওফ

প্রতিহিংসা আমাকে জের্বার কোরে তুলছে

নিজের সঙ্গে শলাপরামর্শ এঁটে ঠিক কোর্ছি কি কোরে প্রতিশোধ নেয়া যায়

এক একটা চোটে ফেটে গুঁড়িয়ে যেতে চাইছে আমার কঙ্কালের সমঝদার ঘরদোর

আক্রমণের আগে আমি ২দণ্ড জিরিয়ে নিচ্ছি

ধাক্কা খেয়ে পড়ে যাবার পর আমি উঠে দাঁড়িয়ে ফুঁসছি আর গর্জাচ্ছি

বালামচি দিয়ে চোটজখম ঝালাই কোরে স্রেফ ন্যাটা হাতে লড়ে যাচ্ছি ২৫ বছর

সমস্ত কিছুর সঙ্গে মোকাবিলা করার জন্য আমার চোখমুখ থমথম কোর্ছে এখন’

 

ঠিক এর বিপরীত অবস্হানটিও কাব্যিক ভারসাম্যের দিক থেকে চমৎকারভাবে হাজির করেছেন । একসময় ধুমকেতুগুলি মহাশূন্য থেকে প্রচণ্ড গতিতে এসে ভূপৃষ্ঠে আঘাত করেছে । সৃষ্টি করেছে ভয়ংকর চোটগহ্বর —’প্রশান্ত মহাসাগরের আকরিক মাটি ১টা নির্দিষ্ট দূরত্বে গিয়ে চাঁদ হয়ে গেল।’ যে চাঁদ কবিদের দিয়েছে রোমান্টিকতার প্রশ্রয় । পৃথিবী থেকে দূরে চলে গেলেও পৃথিবী ও চাঁদের পারস্পরিক টান ও আসক্তি পৃথিবী ও আকাশে রচনা করেছে জোয়ার-ভাঁটা, তিথিবন্ধন, পূর্ণিমা-অমাবস্যা, জ্যোৎস্না, সময়ের হিসেবনিকেশ, প্রেম ও যৌনতার নিশ্চিন্তির আধার ।

চাঁদের মতোই নিরাময়ময়ী নীলা কবির কবিতায় বারবার আবির্ভূত হয়েছেন । ‘প্রচণ্ড বৈদ্যুতিক ছুতার’-এর শুভা থেকে সরে এসেছেন নীলার কাছে । পরবর্তীকালে তাঁর জীবনের বিভিন্ন নারী দেখা দিয়েছেন বিভিন্ন কবিতায়, অবন্তিকা, ইন্দ্রাণী, অনামিকা, সোনালী, কৃতি, উপমা এবং আরও অনেকে । আমরা এখন জানি তাঁরা সকলেই মলয়ের কবিতার প্রতিনিধিত্ব করেন । প্রকৃতিস্হ রমণী চাঁদেরই গুণসম্পন্ন—

‘নীলার রোঁয়ায় জ্বলা-নেভা ১টা ছোট্ট হাইভোল্টেজ ঘাম আমার রক্তকে তোল্পাড় করে দিচ্ছে’ ; আবার কবি ফিরিয়ে এনেছেন নিশামণি রাত্রির উষ্ণতাকে — ‘নীলার লেপের নীচে শুয়ে আদ্দেক রাত্তিরে উঠে এলুম নিজের ঠাণ্ডা বিছানায়।’ এভাবেই নীলা ফিরে-ফিরে এসেছে, যেমন সুগন্ধময়ী রূপে—’স্নানের পর নীলার শীতল আর নরম চামড়ার কচি আতর ভেসে আসছে।’ কবি তন্ন তন্ন করে খুঁজেছেন নিরাময়ের ইশারাগুলি । হঠাৎ-হঠাৎ আশ্চর্য সব পংক্তি উঠে এসেছে কবিতার ফাঁক ফোকর দিয়ে—’এখন এই রাত্তিরবেলায় সমুদ্রের ঢেউয়ের ওপর চিৎ হয়ে আলতোভাবে শুয়ে/লাজুক মাছেদের শিস শোনার ইচ্ছে হচ্ছে আমার।’ অথচ স্বয়ং নীলা অর্থাৎ কবিতা বিপন্ন । তার বিপন্নতা, শারীরিক বার্তা এইভাবে উঠে এসেছে—’হৃদযন্ত্রের আলতো কাঁপনে কেঁপে ওঠা নীলার বাঁদিকের রুগ্ন স্তন আমার মনে পড়ছে এখন।’

নীলার শরীরের ডানদিক আর বাঁদিক এক নয় । বাঁদিকের স্তন বরং রুগ্ন । উল্লেখ্য যে মলয়ের মামলায় বামপন্হী পত্রিকাগুলিও সমর্থন করেনি ; তাদের রুগ্ন ঔচিত্যবোধে আক্রান্ত ছিল তারা । তাদের অমান্য করে বামপন্হী কবি তরুণ সান্যাল মলয়ের পক্ষে সাক্ষ্য দিয়েছিলেন । কিন্তু এখানেই মলয় প্রশ্ন তুলেছেন, তিনি নিজেও কি স্বধর্মনিষ্ঠ ? নিজের গভীরেজাত চেতনার প্রতি নিষ্ঠাবান কি ? যেজন্য তিনি বলছেন, ‘আমার পা বুঝতে পার্ছে না যে আমিই তদের গতি আর দিক নিয়ন্ত্রণ কোর্ছি।’ যখনই কবি নীলার প্রসঙ্গে ফিরে আসছেন, আড়ালে আবডালে চেতনা ও চৈতন্যের প্রসঙ্গে তুলে ধরছেন কবিতার অন্তরাত্মায় ; এই বৈভিন্ন্যকে তুলে ধরেছেন আবার নীলার সান্নিধ্যের উষ্ণতার প্রসঙ্গে । উইলিয়াম ব্লেক, হুইটম্যান, জীবনানন্দ দাশ-এর অন্বেষার প্রসঙ্গে ।

চেতনা ও চৈতন্যের ক্রিয়ায় ‘প্রচণ্ড বৈদ্যুতিক ছুতার’-এর শুভা ও ‘জখম’-এর নীলা অথবা পরবর্তীকালের অবন্তিকা একই অবস্হানপন্নতায় বিরাজ করছেন । মলয় বলেছেন যে তাঁর কবিতার নারীরা কেউ তাঁর স্লেভগার্ল নন, যেমন ছিলেন বনলতা সেন, নীরা, সুপর্ণা কবিদের নিজস্ব, যে কবিরা বলেন, ওইখানে যাওনাকো তুমি, মিশোনাকো ওইসব যুবকের সাথে । নীলা আরও পরিণত । নীলায় নীলিমাকে পাওয়া যায় । আবার নীলার আরেকটা অর্থ গ্রহরত্ন, যে রত্নকে সাধারণ মানুষ এড়িয়ে চলেন ।

‘প্রচণ্ড বৈদ্যুতিক ছুতার’ কবিতাটি মলয় লিখেছিলেন ১৯৬৩ সালে, প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৬৪ সালে, হাংরি আন্দোলন যখন চরম পর্যায়ে, এবং এই কবিতাটির জন্যই কবি গ্রেপ্তার হয়েছিলেন, হাংরি আন্দোলনের সঙ্গে সম্পর্ক অস্বীকার করে মুচলেকা দিয়েছিলেন তাঁর বন্ধুরা, যেকারণে মলয় বলেছেন ১৯৬৫ সালে হাংরি আন্দোলন ফুরিয়ে যায় । অবশ্য সত্তর দশকে সেই বন্ধুরা  আন্দোলনের স্রষ্টার দাবিদাওয়া নিয়ে আবার নেমেছিলেন আসরে, হাংরি শব্দকে বর্জন করে ‘ক্ষুধার্ত’ নাম নিয়ে ।

মলয় রায়চৌধুরী ‘জখম’ লেখেন ১৯৬৫ সালে, যখন তিনি চতুর্দিক থেকে আক্রান্ত, কলকাতায় মামলা চলছে, মাথাগোঁজার ঠাঁই নেই, খাওয়া-দাওয়া সস্তার পাইস হোটেলে, বন্ধুরা তাঁকে এড়িয়ে চলছেন, কফিহাউসে কবিরা তাঁকে প্রায় বয়কট করেছেন, চাকরি থেকে সাসপেন্ড হবার দরুন মাইনে অর্ধেক হয়ে গেছে । তখন তিনি রক্তাক্ত এবং একা পালটা আক্রমণের জন্য ফুঁসছেন । সমস্ত কিছুর সঙ্গে মোকাবিলার জন্য প্রস্তুত । ‘জখম’ কবিতাটিতে অসাধারণ কিছু পংক্তি রয়েছে, যেমন, ‘অসীম বলতে আমি বুঝি নিজেরি গায়ের চামড়া।’  এই লাইনটি পাঠক গভীরভাবে অনুধাবন করলে টের পাবেন আকাশের দিকে হাত তুলে ‘অসীমকে’ অনুধাবন করা যায় না । চেতনার বসতবাটি কবির অস্তিত্বে । তার শুরু ও শেষ উভয়েই তাঁরই বোধে অর্থাৎ দূরে কোথাও নেই, বরং তা নিকটতম, অনুভাব্য । কেননা ঠিক পরের লাইনেই কবি লেখেছেন ‘আমার সামান্য ফুঁ-এ পথিবীর সমস্ত গ্রন্হের অক্ষর উড়ে তালগোল পাকিয়ে যায় ।” ‘ফুঁ’ শব্দটি এখানে ঝড়ের শক্তির সমার্থক । ‘অক্ষর’ শব্দটি প্রয়োগ করা হয়েছে ভাষার বীজ অর্থে । কবি চান সমস্ত ভাষার বীজের জায়গায় প্রতিস্হাপিত হোক মলয় রায়চৌধুরীর কবিতা-ভাষার বা আরও ব্যপ্তি দিয়ে বলা যায় বাংলা কবিতার বীজ । কেননা কবির একমাত্র অস্ত্র অক্ষর । এই অক্ষরে শাণ দিয়ে তাঁর প্রতিবাদী কবিতাগুলিকে তিনি রচনা করেছেন ।

কবি বলেছেন, ‘নিজের সই জাল করে চালিয়ে দিলুম গোটা শীতকাল’ । কবি বা যেকোনো মানুষের সই তারই আরও এক পরিচিতি । আরও এক বৈধ উপস্হিতি । আমারই ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট থেকে টাকা তুলতে গিয়ে কতোবার একটা প্রশ্নের মুখোমুখি হয়েছি –’অ্যাকাউন্টটা আপনার তো ?’ চেকের পেছনে আমারই দুটো সই । তবু কাউন্টারের মেয়েটির সন্দেহজনক নির্দেশ ‘সই করুন’ অর্থাৎ তার সামনে সই করলে সে মিলিয়ে দেখবে সই । তবুও সন্দেহ থেকে গেলে চেকটি সিগনেচার ভেরিফিকেশানের বইতে লিখে পাঠিয়ে দেবে উপযুক্ত আধিকারিকের কছে । যাতে ‘আহ্মি’ আমি থেকে আমরা হয়ে ওঠার যাত্রা সম্পূর্ণ করে । অতএব কবির এই উক্তি: নিজের সই জাল করে চালিয়ে দিলুম গোটা শীতকাল’।

কবি বলেছেন, ‘স্ত্রীলোকদের পা-এ চলা রাস্তার গন্ধ শুঁকতে-শুঁকতে আমি এগিয়ে যাচ্ছি তাদের অ্যামেচার আস্তানার দিকে ।/অন্ধকার রাস্তার ওপর পায়ের ছাপ দেখে আমার বুক ছাঁৎ করে উঠেছিল!’ কবিতার এই কয়েকটি লাইনে কবি জীবজগতে ক্রমবিকাশের ধারাকে পুনঃস্মরণ করেছেন । এ ধরণের আচরণ আমরা দেখতে পাই মনুষ্যেতর প্রাণীদের মধ্যে, যেমন পুংবিড়াল পথ শুঁকতে শুঁকতে এগিয়ে টের পেয়ে যায় তার সঙ্গিনী স্ত্রীবিড়ালটি কোন দিকে গেছে । সহজাত এই বোধগুলিকে চারপেয়ে জীবন পেরিয়ে দু-পায়ে দাঁড়ানো মানুষ ধরে রেখেছে তার দশবিধ অনুষ্ঠানগুলির মাধ্যমে । যেমন বিবাহের মাধ্যমে দাম্পত্যজীবনের দোরগোড়ায় দেখা যায় একটি নারী দুধ-আলতায় পা দিয়ে পদচিহ্ণ রেখে রেখে ক্রমশ প্রবেশ করেন স্বামীর ঘরসংসারে, যা সেই মুহূর্ত থেকে তার নিজের বসতবাটি । তার ছেড়ে আসা সংসারকে বিদায় জানান নানা আচার-উপাচারের মাধ্যমে । নতুন সংসারে সে ঘরণী হয়ে উঠবে । সকলের চোখের সামনে একদিন তারই দক্ষতায় পেতে ফেলবে তার নিজের নতুন সংসার । মলয় রায়চৌধুরী স্ত্রীলোকের দাম্পত্যজীবনের পথ টের পাচ্ছেন, যাকে কখনই বিমূর্ত বলা যাবে না । আমাদের সহজাত বোধে, ডি.এন.এ.-এর পটচিত্রে জীবনের এই জার্নিগুলি খোদাই করা আছে । বোধবিজ্ঞানে দেখা যায় এই ধরণের বোধগুলিকে সেনসডেটাম ( Sense-datum ) বলা হয়েছে । যা কবিতা লেখার সময়ে একজন পরিণত কবি যখন তাঁর বোধের গভীরে ডুব দেন, সহযাত্রী হয়ে ওঠেন কবিতার গতিবেগের সঙ্গে, তখন স্বতঃস্ফূর্তভাবে জীবন ও জৈব, প্রকৃতি ও প্রকৃত একাকার হয়ে ওঠে । মলয় রায়চৌধুরীর কবিতার যারা নিয়মিত পাঠক, তাঁরা লক্ষ্য করেছেন তাঁর কবিতায় এমনই সব মহাজাগতিক ও একই সঙ্গে লোকায়ত সব মুহূর্তগুলিকে ।

কবি ‘অ্যামেচার’ শব্দটি প্রয়োগ করেছেন আস্তানার বৈশিষ্ট্যরূপে । অ্যামেচার অর্থাৎ যার মধ্যে রয়েছে ইচ্ছাকৃত দ্বৈত সহজাত বোধ । কেননা যিনি স্ত্রীলোকের পায়ে-চলা রাস্তার গন্ধ শুঁকতে শুঁকতে অ্যামেচার আস্তানার দিকে এগিয়ে চলেছেন তিনি, একদিকে ঐ আস্তানার রক্ষাকারী আবার বিড়াল দিয়ে ব্যাখ্যা করলে দেখা যাবে নবীন হুলোটিকে প্রবীণ হুলো খেয়ে ফেলেছে । আবার মানুষ দিয়ে ব্যাখ্যা করলে বলা যায় পঞ্চাশ দশকের কবি ষাট দশকের প্রজন্মের কবিকে সোনার কাঠি হস্তান্তর করে দিতে বাধ্য হচ্ছেন । জীবন দিয়ে ব্যাখ্যা করলে বলা যায়, আগন্তুক ডোর বেল বাজিয়ে ‘কাজী কোথায়…কাজীকে চাই..’ বলছে, তখন সে কাজী সামসুদ্দীনকে না ডেকে বরং কাজী বদরুদ্দীনকে ডাকছে, যার ডাক নাম ‘সানু’, যে ছেলেটির বন্ধু, অর্থাৎ এই ডাকটির মধ্যে দ্বৈততা আছে । দ্বৈরাজ্য রয়েছে ।

কবি বলেছেন, ‘সাঁতার না জেনেও নৌকায় পার হয়েছি মরে যাবার ভয়/আমাকে ধিক্কার দেওয়া যায়, আমাকে উপেক্ষা করা যায় না/ঈশ্বর যন্ত্রস্হ’। তারপর বলেছেন,

আমি ভুল গর্ভ থেকে নেবে ভুল নাম নিয়ে ঘুরে বেড়ালুম ২৫ টা বছর

ভুল ইচ্ছে থেকে পেয়েছি ভুল দ্বেষ

ভুল সুখ থেকে ভুল দুঃখ পেয়ে মেজাজ খারাপ হয়ে গেল

আমি ভুল সংঘাত থেকে জড়ো করেছি ভুল চেতনা

আহ এ ভুল কোল্কাতা এ ভুল মানুষমানুষী

ভুল দম্ভ থেকে তৈরি করেছি ভুল হিংসে

আমি ভুল শৌচকাজ থেকে জেনেছি ভুল সরলতা

ভুল সংযম আমাকে এনে দিয়েছে ভুল বিরাগ

আমি ভুল অহংকার নিয়ে ভুল ভিড়ের কাছে চলে গেছি

আমি ভুল ভক্তি নিয়ে যে কোনো কারুর খোঁজে জেগে বসে রইলুম সারারাত

ভুল স্বপ্ন দেখে ভুল জায়গায় স্ত্রীযন্ত্রের বদলে পেলুম অশ্বথ্থের পাতা

ভুল শিক্ষা থেকে ভুল সুনাম পেয়ে কব্জির শিরা ছিঁড়ে ফেলে দিলুম

আমি ভুল নারীর পায়ের ওপরে রেখেচিলুম আমার নির্ভুল ভালোবাসা

 

জীবনের সমস্ত ঘটমানতার মধ্যে রয়েছে অনিশ্চয়তার আনন্দ । সাঁতার না জেনে আমরা অনেকে নদী পার হয়েছি । ভয়, ভয় তবু শেষাবধি নির্ভয়কে পেয়েছি তীরে নেমে । পরপর কতগুলি পংক্তিতে সাঁতার না জেনে তবু নদী পার হওয়ার সাদৃশ্য রচনা করেছেন কবি । এই সাদৃশ্য রচনার মধ্যে রয়েছে অনিশ্চয়তার আনন্দকে ভোগ করার থ্রিল । সম্প্রতি পুজো সংখ্যায় বিজ্ঞাপন বেরিয়েছে –’যন্ত্রস্হ’ হাংরি জেনারেশন সংকলন । কে জানে কেমন হবে, কাদের ব্যাপার — সেও এক অনিশ্চয়তা ।

মানুষ ডাঙার প্রাণী ( টেরেসট্রিয়াল ), ফলে জলে বা আকাশে টেরেসট্রিয়াল সারাক্ষণই এক অনিশ্চয়তার আনন্দ তাকে বিহ্বল করে রাখে । অথবা বলা যায়, গ্যেদেলের অসম্পূর্ণতার তত্ব যেমন অনিশ্চয়তার আনন্দের কাছ্কাছি, তবু সমান্তরাল । এ পর্যন্ত কবি যাকিছু বলেছেন, তারপর একটিমাত্র শব্দ ‘আহ’ উচ্চারণ করে কবি পা রেখেছেন জীবনপর্বের পর্বান্তরে —’আঙুলগুলো হৃদয়ের সঙ্গে সেলাই করে রেখেছিলুম ২৫ বছর’। আবেগ অর্থে কবি প্রয়োগ করেছেন ‘হৃদয়’ শব্দ । আঙুলগুলো হৃদয়ের সঙ্গে সেলাই করে রেখেছিলেন যাতে আবেগতাড়িত না হয়ে যান । ২৫ বছর, অর্থাৎ যখন মস্তিষ্ক পরিণত হয়ে কাজ করতে আরম্ভ করে—চিন্তাভাবনায় পা রাখে । যখন কবি টের পান, ‘মাসিক ২৮৭.৭৫ টাকা ভাড়ায় আমাকে খাটিয়ে নিলো জমিদারি নিলামের চোথাপত্তর’।

আত্মবিশ্লেষণ থেকে এসে এই পথম কবি সেই সময়ের ব্যবহারিক জীবনকে তুলে ধরেছেন । রিজার্ভ ব্যাঙ্কে কিছুদিন চাকুরি করার সময়ে তাঁর মাসিক বেতন ছিল ২৮৭.৭৫ টাকা । সেই সময় জমিদারি প্রধা বিলোপের পর তার পরিবর্তে সরকার বণ্ড ইশ্যু করেছিল ; এইসব বণ্ডে তিনি নাম লিখতেন, তাঁর হাতের লেখা মুক্তের মতন ছিল বলে । পরে তিনি পাটনার রিজার্ভ ব্যাঙ্ক ছেড়ে চলে যান লখনউয়ের অ্যাগ্রিকালচারাল রিফাইনান্স অ্যাণ্ড ডেভেলপমেণ্ট কর্পোরেশন’-এ । নতুন চাকুরির জন্য ইনটারভিউ গ্রহণকারীরা উদ্ভট সব প্রশ্ন করেছিলেন । মলয় লিখেছেন, ‘আমি খালি পেটে ইনটারভিউ দিতে গিয়ে বলে এলুম অর্থমন্ত্রীর কাকিমার নাম’ । কবি অন্ধকার পর্ব থেকে বেরিয়ে এলেন । বেরিয়ে আসার মুহূর্তটি ইতিপূর্বে এইভাবে বলেছেন, ‘অন্ধকারে নিজের সঙ্গে নিজে ধাক্কা খেয়ে আমাকে জাপ্টে ধোর্লুম অন্ধকারে নিজেকে দেখে চমকে উঠলুম’।

এর পর প্রায় আট পৃষ্ঠা জুড়ে দেখা যাবে কবি তাঁর সঙ্গ, আসঙ্গ, পপেম, পরকীয়া সমাজ, রাষ্ট্র, রাষ্ট্র পরিচালক, নিজের আর্থিক, রাজনৈতিক যাপনের পর্যবেক্ষণ থেকে উঠে আসা জীবনের নানা এলাকায় তুলনামূলক খুঁটিনাটি বিচার-বিশ্লেষণ করেছেন । বাদ যায়নি জীবনের কোনও এলাকার শৃঙ্খলা, বিশৃঙ্খলা। হাংরি আন্দোলনকারীদের মধ্যে মলয় রায়চৌধুরী একমাত্র কবি যিনি সরাসরি রাষ্ট্রকে, রাজনৈতিক দলকে, প্রতিষ্ঠানকে অবিরাম আক্রমণ করেছেন । তিনি জন্মসূত্রে পাটনা শহরের ইমলিতলা নামের এক এঁদো বস্তির বাসিন্দা, তাদের অবস্হান দারিদ্র্যসীমার নীচে, সমাজের সবচেয়ে নীচু ধাপের মানুষ, আবার একজন সমাজে শিক্ষিত হবার সব সুযোগ সুবিধা পেয়েছেন, ফলে তাঁর অবস্হান তুলনামূলকভাবে উঁচুতে । তিনি যেসব কথাবার্তা বলেন, এবং বিশ্বাস রাখেন সেই সব সামাজিক বিশ্লেষণে, বৈশ্লেষিক দৃষ্টিকোণে তাঁর সঙ্গে ইমলিতলার এঁদো বস্তির বাসিন্দাদের ধ্যানধারণা মেলে না । আমরা যতই মনে করি যে, উঁচু তলার চিন্তকদের ভাবনা তাদের কাছে পৌঁছে দেওয় যাবে, এবং তাদের কাছে অর্থবহ হয়ে উঠবে, এবং একটিমাত্র ঐক্যমতের পরিসর সৃষ্টি করা যাবে, বস্তুত বাস্তব জগতে তা সম্ভব হয়ে ওঠে না । কেননা এই দুই অবস্হানপন্নতার মধ্যে কোনও লেভেল প্লেইং ফিল্ড বিরাজ করে না । চিন্তক মানুষটির কথাবার্তা এঁদো বস্তির মানুষদের কাছে ফোঁপরা, অসার এবং তাচ্ছিল্যের স্রেফ বুকনি। মলয় তাই বলেছেন, বিশ্বভাতৃত্ব শিখে এঁদো বস্তিতে ফিরে যাচ্ছে মানুষ’। ঠিক এমনই একটি পংক্তি মলয় উপস্‌আপন করেছেন পরবর্তী পৃষ্ঠায় পরাবাস্তব আঙ্গিকে, ‘কোল্কাতার আকাশ দিয়ে এখন সমাজকল্যাণ কমিটির কাগজপত্তর উড়ে যাচ্ছে’ । আবার, আরেকটি পরাবাস্তব দৃশ্যকল্পে বলেছেন, ‘আমারই নিজের বাড়ির খোঁজে আমি রাস্তায় রাস্তায় ২৫ বছর ঘুরে বেড়ালুম/বসতিবিরল এঁদো গলির মাটিতে ছড়ানো/অজস্র ধবধবে পাশবালিশ ডিঙিয়ে আমি হেঁটে যাচ্ছি।’

নিজেরই বাড়ির খোঁজে, বলাবাহুল্য আত্মানুসন্ধানের বহুত্বময়তায়, কবি ২৫ বছর ঘুরে বেড়িয়েছেন বসতিবিরল এঁদো গলিতে, যার গন্তব্য ইমলিতলার মানুষেরা । বাসিন্দাদের পরিস্হিতি এমন যে, যেকোনও স্পেসই তাদের কাছে দুর্লভ । কোনও রকমে কাজ চালাবার মতো সরু অন্ধকারাচ্ছন্ন বিজলিহীন স্যাঁতসেতে গলি। এঁদো শব্দটির উৎপত্তি ‘আধুয়া’ থেকে । এই স্পেস দখলের প্রসঙ্গ উঠে এসেছে ফুটপাথের যৌনকর্মীদের গলায়, চৌরঙ্গির থামগুলোতে পিঠ-ঠেশে দাঁড়াবার জন্যে জায়গা কাড়াকাড়ি করছে রঙবেরঙ বেশ্যারা’— তাঁর মামলার সময়ে মলয় রায়চৌধুরী রাতের কলকাতায় ঘুরে বেড়িয়েছেন এবং বহু দৃশ্যকল্প উঠে এসেছে সেই অভিজ্ঞতা থেকে। স্পেস বা পরিসরের চলমান ভিড় প্রসঙ্গে এমনই একটি উক্তি, ‘গাদাগাদি কোরে বিয়োতে বিয়োতে গাঁ-মাঠ-পরগণার দিকে ছুটে যাচ্ছে কোল্কাতা ।’ এর ফলে কলকাতার পিনকোড শুধু বাড়ছে না, বাড়ছে শহুরে সংস্কৃতির গ্রামের পর গ্রাম দখলের হাঁ-মুখ এবং প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের সম্পর্কের আত্মবিচ্ছেদ । বাড়ছে প্রোমোটার ও সিন্ডিকেট রাজ্যের ছোবল ।

রূপান্তর বিষয়টিকে সহজবোধ্য  করার জন্য এবং সমাজের বজ্রআঁটন ফাঁস করার জন্য মলয় একটি প্রাঞ্জল পংক্তি রচনা করেছেন—’গাছের গায়ের ভেতরে লুকিয়ে রয়েছে খিল, দেরাজ, ফাঁসিকাঠ’ । এমনই একাধিক আপাতসরল অথচ পরাবাস্তব পংক্তি পাঠক চি্‌ণিত করতে পারবেন ‘জখম’ কবিতার প্রসঙ্গ থেকে প্রসঙ্গান্তরে, লেভেল জাম্পিং করে এগিয়ে গেছে চিত্রকল্পের পর চিত্রকল্প, গড়ে তুলেছে লজিকাল ক্র্যাক, পংক্তির রাইজোম । মলয় লিখেছেন, ‘মাটির ভেতরে আকরিক লোহার বুকে ঘুমোচ্ছে রাইফেলের ডাঁটি ডিজেলরোলার/মাটির ভেতরে সীসের মগজে ওৎ পেতে আছে সংবাদ পত্রিকার ‘হ্যাঁ’ কিংবা ‘না’। আবার যেমন, ‘আমি জেনেছি খাদ্য জিনিসের মধ্যেই ১সঙ্গে লুকিয়ে থাকে রক্ত আর পুঁজের অ্যাকালষেঁড়ে রঙ’ । সবচেয়ে অভিনব রূপান্তর, ‘প্রশান্ত মহাসাগরের আকরিক মাটি ১টা নির্দিষ্ট দূরত্বে গিয়ে চাঁদ হয়ে গেল।’

মলয় রায়চৌধুরীর ‘জখম’ কবিতাটি  রূপান্তরের সন্ধিক্ষণকে চিহ্ণিত করেছে ; তারপরেই পশ্চিমবাংলায় দেখা দিয়েছিল নকশাল আন্দোলন । মলয় যেন আগাম জেনে গিয়েছিলেন । ঐ একই উদ্ধৃতিতে ধুমকেতুর চোট-গহ্বর প্রসঙ্গে উল্লেখ করা হয়েছে । বস্তুত এই দ্বৈততা বা দ্বৈরাজ্য যেমন কবির জীবনের তেমনই পশ্চিমবাংলার সমাজরাষ্ট্রের এক পর্বান্তর । যেজন্য পাঠক কবিতাটির দোলাচলের সঙ্গে নিজেকে রিলেট করতে পারে । নিজের ব্যক্তিগত সংকটের সঙ্গে, সমাজ-সংসারের সংকটের অগ্নিময় সম্পর্ক কবিতাটি দাঁড় করাতে পেরেছে নিজের অবস্হানের যুক্তি । একজন রক্তাক্ত মানুষ কেমন করে ঘুরে দাঁড়ালেন, একা লড়ে গেলেন ও জিতে গেলেন, তা বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস ।

এইভাবে যখন মলয় রায়চৌধুরীর ‘কবিতাসমগ্র ( ১৯৬১ – ২০০৪ )-এর মুখোমুখি হন একজন পাঠক, তখন ‘মেধার বাতানুকূল ঘুঙুর’ কাব্যগ্রন্হের ঢের আগে তিনি তাঁর কবিতার স্বপক্ষে পাঠকের সন্মতি আদায় করে নিয়েছেন । মলয় রায়চৌধুরীর বহু আলোচক বলেছেন, ‘জখম’ একটি টার্নিং পয়েন্ট, শেষ আধুনিক টেক্সট। মলয় যখন আবার মঞ্চে আসীন হলেন ও অনেকের মনে পুনরায় ভীতির সঞ্চার করলেন, তখন তিনি অধুনান্তিক, পোস্টমডার্ন, উত্তরাধুনিকের নবাঞ্চল-সন্ধানী, এবং এই চি্‌হ্ণগুলির মাধ্যমে পাঠকৃতিকে সনাক্ত করতে চেয়েছেন, তখন মনে হয়েছে ‘জখম’ হলো জংশন স্টেশনের সকাল । চেঞ্জওভার । কবিতাটি প্রসঙ্গে  বাংলাদেশের আলোচক নুরুদ্দীন জাহাঙ্গীর বলেছেন, ‘জখম’ পড়তে গিয়ে আমাদের পিকাসোর গোয়ের্নিকার কথা মনে পড়ে । কবিতাটিতে সংখ্যার খেলা বা ডিজিটাল গেম লক্ষণীয় । কলকাতা থেকে লক্ষ-লক্ষ মনিঅর্ডার ফর্ম ও টাকা প্রতিনিয়ত বাইরে চলে যাচ্ছে তার এক পরাবাস্তব ছবি এঁকেছেন মলয় । আবার যখন নিজের কথা বলছেন তখন তিনি সংখ্যা বা ডিজিটকে কম করে দিয়েছেন, যেমন, ‘খিল আর ছিটকিনির কাছে বসে শিখে এলুম আত্মপরিত্রাণ/পুরোপুরি ৪দিন গুম মেরে থেকে আমার গলা ভেঙে গেল’।

সংখ্যা বা ডিজিটের ব্যাপারটি যে খাঁটি বা পিওর, সেটি আরও স্পষ্ট হয় যখন কারও কাছ থেকে একটি চেক বা ড্রাফ্ট পাই । শব্দে লেখা থাকে পাঁচ হাজার তিনশত আটত্রিশ টাকা মাত্র । আবার সংখ্যাতেও নির্দিষ্ট জায়গায় লেখা থাকে ৫৩৩৮। আবার ৫৩৩৮-কে আরও খাঁটি করে তোলার জন্য প্রাপ্ত চেকে বা ড্রাফ্টে লেখা থাকে ৫৩৪০-এর থেকে কম । শব্দ ও সংখ্যার মধ্যে যদি তুলনামূলক বিচার করা যায়, তাহলে দেখা যাবে সংখ্যা ঢের বেশি ডিটারমিনিস্টিক ( নির্ধারণাত্মক বা নির্দিষ্টতাবোধক ) । সম্পাদক তুহিন দাস ‘ক্যাম্পে’ নামে একটি চটি পত্রিকার ‘জখম’ সংখ্যা প্রকাশ করেছিলেন আগস্ট ২০১৩ সালে বাংলাদেশের বরিশাল থেকে । এই পত্রিকায় লিখেছিলেন নুরুদ্দিন জাহাঙ্গীর, অনুপম মুখোপাধ্যায়, জাহিদ সোহাগ, রিঙ্কু অনিমিখ, মিছিল খোন্দকার এবং তুহিন দাস । কবিতাটির নানা দিক আলোচনা করেছেন তাঁরা । এঁদের সব বক্তব্যের সঙ্গে আমি একমত নই। আবার তাঁদের অনেক মন্তব্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ, উল্লেখযোগ্য ।

মানুষ ডাঙার প্রাণী — আগেই বলা হয়েছে, যার প্রথম রূপ জল ও স্হলের সংযোগে শৈবাল । একটি বহুত্বময়তা থেকে একের সন্ধানী এই অস্তিত্ব । এখানে কার্যকর রয়েছে জল, স্হল, স্রোত, সংঘর্ষ এবং সূর্যালোক । জলের মধ্যে রয়েছে জলভাগ ধুয়ে আসা লবণ । এই এককের সন্ধান ধাপে ধপে নানা ক্রমান্বয়ের মাধ্যমে আজকের ‘আমি’তে পৌঁছেছে । সংখ্যা, বহুত্বের বা ‘মেনি’র প্রশ্রয়ে পবিত্র, মহান, স্রেফ কবির ব্যক্তিপ্রতিস্ব নয় । তুহিন দাস মলয় রায়চৌধুরী সম্পর্কে উৎপলকুমার বসুর এই কথাগুলি তুলে ধরেছেন যা ‘হাওয়া৪৯’ পত্রিকার এপপিল ২০০১ সংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছিল । উৎপলকুমার বসুর রচনাটি, মলয়ের সাহিত্যভাবনাকে জীবনের প্রেক্ষিতে সম্পূর্ণ খোলসা করেছিলেন :-

 

“তিনি ছয়ের দশকে লিখতে শুরু করেন । তিনি সাহিত্যিক নন । অর্থাৎ ‘সাহিত্যের সেবক’ বললে আমাদের স্মরণে যে-ছবিটি ভেসে ওঠে, তাঁকে সেই শ্রেণিতে ফেলা যাবে না । বাংলা সাহিত্য তাঁর হাতে যতটা না পূজিত হয়েছে, আক্রান্ত হয়েছে তার থেকে অনেক বেশি । মলয় রায়চৌধুরী অস্ত্র-শস্ত্রে সজ্জিত হয়েই যুদ্ধে নেমেছিলেন । তাঁর তাত্বিক প্রস্তুতি ছিল । এবং তথাকথিত বাংলা ‘সংস্কৃতি’র ঘরে তাঁর লালন পালন নয় বলে ওই কালচারের পিঠভূমিগুলিকে অবজ্ঞা করার মতো দুঃসাহস তিনি দেখিয়েছেন । বাংলা আধুনিক কবিতার প্রসঙ্গটি নিয়ে যদি ভাবা যায়, তবে দেখব, জীবনানন্দই সেই অঞ্চলের প্রধান পুরুষ। তাঁকে পেছনে ফেলে এগিয়ে না গেলে পরবর্তী একটা নতুন যুগের পত্তন হওয়া সম্ভব ছিল না । জীবননন্দ কয়েকটু উপাদানকে অবলম্বন করেছিলেন। যেমন অভিনব ইমেজ বা চিত্রকল্পের ব্যবহার, মহাজাগতিক সচেতনতা, মানুষের উদ্যম ও প্রচেষ্টার প্রতি তীব্র অবজ্ঞা এবং সংশ্লিষ্ট আরও কয়েকটি গৌণ বিষয় । মলয় রায়চৌধুরী ও তাঁর প্রজন্মের লেখকদের ওই পাঠশালাতেই হাতেখড়ি হয়েছিল । কিন্তু অল্প কিছুদিনের মধ্যেই তাঁদের অন্য ধরণের পথসন্ধান শুরু হয় । বাংলা সাহিত্যের প্রধান ধারাটি একপ্রকার স্হিতাবস্হায় পৌঁছে গিয়েছিল । তার বাঁধ ভেঙে দেওয়া ছাড়া উপায় ছিল না । তিনটি উপন্যাস ও স্মৃতিচারণেও মলয় রায়চৌধুরীর ওই আক্রমণকারী প্রবণতা লক্ষ্য করি । কথা প্রসঙ্গে তিনি একবার বলেছিলেন, ‘লেখা রাজনীতি ছাড়া আর কী হতে পারে।’

বলাবাহুল্য, তিনি দলীয় বা সংসদীয় রাজনীতির কথা বলেননি । তিনি বলেছেন, ‘পলিটির’ কথা । আমরা সবাই মিলে কীভাবে থাকব, মলয় রায়চৌধুরী তারই একটা বোঝাপড়ার দলিল তৈরি করেছেন ।

 

‘জখম’ কবিতা নিয়ে চমৎকার আলোচনা করেছেন রিঙ্কু অনিমিখ । তিনি বলেছেন, ‘জখম’ কবিতার “পাঠগতি যেন এক ছুটন্ত রেলগাড়ি যার প্রতিটি স্লিপারে ঘাত-প্রতিঘাত । অথচ তা পাঠগতিকে আরও বাড়িয়ে দিচ্ছে । তিনি আরও বলেছেন, চেতনানিঃসৃত উপলব্ধির এ যেন এক অনির্দেশ্য যাত্রা । হাংরি আন্দোলনের কাব্যময় চেতনার এক দীর্ঘ ইস্তাহার । কবি লাগাতার বেপরোয়া অথচ যথোপযুক্ত শব্দ ব্যবহার করে চলেছেন। কবিতটি অর্গানিক, যার অস্তিত্ব  মস্তিষ্কে জারিত হবার পর চেতনায় অধিষ্ঠিত হয় । কবির অপূর্ব নির্মাণক্ষম প্রজ্ঞা বা ক্রিয়েটিভ নুয়ান্সের অনর্গল স্ফূর্তি ও প্রাঞ্জল বিচ্ছুরণ ঘটছে ভাষার মাধ্যমে । ভাষাটি কবিতকে ফিজিকাল কাঠামোর ভিতর দিয়ে সাইকোলজিকাল নিরাবয়বে পৌঁছে দেয় । যার বাহুর ঘের যতো বেশি প্রস্তুত তার ভাষা সংগ্রহ তত বিপুল । কবির হাতে পোয়েটিক লাইসেন্স ; তিনি যে কোনো স্হানে কলম চালিয়ে শব্দ দখলে স্বাধীন । বৈচিত্র্যময় অর্থ-বিশিষ্ট ব্যবহারযোগ্য শব্দকে পৃথক প্রয়োজনে বহুবিভক্ত করেছেন কবি । অর্থাৎ প্রত্যক্ষ ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য, ইন্দ্রিয়বেদ্য,ইন্দ্রিয়াশ্রয়ী, মানসগ্রাহ্য, অনুভব সংবেদ্য ইন্দ্রিয়তীত, ব্যঞ্জনাশ্রয়ী, ইন্দ্রিয়নির্ভর অথচ মনোগ্রাহী, রূপাশ্রয়ী অথচ অনুভব-সংবেদ্য ।”

মলয় রায়চৌধুরীর প্রধান সাংগঠনিক কাজ নিজস্ব শিল্পগড়ন অনুধাবন করে প্রকাশের যথোপযুক্ত সাংগঠনিক কাব্যভাষা নির্মাণের জন্য নিরাকার অথচ অনস্বীকার্য ‘সৎ-চিৎ-আনন্দ’-লাভ অর্জনে মর্মার্থসম্পন্ন শব্দকে নির্বাচন ও প্রয়োগ জরুরি । রিঙ্কু অনিমিখ মনে করেন, ‘জখম’ কবিতার পপত্যেক পংক্তির স্ফূলিঙ্গ এক একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ কবিতার দাবী করে । প্রত্যেক শব্দের অর্থময়তার মধ্যে ঢুকে রয়েছে শক্তি ও জনশক্তির সমার্থকতা ।

হাংরি আন্দোলনের কুড়ি বছর পর, অর্থাৎ ‘জখম’ প্রকাশের বাইশ বছর পরে প্রকাশিত হয়েছিল মলয় রায়চৌধুরীর কাব্যগ্রন্হ, ১৯৮৭ সালে, ‘মেধার বাতানুকূল ঘুঙুর’, কবি-প্রকাশক উত্তম দাশের উদ্যোগে । প্রচ্ছদ এঁকে দিয়েছিলেন যোগেন চৌধুরী । ‘মেধার বাতানুকূল ঘুঙুর, কাব্যগ্রন্হের এবং তার পরের কবিতার বইগুলোর কাব্যশৈলী মলয় প্রতিবার বদল করেছেন । এই সময়ে তিনি অনুবাদ করেছেন উইলিয়াম ব্লেক, র‌্যাঁবো, পাবলো নেরুদা, জাঁ ককতো, অ্যালেন গিন্সবার্গ, ত্রিস্তান জারা প্রমুখের কবিতা, লিখেছেন বহু প্রবন্ধ । ‘জখম’ এবং ‘প্রচণ্ড বৈদ্যুতিক ছুতার’ ছিল আধুনিক টেক্সট । এরপর মলয় অধুনান্তিকতার নবাঞ্চল অভিমুখী হলেন । নবাঞ্চলের পরিসরে রচিত কবিতাগুলির উৎসভূমি মলয় ব্যাখ্যা করেছেন তাঁর ‘অ’ বইতে ।

যেমন ‘আলো’ শিরোনামের কবিতায় আলোর অর্থ নঞর্থক । অর্থাৎ অন্ধকার । হাজতে যেমন থার্ড ডিগ্রি টরচার-এ আলো ব্যবহার করা হয়, যাতনা দেবার জন্য, যা আলোকপ্রাপ্তি বা এনলাইটেনমেন্ট নামক কান্টীয় তত্বের বিপরীত, নেতিবাচক । মলয় জানিয়েছেন যে, লখনউতে এ.আর.ডি.স.তে চাকরি করার সময়ে তাঁকে গ্রামেগঞ্জে ঘুরে বেড়াতে হতো । সেসময়ে দেখেছিলেন ওরাই থানায় ডাকাত সন্দেহে এক গরিব চাষিকে ধরে এনে অন্ধকারে বসিয়ে রেখে মাঝে মাঝে হঠাৎ আলোর ছ্যাঁকা দিয়ে, তার বোধশক্তি বিবশ করে দেওয়া হয়েছিল । প্রসঙ্গত, সেই এলাকায় চব্বিশ ঘণ্টা বিদ্যুৎ থাকত না, তারা অন্ধকারে অভ্যস্ত । ফলে দ্রুত বারবার আলোকিত করবার যাতনায় পরের দিন লোকটি স্নায়বিক অবসাদে মারা যায় । ‘আলো’ নিজেই বোলিমক্রিয়া বা ইনভারশানের দরুণ নিজেই অন্ধ ।

এই একই বিষয়কে অধুনান্তিকতার নানা পারিভাষিক পরিসরে নিয়ে গিয়ে ব্যাখ্যা বা বিশ্লেষণ করা যেতে পারে : ১) আলো দ্যোতকটি দ্যোতিত করছে ভাষা-উত্তর বাস্তবতাকে ; ২) বিষয়টি বস্তুত কমপ্লেকসিটি বা জটিলতায় আকীর্ণ আর এখানেই কবিতাটির কবিত্ব ; ৩) দ্যোতকের পূর্ব অবস্হান থেকে সরে এসে প্রথাবাহিত সাংস্কৃতিক অনুমানগুলিকে বর্জন করে ; ৪) বদলেয়ার বা জীবনানন্দের ধরতাই বা তর্ককে প্রত্যাখ্যান করে এবং ৫ ) যার ফলে কবিতাটি উত্তরাধিকার মুক্ত ।

‘মেধার বাতানুকূল ঘুঙুর’ বইয়ের বেশ কিছু কবিতায় রেনে দেকার্তের ‘কজিতো এরগো সাম’ তত্বকে চ্যালেঞ্জ জানিয়েছেন মলয়, যৌক্তিকতার কাব্যিক তত্বকে গোড়ায় নস্যাৎ করে । কোথাও প্রয়োগ করেছেন ব্রায়ান জিসিন টেকনিক, উন্মুক্ত সূচনা, উন্মুক্ত সমাপ্তি । কবি লক্ষ্য করেছেন কলকাতা শহরে শিকড়হীনতার উৎসবে মেতে থাকে মানুষ । ফলে তাঁর কবিতায় ‘আমি’ একটি সমস্যার কেন্দ্র । সমাসাময়িক রাজনীতির সমস্যা একটাই ব্যক্তিমানুষের অস্তিত্ব জবরদখল । মানুষকে তুলে নিয়ে গিয়ে জীবন্ত পুঁতে ফেলা হয়েছে পশ্চিমবাংলায়, মার্কসের দোহাই দিয়ে । ‘মেধার বাতানুকূল ঘুঙুর’ গ্রন্হের থিম সন্ত্রাস হলেও মলয় চেষ্টা করেছিলেন মেটাফরের জটিলতা বর্জন করতে ।

মলয় পুনরায় ফিরে গেছেন প্রেমের কবিতায় । কিন্তু এই প্রেম ‘প্রচণ্ড বৈদ্যুতিক ছুতার’-এর প্রেম নয় । তাঁর দুটি সাম্প্রতিক প্রেমের কবিতা পড়লে নবাঞ্চলের বিস্তার কীভাবে ঘটিয়েছেন কবি তা স্পষ্ট হয় :-

বুড়ি

এই বুড়ি আমার দিদিমার বয়সী

চুল পেকে গেছে, কয়েকটা দাঁত

নেই, দিদিমার মতন শুয়ে থাকে

কবে শেষ হয়ে গেছে পুজো-পাঁজি

ক্যালেণ্ডারে ছবি-আঁকা তিথি

দিদিমার মতো এরও প্রতি রাতে

ঘুম পায় কিন্তু আসে না, স্বপ্নে

কাদের সঙ্গে কথা বলে, হাসে

চোখে ছানি তবু ইলিশের কাঁটা

বেছে ঘণ্টাখানেকে মজে খায়

দিদিমার মতো বলেছে, মরবে

যখন, চুড়ি-নাকছাবি খুলে নিয়ে

তারপরে আলতা-সিঁদুর দিয়ে

পাঠাতে ইনসিনেটরে, এই বুড়ি

চল্লিশ বছর হলো সিঁদুর পরে না

পঞ্চাশ বছর হলো শাঁখাও পরেনি

দামি দামি শাড়ি বিলিয়ে দিয়েছে

দিদিমা যেমন তপ্ত ইশারায়

দাদুকে টেনে নিয়ে যেতো রোজ

এও আমাকে বলে, এবার ঘুমোও

আর রাত জাগা স্বাস্হ্যের পক্ষে

খারাপ, এই বুড়ি যে আমার বউ

বিছানায় শুয়ে বলে, কাউকে নয়

কাউকে দিও না খবর, কারুক্কে নয়

একথাটা আমারই, কাউকে নয়

কারুক্কে বোলো না মরে গেছি ।

 

মাথা কেটে পাঠাচ্ছি, যত্ন করে রেখো

মাথা কেটে পাঠাচ্ছি যত্ন করে রেখো

মুখ দেখে ভালোবেসে বলেছিলে, “চলুন পালাই”

ভিতু বলে সাহস যোগাতে পারিনি সেই দিন, তাই

নিজের মাথা কেটে পাঠালুম, আজকে ভ্যালেনটাইনের দিন

ভালো করে গিফ্টপ্যাক করা আছে, “ভালোবাসি” লেখা কার্ডসহ

সব পাবে যা-যা চেয়েছিলে, ঘাম-লালা-অশ্রুজল, ফাটাফুটো ঠোঁট

তুমি ঝড় তুলেছিলে, বিদ্যুৎ খেলিয়েছিলে, জাহাজ ভাসিয়েছিলে

তার সব চিহ্ণ পাবে কাটা মাথাটায়, চুলে শ্যাম্পু করে পাঠিয়েছি

উলঙ্গ দেখার আতঙ্কে ভুগতে হবে না

গৌড়ীয় লবণাক্ত লিঙ্গ কোনো স্কোপ আর নেই

চোখ খোলা আছে, তোমাকে দেখার জন্য সব সময়, আইড্রপ দিও

গিফ্টপ্যাক আলতো করে খুলো, মুখ হাঁ-করাই আছে

আমার পছন্দের ননভেজ, সন্ধ্যায় সিঙ্গল মল্ট খাওয়াতে ভুলো না

মাথাকে কোলেতে রেখে কথা বোলো, গিটার বাজিয়ে গান গেও

ছ’মাস অন্তর ফেশিয়াল করিয়ে দিও, চন্দনের পাউডার মাখিও

ভোর বেলা উঠে আর ঘুমোতে যাবার আগে চুমু খেও ঠোঁটে

রাত হলে দু’চোখের পাতা বন্ধ করে দিও, জানো তো আলোতে ঘুমোতে পারি না

কানে কানে বোলো আজও উন্মাদের মতো ভালোবাসো

মাথা কেটে পাঠালুম, প্রাপ্তি জানিও, মোবাইল নং কার্ডে লেখা আছে

সমরজিৎ সিংহ : মলয় রায়চৌধুরীর ‘মেধার বাতানুকূল ঘুঙুর’

মলয় রায়চৌধুরী কে ?

এই নিরীহ, আপাত শান্ত, সাদামাটা প্রশ্নের সামনে, আমাকে,  দুমিনিট, স্তব্ধ হয়ে বসে থাকতে হয় ; কেননা, একজন অশিক্ষিত পাঠক বলে, মলয় রায়চৌধুরীকে আমার জানা হয়ে ওঠেনি । দু-একটি সামান্য তথ্য আমি, একেবারেই ছিল না, তা নয় ; আবার, তাও জেনেছি ‘হাংরি সাক্ষাৎকারমালা’ এবং আমার দু-একটি ‘ছিটমহলবাসী’ হাংরি বন্ধুদের সৌজন্যে, তাদের দেওয়া বইপত্তর ঘেঁটে । একে কি, সত্যিই, জানা বলে ? আমি জানি না ।

সম্ভবত, ১৯৯০ বা তার আগে-পরে, কোনও এক সময়ে, কীভাবে যেন আমার হাতে এসে পড়েছিল মলয় রায়চৌধুরীর কবিতার বই ‘মেধার বাতানুকূল ঘুঙুর’ ( ১৯৮৭ ) । বইটির রচয়িতা আর কেউ নয়, মলয় রায়চৌধুরী, যাঁকে হাংরি কবি হিসাবে, আগরতলার এই ছিটমহলে, তখনও বেশ তোল্লাই দেওয়া হতো।

অবাক হয়ে লক্ষ্য করি, এই কবিতার বইয়ের ভাষা, ও মা ! এ তো বাংলা ভাষাই । পঞ্চাশের দশকে, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় যেভাবে মুখের ভাষাকে ঠাঁই দিতে চেয়েছিলেন কবিতায়, মলয়ও, ‘ইতর লেকসিকন’ ব্যবহার করে, নতুন করে গড়তে চাইছেন । তবে, ওই যে, সুনীলীয় ভাবে নয়। সুনীলকে কেউ-কেউ বাঁক বদলের সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে আছেন ভেবে, গুরুত্ব দিয়ে থাকেন ; এই তথ্য মলয়ের জানা ছিল কিনা জানি না ; তবু , তিনিও খুব সচেতনভাবে আপ্রাণ চেষ্টা করেছেন বাঁক বদলের, অন্তত এই বইতে । আমি বেশ মজা পাই এতে, এই সচেতন প্রয়াস দেখে ।

কবিকে নিজের শৈলী বানাতে হয়, এই ‘চালু চেতনার ফাঁদ’ থেকে নিষ্ক্রান্ত হতে গিয়ে, কীভাবে একজন সচেতন কবিতা-লেখক, ওই ফাঁদের ফাঁস গলায় পরে ছটফট করছেন, এটা লক্ষ্য করলে, মজা পাও্য়া যায় বৈকি! মলয়, ‘মেধার বাতানুকূল ঘুঙুর’-এ নাটুকেপনা বিস্তর করেছেন ; গিমিক বলা উচিত হবে কিনা, এ বিষয়ে সংশয় আছে বলে, আমি সেদিকে যাচ্ছি না ; তবে ওই যে নাটুকেপনা করতে গিয়ে যাত্রাপালার অভিনয়ে যা হয়ে থাকে, চিচিচকার, মলয়ের চিচিচকার, বড় বেশি কানে লাগে ; লাগে, তবে মর্মে বেঁধে না । এতদসত্বেও, ‘মেধার বাতানুকূল ঘুঙুর’ আমাকে চিন্তাগ্রস্ত করে তোলে, ভাষায় । মলয়ের সাহস ও শব্দ ব্যবহারবিধি আচ্ছন্ন করে রাখে বহুদিন :-

ফেরার সময়ে ওরা ঘিরে ধরে । ছসাতজন । প্রত্যেকেরই
রয়েছে কিছু-না-কিছু হাতে । আসার সময়ে জানতুম আজ
গোলমাল হবে, তাই তৈরি হয়েই এসেছি । তবু প্রথমেই
নিজের তরফ থেকে হাত ওঠাব না সেটা ঠিক করা আছে ।
জামার কলার ধরে একজন খিস্তি করে, ‘পেরেম করতে এয়েচো
এপাড়ায় ! কেন ? নিজের বাড়িতে মাগ নেই ?’
দাঁতে দাঁত দিয়ে মাথা ঠাণ্ডা রাখি ল তখনই চোয়ালে ঘুষি
রক্ত টেনে বের করে, যেটা হাত দিয়ে টের পাই ।
এক ঝটকায় ছাড়িয়েই বসে পড়ি ল মোজার ভেতর থেকে
চকিতে বেরিয়ে আসে নতুন প্রজন্মের ক্ষিপ্র চিৎপুরি—
হ্যালোজেন-মাখা অন্ধকারে ঝলসে ওঠে স্টেনলেস চাকু
ফলায় ছিদাম লেখা একপিঠে মাকলী ওপিঠে ।
জটলা ছিৎরে যায় ! চাকু-দেবতার নামে কতোগুণ আছে
সকলে জানে না । মানব কেন অমন কুচুটে ?
প্রেমিকের জন্যে কোনো ভালোবাসা নেই ? এই যে ছ’সাতজন
মনের স্বামীত্ব হাতছাড়া হয়ে যাচ্ছিল বলে ঘিরে ধরেছিল
কেমন গুটিয়ে গেল চাউনির একটু ঝলকে
( দোটানা ২৯ আষাঢ় ১৩৯২ )
ওই ঝলক দেখেই, হয়তো শত দোষ সত্বেও, আমার মুগ্ধতা বা আচ্ছন্নতা ।

বাংলা কবিতার আবহমান রীতি ভেঙেচুরে দিতে, ঐতিহ্য ও ধ্যানধারণাকে পালটে দিতে, হাংরিদের আবির্ভাব, এরকমই একটা কথা, কোথায় যেন শুনেছিলাম, এবং মলয় নিজে এই হাংরিদের পুরোধাপুরুষ বলে, হয়তো, তাঁর কবিতায় ওই ধাক্কা দেবার অনলস প্রবাস আমি লক্ষ্য করি, যাকে মলয় বলতে চেয়েছেন ‘পূর্ববিধানকে হটিয়ে নববিধান’ । এইটে করেছেন ‘অচেনা ভাষা ইউনিট’ গড়ে, অন্তত তিনি তাই প্রণিধান করতে চেয়েছেন কোনও এক লেখায়, এবং যথেষ্ট ‘মাজা ঘষার পর, ঠাণ্ডা মাথায় ।’

ফলে, আমার সংশয়, আচ্ছন্নতার রেশ কাটতে না কাততেই, আরও বাড়ে, বেড়ে যায়, কেন এটা করতে চাইছেন মলয় ? এসটাবলিশমেন্ট বিরোধিতার জন্য ? স্রেফ বিরোধিতা, আর কিছু নয় ? পূর্ববিধানকে হটিয়ে নববিধান রূপায়ণের জন্য, প্রতিষ্ঠার জন্য ? তার মানে এসটাবলিশমেন্টের ক্ষমতার দিগন্ত আরও প্রসারিত করা ? ব্যাপারটা বড়ো গোলমেলে মনে হয় । যদি বিরোধিতাই হয়ে থাকে উদ্দেশ্য, বচনবয়নের রূপ পালটেদেওয়াটাই যদি এসটাবলিশমিন্ট বিরোধিতা হয়ে থাকে, এলিট শব্দকোষের বদলে তিনি যে ভাষা বয়ন করেছেন ননএলিট লেকসিকন ব্যবহার করে, তা যে ওই এসটাবলিশমেন্ট-পালিত ‘তোলা আদায়কারী মস্তানবাহিনী’-রই মুখের ভাষা ‘আববে পাণ্ডবের বাচ্চা যুধিষ্ঠির’, সে যে কার ভাষা, তা নিশ্চয় বলে দিতে হবে না, এবং তা ব্যবহার করে পরোক্ষে, তিনিই এসটাবলিশমেন্টের পাছার কাপড় ঠিক করে দিচ্ছেন, এই ভূমিকা লক্ষ্য করেই আমার এত সংশয়:-

যুধিষ্ঠির
আববে পাণ্ডবের বাচ্চা যুধিষ্ঠির
বহুতল বাড়ি থেকে নেবে আয় গলির মোড়েতে
নিয়ায় ল্যাংবোট কৃষ্ণ ভীম বা নকুল কে-কে আছে
পেটো ্কিস্টিক ক্ষুর সোডার বোতল ছুরি সাইকেল চেন
বলেদে দ্রৌপদীকে আলসে থেকে ঝুঁকে দেখে নিক
আমার সঙ্গে আজ কিছু নেই কেউ নেই
ধৃষ্টদ্যুম্ন দুর্যোধন নেই
তোদেরই অঙ্গুলিহেলনে কেটে তর্জনীও দিয়েছি শৈশবে
দাঁড়াচ্ছি পা-ফাঁক করে দন্তস্ফূট হয়ে যাবে জয়ধ্বনি তোর
সিঁড়িতে শেকলবাঁধা মহাপ্রস্হানের কুত্তা লেলিয়েও দ্যাখ
ন্যাটা হাতে যুঝে যাবো জমিন ছাড়ব না
লুমপেন বলে তোরা ঘিরে ধরবি
আরেকবার ছিটকে পড়ব ফুটপাথে মুখে গ্যাঁজলা নিয়ে
ছুটন্ত খচ্চরবাচ্চা পিঠের ওপরে খুর দেগে যাবে
নাভিতে ব্লেডের কুচি দিয়ে তোরা খোঁচা দিবি
পায়ুমুখে জ্বলন্ত সিগারেট
পাঁজরে আছড়ে পড়বে কম্বলে মোড়া সোঁটা
দেখে নিস তোরা
মাটিতে গোড়ালি ঠুকে পৃথিবীর চারিধারে জ্যোতির্বলয় গড়ে যাবো ।( মেসোমশায় পর্ব, ২৭ নৈশাখ ১৩৯২ )

‘ঘুণপোকার সিংহাসন’ বা এরকম আরও কিছু কবিতা এ সংশয় আরও প্রগাঢ় করে তোলে যখন দেখি, ‘নোকরশাহির রাজ্য এনেছো এ-দেশে’ বলে মলয় তৃপ্তি পাচ্ছেন, অথচ ওই নোকরশাহিকেই তিনি করে তুলেছেন মহিমামণ্ডিত :-
ওগো স্তন্যপায়ী ভাষা পিপীলিকাভূক মুখচোরা
ভূচর খেচর জলচর দাম্পত্যজীবনে তুষ্ট একশিঙা
নীলগাই বারাশিঙা চোরাকিশোরীর হাতে মূল্যবান পপাণী
স্হলে বিচরণকারী উদবিড়াল গন্ধগোকুল বিনোদিনী
শব্দগহ্বর খেয়ে নোকরশাহির রাজ্য এনেছ এদেশে ।
( ঘুণপোকার সিংহাসন, ২ ভাদ্র ১৩৯২ )
আমি ভুলে যেতে পারি না মলয়ের কবিতায় শ্রেণিচেতনার গাঢ় উন্মেষ দেখে, একথা আরও উল্লেখ করতে চাইছি, আমাদের দেশের বামপন্হী আন্দোলন, নকশাল আন্দোলনসহ, সব আন্দোলনই মূলত এসটাবলিশমেন্টকে আরও শক্তিশালী করে তোলে ;  উপরি কাঠামোতে একটু গুঁজগাঁজ দিয়ে, আরও বেশি । এর ফলে নিজেকে সংহত করে ওই এসটাবলিশমেন্ট । আমি জানি ,মলয়ের এই বাগব্যবহারবিধি তাঁর ভাষাকে দিয়েছে প্রচণ্ড গতি ও তেজ, কবিতার ক্ষীণ ও প্রায় শুকিয়ে যাওয়া ধমনীতে চালিত করতে পেরেছেন টাটকা রক্ত, এক বিদ্যুৎপ্রবাহ, যার সামনে আমার সন্ত্রস্ত হওয়া ছাড়া আর কোনও উপায় থাকে না । সে অর্থে হলে, মলয় সত্যিই ধন্যবাদার্হ ।

‘মেধার বাতানুকূল ঘুঙুর’ কতোবার যে পড়লাম তার ইয়ত্তা নেই । মনে হয় মলয়, শুধু বিদ্যুৎপ্রবাহ বয়ে যাক, এটা বোধহয় চাইছেন না । আরও কিছু চাইছেন, খুব সচেতনভাবে । এখানেই আমার আপত্তি । একটা পুরোনো বাংলা সিনেমায়, সম্ভবত ‘চারমূর্তি’ হবে সিনেমাটা, ক্যাবলা কংকাল সেজে ভয় দেখাতে গেলে, টেনিদা-রূপী চিন্ময় রায় মূর্ছা যান । জ্ঞান ফিরে এলে, উঠে, গা ঝাড়তে ঝাড়তে বন্ধুদের চিন্ময় বলেন, একটু ভড়কি দিলাম আরকি ! মলয় কি ভড়কিই দিতে চাইছেন শুধু ? আমি আরও মুশকিলে পড়ে যাই, যখন মলয় নিজেই স্বীকার করছেন, “আমি সত্যিই শিল্পের বিরুদ্ধে ও সংস্কৃতির স্বপক্ষে বলতে চেয়েছিলুম ।”

তাহলে, শেষ পর্যন্ত দাঁড়াল কী ? মলয়ের যুদ্ধঘোষণা, তাহলে শিল্পের বিরুদ্ধে, যাকে তিনি কখনও ঔপনিবেশিকতার উপহার হিসেবে চি্‌হ্ণিত করতে চাইছেন, কোথাও কোথাও, সেই শিল্পের বিরুদ্ধে ? তখনই, আবার অবাক হয়ে লক্ষ্য করি, লক্ষ্য করতে হয়, এ কোন যুদ্ধ ? ‘মেসোমশায় পর্ব’  কবিতার যদি সাক্ষ্য নিই, দেখি, আহ্বান তিনি জানাচ্ছেন বটে যুদ্ধের, যুধিষ্ঠির/আববে পাণ্ডবের বাচ্চা যুধিষ্ঠির/বহুতল বাড়ি থেকে নেবে আয় গলির মোড়েতে/ নিয়ায় ল্যাংবোট কৃষ্ণ ভীম বা নকুল কে কে আছে/পেটো হকিস্টিক ক্ষুর সোডার বোতল ছুরি সাইকেল চেন…’, সন্দেহ নেই, তিনি যতই অস্বীকার করুন, এখানে ‘বহুতলবাড়ি’ শব্দের শ্রেণি অভিঘাতে, নতুন প্রতীকি মাত্রা পেয়েছে; দ্বাপর যুগের ওই চেতনাপ্রবাহ কী করে যেন এসে, কলকাতা শহরে, নকশাল-মাস্তান মিলেমিশে, একাকার হয়ে শ্রেণিযুদ্ধ থেকে বাঁক নিয়ে, একাকী, নিঃসঙ্গ কবির মরণপণ সংগ্রামে উত্তীর্ণ হয়ে যায় । তবু যে প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে তিনি যুদ্ধ ঘোষণা করছেন, আর ওই বহুতল বাড়িরই তৈরি করে দেওয়া মিথকেই ক্রমে সন্মানিত করে তুলছেন, ‘দেখে নিস তোরা/মাটিতে গোড়ালি ঠুকে পৃথিবীর চারিধারে জ্যোতির্বলয় গড়ে যাবো’, এই ঘোষণা দিয়ে ।

শেষ পর্যন্ত ওই জ্যোতির্বলয় গড়ে তোলার জন্য মলয়ের এত কসরত, এত চেষ্টা, এত হাঁকডাক ? তাহলে যুদ্ধের আহ্বান কেন ? না কি, মলয়ও চাইছেন, যেভাবেই হোক, বা, বৈরীভাবেই হোক, এসটাবলিশমেন্টে পাতে বসার সুযোগ পেতে ? যে-আবহমান বাংলা কবিতারীতি তিনি ভাঙতে চাইছেন ঠাণ্ডা মাথায়, সেই আবহমানতা তিনি, অজান্তে, বয়ে নিয়ে যাচ্ছেন নিজের কাঁধে করে, এটা দেখে, আমারও কষ্ট হয়, মলয়ের জন্য । তিনি, অসহায়ভাবে, কখনও কখনও, মেনে নিচ্ছেন, অক্ষরবৃত্তের বিলাসিতা, ডুবে যাচ্ছেন বৃহত্তর মায়ায় । আবার, কবিতার ভাষা বদলাতে গিয়ে, শব্দ বদলে দিচ্ছেন, কিন্তু মেনে নিচ্ছেন ব্যাকরণের রক্তচক্ষু, আঁকড়ে ধরছেন কবিতাপ্রতিমার পুরোনো কাঠামো ।

এত স্ববিরোধিতা, তবু, অল্প জানি বলেই, মলয়কে আমার ভালো লাগে । আমার, বরাবরই মনে হয়, মলয়, তাঁর রাগি চেহারা নিয়েও, প্রবল-রোমান্টিকতা বিরোধী বলে, নিজেকে বরাবর চি্‌হ্ণিত করতে চাইলেও, আদ্যোপান্ত এক রোমান্টিক কবি, বড় রোমান্টিক । তিনি প্যানপ্যানানি বলে নস্যাৎ করতে চেয়েছেন একে, তবু, আমি তা বলছি, আর আমার এই বক্তব্যকে সমর্থন করতে ্গিয়ে এসে সাক্ষ্য দেবে তাঁরই কয়েকটি কবিতার পংক্তি :-

সে শরীর ছুঁতে ভয় পাবে তারা আজ
দোলো লাশ নামাবার জন্য আছি আমি ।
( বিজ্ঞানসন্মত কীর্তি ১৯ শ্রাবণ ১৩৯২ )
আরেকবার সুস্হ হও শুভ্রা রায়
নাচবো সকলে তুর্কি গাঁজাভাঙ টেনে
হাড়িয়া মহুল খেয়ে ফিরিঙি আদলে
উঠে এসো সুর্মা চোখে লুপুঙগুটুতে
বেবাক দুনিয়া যায় জাহান্নমে যাক ।
( শিল্পোন্নয়ন ২১ শ্রাবণ ১৩৯২ )
আমি চাই যে করেই হোক বেঁচে ওঠো
সমগ্র জীবন থাকো কথাহীন হয়ে ।
( ধনতন্ত্রের ক্রমবিকাশ ২২ শ্রাবণ ১৩৯২ )
কী রকম জ্বলে ওঠো দেখতে চেয়েছি
শাদা ত্বক এক লহমায় পুড়ে কালো
চোখ থেকে চাউনি উধাও জানুদেশ
থির থির কেঁপে ছিটকে ঘাসের ওপরে
পড়ে তুমি বারকয় নড়েচড়ে স্হির
শেষবার তারপর ঝুঁকে চুমু খাবো ।
( উৎপাদন পদ্ধতি ২১ শ্রাবণ ১৩৯২ )
দাঁড়াবে আমার সামনে এসে তুমি
বলবে, ‘আমাকে যেতে দিন’।
( বাজারিনী ২৮ আষাঢ় ১৩৯২ )
সাক্ষ্যপ্রমাণ থাক, দিতে গেলে আরও দেয়া যাবে বিস্তর, মলয় কী চাইছেন আর শেষ পর্যন্ত কী করতে গিয়ে কী করছেন, সেটা থাক । আমি শুরু করেছিলাম ‘মলয় রায়চৌধুরী কে?’ এই নিরীহ প্রশ্ন সামনে রেখে ; ‘মেধার বাতানুকূল ঘুঙুর’  পড়ে, যত সংশয় মনে আসুক, আমি তবু আবিষ্কার করি, মলয়, এই বাংলা ভাষারই আবহমান ঐতিহ্যের পথ ধরে ক্রম অগ্রসরমান এক উজ্জবল কবি, যাঁর হাত ধরে বাংলা কবিতা ধনী হচ্ছে, যিনি ‘বজ্রমূর্খের তর্ক’ লিখে সকল স্ববিরোধিতার শ্বাসরুদ্ধকর অবস্হা থেকে নিজেকে উদ্ধার করেন শেষ পর্যন্ত :-
আজকে শুক্কুরবার । মাইনে পেয়েচি । বোধায় শরৎকালের পুন্নিমে ।
পাতলা মেঘের মধ্যে জ্যোসনা খেলছে । মাঝরাত । রাস্তাঘাট ফাঁকা ।
সামান্য টেনিচি তাড়ি । গাইচি গুনগুন করে অতুলপ্রসাদ ।
কোথাও কিচ্ছু নেই হঠাৎ কুচকুচে কালো নেড়িকুকুরের দল
ঘেউঘেউ করে ওঠে । তাড়া করে । বেঘোরে দৌড়ুতে থাকি ।
বুঝতে পারিনি আগে । রাজপথে এসে হুঁশ হয় ।
মাইনেটা পড়েচে কোথাও হাত থেকে । কী করে ফিরব বাড়ি ?
কেউ তো বিশ্বাস করবে না ! ভাববে খেলেচে রেস,
গিয়েচে মাগির বাসা, বন্ধুদের সাথে নিয়ে বেলেল্লা করেচে ।
বন্ধুবান্ধব কেউ নেই । রেসও খেলি না কতোকাল ।
অন্য স্ত্রীলোকের খোলা বুকে হাত শেষ কবে দিয়েচি যে
ভুলে গেচি । জানি না বিশ্বাস করে না কেউ কেন !
আমার তো মনে হতে থাকে, যা করিনি সেটাই করেচি বুঝি ।
যা কইনি সেকথা বলেচি । তাহলে এ পুন্নিমের মানে ?
কেন এই মাইনে পাওয়া ? কেন গান ! কেন তাড়ি ?
আবার ঢুকতে হবে রামনোংরা গলির ভেতরে । নির্ঘাত কুকুরগুলো
গন্ধ শুঁকে টের পাবে । ছেঁকে ধরবে চারিদিক থেকে ।
যা হবার হয়ে যাক । আজ শালা এস্পার কিংবা ওস্পার ।
( বজ্রমূর্খের তর্ক ২৭ আষাঢ় ১৩৯২ )
মলয় টের পান, প্রশ্ন করেন নিজেকেই, এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন নিজেই, ‘আবার ঢুকতে হবে রামনোংরা গলির ভেতে।’ ওইখানেই মলয়ের সার্থকতা, তা তিনি যতই শিল্পের বিরুদ্ধে চিচিচকার করুন । ‘শ্রেষ্ঠ বাংলা কবিতা’ নামে কোনও সংকলন যদি কেউ করেন, তাহলে ‘বজ্রমূর্খের তর্ক’ তাতে অবশ্যই সংকলিত হওয়া উচিত । না হলে বুঝব, ‘শ্রেষ্ঠ বাংলা কবিতা’ নামকরণ বিফলে গেল, অসম্পূর্ণ রয়ে গেল ওই সংকলনটি ।
[ হাওয়া৪৯ এপ্রিল ২০০১ সংখ্যা থেকে নেয়া ]

শ্রীমন্তী সেনগুপ্ত : হাংরি আন্দোলনের স্রষ্টা মলয় রায়চৌধুরীর সাহিত্যপ্রতিভা

Sreemanti Sengupta
এই রচনাটি আমার জন্য বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ । প্রথমত, এটা এক ধরণের ফিরে আসা — আমি শব্দহীনতার মানসিক অবসাদে দীর্ঘকাল ভুগছিলাম, যখন আমার মনে হলো যে এর থেকে নিষ্ক্রমণের সহজ উপায় হবে কমপিউটারের কিবোর্ডে আঙুল রেখে টকাটক টাইপ করে যাওয়া । দ্বিতীয়ত, এই রচনাটি উৎসর্গ করেছি একজন ডিস্টার্বিং কবির প্রতি, এমন একজন যাঁর গভীরতায় প্রবেশ করার সাহস নেই আমার । এখানে আমি যা কিছু লিখব তা মলয় রায়চৌধুরী সম্পর্কে আমার বোধবুদ্ধির অতীত, যিনি বাংলা ভাষার কবি, স্কলার, ষাট দশকের হাংরি আন্দোলনের জনক । তিনি তাঁর বন্ধুদের সঙ্গে ষাটের দশকের পশ্চিমবঙ্গে সক্রোধে আবির্ভুত হলেন, বাঙালির পচনরত সমাজকে পরিবর্তনের উদ্দেশ্য নিয়ে ।

আমি ইংরেজি উইকিপেডিয়া থেকে অনুবাদ করে একটি উদ্ধৃতি দিচ্ছি :-

“হাংরি জেনারেশন সাহিত্য আন্দোলন  মলয় রায়চৌধুরী, সমীর রায়চৌধুরী (মলয়ের বড় ভাই), শক্তি চট্টোপাধ্যায় এবং হারধন ধাড়া (ওরফে দেবী রায়)  আরম্ভ করেছিলেন । পরে ত্রিশের বেশি কবি এবং শিল্পীরা তে তাঁদের আন্দোলনে যোগ দিয়েছিলেন, তাঁদের মধ্যে উল্লেখ্য বিনয় মজুমদার, উৎপলকুমার বসু, ফাল্গুনী রায়, সুবিমল বসাক, ত্রিদিব মিত্র, রবীন্দ্র গুহ এবং অনিল করঞ্জাই।

“হারি আন্দোলনে মলয় রায়চৌধুরীর ভূমিকা তুলনীয় স্টিফেন মালর্মের সিমবলিজম , এজরা পাউণ্ডের ইমজিজম, আঁদ্রে ব্রেতঁর পরাবাস্তববাদ, এবং অ্যালেন গিন্সবার্গের বিট আন্দোলনের সঙ্গে। হাংরি আন্দোলন এখন ইংরাজিতে Hungryalism বা “ক্ষুধার্ত প্রজন্ম” নামে পরিচিত। হাংরি শব্দটি  জিওফ্রে চসারের “ইন দ্য সাওয়ার হাংরি টাইম” থেকে নেয়া হয়েছে; দর্শনটি ওসওয়াল্ড স্পেঙ্গলারের “দ্য ডিক্লাইন অব দ্য ওয়েস্ট”-এর ওপর ভিত্তি করে । ১৯৬১ সালের নভেম্বরে আন্দোলনের প্রথম বুলেটিন ইংরেজিতে মলয় রায়চৌধুরী কর্তৃক প্রকাশিত হয় । তবে আন্দোলনটি ১৯৬৫ সালে ফুরিয়ে যায় । এরপর মলয় রায়চৌধুরী কবিতা ছাড়াও উপন্যাস, নাটক, এবং সামাজিক ও সাংস্কৃতিক বিষয়বস্তু নিয়ে প্রবন্ধ লেখেন, যে ব্যাপারগুলো বাঙালি সমাজকে ভোগান্তির শেষ প্রান্তে এনেছে ।”

“ওয়াশিংটন স্টেট ইউনিভার্সিটির প্রাক্তন ইংরেজী শিক্ষক হাওয়ার্ড ম্যাককোর্ড এবং পরে বাওলিং গ্রিন বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্যের অধ্যাপক, যিনি কলকাতা সফরের সময় মলয় রায়চৌধুরীর সাথে সাক্ষাত করেছিলেন, তিনি ফেরলিংঘেটি-সম্পাদিত ‘সিটি লাইাইটস জার্নাল’ ৩-এ এই বিষয়ে লিখেছিলেন : “ষাটের  দশকের শুরুতে আন্দোলন শুরু হওয়ার পর থেকে হাংরি জেনারেশনের সাংস্কৃতিক সংগঠনের আক্রমণের একটি কেন্দ্রীয় ব্যক্তিত্ব হলেম মলয় রায়চৌধুরী”। মলয় রায়চৌধুরীর কবিতা, “এসিড, ধ্বংসাত্মক, ক্ষতিকারক, নির্বিচার, অসম্মানজনক, ক্ষুব্ধ, আক্রমণাত্মক, হতাশাব্যঞ্জক, – এই ভয়ঙ্কর এবং বিশুদ্ধ দৃষ্টিভঙ্গিকে চিত্রিত করে”।

এ থেকে আপনি তাঁর জীবন ও সময় সম্পর্কে ধারণা করতে পারবেন, অন্তত আমি যা বলতে পারব তার তুলনায় স্পষ্ট, কেননা প্রথমত, আমি অনুভবের তাৎক্ষণিকতায় বিশ্বাস করি যাতে পাঠকের সংবেদনকে আক্রমণ করতে পারি, এবং দ্বিতীয়ত, তাঁর সঙ্গে সাইবার জগতে আমার যোগাযোগকে  আমি এই রচনার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ মনে করি ।

আমার অশেষ ভাগ্য যে মলয় রায়চৌধুরীর সঙ্গে, যাঁকে আমি মলয়দা বলে ডাকতে ভালোবাসি, তাঁর সঙ্গে ফেসবুকের মাধ্যমে পরিচয় হয়েছিল । এই ঘটনাটি ‘সোশাল নেটওয়র্কিঙের’ প্রতি আমার উদাসীন অবস্হানকে কিছুটা নমনীয় করেছে । মলয়দার রচনাবলীর সঙ্গে আমার প্রথম যোগাযোগ ঘটে একজন বুদ্ধিজীবীর মাধ্যমে, দুই বছর পুর্বে, যে ব্যাপারটিকে  আমি মনে করি এ-পর্যন্ত আমার জীবনে একটি বাঁকবদলের ঘটনা । যা আমাকে যৌক্তিকতার পাহাড়চূড়া থেকে মোহাচ্ছন্ন জ্ঞানের অতলে ঠেলে ফেলে দিয়েছিল, এবং আমি ভয়ংকর পতন থেকে নিজেকে বাঁচাবার জন্য একটা লতাকে আঁকড়ে ধরেছিলাম । তাঁর প্রথম যে রচনাটির সঙ্গে আমি পরিচিত হলাম তা ইনটারনেটে পাওয়া ‘প্রচণ্ড বৈদ্যুতিক ছুতার” কবিতাটি । আমি কবিতাটির কয়েকটি লাইন তুলে দিচ্ছি, যা পড়ার পর আমি ব্লাশ করতে বাধ্য হয়েছিলাম এবং চোখ বুজে অনুভব করতে পারছিলাম যে এক গরম হল্কা আমার মাথার চুলের গোড়া থেকে বইতে আরম্ভ করেছে :-

তোমার তীব্র রূপালি য়ূটেরাসে ঘুমোতে দাও কিছুকাল শুভা
শান্তি দাও, শুভা শান্তি দাও
তোমার ঋতুস্রাবে ধুয়ে যেতে দাও আমার পাপতাড়িত কঙ্কাল
আমাকে তোমার গর্ভে আমারই শুক্র থেকে জন্ম নিতে দাও
আমার বাবা-মা আন্য হলেও কি আমি এরকম হতুম ?
সম্পূর্ণ ভিন্ন এক শুক্র থেকে মলয় ওর্ফে আমি হতে পার্তুম ?
আমার বাবার অন্য নারীর গর্ভে ঢুকেও কি মলয় হতুম ?
শুভা না থাকলে আমিও কি পেশাদার ভদ্রলোক হতুম মৃত ভায়ের মতন ?
ওঃ বলুক কেউ এসবের জবাবদিহি করুক
শুভা, ওঃ শুভা
তোমার সেলোফেন সতীচ্ছদের মধ্যে দিয়ে পৃথিবীটা দেখতে দাও আমায়
পুনরায় সবুজ তোশকের ওপর চলে এসো শুভা
যেমন ক্যাথোড রশ্মিকে তীক্ষ্ণধী চুম্বকের আঁচ মেরে তুলতে হয়
১৯৫৬ সালের সেই হেস্তনেস্তকারী চিঠি মনে পড়ছে
তখন ভাল্লুকের ছাল দিয়ে সাজানো হচ্ছিল তোমার ক্লিটোরিসের আশপাশ
পাঁজর নিকুচি করা ঝুরি তখন তোমার স্তনে নামছে
হুঁশাহুঁশহীন গাফিলতির বর্ত্মে স্ফীত হয়ে উঠছে নির্বোধ আত্মীয়তা
পায়জামায় শুকিয়ে-যাওয়া বীর্য থেকে ডানা মেলছে
৩০০০০০ শিশু উড়ে যাচ্ছে শুভার স্তনমণ্ডলীর দিকে
ঝাঁকে-ঝাঁকে ছুঁচ ছুটে যাচ্ছে রক্ত থেকে কবিতায়
এখন আমার জেদি ঠ্যাঙের চোরাচালান সেঁদোতে চাইছে
হিপ্নোটিক শব্দরাজ্য থেকে ফাঁসানো মৃত্যুভেদী যৌনপর্চুলায়
ঘরের প্রত্যেকটা দেয়ালে মার্মুখি আয়না লাগিয়ে আমি দেখছি

এর আগে আমি এরকম কবিতা কখনও পড়িনি । আমি সবচেয়ে প্রথমে আসেপাশে তাকিয়ে দেখে নিলাম যে বাড়ির গুরুজনরা কেউ আমার কমপিউটার স্ক্রিনে উঁকি মারছেন না তো ! আমার চোখ কুঁচকে উঠল আর মণি দুটো ঘন হয়ে এলো, যেমন-যেমন আমি কবিতার ছবিগুলো মস্তিষ্কে স্পষ্ট করে তুলতে লাগলাম, তেমন তেমন ঘটতে লাগলো এগুলো ।

“এই লোকটা কী লিখছে রে বাবা ! লোকটা তো উন্মাদ আস্ফালন করছে !”  আর তারপর বেশ কয়েক ঘণ্টা পরে আমি আমার স্হিতির সঙ্গে আপোষ করে বুঝতে পারলাম যে কবিতাটা আমাকে মর্মপীড়ায় অভিভূত করেছে, কয়েকটা লাইন আমাকে ধর্ষণ করেছে । আমি একা ছিলাম না । অশ্লীল রচনার দায়ে মলয়দাকে আদালতে মামলার দুর্ভোগ পোয়াতে হয়েছিল, আর সেই মামলায় বাংলা কবিতার কয়েকজন নামিদামি মানুষ তাঁর বিরুদ্ধ সাক্ষ্য দিয়েছিলেন।

প্রায় এক সপ্তাহের ঘুমহীন দাহময় দুপুরের পর, আমি কবিতাটায় ফিরে-ফিরে যেতে লাগলাম, বয়ঃসন্ধির সেই বালিকার মতন যে সদ্য নিজের দেহের রহস্যগুলোর সঙ্গে পরিচিত হয়েছে । বিপরীত সেক্সের মানুষকে ছোঁবার জান্তব প্রবৃত্তি, দেহকে লুটেনেবার আগ্রহ, আরন্যক আকাঙ্খায় পাগল হয়ে ওঠার উপক্রম হলো । মলয়দার ভাষার ক্ষমতা আমাকে চিরকালের জন্য যেন অসাড় করে দিয়েছিল । আর তারপর হঠাৎই ফেসবুকে তাঁর সঙ্গে দেখা, আর আমাকে ঘিরে ধরল এক অদ্ভুত ভয় । স্পষ্ট কথায়, আমি এই ধরণের মানুষদের সম্পর্কে ভীষণ আতঙ্কিত ।  একদল শিল্পী আছেন যাঁরা তাঁদের শিল্পকর্মের প্রতি অত্যন্ত সমর্পিত । এই এলাকায় যাঁদের পাওয়া যাবে তাঁরা হলেন অ্যালেন গিন্সবার্গ, অ্যামি ওয়াইনহাউজ, কুর্ট কোবেইন এবং আরও অনেক চরমপন্হী-শিল্পী ; তাঁদের জন্য শব্দবন্ধটা আমিই তৈরি করেছি । তাঁরা বিপরীত সেক্সের মানুষদের দুর্নিবার আকর্ষণ করেন, তাঁরা নিজেদের সময় ও শিল্পের সঙ্গে চূড়ান্ত ও বিপজ্জনকভাবে জড়িয়ে পড়েন । পাবলো পিকাসোকে অনেক সময়ে গ্রিক পুরাণের অর্ধেক-মানব ও অর্ধেক দানব মিনোটরের সঙ্গে তুলনা করা হয় । মিনোটরের মতো তিনি চাইতেন যে নারীদের তাঁর সামনে বলি দেয়া হোক, তাঁর ব্যক্তিজীবনের ঘটনাবলী থেকে যা প্রমাণিত, যেসব ঘটনা পিছনে ফেলে গেছে ধারাবাহিকভাবে  যন্ত্রণাগ্রস্ত স্ত্রীদের, রক্ষিতাদের ও সন্তানদের ।

মলয়দা আমাকে একবার বলেছিলেন যে তাঁর চেয়ে বয়সে কুড়ি বছর ছোটো একজন তরুণী তাঁকে থ্রেটেন করেছিলেন যে যদি মলয়দা তাঁকে বিয়ে না করেন তাহলে আত্মহত্যা করবেন । তরুণীটি নিজের কথা রেখেছিলেন । টয়লেটের অ্যাসিড খেয়ে আত্মহত্যা করেছিলেন ।

আমি লুকিয়ে মলয়দার সাইবার জগতে প্রবেশ করেছিলাম, অত্যন্ত সাবধানে, ছায়ার মতো সশ্রদ্ধ প্রশংসকরূপে, যাতে আমি নিজে না উন্মাদনার বিপদে আক্রান্ত হই, কিন্তু আমি তাতে সফল হইনি । শেষ পর্যন্ত একদিন আমি তাঁকে জিজ্ঞাসা করলাম, “ তোমার কবিতায় যৌনতার এরকম খোলাখুলি প্রয়োগের ভূমিকা কি ?”

মলয়দার অবাক-করা উত্তরে ছিল সাহসিক প্রশান্তি : “ভাষার  লোভনীয় শরীরের সঙ্গে সঙ্গম করলে কবিতার জন্ম হয় ।”

শুনে, আবার আমি শব্দহীনতায় থতমত খেলাম । আমি ইনটারনেটে মলয়দার লেখাগুলোতে ঢুঁ মারতে লাগলাম ( সবই ‘ব্লগস উইথ জবস’ ট্যাগ করা ) , পাঠকের মন্তব্য থেকে বোঝা যায় তারা কবিতাগুলোকে অশ্লীল তকমা দিয়েছে । মলয়দা তাদের জিজ্ঞাসা করেছিলেন, “অশ্লীলতা বলতে ঠিক কী বোঝায়? শুনতে ভালো লাগে এরকম শব্দে সাজানো রোমান্টিক ছবিকেই কি কবিতা বলা হবে ? তোমরা বরং পড়া অভ্যাস করো, তাহলে ঠাহর করতে পারবে ।”
মলয়দার বিষয়ে ভাবলে আমার মনে পড়ে কমলা দাস-এর কথা, আরেকজন একমাত্র কবি যার প্রভাব আমার ওপরে একই রকম হয়েছিল । তিনিও, পাঠকের গ্রহণ করার শেকল ভেঙে নিজের কন্ঠস্বরকে কবিতায় জায়গা দিয়েছেন । এই ধরণের মানুষের কাছে কবিতা হলো তাঁদের অস্তিত্বের প্রসারণ । ব্যাপারটা খুবই স্বাভাবিক, আমি অন্তত তাই মনে করি, যেমন বন্ধুদের সম্পর্কে কুৎসা করা, অফিসের বসের সম্পর্কে গজগজ করা, দাঁত মাজা, কিংবা পেচ্ছাপ করার মতন ।

এই ধরণের মানুষরা অন্যের খারাপ লাগতে পারে ভেবে নিজের কাজকে কার্পেটের তলায় লুকিয়ে ফেলতে পারেন না, এই ভেবে যে তা করলে জনপ্রিয় হওয়া যাবে । তাঁরা বেশ বিপজ্জনক, অরুন্ধতী রায়ের ‘গড অফ স্মল থিংস’-এর আম্মুর মতন, তাঁদের থাকে চূড়ান্ত উন্মাদনা, দায়িত্বহীন এনার্জি, যেমন ভাই আর বোনের প্রেম, প্রেমের সীমারেখা লঙ্ঘন করে তারা ।

আমি এখন মলয়দার ‘ছোটোলোকের ছোটোবেলা’ পড়ছি । তাঁর কটু শৈশবের উষ্ণ স্মৃতিচারণা, মতামতে সমঝোতাহীন, অবাক-করা সততা এবং তীক্ষ্ণ ব্যঙ্গে ও বক্রোক্তিতে পরিপূর্ণ । মলয়দার শৈশব কেটেছিল প্রাক-স্বাধীন ভারতের  বিহার রাজ্যের পাটনা শহরের এক এঁদো পাড়ায় । বালক মলয়ের চোখ দিয়ে দেখা জগতকে তিনি তুলে ধরেছেন, এবং অনেক সময়ে বর্তমানের জ্ঞানী, চোটখাওয়া লেখকের দয়াহীন সততায় গড়ে তুলেছেন ন্যারেটিভ । তাঁদের পরিবার, সাবর্ণ রায়চৌধুরীদের বংশ, মিথ্যা কুসংস্কার ও অতীত গৌরবে আক্রান্ত, অসহ্য দারিদ্রের মাঝে মাথা চাড়া দিয়েছিল । মলয় দারিদ্রের কথা বলেন, প্রথম দেখা এক উলঙ্গ বিধবার কথা, দুইজন বোবা দর্জি যারা তাঁদের বাড়ির সকলের পোশাক সেলাই করত, পায়খানা থেকে বেরিয়ে অদ্ভুত নিয়মপালন, পাটনা মিউজিয়ামের কিপার অব পেইনটিংস অ্যাণ্ড স্কাল্পচার তাঁর বড়োজেঠার সঙ্গে সেখানে গিয়ে দর্শনার্থীরা কেমন গ্রিক মূর্তির লিঙ্গে হাত দিচ্ছে তা এক বালকের বিস্ময়ে যে  ঢেউ তোলে তার বর্ণনা ।

বইটা থেকে পাঠক পাবেন অনেককিছু,  যা চাই তাই, সবকিছু, যখন কিনা প্রথম দৃশ্য থেকে শুরু হয় মলয়দার পনেরো বছরের জাঠতুতো ভাই বাড়িতে একজন বেশ্যাকে এনে বিদায় দেবার সময়ে মাঝরাতে ধরা পড়ার ঘটনা । কম বললেও একথা বলতে হয় যে মলয় রায়চৌধুরী একজন ডিস্টার্বিং লেখক । অনেক সময়ে আমি ওনার গড়ে তোলা দৃশ্যাবলী ও ঘটনায় প্রতিহত হই, এমনকি বিবমিষায় আক্রান্ত হই । কখনও বা মনে হয় তাঁর কবিতা যেন ফাঁদ পেতে রাখে, মর্মার্থহীন গোঁসায় ঠাশা, নঙর্থক এবং উত্তেজনাপূর্ণ । তারপর আমি ফিরে আসি সন্ধ্যার প্রশান্তিতে এবং সবকিছু আবার নিজের জায়গায় স্হান করে নেয় — সময়, ক্রোধ, মানুষের অবস্হার প্রতি অবিশ্বাস ।

সত্তর বছর বয়সের এই মানুষটার সঙ্গে কথা বলার সময়ে আমি ক্রুদ্ধ এবং নিজেকে ব্যর্থ অনুভব করি, যে লোকটা অবসর নিয়ে স্ত্রীর সঙ্গে মুম্বাইতে থাকে । লোকটার এতো বুকের পাটা হলো কেমন করে যে বিস্ময়করভাবে নিজের সততা প্রকাশ করে ? কোন সে স্পর্ধার অনুমতি লোকটা পেয়েছে যে এরকম দায়িত্বজ্ঞানহীনভাবে স্বাধীন । এই প্রশ্নগুলো মলয়দাকে করলে আমি ওনার দেয়া উত্তরে নিঃশব্দ হাসি শুনতে পাই:-

“তুই কি কখনও ভেবে দেখেছিস তোর জীবনে কে এমন হতে পারে যাকে তুই একই সঙ্গে ভালোবাসিস আর ঘৃণা করিস ? আমি সেই ধরণের ক্ষতিকর জীব যে আক্রান্ত হওয়াকে উপভোগ করে ! তুই কি লক্ষ্য করেছিস যে আলফা পুরুষ জানোয়ার তার বিপক্ষকে হারাবার জন্য মাথাকে ব্যবহার করে ? বাইসন, জিরাফ, সিংহ, হাতি, গণ্ডার, কুমির, যেকোনো ক্ষমতাবান জানোয়ার । আমি সেই ধরণের জানোয়ারদের মতন অস্তিত্ব বজায় রাখি, যারা একটা দলের নেতৃত্ব দেয় । যেমন সিংহ । সিংহের মতন আমি একাকীত্ব পছন্দ করি । লেখার জন্য আমি আমার মস্তিষ্ক ব্যবহার করি । পাঠক তো অপ্রাসঙ্গিক । ভাষাই হলো প্রেমিকা, যাকে আমি ভালোবাসি।”

আর ব্যাস, মলয়দা নির্ণয় নিলেন যে সাম্প্রতিক কবিতাগুলোকে ‘আলফা মেল পোয়েট্রি’ নাম দেবেন । লোকটা এই রকমই, বিরক্তিকরভাবে সরল । ওনার হৃদয় আর হাতের মাঝে কোনো জেসটেশান পিরিয়ড নেই । ওনার অনুভূতি ও যন্ত্রণার মাঝে কেউ একজন কয়েক আলোকবর্ষের দূরত্ব তৈরি করে দিয়েছে । আমরা যারা  ভেবেচিন্তে পা ফেলি তারা এই ধরণের ঔদ্ধত্য কেবল হাঁ করে দেখি । আমরা একে বলতে পারি ক্ষিপ্ত তারস্বর ; আমরা উত্যক্ত হয়ে পাতার পর পাতা বিতর্ক করতে পারি, ওনাকে ঘরে তালা বন্ধ করে রাখতে পারি, কিন্তু ওনাদের কলম কেড়ে নেবার ক্ষমতা, কষ্টযন্ত্রণা লাঘব করার ক্ষমতা, আমাদের নেই ।

একবার আমি ওনাকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, ‘তুমি কি সাধারণ সংসারি মানুষের মতন আচরণ করো ? বাজারে যাও, চায়ে দুধ ঢেলে চুমুক দাও ? ইত্যাদি ।”

উনি কোনো গুরুত্ব না দিয়ে উত্তর দিয়েছিলেন যে ওনার স্ত্রী বাজার ইত্যাদি করার দায়িত্ব নিয়েছেন, এবং উনি লিকার চা খান । আর খাদের কিনারায় বসবাসের চেয়ে সংসারি মানুষ হওয়া ঢের ভালো । আমার গভীর উদ্বেগকে এভাবে এড়িয়ে যাবার জন্য আমি ওনাকে ক্ষমা করতে পারিনি । লোকটা কি সত্যিই বাস্তব ?

উনি একবার বলেছিলেন, “পিকাসো সম্পর্কে তোর লেখাটা পড়লুম । দারুণ । আমার সম্পর্কে এক পাতা লিখলেই তো পারিস, কেননা এখন আমার বইগুলো পড়ে ফেলেছিল । যা ইচ্ছে লিখবি ; আমার প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে চিন্তা করার দরকার নেই । আমি গণ্ডারের-চামড়া লেখক । তোর নিজের চিন্তাধারার ওপর ভালো দখল আছে । অতএব শুরু করে দে । আমাকে তুই যাকে বলে ‘পিস অব ইয়োর মাইন্ড’, তাই দিস ।”

এই ছোটো লেখাটা মলয় রায়চৌধুরীকে উৎসর্গ করলাম । অশ্লীলতার জয় হোক।

Sreemanti Sengupta

সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় হাংরি আন্দোলনের ভয়ে যে চিঠি মলয় রায়চৌধুরীকে লিখেছিলেন

images

আয়ওয়া, আমেরিকা, ১০ জুন ১৯৬৪

 

মলয়,

তুমি কলকাতায় কি সব কাণ্ডের বড়াই করে চিঠি লিখেছ জানি না । কী কাণ্ড করছ ? আমার বন্ধু-বান্ধবদের কেউ-কেউ ভাসা-ভাসা লিখেছে বটে কফিহাউসে কী সব গণ্ডোগোলের কথা ।

কিছু লেখার বদলে আন্দোলন ও হাঙ্গামা করার দিকেই তোমার লক্ষ্য বেশি । রাত্রে তোমার ঘুম হয় তো ? এসব কিছু না — আমার ওতে কোনো মাথাব্যথা নেই । যত খুশি আন্দোলন করে যেতে পারো — বাংলা কবিতার ওতে কিছু আসে যায় না । মনে হয় খুব একটা শর্টকাট খ্যাতি পাবার লোভ তোমার । পেতেও পারো, বলা যায় না । আমি এসব আন্দোলন কখনো করিনি ; নিজের হৃৎস্পন্দন নিয়ে আমি এতই ব্যস্ত ।

তবে একথা ঠিক, কলকাতা শহরটা আমার । ফিরে গিয়ে আমি ওখানে রাজত্ব করব । তোমরা তার এক ‘চুলও’ বদলাতে পারবে না । আমার বন্ধুবান্ধবরা আনেকেই সম্রাট । তোমাকে ভয় করতুম, যদি তোমার মধ্যে এখন পর্যন্ত একটুও জেল্লা দেখতে পেতুম । আমার চেয়ে কম বয়সিদের মধ্যে একমাত্র তন্ময় দত্ত এসেছিল বাংলা কবিতায় তলোয়ার হাতে, আমার চেয়ে অন্তত ছ’বছরের ছোটো—- কিন্তু জীবনানন্দের পর অত শক্তিশালী কবি এদেশে আর কেউ আসেনি । প্রচণ্ড অভিমান করে ও চলে গেছে । সেজন্যে এখনও আমি অপরের হয়ে অনুতাপ করি । আমি নিজে তো এখনও কিছুই লিখিনি , লেখার তোড়জোড় করছি মাত্র ; কিন্তু তোমার মতো কবিতাকে ‘কমার্শিয়াল’ করার কথা আমার কখনো মাথায় আসেনি ।  বালজাকের মতো আমি আমার ভোকাবুলারি আলাদা করে নিয়েছি কবিতা ও গদ্যে । তোমার প্রতি যতই আমার স্নেহ থাক মলয়, কিন্তু তোমার কবিতা সম্বন্ধে এখনো কোনোরকম উৎসাহ আমার মনে জাগেনি । প্রতীক্ষা করে আছি অবশ্য ।

অনেকের ধারণা যে পরবর্তী তরুণ জেনারেশানের কবিদের হাতে না রাখলে  সাহিত্যে খ্যাতি টেকে না । সে জন্যে আমার বন্ধুবান্ধবদের  মধ্যে কেউ-কেউ একসময় তোমাদের মুরুব্বি হয়েছিল । আমি ওসব গ্রাহ্য করি না । নিজের পায়ে আমার যথেষ্ট জোর আছে, এমনকী একা দাঁড়াবার । আমার কথা হল : যে-যে বন্ধু আছ কাছে এসো, যে ভালো কবিতা লেখো কাছে এসো — যে-যে বন্ধু নও , বাজে কবিতা লেখো, দূর হয়ে যাও কাছ থেকে । বয়সের ব্যবধান তোলা আমার কাছে অত্যন্ত ভালগার লাগে ।

চালিয়ে যাও ওসব আন্দোলন কিংবা জেনারেশানের ভণ্ডামি । আমার ওসব পড়তে কিংবা  দেখতে মজাই লাগে । দূর থেকে । সাহিত্যের ওপর মৌরসি পাট্টা বসাতে এক-এক দলের অত লোভ কী করে আসে , কী জানি ।  তবে একটা কথা জানিয়ে রাখা ভালো । আমাকে দেখেছ নিশ্চয় শান্তশিষ্ট, ভালো মানুষ । আমি তাই-ই, যদিও গায়ে পদ্মাপাড়ের রক্ত আছে । সুতরাং, তোমাদের উচিত আমাকে দূরে-দূরে রাখা , বেশি খোঁচাখুঁচি না করা । নইলে হঠাৎ উত্তেজিত হলে কী করব বলা যায় না । জীবনে ওরকম উত্তেজিত হয়েছি পৌনে এক বার । গত বছর । দুএকজন বন্ধুবান্ধব ও-দলে আছে বলে নিতান্ত স্নেহবশতই তোমাদের হাংরি জেনারেশান গোড়ার দিকে ভেঙে দিইনি । এখনও সে ক্ষমতা রাখি , জেনে রেখো । তবে এখনও ইচ্ছে নেই ও-খেলাঘর ভাঙার ।

আমার এক বন্ধু জানিয়েছে যে তোমরা নাকি আমার কোনো কোনো চিঠির অংশ-বিশেষ ছাপিয়েছ । পত্রসাহিত্য-ফাহিত্য করার জন্য আমি চিঠি লিখি না । আমার চিঠি নেহাত কেজো কথা ।  অবশ্য লুকোবারও কিছু নেই । কিন্তু আগে-পরের কথা বাদ দিয়ে, ডটডট মেরে, চালাকির জন্য আমার কোনো চিঠি যদি কেউ ছাপিয়ে থাকে — তবে আড়াই মাস পরে ফিরে তার কান ধরে দুই থাপ্পড় লাগাব বলে দিও ।

আশা করি শারীরিক ভালো আছ । আমার ভালোবাসা নিও ।

সুনীলদা

 

( The facsimile of the letter was first published in 1987 in the book HUNGRY, SHRUTI and SHASTROBIRODHI ANDOLON by Dr Uttam Das. Publisher : Mahadiganto Prokashani, Padmapukur Mor, Kolkata 700 144. The letter has been reprinted thereafter in various books and periodicals and used by researchers doing M Phil and PhD )

পৃথা রায় চৌধুরী : মলয় রায়চৌধুরীর কবিতা

16729201_1216091661838929_3184981702891417583_n-1

বিতর্ককে নস্যাৎ করে কজন হয়ে উঠেছেন নিজস্ব ঘরানার ব্র্যান্ড নেম? বিতর্ককে কবচকুন্ডল করেই আজও তিনি সোজা কথায় বলেন:

“একাই লড়েছিলুম।
কেউ বলেনি ‘হোক কলরব’
একাই নেমেছিলুম ব্যাংকশাল কোর্টের সিঁড়ি বেয়ে
সেদিন একাই ঘুরেছিলুম কলকাতার পথে সকাল পর্যন্ত” 

তাই তো মলয় রায়চৌধুরী হাজার কোটি মেকিদের থেকে এতটা ওপরে। একাই লড়েছেন আর জিতে গেছেন, আমাদের অনেকেরই ক্ষমতা নেই এভাবে রুখে দাঁড়াবার। নিজের প্রতি, নিজের কবিতার প্রতি, সৎ থাকতে তিনিই পেরেছিলেন, পেরেছিলেন নির্দ্বিধায় সাহিত্য অ্যাকাডেমি সহ বহু পুরস্কার প্রত্যাখ্যান করতে।

“আমি লক্ষ্মীকান্ত, মহারাজা প্রতাপাদিত্যের অমাত্য, সাবর্ণ গোত্রের যোদ্ধা
আজ পর্যন্ত কেউ তরোয়াল চালানোয় আমাকে হারাতে পারেনি
কতো মুণ্ড এক কোপে ধরাশায়ী করেছি তার গোনাগুন্তি নেই
আমার বংশধরেরা তাই করবে একদিন, প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে–
ঘোড়ার পিঠে বসে চালাবে তরোবারি, যারাই সামনে আসবে মূর্খ মুণ্ড
গলা থেকে কেটে ফেলবে ধুলায়, সেসব মুণ্ড বেঁচে থাকবে, কথা বলবে
দরবারে গিয়ে যে-যার লেজটি নাড়িয়ে রাজা বা রানির সেবাদাস হয়ে
সারটা জীবনভর ঘেউ-ঘেউ করে ক্রমে-ক্রমে জীবাশ্মের রূপ নেবে”
লাইন কটা তুলে নিয়েছি ‘আমি লক্ষ্মীকান্ত, মহারাজা প্রতাপাদিত্যের অমাত্য’ কবিতা থেকে, শিহরিত হয়েছি বারবার এই কবিতা পড়ে, মনে মনে বলেছি, “যথার্থ! যথার্থ বলেছো মলয় রায়চৌধুরী, নিজের বংশগৌরবে গৌরবান্বিত তুমি। সেই আপোষহীন উচ্চশির লক্ষ্মীকান্তের বংশধর তুমি । সাবর্ণ রায়চৌধুরী বংশের ৩৪তম উত্তরপুরুষ, প্রতি পদে রয়েছো আপোষহীন, নির্ভীক।” ১৬ই জুলাই, ২০১৭ এই কবিতা আমি পড়ি ফেসবুকেই মলয় রায়চৌধুরীর পোস্টে। কবিতায় সাবর্ণ রায়চৌধুরীদের ইতিহাস জীবন্ত হয়ে উঠছে প্রতি শব্দে, ছত্রে আর আমাকে বলেছে, “চিনে নে!” এই কবিতায় কিন্তু আমরা কবির ভেতর দিয়েই মানুষটাকেও দেখতে পাচ্ছি, চিরকালের প্রাতিষ্ঠানিকতায় মাখানো অন্যায়ের বিরুদ্ধে মুখর হয়ে ওঠা, একা লড়াকু মানুষটা, যার হাতের কলম বরাবর তরোয়ালের মতোই ঝলসে উঠেছে, ফালাফালা করে দিয়েছে যা কিছু বস্তাপচা।
না, এখানে মানুষ মলয় রায়চৌধুরীকে নিয়ে মোটেই আলোচনা করতে বসিনি, সেই স্পর্ধা আমার নেই, মনে মনে কেবল এই ভেবে গর্বিত হই, এই মহান কবি, সম্পর্কে আমার জ্যাঠাশ্বশুর হন, আর এঁর লেখা পড়ে পড়ে শিউরে উঠি কেবল। নিজে যেহেতু কবিতা লিখি, তাই বিশেষ করে পড়ে ফেলি ওঁর কবিতা, বুঝি, কতটা আপাত সরল ভাষ্যের ভেতর দিয়ে উনি নিংড়ে বার করে আনেন মানুষের ভেতরের সমস্ত দ্বিধা, দ্বন্দ্ব, জটিল ভাবনা বা চলতে থাকা নানান সংঘাত। বসেছি জেঠুর কবিতা সম্পর্কে সামান্য দুকলম লিখতে,  কিন্তু প্রতি পদক্ষেপে যেন মনে হচ্ছে কবি মলয় রায়চৌধুরীর কবিতার সামনে আমরা সকলে এতোটাই ছোটো, যে তাঁর সব কবিতা নিয়ে আমরা আলোচনা তো করতে পারি, কিন্তু তা হয়ে দাঁড়ায় সুউচ্চ পর্বতের নীচে দাঁড়িয়ে ঘাড় উঁচু করে পর্বতশৃঙ্গের ভয়াল সৌন্দর্যকে ব্যাখ্যা করার সমতুল্য।
কবি তাঁর বহু বিতর্কিত ‘প্রচণ্ড বৈদ্যুতিক ছুতার’ কবিতা লেখার ‘অপরাধে’ অশ্লীলতার দায়ে কারাবাস করেন, এ কথা সাহিত্য জগতের প্রতিটি মানুষ জানেন, এই কবিতা নিয়ে আজও প্রতিনিয়ত সাহিত্য সংক্রান্ত গবেষণা করা হয়, আন্তর্জাতিক স্তরেও। যা এককালে কবিকে অপমানজনক পরিস্থিতিতে দাঁড় করিয়েছিল, তা এখন একপ্রকার কিংবদন্তী। বড়ো বেশি শরীরধর্মী, যৌনতার আঁশটে ভাষায় লেখা এই কবিতা পড়ে আপাতভাবে শ্লীল সমাজ চোখে-মনে কাপড় বেঁধে গান্ধারী হয়ে যান আজও, অথচ কবিতাটির ভেতর যে চরম যন্ত্রণার প্রকাশ, তা বুঝে নিতে পারলে, এই কবিতা হয়ে ওঠে অমৃত, আপাত অশ্লীল ভাষ্যের গরল মন্থন করে পাঠক পেয়ে যান অমৃত। যন্ত্রণা অপরিসীম, কবিতাটির নিচের কটি লাইনে…

“প্রতিটি শিরা অশ্রুস্রোত বয়ে নিয়ে যাচ্ছে হৃদয়াভিগর্ভে
শাশ্বত অসুস্থতায় পচে যাচ্ছে মগজের সংক্রামক স্ফুলিঙ্গ
মা, তুমি আমায় কঙ্কালরূপে ভূমিষ্ঠ করলে না কেন ?
তাহলে আমি দুকোটি আলোকবর্ষ ঈশ্বরের পোঁদে চুমু খেতুম
কিন্তু কিছুই ভালো লাগে না আমার কিছুই ভালো লাগছে না”
আবার কতটা তীব্র ব্যথা অনুভব হলে কবি এমন অস্থির ভাবে লিখতে পারেন,
“আমি আমার নিজের মৃত্যু দেখে যেতে চাই
মলয় রায়চৌধুরীর প্রয়োজন পৃথিবীর ছিল না
তোমার তীব্র রূপালি য়ুটেরাসে ঘুমোতে দাও কিছুকাল শুভা
শান্তি দাও, শুভা শান্তি দাও”… 

পাঠক ঢুকে যান কবিতার ছত্রে ছত্রে রন্ধ্রে রন্ধ্রে, কি মারাত্মক আঘাত করেছেন কবি প্রতিষ্ঠানকে, ভেঙ্গে গুঁড়িয়ে দিয়েছেন চাঁদ-তারা-নদী-তুমি আমি-ফল্গুধারা কাব্যভাষাকে। আর এই প্রচণ্ড বেগে হুড়মুড়িয়ে ঢুকে আসা কর্কশ সপাট কবিতাকে হজম করে নিতে তখনও বহু মানুষ পারেননি, আজও অনেকে পারেননা, বলাই বাহুল্য।
ঝলসে দেওয়া কবিতার কণ্ঠ তাঁর হয়তো ছোটবেলার অস্বাচ্ছন্দের জন্য বেড়ে ওঠা ক্ষোভ বিদ্রোহ ভরা বুকের একেবারে ভেতরের অনুভূতির জন্য। আবার এই কবিই ‘আমার জন্মদিন নেই’ কবিতায় লিখে ফেলেন,

“ঠাকুমা কবে জেঠা আর বাবাকে প্রসব করেছিলেন 
তার তিথি ঠাকুমা জানেন
প্রসবদিন পালনের তো কোনো রেওয়াজ নেই
তাই মা আমাকে কোন তিথিতে প্রসব করেছিলেন জানি
মায়ের কষ্টের গল্প জানি
হাসপাতালে ভর্তির গল্প জানি
কিন্তু আমার জন্মদিন জানি না”…
সাধারণ পাঠক আমি, কবির অন্তরাত্মা ছুঁয়ে বলি, এতটাও নরম ভাব এই রুক্ষ জমিতে থাকে ! কেবল বারুদ আর লাভা নিয়ে যে কবির বিচরণ, তার ভেতরের প্রকৃত মানুষের হৃদয় কে-ই বা সহজে বুঝেছে!
পাঠক যেন ক্রমাগত তড়িতাহত হতে থাকেন তাঁর বিজলীসম কবিতায় । কবির তাৎক্ষনিক মনের ভাব, চঞ্চলতা তিনি প্রকাশ করেন  ভিন্নধর্মী কবিতায়। আবার এই তিনিই ‘নখ কাটা ও প্রেম’ কবিতায় হঠাৎ লিখে ফেলেন, বলা ভালো প্রশ্ন করে বসেন,

“রবীন্দ্রনাথ, দেড়শ বছর পর একটা প্রশ্ন আপনাকে :
কে আপনার নখ কেটে দিত যখন বিদেশ-বিভুঁয়ে থাকতেন–
সেই বিদেশিনী ? নাকি চৌখশ সুন্দরী ভক্তিমতীরা ?” 

ভাবা যায়? নেকুপুষু প্রেমের কবিতা লিখে তুলতুলে ভাব ভাগ্যিস তিনি তাঁর কবিতায় আনেননি। বরাবর প্রথাভাঙ্গার নিদর্শন হয়েছে তাঁর প্রায় প্রতিটা কবিতা। কি অসামান্য প্রেম দেখিয়েছেন তিনি তাঁর ‘বুড়ি’ কবিতায়। গভীর প্রেম এই কবিতায়।

“এও আমাকে বলে এবার ঘুমোও
আর রাত জাগা স্বাস্হ্যের পক্ষে
খারাপ, এই বুড়ি যে আমার বউ
বিছানায় শুয়ে বলে, কাউকে নয়
কাউকে দিও না খবর, কারুক্কে নয়–
এ-কথাটা আমারই, কাউকে নয়
কারুক্কে বোলো না মরে গেছি ।“ 

মন খারাপ করে, গলায় ব্যথা-ব্যথা কষ্ট হয়, অথচ কি চরম প্রেম ! গভীর অনুভূতি, পরম ভরসা ফুটে ওঠে, প্রতি ছত্রে। বিষাদেরও যে এমন মিঠে সোয়াদ, তা বোধহয় এই কবিতা পড়লে তবেই বোঝা যায়। এ যেমন একাধারে প্রেমের কবিতা, তারই সাথে এ চিরশাশ্বত মৃত্যুচেতনার কবিতা। আমরা ভাবতে বাধ্য হই, এই এত আঁকড়ে থাকা, এত ভালোবাসা, এত জীবন প্রাচুর্যের মাঝেও মৃত্যুচেতনা কতটা ঘিরে রাখে আমাদের অবচেতন।
মলয় রায়চৌধুরীর দাদা,  অর্থাৎ স্বর্গত সমীর রায়চৌধুরীর মৃত্যুর পরের দিন লেখা কবির যে কবিতা, ‘সেন্স অফ লস’ এর স্তবগান’, তা যেন পাঠককে কবির জায়গায় বসিয়ে দেয়,

“কাল বাইশে জুন, ২০১৬, সকাল আটটা পনেরোয় দাদা মারা গেছেন 
দাদা সমীর রায়চৌধুরী”…………
“কাল, বাইশে জুন ২০১৬, সকাল আটটা পনেরোয় দাদা মারা গেছেন 
দাদা মানে মিনু” 
 
কবিতার প্রথম লাইন কবিতার মাঝামাঝি আবার ফিরে এসেছে। প্রথম লাইনের পরে এসেছে প্রয়াত দাদার পোশাকি নাম, আর মাঝখানে এসেছে দাদার ডাকনাম। এইভাবে একই লাইনের ব্যবহারে, অথচ দুবার দুরকম নামের ব্যবহারে আমরা আসল ‘সেন্স অফ লস’ বুঝতে পারি। বুঝতে পারি, কতটা জড়িয়ে রাখেন কবি তাঁর সদ্যপ্রয়াত দাদার স্মৃতি, কতটা হারাবার বোধ পীড়াদায়ক হয়ে উঠেছে কবির কাছে।

হাংরি আন্দোলনের সময়ে লেখা ‘জখম’ কবিতাটি মলয় রায়চৌধুরী এইভাবে আরম্ভ করেছেন :
“চাঁদোয়ায় আগুন লাগিয়ে তার নীচে শুয়ে আকাশের উড়ন্ত নীল দেখছি এখন
দুঃখ-কষ্টের শুনানী মুলতুবি রেখে আমি আমার সমস্ত সন্দেহকে জেরা করে নিচ্ছি
হাতের রেখার ওপর দিয়ে গ্রামোফোনের পিন চালিয়ে জেনে নিচ্ছি আমার ভবিষ্যত” 

হাংরি জেনারেশানের পুরোধা কবির নিজের বিশেষ প্রিয় কবিতা ‘জখম’ থেকে নেওয়া এই কটা লাইনে দ্রিম দ্রিম করে শুরুয়াতি সুর শোনা যায় এক অনন্ত ক্ষুব্ধ আহত অস্থির কণ্ঠের কবিতার। ‘জখম’ ভর্তি কবি হৃদয় থেকেই কাব্যধারায় বেরিয়ে আসে এই অনন্ত শোণিতাভ দীর্ঘ কবিতা, কবিতায় বারবার প্রয়োগ হয়েছে তাঁর নিরীক্ষার বিশেষ বানানরীতি…

“বুকের বাঁদিকের আর্মেচার পুড়ে গেছে বহুকাল
এখন চোখ জ্বালা কোর্ছে  মলয়ে কঙ্কাল জ্বালানো ধোঁয়ায়
আশপাশ দিয়ে ঘণ্টায় ৯৯ কিলোমিটার দরে উড়ে যাচ্ছে বদমতলব ঝড়
কব্জিতে ঘড়ির কাঁটা রেখে চলে যাচ্ছে সারসার সমদ্বিঠ্যাঙ মানুষের লাভলোক্সানময় দল” 

আবার কি অনায়াস উচ্চারণে কবি তাঁর লেখা অবিস্মরণীয় ছত্রগুলোর ইংরেজি অনুবাদ করেছেন সময়ে সময়ে…

“armature on thye left turned slag long ago
now eyeflesh twitching in the smoke of malay’s burning
skeleton
dismantled tempests sweep by at 99mph
uniform queues of wristwatched zombies tattle”

রাজনৈতিক বা তৎকালীন সাম্প্রদায়িক যতো অসহিষ্ণুতা এবং অস্থিরতা যেন ফুটে ওঠে এই ‘জখম’ ভর্তি কবিতায়। যা তখন সত্যি ছিল, তা আজও চরম প্রাসঙ্গিক। তাই এটুকু বলাই যায়, কবি মলয় রায়চৌধুরী সময়ের থেকে এগিয়ে গিয়ে নিজের অন্তঃস্থল খুঁড়ে, সচেতনভাবে মানুষের কথা বলে যান তাঁর কবিতায়। তিনি কাব্যকথায় মানুষের অবচেতনের সমস্ত কথা এবং সচেতন যাপনের সার কথা সমস্তই বলে যান অকপট ভাবে।
এই কবি তাঁর কবিতা সম্পর্কে বলেছেন, তাঁর “কবিতা পায়”; ঠিক মানুষের বাকি সব পাওয়ার মতোই কবিতাও পায়। কবিতার সাথে কতটা ওতপ্রোত ভাবে সম্পৃক্ত হলে একাত্মতা থাকলে এবং কবিতার প্রতি একনিষ্ঠ থাকলে কেউ এই কথা বলতে পারেন, তা সাধারণের পক্ষে বোঝা হয়তো দুষ্কর। গতানুগতিকতার মন্থর চালে চলে আসতে থাকা বাংলা কবিতার রক্ষণশীল বেড়াকে তিনি তাঁর কথ্যভাষার বম্বশেলে গুঁড়িয়ে দিতেই “গেল গেল” রব যেমন উঠেছিলো, সেই রবের কারণগুলোকে কিন্তু লুকিয়ে-চুরিয়ে হলেও পড়ে ফেলত গোঁড়া বাঙালি । ভাষা সাহিত্যের তথাকথিত এলিট ক্লাস সেসব না পড়ে ফেললে, নিজেদের টলোমলো আসন সামলে রাখার জিগিরে কীভাবে  গেল-গেল রবের হিড়িক তুলতেন?
ভয় পেয়েছিলেন কি এই আগুন কলমকে তাঁরা?

সম্প্রতি পড়লাম তাঁর কবিতা ‘রাষ্ট্রের বহি-খাতা’; পড়েই নিজেকে এবং অসংখ্য মানুষের অত্যন্ত সমস্যাসংকুল জীবনের এক মোক্ষম প্রশ্নের সম্মুখীন দাঁড়াতে হল, আমরা কি হরেদরে সকলেই এই সাংবিধানিক গণতন্ত্রের চাকার চোখে নিজের দেশে অভিবাসী মাত্র? আমাদের নাগরিকত্ব, আমাদের স্বদেশের শেকড় কি কেবল সরকারের ঠাপ্পা মারা, সরকারী শিলমোহর আঁকা কয়েক টুকরো কাগজের মুখাপেক্ষি?

 দলিল থাকলেও ফেলে দিতুম, তবে দলিলের জেরক্স 
দেখেছিলুম, ষোড়শ শতকের কারোর ফার্সিতে লেখা নাম 
এখন রাখি কেমন করে প্রমাণ করবে যে ষোড়শ শতকের
সেই পূর্বপুরুষে ওর রক্তের শেকড় রয়েছে?  
বাড়ির ট্যাক্স বাবা দিতেন, তার আগে দাদু
দাদুর বাবা, তার আগে নবাবের খাজনা–
বিলডার ঘুষের ঠেলা মেরে মালিকানার
সমস্যা সমাধান করে ফেলেছিল 
এখন রাখি কেমন করে প্রমাণ করবে যে
 ভারতের সত্যিকারের নাগরিক?”

রাখি কবির বোন। বোনের ন্যায্য চিন্তার মধ্যে দিয়ে আসলে তিনি প্রতিফলিত করেছেন এই দেশের নাগরিকদের চিন্তাক্লিষ্ট চেহারা।
কবি শ্লেষাত্মক ভঙ্গীতে লিখে ফেলেছেন ‘রাস্তার কবিতা’। তার ছত্রে ছত্রে লেখা আছে, বলা ভালো বয়ান করা আছে আমাদের তুচ্ছতা। আপাতদৃষ্টিতে এখানে যা শুধু কবির দুর্ভাগ্যজনক পরিস্থিতির লঘু বর্ণনা, তা আসলে গভীরে ঢুকে নাড়া দেয় আমাদের, বুঝিয়ে দেয়, এইটুকুই আমাদের মূল্য। চোখ বাঁধা অন্ধ আমাদের ঝাঁকুনি দেয় তাঁর সোজা সরল কথ্য ভাষায় লেখা গভীর অর্থবহ সমস্ত কবিতা।

“কাগজ কুড়োনোর কাজ আরম্ভ করে প্রথম ছেঁড়া নোংরা কাগজের টুকরো
তুলেই কাগজটা ছেড়ে দিতে হলো
কাগজটা দিয়ে দিলুম কুড়ানিকে
যে আঁস্তাকুড় থেকে কাগজ বাছাই করছিল
আসলে যে কাগজটা তুলেছিলুম সেটায় দেখলুম
আমারই একটা কবিতা, ‘কালিমাটি’ পত্রিকায় বহুদিন আগে 
প্রকাশিত হয়েছিল
মলয় রায়চৌধুরীর কবিতা নিয়ে লিখতে বসলে সামান্য কটা পাতায় তা সীমিত রাখা বড়ই কষ্টকর, অথচ সুবিশাল কিছু লেখা এখানে সম্ভব না, কারণ তা যে দুতিন পাতার ভেতর লিখতে হবে, তা কবি আগেই বলেছেন। তবুও সামান্য হয়তো বড়ো হয়ে গেল লেখাটা। তাঁর কবিতার কথা বলতে গেলে অবশ্যম্ভাবী ভাবেই আসবে ‘অবন্তিকা’র কথা। এক অনবদ্য প্রেমের কবিতা, ‘মাথা কেটে পাঠাচ্ছি, যত্ন করে রেখো’।

“মাথা কেটে পাঠাচ্ছি, যত্ন করে রেখো
মুখ দেখে ভালোবেসে বলেছিলে, “চলুন পালাই”
ভিতু বলে সাহস যোগাতে পারিনি সেই দিন, তাই
নিজের মাথা কেটে পাঠালুম, আজকে ভ্যালেনটাইনের দিন
ভালো করে গিফ্টপ্যাক করা আছে, “ভালোবাসি” লেখা কার্ডসহ
সব পাবে যা-যা চেয়েছিলে, ঘাম-লালা-অশ্রুজল, ফাটাফুটো ঠোঁট”… 

হেন প্রেমিক বা প্রেমিকা নেই, যার অন্তঃস্থল পর্যন্ত শিরশির করে উঠবে না এই কবিতা পাঠ করে।
“কি-বোর্ডে পাকাচুল পড়ে, তুলো দিয়ে সরিয়ে দিই ; চশমার লেন্সে পাকাচুল পড়ে, মুছে সরিয়ে দিই। তবু লেখালিখি ছাড়তে ইচ্ছে করে না”… সম্প্রতি কবি এমনটাই বলেছেন।

এক সাধারণ গুণমুগ্ধ পাঠিকার আসন থেকে চীৎকার করেছি, আরও, আরও লিখুন কবি, এত লিখুন যে আমাদের মগজের রক্তক্ষরণ যেন বন্ধ না হয়। রক্তের সরোবর বানান আমাদেরই হৃদয়ের ক্ষরণে, সেই সরোবরকে আয়না করে আমরা সকলে উঠে দাঁড়াই ঋজু দৃপ্ত কবিতার কাঁধে ভর করে। তাঁর নিজের ভাষায়, “কবিতা কেবল মঞ্চে বিড়বিড় করে পড়ার ব্যাপার নয়;  উন্মাদের মতো চীৎকার করে না পড়লে প্রতিষ্ঠান কষ্টযন্ত্রণার গোঙানি শুনতে পায় না।” শিখি তাঁর প্রতিটি উক্তি থেকেও। কবি মলয় রায়চৌধুরীর কাছে “কবিতার কোনও সংজ্ঞা নেই, নির্দেশিকা হয় না তাই যা ইচ্ছা, যেমন ভাবে ইচ্ছা লিখুন”… এই মানুষের কবিতা নিয়ে আলোচনা করা কি সহজ কথা? যিনি কবিতাকেই প্রেমিকা করে নিতে পারেন, তাঁর কবিতার কাছাকাছি গিয়ে তাকে স্পর্শ করাই নিজের মধ্যে এক সুবিশাল অর্জন।
“আবলুশ অন্ধকারে তলপেটে লাথি খেয়ে ছিটকে পড়ি
পিছমোড়া করে বাঁধা হাতকড়া স্যাঁতসেঁতে ধুলোপড়া মেঝে
আচমকা কড়া আলো জ্বলে উঠে চোখ ধাঁধায়
তক্ষুণি নিভে গেলে মুখে বুট জুতো পড়ে দু-তিনবার” 

তাঁর ‘আলো’ নামক কবিতার প্রথম চার লাইন উদ্ধৃত করে এই লেখা শেষ করছি। এই কবিতার মধ্যে দিয়ে কবি পেরেছিলেন সামগ্রিকরূপে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসকে ফুটিয়ে তুলতে। রাষ্ট্রের শাসনের নামে যে সন্ত্রাস, যার চাবুকের নীচে আলোহীন বাঁচতে-থাকা বোবা মানুষেরা প্রতিবাদী হলেই, তারা প্রথা ভাঙতে চেষ্টা করলেই, কি কি ঘটে যায়, তা ধরে রেখেছে এই কবিতার প্রতিটি শব্দ। অথচ লড়াকু প্রতিবাদী কবি কণ্ঠ লিখে ফেলে এই কবিতার শেষ লাইন দুটি মূল উপাদান হিসেবে…

“একসঙ্গে সব আলো আরেকবার নিভে গেলে
পরবর্তী আক্রমণ সহ্য করার জন্য নিজেকে তৈরি করে নিই।”

কলকাতার সাহিত্যজগত থেকে দূরে বসে কবি ভারতীয় সমাজের প্রতি তাঁর দায়বদ্ধতা থেকে সচেতনভাবে সৃষ্টিতে মেতে লিখে চলেছেন ষাটের দশক থেকে জ্যা মুক্ত তীরের মতো ক্ষিপ্র ধারালো কবিতা। তাঁর লেখা স্বাধীন ও স্বতন্ত্র।
সত্যিই তিনি অসীম শক্তিশালী, আমার কাছে কবিতার ঈশ্বরসম বলেই, তাঁর কবিতার কাছে সহজ মনে না পৌঁছতে পারলে আজও শ্লীল-অশ্লীল, অথবা নানান দোহাই পাড়ে যারা, তাদের উদ্দেশ্যে কবির ভাষায় বলি,”আমাকে ধিক্কার দেয়া যায় আমাকে উপেক্ষা করা যায় না।” কারুর আনুকূল্য অথবা হাততালি, পুরস্কার ইত্যাদির পরোয়া না করে তিনি লিখে চলেছেন আজও তাঁর বাঁধনছাড়া বেপরোয়া নিজস্ব শৈলীতে।

সোনালী মিত্র নিয়েছেন মলয় রায়চৌধুরীর সাক্ষাৎকার

12669528_570042299825533_7388063549220309394_n

মায়াজম :  ” প্রচণ্ড বৈদ্যুতিক ছুতার ” এর পরে মলয় রায়চৌধুরীর সেই কবিতা আর এলো কই যে আগামী প্রজন্ম মনে রাখবে ? নাকি বিতর্ক হয়েছিল বলে কবিতাটা বিখ্যাত হয়েছিল ? নাকি মলয় রায়চৌধুরীর সব প্রতিভা ঢাকা পড়ে গেলো ”প্রচণ্ড বৈদ্যুতিক ছুতার ” এর সৌজন্যে ?
মলয় :  ওটা ছিল মূলত দ্রুতির কবিতা ; আক্ষেপানুরাগের কবিতা । ওই কবিতার দরুন পঁয়ত্রিশ মাস ধরে আদালত-উকিল-চাকুরি থেকে সাসপেনশানের কারণে অর্থাভাব ইত্যাদির ফলে দ্রুতির রেশ আক্রান্ত হয়েছিল । কলকাতায় তো আমার মাথাগোঁজার ঠাঁই ছিল না, কেননা আমরা তখন পাটনায় থাকতুম । সুবিমল বসাক ছাড়া অন্যান্য বন্ধুরাও কলকাতায় তাদের আস্তানায় রাতে থাকতে দিত না । উত্তরপাড়ার আদিবাড়ির খণ্ডহরে রাতে থাকলে সকালে কলকাতা আদালতে যাবার জন্যে প্যাসেঞ্জার ট্রেন, যার সময়ের ঠিক ছিল না । ইলেকট্রিক ট্রেন তখন সেরকমভাবে আরম্ভ হয়নি । সে কি দুরবস্হা । টয়লেট করতে যেতুম শেয়ালদায় দাঁড়িয়ে থাকা দূরপাল্লার ট্রেনে ; রাত কাটাতুম সুবিমলের জ্যাঠার স্যাকরার এক-ঘরের দোকানে, বৈঠকখানা পাড়ায় । একই শার্ট-প্যাণ্ট পরে দিনের পর দিন কাটাতে হতো ; স্নান রাস্তার কলে, সেগুলোও আবার এতো নিচু যে হামাগুড়ি দিয়ে বসতে হতো । কবিতা লেখার মতো মানসিক একাকীত্বের সময় পেতুম না মাসের পর মাস ।
‘প্রচণ্ড বৈদ্যুতিক ছুতার’ কবিতাটা তখন বিখ্যাত হয়নি ; হয়েছে এই বছর পনেরো-কুড়ি হল । তখন তো ভয়ে লোকে হাংরি শব্দটাই ব্যবহার করত না, কবিতাটা নিয়ে আলোচনা তো দূরের কথা । আমার মনে হয় বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পর ওদেশে কবিতাটা প্রকাশের ব্যাপারে বা হাংরি আন্দোলন নিয়ে আলোচনার ব্যাপারে ভীতি ছিল না । ঢাকায় মীজানুর রহমান ওনার পত্রিকায় ধারাবাহিক আমার ‘হাংরি কিংবদন্তি’ প্রকাশ করেছিলেন । আশির দশকে আমার বেশির ভাগ লেখা প্রকাশিত হয়েছে ঢাকার পত্র-পত্রিকায় । বাংলাদেশের কবিদের দেখাদেখি পশ্চিমবঙ্গে বছর দশেক পরে কবিতাটা প্রকাশের সাহস যোগাতে সক্ষম হন লিটল ম্যাগাজিন সম্পাদকেরা । এখন তো কলকাতার সংবাদপত্রের পুস্তিকাতাও প্রকাশিত হতে দেখি । ‘ক্ষুধার্ত’, ‘ক্ষুধার্ত খবর’ ইত্যাদি যে পত্রিকাগুলো সুভাষ ঘোষ আর বাসুদেব দাশগুপ্ত প্রকাশ করত, তাতেও ওরা আমার কবিতা প্রকাশ করতে বা আমার নামোল্লেখ করতে ভয় পেতো ; এমনকি হাংরি শব্দটা এড়াবার জন্য ক্ষুধার্ত শব্দটা প্রয়োগ করা আরম্ভ করেছিল । আসলে শৈলেশ্বর ঘোষ, সুভাষ ঘোষ আদালতে আমার বিরুদ্ধে রাজসাক্ষী হয়ে গিয়ে আত্মঅবমাননার গাড্ডায় পড়েছিল ।
আমার মনে হয় তোদের নাগালে আমার বইপত্র পৌঁছোয় না বলে কেবল ‘প্রচণ্ড বৈদ্যুতিক ছুতার’ দ্বারা প্রভাবিত রয়েছিস । আমার উপন্যাস ‘ডুবজলে যেটুকু প্রশ্বাস’ আর ‘অরূপ তোমার এঁটোকাঁটা’ তো বেশ বৌদ্ধিক রেসপন্স পেয়েছে, বিশেষ করে কম বয়সী অ্যাকাডেমিশিয়ানদের থেকে । নয়তো কেনই বা বিষ্ণুচন্দ্র দে আমার কবিতা নিয়ে পিএচডি করবেন, উনি ওনার গবেষণাপত্র গ্রন্হাকারে প্রকাশ করেছেন । স্বাতী বন্দ্যোপাধ্যায় এম ফিল করবেন ? মারিনা রেজা ওয়েসলিয়ান বিশ্ববিদ্যালয় থেকে হাংরি আন্দোলন নিয়ে গবেষণার জন্য আসবেন ? আরও কয়েকজন তরুণ-তরুণী গবেষণা করছেন । অধ্যাপক দেবপ্রসাদ বন্দ্যোপাধ্যায় সম্প্রতি ‘প্রচণ্ড বৈদ্যুতিক ছুতার’ কবিতাটা বিনির্মাণ করে অ্যাকাডেমিশিয়ানদের সাইটে আপলোড করেছেন । পড়ে দেখতে পারিস । তুই দিল্লিতে থাকিস বলে আমার বইপত্র পাস না। এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহে ইটালি থেকে গবেষণার জন্য আসছেন ড্যানিয়েলা লিমোনেলা ।
মায়াজম :  হাংরি আন্দোলন নতুনধারার কবিতার জগতে বিপ্লব এনেছিল । কিছুদিন ফুল ফুটবার পরেই রোদের তাপে মিইয়ে গেলো ! মতপার্থক্য জনিত কারণেই কি আন্দোলন শেষ হয়ে গেলো ? পৃথিবীতে সমস্ত আন্দোলনই প্রথমে আগুন লাগিয়ে দেয় মানুষের বুকে , আবার আগুন নিভিয়েও দেয় আন্দোলনের হোতারা , হাংরি ও এর ব্যতিক্রম হোল না কেন?
মলয়: হ্যাঁ, পৃথিবীর সব আন্দোলনই একটা নির্দিষ্ট উদ্দেশ্যে গড়ে ওঠে ; তার কাজ হয়ে গেলে মিলিয়ে যায় ; আন্দোলন মাত্রেই সমুদ্রের আপওয়েইলিং । হাংরি আন্দোলনের অনুপ্রেরণায় একের পর এক কতোগুলো আন্দোলন হয়ে গেছে বাংলা সাহিত্যে । তারা মিডিয়া প্রচার পায়নি বলে সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারেনি । আমরা পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের মিডিয়ার দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পেরেছিলুম, যে কারণে এই মাস তিনেক আগেও বিবিসির প্রতিনিধি এসে একটা প্রোগ্রাম তৈরি করে নিয়ে গেলেন আর প্রসারণ করলেন । গত বছর আমেরিকা থেকে অনামিকা বন্দ্যোপাধ্যায় এসে একটা ফিল্ম তৈরি করে নিয়ে গেলেন ; হাংরি আন্দোলন নিয়ে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বক্তৃতা দেবার সময়ে ওনার কাজে লাগে ফিল্মটা। হাংরির পর তো কবিতার আর গদ্যের ক্রিয়েটিভ ধারাই পালটে গেছে ।
মায়াজম :  আপনারা কবিতা আন্দোলন করে কি করতে চেয়েছিলেন ? এতদিন পরে পেছনের দিকে তাকালে কি মনে হয় অল্পবয়সে হুজুকে চেপেছিল আপনাদের সাহিত্য সাধনা ? আপনারা যা চেয়েছিলেন তার কতখানি সফলতা অর্জন করেছিলেন ? যদি সফলতা অর্জন করে থাকেন তাহলে ধরে রাখতেই বা পারলেন না কেন ?
মলয় : না, আমাদের আন্দোলন কেবল কবিতার আন্দোলন ছিল না । গদ্য-নির্মাণ আর ছবি-আঁকারও আন্দোলন ছিল । ছবি আঁকায় ১৯৭২ সালে অনিল করঞ্জাই ললিত কলা অ্যাকাডেমি অ্যাওয়ার্ড পেয়েছিলেন । বাসুদেব দাশগুপ্তের ‘রন্ধনশালা’ গল্পের বইটা সেই ষাটের দশকেই প্রশংসিত হয়েছিল ; এখন তো ওর রচনাসমগ্র প্রকাশিত হয়েছে, আর পাঠকদের দ্বারা সমাদৃত হচ্ছে । হাংরি আন্দোলনের কারণে পাঠবস্তু মুক্ত হয়ে গেছে যুক্তির কেন্দ্রিকতা থেকে; কবিতা আর গল্প লেখা হচ্ছে মুক্ত-সূচনা, মুক্ত-সমাপ্তি এবং মুক্ত আঙ্গিক নিয়ে ; মানের নিশ্চয়তা এড়াতে পারছে ; অফুরন্ত মানে গড়তে পারছে; সংকরায়ণ ঘটাতে পারছে; ‘আমি’কে বহুমাত্রিক আর বহুস্বরিক করে তুলতে পারছে ; শিরোনামের পরিবর্তে রুবরিক প্রয়োগ করতে পারছে ; ভঙ্গুরতা আনতে পারছে ; মাইক্রোন্যারেটিভকে গুরুত্ব দিতে পারছে; ফ্লাক্স তৈরি করতে পারছে । এ থেকেই তো বোঝা যায় যে পরের পর প্রজন্মে সফলতা ক্রমশ চারিয়ে যেতে পেরেছে ।
মায়াজম : হাংরি ভূত কি গায়ে চেপে বসে আছে এখনও আপনার পরিচয়ের সঙ্গে ? এখন ও যা লেখেন মানুষ তুলনা টানে হাংরি কবিতার সঙ্গে , এটাকে উপভোগ করেন না খারাপ লাগে ? জীবনের এইপ্রান্তে এসে কি মনে হয় হাংরি আন্দোলন অন্যকোন ভাবে পরিচালনা করা যেত যাতে এই সময়েও সমান প্রাসঙ্গিকতা থাকত ?
মলয়: হাংরি আন্দোলনের তো কেউ পরিচালক ছিলেন না । আমাদের আন্দোলনের কোনো সম্পাদকীয় দপতর, হেড কোয়ার্টার, হাই কমাণ্ড, পলিট ব্যুরো জাতীয় ব্যাপার ছিল না । যাঁর যেখান থেকে ইচ্ছে বুলেটিন বা পুস্তিকা প্রকাশ করার স্বাধীনতা ছিল । বাঙালির সাহিত্য চেতনায় এই ব্যাপারটা ছিল অভাবনীয় । প্রথম দিকে হ্যাণ্ডবিলের আকারে বেরোতো আর ফ্রি বিলি করা হতো ; যিনি বের করতেন তিনিই বিলি করতেন । কবিতার পোস্টারের প্রচলনও আমরাই সর্বপ্রথম করি, তখনকার দিনে উর্দু লিথোপ্রেসে অনিল করঞ্জাইয়ের আঁকা পোস্টার ছাপিয়ে । দেয়ালে সাঁটার কাজটা করতেন ত্রিদিব মিত্র আর ওনার প্রেমিকা আলো মিত্র । এখন যেটা হয়েছে তা হাংরি নাম ঘাড়ে চেপে যাওয়ার নয় । যা মাঝে-মাঝে নজরে পড়ে তা হল, মলয় রায়চৌধুরী নামটা আমার লেখার আগেই পাঠকের কাছে পৌঁছে একটা ইমেজ গড়ে ফেলার । এর জন্য আমার কিছু করার নেই । জনৈকা পাঠিকা লিখে জানিয়েছিলেন যে আমার কবিতাগুলোকে তিনি প্রিডেটর মনে করেন, এবং আমাকে নয়, আমার কবিতার সঙ্গে তাঁর সুপ্ত যৌনসম্পর্ক গড়ে ওঠে তা তিনি টের পান । অর্থাৎ এ-ক্ষেত্রে আমার নামকে অতিক্রম করে তিনি আমার কবিতার সঙ্গে সম্পর্ক পাতিয়ে নিয়েছেন । এই তরুণীর চরিত্রটিকে আমি ‘ভালোবাসার উৎসব’ কাব্যনাট্যে ব্যবহার করেছি । হাংরির ভুতপ্রেত আমার চেয়ে পাঠক-পাঠিকার ওপর চেপে বসেছে বেশি করে । আর হাংরি আন্দোলনের প্রাসঙ্গিকতা না থাকলে তুই পাঁচ দশক পর বিষয়টা নিয়ে উৎসাহী কেন ?
মায়াজম : স্পষ্টত তখন হাংরি আন্দোলন নিয়ে বাংলার কবিদল দু’ভাগে বিভক্ত হয়ে গিয়েছিল , যারা সঙ্গে থাকব বলেও পরে সরে গিয়েছিলেন , যারা কিছুদিন থাকবার পরে সরে গিয়েছিলেন , যারা প্রথম থেকেই বিরুদ্ধে ছিলেন , তাদের প্রতি আপনার কখনও কি মনে হয়েছে যে শিল্প-সাধনার স্বাধীনতার পরিপন্থী ছিলেন তারা ? কিংবা তাদের সেই সাহস ছিল না ?
মলয় : দু’ভাগ নয়, অনেক ভাগ । লেখালেখির জগতে এই ধরণের ঘটনা আকছার ঘটে । এটা ব্যক্তিচরিত্রের ব্যাপার, শিল্প-সাধনার নয় । সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় আমেরিকা থেকে সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়, উৎপলকুমার বসু, শক্তি চট্টোপাধ্যায়কে চিঠি লিখে ওসকাচ্ছিলেন হাংরি আন্দোলন ছেড়ে বেরিয়া যাবার জন্য । তাঁরা বেরিয়ে গিয়ে আমার বিরুদ্ধে পুলিশের সাক্ষী হয়ে যেতেই উনি ফিরে এসে আমার পক্ষের সাক্ষী হয়ে গেলেন আর নিজের বন্ধুদের ছবিটা বাঙালির ইতিহাসে নোংরা করে দিলেন । মীজানুর রহমান ‘হাংরি কিংবদন্তি’ ধারাবাহিক প্রকাশ করার পর গ্রন্হাকারে বের করতে চাইছিলেন, কিন্তু সেখানেও শামসুর রাহমানের মাধ্যমে তাঁকে বিরত করা হয় ; করেছিলেন ‘কৃত্তিবাস’ গোষ্ঠীর কবিরা । স্ট্যালিন যখন পরাবাস্তববাদীদের জেলে পুরছিলেন তখন কয়েকজন কমিউনিস্ট হয়ে-যাওয়া পরাবাস্তববাদী স্ট্যালিনকে সমর্থন করেন । হুমায়ুন আজাদ আর অভিজিৎ রায় হত্যা নিয়ে আল মাহমুদ আর নির্মলেন্দু গুণ মুখে লিউকোপ্লাস্ট লাগিয়ে বসে রইলেন । আল মাহমুদ একজন মৌলবাদী, তাঁর আচরণ বোঝা যায় । নির্মলেন্দু গুণ মুখ খুললেন না ভয়ে, এসট্যাবলিশমেন্ট তাঁকে সাহিত্যের ইতিহাস থেকেই লোপাট করে দিতে পারে এই আশঙ্কায় । পশ্চিমবঙ্গেও গণধর্ষণের ঘটনা ঘটে, কিন্তু ‘পরিবর্তনওয়ালা’ কবি-সাহিত্যিকরা মুখে লিউকোপ্লাস্ট চিপকে লুকিয়ে পড়েন । শিল্প-সাধনার স্বাধীনতা তখন কোথায় যায় ?
মায়াজম :  মলয় রায়চৌধুরী একটা ব্র্যান্ড । মলয় রায়চৌধুরী তকমা ছেপে গেলে অনেক কিছু করে ফেলা যায় যা একটা সাধারণ শিল্পীর দ্বারা সম্ভব নয় ! আপনার কি মনে হয়নি এতদিন যা লিখেছেন , যা লিখছেন এসব যেন কিছুই নয় , চরম কিছু বাকি রয়ে গেলো যা এখনও লেখা হোল না ! শেষ সময়ে এসে কি পেছনে তাকিয়ে হাঁটেন না সামনের পথ তৈরি করার খেলাতে মেতে আছেন ?
মলয় : হ্যাঁ, আসল লেখা এখনও লেখা হয়ে ওঠেনি ; মগজের মধ্যে ঘটে চলে অনেকরকমের ভাবনাচিন্তা। ব্র্যাণ্ড কিনা তা জানি না । আমার কতো প্রবন্ধ, কবিতা, উপন্যাস, কাব্যনাট্য গ্রন্হাকারে প্রকাশের অপেক্ষায় রয়েছে । ব্র্যাণ্ড হলে তো কোনো না কোনো প্রকাশক রাজি হতেন প্রকাশ করতে । কেউই রাজি হন না । অনেকে ছাপার জন্য টাকা চেয়ে বসেন । টাকাই যদি দিতে হয় তো নিজেই ছাপিয়ে ফ্রি বিলি করা ভালো, যেমন রবীন্দ্রনাথ করতেন । কেননা প্রকাশকরা টাকা নিয়ে নাকি যথেষ্ট কপি ছাপেন না, শুনেছি কয়েকজন তরুণ কবি-সাহিত্যিকের কাছে । পেছনে ফিরে তাকাই না । আমি বইপত্র সংগ্রহ করি না, নিজের বইও আমার কাছে নেই, তাই আগের লেখাগুলোর সঙ্গে সম্পর্কটা অবিরাম ছিন্ন হয়ে চলেছে । আমার বইয়ের কোনো লাইব্রেরি নেই । বই-পত্রিকা পড়ি, আগ্রহী পাঠকদের বিলিয়ে দিই ।
মায়াজম : যৌবনে শুভা শেষ জীবনে অবন্তিকা’র মধ্যে দিয়ে প্রেমের ভিন্নতা খুঁজতে চাওয়া কি কোন ভুল সংশোধন ? নারীকে যখন ভোগ্য , পুরুষকে ও যখন ভোগ্য ভেবে সমস্ত নৈরাশ্যকে প্রশ্রয় দেওয়া হয় , তখন কি মনে হয়নি শ্মশানের পাশেই হাসনুহানা গাছে কত ফুল ফুটে আছে , সেই ফুলের শোভা ও নৈরাশ্যর মতই ভীষণ সত্য , ফুলকে উপেক্ষিত করা যায় ?
মলয় : শুভা যৌবনের নয় ; বয়ঃসন্ধিকালের । আমার “রাহুকেতু” উপন্যাস পড়লে তুই আমার জীবনের কয়েকজন নারীর সঙ্গে পরিচিত হতে পারবি । “ভালোবাসার উৎসব” কাব্যনাট্যেও আছেন তাঁরা । আমার ‘অলৌকিক প্রেম ও নৃশংস হত্যার রহস্যোপন্যাস’ বইতে একটি নারী চরিত্র আছে যে একজন আধচেনা পুরুষের হাত ধরে বলে ওঠে, ‘চলুন পালাই’ । এটা আমার জীবনে একজন নারীর প্রবেশের প্রয়াস ছিল । অবন্তিকা একটি নির্মিত প্রতিস্ব । এর আগে রামী, বনলতা সেন, নীরা, নয়ন, সুপর্ণা ইত্যাদি ছিল কবিদের নিজস্ব নারী । অবন্তিকা সেরকম নারী নয়, সে স্বাধীন, পাঠকের কাছে, আলোচকের কাছে, নির্দ্বিধায় যায় । অবন্তিকা আমার স্লেভগার্ল নয় ।
মায়াজম : এই সময়ের কবিতার ভবিষ্যৎ কি ? এই সময়ের কবিতা কোনপথে এগিয়ে গেলে হাংরি যেখানে শেষ করেছিল সেখান থেকে শুরু করা যাবে ? নাকি এখনকার কবিরা গোলকধাঁধায় পড়েছে , কি করবে না করবে কিছুই যেন লক্ষ্য নেই তাদের সামনে ? নাকি এখনকার কবিতা সমাজ রাষ্ট্র সময় থেকে সরে যাওয়া কোন জাফর শা ? কোন উত্তাপ লেগে নেই তাদের হৃদয়ে ?
মলয় : এখন তো অনেকের কবিতা পড়ে আমার হিংসে হয়; অসাধারণ কবিতা লিখছেন এখনকার কবিরা । মনে হয় শব্দ বাক্য ছন্দ সবই তো রয়েছে, আমি কেন এদের মতন লিখতে পারছি না । যেমন রাকা দাশগুপ্ত, সাঁঝবাতি, মুজিবর আনসারী, বিভাস রায়চৌধুরী, অনুপম মুখোপাধ্যায়, বিদিশা সরকার, বহতা অংশুমালী, মিচি উল্কা প্রমুখ । সব নাম এক্ষুনি মনে আসছে না ।
মায়াজম : কবির চেতনায় কোন না কোন পূর্বজ কবির একটি আদর্শগত ধারাপাত থেকে যায়, এটা প্রাচীন কাল থেকেই লক্ষণীয় ,কবি অগ্রজ কোন কবির দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন ? আসলেই কে কাউকে সামনে রেখে এগিয়ে যাওয়া যায় সাধনায় ? যদি যায় কতদূর গিয়েই বা ফিরে আসা উচিত নিজের চেতনায় ?
মলয় : শৈশবে আমাদের পরিবারে শিউনন্দন কাহার আর বাবার ফোটোগ্রাফি দোকানে রামখেলাওয়ন সিং ডাবর, দুজন কাজের লোক ছিল । শিউনন্দন নিরক্ষর হলেও পুরো রামচরিতমানস মুখস্হ ছিল । রামখেলাওয়ন রহিম, দাদু আর কবির থেকে উদ্ধৃতি দিতে পারত । তারা কাজের লোক ছিল বলে সরাসরি বকুনি দিতে পারত না, কিন্তু রামচরিতমানস বা রহিম-কবির-দাদু থেকে কোট করে জানিয়ে দিত আমরা কী ভুল করছি । আমার বাল্যস্মৃতি “ছোটোলোকের ছোটোবেলা”র ‘এই অধম ওই অধম’ অংশে আমি তাঁদের উদ্ধৃতি দিয়ে নিষেধ করার কিছু উদাহরণ দিয়েছি । অগ্রজ কবিদের বদলে এই দুই জনের প্রভাব আমার ওপর গভীরভাবে পড়েছিল । তাছাড়া, আমাদের বাড়িতে প্রথম স্কুলে পড়তে ঢুকেছিলেন আমার দাদা সমীর রায়চৌধুরী । আমাদের পরিবার সেই অর্থে শিক্ষিত-সংস্কৃতিমান পরিবার ছিল না । বাবা-মা আর জেঠা-কাকারা কেউই স্কুলে পড়েননি । বাবা-জেঠারা সুযোগ পাননি কেননা ঠাকুর্দা ছিলেন ভ্রাম্যমান ফোটোগ্রাফার-আর্টিস্ট, বেশির ভাগ সময় কাটাতেন প্রিন্সলি স্টেটের সদস্যদের পেইনটিং আঁকায় ; উনি সপরিবারে মুভ করতেন এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় । আমার বাবা তো জন্মেছিলেন লাহোরে । গোঁড়া বামুন পরিবার ছিল বলে ঠাকুমা আর বড়োজেঠা রবীন্দ্রসঙ্গীতকে মনে করতেন বেমমো ; বহুকাল রবীন্দ্রসঙ্গীত নিষিদ্ধ ছিল আমাদের বাড়িতে ।
মায়াজম : প্রতিটি সফল পুরুষের পিছনে নাকি একজন নারী শক্তি বিরাজ করেন ।আপনার কলমের প্রাণোচ্ছল পরিনতির জন্য কোন নারীশক্তিকে কি আধার মানতে চান ?কবি কলম দূর্ধষ রোম্যান্টিক, এই রোম্যান্টিসিজম এখনো কি প্রেমে পড়তে বাধ্য করে ?আপনার কলমে যে নারীদের পাই তারা কি শুধুই কল্পনারী নাকি বাস্তবেও তাদের ছোঁয়া আছে ?
মলয় : না, আমার পেছনে কোনো নারী নেই, মানে প্রেমিকা-নারী নেই । তবে সাপোর্ট সিস্টেম হিসাবে মা ছিলেন । যে নারীদের আমার লেখায় পাস, তারা কল্পনারী নয়, বাস্তবের নারী, একমাত্র অবন্তিকা হল বিভিন্ন নারীর উপাদান নিয়ে নির্মিত একটি প্রতিস্ব । ‘চলুন পালাই’ পর্ব থেকে আমি আর প্রেমে পড়তে চাই না । রোম্যান্টিক হওয়াটাই আমাকে বিপদে ফেলেছে বারবার । বড্ড ডিসট্র্যাকশান হয় প্রেমে । বুড়ো হয়ে গেছি বলে বলছি না, অভিজ্ঞতা থেকে বলছি ।
মায়াজম : একদম সর্বশেষ প্রশ্নটা করেই ফেলি , আগামীদিনে আপনার পরিকল্পনা কি ? নতুন কি কোন পরিকল্পনা আছে লেখালেখি নিয়ে ? পাঠকরা কি নতুন স্বাদের কিছু পেতে চলেছে আপনার কলম থেকে ?
মলয় : তোরা তো আমার লেখাপত্র যোগাড় করে পড়িস না । কমার্শিয়াল পত্রিকায় আমার লেখা বেরোয় না যে হাতে পাবি। ‘রাহুকেতু’ উপন্যাসে লেভেল-জামপিং আর ফ্রো-টু আঙ্গিক দেবার কাজ করেছি । ‘ঔরস’ উপন্যাসে ফর্ম ভেঙে মানুষের পাশাপাশি মাছিদেরও টিভি সাংবাদিকের চরিত্র দিয়েছি । ‘গল্পসংগ্রহ’তে বিভিন্ন জীবজন্তু পাখিপাখালিকে রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক মানুষের ভূমিকা দিয়েছি । চটকল আর পাটচাষের দুর্দশা নিয়ে ‘নখদন্ত’ উপন্যাসটায় ডায়েরি, নোটস, সত্য ঘটনা আর কাহিনির মিশেল দিয়েছি । ‘জঙ্গলরোমিও’ নামে একটা উপন্যাস পুজোর সময় প্রকাশিত হবার কথা, যার গল্প একদল ক্রিমিনালদের নিয়ে, সেখানে কারোর নাম উল্লেখ করা হয়নি, তাদের সংলাপের ঢঙই তাদের পরিচয়। এলেকট্রা কমপ্লেক্স নিয়ে একটা নভেলাও প্রকাশিত হবে পুজোর সময় বা পরে, তাতেও ফর্মের নিরীক্ষা করেছি ।

প্রণবকুমার চট্টোপাধ্যায় : হাংরি আন্দোলনের স্রষ্টা মলয় রায়চৌধুরী

200700_571276619566490_1868131398_n

ছয়ের দশক । নেহেরুর দ্বিতীয় যোজনা অনেকটা সরে গেছে বোম্বাই মডেলের দিকে । ঔপনিবেশিক খেসারত দিতে ভারত-চিন যুদ্ধ । ভারত পাকিস্তন যুদ্ধ । স্বদেশি আন্দোলনের সময়ে জাতীয়তাবাদী নেতারা যে সুখি, সমৃদ্ধ, উন্নত ভারতবর্ষের স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন, উত্তরঔপনিবেশিক ভারতে তা সেই সেময় দিশা হারিয়েছে । বাংলা সাহিত্যে তখন মূল ধারা দুটি । একটি বুদ্ধদেব বসু, আলোক সরকার, অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত, বিষ্ণু দে, সমর সেন, কবিতা সিংহ, শতভিষা নামক পত্রিকাসহ খ্যাতির মধ্যগগনে । অন্য ধারাটি বামপন্হী সুভাষ মুখোপাধ্যায়, বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, মঙ্গলাচরণ, রাম বসু প্রমুখরা । এই সময়কালে সাহিত্যের অঙ্গনে আবির্ভাব হলো হাংরি আন্দোলনকারীদের । যা খাপ খোলা তলোয়ার নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ল, নেতৃত্ব দিলেন মলয় রায়চৌধুরী নামের একুশ বছরের যুবক । কলকাতা শহরের শিক্ষিত মধ্যবিত্ত বাবুরা ইস্তাহার দেখেছে ট্রেড ইউনিয়ান আন্দোলনে, রাজনৈতিক দলে । তা বলে সাহিত্য আন্দোলনে ইস্তাহার বিলি করে ! ভাবগতিক দেখে নড়ে চড়ে বসলেন প্রাতিষ্ঠানিক কবি-সাহিত্যিকের দল । প্রতিটি বিষয়ের ওপর হাংরি আন্দোলনকরীদের আলাদা আলাদা ইস্তাহার ছিল । সাহিত্য বিষয়ক প্রথম ইস্তাহারটি লেখা হয় ইংরেজিতে, প্রকাশিত হয় ১৯৬১ সালে । কারণ সেটির রচয়িতা মলয় রায়চৌধুরী পাটনার বাসিন্দা, সেখানে কোনো বাংলা প্রেস নেই । পরে ১৯৬২ সালের এপ্রিলে বাংলায় ইস্তাহার প্রকাশিত হয় । ক্রিয়েটর মালয় রায়চৌধুরী, লিডার উল্টোডাঙা বস্তিতে সেই সময়ে বাস করা কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায়, প্রকাশক ও সম্পাদক হাওড়ার এক বস্তিবাসী হারাধন ধাড়া ( দেবী রায় ) । কী ছিল সেই ইস্তাহারে ?

 

 

সেই ইস্তাহার ছিল এই রকম :  মানুষ, ঈশ্বর, গণতন্ত্র পরাজিত । কবিতাই এখন একামাত্র আশ্রয় । এখন প্রয়োজন মেরুবিপর্যয়, প্রয়োজন অনর্থ বের করা । চূড়ান্ত বিশৃঙ্খলা থেকে জন্ম নেবে কবিতা । শিল্পের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা কবিতা সৃষ্টির প্রথম শর্ত । ছন্দে গদ্য লেখার খেলাকে কবিতা নাম দিয়ে চালাবার চালাকি এবার শেষ হওয়া প্রয়োজন । টেবল ল্যাম্প ও সিগারেট জ্বালিয়ে, সেরিব্রাল কর্টেক্সে কলম ডুবিয়ে, কবিতা বানানোর কাল শেষ হয়ে গেছে । এখন কবিতা রচিত হয় অরগ্যাজমের স্বতঃস্ফূর্তিতে । অন্তরজগতের নিষ্কুন্ঠ বিদ্রোহ, অন্তরাত্মার নিদারুণ বিরক্তি, রক্তের প্রতিটি বিন্দুতে রচিত হবে কবিতা । অর্থব্যঞ্জনাঘন হোক বা ধ্বনি পারম্পর্যে শ্রুতিমধুর, বিক্ষুব্ধ প্রবল চঞ্চল অন্তরাত্মার ও বহিরাত্মার ক্ষুধা নিবৃত্তির শক্তি না থাকলে কবিতা সতীর মতো চরিত্রহীনা, প্রিয়তমার মতো যোনিহীনা ও ঈশ্বরীর মতন অনুন্মেষিনী হয়ে যেতে পারে ।

 

 

সাহিত্যে ছড়িয়ে পড়ল হাংরি আন্দোলন । একে একে এসে যোগ দিলেন বিনয় মজুমদার, উৎপলকুমার বসু, সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়, সুভাষ ঘোষ, প্রদীপ চৌধুরী, সুবো আচার্য, সুবিমল বসাক, শৈলেশ্বর ঘোষ, ত্রিদিব মিত্র, আলো মিত্র, অনিল করঞ্জাই, করুণানিধান মুখোপাধ্যায়, রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়, সমীর রায়চৌধুরী, বাসিদেব দাশগুপ্ত, অবনী ধর, রবিউল, শম্ভু রক্ষিত, তপন দাশ, এবং আরও অনেকে । তখনকার প্রচলিত রীতি মানেননি হাংরিরা, তাঁদের কোনো সম্পাদকীয় দপতর বা হেড কোয়ার্টার ছিল না। যে যার মতো করে ফালি কাগজে বুলেটিন বার করত, খরচ দিতেন মলয় এবং সমীর । পত্রিকাগুলোর নামও ছিল একেবারে ভিন্ন, স্বকাল, ফুঃ, চিহ্ণ, জেব্রা, জিরাফ, প্রতিদ্বন্দ্বী, উন্মার্গ, ওয়েস্ট পেপার, ধৃতরাষ্ট্র, কনসেনট্রেশন ক্যাম্প ইত্যাদি । প্রকাশিত বুলেটিনগুলি কফি হাউসে, বিশ্ববিদ্যালয়ে, সংবাদপত্র দপতরে, কলেজে হাতে হাতে বিলি করা হতো ।

 

 

হাংরি আন্দোলন বহিরাগত এমন তকমা দিয়ে প্রাতিষ্ঠানিক লেখকরা দল বাঁধতে লাগলেন ভিতরে ভিতরে । শক্তি চট্টোপধ্যায় তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী প্রফুল্ল সেনকে উদ্দেশ্য করে ‘সীমান্ত পপস্তাব’ কবিতায় লিখলেন :

“কবিতা ভাতের মতো কেন লোকে নিতেই পারছেনা

যুদ্ধ বন্ধ হলে নেবে ? ভিখারিও কবিতা বুঝেছে

তুমি কেন বুঝবে না হে অধ্যাপক মুখ্যমন্ত্রী সেন?”

 

আগুনের মতো সব লেখা বেরিয়ে আসছে । নতুন ভাষা, নতুন আঙ্গিক, ঝরঝরে গদ্য,  তথাকথিত অশ্লীল ও যৌনশব্দের মিশেল, একবার পড়লে আর একটা পড়তে ইচ্ছা হবে । গ্রন্হ প্রকাশিত হতে লাগল আন্দোলনকারীদের । শৈলেশ্বর ঘোষের ‘জন্মনিয়ন্ত্রণ’, সুভাষ ঘোষের ‘আমার চাবি’, ‘যুদ্ধে আমার তৃতীয় ফ্রন্ট’, ফালগুনী রায় লিখলেন ‘নষ্ট আত্মার টেলিভিশন’, বাসুদেব দাশগুপ্ত লিখলেন, ‘রন্ধনশালা’, সুবিমল বসাক লিখলেন ‘ছাতামাথা’, মলয় রায়চৌধুরী লিখলেন ‘শয়তানের মুখ’, ত্রিদিব মিত্র লিখলেন ‘হত্যাকাণ্ড’, প্রদীপ চৌধুরী লিখলেন ‘চৌষট্টি ভুতের খেয়া’, আরও অনেকের লেখা বই ।

 

আঁকার জগতে প্রসারিত হল হাংরি ভাবধারা । যোগ দিলেন অনিল করঞ্জাই, করুণানিধান মুখোপাধ্যায় । মাত্র সাতাশ বছর বয়সে অনিল করঞ্জাই দিল্লির ললিতকলা অ্যাকাডেমির পুরস্কার পেয়েছিলেন।

 

 

কলকাতায় আন্দোলনের ধারা ঝড় তুলেছে । বিভিন্ন জীবজন্তু, জোকার, রাক্ষস, দেবতার মুখোশ প্রতিষ্ঠানের কর্তাব্যক্তি, কবি, লেখক, সাংবাদিক, সরকারি আধিকারিকদের পাঠিয়ে বল হলো ‘দয়া করে মুখোশ খুলে ফেলুন’ ।  পত্রিকার দপতরে বাচ্চাদের চটির বাক্স পাঠিয়ে বলা হলো রিভিউ করতে । নিমতলা শ্মশানঘাট, মাইকেলের কবর, খালাসিটোলা-মদের আড্ডায় কবিতা উৎসব করলেন তাঁরা, হাওড়া স্টেশনে বেঞ্চে দাঁড়িয়ে কবিতা পড়লেন ত্রিদিব মিত্র ও মলয় রায়চৌধুরী । মাইকেল এবং জীবনানন্দ ছাড়া অন্য কোনও কাব্যপ্রতিভাকে স্বীকার করতেন না তাঁরা । রবীন্দ্রনাথকে তাঁর গানের জন্য শ্রদ্ধা করতেন । রবীন্দ্রনাথের গান গাইতেন বাসুদেব দাশগুপ্ত ও মলয় রায়চৌধুরী ।

 

 

হাংরি আন্দোলনের সংবাদ বিদেশেও পৌঁছালো । আমেরিকার ‘টাইম’ ম্যাগাজিনে ফোটোসহ হাংরি আন্দোলনকারীদের সংবাদ প্রকাশিত হবার পর ভারতের অন্যান্য ভাষায় ছড়িয়ে পড়ল । ১৯৬৩ সালে মলয় রায়চৌধুরীর সঙ্গে পাটনায় গিয়ে দেখা করলেন বিট আন্দোলনের কবি অ্যালেন গিন্সবার্গ । বেনারসে তাঁর সঙ্গে পরিচয় হল অনিল করঞ্জাই ও করুণানিধান মুখোপাধ্যায়ের। কলকাতার প্রাতিষ্ঠানিক লেখকরা প্রশাসনের ওপর চাপ সৃষ্টি করলেন হাংরি আন্দোলনকারীদের ওপর পুলিশি অ্যাকশান নেবার জন্য । ১৯৬৪ সালে পুলিশ তাঁদের ওপর অ্যাকশান নেয়া আরম্ভ করলে, আমেরিকা থেকে অ্যালেন গিন্সবার্গ হাংরি আন্দোলনকে সমর্থন জানিয়ে কমিটি ফর কালচারাল ফ্রিডাম এর কর্তাব্যক্তি আবু সয়ীদ আইয়ুবকে ১৯৬৪ সালের ৬ই অক্টোবর চিঠি লেখেন :-

“আপনার বাগাড়ম্বর আমাকে বিভ্রান্ত করে তুলছে । মাথা গরম করে দিচ্ছে আমার । আপনি প্রতিষ্ঠিত লেখক নন ? ‘আমার কোনো পদমর্যাদা নেই’, এসব কথার মানে কি ? ইনডিয়ান কমিটি ফর কালচারাল ফ্রিডাম-এর উদ্যোগে চলা চতুর্মাসিক পত্রিকার সম্পাদক আপনি । আপনার নিজস্ব লেটারহেড আছে । ভারতীয় কমিটির এগজিকিউটিভদের তালিকা আপনার হাতের কাছেই আছে । বাগাড়ম্বর বলতে আমি বোঝাতে চাইছি  আপত্তিকর উপাদানের কথা । মশায়, আপনি এবং পুলিশই একমাত্র লেখাগুলি আপত্তিকর বলছেন । আমি আপনাদের আপত্তি তোলা নিয়েই প্রশ্ন করছি । পুলিশ নিজেদের ও অন্যদের রক্ষণশীল সাহিত্যরুচি চাপিয়ে দিচ্ছে জোর করে । ” ( দেশ, অক্টোবর, ২০১৫ )

 

আবু সয়ীদ আইয়ুব অ্যালেন গিন্সবার্গকে জবাবে বলেন, “আই ডু নট অ্যাগ্রি উইথ ইউ দ্যাট ইট ইজ দি পপাইম টাস্ক অব দি কমিটি ফর কালচারাল ফ্রিডাম টু টেক আপ দিস কজ অব দিস ইমম্যাচিয়র ইমিটেটরস অব আমেরিকান পোয়েট্রি।”

 

আবু সয়ীদ আইয়ুবের উষ্মার কারণ ছিল । মলয় রায়চৌধুরী সেসময়ে প্রাতিষ্ঠানিক কবি-লেখকদের উদ্দেশ্য করে বলেছিলেন, “ফাক দি বাস্টার্ডস অব গাঙশালিক স্কুল অব পোয়েট্রি”। কথাগুলি একটি বিয়ের কার্ডে ছাপিয়ে সাহিত্যিকদের পাঠানো হয়েছিল ।মলয়ের দেওয়া অভিধা আইয়ুব সাহেবকে আঘাত করে থাকবে ।

 

বিরোধের কারণ হল, ১৯৬৪ সালে প্রকাশিত একটি হাংরি বুলেটিনে মলয় রায়চৌধুরীর লেখা ‘প্রচণ্ড বৈদ্যুতিক ছুতার’ ( Stark Electric Jesus ) কবিতাটি, যার বিরুদ্ধে অশ্লীলতার অভিযোগ ওঠে । এছাড়াও ওই কবিতায় প্রচলিত কাব্যভাষার বিরুদ্ধে তীব্র আক্রমণ ছিল । কবিতাটি এখানে দেয়া হল:

 

ওঃ মরে যাব মরে যাব মরে যাব

আমার চামড়ার লহমা জ্বলে যাচ্ছে অকাট্য তুরুপে

আমি কী কোর্বো কোথায় যাব ওঃ কিছুই ভাল্লাগছে না

সাহিত্য-ফাহিত্য লাথি মেরে চলে যাব শুভা

শুভা আমাকে তোমার তর্মুজ আঙরাখার ভেতর চলে যেতে দাও

চুর্মার অন্ধকারে জাফ্রান মশারির আলুলায়িত ছায়ায়

সমস্ত নোঙর তুলে নেবার পর শেষ নোঙর আমাকে ছেড়ে চলে যাচ্ছে

আর আমি পার্ছি না, অজস্র কাঁচ ভেঙে যাচ্ছে কর্টেক্সে

আমি জানি শুভা, যোনি মেলে ধরো, শান্তি দাও

প্রতিটি শিরা অশ্রুস্রোত বয়ে নিয়ে যাচ্ছে হৃদয়াভিগর্ভে

শাশ্বত অসুস্হতায় পচে যাচ্ছে মগজের সংক্রামক স্ফুলিঙ্গ

মা, তুমি আমায় কঙ্কালরূপে ভূমিষ্ঠ করলে না কেন ?

তাহলে আমি দুকোটি আলোকবষহ ঈশ্বরের পোঁদে চুমো খেতুম

কিন্তু কিছুই ভলো লাগছে না আমার কিচ্ছু ভালো লাগছে না

একাধিক চুমো খেলে আমার গা গুলোয়

ধর্ষণকালে নারীকে ভুলে গিয়ে শিল্পে ফিরে এসেছি কতদিন

কবিতার আদিত্যবর্ণা মূত্রাশয়ে

এসব কী হচ্ছে জানি না তবু বুকের মধ্যে ঘটে যাচ্ছে অহরহ

সব ভেঙে চুরমার করে দেব শালা

ছিন্নভিন্ন করে দেব তোমাদের পাঁজরাবদ্ধ উৎসব

শুভাকে হিঁচড়ে উঠিয়ে নিয়ে যাব আমার ক্ষুধায়

দিতেই হবে শুভাকে

ওঃ মলয়

কোল্কাতাকে আর্দ্র ও পিচ্ছিল বরাঙ্গের মিছিল মনে হচ্ছে আজ

কিন্তু আমাকে নিয়ে আমি কী কোর্বো বুঝতে পার্ছি না

আমার স্মৃতিশক্তি নষ্ট হয়ে যাচ্ছে

আমাকে মৃত্যুর দিকে যেতে দাও একা

আমাকে ধর্ষণ ও মরে যাওয়া শিখে নিতে হয়নি

প্রস্রাবের পর শেষ ফোঁটা ঝাড়ার দায়িত্ব আমায় শিখতে হয়নি

অন্ধকারে শুভার পাশে গিয়ে শুয়ে পড়া শিখতে হয়নি

শিখতে হয়নি নন্দিতার বুকের ওপর শুয়ে ফরাসি চামড়ার ব্যবহার

অথচ আমি চেয়েছিলুম আলেয়ার নতুন জবার মতো যোনির সুস্হতা

যোনোকেশরে কাঁচের টুকরোর মতন ঘামের সুস্হতা

আজ আমি মগজের শরণাপন্ন বিপর্যয়ের দিকে চলে এলুম

আমি বুঝতে পার্ছি না কী জন্যে আমি বেঁচে থাকতে চাইছি

আমার পূর্বপুরুষ লম্পট সাবর্ণচৌধুরীদের কথা আমি ভাবছি

আমাকে নতুন ও ভিন্নতর কিছু কোর্তে হবে

শুভার স্তনের ত্বকের মতো বিছানায় শেষবার ঘুমোতে দাও আমায়

জন্মমুহূর্তের তীব্রচ্ছটা সূর্যজখম মনে পড়ছে

আমি আমার নিজের মৃত্যু দেখে যেতে চাই

মলয় রায়চৌধুরীর প্রয়োজন পৃথিবীর ছিল না

তোমার তীব্র রূপালি য়ূটেরাসে ঘুমোতে দাও কিছুকাল শুভা

শান্তি দাও, শুভা শান্তি দাও

তোমার ঋতুস্রাবে ধুয়ে যেতে দাও আমার পাপতাড়িত কঙ্কাল

আমাকে তোমার গর্ভে আমারই শুক্র থেকে জন্ম নিতে দাও

আমার বাবা-মা আন্য হলেও কি আমি এরকম হতুম ?

সম্পূর্ণ ভিন্ন এক শুক্র থেকে মলয় ওর্ফে আমি হতে পার্তুম ?

আমার বাবার অন্য নারীর গর্ভে ঢুকেও কি মলয় হতুম ?

শুভা না থাকলে আমিও কি পেশাদার ভদ্রলোক হতুম মৃত ভায়ের মতন ?

ওঃ বলুক কেউ এসবের জবাবদিহি করুক

শুভা, ওঃ শুভা

তোমার সেলোফেন সতীচ্ছদের মধ্যে দিয়ে পৃথিবীটা দেখতে দাও আমায়

পুনরায় সবুজ তোশকের ওপর চলে এসো শুভা

যেমন ক্যাথোড রশ্মিকে তীক্ষ্ণধী চুম্বকের আঁচ মেরে তুলতে হয়

১৯৫৬ সালের সেই হেস্তনেস্তকারী চিঠি মনে পড়ছে

তখন ভাল্লুকের ছাল দিয়ে সাজানো হচ্ছিল তোমার ক্লিটোরিসের আশপাশ

পাঁজর নিকুচি করা ঝুরি তখন তোমার স্তনে নামছে

হুঁশাহুঁশহীন গাফিলতির বর্ত্মে স্ফীত হয়ে উঠছে নির্বোধ আত্মীয়তা

আ আ আ আ আ আ আ আ আ আঃ

মরে যাব কিনা বুঝতে পার্ছি না

তুল্কালাম হয়ে যাচ্ছে বুকের ভেতরকার সমগ্র অসহায়তায়

সব কিছু ভেঙে তছনছ করে দিয়ে যাব

শিল্পের জন্যে সক্কোলকে ভেঙে খান-খান করে দোব

কবিতার জন্যে আত্মহত্যা ছাড়া স্বাভাবিকতা নেই

শুভা

আমাকে তোমার লাবিয়া ম্যাজোরার স্মরণাতীত অসংযমে প্রবেশ কোর্তে দাও

দুঃখহীন আয়াসের অসম্ভাব্যতায় যেতে দাও

বেসামাল হৃদয়বত্তার স্বর্ণসবুজে

কেন আমি হারিয়ে যাইনি আমার মায়ের যোনিবর্ত্মে ?

কেন আমি পিতার আত্মমৈথুনের পর তাঁর পেচ্ছাপে বয়ে যাইনি ?

কেন আমি রজোস্রাবে মিশে যাইনি শ্লেষ্মায় ?

অথচ আমার নীচে চিত আধবোজা অবস্হায়

আরামগ্রহণকারিণী শুভাকে দেখে ভীষণ কষ্ট হয়েছে আমার

এরকম অসহায় চেহারা ফুটিয়েও নারী বিশ্বাসঘাতিনী হয়

আজ মনে হয় নারী ও শিল্পের মতো বিশ্বাসঘাতিনী কিছু নেই

এখন আমার হি২স্র হৃৎপিণ্ড অসম্ভব মৃত্যুর দিকে যাচ্ছে

মাটি ফুঁড়ে জলের ঘূর্ণি আমার গলা ওব্দি উঠে আসছে

আমি মরে যাব

ওঃ এসমস্ত কী ঘটছে আমার মধ্যে

আমি আমার হাত হাতের চেটো খুঁজে পাচ্ছি না

পায়জামায় শুকিয়ে-যাওয়া বীর্য থেকে ডানা মেলছে

৩০০০০০ শিশু উড়ে যাচ্ছে শুভার স্তনমণ্ডলীর দিকে

ঝাঁকে-ঝাঁকে ছুঁচ ছুটে যাচ্ছে রক্ত থেকে কবিতায়

এখন আমার জেদি ঠ্যাঙের চোরাচালান সেঁদোতে চাইছে

হিপ্নোটিক শব্দরাজ্য থেকে ফাঁসানো মৃত্যুভেদী যৌনপর্চুলায়

ঘরের প্রত্যেকটা দেয়ালে মার্মুখি আয়না লাগিয়ে আমি দেখছি

কয়েকটা ন্যাংটো মলয়কে ছেড়ে দিয়ে তার আপ্রতিষ্ঠিত খেয়োখেয়ি

 

তৎকালীন কবি-সাহিত্যিকরা হাংরি আন্দোলনকারীদের ক্ষুধার্ত ভাষা সম্পর্কে আতঙ্কিত হচ্ছিলেন । প্রচারের সব আলো তখন হাংরি আন্দোলনের দিকে । সরকার বিব্রত হচ্ছিল হাংরি আন্দোলনকারীদের বৌদ্ধিক আক্রমণে । একটি লিটল ম্যাগাজিন সম্পাদক ( পবিত্র বল্লভ ), কয়েকজন কবি এবং পুলিশের ইনফরমাররা গোপনে তথ্য, বুলেটিন, পত্রিকা, হাংরিদের ঠিকানা ইত্যাদি যোগাড় করতে লাগল, তাদের বিরুদ্ধে পুলিশি অ্যাকশান নেবার জন্য । পরিশেষে ছাব্বিশজন কবিকে লালবাজারে ডেকে জেরা করা হল । ওয়ারেন্ট ইশ্যু করা হল এগারোজনের বিরুদ্ধে । বুলেটিনের প্রকাশক হিসাবে সমীর রায়চৌধুরী গ্রেপ্তার হলেন চাইবাসা থেকে । তিনি সেখানে ছিলেন ডিস্ট্রিক্ট ফিশারিজ অফিসার । কলকাতার পুলিশ পাটনায় গিয়ে মলয় রায়চৌধুরীকে গ্রেপ্তার করল । গ্রেপ্তারের পর পুলিশ ইন্সপেক্টররা রিকশায় বসলেন এবং মলয়কে হাতে হাতকড়া ও কোমরে দড়ি বেঁধে চোরডাকাতের মতন রাস্তা দিয়ে হাঁটিয়ে নিয়ে যাওয়া হল । বাড়ি লণ্ডভণ্ড করে বহু লেখাপত্র নষ্ট করে দেওয়া হল। ফাইল, বইপত্র, টাইপরাইটার ইত্যাদি বগলদাবা করে কলকাতায় নিয়ে গেল লালবাজার পুলিশ, যা আর পরে ফিরে পাননি হাংরি আন্দোলনকারীরা। শৈলেশ্বর ঘোষ ও সুভাষ ঘোষ গ্রেপ্তার হল কলকাতায় । তাদের কাছ থেকে ঠিকানা নিয়ে আগরতলা থেকে গ্রেপ্তার  করে নিয়ে এলো প্রদীপ চৌধুরীকে । দেবী রায়কে বর্ধমানে পোস্টাফিসের দপতর থেকে গ্রেপ্তার করে আনা হল । সুবো আচার্য আগরতলা থেকে এক উপজাতি গ্রামে পালিয়ে গিয়েছিলেন, পুলিশ তাঁকে ধরতে পারেনি । সকলকে জিজ্ঞাসাবাদ করে, শৈলেশ্বর ঘোষ ও সুভাষ ঘোষকে দিয়ে মলয় ও হাংরি আন্দোলনের বিরুদ্ধে মুচলেকা লিখিয়ে ছেড়ে দেয়া হয় । মলয়ের বিরুদ্ধে মুচলেকা লিখে দিয়েছিলেন সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়, শক্তি চট্টোপাধ্যায় ও উৎপলকুমার বসু — এনারা মলয়ের বিরুদ্ধে সরকার পক্ষের সাক্ষী হয়েছিলেন । শৈলেশ্বর ঘোষ ও সুভাষ ঘোষ মলয়ের বিরুদ্ধে রাজসাক্ষী হতে রাজি হয়ে ছাড়া পান । ১৯৬৫ সালে নিম্ন আদালতে ( ব্যাংকশাল কোর্ট ) মলয়ের দণ্ডাদেশ হয় । মলয় এর বিরুদ্ধে হাইকোর্টে আপিল করেন ।

 

 

কলকাতায় যখন হাংরি আন্দোলন নিয়ে তোলপাড় চলছে , সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় তখন মার্কিন সরকারের টাকায় গেছেন আমেরিকার আইওয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে কবিতার কর্মশালায় যোগ দিতে । ‘কৃত্তিবাস’ পত্রিকা সামলাচ্ছেন শরৎকুমার মুখোপাধ্যায় । স্বাভাবিকভাবেই সুনীল বেশ উদ্বিগ্ন । তাঁর অবর্তমানে কলকাতা দখল করে নিচ্ছে একদল তরুণ, এবং তিনি এই বিষয়ে কিছুই জানেন না ; বন্ধুদের চিঠি পেয়ে তাঁর উদ্বেগ বাড়ছে । ১৯৬৪ সালের ১০ই জুন একটি চিঠিতে সুনীল আইওয়া থেকে মলয়কে লিখলেন, “কলকাতা শহরটা আমার, ফির গিয়ে আমি ওখানে রাজত্ব করব । দু’একজন বন্ধুবান্দব ওই দলে আছে বলে নিতান্ত স্নেহবশতই তোমাদের হাংরি জেনারেশন গোড়ার দিকে ভেঙে দিইনি । এখনও সে ক্ষমতা রাখি । লেখার বদলে হাঙ্গামা ও আন্দোলন করার দিকেই তোমার লক্ষ্য বেশি । যতো খুশি আন্দোলন করো, বাংলা কবিতার এতে কিছু এসে যায় না ।” আসলে সুনীলও প্রাতিষ্ঠানিক লেখকদের মতো হাংরি আন্দোলনের জনপ্রিয়তা ও বিস্তার নিয়ে শঙ্কিত হচ্ছিলেন । আমেরিকার লিটল ম্যাগাজিনে হাংরি আন্দোনকারীদের রচনা তাঁর চোখের সামনেই প্রকাশিত হচ্ছিল । উক্ত চিঠিতে সেই উদ্বেগের প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে ।

 

 

কলকাতা হাইকোর্টে মলয়ের মামলাটি ওঠে বিচারক তারাপদ মুখোপাধ্যায়ের এজলাসে ।মলয়ের হয়ে মামলাটি হাইকোর্টে লড়েছিলেন ব্যারস্টার মৃগেন সেন ও তাঁর চারজন সহকারী । মৃগেন সেনের কাছে মলয়কে নিয়ে গিয়েছিলেন সদ্য লণ্ডন থেকে ফেরা ব্যারিস্টার, জ্যোতির্ময় দত্তের বন্ধু, করুণাশঙ্কর রায় ।

 

 

 

ব্যাংকশাল কোর্টে মলয়ের বিরুদ্ধে প্রথম সাক্ষ্য দিয়েছিলেন ‘উপদ্রুত’ পত্রিকার সম্পাদক পবিত্র বল্লভ । এর পর লালবাজারের জাল সাক্ষী দিয়ে গেলেন এক অফিসার যিনি মলয় রায়চৌধুরীকে পাটনা থেকে গ্রেপ্তার করে এনেছিলেন । এরপর শক্তি চট্টোপাধ্যায়, যিনি প্রথম হাংরি ইস্তাহারে লিডার ছিলেন । এছাড়াও মলয়ের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিয়ে গেলেন সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়, উৎপলকুমার বসু, অন্য দুই হাংরি শৈলেশ্বর ঘোষ ও সুভাষ ঘোষ । তারপর মলয়ের পক্ষের সাক্ষীরা । প্রথমে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, ভরা আদালতে দাঁড়িয়ে বিচারককে জানালেন কবিতাটি অবসিন নয়, ভালগারও নয়, কবিতাটিতে নামমাত্র অশ্লীলতা আছে বলে তিনি মনে করেন না । একে একে সাক্ষ্য দিলেন তরুণ সান্যাল, কবি বুদ্ধদেব বসুর জামাতা জ্যোতির্ময় দত্ত, কবি অজিত দত্ত’র মার্কিন-প্রবাসী পুত্র সত্রাজিৎ দত্ত ।  মলয়ের পক্ষে এতোজনের সাক্ষ্য সত্ত্বেও বিচারক অমলকুমার মিত্র মলয়ের বিরুদ্ধে সাক্ষ্যদানকারীদের বক্তব্যের ওপর নির্ভর করে দণ্ডাদেশ দিয়েছিলেন।

কলকাতা হাইকোর্ট মলয়কে ১৯৬৭ এর জাজমেন্টে বেকসুর খালাস করে দেন । মলয়ের বিরুদ্ধে অভিযোগকে নাকচ করে দেন বিচারক । এই ঘটনাটি আন্তর্জাতিক পত্র-পত্রিকায় ভালো রকমের সাড়া ফেললো । টাইম ম্যাগাজিন লিখলো, ‘ক্যালকাটাজ হাংরি জেনারেশন ইজ এ গ্রোইং ব্যাণ্ড অব ইয়ং বেঙ্গলি টাইগার্স উইথ টাইগার্স ইন দেয়ার ট্যাঙ্কস’।

মলয়ের ‘প্রচণ্ড বৈদ্যুতিক ছুতার’কবিতাটির ইংরেজি অনুবাদ প্রকাশিত হল ওয়াশিংটন স্টেট ইউনিভার্সিটি থেকে, ‘স্টার্ক ইলেকট্রিক জেশাস’ নামে যা হাওয়ার্ড ম্যাককর্ড অনুবাদ করেছিলেন । কবিতাটি এবং তাঁর কোর্ট কেসের সংবাদ তার আগে প্রকাশিত হয়েছিল লরেন্স ফেরলিংঘেট্টি সম্পাদিত ‘সিটি লাইটস জার্নাল’ পত্রিকায় । এই সিটি লাইটস থেকেই প্রকাশিত হতো বিট আন্দোলনের কবি ও লেখকদের বই ।

 

১৯৬৪ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর ব্লিৎস পত্রিকায় এক পৃষ্ঠাব্যাপী হাংরি আন্দোলনের খবর প্রকাশিত হল । তাতে বলা হল, “পুলিশ ন্যাব ক্যালকাটা বিটনিকস । ইরটিক লাইভস অ্যাণ্ড লাভস অব হাংরি জেনারেশন।”

 

আন্দোলন তুঙ্গে থাকার সময়ে আনন্দবাজার, যুগান্তর, সাপ্তাহিক জনতা নামের সংবাদপত্রগুলিতে নিয়মিত হাংরি আন্দোলনের খবর গুরুত্ব সহকারে প্রকাশিত হতো । দৈনিক স্টেটসম্যান, যুগান্তর, আনন্দবাজর পত্রিকায় মলয় ও দেবী রায়ের কার্টুন প্রকাশিত হয়েছিল। সেই সময়ে জনতা পত্রিকার প্রথম পাতায় একবার মলয়ের আকটি কার্টুন প্রকাশিত হল । উপরে শিরোনাম “কল্লোল যুগের প্রৌঢ় কবিও কি হাংরি?” কার্টুনের তলায় বুদ্ধদেব বসুর সাম্প্রতিক একটি লেখা থেকে কয়েক লাইন । উদ্ধৃত অংশটি লেখার কিছুদিন আগেই বুদ্ধদেব বসু আমেরিকা গিয়েছিলেন । লেখাটিতে বুদ্ধদেব বসুর এরকম লাইন ছিল, “শিথিল শাড়ি, সোনালী শরীর গলে যায় ধীরে, স্তনের বোঁটা, চোখের মতো কাঁপছে । টার পাই তার স্তন দুটি উঁচু হয়ে আমাকে দেখছে । বলি, থামো, যেও না, ময়লা জিনের প্যান্টালুন থেকে বেরিয়ে আসবে তলোয়ার, জ্বলবে আমার আগুন তোমার জোয়ারে । জবাবে সে মাথার তলা থেকে বালিশ ফেলে দেয়, দমকা হাওয়ায় উড়িয়ে দেয় শাড়ি, তার উদর পালের মতো এগিয়ে আসে । এখনও তবু আমি লুব্ধ । হাড়ে হাড়ে অমর কাম ক্ষমাহীন।”

 

এই লেখাটি প্রমাণ করে যে কেবল যৌন শব্দপ্রয়োগের জন্যই মলয় রায়চৌধুরী আক্রান্ত হননি । তাহলে বুদ্ধদেব বসুও হতেন । আসল কারণ ছিল প্রতিষ্ঠানবিরোধিতা । প্রতিষ্ঠান চায়, ব্যক্তিএকক চিরকাল সরকার ও ক্ষমতাবান প্রাতিষ্ঠানিকদের পদানত থাকবে । এটাই সত্য । মলয়ের অসহ্য উপস্হিতি, সরকার ও প্রাতিষ্ঠানিক কর্তাদের বিব্রত করছিল । তাই সকলকে ছেড়ে দিলেও মলয় রায়চৌধুরীকে মামলার মুখোমুখি হতে হয় । হাতে হাতকড়া, কোমরে দড়ি বেঁধে তাঁকে রাস্তা দিয়ে হাঁটিয়ে নিয়ে যাওয়া হয় । হাংরি আন্দোলন মামলা চলাকালীন বুদ্ধদেব বসুর সঙ্গে দেখা করতে চেয়েছিলেন মলয়, তাঁর কবিতা ভবনের বাড়িতে গিয়ে । বুদ্ধদেব বসু দেখা করতে চাননি ; মলয় পরিচয় দিতেই দরোজা বন্ধ করে দিয়েছিলেন ।

 

এখন দেখা যাক মলয় রায়চৌধুরী মানুষটা কেমন । কিসের জোরে হাংরি আন্দোলনের মতো এতো বড়ো উথালপাথাল ঘটিয়ে দিতে পারলেন, তার জন্ম দিলেন, তাকে লালন করলেন, অংশগ্রহণকারীদের একত্রিত করে প্রকৃত নেতৃত্ব দিলেন । বাংলা কবিতার খোলনলচে পালটে দিয়ে জেল খাটলেন কবিতা লেখার জন্য । সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের মতো প্রাতিষ্ঠানিক লেখককে ভয় পাইয়ে দিলেন । মলয় রায়চৌধুরী, যিনি একটি কবিতায় লিখেছিলেন, সাহিত্যের আধুনিকতাবাদ একটি ‘ধ্রুপদী জোচ্চোর’ ।

 

মলয় ১৯৩৯ সালে জন্মগ্রহণ করেন পাটনা শহরের ইমলিতলা নামের এক অন্ত্যজ অধ্যুষিত পাড়ায়, যেখানে ডোম, মেথর, দুসাধ, চামার, কুমোর, দরিদ্রতম মুসলমান পরিবারের বসবাস ।

 

 

মলয়ের শৈশব কেটেছে প্রত্যহ  সন্ধ্যায় শূকরের মৃত্যুকালীন আর্ত-চিৎকার শুনে । পাড়ার গরিব অন্ত্যজরা শুকরের মাংস খেতো । শূকরকে মারার জন্য প্রাণীটাকে একটা গর্তে ফেলে দিয়ে তার দেহে গনগনে লোহার শিক বিঁধে দিত, আর তার মৃত্যকালীন চিৎকারে ভারি হয়ে উঠত মহল্লার বাতাস । কম বয়সি বাচ্চাদের মুখে ফিরত “পুরি কচৌড়ি তেল মে, জিন্না বেটা জেল মে।”

 

 

মলয় প্রাথমিক শিক্ষা পান পাটনা শহরের মিশনারি স্কুলে । মিশনারি স্কুলের চার্চের ফাদার হিলম্যান মলয়ের বাবার ফোটোর দোকানের ক্রেতা ছিলেন ; তাঁরই সহযোগিতায় মলয় ভর্তি হন, এবং তাঁর ফিসও মুকুব করে দেয়া হয়েছিল । তারপর ক্লাস সিক্স থেকে ম্যাট্রিক পর্যন্ত পড়েন ব্রাহ্ম স্কুল রামমোহন রায় সেমিনারিতে । পাটনা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৫৮ সালে অর্থনীতিতে সান্মানিক স্নাতক হন, দ্বিতীয় স্হান অধিকার করেন । ১৯৬০ সালে অর্থনীতিতে স্নাতকোত্তর হন, এবং পুনরায় বিশ্ববিদ্যালয়ে দ্বিতীয় স্হান অধিকার করেন । পাশ করা মাত্র তিনি ভাগলপুর ও শিলঙে অধ্যাপকের চাকরি পেয়েছিলেন, কিন্তু তাঁর বাবা-মা তাঁদের একা ছেড়ে যেতে বারন করেন । মলয়ের দাদা সমীর রায়চৌধুরী ডিস্ট্রিক্ট ফিশারিজ অফিসার হিসাবে বিহারের বিভিন্ন জেলা সদরে চাকরি করতেন । বাবা-মাকে দেখার আর কেউ ছিল না । মলয়রা দুই ভাই, কোনও বোন নেই ।

 

পাটনার অতিদরিদ্র ইমলিতলা পাড়ায় বসবাস করলেও, মলয়ের একটি উজ্জ্বল পারিবারিক অতীত আছে । বড়িশা-বেহালার সাবর্ণ চৌধুরী বংশের সপ্তম প্রজন্ম মলয় । বাবা রঞ্জিত রায়চৌধুরী, মা অমিতা রায়চৌধুরী । মলয়ের বাবা ও দাদুর কোনো বিদ্যায়তনিক শিক্ষা চিল না । দাদু ফারসি, আরবি, উর্দু লিখতে পড়তে পারতেন, কিন্তু ইংরেজি জানতেন না । সেই অর্থে মলয় এবং দাদা সমীরই স্কুল-কলেজে শিক্ষিত প্রথম প্রজন্ম । মলয়ের বাবার ঠাকুর্দা  সাবর্ণ চৌধুরী পরিবার থেকে বিতাড়িত হন মুখোপাধ্যায় পরিবারের বাল্য বিধবাকে বিবাহের কারণে । মলয়ের বাবার পাটনায় ফোটোগ্রাফির দোকান ছিল, ব্যবসাটি পত্তন করেছিলেন মলয়ের ঠাকুর্দা, সেসময়ে তা ছিল ভ্রাম্যমান ফোটোর ব্যবসা । ঠাকুর্দা বর্তমান পাকিস্তানের বিভিন্ন শহরে গিয়ে অভিজাত পরিবারের সদস্যদের ফোটো তুলে তা থেকে পেইনটিঙ আঁকতেন । মলয়ের জেঠামশায় প্রমোদ ছিলেন পাটনা মিউজিয়ামের ‘কিপার অব পেইনটিংস অ্যান্ড স্কাল্পচার’।

 

 

সাবর্ণ চৌধুরী পরিবারের বিদ্যাধর রায়চৌধুরীর কাছ থেকেই ১৬৯৮ সালে মাত্র তেরোশো টাকায় জোব চার্নকসুতানুটি, গোবিন্দপুর, কলিকাতা নামের তিনটি গ্রামের ইজারা নিয়ে কলকাতা নগরীর পত্তন করেন । নবাবের নির্দেশে তাঁরা ইজারা দিতে বাধ্য হয়েছিলেন ।ইস্ট ইনডিয়া কোম্পানির পরিবর্তে সিরাজ-উদ-দৌলার পক্ষ নেবার কারণে সাবর্ণ চৌধুরীরা অন্যান্য অভিজাত পরিবারের তুলনায় ব্রিটিশদের দাক্ষিণ্য থেকে বঞ্চিত হয়েছিলেন, এবং তাঁরা ক্রমশ ছত্রভঙ্গ হয়ে সারা ভারতে ছড়িয়ে পড়েন ।

 

 

বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়াশুনা করার সময় থেকেই মলয় মার্কসবাদ ও ইতিহাসের দর্শন নিয়ে পড়াশুনা ও লেখালিখি করছিলেন । ‘ইতিহাসের দর্শন’ শিরোনামে তিনি ‘বিংশ শতাব্দী’ পত্রিকায় একটি ধারাবাহিক রচনা লিখেছিলেন । দাদার বন্ধু কবি দীপক মজুমদারের পরামর্শেই তিনি ইতিহাসের পরিবর্তে ইতিহাসের দর্শনে আগ্রহী হন । ইতিহাসের দর্শন সম্পর্কিত বইগুলি পড়ার সময়ে মলয় ইতিহাসকার অসওয়াল্ড স্পেংলারের ‘দি ডিক্লাইন অব দি ওয়েস্ট’ বইটির সঙ্গে পরিচিত হন । ‘হাংরি’ শব্দটি মলয় পেয়েছিলেন ইংরেজ কবি জিওফ্রে চসারের ‘ইন দি সাওয়ার হাংরি টাইম’ বাক্যটি থেকে । অসওয়াল্ড স্পেংলারের বই এবং জিওফ্রে চসারের কবিতার লাইন মলয়কে হাংরি আন্দোলনের তাত্বিক ভিত গড়তে সাহায্য করেছিল ।

 

স্পেংলার বলেছিলেন, একটি সংস্কৃতি কেবল একটি সরলরেখা বরাবর যায় না, তা লিনিয়র নয়, তা একযোগে বিভিন্ন দিকে প্রসারিত হয় । তা হল জৈবিক প্রক্রিয়া, এবং সেকারণে সমাজটির নানা অংশ কোন দিকে কার বাঁকবদল ঘটবে, তা আগাম বলা যায় না । যখন কেবল নিজের সৃজনক্ষমতার ওপর নির্ভর করে, তখন সংস্কৃতিটি নিজেকে সমৃদ্ধ ও বিকশিত করতে থাকে ; তার নিত্য নতুন স্ফূরণ ঘটতে থাকে। কিন্তু একটি সংস্কৃতির অবসান সেই সময় থেকে আরম্ভ হয়, যখন তার নিজের সৃজনক্ষমতা ফুরিয়ে গিয়ে তা বাইরে থেকে যা পায় তা-ই ‘আত্মসাৎ’ করতে থাকে, খেতে থাকে, তার ক্ষুধা তখন তৃপ্তিহীন।

 

মলয় রায়চৌধুরীর মনে হয়েছিল, দেশভাগের ফলে পশ্চিমবঙ্গ এই ভয়ঙ্কর অবসাদের মুখে পড়েছে । কলকাতা থেকে পাণিহাটি যাবার সময়ে ( তাঁর দাদা সমীর পাণিহাটিতে মামার বাড়িতে থেকে কলকাতার সিটি কলেজে যাতায়াত করতেন ) মলয় ও সমীর উদ্বাস্তুদের অসহায় জীবন প্রত্যক্ষ করতেন প্রতিদিন, কলকাতার পথে দেখতেন বুভুক্ষুদের প্রতিবাদ মিছিল । ক্ষোভ, ক্রোধ, প্রতিবাদ প্রকাশ করার জন্য তাঁদের দুজনের মনে হয়েছিল হাংরি আন্দোলন জরুরি । মলয় মনে করতেন, তাঁরা না করলেও অন্যেরা এই ধরণের আন্দোলন করত, প্রতিষ্ঠানকে নাস্তানাবুদ করত ।

মলয়ের প্রথম বই প্রবন্ধের, ‘মার্কসবাদের উত্তরাধিকার’, ১৯৬২ সালে প্রকাশিত হয়েছিল, যার প্রকাশক ছিলেন শক্তি চট্টোপাধ্যায় । হাংরি আন্দোলনের সময়ে একটি কপি দেবী রায়ের কাছে রেখে বাকি কপি পেটরল ঢেলে পুড়িয়ে ফেলা হয়েছিল । মলয় পরে বলেছিলেন, ওই পুড়িয়ে দেয়াটা ছিল একটা পলিটিকাল ব্লাণ্ডার । শোনা যায়, শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের ওপর ক্ষেপে গিয়ে শক্তির উল্টোডাঙা বস্তিবাড়ির সামনে বইগুলো জড়ো করে জ্বালিয়েছিলেন মলয় । তাঁর দ্বিতীয় বইটি ছিল কবিতার ; বইয়ের নাম শয়তানের মুখ, ১৯৬৩ সালে কৃত্তিবাস প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত, প্রকাশক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় । বাংলা ভাষায় আর দ্বিতীয় কবি অথবা লেখক নেই যাঁর গ্রন্হ শক্তি এবং সুনীল দুজনেই প্রকাশ করেছিলেন ।

 

মলয়ের গ্রন্হাবলী ও সাহিত্যচর্চাকে দুটি পর্বে ভাগ করা যায় । যার প্রথম পর্ব ছিল হাংরি আন্দোলন থেকে আরম্ভ করে জেল থেকে ছাড়া পাওয়া পর্যন্ত । অর্থাৎ ১৯৬১ থেকে ১৯৬৭ সাল । এই সময়পর্বে তিনি ‘জেব্রা’ নামের একটি পত্রিকার দুটি সংখ্যা প্রকাশ করেন এবং শতাধিক হাংরি বুলেটিন প্রকাশের জন্য আর্থিক সাহায্য করেন । হাংরিদের পত্রিকার কভারের ব্লকও তিনি পাটনা থেকে করিয়ে এনে দিতেন । মলয়ের বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে প্রতিষ্ঠানের বুদ্ধিজীবীরা পেরে উঠতেন না তার কারন মলয়ের গভীর পড়াশুনা ।

 

‘হাওয়া-৪৯’ পত্রিকায় মলয় সম্পর্কে উৎপলকুমার বসু লিখেছিলেন :-

“মলয় রায়চৌধুরী এখনকার বাংলা সাহিত্যে একটি বিশিষ্ট নাম । তিনি ছয়ের দশকে লিখতে শুরু করেন এবং এখনও লিখছেন । তাঁর কবিতা, গদ্য, প্রবন্ধ, সাক্ষাৎকার, ইস্তাহার ও পোলেমিক্সের   সমগ্র সংগ্রহ প্রকাশিত হলে একটি প্রয়োজনীয় কাজ হবে বলে আমার ধারণা। তিনি সাহিত্যিক নন । অর্থাৎ ‘সাহিত্যের সেবক’ বললে আমাদের স্মরণে যে ছবিটি ভেসে ওঠে, তাঁকে সেই শ্রেনিতে ফেলা যাবে না । বাংলা সাহিত্য তাঁর হাতে যতটা না পূজিত হয়েছে — আক্রান্ত হয়েছে তার চেয়ে অনেক বেশি । গত চল্লিশ বছরে, বাংলা সাহিত্যের রণক্ষেত্রে যা-যা ঘটেছে, তা লিপিবদ্ধ করার যোগ্যতা বা ধৈর্য আমার নেই । তবে সংক্ষেপে এটুকু বলা যায় যে মলয় রায়চৌধুরী অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত হয়েই যুদ্ধে নেমেছিলেন । তাঁর তাত্বিক প্রস্তুতি ছিল । এবং তথাকথিত বাংলা ‘সংস্কৃতির’ ঘরে তাঁর লালন-পালন নয় বলে ওই কালচারের পীঠভূমিগুলিকে অবজ্ঞা করার মতো দুঃসাহস তিনি দেখিয়েছেন । বাংলা আধুনিক কবিতার প্রসঙ্গটি নিয়ে যদি ভাবা যায়, তবে দেখব, জীবনানন্দই সেই অঞ্চলের প্রধান পুরুষ । তাঁকে পিছনে ফেলে এগিয়ে না গেলে পরবর্তী একটা নতুন যুগের পত্তন হওয়া সম্ভব ছিল না । জীবনানন্দ কয়েকটি উপাদানকে অবলম্বন করেছিলেন । যেমন অভিনব ইমেজ, বা চিত্রকল্পের ব্যবহার, মআজাগতিক সচেতনতা,মানুষের উদ্যম ও প্রচেষ্টার প্রতি তীব্র অবজ্ঞা এবং সংশ্লিষ্ট আরও কয়েকটি গৌণ বিষয় । মলয় রায়চৌধুরী ও তাঁর প্রজন্মের লেখকদের ওই পাঠশালাতেই হাতে খড়ি হয়েছিল। কিন্তু অল্প কিছুদিনের মধ্যেই তাঁদের অন্য ধরণের পথসন্ধান শুরু হয় । বাংলা সাহিত্যের প্রধান ধারাটি একপ্রকার স্হিতাবস্হায় পৌঁছে গিয়েছিল । তার বাঁধ ভেঙে দেওয়া ছাড়া অন্য উপায় ছিল না । তিনটি উপন্যাস ও স্মৃতিচারণেও মলয় রায়চৌধুরীর ওই আক্রমণকারী প্রবণতা লক্ষ করি । কথা প্রসঙ্গে তিনি একবার বলেছিলেন, ‘লেখা রাজনীতি ছাড়া আর কী হতে পারে?’ বলা বাহুল্য তিনি দলীয় বা সংসদীয় রাজনীতির কথা বলেননি । তিনি বলেছিলেন ‘পলিটির’ কথা । আমরা সবাই মিলে কীভাবে থাকব — মলয় রায়চৌধুরী তারই একটা বোঝাপড়ার দলিল তৈরি করেছেন।”

প্রথম পর্বের পর প্রচণ্ড অভিমান, ঘৃণা ও বিরক্তিতে মলয় তাঁর সমস্ত বইপত্র বিলিয়ে দিয়ে প্রথমে লখনউ ও পরে মুম্বাই চলে যান । রিজার্ভ ব্যাঙ্কে নোট পোড়াবার চাকরি ছেড়ে তিনি অ্যাগরিকালচারাল রিফাইনান্স ও ডেভেলপমেন্ট কর্পোরেশনে যোগ দেন, এবং তখন থেকেই তিনি চাকুরিসূত্রে  ভারতের গ্রামেগঞ্জে চাষি, তাঁতি, জেলে, কুমোর, চামার, ঝুড়ি প্রস্তুতকারী, খেতমজুর, ছুতোর প্রমুখ সমাজের তলার দিকের মানুষের জীবনযাত্রার সঙ্গে পরিচিত হন যা প্রতিফলিত হয়েছে তাঁর উপন্যাস, গল্প ও প্রবন্ধে । এআরডিসি থেকে তিনি চলে যান নাবার্ডের মুম্বাই হেড অফিসে এবং ১৯৯৭ সালে অবসর নেন কলকাতা দপতরের ডেপুটি জেনারাল ম্যানেজার হিসাবে, পশ্চিমবঙ্গে সম্পর্কে প্রভূত অভিজ্ঞতা সঞ্চয়ের পর ।

 

দ্বিতীয় পর্বের আত্মপ্রকাশ আটের দশকের মাঝামাঝি থেকে । মহদিগন্ত পত্রিকার সম্পাদক উত্তম দাশ তাঁর লখনউয়ের বাড়ি গিয়ে তাঁকে কবিতা সংকলন ও ইস্তাহারগুলির সংকলন প্রকাশে উৎসাহিত করেন । দুই পর্ব মিলিয়ে, এই রচনা লেখার সময় পর্যন্ত মলয়ের কাব্যগ্রন্হ চৌদ্দটি, উপন্যাস চৌদ্দটি, ছোটোগল্প সংকলন দুটি, নাটকের বই একটি, অগ্রন্হিত কাব্যনাটক তিনটি, প্রবন্ধ সংকলন সতেরোটি, স্মৃতিকথা দুটি, অনুবাদগ্রন্হ সাতটি, সাক্ষাৎকারগ্রন্হ চারটি — সব মিলিয়ে সত্তরটির মতো ।

 

সাতাত্তর বছর বয়সে এসে কমপিউটারে এক আঙুলে টাইপ করে লেখেন । এখনও সচল মস্তিষ্ক । চিকিৎসা বিভ্রাটে আর্থ্রাইটিসে সারা শরীরে ব্যথা নিয়ে কাজ করে চলেছেন । তরুন কবি ও লেখকদের বইয়ের ভূমিকা লিখে দিচ্ছেন । যৌবনের শুকনো নেশা, ক্যানাবিস, হ্যাশিস, মেস্কালিন, এলএসডি, আফিম, খালাসিটোলার বাংলা, পাটনার ঠররা, নেপালের ঠমেলে মোষের কাঁচা মাংস হরিণের মাংসের আচার আর গমের মদ ইত্যাদি থাবা বসিয়েছে স্বাস্হ্যের ওপর ।

 

মলয়ের যাবতীয় লেখালিখি সবই লিটল ম্যাগাজিনে । এপার বাংলা, বাংলাদেশে এবং যেখানে বাংলা ভাষার কাগজ প্রকাশিত হয় তার প্রায় সব কাগজেই মলয় কোনো না কোনো সময় লিখেছেন । প্রাতিষ্ঠানিক কোনো কাগজে মলয় কখনও একলাইনও লেখেননি । মলয় সম্ভবত একমাত্র লেখক যিনি তাঁর বইতে ঘোষণা করতেন যে তাঁর বইয়ের কারোর কোনো কপিরাইট নেই । প্রতিষ্ঠানবিরোধিতায় স্হির অবিচল মলয় ২০০৩ সালে ফিরিয়ে দিয়েছেন অকাদেমি সাহিত্য সন্মান । যদিও তাঁর এক সময়ের হাংরি বন্ধ শক্তি, সন্দীপন, উৎপল, সুবিমল মাথা পেতে সরকারিপুরস্কার নিয়েছেন । মলয়ের লেখালিখির ওপর পিএইচডি করেছেন আসাম বিশ্ববিদ্যলয়ের কুমার বিষ্ণু দে এবং রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের উদয়শঙ্কর বর্মা । এম ফিল করেছেন অনেকে, এখনও কয়েকজন করছেন । তাঁর উপন্যাসে জাদুবাস্তবতা নিয়ে গবেষণা করছেন অধ্যাপক শুভশ্রী দাশ ।গবেষণা করেছেন মার্কিন ছাত্রী মারিনা রেজা ।

 

 

‘মধ্যরাত্রি’ পত্রিকার সম্পাদক সৈয়দ সমিদুল ইসলাম একটি সাক্ষাৎকার মলয় রায়চৌধুরীকে প্রশ্ন করেছিলেন, “মলয়বাবু, আপনি কখনও নিশ্চয়ই ভেবে দেখেছেন, আপনি কী ? আপনি কে?”

জবাবে মলয় জানিয়েছিলেন, “আজিজুল হক তাঁর এক সাক্ষাৎকারে জানিয়েছিলেন, মলয় রায়চৌধুরী মানব সমাজের পেরিফেরির জীব, সোজা বাংলায় আমি একজন কালচারাল বা্টার্ড।”

( ‘নতুনপথ এই সময়’ পত্রিকার  ১৪২৪ শরৎ সংখ্যায় প্রকাশিত )

 

 

 

 

 

 

 

বিশ্বজিত সেন : মলয় রায়চৌধুরীর কবিতা

Malay Final

 

বাংলা সাহিত্য নিয়ে যাঁরা ভাবাভাবি করেন, তাঁদের কিছু মজার প্রবণতা আছে। তাঁরা কবিতাকে গদ্য থেকে একেবারে আলাদা করে দেখেন, ও সেই দেখা চিরস্হায়ি করতে নানাবিধ সাংস্কৃতিক প্রপেরও আয়োজন রয়েছে। যেমন রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে বেশিরভাগ অনুষ্ঠানেরই নাম— কবিপ্রণাম । রবীন্দ্রনাথকে মূলত দেখা হয় কবি হিসাবে। গল্পকার, প্রাবন্ধিক, ঔপন্যাসিক, নাট্যকার, সঙ্গীতজ্ঞ রবীন্দ্রনাথ তেমন গুরুত্বপূর্ণ লোক নন। আমাকে প্রশ্ন করলে আমি বলব, গল্পলেখক রবীন্দ্রনাথই আমার কাছে সর্বাধিক গ্রাহ্য । যদিও রবীন্দ্রনাথের গল্প লেখার দর্শন আমার কাছে একেবারেই গ্রহণীয় নয়, তবু ‘কবি’ রবীন্দ্রনাথের চেয়ে, এই লোকটি আমার চোখে ঢের বাস্তব।

 

কবিতাকে আলাদা করে দেখা, তাকে সুউচ্চ বেদিতে বসিয়ে রাখা, অহরহ গুজগুজ-ফিসফিস, আরে আজও যাচ্ছেতাই কাণ্ড ঘটিয়ে চলেছে বাংলা সাহিত্যে ও মধ্যবিত্ত জনজীবনে । এ নিয়ে চিন্তা করেছি, আজও মাঝে-মাঝে করি। এ ভাবনার উৎস কোথায়?কিছুটা কি “ভারতীয় অতীত”- এর ব্যাপার রয়েছে এর মধ্যে। বেদ, উপনিষদ, পুরাণ, রামায়ণ, মহাভারত— সবই কবিতায় । কবিকে রহস্যময় মানুষ মনে করা হত, যিনি নিজের চিন্তা-ভাবনাকে ছন্দবদ্ধ করতে সক্ষম। মনে করা হত স্বয়ং ঈশ্বর তাঁর কাছে বার্তা পাঠিয়ে থাকেন। ভগবানের স্পেশাল মেসেঞ্জার তিনি, ‘নট টু বি টেকন লাইটলি’। তার বহু পরে, ‘ভক্তি’ যুগে ভারতীয় সাহিত্যের উল্লেখযোগ্য কয়েকজন কবিকে সাধক বানিয়ে কুলুঙ্গিতে লাল শালু মুড়ে রেখে দেওয়া হল।কবীর, দাদু, নানক, সুরদাস, রহিম, জয়দেব, চণ্ডীদাস । তুলসীদাসকে ‘গোঁসাই’ বানিয়ে তাঁরও একই হাল করা হল।‘রামচরিতমানস‘কে ধর্মগ্রন্হ মনে করে গদগদ আপামর হিন্দিভাষী জনসাধারণ। তার দোহায় দোহায় শব্দের যে অদ্ভুত খেলা, ভাষাকে কাদার মতো ব্যবহার করে তা থেকে বিচিত্র নানা মূর্তি গড়ে তোলা, সেদিকে দুচারজন ক্রিটিক ছাড়া কারো নজরই যায়নি প্রায়। হিন্দি সাহিত্য ঐশ্বরিক বিশ্বাস থেকে মুক্ত হয়ে কবে একাজে হাত দেবে জানি না । আজকে ভারতের পরিপ্রেক্ষিতে মনে হয়, এ-কাজ করার সময় এসে গেছে ।

 

ইংরাজপূর্ব বাংলার গ্রামাঞ্চল কিন্তু কবিকে অনেক সহজভাবে নিয়েছিল। কথক ও কবিয়াল ছিলেন, কবিগান ছিল। যাত্রার, পালার আসর ছিল, চণ্ডীতলা ছিল। অবশ্যই কবিকে স্পেশাল টেকনিকে দক্ষ লোক মনে করা হত; তবে সাউক বা অবতার, বা ভগবান নয় । কবির লড়াইতে তো কবিতা তৈরি হত সর্বসমক্ষে, মুখে-মুখে। আর হারজিতও ছিল। কাজেই রহস্যের সেখানে কোনো ভূমিকাই ছিল না । কবি স্পেশাল টেকনিকে দক্ষ বলে তাঁদের আদর-আপ্যায়নও হত, তবে তাঁকে একটি বেদিতে বসিয়ে তাঁর মুখের ওপর স্পটলাইট জ্বেলে রাখা ? নাঃ ! ইংরাজপূর্ব বাংলার গ্রামাঞ্চলে তা করা হত না।

 

ইংরাজরা আসার পর বাংলা সাহিত্যে কবিতার রহস্যের আমদানি হয় । নিজস্ব সংস্কৃতি বলতে ইংরাজদের কিছু ছিল না। যাকে তারা নিজের সংস্কৃতি বলত, তার খুঁটিগুলো সবই ছিল গ্রিস, রোম থেকে ধার করা। গ্রিসে ‘বার্ড’ বা ভ্রাম্যমান কবিদের নিয়ে রহস্য গড়ার অভ্যাস প্রচলিত ছিল। ভক্তি যুগের আদলেই প্রায় বলা যায়, তাঁদের ‘ভবিষ্যৎ দ্রষ্টা’, ঐশ্বরিক ক্ষমতার অধিকারী, ইত্যাদি মনে করা হত। হোমারের স্হান গ্রিক মানসে প্রায় ঋষির জায়গাতেই ছিল, দাড়ি-টাড়ি সমেত। শেকসপিয়রও আরও কয়েকশো বছর আগে জন্মালে ঐ জায়গাতেই পৌঁছে যেতেন। আমাদের সৌভাগ্য, তিনি পরে জন্মানোর দরুন বিশ্বসাহিত্য একটি নিদারুণ দুর্ঘটনা থেকে বেঁচে গিয়েছিল।

 

রবীন্দ্রনাথ স্বয়ং, সাহিত্যিক জীবনের পরবর্তীপর্বে, কবিতার বিশেষত্বের জায়গা থেকে অনেকটা সরে এসেছিলেন। যাকে সাহিত্যের বিশেষজ্ঞরা ‘গদ্য কবিতা’ বলেন, তা তাঁর এই বোধের সাক্ষ্য দেয়। তাঁর কিছু গদ্য কবিতা গল্পকেন্দ্রিক। সাহিত্যকর্ম ইশাবে অনেক উঁচু দরের কাজ সেগুলো। মোদ্দা ব্যাপার হল, আজ পাড়াব-পাড়ায় ‘কবি প্রণাম’ সত্ত্বেও সাহিত্যের বিভিন্ন ফ্যাকাল্টির মাঝখানের দেওয়াল ধ্বসিয়ে দেবার পক্ষপাতী ছিলেন রবীন্দ্রনাথ স্বয়ং। তাঁকে বাঙালি এত বেশি ‘কবি’ বানিয়ে ফেলেছিল যে হাত খুলে এই কাজটি করা সম্ভব ছিল না তাঁর পক্ষে। তবে কাজের মধ্য দিয়ে ঠারে-ঠারে যতটা পেরেছেন, করেছেন। বিশেষ করে ছবি আঁকার মাধ্যমে।

 

কবিতাকে বা কবিকর্মকে ঘিরে একটা রহস্য সৃষ্টি করে রাখলে কবিতা কখনই সামাজিক পরিস্হিতির দলিল হয়ে উঠতে পারে না। কবিতার মিস্টিসিজমের প্রথম অসুবিধে এটা। কবিতা যদি সামাজিক পরিস্হিতির দলিল না হয়, তবে তাকে ড্রইংরুম সাজানোর ডলপুতুল বা অশ্রুমোছার রুমাল হয়ে থাকতে হয় কেবল।সেটা অবশ্য অনেকেরই মনঃপূত, বিশেষ করে যাঁরা ‘সমাজ-টমাজ’কে দশ হাত দূরে রাখতে চান। সমাজের অন্যান্য ক্ষেত্রের মতো সাহিত্যেও লড়াই আছে, পক্ষ-প্রতিপক্ষ আছে। একটি পক্ষের বিশেষ দর্শন এটাই। কবিতার গায়ে গরম হাওয়ার ঝাপটা যেন না লাগে।

 

কবিতার মিস্টিসিজমের দ্বিতীয় অসুবিধে ভাষার স্তরে। ভাষা তো একটি নদী বিশেষ। একূল-ওকূল দুকূলই সে ভাসায়। তাকে সিমিলি, মেটাফর, ছন্দবৃত্ত, মাত্রা, পয়ার ইত্যাদির গণ্ডীর মধ্যে সর্বদা বেঁধে রাখা যায় না। কবিতার নিয়মানুবর্তিতা থেকেই কবিতার মিস্টিসিজমের জন্ম। এই নিয়মানুবর্তিতার দরুনই, একটি বিশেষ শ্রেণীর প্রয়োজন অনুভূত হয়, যে কবিতা ‘লিখতে পারে’। যে ‘পারে না’, তাকে দূর করো, দাঁড় করিয়ে রাখো দরজার বাইরে। তার ভাষাটিও ব্রাত্য।

 

তাই, কবিতার স্বার্থেই, কবিতার রহস্যময়তাকে ভাঙা অত্যন্ত প্রয়োজন।

 

বাংলা সাহিত্যের সিরিয়াস পাঠক সম্প্রতি নড়ে-চড়ে বসেছেন। ষাটের দশকে, যে একটি তুমুল ওলোট-পালোট ঘটে গিয়েছিল বাংলা সাহিত্যে, বিশেষ করে বাংলা কবিতার ক্ষেত্রে— সেদিকে নজর গেছে তাঁদের। দেরিতে হলেও, এটাই কাম্য ছিল।’হাংরি আন্দোলন’ নিয়ে ইতিপূর্বে ‘ধরি মাছ না ছুঁই পানি’ গোছের কথাবার্তা হয়েছে। ‘হাংরি আন্দোলনকারীদের’ গভীর মননশীল পঠন-পাঠন ছিল, যাকে বলা যায় ওভারভিউ। হাংরির পরেও আরও কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ আন্দোলন এসেছে, তবে সামাজিক-সাংস্কৃতিক ঝাঁকুনি হিসাবে হাংরিই ছিল “প্রথম”। বাংলা সাহিত্যের অবস্হা, হাংরি আন্দোলনের আগে ছিল অকালবৃদ্ধ আফিংখোরের মতো। রবীন্দ্র ঐতিহ্য পুঁটুলি বেঁধে কোলে নিয়ে বসে ঝিমোনো আর মাঝে-মাঝে চটকা ভেঙে, “অ্যাই, গোল কোরো না বলচি, পড়াশুনো করো, পড়াশুনো…”। অথচ দেশে-বিদেশে তখন ঘটছে যুগান্তকারী ঘটনা । ‘গ্রানমা’ জাহাজে চড়ে বিপ্লব করতে আসা কয়েকজন যুবক হঠাৎ জয়ী হয়েছেন। ওয়াশিংটন থেকে মাত্র নব্বই মাইল দূরে দেখা দিয়েছে বিদ্রোহের পতাকা। ওদিকে ঠাসবুনোট সমাজতান্ত্রিক মূল্যবোধ ক্রমে ঠোঙা বানাবার কাগজ বই আর কিছু নয়। স্হিতাবস্হাকামী বাণিজ্যিক সংবাদপত্র গোষ্ঠীর প্রচণ্ড একমাত্রিক দাপট বাংলা সাহিত্যে। তার দোরগোড়ায় মাথা না ঠুকলে কেউ মানুষই হবে না, সাহিত্যিক হওয়া তো দূরে রইল।

 

এইরকম সময়ে বাংলা সাহিত্যের ‘পীঠস্হান’ কলকাতা থেকে দূরে, পাটনা শহরে, যেখানে ঐশ্লামিক ধর্মশাস্ত্র পড়তে গিয়েছিলেন রামমোহন রায়, আর বেশ কয়েক বছর চাকরি করে গেছেন দীনবন্ধু মিত্র, সাংস্কৃতিক দিক দিয়ে একটি অপরিচিত গরিব পরিবারের যুবক মলয় রায়চৌধুরী আই আন্দোলনটির ছক কষেন। দাদা সমীর রায়চৌধুরী কলকাতায় সিটি কলেজে পড়েন, সেই সুবাদে যুবা বাঙালি লেখক-কবিদের সাথে আলাপ-পরিচয় । দেশ-দুনিয়ে জুড়ে উথালপাথাল সত্ত্বেও কলকাতা, ব্রিটিশের প্রিয় ‘কালকুত্তা’ তখনও শীতল। বামপন্হী দলগুলোর বিরুদ্ধে গান্ধীবাবার কংগ্রেস প্রতিপালিত গোপাল পাঁঠা, ইনু মিত্তিরদের দাপাদাপি; কলকাতা শীতল। কবিতা ভবন (!) থেকে ‘কবিতা’ বেরোয় । বুদ্ধদেব বসুর পরিশীলিত আঙুল কবি বাছাই করে, ফতোয়া দেয়। দোর্দণ্ডপ্রতাপ সেই উপস্হিতি। এককালে…’না না অমন বলবেন না । সুকান্তও কবি। ছন্দ বোঝে। এই দেখুন আমি দেখাচ্ছি — পতা/কায় পতা/কায় ফেরমিল/আনবে ফেব্রু/য়ারি। দেখলেন ?

 

অট্টহাসি উদ্রেক করা সেই সময়। সমীর রায়চৌধুরীর ‘পাটনাই’ হওয়ার দরুন কলকাতার যুবক কবিদের পাটনায় আনাগোনা। এঁদের মধ্যে অন্যতম শক্তি চট্টোপাধ্যায়। যাঁর বিষয়ে বাসব দাশগুপ্তকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে মলয় বলেছেন, “শক্তির কবিতা সম্পূর্ণ নিজস্ব ও অসাধারণ। কেননা তিনি পাঁড় অশিক্ষিত, কোনো লেখাপড়া করেন না, এবং দর্শন, ইতিহাস, সমাজবোধ এসব ছিটেফোঁটা তাঁর মধ্যে নেই। নিজের খাঁটি বোধ থেকে তিনি লেখেন, তখন তাঁকে জীবনানন্দের পরের প্রভূত ক্ষমতাসম্পন্ন মনে হয়।”  মনে রাখা প্রয়োজন, এই সাক্ষাৎকারটি যখন দিচ্ছেন মলয়, তখনও হাংরি আন্দোলনের স্মৃতি, তজ্জনিত তিক্ততা, সব কিছু মলয়ের মস্তিষ্ককোষে উপস্হিত। কিছুই ক্ষমা করেননি। অথচ কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায় সম্পর্কে মলয়ের চোখা, টান-টান মূল্যায়ন। ব্যক্তিগত তিক্ততা সেখানে ছায়া ফেলেনি।

 

হাংরি আন্দোলনের পরিকল্পনাপর্বে এই শক্তি চট্টোপাধ্যায়কে মলয় সঙ্গে পেয়েছিলেন, আর পেয়েছিলেন দেবী রায়          ( হারাধন ধাড়া) কে। পাটনার সুবিমল বসাক এসে যোগ দেন কিছুকাল পরে।একটি সাহিত্য আন্দোলন, যা বাংলা সাহিত্যের হাল-হকিকত পালটে দিয়েছিল, কত সামান্যভাবে শুরু হয়েছিল, ভাবলে অবাক লাগে। প্রেস পাওয়া যাচ্ছিল না, তাই মিষ্টির দোকানের বাকসো যে জব প্রেস ছাপতো, সেখানেই ছাপতে হয় হাংরি বুলেটিন। রিজার্ভ ব্যাঙ্কে মলয় তখন লোয়ার গ্রেড কেরানির চাকরিতে, কত মাইনে পেতেন জানা নেই, তবে প্রায় সম্পূণফ মাইনেটাই মনে হয় হাংরি বুলেটিনের পেছনে ঢালতে হত। বাংলা সাহিত্যে, বিশেষ করে বাংলা কবিতায়, পরীক্ষা-নিরীক্ষার প্রথম কাগজ বেরোনোর আরম্ভটা এইরকম। ‘শতভিষা‘ পত্রিকার তুলনায় ‘কৃত্তিবাস‘ ও নিজেকে পরীক্ষা-নিরীক্ষার কাগজই বলত, তবে হাংরি বুলেটিনের সাথে তার ছিল মৌলিক প্রভেদ। ‘কৃত্তিবাস’ ছিল সাহিত্যিক উচ্চাকাঙ্খীদের কাগজ। তাঁদের পরীক্ষা-নিরীক্ষা ছিল প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সংঘর্ষ এড়িয়ে সুরে সুর মিলিয়ে। প্রতিষ্ঠান কখন যশ, প্রতিপত্তি, বৈভব, টাকাকড়ি, সামাজিক সুবিধার কাজে লেগে যায়, বলা তো যায় না। হাংরি বুলেটিনের উদ্দেশ্যই ছিল যুদ্ধ। আপসের জন্যে সেখানে কোনও জায়গাজমি রাখা হয়নি।

 

অনেকের মতে হাংরি আন্দোলনকারীরা কয়েকটি গিমিকের আশ্রয় নিয়েছিলেন রাতারাতি খ্যাত হবার জন্য, যেমন শাদা দিস্তা কাকজ, জুতোর বাকসো ইত্যাদি রিভিউএর জন্য পাঠানো, টপলেস প্রদর্শনীর আয়োজন ( টপলেসের অর্থ যে মুন্ড বা মস্তিষ্কবিহীনও হয়, এই বোধটুকু কলকাতার বুদ্ধিজীবীদের হয়নি), জীবজন্তু-জোকারের মুখোশ বিলি ইত্যাদি। ‘হাংরি কিংবদন্তি’তে মলয় উদ্ধৃত করেছেন আবু সয়ীদ আইয়ুবের যে মন্তব্য, তা এ-প্রসঙ্গে দেখা যেতে পারে।কিন্তু মলয় বা তাঁর সঙ্গীরা কি জানতেন না যে প্রতিষ্ঠান ও প্রসাশন কতদূর হিংস্র হতে পারে? এ জানা সত্ত্বেও একজন চাকুরিজীবী ( মলয় ) নিজেকে এই ঝুঁকির সামনে এগিয়ে দিয়েছিলেন কেন ? শুধুই প্রচারের জন্য? না কি কিছু মূল্যবোধের ব্যাপারও ছিল ? মলয় তাঁর ‘সাক্ষাৎকারমালা’র এক জায়গায় বলেছেন, ‘ষাট দশকের সুস্হতা স্বাভাবিক ছিল না।’ এই অস্বাভাবিক সুস্হতাকে ভালোমতো একটা ঝাঁকুনি দেওয়াই উদ্দেশ্য ছিল তাঁর। তার জন্য দুহাতে হাতকড়া, কোমরে দড়ি পরে চোর-ডাকাতের সঙ্গে সার বেঁধে পাটনা শহরের রাস্তায় অতিপরিচিতজনের মাঝে হাঁটা, চাকুরি থেকে সাসপেন্ড হওয়া, পঁয়ত্রিশ মাস প্রতি সপ্তাহে কাঠগড়ায় দাঁড়ানো— সবই। প্রচার পাওয়ার জন্য যদি এত করতে হয়, তাহলে তো মুশকিল। এর চেয়ে সহজ রাস্তা তো কতই ছিল। বিশেষত, ‘কৃত্তিবাস’ গোষ্ঠীতে তাঁর দাদার বন্ধুরাই যখন সর্বেসর্বা। সমসাময়িক অন্যান্যদের মতন একটু মিঠে ব্যবহার রাখলেই আর দেখতে হচ্ছিল না। আর, ‘কৃত্তিবাস’ও তেমন-তেন বৈশিষ্টহীন ও লুপ্ত হবার পথে এগিয়েছে। সাহিত্য আন্দোলন সম্পর্কে ‘কৃত্তিবাসীয়’দের সততার এর চেয়ে ভালো উদাহরণ আর কী হতে পারে ?

বলা যেতে পারে যে ‘কৃত্তিবাস’ যদি সাহিত্য পত্রিকা হিসেবে না টিকে থাকে তবে ‘হাংরি বুলেটিন’ও তো টেকেনি। হ্যাঁ, হাংরি বুলেটিন উঠে গিয়েছিল মামলা-মকদ্দমার দরুন, অন্তর্কলহের দরুন। কিন্তু হাংরিদের ঝগড়াঝাঁটি ছিল খোলাখুলি, তাতে মধ্যবিত্তের চাপ-চাপ ঢাক-ঢাক ছিল না। মামলা-মকদ্দমার ভয়ে কেউ রাজসাক্ষী হয়েছিলেন ( সুভাষ ঘোষ,শৈলেশ্বর ঘোষ, শক্তি চট্টোপাধ্যায়, সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়, উৎপলকুমার বসু  প্রমুখ ), কেউ ভেবড়ে গিয়ে কলকাতার বাইরে কেটে পড়েছিলেন ( প্রদীপ চৌধুরী, সুবো আচার্য প্রমুখ )। সেগুলোকে দেখার কোনও অর্থ হয় না।’হাংরি বুলেটিন’ বন্ধ হবার পর অগনণ পেশিবহুল বাহু এগিয়ে এসেছে আন্দোলনের পতাকা তুলে নিতে।জেব্রা, উন্মার্গ, ফুঃ, স্বকাল, ক্ষুধার্ত খবর, জিরাফ, কনসেনট্রেশান ক্যাম্প, ওয়েস্ট পেপার, চিহ্ণ, প্রতিদ্বন্দী ইত্যাদি পত্রিকাও হাংরি বুলেটিনই। মলয় কোনোদিন বলেননি যে হাংরি আন্দোলনের কপিরাইট একমাত্র তাঁর। হ্যাঁ, আন্দোলনের প্রতিষ্ঠাতা ও দার্শনিক প্রতিনিধি হিসাবে তাঁর কিছু বক্তব্য থাকতেই পারে, যা তিনি বিভিন্ন সাক্ষাৎকারে পাঠকদের সামনে রেখেছেন।এই অধিকার থেকে তো আর তাঁকে বঞ্চিত করা যায় না। মলয়ের পরবর্তীকালীনরা হাংরি মতাদর্শকে নিজেদের মতো করে ব্যাখ্যা করেছেন।এটিও একটি আন্দোলনের প্রাণশক্তির প্রমাণ। মলয়, হাংরি আন্দোলন ফুরিয়ে যাবার পর, পড়ালেখার নিজস্ব পৃথিবী গড়ে তুলেছেন, মন দিয়ে এবং চুটিয়ে বিভিন্ন শহরে চাকরি করেছেন, সংসার করেছেন, ভারতীয় জনজীবনকে দেখেছেন, জীবন থেকে শিখেছেন। আজ গল্প, উপন্যাস, কবিতা, নাটক, প্রবন্ধের যে হতচকিত-করা ফসল তিনি আমাদের হাতে তুলে দিচ্ছেন তা সম্ভব হতে পেরেছে এরই দরুন। বাণিজ্যিক সাহিত্য প্রতিষ্ঠানের গদি-আঁটা চেয়ারে বসে আঙুলে চাবির রিং ঘোরাননি মলয়। এর জন্য তাঁর কাছে আমরা কৃতজ্ঞ। অন্তত একটি আকাশ এমন রয়েছে, যাকে ঢেকে ফেলতে পারেনি কালো মেঘ।

 

মলয়কে ‘প্রচণ্ড বৈদ্যুতিক ছুতার‘ কবিতাটির দরুন মামলায় পড়তে হয়। কবিতাটি বর্তমানে বহুল প্রচারিত, তাই তাকে আর সম্পূর্ণ উদ্ধৃত করার প্রয়োজন নেই। তবে এই কবিতাটিকে কেন্দ্র করে অশ্লীলতা ও রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র মামলা, যদি ধরেও নেওয়া যায় যে এর পেছনে কোনো অসূয়া কাজ করছিল না, একটি কৌতুকপ্রদ মাইন্ডসেট-এর দিকে ইঙ্গিত করে। এই মাইন্ডসেটটি তদানীন্তন বুদ্ধিজীবী বাঙালির, যিনি পুজোর ছুটিতে সস্ত্রীক খাজোরাহো দেখতে যান। তাহলে মলয়ের কবিতা কেন গ্রহণীয় নয় ? মজা কেবল এই জায়গাটুকুতে নয়, অন্যত্রও আছে। “আমরা যখন অসভ্য ছিলুম তখন ওইগুলো বানিয়েছি। এখন আমরা সভ্য, এখন তো আর এসব চলতে দেওয়া যায় না ।” এও মানলাম, কিন্তু মাই ডিয়ার, ব্যাপারটা যে আদপে তা নয় একেবারেই। ব্যাপার আগাগোড়া অন্যরকম। যৌন রূপকল্প, দ্যোতক ও বিম্ব কেবল ব্যবহার করেছেন মলয়, সেগুলির মাধ্যমে নিজের কথা বলেছেন। এও চলবে না ? তাহলে শিবলিঙ্গ তুলে দিন, গৌরীপট্ট নাকচ করুন, অম্বুবাচী ব্যান করুন। কামাখ্যা মন্দিরে মা-কামাখ্যার মাসিক যেন আর না হয়। কি বলেন ? যাঁরা “অশ্লীল অশ্লীল” চিল্লিয়েছিলেন, তাঁরা সম্ভবত ‘প্রচণ্ড বৈদ্যুতিক ছুতার-এর এই লাইনগুলো নজর করে দেখেননি–

১.

জন্মমুহূর্তের তীব্রচ্ছটা সূর্যজখম মনে পড়ছে

আমি আমার নিজের মৃত্যু দেখে যেতে চাই

মলয় রায়চৌধুরীর প্রয়োজন পৃথিবীর ছিল না

তোমার তীব্র রূপালি য়ুটেরাসে কিছুকাল ঘুমোতে দাও শুভা

শান্তি দাও, শুভা শান্তি দাও

২.

হুঁশাহুঁশহীন গাফিলতির বর্ত্মে স্ফীত হয়ে উঠছে নির্বোধ আত্মীয়তা

আ আ আ আ আ আ আ আ আঃ

মরে যাব কিনা বুঝতে পার্ছি না

তুলকালাম হয়ে যাচ্ছে বুকের ভেতরকার সমগ্র অসহ্যতায়

সবকিছু ভেঙে তছনছ করে দিয়ে যাব

শিল্পর জন্যে সক্কোলকে ভেঙে খান-খান করে দোবো

কবিতার জন্যে আত্মহত্যা ছাড়া স্বাভাবিকতা নেই…

৩.

এরকম অসহায় চেহারা ফুটিয়েও নারী বিশ্বাসঘাতিনী হয়

আজ মনে হয় নারী ও শিল্পের মতো বিশ্বাসঘাতিনী কিছু নেই

এখন আমার হিংস্র হৃৎপিণ্ড অসম্ভব মৃত্যুর দিকে যাচ্ছে

মাটি ফুঁড়ে জলের ঘূর্ণি আমার গলা ওব্দি উঠে আসছে

আমি মরে যাব…

৪.

৩০০০০০ লক্ষ শিশি উড়ে যাচ্ছে শুভার স্তনমণ্ডলীর দিকে

ঝাঁকেঝাঁকে ছুঁচ ছুটে যাচ্ছে রক্ত থেকে কবিতায়

এখন আমার জেদি ঠ্যাঙের চোরাচালান সেঁদোতে চাইছে

হিপ্নটিক শব্দরাজ্য থেকে ফাঁসানো মৃত্যুভেদী যৌনপর্চুলায়

ঘরের প্রত্যেকটা দেয়ালে মার্মুখী আয়না লাগিয়ে আমি দেখছি

কয়েকটা ন্যাংটো মলয়কে ছেড়ে দিয়ে তার অপ্রতিষ্ঠিত খেয়োখেয়ি

 

এই পঙক্তিগুলো একটু মন দিয়ে পড়লে বাঙালি মধ্যবিত্ত বুদ্ধিজীবীর পক্ষে বোঝা দুষ্কর ছিল না যে নিছক যৌনতা নয়, আরো গূঢ় কোনো বোধের দ্যোতনা এই পঙক্তিগুলোয় রয়েছে।’সাত বছর আগের একদিন’ কবিতায় জীবনানন্দ লিখেছিলেন, “অর্থ নয় কীর্তি নয় স্বচ্ছলতা নয় আরও এক বিপন্ন বিস্ময় আমাদের অন্তর্গত রক্তের ভিতরে খেলা করে। আমাদের ক্লান্ত করে, ক্লান্ত ক্লান্ত করে। লাশকাটা ঘরে সেই ক্লান্তি নাই…”। এই পঙক্তিগুলোকে উদ্ধৃত করে জীবনানন্দকে শবসাধক সাব্যস্ত করা অবশ্যই উচিত হবে না, অথবা ঘোর অঘোরপন্হী। তেমনই হাস্যকর ‘প্রচণ্ড বৈদ্যুতিক ছুতার’-এ যৌনতার বহিঃপ্রকাশ খোঁজা। আসলে মলয়ের বিরুদ্ধে যখন ষাটের দশকে রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র ও অশ্লীলতার মকদ্দমা দায়ের করা হয়, তখন ষাটের দশকের ‘অস্বাভাবিক সুস্হতা’ রাজত্ব করছে পুরোদমে।‘দেশ’ পত্রিকায় ধারাবাহিক প্রকাশিত হচ্ছে প্রবোধকুমার সান্যালের ‘দেবতাত্মা হিমালয়’ আর মেট্রো সিনেমার ফুটে রিফিউজি যুবতীদের শরীর নিয়ে চলছে অবাধ বাণিজ্য! পায়ের চটি ঘষটাচ্ছে রিফিউজি যুবক, ‘মাই ওন সিসটার স্যার, ভেরি সুইট, ওনলি সিক্সটিন’। অথচ বাঙালি পাঠক ‘কত অজানারে‘র বারবেল সাহেব আর ‘সখী সংবাদ’ এর মিষ্টিদিদি, নতুন দিদি, এদের নিয়েই মুগ্ধ। সমাজ কোথাও নেই; সমাজের জ্ধবলাপোড়া, আর্তি, চিৎকার এগুলোও কোথাও নেই। বামপন্হীরা ‘পরিচয়’ পত্রিকা চালাচ্ছেন, তাতেও এন্ট্রি পারমিট নিয়ে ঢুকতে হয়। এইরকম এক সময়ে ‘হাংরি বুলেটিন’ এর দরকার ছিল, প্রয়োজন ছিল ‘প্রচণ্ড বৈদ্যুতিক ছুতার’-এর। মূল্যবোধ ভেঙে খানখান হওয়ার যে হরর, শিল্পপ্রতীক জোলো হয়ে যাওয়ার যে শক, তাকে যথার্থ ফুটিয়ে তুতে গেলে এই কবিতাই তো লিখতে হবে। মলয় তাই করেছিলেন।

 

অবশ্য বিপদ চেনার ব্যাপারে প্রশাসন ও প্রতিষ্ঠানের সূক্ষ্মদৃষ্টির প্রশংসা করতেই হয়। কেই বা পড়ে তখন ‘হাংরি বুলেটিন’, কটা লোক ? পাটনার দুই যুবক, একজন হাওড়ার, একজন বিষ্ণুপুরের, একজন শান্তিনিকেতনের, এদের বুলেটিন বেরোয়। তার জন্যও আবার এই প্রেস, ওই প্রেসের হাতে-পায়ে ধরাধরি। তাহলে? এমন কী ক্ষমতাসম্পন্ন এরা, যে ক্ষেপে উঠল গোটা কলকাতার বাণিজ্যিক সাহিত্য প্রতিষ্ঠান ও সরকারি প্রশাসন ? মলয়ের বিরুদ্ধে কেবল মামলাই নয়, তাঁকে ও অন্যান্য হাংরি আন্দোলনকারীদের গ্রেপ্তার করে অপমান করা হল চরম, যাতে ভবিষ্যতে আর কোনোদিন এই জাতীয় প্রবণতা মাথা তোলার হিম্মত না করে ।

 

বাণিজ্যিক সাহিত্য প্রতিষ্ঠান ও প্রশাসন যে সমাজকে বুঝতেন না তা নয়, ভালোমতোই বুঝতেন। তাঁরাও জানতেন যে, যে-বদমায়েশি তাঁরা শিল্প, সাহিত্য, সমাজ, সংস্কৃতির সর্বত্র বিছিয়ে রেখেছেন, তা মানুষের জন্য নয় । তবে শ্রেণী স্বার্থে এর প্রয়োজন তাঁদের ছিল। যেমন ইংরেজরা, আই.সি.এস.কে লৌহ কাঠামো হিসাবে গড়ে তুলতে ছেয়েছিল, তেমনই উত্তর-স্বাধীনতা যুগের ভারতীয় পুঁজিবাদ, আমলাতন্ত্র ও তার মিডিয়া-খানসামাদের লক্ষ ছিল একটি জড়, নির্বোধ, সংবেদনহীন মধ্যবিত্ত শ্রেণী গড়ে তোলা। তাদের রুচি, জীবনযাপন, মূল্যবোধ, সব কিছু হবে ছাঁচে ঢালা, সিনথেটিক। তারা হাসবে, কাঁদবে, গাইবে, সঙ্গম করবে একটি বিশিষ্ট কায়দায়। ‘হাংরি প্রজন্ম’এর হুড়মুড় করে এসে পড়ায় এই গোটা গেমপ্ল্যানটি ধ্বসে যাওয়ার সম্ভাবনা ছিল। মলয় এবং অন্যান্যদের ওপর আক্রমণ সেই কারণেই।

 

প্রজাপতি-আঁকা বিয়ের কার্ডে হাংরি প্রজন্ম ধ্বনি তুলেছিল, “গাঙশালিক কাব্যস্কুলের জারজদের ধর্ষণ করো”। এই ধ্বনিটিতে অন্তর্নিহিত ছিল তদানীন্তন কাব্যধারার প্রতি বিবমিষা।

 

প্রকৃতি, নিসর্গ এই ব্যাপারগুলো হয়ে দাঁড়িয়েছিলো বাংলা কবিতার কলোনোয়াল রোগবিশেষ। রবীন্দ্রনাথের শিলাইদহ ছিল একটা কমপালশান, যেমন লেখালিখি ছিল তাঁর কমপালশান। সেজন্য তাঁর লেখায় প্রকৃতি, নিসর্গ বিশেষভাবে উপস্হিত— কবিতায়, নাটকে, উপন্যাসে। আঁকার সময়ে তিনি এগুলো বর্জন করতে বাধ্য হয়েছিলেন। পরে, বাংলা কাব্যধারায় এই ব্যাপারগুলো প্রয়োজনীয় অনুপান হয়ে ওঠে। এবং অনুপানেরও অধিক, অভ্যাস।জীবনানন্দ লেখেন ‘রূপসী বাংলা‘। তাতেও নিসর্গ ছিল; তবে সেই নিসর্গ, প্রকৃতির প্রতিটি কমপোনেন্ট আবহমানের বাঙালিজাতির চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যগুলোর প্রতিনিধিত্ব করেছিল।মানুষের সাথে সম্পর্কবিহীন ছিল না সেই নিসর্গ, সেই প্রকৃতি।সুভাষ মুখোপাধ্যায় লিখেছেন, “একদা আষাঢ়ে এসেছি এখানে, মিলের ধোঁয়ায় পড়ল মনে; কালবৈশাখী নামবে যে কবে আমাদের হাত-মেলানো গানে”। এখানে মানুষের সংগ্রামকে আঁকা হয়েছে প্রাকৃতিক ঘটনার রং-তুলিতে। কিন্তু বাংলা ভাষার সেইসব কবিরা    (গাঙশালিক কাব্যস্কুল) সৃষ্টি করছিলেন মনুষ্যবিহীন নিসর্গ, মানুষকে মাইনাস-করা প্রকৃতি। এ ছিল একজাতীয় পলায়নবাদ। শংকরের ‘কত অজানারে’ যেমন বাঙালি যুবকের বেকারত্ব থেকে পলায়ন করতে চেয়ে বারবেল সাহেবের মহানতায় বুঁদ হয়ে থাকা, বিমল মিত্রের মিষ্টি দিদি, নতুন বৌদি, ছোট বৌঠান যেমন নারী-পুরুষের স্বাভাবিক যৌনসম্পর্ক ফেস করতে না চাওয়ার যুক্তি, তেমনই ‘গাঙশালিক কাব্যস্কুল’ ছিল মানুষের দুঃখ, শোক, রোগ, ঘা-পাঁচড়া এগুলোকে দেখতে না চেয়ে স্টুডিওর পর্দায় আঁকা চাঁদ, তারা, নদী, ফুলে বিভোর হয়ে থাকা। ঠিক তখনই মানুষের জীবনধারণ কতদূর দুঃসাধ্য হয়ে উঠেছিল, তা দেখতে পাওয়া যায় ঋত্বিক ঘটকের ফিলমগুলোতে। সেই দৈন্য, দুর্দশা, দাঁতে দাঁত চেপে লড়াইয়ের প্রতিফলন এই কবিতাগুলোতে কোথাও ছিল না। কেন ? কেননা, তা করার অসুবিধে ছিল। তা করতে গেলে দীর্ঘ একটা লাফ দিতে হত, বিশেষ করে ভাষার ক্ষেত্রে।ঋত্বিক যেমন ‘মেঘে ঢাকা তারা’ বা ‘কোমল গান্ধার’ -এ গোটা ইডিয়মটিকেই ভেঙেচুরে ফেলেছিলেন, তেমনই ষাটের দশকের বঙ্গসমাজ ও মানুষেকে তুলে আনতে গেলে বাংলা কবিতার গোটা ইডিয়মটিকেই ভাঙতে হত। খানিকটা শ্রেণী পরিপ্রেক্ষিত আর কিছুটা গাড্ডায় পড়ে যাওয়ার ভয়, উভয়ে মিলে এ-কাজ করতে দেয়নি বাংলা ভাষার কবিদের। অতএব চাঁদ, তারা, নদী, ফুল, মৌমাছি…

 

আরেকটি প্রশ্নও ছিল। কবি কি কেবল কবিতাই লিখবেন, না সামাজিক ভাষ্যকারও হবেন ? রবীন্দ্রনাথ কেবল কবি নন, সামাজিক ভাষ্যকারও ছিলেন। জীবনানন্দও তাই ( জীবনানন্দকে নিবীঢ়ভাবে পড়লে এই ব্যাপারটি ধরা পড়ে) । কিন্তু উত্তরোত্তর সামাজিক ভাষ্যের ব্যাপারটি বাংলা কবিতা থেকে উঠে যেতে থাকে। “কবিতা কবিতাই। সামাজিক ভাষ্যটাষ্য আবার কী?” এ-জাতীয় একটী প্রবণতা বাংলা কবিতাকে পেয়ে বসতে থাকে। একে ক্রমাগত হাওয়া দিতে থাকে স্বার্থান্ধ বাণিজ্যিক সাহিত্য প্রতিষ্ঠান।

খুব স্বাভাবিকভাবেই নভেম্বর ১৯৬১-এর প্রথম বুলেটিন থেকেই হাংরি প্রজন্ম এই প্রবণতার বিরুদ্ধে ছিল। সেই দিন থেকে আজ অব্দি মলয়, সামাজিক ভাষ্যকারের ভূমিকাটি কোনোদিনই হাতছাড়া করেননি। ‘প্রচণ্ড বৈদ্যুতিক ছুতার’এ যেমন সামাজিক বিশৃঙ্খলা নিয়ে তাঁর তীব্র বিবমিষা, তামনই আজও। তাঁর হালের একটি কবিতা নেওয়া যেতে পারে, ‘যা লাগবে বলবেন‘ সংকলন থেকে । কবিতাটির নাম ‘ক্ষুধার্ত মেয়ে’:

 

আমার আসক্তি নেই কোনো

চলে যা যেখানে যাবি

যার সঙ্গে শুতে চাস যা

আমি একা থাকতে চাই

ক্ষুধার্ত বা পেটুক মহিলা

যে ঘোরে সবার হাতে

খড়কুটোময় সংসারে

তার কোনো প্রয়োজন নেই।’

 

কবিতাটিতে জড়িয়ে আছে একটা ঈষৎ বোহেমিয়ান বাচনভঙ্গী। পড়লে মনে হবে কেউ একজন লিখছেন তাঁর শয্যাসঙ্গিনীর উদ্দেশ্যে। এটি কিন্তু কবিতার প্রথম স্তর। দ্বিতীয় স্তরে কবিতা ও সমাজ সম্পর্কে মলয়ের দার্শনিক বোধ সন্নিহিত। শয্যাসঙ্গিনী মহিলাটি আসলে কবিতাই। অথচ সবার হাতে ঘোরার প্রবণতা তার, সে হাত স্মাগলারের হোক বা বিপ্লবীর।কবিতার লয়ালটি সন্দিগ্ধ। ওদিকে সংসার অনিত্য, অতএব তার প্রয়োজন কিসের?

 

‘প্রচণ্ড বৈদ্যুতিক ছুতার’ কবিতায় যে-কথা বলার জন্য মলয়কে অনেক বেশি জায়গা ব্যবহার করতে হয়েছে, ‘যা লাগবে বলবেন’ গ্রন্হে সেই কথাই তিনি বলেছেন অনেক সংক্ষিপ্ত পরিসরে। ‘হাংরি আন্দোলন’ থেকে সরে এসে রিজার্ভ ব্যাঙ্কের ইন্সপেক্টিং অফিসার হিসেবে ভারতের গ্রামে-গঞ্জে শহরে শহরে ঘোরা, তারপর এ.আর.ডি.সি. ও নাবার্ডের গ্রামোন্নয়ন বিশেষজ্ঞের উচ্চপদে। যদিও মলয় তাঁর এই পরিবর্তিত জীবনশৈলী নিয়ে ‘হাংরি কিংবদন্তি’ গ্রন্হের শেষে মশকরাও করেছেন, “ছাই-এর জায়গায় আসে টুথপেস্ট, কয়লার উনুনের বদলে গ্যাস, সর্ষের তেলের বদলে সূর্যমুখী, শার্ট-প্যান্টের বদলে সাফারি, মাদুরের স্হানে বিছানা, ঢাবার বদলে রেস্তরাঁ, দিশির জায়গায় স্কচ, কলেজস্ট্রিট ও বইপাড়ার বদলে বাংলার গ্রামশহর।” কিন্তু তবু জীবনের এই অধ্যায়টিও যে কবি হিসেবে মলয়কে অনেক বেশি সমৃদ্ধ করেছে, তাতে সন্দেহ নেই।

‘প্রচণ্ড বৈদ্যুতিক ছুতার’-এ বাঁধন-ছেঁড়া রাগ ছিল মলয়ের কবিতার পরিচিত চিহ্ণ। কিন্তু এই পর্যায়ে এসে জীবনের বহু কিছু দেখে-শুনে মলয়ের কন্ঠস্বর তেতো, অম্লকষায়, আর তার সাথে এসে জুটেছে আয়রনির অধুনান্তিক পরিহাসও। তবু তা মলয়ের কবিতাকে সর্বজনগ্রাহ্যও করে তোলে বটে।’যা লাগবে বলবেন’-এর আরও একটি কবিতাকে নেওয়া যেতে পারে, যেমন ‘দ্রোহ’:

 

এ-নৌকো ময়ূরপঙ্খী

তীর্থযাত্রী

ব্যাঁটরা থেকে যাবে হরিদ্বের

এই গাধা যেদিকে দুচোখ যায় যায়

যাযাবর

ঘাট বা আঘাটা যেখানে যেমন বোঝে

ঘুরতে চাই গর্দভের পিঠে

মাথায় কাগুজে টুপি মুখে চুনকালি

পেছনে ভিড়ের হল্লা ।

 

ব্যাস! কবিতা এইটুকুই। অথচ বাঙালি সমাজের যে একটি বিশেষ প্রবণতা, কবিকে বেদিতে বসিয়ে রাখার, তাকে কত সার্থক ভাবে ভাঙঅ হয়েছে এখানে। পাটনার অন্ত্যজ মহল্লাগুলোতে হোলির দুতিন দিন আগে থেকে চোখে-পড়া একটি সুপরিচিত দৃশ্যকে ব্যবহার করেছেন মলয়, প্রশ্নাতীত দক্ষতাসহ। তার সাথে মিশিয়েছেন তীর্থযাত্রার জন্য বাঙালি হিন্দুর চিরাচরিত আতুরতাটিকে, যাতে পোস্টমডার্ন পরিহাস আরও তীব্র হয় । আর… হাংরি মামলার সময়ে তাঁকে যে-সামাজিক অবমাননা সইতে হয়েছে, তাও উঠে এসেছে। মাত্র কয়েকটি পঙক্তির মধ্যে কত প্রসঙ্গ যে এসেছে, অথচ বলার ভঙ্গিটি এত সহজ যে ভাবাই যায় না ।

 

এই সংগ্রহের আরেকটি কবিতা ‘যে পার্টি চাইছেন সে পার্টিই পাবেন’।

বিশ্বাস এক দুর্ঘটনা

বুকপকেটে শ্রেণী

প্রতিরোধী থাকেন জেলে

কাজু-ফলের ফেনি

বরং ভালো

ভুল অঙ্কের ডানা।

…মোড়ল দলের পাড়ার কেউ বা

আওড়ায় বেঘোরে

ছাদ ঢালায়ের সমরবাদ্য

কর্তাবাবার জানা

মেলাবেন তিনি অন্তরীক্ষে

মোক্ষ একখানা ।

 

কবিতার শেষ দুটি পঙক্তিতে অমিয় চক্রবর্তীর ‘মেলাবেন তিনি মেলাবেন’, এই শান্ত, স্হিত, প্রায় ব্রাহ্ম, উত্তর-রাবীন্দ্রিক বিশ্বাসের আদলটি একেবারে বিপরীত অর্থে প্রযুক্ত হয়েছে। পশ্চিমবঙ্গে পার্টি আমলাতন্ত্রের যে প্রবল দাপত, যার দরুণ তেলে-জলে মিশ খেয়ে একেবারেই একাকার, পুতুল নাচের সুতোর শেষ প্রান্তটি ব্যক্তিবিশেষের হাতে, সেটিতে যেমন-যেমন টান পড়ছে, কাঠের পুতুলগুলো তেমন-তেমনই নাচছে; এই গোটা পরিবেশটি উঠে এসেছে কয়েকটি মাত্র পঙক্তির মাধ্যমে। মলয় বুঝিয়েছেন, যা বোঝাতে গেলে অন্তত কয়েকশো পাতার বই দরকার। আর?  বিরোধীপক্ষ বলতে কিছু নেই আর। যারা বিরোধ করছে, তারাও বস্তুত নিজের-নিজের ছাদই ঢালাই করছে। সেই ছাদ ঢালাই-এর বাজনাকে মানুষ মনে করছে সমরবাদ্য।

 

এত সূক্ষ্ম যাঁর ভাষার পরিমিতিবোধ, তিনি কিন্তু ‘চিৎকারসমগ্র‘ গ্রন্হে এসে আবার অন্যরকম হয়ে যান। দড়ি ঢিলে দেন একটু, যাতে তাঁর সংবাদবাহক ঘুরতে পারে জায়গা-বেজায়গায়। ‘ভাঙনের ছায়াগাছ’ কবিতাটির অংশ পড়া যেতে পারে এই প্রসঙ্গে:

 

হাজত থেকে ছাড়ান-পাওয়া সেই প্রৌঢ় নদী

নাচছে দুর্গাবোঙার ফরসা কোমর জড়িয়ে

শহর-পুরুতের গামছা কাঁধে

তাককা হুরে

আরে হুরে তাককা হুরে

 

বোঙা আদিবাসী দেবতা-অপদেবতার সর্বনাম। দুর্গা বাঙালির আবহমানের দুর্গতিনাশিনী। তারই কোমর জড়িয়ে নাচছে হাজত থেকে ছাড়ান-পাওয়া প্রৌঢ় নদী, কাঁধে শহর-পুরুষের গামছা। তাককা হুরে, আরে হুরে তাককা হুরে, শহুরে মাস্তানদের উল্লাসধ্বনি।

 

ভাঙনের ছায়াগাছ। এই ভাঙনকে সর্বদা দেখতে পাওয়া যায় না, অথচ সে তার কাজ করে চলেছে। ভাঙন বস্তুত একটি সার্বিক প্রক্রিয়া। এর দরুন সমাজের বিভিন্ন অংশের মধ্যে মজাদার মিলমিশ। বুর্জোয়ার বক্তব্য আশ্রয় করে লুমপেনের ভাষাকে।লুমপেন অ্যাডপ্ট করে বুর্জোয়ার চালচলন। এর সংস্কৃতি ঢুকে পড়ে ওর উঠোনে। ওর ‘রোনাধোনা’য় শোনা যায় এর অনুরণন।

 

চিৎকার করতে-করতে পড়ছে জলপ্রপাত চুলে

ঢাউসপেট পোয়াতি অফিস-বারান্দায় আইল হাতে

থ্যাতলানো ট্যাক্সিচালক হাওড়া স্টেশানে

যেখানে সাপের ফণা জমা রাখতে হয়

 

শহর বিষদাঁত খুলে নেয় প্রত্যেকের। ছোবলানো তো চলবেই না, ফোঁস করাও নয়। অফিস বারান্দায় ফাইল হাতে গর্ভিনী। কী প্রসব করতে চলেছে সে ? তারই মধ্যে ঝরে যেতে থাকা কেশপাশের চিৎকার। আলুলায়িত কেশপাশ বাঙালির আবহমানের সৌন্দর্য-মিথের অংশ।

 

মেঝেময় ছড়িয়ে-থাকা গোঙানির টুকরো তুলে

তারা বদলায়নি তবু আদল পালটেছে

হে নাইলন দড়ি বাড়িতে এখন কেউ নেই

কিন্তু বাইরে হাজার দুর্গন্ধে ভাগ-করা শহর

 

কবিতাটি পড়তে-পড়তে বহু পুরোনো টার্কিশ ফিলম ‘কংকারার্স অফ দি গোলডেন সিটি’র কথা মনে পড়ে। নিষ্পাপ একটি গ্রাম্য পরিবার শহরে এসে সব কিছু ধিরে-ধিরে হারাল। তার মেয়েরা হয়ে গেল বেশ্যা, পুরুষেরা অপরাধি। হাজার দুর্গন্ধে ভাগ-করা শহর— গোল্ডেন সিটি। সোনার শহর। নারকেল দড়ির বদলে নাইলন দড়ি, সভ্যতার অগ্রগতি। বাড়িতে কেউ নেই , শূন্যতা অপরিসীম।

 

কবিতাটির শেষ স্তবকে এসে মলয় দুর্বার ছুট লাগান— এমন ছুট যে কবিতা ব্যাপারটাই দুমড়ে-মুচড়ে যায়।

 

কচি বালক-পাছার নধরমাংস দেবদূত

মাখনমাখা ব্রয়লার যার শেষ খদ্দের

চলে গেছে তিন বছর তার ব্লাউজে সেফটিপিনগাঁথা হৃদয়

স্লুইস দরজা খুলে আলোর নারীশরীর

যে জীবন বুকের সামনে উঁচিয়ে অচেনা পিস্তল

তখনই সিঁড়িতে সাদা ছড়ির আওয়াজ তুলে

গামছায় মুখ ঢেকঢ গাঁও বালিকার কান্না

কেঁপে উঠেছে শিশুর গায়ে হাত ঠেকলে

 

ভাঙন যখন সব কিছুকেই ভাঙছে, তখন কবিতাকেও সে ভাঙবে। ভাঙতে-ভাঙতে কবিতাও মুক্ত হয়ে যাবে। তখনই বোধহয় বিদ্যুৎ ঝলকের মত এক অন্য কবিতার সৃষ্টিমুহূর্ত।‘ভাঙনের ছায়াগাছ‘ কবিতায় আমরা সেই প্রক্রিয়াটি দেখতে পাচ্ছি, চাক্ষুষ।মলয় রায়চৌধুরী থেকে বোধ হয় এক নতুন কবিকুলের সৃষ্টি হল, যাঁরা কেবল কবি নন, আপোষহীন সামাজিক ভাষ্যকারও বটে। “ঘুম-ঘুম চাঁদ ঝিকিমিকি তারা এই মাধবী রাত” এর ব্যকরণ ভেঙে চুরমার, পর্বত শিখরে সূর্যোদয়ের মতো শোনা যাচ্ছে সেই নতুন কবিতার বজ্রনির্ঘোষ।

‘হাংরি সাক্ষাৎকারমালা‘য় মলয় বলছেন বিবেকানন্দ চট্টোপাধ্যায়কে, “যতদিন বেঁচে থাকা ততদিন কবিতা ও গদ্যের চাকুতে একনাগাড় পালিশ দেওয়া দরকার।” হাংরি আন্দোলন ফুরোবার পর মলয় কেবল প্রথাগত জীবন যাপনই করেননি, একনাগাড়ে অনুশীলনও করেছেন। এই অনুশীলন ও পঠন-পাঠন ছিল একলব্য সদৃশ, অথচ সামনে ছিল না দ্রোণের মূর্তি।মলয়ের সাধনা এরকমই। তার ফলে ‘প্রচণ্ড বৈদ্যুতিক ছুতার’ ও তাঁর আজকের কবিতার মধ্যে গড়ে উঠেছে লক্ষণীয় দূরত্ব। ‘লক্ষণীয়’ বললাম, কারণ মলয়ের ‘হাততালি’ কবিতাটিতে এমনই কিছু পরীক্ষা ও নিরীক্ষা জ্বলজ্বল করছে। রেলওয়ে ট্র্যাকের পাশে দাঁড়িয়ে থাকলে যেমন ট্রেনের আলো-আঁধারি কামরাগুলো ঝটিতি চোখের সামনে দিয়ে বহুমাত্রিক অর্থময়তায় সরে-সরে যেতে থাকে, তেমনই এই কবিতার অজস্র ছবি, চিত্রকল্প, ইশারা এরা দ্রুত ছুটে চলেছে:

 

তারপর পলিতকেশ কাশফুলে

পইপই বারনের পুশতুভাষী দুর্যোধন বেরিয়ে পড়েছে

দগদগে রোদে

চন্দন রক্তের পাথর-পোশাক রক্ষীদের সরিয়ে

অন্ধকারকে খুঁচিয়ে বের করে এনেছেন সকালের বিকল্প

কাঁচা নরকের উদাত্ত অনুভব

হাহ

রোগা পৃথিবীর শিয়রে রাতজাগা নেশুড়ে

হরতালের দরুণ ক্রুশকাঠ থেকে নামতে পারেনি হাততালি

চোখে জলসুদ্দু হেসেছে শিশুরা

 

‘হাততালি’ প্রাথমিক স্তরে উল্লাসের বহিপ্রকাশ। প্রশ্ন উঠছে, সমাজ যখন পচছে-গলছে, তখন কবি এত উল্লসিত কেন ? কিসের এ-উল্লাস ? কেন উল্লাস ? বিশৃঙ্খলার মহোল্লাস ?

 

যা অচল, যা জড়, তাকে একদিন না একদিন ভেঙে জেতেই হবে। যতদিন তা না হচ্ছে, ততদিন নতুন কিছু গড়ে উঠবে না, উঠতে পারে না। মানুষের ভাবনাচিন্তা কার্যকলাপের ইতিহাসে এই উল্লাস অন্যত্রও দেখা গেছে। তন্ত্রসাধনার যে দিকগুলো, বামাচারের যে চালচলনগুলোকে ‘বিকৃতি’ বলে মনে করা হয়েছে, বস্তুত তা ছিল বর্ণাশ্রমপন্থী ছুঁৎমার্গপ্রবণ সনাতন হিন্দুধর্মের গড়া বিভিন্ন আগড় ভেঙে ফেলার উল্লাস। ভিন্ন ‘অন্ত্যজ’ বা অস্পৃশ্য জাতির নারীদের সাধনসঙ্গিনী করা, এই উল্লসিত বিদ্রোহের একটি দিক। নালান্দা জেলার কিংবদন্তি অনুযায়ী বৌদ্ধতন্ত্রের ভিক্ষু ‘পদ্মসম্ভব’ একজন অন্ত্যজ নারীকে নিয়ে ইলোপ করেছিলেন, ও দীর্ঘকাল নালান্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকের দায়িত্ব থেকে উধাও ছিলেন।দাহসংস্কারকে নানা কর্মকাণ্ডে মুড়ে সনাতন হিন্দুরা চেয়েছিলেন, মানুষ যেন অতীতকে খুঁটিয়ে না দেখে। শবসাধনা ও অঘোরপন্থা ছিল পরোক্ষে এর বিরুদ্ধচারণ। অতীতকে বিশ্লেষণ করা ও তার ভিত্তিতে ভবিষ্যৎ গড়ে তোলা, এই ছিল নানা তান্ত্রিক আচারের পেছনের অস্ফুট উত্তেজনা ও মহোল্লাস । মলয়ের ‘হাততালি’ কবিতার শিরোনাম ও ও প্রথম স্তবক এই আশ্চর্য নানার্থময় উল্লাসে মুখর। পুশতুভাষী দুর্যোধনের পৌরাণিক প্রাসঙ্গিকতাও আছে। একেবারে আলটপকা নয় এই অভিব্যক্তি। গান্ধার, কান্দাহার, পুরুষপুর, পেশাওয়ার, ভারত-পুরাণের এই অতিদীর্ঘ ছায়াবৃত যাত্রাপথের দূরত্ব নির্দেশকারী সংকেতগুলো মলয় ব্যবহার করেছেন স্হপতির নিপুণতায়, ইউক্লিডের নির্দেশ অমান্য করে। চন্দনরক্তের পাথর-পোশাক রক্ষীদের সরিয়ে। হিন্দুর পূজাসামগ্রী রক্তচন্দন। তাকে উল্টে চন্দনরক্ত। রক্ষীদের পোশাক পাথরের। অজর অনড় সনাতনী অতীত ভারত দেশের। অতীতকে না হয় মুছে ফেলা গেল, কিন্তু তারপর ?

“অন্ধকারকে খুঁচিয়ে বের করে এনেছেন সকালের বিকল্প/কাঁচা নরকের উদাত্ত অনুভব/হাহ”। যে নতুন পৃথিবী তৈরি হয়েছে তা নারকীয়। অতীতের বিকল্প গড়ে তোলার নামে কেবল নরকই তৈরি হয়েছে, অন্য কিছু নয়।

আধুনিকতার লাফঝাঁপ আজ হাস্যকর।

 

আধুনিকতার হাতে গড়া সামাজিক প্রতিবাদের নানা যোগাড়যন্ত্র প্রতিবাদকে ব্যহতই করেছে, আর কিছু করেনি।”হরতালের দরুণ ক্রুশকাঠ থেকে নামতে পারেনি হাততালি”, তথাপি “চোখে জলসুদ্দু হেসেছে শিশুরা।” কেউ যদি প্রশ্ন করেন যে মনুষ্য ইতিহাসের সবচেয়ে বড় দুর্ঘটনা কোনটি, তবে আমি কিন্তু বলব না, ‘পরমাণু বোমা আবিষ্কার’। বলব না ‘ঔপনিবেশিকতা’। বলব না কলম্বাস অথবা ভাস্কো ডা গামার জন্ম। আমার উত্তর “মনুষ্য ইতিহাসের সবচেয়ে বড় দুর্ঘটনা মার্কসবাদ ও জুডিও ক্রিশ্চিয়ানিটির সমার্থক হয়ে যাওয়া।” মার্কস একেবারে চাক্ষুষ দেখে ছিলেন বিশ্ব পুঁজিবাদের উদয়। সেই দেখা ছিল নিখুঁত। তাঁর অভুতপূর্ব মেধা খুঁজে পেয়েছিল সেই উদয়ের কারণগুলোকে। কিন্তু এক জীবনে তাঁকে করতে হয়েছিল বিপুল পরিমাণ কাজ।করাল দারিদ্রের সাথে প্রতিনিয়ত যুঝে, একমাত্র বন্ধো ও সহযোদ্ধা এঙ্গেলসের সাহায্যে, তাঁকে সমাজবাদী দর্শন, অর্থনীতি ও সমাজত্ত্বের ভিত্তিপ্রস্তর স্হাপন করতে হয়েছিল। তাই ইউরোপীয় সমাজের বাইরে বড় একটা ছড়িয়ে পড়তে পারেনি তাঁর দৃষ্টি। তবু ভারতবর্ষকে বোঝবার চেষ্টা তিনি করেছিলেন, উল্লেখ করেছিলেন ‘এশিয়াটিক মোড অফ প্রডাকশানে’ এর কথা। যদি এই মোডকে বোঝাবার সময় তাঁর হাতে থাকত, তবে হয়ত, হয়ত কেন, অবশ্যই, পরবর্তীকালীন যান্ত্রিকতা থেকে মার্কসবাদের মুক্ত থাকার সম্ভাবনা হত অনেক বেশি প্রবল।তা না হবার দরুন, পরে জুডিওক্রিশ্চান নিয়তির সাথে মার্কসবাদও জড়িয়ে পড়ে। যেমন খ্রিস্টধর্ম দরিদ্র ইহুদি ক্রীতদাসের ধর্ম হিসাবে যাত্রা শুরু করে, পরে রোমক সম্রাটদের ধর্ম হয়ে ওঠে, ঠিক তেমনিই, মার্কসবাদ, কাউটস্কি প্রমুখ সুবিধাবাদীর হাতে পড়ে অচিরেই ইউরোপীয় পুঁজিতন্ত্রের সেবাদাসের কাজে লেগে যায়।

 

মার্কসবাদের সামাজিক বিকাশের নিয়মটিকে তার দ্বান্দ্বিক অন্তর্বস্তু থেকে বিচ্ছিন্ন করে এমনই একটি যান্ত্রিক সিদ্ধান্তে পরিণত করা হয়েছিল যে, বলা হল, “ধাপে-ধাপে এগিয়ে পুঁজিবাদই সমাজবাদ (!) হয়ে উঠবে”— এই হয়ে ওঠে দ্বিতীয় আন্তর্জাতিকের দলগোলুর ধারণা।লেনিন, রোজা লুক্সেমবুর্গ প্রমুখেরা দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক ভেঙে তৃতীয় আন্তর্জাতিক গড়ে সৃষ্টিশীল মার্কসবাদের গোড়াপত্তন না করলে, পরে মার্কসবাদকে পুঁজিবাদের দর্শন থেকে আলাদা করে আর চেনাই যেত না। তখনকার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায়, লেনিন ছিলেন অধুনান্তিক রাজনীতিবিদ, যিনি আধুনিকতার প্রবক্তা কাউটস্কির বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছিলেন। কাউটস্কি প্রমুখরা মার্কসবাদকে অক্ষরসর্বস্ব করে তুলেছিলেন।কিন্তু যান্ত্রিকতা বোধহয় মানুষের একটি স্বাভিক ঝোঁক। পরে লেনিন-শিষ্যরাই আবার যান্ত্রিক হয়ে ওঠেন; রুশ মডেলটিকে ব্যবহার করতে থাকেন যত্রতত্র সর্বত্র। ভারতের মার্কসবাদীরাই হয়ে ওঠেন সবচেয়ে বেশি যান্ত্রিক।

 

‘ইতিহাস’ ভদ্রলোকটি নানাবিধ পরিহাসে যে ভালোরকম সিদ্ধহস্ত, তাতে আর সন্দেহ নেই। মলয়ের ‘হাততালি’ কবিতার ( এটি একটি দীর্ঘকবিতা ) দ্বিতীয় স্তবকের দ্বিতীয় পঙক্তিতে আছে, “যাত্রীডুবির খবরে ডুকরে উঠেছেন লালশালু নৌকার হাততালি।” পরিস্হিতি বারবার ওলোটপালোট করে দিচ্ছে মার্কসবাদীদের কষা ছক। এর ঠিক আগের পঙক্তিতে আছে, “একথোকা অন্ধকারে জোর করে দেখানো স্বপ্নে…।” মার্কসবাদীরা ভবিষ্যতের একটি মনমোহক স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন আপামর জনসাধারণকে। সেই ছবি বাস্তবসম্মত ছিল না। তাই ছক নষ্ট হয়ে যাওয়ায় হতপ্রভ মার্কসবাদী ভাবুক শিবির। “না খেতে পাওয়া হলুদ শীতে/গরম আলকাতরায় ফোটা ফরসা রজনীগন্ধা।” ওদিকে শোষণও অব্যাহত। তারই হাড়ে-মাংসে তৈরি হচ্ছে নবতম ‘নন্দনতত্ত্ব’। “কাঁধে চাঁদ নিয়ে ভররাত শাসিয়েছে শ্যাওলাধরা করোটি।” অতীতের দুঃসহ চাপ আর বারবার সেই চাপের কাছে নতিস্বীকার… “জ্বরগরম কপাল ছুঁইয়েছে তাঁর পশুপশম নাভিতে।” এরপর গুটিয়ে-রাখা একটি প্রাচীন, কীটদষ্ট মানচিত্র খোলার মতো একখানা গোটা উপমহাদেশ মলয় খুলে ধরেন আমাদের চোখের সামনে। সেই উপমহাদেশকে নষ্ট করেছে সাম্রাজ্যবাদ আর সামন্তবাদ। তাদের রূপক দ্যোতক প্রতীকগুলো বর্শাফলকের মতো বিদ্ধ হয়ে আছে উপমহাদেশটির হৃদয়ে।

 

“ব্যাবিলনের শাদা নরকহুরি/উত্রমুখো নকশিমেঘের ওষুধবড়ি গিলিয়েছে/রেড়িপ্রদীপে ঝুঁকে ঘুরঘুরে শুঁটিপোকা/

এলোচুলে ঢাকা রাজকন্যার মুকুট থেকে গানের টুকরো/

পায়ে রক্তমাখা রাজহাঁস/যখন-তখন চেয়েছে বাড়িফেরত সৈন্যের বসন্তকাল/সাজিয়েছে খেলাচ্ছলে মারা চরমযুবার মা-বাপের সবুজকাঁথা ধানক্ষেত/তুঁতেরঙা কুয়াশা এগিয়েছে সিংহচামড়া শিকারীর গোপন ঘাসপথে/বিবাহযোগ্য ঘুড়সওয়ার হাততালি/হেই হো”। এই নষ্ট প্রক্রিয়াটির বিরুদ্ধে দানা বাঁধেনি, বাঁধতে পারেনি যথার্থ বিদ্রোহ, যদিচ দেখতে বিদ্রোহের মতন, এমন অনেক কিছুই ঘটেছে।”আগুন যখন ধোঁয়া থেকে আলাদা হচ্ছে/যেটুকু সময়ে/আলজিভ/দুই হৃৎস্পন্দনের মাঝে তেতো হয়ে ওঠে/জলপথে এসে আক্রমণ করেছে জ্বরবিদ্রোহী/গাছে-গাছে ঝড়কালীন পলাশের লাল সক্যতা/ঠিক যেন চিড়িয়াখানার ভবিষ্যৎহীন/শেষ হাওয়ায়/পটকা ফাটিয়েছে রাংতাপাড় মেঘ/যেন এক্ষুনি এসে পড়ল বলে হাততালি।” একটি নষ্ট প্রক্রিয়া, তার বিরুদ্ধে ‘গড়ে ওঠা’ বিপ্লবী আন্দোলনের দেউলেপনা, সবকিছু মিলে বিচিত্র এক পরিস্হিতি। বিপ্লবী আন্দোলনের সেই সততা নেই যে নিজের দেউলেপনা স্বীকার করে নেবে।”কবরে পাওয়া গেছে ভাত খাবার কাঁসি/অত্যাচারিতের কাতরানিতে পড়েছে হাড়ের খিলান/কেউ সুখি নয়/কেমন আছো জানতে চাইলে বলেছে /ভালো/পাকের পর পাক কাঁটাতার কোমর থেকে খুলে দিয়েছে”।

 

ভারতবর্ষে বিহারসদৃশ যে কয়টি আভ্যন্তরীণ উপনিবেশ আছে, সেখানে অবস্হা আরও ভয়াবহ।এই আভ্যন্তরীন উপনিবেশগুলোকে নিয়ে বিপ্লবীদের ভড়ংএরও শেষ নেই।”ওদিকে হাততালিবাদক/ভগ্নস্বাস্হ্য আকাশে/পাখিদের গান শুধরে দিতে চেয়েছে/তারা দপদপে অন্ধকারে/

বালিশ-জড়ানো বর্ষায়/পালামৌ জেহানাবাদ রোহুতাসে কাদাপেছল মাগুরের আঁশটে হাঁপানি/শামুক থুতনি বুড়ির চোখের পাতায় ধূসর সোরাগন্ধক।”

 

সবকিছুর শেষে, সমস্তকিছুর পরিণামে খিদে। খেতে চাইছে মানুষ আর নিরন্তর খাদ্য হয়ে যেতে হচ্ছে তাকেই। আর তার এই খাদ্য হয়ে যাওয়াকে নানা অং বং চং দিয়ে মহিমা মন্ডিত করা হচ্ছে। মলয় এই বিচিত্র প্রক্রিয়াকে প্রস্ফূট করতে গিয়ে ব্যবহার করেছেন বিভিন্ন রূপকল্প, যাতে এই পরিস্হিতির দ্বৈততা যথার্থ ব্যাখ্যাত হয়। যে ক্ষুধার্ত, সে-ই খাদ্য। “এদিকপানে মুখ করে দাঁড়িয়েছে ছোকরা সূর্যমুখী/ গরম তেলে লাল দুহাত উড়িয়ে স্বাস্হ্যবতী কাঁকড়া/ভাতের হাঁড়িতে নেচেছে সফেদ-মসলিন নরম অপ্সরা/তখন অন্ধকারে কেঁদে নিয়ে আলোয় হেসেছে হাততালি/হাসপাতালের বিছানায় লোহার শেকলে বাঁধা শুনেছে/ টেবিল ঘড়িতে সারারাত গ্রেপ্তারের ঠক ঠক ঠক ঠক।”

 

আন্তর্জাতিক কমিউনিস্ট আন্দোলনে যাঁরা ঔৎসুক্য রাখেন, তাঁদের অবশ্য পঠনীয় একটি বই “দি নিউ ক্লাস”, লেখক মিলোভান জিলাস। জিলাসের সংক্ষিপ্ত পরিচয় দেয়া আবশ্যক।মিলোভান জিলাস, তদানীন্তন যুগোস্লাভ কমিউনিস্ট পার্টির শীর্ষস্হানীয় নেতাদের একজন, স্ট্যালিন ও টিটোর অন্তরঙ্গ, আন্তর্জাতিক কমিউনিস্ট আন্দোলনের ‘কমিনফর্ম’ পর্যায়ের একজন সম্মানিত ব্যক্তি। পরে কমিউনিস্ট পার্টির সদস্যতা ত্যাগ করেন ও এই বইটি ও আরও কয়েকটি উল্লেখযোগ্য বই লেখেন, যেমন “কনভারসেশানস উইথ স্ট্যালিন” লেখেন। “দি নিউ ক্লাস” লেখার অপরাধে টিটো জিলাসকে সশ্রম কারাদন্ডে দম্ডিত করেন। দি নিউ ক্লাস বইটিতে জিলাস সমাজবাদী রাজনীতির ক্ষেত্রে একেবারে নতুন একটি অবদান রাখেন। তাঁর বক্তব্য ছিল, মিনস অফ প্রোডাকশানের মালিকানা স্বত্ব কাগজে-কলমে না থাকলেও সমাজতন্ত্রী দেশগুলোতে একটি নিউ ক্লাস বা নতুন শ্রেণির উদয় হয়েছে, যারা উদ্বৃত্ত বা সারপ্লাস সংগ্রহ করতে সক্ষম। এই শ্রেণীটি ক্রমশ নিজেদের হাতে প্রভূত অর্থ ও ক্ষমতা কেন্দ্রিত করেছে, এবং পার্টি, শাসনতন্ত্র, সমস্তকিছু নিয়ন্ত্রণ করছে। জিলাসকে সেই যুগে সাম্রাজ্যবাদীর দালাল উত্যাদি আখ্যায় বদনাম করা হয়েছিল। তিনি কারাবাস করেন, এবং ধিরে-ধিরে লোকচক্ষুর আড়ালে চলে যান। পরে যখন সোভিয়েট দেশ ও সমাজতান্ত্রিক শিবিরে ধ্বস নামে, এক কালীন পার্টি আমলারাই সি.পি.এস.ইউ.কে ভোগে দিয়ে দেন, এবং রাতারাতি বিশাল-বিশাল কল-কারখানার মালিকের চেয়ারে জাঁকিয়ে বসেন, তখন আবার জিলাসকে খোঁজা আরম্ভ করেন যথার্থ মার্কসবাদীরা। পশ্চিমবঙ্গে বহুকাল বহুবছর বামফ্রন্ট ক্ষমতায় থাকার ফলে আমলাতন্ত্রের যে অভ্যুদয় ঘটেছে, তাকে যথাযথ বুঝতে যাঁরা চান, তাঁরা এই বইটির সাহাজ্য নিতে পারেন।

 

‘কৌণপের লুচিমাংস‘ কাব্যগ্রন্হের ভূমিকায় মলয় বলেছেন, “বর্তমান কালখন্ডের বঙ্গসমাজটি অধিবাস্তব। আমি চেষ্টা করেছি তাকে উপস্হাপনের। সেকারণে কোথাও-কোথাও পঙক্তি এবং ছবিকে মনে হতে পারে জটপাকানো। আমার প্রতিভা দ্বারা কবিতাগুলোর সৃজন হয়েছে মনে করা ভুল।আমিই বরং সৃজিত হয়েছি কবিতাগুলোর দ্বারা। ভাষাসমাজের দ্বারা।”মলয়ের এই বক্তব্যটি কবিত্বের ধারণাটিকেই পালটে দেয় মূল থেকে। গলায় গাঁদাফুলের মালা, স্কুল-শিশুদের উদ্দেশ্যা নরম গলা, ‘নারীত্বের’ প্রতি সম্ভ্রমশীল, চোখ ঢুলুঢুলু, ভুলো মন, জীবন সম্বন্ধে উদাসীন— স্বল্পকথায় একটি প্রবল নন্দনতাত্ত্বিক তালগোলের যে চিত্রটি চোখে ভেসে ওঠে ‘কবি’ শব্দটি উচ্চারণ করতেই, তা থেকে মলয় নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়েছেন কিছুটা জোর করেই হয়ত। মলয় বলছেন, ‘কোথাও-কোথাও পঙক্তি এবং ছবিকে মনে হতে পারে জটপাকানো’। এও বলছেন, একটি অধিবাস্তব সমাজকে উথ্থাপন করতে গিয়েই হয়ত এই জটিলতার সৃষ্টি। কৌনপ একজন পৌরাণিক রাক্ষস, যে কুনপ অর্থাৎ শব খেয়ে বেঁচে থাকে। ‘কৌনপের লুচিমাংস’ রাজনৈতিক কবিতার সংগ্রহ। সর্বসাকুল্যে বত্রিশটি কবিতা আছে সংকলনে। কবিতাগুলির প্রত্যেকটিই একটি করে হাহাকার। আজকের পশ্চিমবঙ্গ, তার সমাজ, তার সংস্কৃতি, তার পচন, সবকিছু নিয়ে হাহাকার; যদিও ওই একই ভূমিকায় মলয় বলেছেন, ‘এই গ্রন্হের পাঠবস্তু আসলে বাঙালির পচনের হোলিখেলা’। কিন্তু মলয়ের কষ্ট ও বেদনা প্রতিটি কবিতায় প্রস্ফূট। তার আঙ্গিকটি যদিও উল্লাসের, হোলিখেলার। ব্যাপারটা কিছুটা চার্লি চ্যাপলিনের ফিলমের মত বলা যায়।অধুনান্তিক। ‘রাঁঢ়বাজারে শততম প্রেমিকের আবির্ভাব হল/ অথচ ফুলের টবে মাটি নেই শেকড়ে-শেকড়ে ছয়লাপ সংসার’। রাঁঢ়বাজার শব্দটি প্রণিধানযোগ্য।

মলয় বর্তমান পশ্চিমবঙ্গের পরিস্হিতিকে ‘রাজনীতিবিদ বনাম জনতা’ এভাবে নিচ্ছেন না কিন্তু। আগেও বলেছি, সামাজিক ভাষ্যকারের ভূমিকাটি মলয় কখনই হাতছাড়া করেননি। সেই ভূমিকাটিই তাঁকে উৎসাহিত করেছে পশ্চিমবঙ্গের কলোনিয়াল অতীতকে খুঁটিয়ে দেখতে। তাঁর লেখা বহু গল্পে ও প্রবন্ধে এই দেখা খুব স্পষ্ট। মলয়ের অধুনান্তিক ধ্যান-ধারণার উৎপত্তিও বস্তুত এখান থেকেই। উপনিবেশবাদ পশ্চিমবঙ্গের মনোজগৎকে ভালো রকম ধামসে দিয়েছে বহু আগেই। তার ফলে তা হয়ে দাঁড়িয়েছে একটি ফলাও রাঁঢ়বাজার, যেখানে কেবল প্রেমিক যায় আর আসে। বর্তমান কালখণ্ডের ক্যাডাররা সেই রাঁঢ়বাজারের শতশত প্রেমিক। ফুলের টবে মাটি নেই, অথচ শেকড় সেঁদিয়ে গেছে ভেতরে, প্রায় অতল পর্যন্ত।অনন্ত পর্যন্ত নানা কায়েমিস্বার্থ চারিয়ে দিয়েছে শেকড়।

 

সামাজিক ভাষ্যকারের ভূমিকাটি অত্যন্ত সিরিয়াসলি নেয়ার দরুনই মলয় খুঁটিয়ে দেখেন গলদ কোথায় ছিল আর আছে। কমিউনিস্ট-বিরোধীরা যেমন গোটা ব্যাপারটিকেই “আরে ও শালারা অমনধারাই” বলে সেরে নেন, মলয় কিন্তু তা করেননি। তিনি খু#টিয়ে দেখেন, জানতে এবং জানাতে চান।তার ফলে তাঁর চোখে ধরা পড়ে বহু বিচ্যুতি, যেগুলো হয়ত অনেকেই দেখেও দেখেননি। ‘কাউন্টার ডিসকোর্স’ কবিতায় মলয় বলছেন, “খাটের দুপাশ দিয়ে আলাদা বয়ে যাচ্ছিল মজুরের নদী কৃষকের নদী। যে কড়াকড়িতে সারাদিনে সূর্য শুধু একবারই ওঠে আর মিলিয়ে যায়।”

 

অক্টোবর বিপ্লবের সময় সহসা আবিষ্কৃত হয় যে বলশেভিক পার্টির হাতে কৃষক শ্রেণির জন্য কোনো আলাদা প্রোগ্রাম বা কর্মসূচী নেই। অথচ বিপ্লবের কর্মকান্ডে কৃষক শ্রেণির সহযোগীতা অপরিহার্য। লেনিন দ্বিধাহীনভাবে এস.আর. (শ্পেশাল রিভলিউশানারি)-দের প্রোগ্রামটিকেই সরকারের তরফ থেকে অ্যাডপ্ট করে নেন। কয়েকটি পার্টির যে যুক্তফ্রণ্ট অক্টোবর বিপ্লব ঘটাতে চলেছিল, তাদের মধ্যে এস.আর. দলটিও ছিল, তাই এই কাজটি কারো অবিপ্লবী মনে হয়নি। নিজের পার্টির ত্রুটি মেনে নেওয়া, স্বীকার করা, পরিমার্জনা করার ব্যাপারে লেনিন তো, প্রায় বলা চলে তুলনাহীনই ছিলেন। আজকের ভারতবর্ষের, আরও বিশদভাবে বলতে গেলে, আজকের নানা রঙের বামনেতাদের মাইন্ডসেট কি একটুও এরকম? পুঁজিবাদী সামন্ততান্ত্রিক সমাজে ওলোটপালোট ঘটাতে গেলে যে-দুটি শ্রেণীর হাত মেলানো প্রয়োজন, তারা দাঁড়িয়ে সম্পূর্ণ আলাদা-আলাদা অবস্হানে।শ্রমিক ও কৃষকের উঠোন একেবারেই ভিন্ন। আবার মজুরদের বমধ্যেও পি.এস.ইউ.এর মজুর আর আনঅর্গানাইজড   সেক্টরের মজুরের আলাদা হাঁড়ি। কৃষকদের মধ্যেও এই জাতীয় নানা ভাগাভাগি। অথচ এ নিয়ে ‘মার্কাসবাদী’ তাত্ত্বিকদের মাথাব্যথা আছে , ঔপচারিক বুকচাপড়ানো ছাড়া ,     এমন তো  মনে হয় না।  তাহলে রদবদলটা  ঘটবে কীভাবে ?

 

রদবদলের আশা করাটাও কী উচিত ? যখন বিপ্লবী ক্রিয়াকলাপ এক হিমশীতল রুটিন মাত্র , তার রন্ধ্রে-রন্ধে বাসা বেঁধেছে নানা সাইজের ঘুঘু , পৃথিবীর সবচেয়ে অগ্রগামী দর্শনটি এক অকিচিঞ্চিৎকর উপচারে পর্যবসিত, তখন সত্যিই কি কোনো আশা কোথাও রয়েছে যে একদিন সব কিছু বদলাবে ? “শেষ ট্রেনের নাম তত্ত্ববিশ্ব” কবিতায় বলছেন মলয়, “আর ভাটার দুলুনি খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ুক ক্লান্ত স্টিমলঞ্চ/হাড়ে-হাড়ে টের পাওয়া হাড়গুলো দাঁতনদেঁতো প্যাংলার দুর্ভাবনায়/ডেরা ডেলে চুলখোলা বারান্দায় চোখ বুজে দেখবে এক তিন ঠেঙে বেড়াল/শ্যাল-চাদর মুড়ি দেয়ে/প্রতিধ্বনি নকল করতে ওস্তাদ তলপেট-ফোলা বোল্ডার/পিঁপড়ের খনি-টানেলে জড়ো করেছে টুসকি নির্দেশে/নামিয়ে-আনা তত্ত্ববিশ্ব।” তবু মানুষের আশা…। ধন্য আশা কুহকিনী। এখনও সে আশা রাখে রেলিতে যায়, ব্রিগেড জমায়েতে যায়। এখনও পার্টিদাদার দরজায় দাঁড়িয়ে থাকে যে তার আশা-হতাশার কথা দাদা শুনবেন। এখনও…। “খোঁড়া বরের টোপর” কবিতায় মলয় বলছেন, “দূরে শোনা যাচ্ছে/ নারকেল-পাতায় উড়ন্ত ঘোড়ার খুরধ্বনি/ বর আসছে বর আসছে বর আসছে একঠেঙে/ কাছিম-টেকো মাথায় ফর্দাফাঁই লালটোপর।”

 

“কৌনপের লুচিমাংস” সংগ্রহে এসে মলয়ের কবিতায় আবার একটি গুরুত্বপূর্ণ বাঁকবদল ঘটেছে বলে আমার ধারণা। এই কথাটি মলয় নিজেও স্বীকার করেছেন সংগ্রহের ভূমিকায়, “বাঁকবদলের জন্যেই তো নতুন কাব্যগ্রন্হ, নইলে একঘেয়ে একের পর একের কোনো মানেই হয় না।” মলয়ের ভাষা আশ্চর্য দ্যুতিমান হয়ে উঠেছে এই সংগ্রহে এসে। “ভূমিপুত্রের জন্মস্হান বদলের দরখাস্ত” কবিতাটিতে মলয় বলছেন, “দাদু, কেন্দ্র কই, সেই গর্মাগরম ষাঁড়িত জান্তব সিংহাসন ?/এ তো দেখছি গ্যাংগ্রিনের শাশ্বত নালি ঘা!” দুটি মাত্র পঙক্তি। তার মধ্যেই বিধৃত একটি সমাজের গোটা ইতিহাস, তার অতীত, তার বর্তমান, আর বোধকরি তার ভবিষ্যতও। কি আশ্চর্য দক্ষতায় মলয় দেখিয়ে দেন সবকিছু; মাত্র দুটি পঙক্তিতে কত কথাই যে বলেন। পশ্চিমবঙ্গের সাধারণ মানুষের আজকের হাল-হকিকত বোঝাতে….”এই একপশলা সন্ধ্যায় ট্রানজিসটারে লকাপ লোচ্চার লিট্যানি শুনতে/গুটিপোকার সবুজ দেহতরঙ্গের তুলতুলে গানে গাছের কোটরে/সঙ্গীত খুঁজছে কাঠঠোকরা তার নিলাম-ডাকা মেশিন ঠোঁটে/পিটিয়ে-মারা শেষ শেয়াল পঞ্চায়েতকে উন্নীত করেছে জেলাসদরে/ড্যাশবোর্ডে থ্যাঁতামাথা কুষ্ঠ-সাম্রাজ্যের সোনাজল ভোটার/ঠায় বসে আছেন কাদা-কুঁজোর কায়দায় ঘুরন্ত চাকে।”( ফ্রান্তস  ফ্যানঁ ) । অথবা…”আমি যে কিনা কুহকঠুঁটো মেয়েদের মাঝে ছিলুম ট্রিগারলিঙ্গ যুবা/খড়খেতের সোঁদা-সোনালি চামচমকানো মকাইগুঁফো চাষার ছেলে/একটা চুল টানতেই বেরিয়ে পড়েছে রক্তপচা আঁতের ঝুরি/জ্ঞাতিদের মুখে পাঁঠার গলায় নেমে আসা খাঁড়ায় আঁকা চোখের কান্না/ দেখছি আর ভাবছি কি মজা শবশকটে আগে চড়িনি কক্ষুনো” (রূপসী বাংলার ভাতার )

 

অথবা…”আমি কিন্তু কুঁড়ে টাইপের বিকেলবেলায় যখন বেহেড/পাকস্হলি নিয়ে ফিরছি/ভুল সময়ে আগত শীতে বদন-বেচুনিদের চৌরঙ্গি স্যামপেলের ডেরায়/ম্যাপ খুলে দেখাবে, হ্যাঁ, ওই যে ওই তো ইউজারফ্রেন্ডলি বসন্তঋতু/ চিলের পেছন-পেছন উড়ে ব্লো-আপ হিরোর গায়ে/হাত ছুঁইয়ে ভিককে চাইছে/আমি কিন্তু অতীতকে নতুন করে গড়ে ফেলেছি জলফোঁটায় বেঁধে-বেঁধে/প্রকৃতি কি আর ভাবছেন জানত না লাশ গোঁজড়াতে একসেট অমাবস্যা চাই/তাই তো জলের ক্যাঁদরায় খুকি-পোনাদের ভাসিয়ে নিয়ে/চলল জোয়ার-বুড়ো” (ক্যাটাক্রিসিস)।

 

প্রথম-যৌবনে কবিতা লেখার জন্য লাঞ্ছিত ও নিন্দিত, পরে বহু বছর নৈঃশব্দের অতলে, আর আজ বাংলা কবিতার মধ্যগগনে সূর্যের মত ভাস্বর মলয় রায়চৌধুরী এখন পরিণত বয়স্ক। আয়ুর ওপর নিয়ন্ত্রণ নেই মানুষের; শোনা যায় মলয়ের শরীরও খুব একটা সুস্হ নয়।বাংলা ভাষার যে অপরিমেয় সম্ভাবনা আছে, তার ঠাহর মলয়ের মত আর কারো হয়ত নেই। বাংলা ভাষার শব্দগুলোকে তিনি দিয়েছেন সম্পূর্ণ নতুন এক আয়তন, তাকে আজকের পৃথিবীর যোগ্য করে তুলেছেন।মলয়ের কবিতা নিয়ে কথাবার্তার এক নতুন পর্ব আরম্ভ হবে বলে প্রতীক্ষা করছি আমরা। সেই কবে কৃত্তিবাস ওঝা দ্বিধাজড়িত হাতে লেখা আরম্ভ করেছিলেন, “গোলকে বৈকুন্ঠপুরী সবার উপর।/ লক্ষ্মীসহ তথায় আছেন গদাধর।/তথায় অদ্ভু বৃক্ষ দেখিতে সুচারু।/যাহা চাই তাহা পাই নাম কল্পতরু।। দিবানিশি তথা চন্দ্র-সূর্যের প্রকাশ।/তার তলে আছে দিব্য বিচিত্র আবাস।।/নেতপাট সিঙহাসন উপরেতে তুলি।/বীরাসনে বসিয়ে আছেন বনমালী।।/মনে মনে প্রভুর হইল অভিলাষ।/এক অংশ চারি অংশ হইতে প্রকাশ।।” তেলের প্রদীপের আলোয় সামনের দিকে নুইয়ে পড়ে তিনি লিখেছিলেন। বাইরে চরাচরব্যাপী অন্ধকার। সেই অন্ধকারে হয়ত বা জ্বলছিল-নিভছিল গুটিকয় জোনাকি। অশ্বথ্থের নিষের অমান্য করে হঠাৎ-হঠাৎ হাওয়া বইছিল। অসংখ্য কান প্রতীক্ষা করছিল বাংলা কবিতার জন্মের প্রথম কান্নাটি শুনবে বলে। খাগের কলমের খসখস শব্দ উঠছিল তুলোট কাগজে। তারপর দীর্ঘপথ। কত রাজত্ব, সাম্রাজ্যবাদের উথ্থানপতন। ধুলোয় গড়াগড়ি কত মুকুট, রাজদণ্ড। রক্তাপ্লুত, কাঁটা-বেঁধা পায়ে কেবল হেঁটেছে বাংলা কবিতা। হেঁটেছে, হেঁটেছে আর হেঁটেছে। এখনও চোখ খুললে সেই মানুষদের দেখতে পাওয়া যায় সারিবদ্ধ দাঁড়িয়ে, যাঁরা সেই শিশুটিকে বয়স্ক করে তুলতে অসহ্য দুঃখ স্বীকার করেছেন। সকল পার্থিব সুখ-সুবিধা তুচ্ছে করেছেন তাঁরা, নিজের জীবন, যৌবন, মান-সম্মান, সব কিছু ব্যয় করেছেন বাংলা কবিতার জন্য। যেদিন মলয় কবিতা লেখার জন্য কাঠগড়ায় দাঁড়িয়েছিলেন, সেদিনই, সবার অলক্ষ্যে, এই মানুষদের একজন হয়েগিয়েছিলেন তিনি। ভুল করেছিল বাণিজ্যিক সাহিত্য প্রতিষ্ঠান ও প্রশাসন। বাংলা কবিতার জন্য সর্বস্বপণ যোদ্ধাকে অট সহজে পরাভূত করা যায় না। জয় মলয়েরই হয়েছিল। সেই জয় আজ প্রতিধ্বনিত মলয়ের প্রতিটি কবিতায়।

 

———————————————————————————-

বিশ্বজিত সেন ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য ছিলেন। পার্টি বহু অংশে বিভাজিত হবার পর ও তাদের সদস্যদের নৈতিক পতনে আশাহত শ্রীসেন পার্টি ত্যাগ করেন।কিন্তু তিনি আজও নিজেকে একজন মার্কসবাদী ভাবুক বলে মনে করেন।তাঁর একাধিক কাব্যগ্রন্হ, গল্পগ্রন্হ ও প্রবন্ধের বই আছে।

অর্ক চট্টোপাধ্যায় : মলয় রায়চৌধুরীর গদ্য

s200_arka.chattopadhyay
 

 

ছোটোলোকের ছোটোবেলা

 

 

এবার আসি ১৯৯৯ – ২০০৩-এ লিখিত ও ২০০৪ সালে কোবার্ক পাবলিশাসফ প্রকাশিত আত্মজীবনীমূলক উপন্যাস ‘ছোতোলোকের ছোটোবেলা’য় । “উপন্যাস” শব্দটি মলয়ের গদ্যের ক্ষেত্রে কতটা প্রযোজ্য তা অবশ্য বিতর্কসাপেক্ষ । উপনঅস হিল্পের ধারাটি তাঁর কাছে ঔপনিবেশিক আধুনিকতার ফসলমাত্র । এই ধারাটির ভাঙনলীলাই  তাঁর চারণ এবং নড়ন-চড়ন । ব্রিটিশ ঔপনিবেশিকতার সাথে মুখোমুখি হবার আগে ও পরে ভারতীয় সাহিত্যে এক দ্বিধাবিভক্তি লক্ষ্য করা যায় যে কারণে সমালোচিকা মীনাক্ষী মুখোপাধ্যায় “Twice born Indian Fiction” শব্দবন্ধটি ব্যবহার করেছেন । ভারতীয় সাইত্যের এই দোআঁশলা রূপ মলয়ের গদ্যের আনাচে-কানাচে । গল্প বলার থেকে বেশি না-বলা, না বলতে পারা । প্রতিটা গল্পই শুরু হয় হবে হবে করে তারপর আর হয় না, ফুরিয়ে যায় , ফুরোয় না শুধু অনন্ত সিরিজ— গল্প থেকে গল্পান্তর । বদলে যায় । বদলে বদলে যায় । এমনই এক বহুরৈখিক ন্যারেটিভ ট্যানজেন্টের গদ্য হল মলয় রায়চৌধুরীর “উপন্যাস” ।

 

প্রতিষ্ঠান-বিরোধিতা ইওরোপীয় আভান্ত গার্দের মতই এক প্রতিশিল্প ( anti-art ) ও প্রতিসন্দর্ভবাদী অবস্হান বা অনবস্হান তৈরি করে —মলয়ের অভিযোগ— “শিল্প-সংস্কৃতি, প্রতিভা, মাস্টারপিস, এইরকম যাবতীয় কনসেপ্ট এনেছিল সাম্রাজ্যবাদীরা” । ‘হাওয়া-৪৯’কে দেওয়া সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছেন ইংরেজরা আসার পর রবীন্দ্রনাথ ও সুনীতিবাবু মিলে ‘আর্ট’ থেকে ‘কলা’র অনুবাদ-কাঠামো খাযা করেছেন গূঢ় নান্দনিক অভিসন্ধি নিয়ে । মলয় তাই স্বঘোষিতভাবেই প্রতি-লেখক । মলব যখন বলেন—“আসলে ইতিহাসকে বা কালকে বাদ দিয়ে এবার ভূগোল বা স্‌আনকে গুরুত্ব দিতে হবে”, তখন তাঁর কথায়  উত্তরআধুনিকতায়, আধুনিকতার সময়ের মতো, স্হানিকতার গুরুত্বের জায়গাটা পরিষ্কার হয়ে যায় । স্হানিক এবং খণ্ডীকৃত প্রতর্কই মহাসন্দর্ভের বিরোধিতা করে এক বিকল্প ইতিহাস নির্মাণে সচেষ্ট হয় । “ছোটোলোকের ছোটোবেলা” তেমনই এক “local history”—মলয়ের সাংস্কৃতিক সংকরায়ণের কাইনি, যেখানে প্রাব মহাকাব্যের ঢঙে অসংখ্য ও বিচিত্র প্লট ও ক্যারেক্টার দেখা দেয় । একটি প্যারাগ্রাফ শেষ হতে না হতেই হারিয়ে যায় । অধুনান্তিক কাহিনি দর্শনে অসমাপ্ত ও অসমাপ্য এই গল্পগুলিই হল এক-একটি ট্যানজেন্ট । ট্রিলজির “লেখকের কথা” শীর্ষক অংশে তিনি লেখেন তাঁর গল্পের গড়াপেটা হল —“প্রট্যাগনিস্ট-কেন্দ্রিক মেট্রপলিটান সাহিত্য বহির্ভূত এমনই এক প্রারম্ভ যার বুনোট কিছুটা এগোলে চরিত্রেরা ফুরিয়ে এবং হারিয়ে যেতে থাকে । যেমনটা ভারতীয় সমাজে ঘটতে থাকে।” এই সতত বিলীয়মানতা মলয়ের মুসাফির অপরীকৃত জীবন ও তাঁর চারপাশে সাবর্ণ চৌধুরীদের একান্নবর্তি পরিবারে ভাঙনেরও চালচিত্র হয়ে যায় । যেমন নিজের মেজমামা ছ্যানের মৃত্যুতে লেখা ছোটোগল্পে মলয় পুরো গল্পটা লেখেন ন্যারেটিভকে হাইপোথিসিসে বদলে দিয়ে । ছ্যানের জীবনের প্রতিটি গল্পেরই এক বিকল্প বা প্রতি-গল্প ( anti-narrative ) আছে । সত্য তাই অনির্ণেয়ই থেকে যায় । প্যারাগ্রাফগুলি এক-একটি গল্প ও তার বিকল্পকে নির্ভার টেক্সট বানিয়ে পরপর সাজিয়ে ফেলে ।

 

ইতিহাসের এমনই লীনতাপ পাটনাত বাখরগঞ্জ এলাকার ইমলিতলার ছোটোলোক পাড়ায় । সেকানে চেয়ারে বসা বা রোজ স্নান করা বিলাসিতামাত্র । ন্যারেটিভ পেন্ডুলামের মতো পায়চারি করে ১৭০৯ সনে রত্নেশ্বর রায়চৌধুরী প্রতিষ্ঠিত উত্তরপাড়ায় । উত্তরপাড়ার সাবর্ণ ভিলা তখনই খণ্ডহর । আমার জন্মের পর আমি অবশ্য সে খন্ডহরও দেখিনি । সেখানে এখন ফ্ল্যাটবাড়ি । এই দ্বিস্হানিক ইতিহাসে বালক মলয় যেন বিনিময়যোগ্য বস্তুবিশেষ । ইমলিতলা, পানিহাটি, উত্তরপাড়া, আহিরিটোলা— সর্বত্রই তিনি “অন্যান্য”— অপর । প্রথমে ক্যাথলিক স্কুলে তারপর ব্রাহ্ম রামমোহন রায় সেমিনারিতে । কোন্নগরের আত্মীয়রা তাকে “খোট্টা খ্রিস্টান” বলে ডাকতেন—“ইমলিতলায় আমরা ছিলাম বঙ্গসংকর । মামারবাড়ি পানিহাটিতে গেলে খোট্টাসংকর।” মলয়ের চেতনা সদা সংকরায়িত জগৎ যেখানে ক্যাথলিক স্কুলের পিয়ানো টিচার মিস ডরোথির গায়ের পারফিউম ঘৃতকুমারী পাতার শাঁসের গন্ধের মতো ঠেকত বালক মলয়ের নাকে ।

 

এই আখ্যানে ইতিহাস আর কিংবদন্তিকে মিলিয়ে দিয়েছেন লেখক । ইতিহাস লোককথা ও মিথ নির্মাণে এক আত্ম-বিধ্বংসী জিরো-পয়েন্ট — ডায়াস্পোরার জিরো হিসট্রি বা ইতিহাসহীনতা । দেশ থেকে দেশান্তরে হস্তান্তরিত হতে থাকা উদ্বাস্তু জনগোষ্ঠী তার অতীত তথা সিকড়ের ইতিহাস থেকে উৎখাত হয় । এই মিথিক পরিসর ঔপনিবেশিকতার যুক্তিবদ্ধ প্রতর্কের বিরোধিতা করে ।  ইতিহাস এখানে শুধুই এক রেফারেন্স ফ্রেম যেন । গ্রন্হের শেষাংশে লেখক নিজেই একে লাতিন আমেরিকান ম্যাজিক রিয়ালিজমের সঙ্গে তুলনা করেছেন । তবে তাঁর উপনিবেশ বিরোধী অবস্হানের সাথে তাঁর জীবনেরও এক সম্পর্ক খুঁজে পাওয়া যায় । ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির আক্রমণের সময়ে তাঁর পূর্বপুরুষরা সিরাজের পক্ষেই ছিলেন । সিরাজের পক্ষাবলম্বনকে ইমলিতলার বাড়িতে সাবর্ণ চৌধুরীদের “স্ট্র্যাটেজিক ব্লান্ডার” বলে মনে করা হত । ইংরেজদের বিরাগভাজন জমিদারবংশ এভাবেই ইমলিতলার ফেকলু ছোটলোক হয়ে ওঠে ।

 

সাবর্ণ চৌধুরী বংশের এই মিথিক ইতিহাস এক অসম্ভব বৈচিত্র্যের জাদুঘর — কপিলের দাদু ও তার ব্রাত্য হয়ে রকে খিস্তির টোল তৈরি, উত্তরপাড়ার সাবর্ণ ভিলার খণ্ডহরে ন’কাকিমার স্মৃতিতে ক্রন্দনরত ন’কাকা, আহিরিটোলার ঘনান্ধকার রান্নাঘরে রান্না করতে-করতে প্রঅয়ান্ধ পিসিমা –এই সব আধা বিশ্বাসগামী চরিত্রের চলাচল এখানে । পড়তে-পড়তে মনে হয় স্যামুয়ের জনসন থেকে ভিক্টিরীয় যুগ পর্যন্ত ঘনায়মান পরিবারকেন্দ্রিক “panoramic novel”  ( এক ধরনের সমাজ ও সামাজিক গোষ্ঠীকেন্দ্রিক উপন্যাস )-এর কাঠামোকে তছনছ করে দিয়েছেন লেখক । বাংলা-বিহার মিলিয়ে জাতি-ধর্মের এক হাইব্রিড বুনোটে মলয়ের বেড়ে-ওঠা দেখতে পাই আমরা ; দেকি তাঁর ইন্দ্রিয়াদির উন্মেষ, নারীর প্রতি উদগ্রতার শারীরিকতার প্রকাশ । অনিশ্চিত যার জন্ম-ইতিহাস , সেই মেজদা বা বুড়োর বাড়িতে বেবুশ্যে মাগি আনা, হাত থেকে খিল পড়ে গিয়ে শব্দে ধরা পড়ে যাওয়া, মুন্সিজি-পত্নীর নগ্ন “সুডৌল গ্র্যানিট দেহ” আর দোলের রঙ মাখানোর মোচ্ছবের মধ্যেও শোনা যায় “মাসিক” হল “ম্যাজিক” শব্দের বঙ্গীয়করণ — ছোটোবেলাকার এক-দু গাছা বিধিনিষেধ । সংকরায়ণ কিন্তু আনপ্রহিবিটেড, অবশ্যম্ভাবী । তাই তো বন্ধনীমুক্ত হয় — ” এ হো ! কা হো ! আইভ্যান হো !

 

 

 

 

নখদন্ত

 

 

আমার পাঠের অনুক্রমে বছর পাঁচেক ফিরে গিয়ে ‘আওয়া ৪৯’ এর মে ২০০২ সংখ্যায় প্রকাসিত উপন্যাস ‘নখদন্ত : একটি পোস্টমডার্ন সাতকাহন’–এর দিকে নজর দি । শিরোনাম পড়ে আমার প্রাক-মলয় পর্বের গদ্য ধেকে একটা কথা মনে পড়ে গেল — “লোমচোখ”, যা তাড়া করে, ঠিক যেমন মলয় তাড়া করেন আমায় । ‘নখদন্ত’ আদ্যান্ত পোস্টমডার্ন আঙ্গিকে লেখা একটি সেল্ফ রিফ্লেকসিভ উপন্যাস, যেকানে রামায়ণের সাত কাণ্ডের নামে নামাঙ্কিত সাতটি দিনের ঘটনা হল ফ্রেম স্টোরি । এখানে পাওয়া যায় লেখক মলয় রায়চৌধুরীর ব্যক্তিগত ডায়েরি যেখানে তাঁর দাঁত মাজা, ওষুধ খাওয়া আর কমোদ পরিষ্কারে অযথা বিলম্বের পাশেই স্‌আন পায় তাঁর কাইনির নির্মাণসূত্র । লখনউতে মমতা অবস্হির আত্মহতভার খবর আর প্রতিবেশী সাধনবাবুর মৃত্যু একই বন্ধনী তৈরি করে, যার ভিতর থেকে উঠে আসে এক-এক করে পাঁচটি গল্প— “শেষ হাসি”, “শহীদ”, “জিরোনাম্বার মানুষ”, “ভাগ্য লিখনে হরফের দরকার নেই ” এবং “অট্টহাস্য অবিনির্মাণ” । এই পাঁচটি গল্প মলয়ের অথরিয়াল ফ্রেম ন্যারেটিভে বাঁধা, বাঁধা মৃত্যু আর হাসিতেও ।  আলাদা-আলাদা পত্রিকার জন্য লেখা এই গল্পগুলোর মধ্যে “অর্গানিক লিঙ্ক” আছে । একক ব্যক্তির ইতিহাস একানে নাযির যোগ । ধনতান্ত্রিক সমাজে মানুষের পণ্যায়ণ অদ্ভূত ভাবে প্যাসিভ এক ব্ল্যাক হিউমারে দেখিবে গেছেন মলয় । প্রথম গল্পে এলিজাবেথ জুটমিলের [ যেন এক নয়া ঔপনিবেশিক পরিসর ] মজুর কাঙ্গাল চামারকে পুলিশ যৌন অত্যাচারের মধ্য দিয়ে নিকেষ করে, তখন তার মুখের ঐ উদ্ভট হাসি দিবে শুরু হয় এই সিরিজ । ইংরেজদের আগে পাট আর জুটের চাষ, উপনিবেশে আর উত্তরউপনিবেশে পাটকল, জুটমিল, সেখানে ইউনিয়নের দলাদলি, মজুরদের আত্মহত্যা, কলের রেজিস্টারে নাম না থাকা “জিরো নাম্বার শ্রমিক”— এইসব নিবেই মলয়ের আন্ধার পোলিটিকাল কনটেন্ট । উপস্হাপনা ও বিবরণ যত তীক্ষ্ণ, ততই নির্ভার ও আবেগহীন । মলয় ঠিক ট্যাজেডি লিখতে চাননি । পাতাজোড়া বন্ধ কারখানা ও আত্ম্ত্যা-করা শ্রমিকদের নামের তালিকা, চটকলগুলোতে স্বাধীনতার আগে-পরে মালিকানার হাতবদলের পাতার পর পাতা লিস্টি— সংখ্যা এবং তথ্য এখানে স্বয়ম্ভর ; রেফারেন্সিং রাজনৈতিক রিপোর্টের আবহ তৈরি করেছে । কাঙ্গাল চামারের পোঁদে গোঁজা রদ থেকে গান ভেসে এসেছে– “জোর কা ঝটকা ধিরে সে লগে” । রাজপুত কন্সটেবলের মৃত্যুতে অভিযুক্ত কাঙ্গাল চামার হাপিশ হয়ে যায় । পরের গল্পে ঐ একই জুটমিলের পে ক্লাকফ সত্য আচাজ্জির আত্মহত্যা এক স্বঘোষিত শহীদত্বের বাচন । শহীদত্ব কি স্বয়ম্ভর ? নাকি শহীদ হতে গেলে নির্ভর করতে হয় অপরের ওপর ? তারপর আসে থার্ড সিরিজ— কাঙ্গাল চামারের পরিবর্তে দুই অস্তিত্বহীন “জিরো নাম্বার ওয়ার্কার” খালেদালি মণ্ডল ও বৈকুন্ঠ সুর । সিমাহিন দারিদ্র, ক্ষুধা, শেষে ভিক্ষার কলকাতায় খালেদালি মণ্ডলের মৃত্যু । তাও যেন শান্তি নেই । মর্গ থেকে দেহের অদলবদল —খালেদালির জায়গায় হিন্দু শরীর — দিবাকর যুগি । ডেডবডির ধর্ম নিরুপণে মলয়ের জিরো নাম্বার ভারতবর্ষে এ যেন নিকেষ ও হাপিশে এক চৈত্র সেল — “খালেদালি মণ্ডলের দেহ গেল কোথায় স্যার ? এই দিবাকর যুগি লোকটার দেহ আর আইডেনটিটি দুই-ই আছে । কলকাতার মর্গে যে লোকটার দেহ আছে তার কিন্তু আইডেনটিটি নেই । আর খালেদালি মন্ডলের দেহও নেই আইডেনটিটিও নেই । জিরো ? অ্যাঁ ?”

 

ফোর্থ সিরিজ খালেদালির ছেলে আমিনুলের চাকরির খোঁজে কলকাতায় আসা । মাথায় টাইপরাইটার চড়ানো বেকার যুবকদের ভাগ্য পরীকআ মলয়ের চোখা বিদ্রূপ, যা প্রতীকী সংবাদ ও কথপোকথনে সমসময়ের এক সিরিওকমিক ছায়া হয়ে যায় । টাইপ রাইটারবাহীরা গেয়ে ওঠে —“হুমহ না ভাই হুমহু না” —  ( সলিল চৌধুরীর সুরে হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের গাওয়া সুকান্ত ভট্টাচার্যের ‘রানার’ কবিতাটির প্রয়োগ ) । “খপোধ বাড়ে” “রোদ বাড়ে” “ক্লান্তি বাড়ে” আর তারই সঙ্গে লাইনও ।

 

শেষ গল্পে কাঙ্গাল চামারের মরণোত্তর হাসি মিশে যায় শহরের পার্কে সক্কাল বেলায় আমলাদের লাফিং প্র্যাকটিসের সাথে । দেখতে থাকে অর্ণব । বৃষ্টিভেজা ঐ সকালে গোগ্রাসে পড়ে ফ্যালে স্বাধীনতা দিবস অনুষ্ঠানে বিভ্রাটের খবর । পতাকা উত্তোলনের সময়ে পতাকাটি না খুলে দণ্ডের ওপর থেকে পুঁটলিসহ মুখ্যমন্ত্রীর পায়ের সামনে এসে পড়ে । অনুষ্ঠান অবশ্য চলতে থাকে । পরে জানা যায় পাটের দড়ি দিয়ে কাঠের কপিকলে বাঁধাতেই এই বিপত্তি । স্বাধীনতার ঐ পতাকাহীন দণ্ড কাঙ্গাল চামারের যৌনাঙ্গ হয়ে ওঠে, যার বীর্য ও রক্তে চকমক করছিল পুলিশের বুট । পতাকাহীন ঐ দণ্ড সহাস্য ক্যাসট্রেশানের প্রতীক হয়ে ওঠে । এই হল মলয়ের উত্তরঔপনিবেশিক ভারতবর্ষ যেখানে দেশভাগের মানদণ্ড বলতে বোঝায় নুনুর খোসা— ছাড়ানো, অথবা না-ছাড়ানো । তাই কথনের কিনারায় আবার শোনা যায় প্রপাত-সংকেতের মত ঐ হাসি, ঠিক যেন বাখতিনীয় কার্নিভাল লাফটার ( রুশ দার্শনিক মিখাইল বাখতিন হাসিকে বিপ্লবী রদবদল ঘটানোর হাতিয়ার মনে করেন ), যা নিতান্তই অশান্তিকামী ও রাজনৈতিক ।

 

“নখদন্ত”-র ফ্রেম ন্যারেটিভে লেকক-প্রতিস্বের এক অনর্গল নিমফাণ চকলতে থাকে । মলয় কী বই পড়ছেন, কী করছেন, কী দেখচেন —কোন যাপন ও পাঠ অভিজ্ঞতা থেকে আদল পাচ্ছে তাঁর কাহিনিরা— এসব যেমন  আছে, তেমনই আছে প্ররোচনামূলক নানা বভক্তিগত পোলেমিক । শঙ্খ ঘোষ থেকে সন্দীপন চট্তোপাধ্যায়— এসট্যাবলিশমেন্ট ও আপোষের প্রতি তীব্র শ্লেষ । উল্লেখযোগ্য ফ্রেম স্টোরি জুড়ে “Notes” নামক অংশগুলি, যেকানে বাংলা ্রফে ইংরাজি ভাষায় নানা অ্যাফরিজম পাওয়া যায় । ট্রান্সলিটারেশন পাঠ অভিজ্ঞতাকে মোচড় দেয় । যৌক্তিক সামান্যিকৃন প্রক্রিয়ায় লেকক এক বিমূর্ত এবং প্রাব দার্শনিক স্পেস তৈরি করেন উপনভাসটির ভিতর, উদাহরণস্বরূপ — ” নাথিং ইজ টু মিন ফর ইম্যাজিনেশন অ্যাজ নাথিং অন আর্থ ইজ ইনসিগনিফিক্যান্ট” । উপন্যাসটিতে মলয় নিজেই “ঋদ্ধ” আর “মুগ্ধ” হওয়ার মধ্যে ফারাক করেন । মলয় মুগ্ধ নয়, ঋদ্ধ হতে চান । আর আমরা ?

 

 

 

অরূপ তোমার এঁটোকাঁটা

 

 

আমি যখন মলয় রায়চৌধুরীর উপন্যাস পড়িনি তখনও আমি মলয়কে আর মলয় আমাকে পড়ছিলাম । পড়েই যাচ্ছিলাম । ‘ডুবজলে যেটুকু প্রশ্বাস’  পড়তে গিয়ে নোট পরীক্ষক অতনুকে দেখলাম পচাছেঁড়া নোটের ধড়পাকড়ের ভিতর বসে বসে পোড়া নোটের গন্ধকে মানুষের পোড়া মাংসের সঙ্গে মিলিয়ে দিতে, আমার মনে পড়ল বছর দুয়েক আগে লিখতে শুরু করা এযাবৎ অসম্পূর্ণ আমার উপন্যাসের প্রথম দুটি লাইন — ” মৃত্যুর মত দশ টাকার কয়েন । মৃত্যুর যত দশ টাকার কয়েন ।”

 

‘এই অধম ওই অধম’ পেরিয়ে মলয়ের ট্রিলজিতে হাত দিয়েছি, একদিন পড়ন্ত বিকেলে সোমানাথদার ( সম্পাদক : অপর ) টেলিফোন ও এই লেখার অবতারণা । তারপর ফেসবুকে মলয়দার সাথে কথা, ই-মেল চালাচালি । তাঁর ও তাঁর দাদা সমীর রায়চৌধুরীর সাহায্যে কলেজ স্ট্রিটের আনাচে-কানাচে হাতে-হাতে হাতেনাতে পাওয়া মলয়দার উপন্যাস, গল্প ও প্রবন্ধমূলক গদ্য ।

 

সবই মলয়ের কথামত । যেমন ‘হাওয়া-৪৯’কে দেওয়া ইনটারভিউতে তিনি বলেন— ” আমার বই তো গাদাগাদা বিক্রি হয় না, কোনো ফিক্সড পাবলিশারও নেই । পড়তে হলে বইটা খুঁজে খুঁজে জোগাড় করতে হয় ; অর্থাৎ , আমার বই যিনি পড়েন বাধ্য হয়েই পড়েন, পড়তেই হয় বলে পড়েন ।” আমিও তেমনই এক শ্রমিক-পাঠক । অন্বেষণের কায়িকতায় পাঠ প্রক্রিয়ার সম্প্রসারণ ও বিয়োজন দুইই ঘটে । খোঁজা ও পড়ার এই গল্পে উত্তরপাড়া শহরতলির সহস্মৃতি শেয়ার করি আমরা দু’জন । এই স্হানিক এককত্ব মলয়ের আখ্যানে এক কূটাভাস হয়ে দেখা দেয় যখন ইমলিতলার অন্ত্যজ পাড়ার জন্মস্হান বা উত্তরপাড়ার সাবর্ণ রায়চৌধুরীর বিলীয়মান ঐশ্বর্য — এইসব গম্বুজ পাশ কাটিয়ে মলয়ের কাহিনীগুলি ধারণ করতে থাকে অন্তর্দেশীয় প্রবাসের এক নব্য-বাঙালিয়ানাকে, যা দোআঁশলা, বহুভাষিক, বহু-সাংস্কৃতিক ও অধুনান্তিক সমাজ ভাবনার্ দোসর । এই সব শাখা-প্রশাখা থেকে ফিরে তাকালে শিকড়ের গম্বুজস্বরূপ ইমলিতলা বা উত্তরপাড়ায় এন অনাবিল তরলতা তৈরি হয় । মলয়ের আখ্যান এই ” Space of Flows” [ পরিসর যখন সদা ধাবমান, একক অবস্হান নয় ] এর স্মৃতিবাহী ।

 

শ্রমসাধ্য প্রাপ্তি দিয়েই শুরু করি । ‘বিষয়মুখ’ পত্রিকার ২০০৭ জুলাই –  ডিসেম্বর সংখ্যায় প্রকাশিত উপন্যাস ‘অরূপ তোমার এঁটোকাঁটা’ পড়তে-পড়তে যে পেনসিল দিয়ে মার্ক করছিলাম, দেখলাম সেটার শিষটা ভাঙা । তারপর ঐ এঁটোকাঁটা শিষ দিয়েই মার্ক করা শুরু করলাম । এই ‘এঁটোকাঁটা’ মধ্যবিত্ত ভেতো বাঙালির মুখোশ-উচ্ছিষ্ট যেন । উৎকৃষ্ট এবং উৎ-সৃষ্ট । পিতামহ-মাতামহের গুপ্ত যৌনজীবনের এঁটোকাঁটা । প্রয়াত দাদুর চিঠি-চাপাটি দিয়ে শুরু এই খনন । টেক্সট যেন এক খননায়ন  — চোরাগোপ্তা খুলামকুচি আমদানি করে । সাধু বাংলায় লেখা অতীতের হলুদ ন্যারেটিভ জাক্সটাপোজড হয় প্রজন্মান্তরের ই-মেল বা চ্যাট-এর সঙ্গে । কাহিনির প্রবাহ বেনারসে, শিকড় বর্ধমানে । ইন্দিরা ব্যানার্জির প্রয়াত দাদু অতুল মুখোপাধ্যায় বা “অতুল মূর্খ”র বন্ধু শিশির দত্তর লেখা যে ন্যারেটিভ মলয়ের উপন্যাসের মেরুদণ্ড, তা এক জটিল বহুকথন সম্বলিত প্যালিম্পসেস্ট । শিশির দত্তর সাধু বাংলার ওপর পাঠিকা তথা কাইনির অন্যতম প্রধান চরিত্র কল্যাণী/কেকা বউদির ন্যারেটোরিয়াল প্রেজেন্স । তার ওপর আবার নির্মলবাবুর ( অতুলের বন্ধু ) বাবা, যার ডায়েরিতে শিশির লিখেছিলেন এই কাহিনি, তাঁর প্রফেসোরিয়াল নোটস — লেককের বিমূর্ত ও তাত্ত্বিক পরিসর ; এই ত্রিস্তরিত আখ্যানের সমান্তরাল চলে লিখন আর পাঠ । শিশির পড়েন বন্ধুর বাবা তথা প্রফেসরের সমাজভাবনার র‌্যানডাম নোটস, আর তারই ওপর লিখে ফ্যালেন নিজের বৈদেশিক যৌন কাহিনি । অন্যদিকে কেকা বউদি, যিনি নিঃসন্দেহে মলয়ের উপন্যাসের র‌্যাডিকাল নায়িকা, তিনিও তো শিশির কাহিনির পাঠিকাই । তবে শিশিরের মতন তিনিও লেখা ও পাঠ দুই করে থাকেন । শিশিরের কাহিনিকে ক্রমাগত আন্ডারকাট করতে থাকে কেকা-কথনের বলনকলা ।

 

ইমপোটেন্ট ও বধুনির্যাতনকারী প্রসন্নকান্তির বিদ্রোহিনী স্ত্রী কল্যাণী পাড়ার ছেলে অতুলের সাথে বেনারস পালিয়ে আসেন । সেখানে অতুল আর কল্যাণী তথা নামান্তরে কেকা শুরু করে গাঁজাচরস আফিমের ব্যবসা — “দ্রুত ধনী হবার ব্যধি” । বেনারসের মন্দির চত্ত্বরে কালো গ্র্যানাইটের ফ্যালিক এক লিঙ্গ প্রতিষ্ঠা করে কেকা । কিন্তু ক্রমশই অতুলের কাছে কেকার শরীর আকর্ষণ হারায় আর অতুল লিপ্ত হয় অন্য-অন্যান্য নারীশরীরের সাথে । মার্কিনী জোসেফিনের সঙ্গে শয্যা আমদানি করে হাইব্রিড এক শিশুপুত্র ‘কং’ । ‘কং’কে প্রতিপালনের দায় পড়ে কেকার ওপর । জোসেফিন তখন উধাও । শিশিরের কাহিনির সিংহভাগ জুড়ে থাকে কেকার ভাষায় “কভাবলা কামুক”টার সাথে ভাইকিং রমণী ম্যাডেলিন ক্যরিয়েটের সঙ্গম-লীলা । সাধু ভাষার মোচড়ে বলা এই যৌন আখ্যান পর্নোগ্রাফি আর এসক্যাটোলজির মধ্যিখানে থেকে যায় । কখনও তা প্লেজার দেয়, কখনও কুন্দেরায়েস্ক এক বিষাদ । এক অতলান্ত অনুভব । অ্যাটলান্টিকের এপার থেকে ওপার— সংকরায়ণের গন্ধ এই শরীরময় এঁটোকাঁটায় । মলয়ের বর্ণনাগুণে এই ইনটারকোর্স মিস্টিক এক রিচুয়ালে পরিণত হয় — “অগরু” এবং “কান্তা” নামে ছয়টি করে শিশির তরল প্রলেপ সূর্যাস্তের পর ফোরপ্লের ফোরগ্রাউন্ড তৈরি করে । শিশিরের এই ‘বিদকুটে’ সাধু বাংলা কি তবে রক্ষণশীল এক ভাষা-পদক্ষেপ, যেমনটা কেকা বলে — “আর লিখলি তো লিখলি এই বিদকুটে বাংলায় কেন ? সোজা বাংলায় লিখতে গেলে নোংরা করে ফেলতিস ?” শিশির তথা ‘শিশু’ আর ম্যাডেলিন তথা ‘ম্যাডি’র শরীর যেন ভাইকিং রাজগৌরবের এক ঐতিহাসিক যুদ্ধক্ষেত্র ।  স্ক্যান্ডিনেভিয় নৌযোদ্ধাগণের বংশজ অতিকায় ম্যাডেলিন ও শিশিরের এই সঙ্গমে নারী সরীর প্যাট্রিয়ার্কাল গেজের নিষ্প্রাণ পাঠবস্তু নয় । তা এক ঋদ্ধ ইতিহাসমুখরিত চিহ্ণ, যা তেরছা করে দ্যায় যৌনতার পুংশাসিত কাঠামোকে । পুরুষ হেথায় নারীর বশিকৃত ক্যাবলা-কামুক মাত্র । ম্যাডেলিন চলে যাবার পর চাবুক আসে কেকাবউদির হাতে, যখন তিনি সিডিউস করেন শিশিরকে । বিদেশি গান বদলে যায় বৈজয়ন্তীমালার “হোঁটোপে অ্যাইসি বাত”-এ । এই সিক্রেটই কেকার সম্পদ — ” আমার গায়ের রঙ আহ্লাদী পুতুল ম্যাডেলিনের মতন নয়, তাতে কী । আমি এমন অপ্সরা যার মুঠোব আছে শকুনির পাশা । মুকখু চাষা শিশির কিছুই আঁচ করতে পারেনি । ম্যাডেলিনের শেখানো এলকুমি-বেলকুমিই পুঁজি ।”

 

কেকার অভিসন্ধিতে শিশির এক অনুঘটক মাত্র । শিসির-কেকার শয্যা থেকে উঠে আসে ‘বং’ । কেকা হন কং-বং-এর মা — “অতুল আমার কোলে ওর বাচ্চা কংকে ধরিয়েছে । আমি ওর কোলে শিশিরের বাচ্চা বংকে ধরাব ” এই ধরাধরির গুপ্ত পারিবারিক ইতিহাস ছুঁয়ে যায় বারানসীর সাংস্কৃতিক ইতিহাস– অবাধ ফ্যাগের সন্মোহন থেকে বজরং দলের উপস্হিতি যারা তুকটাক চুমুকেও আস্ত রাখেনি । এই আখ্যান শেষ হয় অতুলের নাতনি ইন্দিরা ও শিশিরপুত্র সুবীরের প্রণয়-পরিণয় দিয়ে । তারা গুপ্ত ইতিহাস সম্বলিত ডায়েরিটিকে চুপচাপ স্বস্হানে রেখে দেওয়াই সাব্যস্ত করে । টেক্সটের অপেক্ষা শুরু হয় আবার পাঠ ও লিখন বৃত্তের ভিতর ঢুকে পড়ার জন্য । শিশির জানে সে মোহরা । কেকার ।  কেকা অতুলের মৃত্যুতে কাঙালিভোজন করিয়ে মাদার ইন্ডিয়া সাজে । মলয়ের উপন্যাসে যৌনতা অস্তিত্ব তথা আইডেনটিটিরই বিনির্মাণ ঘটায় । শিশির-কেকারা বুঝতে পারে কত-কত আরও কত-কত শিশির-কেকাদের তারা তাদের শরীর-মন আর অস্তিত্বে পুষছে । লেখক মলয় তার ডিসকার্সিভ স্পেস তৈরি করেন নির্মলের অধ্যাপক পিতার ‘জ্ঞানবাক্যের’ পরিসরে । তাঁর ডায়েরিতেই তো লেখে শিশির । তাঁর সফল দার্শনিক অ্যাফোরিজম এক সমান্তরাল প্রাতর্কিক পরিসর নির্মাণ করে — এক প্রফেটিক স্পেস যার বয়ানে বাঙালির দোআঁশলা আধুনিকতায় এক উনিশ শতকীয় অ্যনাক্রনিস্টিক অধুনান্তিকতার রিপোর্ট পাওয়া যায় । সেখানে উঠে আসে উত্তর-উপোনিবেশের অনুসঙ্গ, ভালো-মন্দের নৈতিক বিচার ও সর্বোপরি এই ‘আমি’র আবরণ— “আমি নামক নিবাসটি যে যাবতীয় সমস্যার আগার । তাকে সংজ্ঞায়িত করা অসম্ভব । কতরকম আমি যে আছে— সবই অনির্ণেয়, তার ইয়ত্তা নেই । পার্শ্বচরিত্র নির্মলের প্রয়াত পিতা যেন ‘অরূপ তোমার এঁটোকাঁটা’র অধুনান্তিক ডেড অথর — স্বয়ং মলয় রায়চৌধুরী । শিষ বড্ডো ছোটো হয়ে গেছে, পড়াও শেষ । শিশির আর কেকার মত আমিও পড়লাম আর লিখলাম ।

 

 

 

 

 

উৎপলকুমার বসু : মলয় রায়চৌধুরী সম্পর্কে কয়েকটি কথা

mOvjMLAb4HvT

মলয় রায়চৌধুরী এখনকার বাংলা সাহিত্যে একটি বিশিষ্ট নাম ।

 

তিনি ছয়ের দশকে লিখতে শুরু করেন এবং এখনও লিখছেন । তাঁর কবিতা, গদ্য প্রবন্ধ, সাক্ষাৎকার, ইস্তাহার ও পোলেমিক্স এর সমগ্র সংগ্রহ প্রকাশিত হলে একটি প্রয়োজনীয় কাজ হবে বলে আমার ধারণা ।

 

তিনি সাহিত্যিক নন । অর্থাৎ ‘সাহিত্যের সেবক’ বললে আমাদের স্মরণে যে-ছবিটি ভেসে ওঠে, তাঁকে সেই শ্রেণীতে ফেলা যাবে না । বাংলা সাহিত্য তাঁর হাতে যতটা না পূজিত হয়েছে— আক্রন্ত হয়েছে তার চেয়ে অনেক বেশি ।

 

গত চল্লিশ বছরে, বাংলা সাহিত্যের রণক্ষেত্রে যা যা ঘটেছে, তা লিপিবদ্ধ করার যোগ্যতা বা ধৈর্য আমার নেই । তবে, সংক্ষেপে এটুকু বলা যায় যে মলয় রায়চৌধুরী অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত হয়েই যুদ্ধে নেমেছিলেন । তাঁর তাত্বিক প্রস্তুতি ছিল । এবং তথাকথিত বাংলা ‘সংস্কৃতি’-র ঘরে তাঁর লালন পালন নয় বলে ওই কালচারের পীঠভূমিগুলিকে অবজ্ঞা করার মতো দুঃসাহস তিনি দেখিয়েছেন ।

 

বাংলা আধুনিক কবিতার প্রসঙ্গটি নিয়ে যদি ভাবা যায়, তবে দেখব, জীবনানন্দই সেই অঞ্চলের প্রধান পুরুষ । তাঁকে পেছনে ফেলে এগিয়া না-গেলে পরবর্তী একটা নতুন যুগের পত্তন হওয়া সম্ভব ছিল না । জীবনানন্দ কয়েকটি উপাদানকেঅবলম্বন করেছিলেন । যেমন অভিনব ইমেজ বা চিত্রকল্পেরব্যবহার, মহাজাগতিক সচেতনতা, মানুষের উদ্যম ও প্রচেষ্টার প্রতি তীব্র অবজ্ঞা এবং সংশ্লিষ্ট আরও কয়েকটি গৌণ বিষয় । মলয় রায়চৌধুরী ও তাঁর প্রজন্মের লেখকদের ওই পাঠশালাতেই হাতে খড়ি হয়েছিল । কিন্তু অল্প কিছুদিনের মধ্যেই তাঁদের অন্য ধরণের পথসন্ধান শুরু হয় ।

 

বাংলা সাহিত্যের প্রধান ধারাটি একপ্রকার স্হিতাবস্হায় পৌঁছে গিয়েছিল । তার বাঁধ ভেঙে দেওয়া ছাড়া উপায় ছিল না । তিনটি উপন্যাস ও স্মৃতিচারণেও মলয় রায়চৌধুরীর ওই আক্রমণকারী প্রবণতা লক্ষ করি । কথাপ্রসঙ্গে তিনি একবার বলেছিলেন—‘লেখা রাজনীতি ছাড়া আর কী হতে পারে’।

 

বলা বাহুল্য, তিনি দলীয় বা সংসদীয় রাজনীতির কথা বলেননি । তিনি বলেছেন ‘পলিটি’-র কথা । আমরা সবাই মিলে কীভাবে থাকব—মলয় রায়চৌধুরী তারই একটা বোঝাপড়ার দলিল তৈরি করেছেন ।

 

(হাওয়া-৪৯ পত্রিকার বৈশাখ ১৪০৮ বা এপ্রিল ২০০১ সংখ্যা থেকে পুনর্মুদ্রিত )

 

সুবোধ সরকার : মলয় রায়চৌধুরী হলেন কিছুটা মস্তান, কিন্তু ঋষি

500277_orig

আন্দোলন করতে লোক লাগে । পত্রিকা লাগে । চাঁদা তুলতে হয় । টাকা লাগে । কিন্তু যিনি লেখেন, তাঁর কিছু লাগে না । তাঁর লাগে একটা কলম, সাদা কাগজ, আর এক বাটি আগুন — যেটা তাঁর মাধায় থাকে । যাঁরা দেখতে পান, তাঁরা দেখেন, লেখকের মাথা থেকে চুলের ভিতর দিয়ে মাঘ নিশীথের ধোঁয়া বেরিয়ে আসছে ।

বাংলা কবিতায় আন্দোলন হয়েছে, কিন্তু তেমন কোনও কাজে লাগেনি । গত পঞ্চাশ বছরে সবচেয়ে বড়ো আন্দোলনের নাম ‘হাংরি’ । ‘টাইম’ ম্যাগাজিনে  তার কাহিনি ছাপা হয়েছিল, আবার এদিকে উচ্চ আদালতে উঠেছিল । এত বড় সৌভাগ্য আর কোনো সাহিত্য আন্দোলন উদযাপন করতে পারেনি ।

সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় একটা চিঠি লিখছেন আয়ওয়া থেকে সমীর রায়চৌধুরীকে ।

আমেরিকার ‘বিট আন্দোলন’ ১৯৬৪ সালের মধ্যে শেষ হয়ে গিয়েছে — সেটাই জানাচ্ছেন সুনীল । তিনি লিখছেন, ‘বিট আন্দোলন সম্পূর্ণ ভেঙে গেছে  — সবাই বিচ্ছিন্ন, অনেকের সঙ্গে অনেকের ঝগড়া । একমাত্র অ্যালেনই আনকমপ্রোমাইজিং এখনও । বিট আন্দোলন মরে ভুত হয়ে গেছে — এখন ওর নকল আন্দোলন আমাদের ভারতবর্ষে আরম্ভ হওয়া স্বাভাবিক । আমি আয়ওয়া ছাড়ছি ১০/১২ তারিখ । তারপর কিছুদিন নিউ ইয়র্ক । তারপর মার্গারিটের সঙ্গে দেখা করব প্যারিসে । তারপর যদি পয়সা থাকে লণ্ডন ও রোমে দু’চারদিন ।’

‘গোখরোর আন্দোলিত উহুরু’ নামে একটি গদ্যে মলয় রায়চৌধুরী চুরমার করে ছেড়ে দেওয়া একটি মন্তব্য করেছিলেন — ‘কবিতা হল আস্তিনের ভেতর থেকে ঝলসানো বাহুর সিগনালিঙ । কবিতার বিষয়বস্তু এখন আমি । আমিই সিসমোগ্রাফ, আমিই ভূমিকম্প, আমিই ভাঙাচোরা খেতখামার।’ এই কথা যিনি লিখতে পারেন, তিনি কবি নন, তিনি ‘ঋষি’ । কিছুটা হাত গোটানো, কিছুটা মস্তান, কিন্তু তিনি ঋষি এবং একজন হাংরি । এই মহৎ কথাগুলো বলে ফেলে মলয় কি হাংরি আন্দোলনের কফিনে শেষ পেরেকটি মেরে দিলেন ? কেননা তিনি নিজেই বলছেন, ‘আমি মনে করি ১৯৬৫ সনে যেদিন পুলিশ আমাকে চার্জশিটের সঙ্গে শৈলেশ্বর, সুভাষ প্রভৃতির মুচলেকা দেয়, সেদিনই হাংরি আন্দোলন ভেঙে যায় ।’ কী আশ্চর্য ! সুনীল লিখছেন এক বছর আগে আয়ওয়া থেকে, বিট আন্দোলন মরে ভুত হয়ে গিয়েছে । আর মলয় বলছেন হাংরি শেষ হয়ে গেল।

সেই সময়, ১৯৬৪, মির্জাপুর স্ট্রিট থেকে একটি কুশ্রী লিফলেট ছাড়া হয় বাজারে, তার রচয়িতা ও প্রকাসক ছিলেন পাঁচের দশকের পাঁচটি ( তিনটিও বলা যায় ) শ্রেষ্ঠ ভূকম্পনের একটি — ‘ফিরে এসো চাকার’ কবি বিনয় মজুমদার ।

কী লেখা হয়েছিল লিফলেটে ? একটি অংশ তুলে দিই :

‘শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের অনিপুণ নপুংসকরূপ আশা করি এ যাবৎ পাঠাকপাঠিকা স্বচক্ষে দেখার সুযোগ পাননি । — কবিটির জন্ম কি কুকুর আর গাধার সঙ্গমজাত ফল ?…রেকটাম বিট করে দিয়েচি বলেই এইসব কেঁচোবৃন্দ বীটনিক নাম নিয়েছিল।’

একজন বৃহৎ কবি আরেকজন বৃহৎ কবিকে এত খারাপ ভাষায় আক্রমণ করতে পারেন, আগে জানা ছিল না । তবে কে কাকে আক্রমণ করছেন, সেটা আমার বিষয় নয় । কবিরাই তো কবিদের সবচেয়ে খারাপ ভাষায় আক্রমণ করে এসেছেন সারা পৃথিবীতে । কবিরাই কবিদের সহ্য করতে পারেন না, কবিরাই আবার অন্যদের বলেন অসহিষ্ণু, গভীরে নেমে খোঁজ করলেই দেখা যাবে এসব ব্যক্তিগত কারণে । রাষ্ট্র, সমাজ, ধর্ম — ওগুলো সব আসলে ‘বাহানা’। মহম্মদ দারউইস বলেছিলেন : ‘তোমার কুৎসা ওরা করতই, এতদিন অপেক্ষা করছিল একটা রাষ্ট্রীয় সংকটের জন্য, সংকটের সময় একজন কবিকে পেটানো অনেক সহজ হয়ে যায়, সংকটের জন্য কে দায়ী, সেটা তৎক্ষণাৎ বিচার করা যায় না, কিন্তু অন্ধকার ঝোপে লাঠি চালানো যায় ।’

 

একটা আন্দোলন কি তুবড়ির মতো আকাশে উঠে, মাটিতে নামতে নামতেই ফুরিয়ে যায় ? একটা আন্দোলন কি ‘এক্সপায়ারি ডেট’-সমেত জন্ম লাভ করে ?আমি সাহিত্যের ইতিহাসের ছাত্র হিসাবে লক্ষ করেছি আকাশে উঠতে এবং আকাশ থেকে নামতে এবং ছাই হয়ে ভস্ম হয়ে মাটিতে ঝরে পড়তে গেলেও একটা যুগ লাগে । নিজেকে বিনাশ করে ভস্ম নিজেই ঝরে পড়ে মাটিতে, কিন্তু মাটির পোড়া অংশ তখন ইতিহাসের নবীন মাথা তুলে ধরে । সেটা ‘হাংরি’ যেমন করেছে, ‘শ্রুতি’ও করেছে । কিন্তু নাম হল ‘কৃত্তিবাস’-এর । নাম হয়েছে ‘কবিতা’র । এখানেই তো মজা ! ‘কবিতা’ কোনো ঘোষিত আন্দোলন করেনি । কিন্তু বুদ্ধদেব বসুর নেতৃত্বে ‘কবিতা’ হয়ে উঠল সবচেয়ে বড় ‘গেম চেঞ্জার’ । শত অপমানের ভিতর মাথা তুলে দাঁড়ালেন বরিশালের জীবনানন্দ দাশ । একাই হয়ে উঠলেন একটি জাতি । একাই হয়ে উঠলেন একটি ভাষা । একাই হয়ে উঠলেন একটি উপমহাদেশ ।

হাংরিদের সঙ্গে থেকে এবং নিজেকে আপৎকালীন অবস্হায় সরিয়ে নিয়ে সন্দীপন চট্টোপাধ্যায় লিখেছিলেন, ‘আমি বিশ্বাস করি একজন লেখক একাই তার মৌলিক ভাষাশৈলী নিয়ে একশো । সে নিজেই মানুষ, সভ্যতা এবং সমাজ বিপ্লবের স্হাবর নিদর্শন । কাজেই অনেকে মিলেজুলে ওভাবে হয় না ।’

অনেকে মিলে ফুটবল খেলতে হয়, মৃগয়ায় যেতে হয়, পাহাড় কাটতে হয়, কিন্তু ভাষা তৈরি করার সময় কেউ পাশে থাকেন না , তখন একজন লেখক একা এবং নিষ্ঠুর, তিনি জানেন তাঁকে বিরাট পাহাড়ের ভিতর নিজের গাঁইতি চালিয়ে একটা গুহা বানাতে হবে ।

গুহাগাত্রে প্রতিটি বাক্যের শেষে যেন তাঁর সই থাকে ।

আমরা জানি প্রতিটি বাক্যের শেষে কোনও লেখক সই করেন না, কিন্তু সই থেকে যায় ।

[ প্রতিদিন ( ছুটি ) পত্রিকায় ১৪ই মে ২০১৭ তারিখে প্রকাশিত ]

ঝুমা চট্টোপাধ্যায় : মলয় রায়চৌধুরীর উপন্যাস ‘ঔরস’

19554140_1033072013496675_2734288792742018078_n

 

মলয় রায়চৌধুরীর সঙ্গে কোনোদিন আমার মুখোমুখি সাক্ষাৎ হয়নি। মাঝ দুপুর বা ঝিঁঝিঁ পোকা সন্ধ্যেয় পুরনো খবরের কাগজের কোণায় মুড়ে সেই অতিরিক্ত ঝাল আর গুড় তেল দেওয়া লংকা-আমের আচার টুকু আর টুকলির মা, ব্যস এই অসামান্য জিনিষদুটোর মুখোমুখি হলেই চিরকাল যার পর নাই খুশী হতাম কিন্তু আশি সালের পর যারা বাংলাদেশ থেকে এসেছিল বরাবর তারা সেল( স্টীল অথারিটি অব ইন্ডিয়া লিমিটেড)এর কোয়ার্টারে উন্নত বসবাস করবে এমনটা আশা করা ভুল, তাই ক’এক বছর পর টুকলি আর তার মা কোথায় চালান হয়ে গেল বলা মুশকিল, আর হ্যাঁ অবশ্যই মলয় রায়চৌধুরী যিনি হাংরী মুভমেন্টের কবি ,দেখেছেন লিখেছেন দিয়ারা , দ্বীপের মত চর, জেগে ওঠে, জল প্রবাহকে জড়িয়ে শুয়ে থাকে বছরের পর বছর…এবং সেই চরে বসবাসকারী অজস্র মানুষের সুখ শান্তি পাইপ-গান কাট্টা –তামাঞ্চা গাঁড়াসা ভোজালি এক নল্লা দু নল্লা একে সান তাল্লিশ। সেই সব প্রত্যক্ষদর্শীরা যারা চায়নি গঙ্গার বুকে চর জাগুক, পুরনো পলি জমে শক্ত হয়ে ক্রমে শুকনো ডাঙ্গা ও অগণিত মানুষের উদ্বিগ্ন ক্রম বিবর্তন, মলয় রায়চৌধুরী তাদের ক্ষোভ লালসা আঘাত প্রত্যুত্তর টু বি স্পেসিফিক, ‘ঔরস’ উপন্যাস দিয়ে আমাদের বুঝিয়েছেন দেখিয়েছেন ভুলিয়েছেন জাগিয়েছেন হয়ত কোথাও গোপনে কাঁদিয়েওছেন, যে কান্নাটা আমি বহু বছর আগে টুকলির মার জন্য কাঁদতে পারতাম। মলয়ের লেখা তবুও সব সময় পড়িনা, কারণ তা একলা একটা খন্ডে গিয়ে শেষমেষ যাবতীয় সুখ-শান্তির সমাপ্তি বা কোকিল ডাকা ভোরএ ঘুম ভাঙ্গিয়ে তুলবে না বলে।। শুধু যখন আর কিছু পড়া বা শোনা মাথায় অবিশ্রান্ত একঘেয়ে কামান দেগে দেগে ইনফরমেশনের পাহাড় গড়ে তোলে,ঠিক তখুনি ‘ছোটলোকের ছেলেবেলা’, ‘অরূপ তোমার এঁটোকাঁটা’ বা ‘ ডুবজলে যেটুকু প্রশ্বাস’ এক আধবার চোখ বুলিয়ে নিলেই যথেষ্ঠ। ‘ঔরস’ও তাই-ই, তবে একবারে হয়নি, পরপর তিন বার পড়ে ফেলতে হল। এক নিঃশ্বাসে দ্রুত,কারণ উপন্যাসটাও যেন ঐ এক নিঃশ্বাসে দ্রুত কয়ে যাওয়া। যার কথা ও সুর দুটোই মলয় রায়চৌধুরীর।

একজন রেগুলার পাঠক বলতে যা বোঝায় মলয় রায়চৌধুরীর তেমন পাঠক আমি না। কিন্তু ওনার অতীত বর্তমান ও ভবিষৎ পাঠক, তাদের আবেদন নিবেদন এবং সপ্রেম গোপন দীর্ঘশ্বাস, এবং তাঁর রচনাবলীর প্রকাশক সম্পাদক এবং বইএর পুনর্মুদ্রন, প্রাপ্তিস্থান এবং অল্প হলেও দ্রুত চোখ বুলিয়ে নেওয়া ‘মূল্য’ আমার নজরে থাকে, থেকেই যায়। আরও মন দিয়ে লক্ষ্য করি ওনার বইগুলির প্রচ্ছদের ভেতর দিকের প্রথম পাতা, যেখানে একদম নীচে ছোট ছোট হরফে ‘ এই লেখকের অন্যান্য বই’। ঔরস উপন্যাস পড়ার আগে ওনার পুরনো লেখাগুলো পড়েছিলাম, কোনও কোনও লেখা আবার দুবারও। অসংখ্য চরিত্র, তাদের হিজিবিজি উপস্থিতি,সংলাপ, বাদানুবাদ,আর্জি, দাবী-দাওয়া বকমবকম…

‘মাছ খাও না?’ জানতে চাইল ঢ্যাঙা যুবতী, জিনসের ঘাঘরা। ‘তুমি তো বাঙালী?’

আবোল তাবল মাংস আর শুঁটকি মাছের বোঁটকা ভয় অতনুর। বরং নিরামিষ খেয়ে চালিয়ে দেবে। যুবতীর কন্ঠস্বর কিছুটা ভাঙা ভাঙা, শোনেনি এর আগে। এত কাছাকাছি একজন যুবতীর সঙ্গে, একজন নয় দু-জন, সে কথা বলতে পারছে। ছি ছি মিথ্যে বলা উচিত হয়নি।

‘তুমি ফ্যামিলি আনতে পারতে’। বেঁটে মতন যুবতীর খোঁজ খবর।

‘বিয়ে করিনি এখনও।’ বিছানা থেকে নেমে, টেবিলে রাখা ফ্রায়েড রাইসে এক নজর লোভী চাউনি , বলল অতনু। এদের ইংরেজী সত্যি কত ভালো। নিজেরটায় বাঙালী টান, ভজকট।

‘ভালো কথা’ একসঙ্গে বলে উঠল দুজনে। একজন আর একজনের মাথায় আলতো চাঁটি মেরে, ‘গুড লাক’……  ( ডুবজলে যেটুকু প্রশ্বাস)

 

‘ মা জিগ্যেস করলেন, আচ্ছা আমায় বলো দিকিন বুড়ো ছেলেটা কার? বটঠাকুরের দু-দুটো মেয়ে থাকতে ও ছেলেটা কেন? ছেলেটা আসলে কার?’

কার মানে? তুমি তো জানোই দাদা বৌদি ওকে পুষ্যি নিয়েছিল।

সেটাই তো জানতে চাইছি। কেন পুষ্যি নিয়েছিলেন? ছেলেটা যে আমার বড় জার নয়, তা আমি জানি। সকলেই জানে।

কার ছেলে কি করে জানব? তোমার সামনেই তো দাদা পাঞ্জাবী বউটার কাছ থেকে দেড়শো টাকায় কিনেছিল বাচ্ছাটা।

আমার এতদিন সন্দেহ হয়নি। আজকে সন্দেহ হল বলেই জানতে চাইছি। বাচ্ছাটা কি তোমার দাদার? উনিই কি বুড়োর আসল বাবা?

তা কেন ? না বোধহয়। দাদার মত অমন দেবতুল্য মানুষ। …… ’’ ( ছোটলোকের ছোটবেলা)

 

কবি মলয় রায়চৌধুরী, ঔপন্যাসিক মলয় রায়চৌধুরী, প্রাবন্ধিক মলয় রায়চৌধুরী, নাট্যকার মলয় রায়চৌধুরী, গল্পকার মলয় রায়চৌধুরী, অনুবাদক মলয় রায়চৌধুরী, সমালোচক মলয় রায়চৌধুরী,সাক্ষাৎকারী মলয় রায়চৌধুরী, গ্রামোন্নয়ন-উপদেষ্টা মলয় রায়চৌধুরী,আবৃত্তিকার মলয় রায়চৌধুরী, ভাবুক মলয় রায়চৌধুরী, দার্শনিক মলয় রায়চৌধুরী, রান্নাশিল্পী মলয় রায়চৌধুরী যে ভাষায় যেমত শব্দবন্ধ ব্যবহার করে উপন্যাস লেখেন, ঔরস তার ব্যতিক্রম না। ভাষার মাধুকরী করেছেন, করতে হয়েছে, যে বুঝবে জানবে তিনি ক্রমে বড় হয়ে উঠেছিলেন যে মহল্লায় চারিদিকে তার কুর্মি দোসাদ ডোম চামার কামার মুসলমান এবং যাদব। কবিসৃষ্টি অপেক্ষা কবিকে জানিলে অধিকতর লাভ’’, লাভ আজও এই মুহুর্তে ছত্রিশ কোটি বাঙালির পুরুষানুক্রমে অতীত বর্তমান ও ভবিষ্যতের খতিয়ান, যে খতিয়ান মলয় দিয়ে গেছেন তাঁর প্রতিটি উপন্যাসে গল্পে কবিতায় প্রবন্ধে মনে মননে ফেস বুক পোস্টে, দিচ্ছেন, ভাবছেন ভাবাচ্ছেন আমরা কি বাঙালি? কি হলে বাঙালি হয়? কোথায় বাঙালির আইডেনটিটি বা পরিচয়। কার উত্তরসুরী আমরা? কবে বাঙালির বাঙালিত্ব শুরু? শেষ বলে কিছু আছে? নেই? কেন নেই? পশ্চিমবঙ্গের বাঙালি, বিহারের বাঙালি, গুজরাটের বাঙালি,ব্যাঙ্গালোরের বাঙালি,দন্ডকারণ্যের বাঙালি, কর্পোরেটের বাঙালি, যখন তখন যেখান সেখান থেকে তাড়া খাওয়া বাঙালি,ব্যবসাদার মাফিয়া ডন খুনী কেন্দুপাতার ডিলার বাঙালি, পার ভাঙা যেমন নদীর মুদ্রাদোষ, বজ্রগর্ভ মেঘের সঞ্চার সত্ত্বেও বৃষ্টিহীনতা যেমন মৌসুমী বাতাসের ব্যাধি,তেমন মলয়ের এই বাঙালি দেখা আ-দিগন্ত…

সাহিত্য সমস্ত জীবন থেকে আহরিত হয় বলে সাহিত্য সমালোচনা ভাষাতত্ব,বিজ্ঞান,দর্শন ইত্যাদি নানান আন্ত-সম্পর্ক যুক্ত বিষয় থেকে নিজেকে আলাদা রাখতে পারেনা। এজন্য আমরা শুধুমাত্র মলয়ের ঔরস উপন্যাসের পাঠকৃতির দিকে নজর না দিয়ে তাঁর সমগ্র সাহিত্য দর্শনের দিকে নজর দিলে ভাল করব। যা থেকে তার লেখনীর গুণিতক গুলোকে খুঁজে পাওয়া যাবে। যাকে উত্তর আধুনিক বলেও চিহ্নিত করা যাবে। আধুনিকতা একটা প্যারাডাইম। যাকে ফুকো বলেছেন episteme। আধুনিকতা ‘প্যারাডাইম শিফট্’ থেকে আসে উত্তর আধুনিকতা। যেখানে একটা প্যারাডাইম থেকে আসে অন্য আর একটা প্যারাডাইম। কথা প্রযুক্তি সেই সামগ্রিক প্যারাডাইম শিফট্ বা বাঁকবদলের একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক। যে পরিবর্তন অর্গানিক বা জৈবিক। মলয় ঘুরে বেড়ান জীবনের নানান বিষয়ের মধ্যে যাকে আধুনিকতা দিয়ে বোঝা যায় না। ঔরস উপন্যাস শুধু মৃত্যুর গল্প না, আনন্দ ও বেদনা এখানে সমান উচ্চারিত। সুশান্ত ঘোষ সর্বদা এক আনন্দ অনুভব করে। সে বিহারী জোতদার পরিবারের যুবকদের মতন, রাজপুত ভুমিহার কুরমি যারা,কিংবা ব্রাহ্মণ কায়স্থ বিহারী আমলার শহুরে ছেলেদের ধাঁচে, অফিসে প্রতি ঋতুতে হালফ্যাশান এনেছে। দপতরের গৃহবধূ কর্মীদের নজরে সুশান্ত অবিনশ্বর যাদুখোকন, লিচুকুসুম্‌ মাগ ভাতারের অচলায়তনের ফাটল দিয়ে দেখা মুক্ত দুনিয়ার লালটুশ। কৃষিবিজ্ঞানে স্নাতক সুশান্ত, আরও স্বচ্ছলতার আপ্রাণে, শীতে দাক্ষিণাত্য থেকে আম, কোংকন থেকে  এঁচোড় কাঁঠাল, গ্রীষ্মে সিমলা থেকে টম্যাটো কড়াই শুঁটি ফুলকপি…, ঠগিদের বংশধর হবার গোপন গর্ব আছে তার। সুশান্ত ঘোষ একটানা গেঁজিয়ে যেতে পারে, চোখে চোখ রেখে, নন স্টপ, যেন বাজে বকার মধ্যেই পালটে যাচ্ছে হিজড়েতে, সবায়ের অজান্তে।

কি হয় অমন কথা বলাবলির, এক্সচেঞ্জ হলে সুশান্তর পাশে চুপচাপ দাঁড়িয়ে, ঠোঁট বন্ধ রেখে হাইতোলা চেপে, ভেবেছে অতনু। অতনু চক্রবর্তী। ময়লা বলতে যা বোঝায়, অতনুর গায়ের রং তার চেয়ে এক পোঁচ ফরসা। দু চোখে সব সময় বরফের বুদবুদ, ভেতরে ভেতরে উসখুসে নদীর স্রোত। গত অঘ্রানে তেইশে পড়েছে…… অতনুর হাতে মানসী বর্মনের গচ্ছিত রাখা বাদামি নরম ফোমলেদার ব্যাগ,কয়েক লক্ষ টাকার নোংরা নোট আর অসীম পোদ্দারের গোপন ডায়রী তাতে। …..গত বছর গরমকালে সুশান্ত অতনুকে এক শনিবার মহংগুর দোকানে বিকেল ছ’টা নাগাদ অপেক্ষা করতে বলেছিল। বগেরির মাংস খেয়ে জীবনের অ্যাকশন রিপ্লে দেখাতে নিয়ে যাবে……। এসব ওদের প্রথম যৌবনের গল্প। এর বিবরন আছে ‘ডুবজলে যেটুকু প্রশ্বাস’ এ। ঔরস উপন্যাস হল এরই পরবর্তী- সুশান্ত, ছেলে অপু, বউ বেবি, শ্বশুর তারিনী মন্ডল,পাটনা শহরের পুরনো পারিবারিক কিছু সম্পর্ক ইত্যাদি ইত্যাদি। গল্পের কেন্দ্রে থাকে মৃত্যু। আর তার চারপাশ জুড়ে থাকে বাঙালি আইডেন্টিটিক্রাইসিস,শারিরীক,জৈবিক,মানসিক ক্ষুধা। জীবন আর মুত্যুকে এক সঙ্গে দেখার যে প্রশ্ন করে সুশান্ত তা শেষ পর্যন্ত হেলে সাপই থেকে যায়।

যে কোনও ধরনের দুঃখ কাব্য-সাহিত্যের উপজীব্য অর্থাৎ বেদনা ব্যথা না থাকলে সে গল্প কবিতা শোনা হয়ে গেলেও পরে আর মনে থাকবে না। মলয় বলছেন , আনন্দের বিপরীত দুঃখ নয়। আনন্দ বলতে বোঝায় প্রীতি হর্ষ সুখ প্রমোদ যেগুলোর স্প্যান ওই ফ্ল্যাশটুকু। বিরল প্রতিস্বের মানুষের কথা যদি ভাবি, যেমন ধরা যাক চৈতন্যদেব ও রামকৃষ্ণ পরমহংসদেব, তাঁদের ক্ষেত্রেও আনন্দের স্প্যান দীর্ঘ হবার কোনও কারণ দেখিনা। বয়সের সঙ্গে এই স্প্যানের হেরফের হয়, এমনও মনে হয় না। কিন্তু দুঃখের ক্ষেত্রে হয়। যে কারণে দুঃখের কোনও দীর্ঘ স্প্যানের মধ্যে এক বা একাধিক আনন্দের ফ্ল্যাশ গড়ে উঠে মিলিয়ে যাবার ঘটনা ঘটতে পারে। বস্তুত এই ফ্ল্যাশের বিমূর্ততার জন্যে ‘অনির্বচনীয়’’ আনন্দ শব্দবন্ধ তৈরী হয়ে থাকবে। কেননা দুঃখও তো বর্ণনাতীত, অবর্ণনীয়,অনির্বাচ্য হতে পারে। আনন্দের তুলনায় বেশি। আনন্দকে যে কাল খন্ডে ব্রহ্মা বলা হয়েছিল, সে সময় থেকেই আনন্দকে মনে হয়, অনির্বচনীয় মনে করা হয়েছে। ব্রহ্মের দুটি রূপের কথা ভাবা হয়েছিল। একটি নির্গুণ ও অমূর্ত, অন্যটি সগুণ ও মূর্ত। সে যুগে দুঃখ নিয়ে সাংখ্য দর্শনে ভাবা হয়েছিল, এবং স্বাভাবিক ভাবেই তাকেও নিয়ে যাওয়া হয়েছিল অ্যাবস্ট্রাকশনে। অন্তত আমাদের সময়ে চিন্তা ভাবনার ফর্মে তা অ্যাবস্ট্রক্ট মনে হবে। সাংখ্যের প্রণেতা কপিল মুনির ব্রহ্ম ভাবকল্পকে আনন্দের সঙ্গে একাত্ম করে ফেলা হয়েছিল। সাংখ্য দর্শনে দুঃখ নিয়ে ভাবা হল। তার কারণ কপিল মুনি ঈশ্বরকে অসিদ্ধ প্রমান করলেন। বললেন,বিশ্ব সৃষ্টি হয়েছে প্রকৃ্তির বিকার থেকে। সাংখ্য অনুযায়ী দুঃখ ত্রিবিধঃ আধ্যাত্মিক, আধিভৌতিক আর আদিদৈবিক। আধ্যাত্মিক দুঃখ দুই রকমঃ- শরীর খারাপ হবার দুঃখ, এবং ঈর্ষা ভয় রিপুর কারণে মনে দুঃখ। আধিভৌতিক দুঃখও দুরকম। প্রথম যদি ভুতে ধরে, দ্বিতীয় – মানুষ পশু পাখি সাপখোপের দেওয়া দুঃখ। আধিদৈবিক দুঃখ উৎপন্ন হতে পারে দেবতার প্রকোপে বা প্রাকৃতিক দুর্যোগে। এই সমস্ত অ্যাবস্ট্রাকশন গুলোর কারনে আনন্দ ও দুঃখের ভাবকল্পে প্রাচীনকালে ভেবে দেখা হয়নি, বা সম্ভবত চিন্তার ফর্মের জন্যে ভাবা সম্ভব হয়নি,যে সমাজ ও সম্প্রদায়ের ব্যবস্থাটি থেকেই কারোর আনন্দ আর কারোর দুঃখ ঘটতে পারে।( হাওয়া ৪৯,চল্লিশতম সংকলন মাঘ ১৪১৭বইপার্বন২০১১, পৃঃ -১৩)

মলয়কে তিন বছর বয়সে ক্যাথলিক স্কুলে ভর্তি করে দেওয়া হয়েছিল। প্রতিদিন যেতে হত বাইবেল ক্লাশ করতে। তিনি বলছেন,চার্চের যে স্মৃতি রয়ে গেছে তা দুঃখের। আজও যে কোনও ক্যাথলিক চার্চে ঢুকলে ইন্সটিংটিভলি তাঁর দুঃখ চাগিয়ে ওঠে। মলয়ের জানতে ইচ্ছে করে আনন্দস্বরূপ ব্রহ্ম ও বেদনাময় খৃস্ট – এভাবনা দুটি রেঁনেশাসকালীন ধর্মান্ত্রিত হিন্দুরা কিভাবে মেলাতেন, কারণ ঐ সব হিন্দুরা বেশিরভাগই ছিলেন উচ্চবর্ণের। খৃস্টধর্মের প্রভাবেই আধুনিকতাবাদী পাশ্চাত্ত্য কবিদের রচনায় এত বেশি দুঃখ ব্যথা, বেদনা, কষ্ট, যন্ত্রনা। লক্ষণীয় যে হরিচরণ বন্দোপাধ্যায়ের ‘বঙ্গীয় শব্দকোষ গ্রন্থে ব্যথা ও বেদনা শব্দদুটি নেই,যদিও ব্যথ ও বেদন আছে। ঔরস উপন্যাস অবশ্যই একটি দুঃখের গল্প যেখানে গল্পের শেষে মলয় আমাদের তেমন কোনও সমতল জায়গায় নিয়ে দাঁড় করাননি। মূলধারার বৃহত্তর বাঙালি জীবন থেকে বিচ্ছিন্ন হয়েও বঙ্গীয় সংস্কৃতির খড়কুটো আঁকড়ে বেঁচে থাকা এক বাঙালি পরিবারেরই গল্প নিয়েই এই উপন্যাস লিখিত। লেখক কি নিয়ে কিভাবে লিখবেন তা সম্পূর্ণ তাঁর নিজস্ব অভীপ্সা। শরৎচন্দ্রের সময়ে ছিল বার্মা মুলুক,রবীন্দ্রনাথের নীড় বিশ্ববিধাতার সাথে যুক্ত,জীবনান্দের মিস্টিক অতীত ও কার্তিকের বাংলা। সেই সব স্পেসের সাথে বর্তমান স্পেস আলাদা। এখন লেখা অনেকটাই ই-স্পেসে। মলয় রায়চৌধুরী লিখেছেন দিনের পর দিন মাসের পর মাস ঘটনার অনুক্রমে সত্যের প্রুরালিটি। যার প্রত্যেকটা আলাদা আলাদা দৃষ্টিকোণ তৈরী করে। যেমন…… ‘হাত পা বাঁধা, গুটকাদেঁতো মুখে লিউকোপ্লাস্ট, বছর তিরিশের ঢাউসভুঁড়ি হুলোচোখ ট্রাক ড্রাইভারটা মার খেয়ে আধজখম হয়ে খড় কাটার যন্ত্রে সবুজ নাইলন দড়ি বাঁধা অবস্থায়, অজ্ঞান হয়ে নেতিয়ে ছিল,প্রায় তিন কিলোমিটার দূরে পাশিদের পাড়ায় তোতারাম পাসওয়ানের মহাত্মা গান্ধী রাস্ট্রীয় কর্মযোজনার টাকা মেরে তৈরী খামারে। ট্রাক চালক বৈশাখি যাদবের কাছ থেকেই তারিণীর সাঙ্গপাঙ্গরা আঁচ করতে পেরেছিল খুনের পেছনে কাদের হাত থাকতে পারে। আররে, বৈশাখি হ্যায় কংসায়তি যাদব, অসলি কৃষ্ণায়তি যাদব নেহি হ্যায়, মুহ খোলেগা ক্যায়সে নেহি; ডরপোক কংসায়তি ফাট্টু কাঁহিকা।

তারিণী মন্ডল দিয়ারার চরের জমিদার, সুশান্ত ঘোষের শ্বশুর। তার মেলা সম্পত্তি। এবং সে সবের একমাত্র ওয়ারিশ নাতি অপু,অশ্বমেধ ঘোষ। সুশান্ত ঘোষ – বাবা মার জন্য স্মৃতির জারকে আচ্ছন্ন সুশান্তর মন কেমন করে মাঝেমাঝে, তখন গ্যাঁজানো তরমুজের চোলাই করা সোমরস নিয়ে বসেন, সঙ্গে শুয়োয়ের মাংসের বড়া,আদা-রসুন-পেঁয়াজবাটা আর বেসনমাখা, হামানদিস্তায় থেঁতো করা মাংসের বড়া, সাদা তেলে যা রাঁধতে ওনার বেবি নামের মেঠোগন্ধা বউএর ভারিভরকম মায়ের জুড়ি নেই। ওনার ছেলে অপু, যদিও বাংলা বলতে পারে কিন্তু মাকে শুনিয়ে হিন্দিতেই বলে, হাঁ পিজিয়ে পিজিয়ে অওর গম গলত কিজিয়ে; আরে অগর আপকা দিল নঁহি লগতা থা তো ভাগ কেঁও নঁহি গয়ে থে? য়ঁহাসে নিকলকে ভাগলপুর স্টেশন, অওর ওঁয়াহাসে সিধে পটনা, স্টেশন ভি ঘর কে নজদিক।পর আপ নহিঁ ভাগে। লগতা হ্যায় আপকো অপনে বিবি সে জ্যাদা প্যার অপনে সসুরসে হ্যায়। বিবি কঁহি ভি মিল জাতি, মগর তারিণী মন্ডলকে তরহ মকখনভরা পহাড় নহিঁ না মিলতা, য়হি হ্যায় না আপকা গম?

সুশান্ত তাই মাঝে মধ্যেই পটনা চলে যায়। পরিবারের বাদবাকি লোকজনদের সঙ্গে খানিক সময় কাটিয়ে আসেন। অবশ্য সুশান্তর বাবা মা আর কেউ বেঁচে নেই, আছেন বড় জ্যাঠাইমা, বড় জ্যাঠা আর ভাইঝি ইতু। এদের সঙ্গে খানিক মন খুলে কথাবার্তা বলেন , বিশেষ করে ভাইঝি ইতু অনেকটাই তাঁকে বোঝে। ইতু নিজেও নিজের মনের কথা কাকা সুশান্তকেই খুলে বলে। পটনার এই আদ্যিকালের বাড়ি আর বস্তপচা মূল্যবোধ ছেড়ে সেও যেদিকে দুচোখ যায় বেরিয়ে যেতে চায়। কারণ এই পরিবারে ইতুও অনাদৃতা, তারও বাবা মা কেউ নেই। এমনকি একমাত্র প্রেমিক অমিত,তাকেও এ বাড়ির সবাই বেজন্মা বদনাম দিয়ে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিয়েছে। অমিত হল সুশান্তর সেই যৌবন কালের বন্ধু অতনু চক্রবর্তী ও অতনুর বান্ধবী মানসী বর্মনের পালিত পুত্র। অমিত আর ইতুর মধ্যে নিভৃত একটি সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। বাড়ির লোকজন তা জানতে পেরে অমিতকে বেজন্মা অপবাদ দেয়। ফলত অমিতের রাতারাতি গৃহত্যাগ। সুশান্তর কাছে ইতু মনের আক্ষেপ প্রকাশ করে। বলে অমিতের জন্যই সে এই বাড়িতে এখনও বাস করছে, কারণ অমিত ফিরে আসবে। সুশান্ত তাকে পড়াশোনা কেরিয়ার নিয়ে ভাবতে বলে, কিন্তু ইতুর অত ইচ্ছে নেই। ইতু এখন পালিয়ে যেতে পারলেই বাঁচে,সুশান্তর মত। অবশ্য সুশান্ত তো পালিয়ে যাননি, ছোটবেলায় তাঁকে তারিণী মন্ডল কিডন্যাপ করে নিয়ে গিয়েছিলেন। মুক্তিপণের টাকা না পাওয়ায় নিজের মেয়ে বেবির সঙ্গে সুশান্তর বিয়ে দিয়েছিলেন। এদিকে উপন্যাসের শেষে দেখা যায় অমিত ইতুর ফের সাক্ষাৎ, ইতু চলে গেল অমিতের সঙ্গে। জায়গাটা হল দন্ডকারণ্যের গভীর জঙ্গল, যেখানে গোঁড় গারিয়া ইত্যাদি আদিবাসীদের অবস্থান। জীবনের হাজার জটিলতা থেকে মুক্তি পেতে ইতু জঙ্গলে ছুটল, লেখক লিখেছেন- নমস্তে ইতুদিদি, শুনে,কালো মোটর সাইকেলের পিলিয়নে বসে,ইতুর নাকে ছেলেটির যৌবন গ্রন্থির ঝাপটের উগ্র গন্ধ নাকে সে লাগতে প্রায় বমি পেয়ে গেল; উফ, ফেরোমোন। মুখে থলেটা চাপা দিয়ে সামলালো। কিছুটা যাবার পর বুঝতে পারল যে এক হাতে ছেলেটির পেট ধরে থাকতে হবে, আরেক হাতে মোটর সাইকেলের হ্যান্ডেল, নয়ত সড়কের যা অবস্থা, নির্ঘাৎ ছিটকে পড়বে কোনও পাথরে চাকা পড়লেই। ঘামে ভেজা পেটে হাত রেখে ধরতে, ছেলেটি বলল, হ্যাঁ ঠিক করে বসুন। এ রাস্তা ভালো নয়, এই তো সবে দুটো ব্লক নিয়ে নারায়নপুর জেলা তৈরী হয়েছে। ইতুর মনে পড়ল অমিত এভাবেই ওর স্কুটারে পেট ধরে বসেছিল, আর নাভিতে সুড়সুড়ি দিয়েছিল। যুবকটির পেট, বর্ষায় ভেড়ার লোমের মতন, বেশ ভিজে,উনিশ কুড়ি বছর হবে, গায়ের রং মুখের গড়ন দেখে আদিবাসি বলেই মনে হল। ইতু জিজ্ঞেস করল, দান্ত্যেশ্বরী মন্দির কি পড়বে রাস্তায়? ছেলেটি বলল, না, দিদি। দান্ত্যেশ্বরী হল বস্তারের দেবী। নারায়নপুরে অবুঝমারিয়াদের দেবী হল কাকসার। বৈগারা রাসনাভাকে পুজো করে, আর গোঁড়রা পুজো করে মেঘনাদকে। উত্তর শুনে যুবকটিকে কোনও পালটা প্রশ্ন করল না ইতু। নিজেকেই প্রশ্ন করল, মেঘনাদ? এ কোন মেঘনাদ? রামায়ন?…।

মলয় রায়চৌধুরী বহু পঠিত, বহুচর্চিত, বহু নিন্দিত ও একই সঙ্গে বহু আলোচিত। বরাবর তিনি টিকে থাকার গল্পই লিখে এসেছেন। এই উপন্যাসের অনেক চরিত্র। মনে হয় শুধুমাত্র জীবনের ভজকট দিক গুলো দেখাবার জন্য এমন ভাবে অহেতুক চরিত্র সংযোজনা। সুশান্ত আর তাঁর ছেলে অপুর মধ্যে তেমন কোনও বাদানুবাদ বা সংলাপ নেই, অথচ ভাইঝি ইতু আর সুশান্ত নিজেদের মধ্যে এমন গল্প করেছে যে তা নাহলেও এই উপন্যাসের অঙ্গহানি হত না। ইতুর মুখ দিয়ে মলয় যে সব কথা বা ডায়ালগ বলেছেন যা শুধু মলয়কেই মানায়( সেই শুভা কে বোবা করে এক তরফা যেমন বলেছিলেন, প্রচন্ড বৈদ্যুতিক ছুতারেরই এক্সটেন্ডেড পার্ট। এর থেকে মলয় আর বের হতে পারলেন না!) সমাজ ও পরিবার সম্পর্কে মলয় রায়চৌধুরী যা যা ভাবেন, যেভাবে ভাবেন, আজ যে শিশুটি দিয়ারা চরে জন্ম নিল, হতে পারে বড় হয়ে সে দিয়ারা চরকেই মডেল টাউন বানিয়ে ফেলল। অপু তার নানা নানির খুনের বদলা নিয়েছে। অথচ তার মানসিক টানাপোড়েন উপন্যাসে বেশি নেই। সে ক্রুদ্ধ, বদ মেজাজী বা রাজনীতি বিলাসী। দিল্লীবাসী ও সময়ের স্রোতে চলা এক যুবক। কিন্তু এটুকু হলেই তার কথা শেষ হয়না। প্রত্যেক মানুষের দুটি করে চিন্তা স্রোত, বিষয় যাই হোক, সর্বদাই মানুষের মন সেই বিষয়ে প্রথমেইএকটি গড়পরতা চিন্তা ভাবনা করে। আবার সম সাময়িক দ্রুত একটি শুদ্ধ চিন্তাও পাশাপাশি কাজ করে চলে। অপু এই মুহুর্তের জেনারেশান। সুতরাং তার কাছ থেকে পাঠকের অন্য যে কোনও আশা বা চাহিদা থাকতেই পারে। কিন্তু সে যেন তার বাবা মা বা নানার প্রতিবিম্ব বা একই চিন্তা ভাবনার উত্তরসুরী। এই চরিত্রটি দিয়ে লেখক ঔরস উপন্যাসকে ভিন্ন মাত্রা এনে দিতে পারতেন। কিন্তু তা হয়নি। অপু একটি গড়পরতা চরিত্র ছাড়া আর কিছু না। মনে রাখার মতন অপু  কিচ্ছুই করে উঠতে পারেনি। ইতু অমিত তারিণী মন্ডল জ্যাঠাইমা সৌদামিনী ইত্যাদিরা না থাকলেও উপন্যাস নিজের নিয়মেই এগিয়ে যেত। ইতু অমিতের একত্র সহবাস হয়েছে, কিন্তু গল্পের শেষে দেখা গেল দুজনে দুই দিকে। তারিণী মন্ডল ও তাঁর স্ত্রী মন্থরা দেবী খুন হলেন, সুশান্ত আত্মহত্যা করল,অপু কোথায় পালালো না পাহাড় থেকে ঝাঁপ দিল ,চরিত্রের পরিনতি মনে দাগ কাটে না। আসলে মলয় স্পেস এর গল্প লিখেছেন, লিখেছেন একটি নিদির্ষ্ট কালখন্ডের চিত্র-চরিত্রায়ন। হতে পারে এইটি হয়ত উত্তর আধুনিকতা। যেন বহমান সময় স্রোত থেকে হঠাৎই এক আঁজলা জল তুলে নেওয়া।

মলয় বলছেন, লেখালেখি সম্পর্কে যখন আমরা ব্যক্তিগত পরিমন্ডল ও মানসিক স্থিতি গড়ে তুলছিলুম, ১৯৫৯-৬০ নাগাদ, তখন কেন লিখব, কেন ভাবছি, কেন কেউ পাঠবস্তুটি পড়বে, এ সমস্ত ধারনা গড়ে ওঠেনি। বিশ্ববিদ্যালয়ে, স্থানীয় বুদ্ধিজীবি মহলে সাহিত্যের আলোচনায়, আলোচকরা ছিলেন ডক্তর জনসন প্রভাবিত এবং প্রতিটি রচনা বা তার অংশের ব্যাখা ছিল পূর্বনির্ধারিত, প্রায় অপরিবর্তনীয়। প্রতিটি মাষ্টারমশায় ‘সোনার তরী’ থেকে একই সংকেত পাচ্ছেন দেখে, মুখ বুজে স্তম্ভিত হয়ে যেতুম। শোকের কবিতায় শোক প্রকাশ করতে অস্বীকার করার বোধটি বাংলা কবিতায় বেশ দেরীতে এসেছে, আটের নয়ের দশকে, যখন পোস্টমডার্ন বা উত্তর-ঔপনিবেশিক কবিতা তার নিজস্ব আদল পেল। বিভা বসু রচিত ‘একটি দুরারোগ্য মুক্তি’, সুবীর সরকার রচিত ‘যুদ্ধরত সৈনিকদের অ্যালবাম’, কামাল হোসেন রচিত ‘শবদের কাঁধে করে’ অ্যান্টিএলিজিগুলো মনে পড়ছে এ প্রসঙ্গে। ইংরিজিতে সম্ভবত শোক প্রত্যাখানের প্রথম এলিজি ডিলান টমাসের ‘রি-ফিউজাল টু মোর্ন ডেথ বাই ফায়ার অব আ চাইল্ড ইন লন্ডন’।

একদা এলিজি ছিল নির্জন সমাধি। এখন সেখানে হুল্লোড় আর হইচই। তাত্ত্বিক,দার্শনিক,নান্দনিক,রাজনৈতিক,আর্থিক,সাংস্কৃতিক লাশে ঠাসা। পোস্টমডার্ন বলা হোক বা উত্তর-ঔপনিবেশিক যে নামেই ডাকা হোক বর্তমান কালখন্ডটিকে, সামাজিক ভাবে মৃত্যু পেয়েছে একটি বীভৎস রূপ, যা শোকের সংজ্ঞায় পরিবর্তন ঘটিয়েছে। যে এলিজি ছিল লিরিক জঁরের অন্তর্গত, তা এখন চীৎকার ও বুক চাপড়ানি, ভয় ও উদাসীনতা,অবিশ্বাস ও বুকনির খোলা ময়দান। সুবিমল বসাকের একটি রচনা আছে। নাম, ‘আত্মার শান্তি দু-মিনিট’। শহুরে দ্রুতির গর্জনে দাঁড়িয়ে ওই বিয়োগব্যথাতুর দু-মিনিট হয়ে ওঠে দুই শতাব্দী। সময় নিজেই আজ আবিষ্ট ও আচ্ছন্ন। সময় এখন বিকার তত্ত্বের অন্তর্গত। গ্রীক এলিজি প্যাসটরাল ছিল। বাংলা ও এউরোপীয়ান এলিজি ছিল স্মৃতি আশ্রয়ী। এখনকার অ্যান্টি এলিজি জানে যে স্বজনের মৃত্যুতে আর্থিক লোকসানে মানুষ অধিক শোকার্ত,ব্যথিত ও আতঙ্কিত। যা অস্বাভাবিক তাকেই স্বাভাবিক করে ফেলেছে আধুনিকতা। শোকের আদিম রূপটি সেহেতু মডার্ন ও পোস্টমডার্ন এলিজিতে পাওয়া যাবে না।

প্রায় আশি বছর বয়সে পৌঁছেছেন মলয়। কথা হল এমন ধরনের উপন্যাস আবার নতুন করে লেখার কি কিছু দরকার ছিল? এতদিন যা যা লিখেছেন, যেভাবে লিখেছেন, মনে হয় ঔরস তারই পুনরাবৃত্তি। বর্ত্তমান কালখন্ড সমাজ পরিবার মানুষ সময় ইত্যাদি সব কিছুকেই অসংখ্য ডাইয়ামেনশনে ঘুরিয়ে মারছে। একটা সময়ে, সে বেশিদিন আগের কথা না, মানুষ একান্নবর্তী পরিবারে জীবন কাটাত। তারপর কালের নিয়মে সে প্রথা ঘুচে গিয়ে এল অণু পরিবার। স্বামী স্ত্রী আর এক বাচ্ছা। এখন সময় আরও বদলেছে। বাচ্ছা ভারতের নামী স্কুলে পড়ে ও সেখানেই থাকে। স্ত্রী মোটামুটি একটি চাকরী করে আর স্বামী আগের চাকরী ছেড়ে বর্তমানে ব্যাবসা করছেন। প্রায়ই তিনি আজ হংকং, কাল আয়ারল্যান্ড, পরশু জাপান ছুটছেন। স্কুলে সামার ভ্যাকেশন হলে বাচ্ছাটি আর বাড়ি আসতে চায় না। স্কুল থেকে সাউথ আফ্রিকা ট্যুর হচ্ছে। মাকে ফোনে জানিয়ে দিচ্ছে , এবার গরমের ছুটিতে সে বন্ধুদের সঙ্গে সেখানেই বেড়াতে যাবে। মা-ও অগত্যা রাজী হয়ে গেলেন। পরবর্তী সময়ে দেখা গেল, কর্মব্যস্ত স্বামী নেক্স্ট ফ্লাইট ধরার আগে গোগ্রাসে কিছু ব্রেড ওমলেট দিয়ে দ্রুত লান্চ সেরে নিচ্ছেন। হতাশা ও একাকীত্বে ভুগতে থাকে স্ত্রী বাড়িতে আজকাল রান্না বান্নার পাট প্রায় তুলেই দিয়েছেন। একমাত্র বাচ্ছা ( এবার সে বড় হয়ে গেছে) একদিন মাকে জানাল,সম্প্রতি বিশেষ একটি অ্যাপস খুব শীঘ্রই চালু হতে চলেছে। থালা ভর্তি খাবার দাবার সাজিয়ে কম্পিউটারের সামনে বসে গেলেই হল। যারা একেবারে একলা, দুপুর বা রাত্রে খাবার সময় সব রকম খাবার দাবার নিয়ে স্ক্রীনের সামনে বসে অন লাইন এমন কাউকে সঙ্গী পাবে বিপরীত দিক থেকে সেই মানুষটিও অমন খাবারের থালা নিয়ে একলা খেতে বসেছে। এক কথায় অন লাইন খাবার টেবিল, একলা খাওয়াও হল না, উলটে প্রাপ্তি হল খেতে বসে নানা রকম গল্প গুজব। এই মুহুর্ত্তের গল্প এটা। এমন বিষয় নিয়ে মলয় আপনি কিছু লিখে দেখাতে পারেন। ঔরস উপন্যাসকে কোথাও কোথাও চর্বিত চর্বন বলে মনে হয়েছে। সেই এক ঘেয়েমি থেকে পাঠক নতুন স্বাদ পেতেও পারেন।

 

…………………………………………………………………………………………………।।ঋণ স্বীকার ঃ

ছোটলোকের ছোটবেলা, ডুবজলে যেটুকু প্রশ্বাস –মলয় রায়চৌধুরী

মলয় রায়চৌধুরীর প্রবন্ধ – সম্পাদক- সমীর রায়চৌধুরী, হাওয়া৪৯,মাঘ১৪১৭,বই পার্বণ ২০১১

সমীর রায়চৌধুরীর ছোটগল্প- অশোক তাঁতী( দমদম জংশন, ২য় বার্ষিক সংখ্যা, ২০১৮)

………………………………………………………………………………………………………।।

ঝুমা চট্টোপাধ্যায়

সুপ্রীতি বর্মন : আধুনিক কবিতার বাউল মলয় রায়চৌধুরীর পজিটিভ ইরটিসিজম

23244048_1058124570996172_4734125158813869917_n

বুদ্ধদেব বসু ইরটিক উপন্যাস লিখেছিলেন, ‘রাতভর বৃষ্টি’, কিন্তু তিনি ইরটিক প্রেমের কবিতা লেখেননি। মলয় রায়চৌধুরীর প্রথম পর্বের কবিতা ‘প্রচণ্ড বৈদ্যুতিক ছুতার’ ইরটিক প্রেমের কবিতা, মলয় রায়চৌধুরী ইরটিক উপন্যাস লিখেছেন, ‘অরূপ তোমার এঁটোকাঁটা’। মলয় রায়চৌধুরী দ্বিতীয় পর্বেও বহু ইরটিক কবিতা লিখেছেন, একজন বাউলের প্রেমের পজিটিভ ইরটিসিজমের কবিতা । কোটিজন্মের যায় পিপাসা বিন্দুমাত্র জলপানে ।

 

মলয় রায়চৌধুরী এক উজ্জ্বল ধ্রুবতারা, একজন বাউল । শব্দ, চিত্রকল্প, বাকবন্ধ তাঁর একতারা, গুবা, সারিন্দা, ডুবকি,  নুপর, খমক । সকল পথ হারিয়ে ফেলা তরুণী-প্রেমিকার গূঢ় তলাতল খুঁজে তুলে এনেছেন রত্নধন, চাঁদের উদয় দেখিয়েছেন অমাবস্যায় । অভেদের সন্ধানে বেরিয়ে তিনি নবদ্বার-পিয়াসী এক জাজ্বল্যমান প্রতিমূর্তি, যাঁর হৃদয়ের কোলাজে স্বর্ণালী কলমের ছোঁয়ায় ফুটে ওঠে স্থলপদ্মে ভাসমান ‘ন্যাংটো তন্বী, । আড়ালের দরমা ছুঁড়ে ফেলে অকপট সহবাস, নগ্নমূর্তির দাম্পত্য কিংবা প্রেমিকের সত্তায়, কৃষ্ণের যতেক লীলা সর্বোত্তম নরলীলা । ধূসর চিত্রকল্পের পরোয়া না করে, পুরুষতান্ত্রিক স্বৈরাচারীতায় না ভুগে, নারীজন্মে পুরুষত্বের অসীম সোহাগশশী কলঙ্কিত না করে, প্রেমের পবিত্র অর্ঘ্যে অর্চনায় হাংরি আন্দোলনের পথিকৃৎ, যে অর্চনার মায়াবী বর্ণনা আছে তাঁর ‘নামগন্ধ’ উপন্যাসে, খুশি মণ্ডলের উদ্দেশ্যে যিশু বিশ্বাসের প্রেমপূজা । আদালতে জেল-জরিমানার ভ্রূকুটি, বন্ধুদের রাজসাক্ষী হয়ে যাওয়া, তবুও কবির বাউলসত্তাকে কে কবে চোখ রাঙিয়ে অবরুদ্ধ করতে পেরেছে ? মলয় রায়চৌধুরীর মতো অতো দম কারোর নেই ; এ  এক সাহসী স্পর্ধা অতল-নিতল-তলাতল সন্ধানের । তাই আমিও কোনও রোক-টোখ ছাড়া স্বাধীনচেতা মননে তাঁর প্রেমের কবিতাগুচ্ছের কয়েকটির বিশ্লেষণ করছি । । বিশ্লেষণের গভীরতার মাপনযোগ্যে যতটা ইহ-দেহবাদের যে আনন্দ তুলে ধরেছি তা শুধু নিঃস্বার্থ ঐশ্বর্গিক প্রেমের অঞ্জলি, আমার স্বামী-সোহাগের অভিজ্ঞতা থেকে।

 

“ঘাস” কবিতাটিতে হৃদয়গ্রাহী প্রেম নিবেদনের পংক্তি কথকথা :  “আমি জন্মাবো কুমারী উরুদ্বয়ের মাঝে কোঁকড়া কৃষ্ণ ঘাস হয়ে তাতে লুকানো গন্ধমাদনের ঝর্না। মহীরুহ নই তাই জিরোই মনে হয় শুকিয়ে গেছি।”  ঢেউ তুলি তোমার ঘর্মাক্ত শরীরে বাড়তি বীজ ফেলবো রাতে। তখন মনে হয় গোল্ডফ্লেকের ধোঁয়ায় নিকোটিনের আসক্তি ওষ্ঠদ্বয়ের হিমাঙ্কে দূর্বল দূর্বাঘাসে আখচার মৌসুমীর অকাল বর্ষণ হবে। সর্বভুক শিখায় উজ্জ্বলা পোড়ামাটি বীর্য উত্থিত  হয় পুরুষালি ঘাসে আর প্রেমিকার দেহে উদ্ভাসিত অপরিমেয় গভীরতায় সংক্ষিপ্ত চিল্কা হ্রদ। অবুঝ কিশোরী খামচে ধরে তক্ষক জিভের টপাটপ গ্রাসে অধিগ্রহন ফেনায়িত ঢেউ। অধিগ্রাসে পুরুষালী ঘাস সমর্পিত পাষান ঈশ্বরী বেদী তোমাকে। মৃন্ময়ীর চুলচেরা বিশ্লেষণ আজ ক্ষুরের ডগায় নাছোড় প্রেমিকের মাথাচাড়া। বিছানায় এলানো মৃত্তিকার নগ্নকায়ার সাথে ভূরাজত্বে তৃষ্ণার্ত সঙ্গীর নাগপাশে মুঠোয় অধঃক্ষেপ মৈথুন। মলয় রায়চৌধুরীর ইরটিক কবিতাগুলো বাউলের দেহতত্বের ভূবনমঞ্চ ।

 

“ন্যাংটো তন্বীর জন্য প্রেমের কবিতায়” কুচকুচে চকচকে পুংঘোড়ায় বসে আছেন ন্যাংটো তন্বী।

যৌননৌকায় টালমাটাল পুংঅশ্বের রোমের কেশর ঝাঁকানো ভরাডুবি পিচ্ছিল স্রোতের উষ্ণ প্রসবন।

অশ্বারোহীর রক্ষাকবচ কনডোম,,, ফানেলে জ্বলন্ত ভিসুভিয়াসের অগ্ন্যুৎপাতের উৎসেচক কেরোসিনে চোবানো আর বর্হিগত অপসারনে ডেসিমেলে কম্পমান স্যাঁতসেতে ধরিত্রী। চুষিকাঠির ইচ্ছেমতন রস নিংড়ানো সরস জিহ্বায় উৎকোচ গাঁটের পর গাঁট খেজুর গাছ। গৃহস্থের পরিপাটি তোশক বিছানা আজ হুলুস্থুলুস দুন্ধুভির  গর্জনে কুমারী মেঘে জমাট জলঙ্গি কামনার রসমজ্জায়। লাজুক ঘোমটায় তরুণাস্থির চলন রুফটপের সানসাইনে মালসায় জমেছে গতরাতের ঋতুস্রাব। পুংঘোড়ার ঈষৎ কম্পিত লাফে অচিন পাখির সন্ধান।

 

“বৈদ্যুতিক ছুতার” কবিতায় কাম রজঃগুণে প্রেমিক জেদি মন সাহিত্য-ফাহিত্য লাথি মেরে চলে যাবে। সে দেউলিয়া থাকতে চায়,  নিঃস্ব, কারণ প্রেম হল তার একমাত্র পাথেয় । সমস্ত নোঙর তুলে নেবার পর শেষ নোঙর ছেড়ে চলে যাচ্ছে তার প্রিয়তমার বিরহের উদ্বিগ্নতা । দুর্নিবার যন্ত্রনায় ছিন্ন প্রেমিক-স্বত্তার উৎকন্ঠিত হৃদয় প্রেমিকাকে হিঁচড়ে উঠিয়ে নিতে চায় আপন ক্ষুধায়। লকলকে জিহ্বায় শ্যাওলা জমেছে  নিরাসক্তির ঘোমটার উদাসীনতায় । কবি যেন গা ঠেশে, ছাড়ো ছাড়ো, একরাশ আকাঙ্খায় অশ্রাব্য ঘুমের স্নিগ্ধতার দূরত্ব গড়ে ফেলেছেন ।তাই বোধহয় চোখের পালকি থেকে বিদায় নিয়েছে দৈহিক স্পর্শের টান— কন্যা এখন যুবতী।

প্রতিবেশী নাভিগহ্বরে শুয়ে আছে সোঁদা গন্ধের বিনুনি,  কবি-প্রেমিকের বীর্যের আঠালো স্রোতে নিংড়ে পেতে চাইছে আজ জরায়ুর গন্ধ, সে প্রেমিকা, সে শুভা, সে বাউলের সঙ্গিনী। মলয়-বাউলের কাছে স্বর্গ-নরক, জন্মান্তর, মূর্তি, মন্দির, শাস্ত্রগ্রন্হ স্বীকৃত ছিল না ; ধর্মের হাংরি ম্যানিফেস্টোয় তিনি লিখেছিলেন সেসব কথা ।

 

মশারীর রৌদ্রদগ্ধ আঁতুড়ঘরে হাপরের দীর্ঘশ্বাসে রাত্রিযাপনের কোলাজে নিতম্বের দূর্দন্ডপ্রতাপে শ্রীমতি সোহাগটুকু নিংড়ে রক্তিম টিপে করেছে বন্দী। আঠালো স্রাবে বৈদ্যুতিক ঝাপটা কবি আজ হয়েছেন ছুতোর; কবি বলেছেন যিশুখ্রিস্ট ছুতোর ছিলেন, শুভা তাঁর মেরি ম্যাগডালেন। প্রেমিকের অপটু ধস্তাধস্তি কুঠারে প্রেমিকার নাভিতে উছলিয়ে বৈতরিনী জাহ্নবীর ছলাকলায় গূঢ় অভ্যন্তর সরস মরণ-পতন। উড়ুক্কু কলা ঊরুদ্বয়ে আগোল প্রেমিকার  যৌবনতটে কবির আঁশ কামড়ে যোনির সুস্থতা নাড়ি ছেঁড়া রোমান্টিসিজম শুভার প্রতি কাঙাল হৃদয় প্রেমিক মলয়ের। তিনি চিৎকার করে বলছেন, শুভার স্তনের বিছানায় আমাকে শুতে দাও, শেষবার ঘুমোতে দাও, মর্মান্তিক আকুতি এক ব্যথিতচিত্তের । ভরাট স্তনের শিমূলে মাথা গোঁজার ঠাঁই। উদ্দাম ন্যাংটো তন্বীর আঁচড়ে কোঁকড়ানো চুলে মেঘের কার্নিশ আকন্ঠ ভরে যাচ্ছে আজ ধাতুর স্রোতে।

 

রূপশালী নাভিমাসে বীর্যস্নেহে স্নিগ্ধ গথিক ভাস্কর্য আঁকশি রূপে নেতিয়ে থাকা দূর্বল শরীরী বাকলের হেতাল বনে আনতে চায় মরা কোটালের বান। পরিপক্ক সোহাগের ডোরে যন্ত্রণা মন্থনে উদ্যত উদ্ধত জেদী আদি যৌনতা ঢোঁড়া সাপ স্ফীতগতরে ঊরুজাত রোঁয়াওঠা শিহরনের কম্বলে দগ্ধভূমি পুরুষত্বের ঔরসে নিষিক্ত জরায়ু আজ তার একচ্ছত্র অধিকার। তাই আজ সব প্রয়োজন শূন্য প্রেমিকার গর্ভে ঔরসজাত সন্তান রূপে শুক্র থেকে প্রেমিকের জন্ম হোক এ যেন এক প্রতিশ্রুতিবদ্ধ প্রেমিকের দৃঢ় অঙ্গীকার, কালজয়ী উৎসর্গীকরণ, বাউলের দেহতত্ত্বের সঙ্গমে।         পাঁজর নিকুচি করা ঝুরি নামছে স্তনে আর তুলকালাম হয়ে যাচ্ছে বুকের ভেতরের সমগ্র অসহায়তা। যোনি মেলে ধরো, বাউল-প্রেমিকের আকুতির টান পাঁজরাবদ্ধ উৎসবে । কুমারী অমাবস্যায় পদ্মবোঁটার উন্মোচন অন্তর্বাস ছিঁড়ে বেআব্রু শুভার রজঃস্বলায় প্রেমিক শ্লেষা হয়ে মিশে যেতে চায়।মায়ের যোনিবর্ত্মে অাত্মগোপন বা ধিক্কার স্বীয় অধিকারে তাই অথৈ বানে পিতার আত্মমৈথুনের পেচ্ছাপে তার বয়ে যাওয়া কেবল এক নিষ্পাপ প্রেমিকের স্বীকারোক্তি শুভার প্রতি তার শেষ প্রয়োজন।তাই ঋতুস্রাবে ধুয়ে যেতে চায় এক প্রেমিকের পাপতাড়িত কঙ্কাল। এক অসাধারণ সান্ধ্যভাষায় রাঙানো চিত্র প্রেমিক সোহাগ স্বপ্ন গর্ভবতী শ্রীময়ী শুভার আসন্ন প্রস্ফুটিত কুসুম। শুকিয়ে যাওয়া বীর্য থেকে ডানা মেলে ৩০০০০০ শিশু উড়ে যাচ্ছে শুভার স্তনমন্ডলীর দিকে।রূপায়নে যেন কোন অন্তরীক্ষের দেবশিশু উন্মোচনে আজ বেজে ওঠে বাউলের দেহযন্ত্র । অন্তিমে বিপর্যয়ে আলোড়িত-হৃদয় এক নিষ্পাপ প্রেমীর ।  গরীবের দেওয়াল জুড়ে দেখবে কেমনে তোমার প্রতুষ্যের বাসি ওষ্ঠমধুর সঞ্চয় যামিনীর কোলাহল। তাই আরশি থাকার পরেও স্বয়ংদর্শন ন্যাংটো মলয়কে ছেড়ে দিয়ে শুধু প্রেমিকের আত্মসমীক্ষণ— অপ্রতিষ্ঠিত খেয়োখেয়ি অনন্তকালের জন্য।

 

“মাথা কেটে পাঠাচ্ছি যত্ন করে রেখো”—, এই কবিতায় এক আশ্চর্য উপস্হাপন প্রেমিকসত্তা মলয়ের যা হৃদয়গ্রাহী সংলাপের চৌম্বকীয় আকর্ষণে গ্রথিত করবে মস্তিষ্ক– এক উচাটন-উন্মাদ শোকে পাঠক তাতে সহজেই যোগসূত্র খুঁজে পাবেন, যদি তাঁর আত্মত্যাগ নিঃস্বার্থ প্রেমের নিমিত্ত হয়। সংসারীর অতৃপ্ত ন্যাকা দেহভাষা নয়। বাউলের দেহবন্দনা । আজ তবে  প্রেমালাপে সঙ্গীতময় হোক নগ্ন শরীরে। পুরুষ ঠোঁটে আর নগ্ন দৃষ্টির উন্মাদ প্রেমে কামার্ত শৃঙ্গারে নারী তুমি আভূষিত হও। আর নেশারু হোক অতৃপ্ত প্রেমের আগুন প্রেমিকার দেহরহস্যের জতুগৃহে। কারণ আজ অতিরিক্ত বাচনিক ক্রিয়াজাত অগ্নির উপশম হোক তোমার মাই চটকানো দুগ্ধ পানে ছটফটানি/ অস্থিরতা জাগ্রত হোক নবকল্লোলে প্রেমিকার মুখশ্রীর রন্ধ্রে রন্ধ্রে। তোমার ন্যাংটো তন্বী আজ হোক আমার উন্মুক্ত আরশি, স্বর্গসুখ পাই স্বীয় মুখদর্শনে আর এটাই আমার ভ্যালেনটাইন দিনের শ্রেষ্ঠ প্রাপ্তি। ষোলোকলায় উন্মুক্ত বিভঙ্গে আলতা চরণে রমণী তুমি তাই নিঃস্ব আজ আমি ঘুমহীন নৈঃশব্দে যন্ত্রনায় আবদ্ধ এক পাগল প্রেমী যার আজ আত্মধ্বংসের ভ্যালেনটাইন কার্ড বা গিফ্টপ্যাক  কাটা মাথার রক্তক্ষরণ। আজ তবে তার উচ্ছন্নে, প্রেমে, শরীর সার্বভৌম নয়, তাই আমি মাথা কেটে পাঠাচ্ছি যত্ন করে রেখো। জঙ্ঘাহীন তাই অনাবৃষ্টির শোক, তবুও তোমার যৌনগন্ধী বেড়ায় আবদ্ধ যোনির হাসিমারা অভয়ারণ্যে আশ্রয় নিক নিষ্পাপ স্কন্ধহীন দামাল পুরুষ প্রেমিক লক্ষ্মীতত্ত্ব জাগাক সে রাতপেঁচার শীৎকারে তুমিও আঙুলে জড়িয়ে তাকে, ঝড় তোলো, বিদ্যুত খেলাও।

 

মলয়ের কাটা মাথা তোমার কোলে রেখো, তোমাদের কোলে রেখো— কিন্তু মৈথুনানন্দে চিত্তপ্রাণ জাগে কপালে।কঙ্কালসার হিম  ন্যাংটো শরীর তোমার বিবর্জিত রোমন্থন শীৎকার কি করে আজ সম্ভব তোমার সাথে সঙ্গম, কেবল মাথার সাথে । আমিও নির্বাক সাতপাঁচ ভেবে কাপুরুষ ভীত শামুকের ন্যায় মাথা মাংসল যোনিকেশরে ঢুকে আত্মগোপন করি চন্দ্রাহত ওষ্ঠে। মনে আছে একদিন শতরূপা গৌরচন্দ্রিকায় আমার মুখশ্রীর লাবণ্যে হতদগ্ধ হয়েছিলে তুমি কিশোরী, বলেছিলে চলো পালাই, একসাথে তবেই অমাবস্যার চাঁদে আমাদের প্রেমের মোক্ষ প্রাপ্তি কিন্তু আমি কাপুরুষ ভীতু প্রেমিক কাঙাল তোমার প্রেমে। মলয় রায়চৌধুরীর ডিটেকটিভ বইয়ের প্রথম প্যারা আরম্ভ হয়েছে এক যুবতী এক পুরুষের হাত ধরে যখন বলেছিল, ‘চলুন পালাই’। সাহসিকতার মাস্তুলে জমেছে আজ অস্তরাগের বিষাদনৌকা, কেন ভাসাতে পারিনি সেদিন।

তুমিও শিহরিত,  কুন্ডলী পাকিয়ে দাঁতের কর্ষণে চুঁইয়ে পড়তে থাকে উঁচিয়ে থাকা অমৃতদুগ্ধ বোঁটার উষ্ণপ্রসবন সিঙ্গেল মল্ট হাঁ করা মুখে ঢালতে লেগেছো অনর্গল আর ঘামে দরদর করে ভিজে আমিও প্রাচীন পুরুষাঙ্গ বর্জিত ঠোঁটে ডুব দিই অতলান্ত অলকানন্দায়। তাঁর আনন্দ, নৃত্য, গীতিময়তা যেন র‌্যাবেলেস্ক ।

 

আমরা জানি মলয় রায়চৌধুরীর প্রিয় পানীয় হল সিঙ্গল মল্ট ও আবসাঁথ । বোদলেয়ার, র‌্যাঁবো, ভেরলেনেরও প্রিয় ছিল আবসাঁথ । স্লিভলেস ব্লাউজ তোমার ভিজে সপসপ অন্তর্বাস আর আমার বাউলসুলভ একা মাথার জরায়ুমুখে গৌড়ীয় লবণাক্ত লিঙ্গের কোন স্কোপ নেই আর। শুধু মস্তকের ঔদ্ধত্ব্যে আজ হতে খুব ইচ্ছা করে জ্যান্ত লকলকে জিব্রাগ্রীবা। উঁকি দিয়ে চতুরঙ্গ কৌশলে কোন লাউডগা উদোম করুক তোমায় আমার জিহ্বায় লুকানো তীক্ষ্ণ করাত। হস্তকরপদ্মহীন তাই রুদালির শোক আলিঙ্গনে লুপ্ত তোমার কষিয়ে বুকে জাপটে ধরার বাহুডোর। আজ তাই হতে চাই নিঃষ্পাপ সন্তান অঙ্গ বিবর্জিত তোমার কৃষ্ণগহ্বরের প্রসবে। আজ না হয় সম্ভ্রান্ত লাবণ্যরসে মাধুর্য আনুক রমণীয় লাস্যে তোমার উন্মোচিত জ্যোৎস্নাময় যোনির গোলাপপাপড়ি তাতেই শুষ্ক ফাঁটা ঠোঁট দিয়ে একটু আদর ঘষি আর তাতেই উদ্গীরন হোক  মায়াবী মাদকের সিঙ্গল মল্ট। লিঙ্গকলা উচ্ছেদ তাই আমাকে আর উলঙ্গ দেখার আতঙ্কে ভুগতে হবে না। আজ শুধু সম্রাট- মস্তকে হয়েছি জেহাদি। চোখ মুদে তবুও তোমার কস্তুরী ঘ্রাণের নাভিতে দিতে চাই আহুতি আমার চারুকলার কেশগুচ্ছের ঝিম ধরা মাতলামো। মার্জিত করো আজ আমায় কারণ আজ আমি এমন এক ব্যাধ যান্ত্রিক নখ ও দাঁতের শান দেওয়া অস্ত্রছাড়া তাই অসহায় হয়েছে তোমার হুক।

 

“বুড়ি” কবিতাটি মলয় রায়চৌধুরীর এক আশ্চর্য সৃষ্টি যেখানে বাউলের অন্তিম চরণে মোচড়ানো প্রেমিক  হৃদয়ে নিঃস্ব রিক্ততার শূন্যতার যন্ত্রণার সাথে মিলেমিশে একাকার তার বুড়ি স্ত্রীর প্রতি যে নাকি তার দিদিমার বয়সী:-

 

এই বুড়ি আমার দিদিমার বয়সী

চুল পেকে গেছে, কয়েকটা দাঁত

নেই, দিদিমার মতন শুয়ে থাকে–

কবে শেষ হয়ে গেছে পুজো-পাঁজি

ক্যালেণ্ডারে ছবি-আঁকা তিথি

দিদিমার মতো এরও প্রতিরাতে

ঘুম পায় কিন্তু আসে না, স্বপ্নে

কাদের সঙ্গে কথা বলে, হাসে

চোখে ছানি তবু ইলিশের কাঁটা

বেছে ঘণ্টাখানেকে মজে খায়

দিদিমার মতো, বলেছে মরবে

যখন, চুড়ি-নাকছাবি খুলে নিয়ে

পাঠাতে ইনসিনেটরে, এই বুড়ি

চল্লিশ বছর হলো সিঁদুর পরে না

পঞ্চাশ বছর হলো শাঁখাও পরেনি

দামি-দামি শাড়ি বিলিয়ে দিয়েছে

দিদিমা যেমন তপ্ত ইশারায়

দাদুকে টেনে নিয়ে যেতো রোজ

এও আমাকে বলে এবার ঘুমোও

আর রাত জাগা স্বাস্হ্যের পক্ষে

খারাপ, এই বুড়ি যে আমার বউ

বিছানায় শুয়ে বলে, কাউকে নয়

কাউকে দিও না খবর, কারুক্কে নয়–

এ-কথাটা আমারই, কাউকে নয়

কারুক্কে বোলো না মরে গেছি ।

 

“স্বচ্ছ দেওয়াল” কবিতায়—– একটি লজ্জার দেওয়াল প্রতি কুমারীর অলক্ষ্যে যুগে যুগে অনুরাগের আকাঙ্খায় জেগে থাকে  আর তার অধিবাস উন্মুক্ত হয় কোন যৌবনের বান ডাকে। ছিঁড়ে যায় সেই স্বচ্ছ দেওয়াল যার ভাঙা ও ভাঙতে দুটোতেই অনাবিল আনন্দ জেগে ওঠে।কোন আড়াল আর অবশিষ্ট থাকে না দুজনের মাঝে শুধুই এক আসন্ন-আনন্দের  নবাঙ্কুরের জন্ম:-

 

“দেওয়ালখানা

বাঁচিয়ে বাঁচিয়ে রাখছে

সেই যুবকের জন্য

যাকে সে ভাঙতে দেবে

যুবকেরা তবু গলদঘর্ম হয়

 

যে ভাঙছে তারও

অহমিকা নাচে ঘামে

রসের নাগর খেতাব মিলেছে

প্রেমিকের।

দেওয়ালখানা প্রেমের ঘামেতে ভিজিয়ে ফেলা দরকার।”

 

“অবন্তিকার শতনাম” কবিতায় ফিরে এসেছেন আধুনিক কবিতার বাউল মলয় রায়চৌধুরী ; দ্রাক্ষাস্তনে একাগ্রচিত্তে ধ্যানমগ্ন সন্ন্যাসীর জপমালা শীর্ণ কায়ার শ্বাসরুদ্ধ নাছোড়বান্দা আলিঙ্গনে শঙ্খিনী আড়মোড়া ভাঙে ভাঁজে ভাঁজে জেগে ওঠে পুরুষোত্তম ব্যাকুল উগ্র নিঃশ্বাসের উৎকোচে চাঁই বাঁধে শঙ্কা কাছ ছাড়া ফুটন্ত দুধে। অবন্তিকাকে একশো নামের ব্যঞ্জনায় জপে জাগ্রত হয় প্রেমিকের সদাজাগ্রত কুন্ডলীচক্র দৈহিক নবরসের পুঙ্খানুপুঙ্খ আলোড়নে শতনামে অবন্তিকা তোমায় খোঁজে। আমি অবন্তিকার দুটো মাইয়ের নাম দিয়েছি কৃষ্ণচূড়া আর রাধাচূড়া, বাঁদিকের বোঁটার নাম করেছি কুন্দনন্দিনী…বঙ্কিমের বিষবৃক্ষ তখন ও পড়ছিল চিৎ শুয়ে,প্যান্টির নাম পিকাসো যোনি তার কোন আদল আদরা নেই।ভগ্নাংঙ্কুরের নাম কোন মিষ্টান্ন দ্রব্য বিশেষ জিহ্বার লালার উৎসেচক।ওষ্ঠের নাম আফ্রিকান সাফারি আর পাছা দুটির নাম গোলাপসুন্দরী। উরুর নাম ককেশিয়া আরো কতক নামের শিরোপার ব্যাঞ্জনায় অবন্তিকার শতনাম মুক্তকন্ঠে জপ করছে কোন প্রেমের তপস্যায় লীন পাগল প্রেমিক।”—এরকম কবিতা কেবল মলয় রায়চৌধুরীই লিখতে পারেন, যা আনন্দের, উদ্দীপনার, প্রেমের, রসমগ্নতার, সহজিয়া, দেহসাধনার গান, মধুস্রাবী, তন্ময়তায় নিবিষ্ট । মধ্যবিত্ত কবিচেতনার বাইরে ।

 

“পপির ফুল” কবিতাটিও রহস্যময়—- এই কবিতায় মলয় রায়চৌধুরী পোস্তগাছের ফুল ও ফল নিয়ে লিখেছেন অথচ তা সান্ধ্যভাষায় । পোস্তফুলের রঙ গোলাপি, ফল সবুজ, আঁচড় দিলে আফিম তৈরি হয়, পেকে গেলে ফেটে পোস্তর বীজ পাই । কিন্তু  এই নিষিক্ত প্রেমে অধ্যুষিত পঙক্তিগুলো ছেঁকে তোলে রোমকূপে জেগে ওঠা ফুলেল শয্যার কমফর্ট জোন। নরম অঙ্গুলির পেন্সিলস্কেচে হালকা ছোঁয়ায় আঁচড়ে তন্বী-সঙ্গিনী কবোষ্ণ কব্জি জেঁকে বসে ঘনত্বে চারকোল শেডে রোমকূপে আসক্তি ক্যানভাসে। রামকিঙ্করের স্থাপত্যে সটান এলানো বিবস্ত্র কালীমূর্তি পদমূলে বিছানো তোরঙ্গ বলশালী সুউচ্চ গতর পুরুষালি সিংহনাদে  ইজেলে টানা রঙের তৈলচিত্রে মধুদ্রবনে মহাপরিনির্বান। সাতলহরীর ছন্দপতনের ঝংকারে ভার্জিন কলসের জল মুখ ডুবিয়ে আকন্ঠ পান করে যাও যত চেটে খাও তত নেশায় আদম হয়ে ওঠো। রাতের পোশাকের খোলসের তলায় স্তন দৃঢ়মুষ্ঠিতে পিচ্ছিল দলিত স্তনের গোলাপী রঙে আবিষ্ট বোঁটায় অসমাপ্ত চুম্বন আঁকড়ে ধরে শেষটুকু আবরন চাদরে অবন্তিকা তুই ইরটিক প্রেমের আগার :-

“বোঁটায় তোর গোলাপ রঙ অবন্তিকা

শরীরে তোর সবুজ ঢাকা অবন্তিকা

আঁচড় দিই আঠা বেরোয় অবন্তিকা

চাটতে দিস নেশায় পায় অবন্তিকা

টাটিয়ে যাস পেট খসাস অবন্তিকা”

 

“নেভো মোম নেভো” কবিতা মলয় রায়চৌধুরী লিখেছেন লেডি ম্যাকবেথকে নিয়ে ; লেডি ম্যাকবেথ মোমবাতি নিয়ে পাগলের মতো ছুটছেন :-

 

“পাছার দু-ঠোঁটে, আহা কি মসৃণ হতো রাজরানি হওয়া, যেন ইস্কাপন

নষ্ট করে নেচে উঠছে বিদ্যুতের খ্যাতি, যার অস্তিত্বে আমি বিশ্বাস করি না

আগুন নগ্নিকা, বুক দুটো অতো ছোটো কেন

লেডি ম্যাকবেথের লোভ সিংহাসনে রাজমহিষীর মতো উঁচু বুকে

বসে আছো, স্কুল-ফেরত সম্পূর্ণ উলঙ্গ তুমি হাঁটছো পাশাপাশি

তেমন নারীও, আত্মজীবনীতে লিখবেন কিন্তু প্রথম হস্তমৈথুনের স্বাহা

ক্লিটোরিসে অঙ্গুলিবাজনার মৃদু উগরে-তোলা ঝর্ণাঝংকার।”

 

“রাবণের চোখ” কবিতা মলয় রায়চৌধুরী লিখেছেন কুলসুম আপাকে নিয়ে । তাঁর আত্মজীবনীতে আমরা জেনেছি কৈশোরে মলয় রায়চৌধুরী তাঁদের বাড়িতে হাসের ডিম কিনতে যেতেন । কুলসুম আপা তাঁকে মাংস খাইয়ে বশ করে একদিন রেপ করেছিলেন, কবিতাটির পৃষ্ঠভূমি পাঠক যদি জানতে না পারেন তাহলে এই কবিতার ভিতরে প্রবেশ করতে পারবেন না :-

শৈশবের কথা । সদ্যপ্রসূত কালো ছাগলির গা থেকে

রক্ত-ক্বাথ পুঁছে দিতে-দিতে বলেছিল কুলসুম আপা

‘এভাবেই প্রাণ আসে পৃথিবীতে ; আমরাও এসেছি

একইভাবে’ । হাঁস-মুরগির ঘরে নিয়ে গিয়ে আপা

আমার বাঁ-হাতখানা নিজের তপ্ত তুরুপে চেপে

বলেছিল, ‘মানুষ জন্মায় এই সিন্দুকের ডালা খুলে’ ।

রাবণের দশজোড়া চোখে আমি ও-সিন্দুক

আতঙ্কিত রুদ্ধশ্বাসে দ্রুত খুলে বন্ধ করে দিই ।

 

“জ্যামিতির উৎস”  কবিতায় মহালয়ায় বীরেন ভদ্রর চণ্ডীপাঠকে দূর্গার পরিবর্তে দেবী অবন্তিকার ক্ষেত্রে প্রয়োগ করেছেন মলয় রায়চৌধুরী । সৃষ্টির রহস্যের উন্মোচনে বাউল-প্রেমিকের সংলাপে। সিকোয়েন্স এ সৃষ্টিকর্তাদের সৃষ্টি সুখের উল্লাসে অনুভবকে আঙ্গিক দিয়েছে প্রেমিকার শরীরের প্রতি আঁকে বাঁকে অপরূপা তিলোত্তমার সৃষ্টি। অবন্তিকাই কবিতা, তাঁর নিজের কবিতার বৈশিষ্ট্য তুলে ধরেছেন মলয় এই কবিতায়:-

 

অবন্তিকা বললি তুই :

নৌকো মাতাল হতে যাবে কেন ? এ-যুগে সমুদ্রটা নিজেই মাতাল !

আমি বললুম :

যত জ্যামিতি কি শুধু তোরই দখলে ? কার কাছ থেকে পেলি ?

অবন্তিকা বললি তুই:

আর্কিমিডিস দিলেন দেহের ঘনত্ব !

রেনে দেকার্তে দিলেন শরীরের বাঁকগুলো !

ইউক্লিড দিলেন গোপন ত্রিভূজ !

লোবাচোভস্কি দিলেন সমন্বিত আদল !

ব্রহ্মগুপ্ত দিলেন মাংসময় বুকের নিখুঁত বর্তুলতা!

শ্রীধর দিলেন আয়তন !

নারায়ণ পণ্ডিত দিলেন দৃষ্টি আকর্ষণের ক্ষমতা !

আর তুই কী দিলি ? অক্ষরে সাজানো যত ফাঁকা মন্তর ?

আমি বললুম :

আমি দিয়েছি প্রেম !

অবন্তিকা তুই বললি :

প্রেম তো আলো হয়ে বেগে আসে আর তত বেগে চলে যায় !

 

সাম্প্রতিক কালে মলয় রায়চৌধুরী নিজের কবিতাকে বলেছেন ডোমনি ; বাউল মলয়ের কাছে কবিতাই তাঁর দয়াল, মলয় স্বয়ং একজন সাঁই । এই কবিতার নাম ‘মলয় সাঁইয়ের গান’:-

 

ডোমনি, তুইই দয়াল, কালো জাগুয়ার চামড়ায় মোড়া দেহ তোর

দু’জনে ধুলোয় গড়াগড়ি দিয়ে যা শিখেছি তা পশুসঙ্গের মহাবোধ

ডোমনি, তুইই দয়াল, ঘামের ত্বকে মোড়া বিকেলের পাঁকবিলাসিনী

পুলিশের গুলি খেয়ে কিশোরী বয়সে তুই খোঁড়া হয়ে গেলি

ডোমনি, তুইই দয়াল, মেছুনির হাজা-হাত, কাগজকুড়ানিয়াফাটল-গোড়ালি

কী করে মগজে নিয়ে যাবো সুষুম্নার মুখে ইড়ার রাস্তায় জড়ো করা বীজ

ডোমনি, তুইই দয়াল, বন্দু ধারণের যোগ্য করে তুলবি কবে

দম নেবো আর ছাড়ব না দঞ যাতে কুম্ভকে থাকি বহুক্ষণ

ডোমনি, তুইই দয়াল, পচা মাংসের গন্ধ তোর মুখে, ঠোঁটেতে কাকের রক্ত

তোর লবণামৃতে সকাল-সন্ধে চান করিয়ে পাপিষ্ঠ করে তুলবি আমাকে

ডোমনি, তুইই দয়াল, শ্রেনিহীন করে দিস, আমিশাষী রসে

নাভিচক্রে কাতুকুতু থিতু করে আসক্তির স্বর্ণলতা দিয়ে মুড়ে দিস

ডোমনি, তুইই দয়াল, বলে দে কেমন করে কুণ্ডলনী চক্র জেগে যাবে

তর্জনীতে অষ্টগুণ ধরে রাখবার ক্রিয়া তোয়াক্কাবিহীন করে দিবি

ডোমনি, তুইই দয়াল, আমাকে যথেচ্ছাচারী মূর্খ করে তোল

নিরক্ষর হয়ে যেতে চাই, অশুদ্ধচিত্ত, নির্বোধ, কমলকুলিশ

ডোমনি, তুইই দয়াল, হাত ধরাধরি করে ডুব দিই বিষ্ঠার পাঁকে

 

“মলয়দাস বাউলের দেহতত্ব” কবিতায় মলয় রায়চৌধুরী আধুনিক জীবনের কর্মব্যস্ত নারীদের বাউল-সঙ্গিনীর আসনে বসিয়েছেন, কবিতা হয়ে উঠেছে অধুনান্তিক, উত্তরাধুনিক, প্রেমিকার প্রয়োজনও উত্তরাধুনিক দেহবন্দনার গুপিযন্ত্র  :-

ডোমনি, তুইই দয়াল, যখন বিদেশে যাস কেন রে আনিস কিনে সেক্সটয় ?

ভাইব্রেটর, ডিলডো, বেন-ওয়া-বল, গুহ্যের মুক্তমালা ?

ডোমনি, তুইই দয়াল,জানি কেন বিডিএসএম কবিতার বই এনেছিস,

জি-বিন্দু হিটাচির ম্যাজিকের ছড়ি ? নিপল টিপে কাঁপাবার ক্লিপ ?

ডোমনি, তুইই দয়াল, হাত-পায়ে দড়ি চোখে ঠুলি আমাকে চেয়ারে

উলঙ্গ বেঁধে রেখে দিয়েছিস, নিজের ফাঁস খুলে তলাতল রক্তের স্বাদটুকু দিলি

ডোমনি, তুইই দয়াল, শুদ্ধ প্রেমে মজল যারা কাম-রতিকে রাখলে কোথায়

চাবুক মারিস তুই, চুলের মুঠি ধরে ক্ষিরোদধারাকে চুষে বের করে নিস

ডোমনি, তুইই দয়াল, চাতক স্বভাব নাহলে অমৃতের দুধ তুই দিবিনাকো

আমার খিদে নেই, মুখের ভেতরে কৃষ্ণের বিশ্বরূপ খেয়ে মজে গেছি

ডোমনি, তুইই দয়াল, যতো ইচ্ছে আনন্দ কর, দেহ নিয়ে খেল

আমি একটুও নড়ব না, আহ উহ করব না, যতো চাই ধাতুবীজ নিস

 

পরিশেষে বলি,  মলয় রায়চৌধুরীর প্রেমের কবিতার পর্যালোচনার বিশ্লেষণে এইকথা নিঃসন্দেহে বলা যেতে পারে যে প্রত্যেকটি সৃষ্টিতে চাক্ষুষমান এক পজিটিভ ইরটিসিজম, এক বেপরোয়া উন্মাদ প্রেমের রসানুভূতি,  যাতে তাঁর প্রেয়সীর আঙ্গিক মাধুর্যে চিত্রিত হয়, মধুবনীপটের সান্ধ্যভাষায় রঙীন লৈখিক-চিত্রে বর্ণিল হয়ে ওঠে পাঠক-পাঠিকার মনের ও দেহের জগত ।

 

 

 

 

Comments

Popular posts from this blog

রাহুকেতু : মলয় রায়চৌধুরীর উপন্যাস

Image

চশমরঙ্গ

Image

লাবিয়ার মাকড়ি

Image

Comments

Popular posts from this blog

কফিহাউসে চেঙ্গিজদা, ল্যাঙড়াদা, গুলপিসি...অ্যান্টি-হিস্ট্রির আড্ডা : মলয় রায়চৌধুরী লিখিত পৃথিবীর ইতিহাস

প্রদীপ চৌধুরী, ফরাসি কবি, বাঙালি কবি, হাংরি আন্দোলনের কবি : মলয় রায়চৌধুরী

Malay Roychoudhury interviewed by Anupam Mukhopadhyay