Malay Roychoudhury's Erotic Novella "ARUP TOMAR ENTOKANTA"

 

মলয় রায়চৌধুরীর ইরটিক উপন্যাস

 ‘অরূপ তোমার এঁটোকাঁটা’

 

         উৎসর্গ

                                       অনির্বাণ মুখোপাধ্যায়, অনুপম মুখোপাধ্যায় ও অর্ক চট্টোপাধ্যায়

          যাদের কাছ থেকে কত কিছু শিখেছি

তাদের সশ্রদ্ধায়

১. একটি শিশিরবিন্দু

শিশির অফুরন্ত………………………………………………………………………………………………….হ্যাশ এবং হুস্ন ; মেরি ও মেরিহুইনা; পাতা আর পতন; বিদেশিনী ও ছিনিমিনি । দু-মাসের মাইনে নিয়ে একমাসের জন্য চলে এসো । তাড়াতাড়ি ।……………………………………………………………………………………………………… অতুল মূর্খ

আতুলদাস মুখোপাধ্যায়ের মেয়ের মেয়ে, অর্থাৎ নাতনি,  ইন্দিরা ব্যানার্জি, শিশির দত্ত নামে কোনো একজনের নামে, বর্ধমানের ঠিকানায় লেখা পোস্টকার্ডটা, যাতে তারিখ নেই কিন্তু পোস্টঅফিসের ছাপ থেকে তার জন্মেরও আগের বলে মনে হয়েছে, প্রয়াত দাদুর একটা ডায়েরির মধ্যে পাবার পর, কৌতুহলবশে শিশির দত্তকে পোস্টকার্ডের জেরক্সসহ চিঠি লিখে জানতে চেয়েছিল, তিনি এ-ব্যাপারে আলো ফেলতে পারেন কিনা ।

বাংলা পড়তে-লিখতে জানে না বলে ইন্দিরা ব্যানার্জি ইংরেজিতে জানিয়েছিল যে, রেক্সিনে বাঁধানো খাতাটি, অর্থাৎ ডায়েরিতে, তিনরকমের হাতের লেখা রয়েছে, একজনের অংশই বেশি ;তবে সনতারিখ দেয়া রোজনামচা নয় । মা-বাবা, বড়মামা ও তাঁর পাঞ্জাবি স্ত্রী, ছোটোমামা, কেউই বাংলা জানেন না । দিদিমা কেবল জানেন, কিন্তু তাঁকে বা অন্য কাউকে পড়তে দিলে ঝামেলা হলেও হতে পারে । ই-মেল আইডি পাঠিয়ে যোগাযোগ করতে বলেছে ইন্দিরা ।

বর্ধমানের আদিবাড়ি বেচে বহুকাল আগে কলকাতায় চলে এসেছেন শিশির দত্ত, যিনি এখন সল্টলেকের বাড়িতে দোতলায় চব্বিশঘন্টা দিন-মাইনের নার্স-আয়ার রুটিনবদ্ধ পরিচর্যায় থাকেন, দেড় বছর হল পক্ষাঘাতে বিছানায় । শিশির দত্তের স্ত্রী, যিনি শিশির দত্তের চেয়ে তেরো বছরের ছোট, প্রেম করেই বিয়ে করেছিলেন, পুজো-টিভি-প্রৌঢ়াদের আড্ডায় ব্যস্ত । মেয়ে ঝিমলি বিয়ে করে সফটওয়ার ইনজিনিয়ার স্বামী আর ছেলের সঙ্গে বেঙ্গালুরুতে ।

রিডায়রেক্ট হয়ে বর্ধমান থেকে ইন্দিরার চিঠি শিশির দত্তর সল্টলেকের বাড়িতে পৌঁছতে একমাস লেগেছিল । ছেলে, বহুজাতিকে মার্কেটিং অফিসার সুবীর, যে বাবার সঞ্চয়, ইনকাম ট্যাক্স, নিবেশের  ওয়ারেন্ট, চিঠিপত্র ইত্যাদি সামলায়, ইন্দিরার সঙ্গে যোগাযোগ করে, নিয়মিত চ্যাটিং, ফোটো এম এম এস, এমেলে ফোটো আপলোড ও ফ্লার্ট করার শেষে  ডায়েরির রহস্য উদ্ঘাটনের জন্য মাস ছয়েক পরে, অফিসের কাজ নিয়ে মুম্বাইয়ে, ইন্দিরার প্রভাদেবী পাড়ার বহুতল ফ্ল্যাটের কাছে ওরলিতে হোটেলে উঠেছে ।

কমপিউটর মনিটর আর মোবাইল স্ক্রিনে যেমন দেখেছিল, কন্ঠস্বর যেমন শুনেছিল, তার চেয়ে পরস্পরকে বেশি আকর্ষক মনে হল সুবীর ইন্দিরার, বান্দ্রার উডিপি রেস্তরাঁয় অফিস-ফেরত বড়া-পাও খেতে-খেতে । সুবি আর দিরা, ডাকনামের আদানপ্রদান হয়ে গেছে এসএমএস, ইমেল, স্কাইপ, চ্যাটিং পর্বের শুরুতেই ।

প্রথম সাক্ষাতে ওরা বেশ কয়েকটা নির্ণয় নিয়ে নিল, প্রজেক্ট রিপোর্ট তৈরির ধাঁচে । চ্যাটিং আর ইমেল স্কাইপে মোবাইলে যা এতদিন ইউ পর্যায়ে ছিল, তা এবার বাংলায় তুমি সম্বোধনে রূপান্তরিত হোক । অফিসের পর প্রতিদিন কোথায় দেখা হবে তা দুপুরে ফোন করে ঠিক করা হবে । ইতিমধ্যে হাতের লেখার পার্ধক্য অনুযায়ী এক-দুই-তিন-চার করে ডায়েরিতে সংখ্যাচিহ্ণ বসিয়ে দিক ইন্দিরা ; বাংলা পড়তে না জানলেও হাতের লেখার পার্থক্য দেখে বর্গীকরণ করতে অসুবিধা হবে না । শনিবার সন্ধ্যায় দাদরের সমুদ্রতীরে, যেখানে বহু বেহায়া যুবক-যুবতী অশালীন ডেটিং করে, ওরাও করবে ; পাঁচতারা হোটেলের  রেস্তরাঁর তুলনায় এই প্লেবিয়ান ডেটিঙের পৃথক যৌনতাবোধ আছে, বেশ আদিম-আদিম ।

ইন্দিরা দুবছর আগে এক গুজরাতি যুবককে বিয়ে করে ছ’মাস পরে ডিভোর্স করে দিয়ে থাকলেও, সুবীর ওদের বাড়িতে রবিবার নিমন্ত্রিত হয়ে ইন্দিরার মা-বাবার কাছে বিয়ের প্রস্তাব রাখবে । ইন্দিরা চেয়েছিল ওরা লিভ-টুগেদার করে কয়েক বছর থেকে নিক; পছন্দ হলে বিয়ে করে নেবে নয়তো যে যার যেদিকে ইচ্ছে চলে যাবে । সুবীর প্রত্যুত্তরে জানিয়েছে বনিবনা না হলে ডিভোর্স করে আলাদা হয়ে যাওয়া ভালো ; নয়তো আত্মীয়-স্বজনদের সঙ্গে মেলামেশা আর মধ্যবিত্ত সমাজে চলাফেরা গোলমেলে হয়ে উঠতে পারে । শেষ পর্যন্ত ঠিক হয়েছে যে বিয়ে করে নিলেও তার আগে কোর্টের কাগজে চুক্তি সই করে নেবে যে ডিভোর্স হলে টাকাকড়ি ভাগাভাগি হবে না, ছেলেপুলে হবে না আপাতত পাঁচ বছর । সোমবার ছুটি নিয়ে সুবীরের হোটেলঘরে সকাল থেকে ডায়েরির রহস্য উদ্ধারে দুজনে মাথা ঘামাবে ।

বছর তেইশের ইন্দিরা ব্যানার্জি তেমন ফর্সা নয় । পাতলা ঠোট, ববকাট গ্লোবাল রঙের চুল, পাতলা ফ্রেমের চশমায় ওর বুদ্ধির দীপ্তি আরও উজ্জ্বল । সব সময় রঙিন টপ, ফেডেড জিনস, টপের রঙে ম্যাচিং স্পোর্টস জুতো । দু’হাত নাড়িয়ে কথা বলার অভ্যাস, যার অধিকাংশ শব্দ ইংরেজি, যৎকিঞ্চিৎ বলিউডি হিন্দির মিশেল দেয়া । মাছভাত ভালোবাসে । বিয়ে করলে বাঙালি মতে বিয়ে করতে চায় ; গুজরাতি বিয়ের আচার-খাওয়া দাওয়া পছন্দ হয়নি ।

ইন্দিরা রুপারেল কলেজ থেকে ইংরেজিতে স্নাতক হবার পর বিজ্ঞাপনে ডিপ্লোমা করে যে কোম্পানিতে কাজ করছে, তারা ওকে কলকাতা অফিসে গিয়ে দায়িত্ব নিতে বললেও, এতকাল রাজি হয়নি, চেনাজানা মহল নেই বলে । সুবীরের মনে হয়েছে মেয়েটা জেদি আর আত্মবিশ্বাসী ।

সুবীরের মধ্যবিত্ত বাঙালিয়ানা, যা ওর স্যুট-টাই ল্যাপটপেও আড়াল পড়ে না, আকর্ষণ করেছে ইন্দিরাকে । বাবা শিশির দত্ত গিটার বাজাতেন , শিশিরকেও গিটার বাজানো শিখিয়েছেন । বাবা গিটারে পাশ্চাত্য সুর ভালোবাসতেন । সুবীর পাশ্চাত্য ব্যান্ডগুলোর গান ভালোবাসে কিন্তু রবীন্দ্রসঙ্গীতের সুরও গিটারে বাজাতে ভালোবাসে । সুবীর সবরকম খাবার খেতেই ভালোবাসে ; তাইওয়ানে অফিসের কাজে গিয়ে বেঁজি-বিড়াল-কুকুরের মাংসও খেয়েছে ।জিম-যাওয়া ফর্সা ছয়ফিটের উদারস্বভাব সুবীরকে নিজের পাঁচ ফুট সাত ইঞ্চের সঙ্গে মানানসই লেগেছে ইন্দিরার । গুজরাতি বর হিমেশ ওর চেয়ে একইঞ্চ ছোটো ছিল ; ফর্সা ছিল না, যদিও অঢেল টাকাকড়ি ওদের পরিবারে । বনিবনা হয়নি ওরা বড় রক্ষণশীল পরিবার, তাই ; এমনকি ওদের ঠাকুর দেবতাগুলোও অচেনা-অজানা ।

কাফে কফি ডে, বারিস্তা, ইরানি হোটেল ইত্যাদিতে অফিস ফেরত কুচিকুর পর, শনিবারের ডেটিঙে ওরা খুশি । দাদর সমুদ্রতীরের অন্ধকারে সবাই যা করে, ওরা-ও তা-ই করেছে । বালিতে তোয়ালে পেতে দেয়ালে ঠেসান দিয়ে বসেছে । আকাশে তারা উঠলে, সুবীরের কোলে বসেছে ইন্দিরা ।

রবিবারের লাঞ্চে ইন্দিরাদের বাড়ি গিয়ে বিয়ের প্রস্তাব দিতে, সুবীরকে ইন্দিরার মা-বাবা নির্দ্বিধায় গ্রহণ করেছেন, সম্ভবত ডিভোর্সি মেয়ে এত ভাল বাঙালি বর পাচ্ছে বলে । সুবীরের পড়াশুনা, চাকরি, মাইনে, গাড়ি, ফ্ল্যাট ইত্যাদি জেনে ওনারা সন্তুষ্ট । ফ্ল্যাটটা ইন্দিরার দিদিমার, যিনি প্রায়-বধির বলে ওনার ঘরে জোরে টিভি চালিয়ে শাহরুখ খানের প্রেমডান্স বা সলমান খানের মারামারি দেখছেন ।

পাশের ফ্ল্যাট থেকে বড়মামা-মামি দেখা করে গেলেন । দুজনেই সোনি টিভির সিরিয়ালে অভিনয় করেন । হিন্দি সিরিয়াল সুবীর দেখে না, সংবাদ ছাড়া টিভিতে ও প্রায় কিছুই দেখে না, সৌজন্য দেখিয়ে ওনাদের অভিনয়ের প্রশংসা করল । স্ত্রী পাঞ্জাবি টিভি-সুন্দরী, প্রধানত খলনায়িকার অভিনয় করেন । বড়মামা  বেশ ফর্সা,  সায়েবি-রঙের ফর্সা, ঢ্যাঙা,  তবে নায়ক-টাইপ মুখ নয়; না হলেও নায়কের অভিনয় দিয়ে শুরু করেছিলেন । মাইমা পাঞ্জাবি হবার দরুণ হিন্দি-ইংরেজি মিশিয়ে কথা বললেন ।

ছোটোমামা, যিনি নাকি দেখতে-শুনতে ভাল,  একসাইজ বিভাগে বড়সড় পদে, থাকেন বান্দ্রার সরকারি আবাসনে, বিয়ে করেননি, করবেন না । কতবার যে প্রেম করেছেন সেই কলেজের দিন থেকে,  দিদিমাও বিরক্ত, বলেন তোর গায়ে রক্তের দোষ । কেউ প্রসঙ্গ তুললে বলেন, অলওয়েজ সিঙ্গল রেডি টু মিঙ্গল থাকতে চান ।

সোমবার ডায়েরিতে সংখ্যাচিহ্ণ বসিয়ে-বসিয়ে, সুবীরের হোটেলের শীততাপ নিয়ন্ত্রিত ঘরে পৌঁছে গেল ইন্দিরা, বাড়ি থেকে ব্রেকফাস্ট করে । টেবিলে ঠ্যাং তুলে, সোফায় হেলান দিয়ে, রেক্সিনে বাঁধানো খাতা বা ডায়েরি পড়া শুরু করল সুবীর । বিছানায় পা ছড়িয়ে, দেয়ালে বালিশ উঁচু করে, ঠেসান দিয়ে ইন্দিরা । শুনছে চোখ বুজে । এসি চলছে সুইঙে । চুমুক দেবার জন্যে বিয়ারের আধ ডজন টিন ।

লেখাটা আমি এই নিয়ে চারবার পড়লুম । এতদিনে পড়ার ফুরসত হল । মেয়ে আর ছেলেরা বড় হয়েছে । যে যার কাজে-টাজে ব্যস্ত । আমি ঝাড়া হাত-পা । অবশ্য, কাছের জিনিস দেখার চশমা নিতে হয়েছে আজ আট বছর । কানেও কম শুনি, এক কালে ফি হপ্তায় সিনেমা হলে গিয়ে ফিলিম দেখার ফল । কদিন ধরে ঘর বন্ধ করে পড়লুম । পড়ে মনে হচ্ছে, আমারও অনেক কথা বলার আছে । ফাঁকে-ফাঁকে যেখানটায় লেখা হয়নি, শিশির আর নির্মলের বাবা যে পাতাগুলো ছেড়ে দিয়েছে; হয়ত আমার  জন্যেই । সেখানে আমার কথাগুলো ঢোকাবো । অগাকান্ত বজ্জাতটা এসব লিখতে গেল কেন জানি না । বোধহয় লেখারও একটা মজা আছে, সব ঘটনা আরেকবার করে ঘটিয়ে তোলা যায় । কিন্তু লিখলি তো লিখলি, এই বিদকুটে মাস্টারি-মার্কা বাংলায় কেন ? সোজা বাংলায় লিখতে গেলে নোংরা করে ফেলতিস, তাই না ? যা একখানা নোংরা কিসিমের ইচ্ছুক ছিলিস তুই !  জানিস শিশু, আজও তোর দেয়া সেই দিনগুলোর কথা ভাবলেই শরীর আনচান করে, তোকে খুঁজে বের করতে ইচ্ছে করে, আরেকবার দুজনে ইচ্ছুক-ইচ্ছুকনি হয়ে ওঠার খাঁই জাগে ।

জীবনটা যে মাংসের উৎসব তা কেন মেনে নেয় না লোকে । আমার শরীরের রক্তমাংসে আমি উৎসব ঘটাব তো তাতে কার কী করার আছে ! বেঁচে থাকা ব্যাপারটা হল এই উৎসবকে সারা জীবন ধরে পালন করে যাওয়া । অবিরাম, অবিরাম, অবিরাম । মনের শান্তি এছাড়া কেমন করেই বা পাবো, কেউ বোঝাক আমাকে । জীবন তো একবারই । তাহলে নিজের জন্যে বাঁচব না কেন ? পল থেকে পল, সবসময় নতুন ; শিশির দেখিয়ে গিয়েছিল সেই পথটা , যে পথটা আমি জানতেই পারিনি শিশিরকে পাবার আগে । ভালবাসা ভালবাসা ভালবাসা ভালবাসা । উন্মাদিনীরা ছাড়া ভালোবাসার কথা আর কেউ বলতে পারে না । নিজেকে ভালবাস, হ্যাঁ, নিজেকে নিজেকে, আর অমন ভালবাসার জন্যে যা ইচ্ছা হয় করো ; ভালবাসার জন্যে বেপরোয়া হতে হবে ।

সৌভাগ্য, যে অতুলের পোস্টকার্ডটি নির্মলদা, আমাদের পাড়ায় যিনি ডাকে-আসা চিঠি বিলি করেন, আমার হাতেই দিয়াছিলেন । বাড়িতে দিবার জন্য বাবার নামে ডাকে-আসা চিঠিগুলি নির্মলদা কিন্তু আমাকে না দিয়া গেটে বসানো কাঠের লেটারবক্সে ফেলিলেন । পোস্টকার্ডটি যে নির্মলদা পড়িয়াছিলেন সে-বিষয়ে আমি নিশ্চিত, নতুবা চিঠিটি আমার হাতেই বা কেন গুঁজিয়া দিবেন । ভালই । বেনারসে কোনো অঘটন ঘটিয়া গেলে যদি গৃহে প্রত্যাবর্তন করিতে না পারি, নির্মলদা আমার বেনারস-অ্যাডভেঞ্চারের সংবাদ মা-বাবাকে দিবেন ।

অফিসে ছুটি মঞ্জুর করাইতে পাঁচ দিন লাগিল । বাড়িতে বলিলাম বন্ধুগণের সহিত কাশ্মীরে বেড়াইতে যাইতেছি । গিটারটি সঙ্গে লইয়াছি, যাহাতে গৃহে সন্দেহের উদ্রেক না হয় ।

বেনারসের যে ঠিকানা অতুল দিয়াছিল, তাহা অতুলের স্হানীয়  চিত্রকর বন্ধু নির্মল রক্ষিতের ছবি আঁকার স্টুডিও । বিশাল বনেদি বাড়ির একাংশ।

বাঙালিটোলার জীর্ণ পুরাতন পৈতৃক অট্টালিকার দীর্ঘ হলঘর রূপান্তরিত হইয়াছে নির্মলের ছবি আঁকার স্টুডিওয় । হলঘর-সংলগ্ন গেস্টরুমে আমার সুটকেসটি টেবিলে রাখিয়া নির্মল কহিল, আপনি স্নানাদি সারিয়া লউন, আমার একজন মডেল অপেকআ করিতেছেন, পেইনটিঙের আউটলাইনটি অদ্য সারিয়া লইব । তাহার পর আপনার কথা শুনিব । অতুল আমাকে আপনার আগমনের বার্তা দেয় নাই, তবে উহার মুখে আপনার গল্প শুনিয়াছি, গিটার বাদ্যের কথা শুনিয়াছি ।

ট্রেনের ক্লান্তি অপনোদনের জন্য ভালভাবে সাবান মাখিয়া, শ্যাম্পু করিয়া, স্নান সারিয়া, পোশাক পরিবর্তন করিয়া, অন্ধকার হলঘরে প্রবেশান্তে চোখ ধাঁধাইয়া গেল ।

অন্ধকার হলঘরে স্ট্যান্ড-বাতির বৈদ্যুতিক আলো যাঁহাকে ফোকাস করিয়াছে, তিনি সম্পূর্ণ উলঙ্গ একজন যুবতী শ্বেতাঙ্গিনী, পুরাতন অ্যান্টিক সোফায় হেলান দিয়া, পা ছড়াইয়া, পোজ দিয়াছেন , এবং নির্মল সিগারেট ফুঁকিতে-ফুঁকিতে একমনে তাঁহাকে ক্যানভাসে তুলিয়া আনিতেছে ।

অন্ধকারে, উহাদের অলক্ষ্যে, ছবি আঁকার বহুবিধ পরিত্যক্ত জঞ্জালের আড়ালে, টুলে বসিয়া পড়িলাম । নিঃশব্দে । রক্তমাংসের নগ্ন শ্বেতাঙ্গিনী  যুবতীদেহ আমি ইতোপূর্বে দেখি নাই, আলিঙ্গনে পাওয়া তো দিবাস্বপ্ন । অমন একখানি মাখননির্মিত দেহ, সেই দেহের আলো, অন্তত কিয়ৎক্ষণের জন্য, নিজ তপ্ত নিয়ন্ত্রণে পাইব বলিয়া এতদূর ছুটিয়া আসিয়াছি ।

নির্মল, জানি না, কোন জাদুবলে নিজেকে নারীদেহের প্রতি উদাসীন ও নির্লিপ্ত  এবং ছবি আঁকার প্রতি একাগ্র ও মগ্ন রাখিয়াছে । শ্বেতাঙ্গিনী ্‌ইতে এত তফাতে বসিয়াও আমার সরীর টাটাইয়া উঠিতেছে । আনকোরা উত্তেজনা দমনে হইতেছি উত্তাল ; শব্দ করিয়া ফেলিতে পারি এই আশঙ্কায় পায়ের উপর পাও রাখিলাম না ।

কলেজে-বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়িবার সময়ে, সমস্বভাবী সহপাঠীগণের সহিত বিভিন্ন শহর ভ্রমণকালে, এবং কর্মোপলক্ষ্যে একা গিয়াও, নারীদেহের রুচিশীল সান্ধ্যবাজারে ঢুঁ মারিয়াছি । ভারতীয় নারীগণের নানাপ্রকার দেহ নাগালের অন্তর্গত করিয়াছি । এরূপও হইয়াছে যে যুবতীর দেহটি  সম্পূণ বোধগম্য কিন্তু তাহার ভাষাটি নহে । অদ্য স্পষ্ট হইল যে আশ সম্পূর্ণ করিবার কিছু বাকি রহিয়া গিয়াছে ।

কিছুক্ষণ বসিয়া থাকিবার পর ঘরের সোঁদাল গন্ধ নাকে আসিলে, নির্মল এবং বিদেশিনী মডেলের নির্লিপ্তির কারণ বোধগম্য হইল । উহারা নিঃসন্দেহে গাঁজাপাতা, মারিহুয়ানা অথবা চরস সেবন করিয়াছে । আমাদের বর্ধমানের বাড়ির পূর্বতন দারোয়ান সর্বসমক্ষে এই নেশা করিত বলিয়া চাকরি খোয়ায় । কোনও-কোনও গিটারসঙ্গীও গোপনে এই নেশা করে, বাজাইবার সময়ে একাগ্রতার উদ্দেশ্যে । আমি তেমন প্রয়োজন বোধ করি নাই ।

নির্মল কেবল আউটলাইন আঁকিতে ছাহিলে ভারতীয় নারীদেহ দিয়া কাজ চলিত । উহাতে পরে বা প্রতিদিনই মাংস ভরিবার কাজ চলিবে । নয় কি ? মনে প্রশ্ন উঠিল ।

ক্ষুধায় আমার পেট ডাকিতেছে । তবুও চক্ষের উজল-পাঁজল ক্ষুধা তাহার চেয়েও তীব্র । মনে হইতেছে এইভাবে নিজেকে গদগদ আহ্লাদের জ্যোতিতে আবরিত রাখি, এবং বিদেশিনীর দেহ হইতে নির্গত তেজোপূঞ্জ আহরণ করিয়া অবিনশ্বর করিয়া তুলি ওই আহ্লাদকে । এই ক্ষুধা না মিটিলেই যেন শ্রেয় ।

খেয়াল করিলাম, আমি এতক্ষণ কেবল বুক হইতে হাঁটু পর্যন্ত দৃষ্টির আনাগোনা সীমাবদ্ধ রাখিয়াছি । মুখশ্রীতে দৃষ্টি নিবদ্ধ করিলাম । গোলমুখ, চওড়া কপাল, ছোট-ছোট চক্ষুদ্বয়, সামান্য চাপা নাক, না-আঁচড়ানো সোনালি চুল । অর্থাৎ মুখটুকু দেখিলে এই নারী আকর্ষণ করিত না । শিল্পী চিত্রকর নির্মল রক্ষিত যে নৈপুণ্যে পোশাকের অন্তরালে গচ্ছিত রক্তমাংসের তুলতুলে দেহটিকে চিহ্ণিত করিয়া যুবতীটিকে স্টুডিওতে আহ্বান করিয়াছে, আমার সেই শৈল্পিক দক্ষতা নাই ।

যা হেরিতেছি, তাহার জন্য আমি নির্মলের নিকট  কৃতজ্ঞ ।

অন্ধকারে স্বসৃষ্ট জ্যোতির ভিতর বসিয়া নির্নয় লইলাম যে আমার কাশীবাসের অভিজ্ঞতা লিপিবদ্ধ করিব । কাহার জন্য, কী জন্য, জানি না । প্রথম দিনেই যখন এই আনন্দঘন অঘটন, আমি নিশ্চিত যে আরও প্রীতিপদ চমকদমক এবং তুরীয়তা অপেক্ষা করিতেছে । যে ঘরটিতে আছি তাহা যে নির্মলের প্রয়াত পিতার স্টাডিরুম, তাহাতে সন্দেহ নাই । যৎসামান্য লিখিত বহু ডায়েরি হইতে একটি হাতসাফাই করিব এবং তাহার  পৃষ্ঠায় আমার অভিজ্ঞতা লিপিবদ্ধ করিব ।

পরে জানিলাম যে দেড় ঘন্টা টুলের উপর স্হানু ছিলাম, এবং পীতাভ-গোলাপি মাখনে নির্মিত স্তনযুগল, কটিদেশ, পদদ্বয়ের সঙ্গমস্হল, বাহুমূল ও উরুদ্বয় ঠায় দেখিয়াছি ; নিষ্পলক দেখিয়াছি, চক্ষের পাতা একমুহূর্ত বুজিলেও সেই মুহূর্তটি আর ফিরিয়া পাইব না । মাথার ন্যায় অন্যত্রও চুলের রঙ সোনালি !

বাড়ির বাহির হইতে নির্মলের নাম করিয়া কয়েকজনের ডাকে টনক আত্মস্হ হইল । টুল হইতে উঠিয়া পাশের ঘরে প্রবেশ করিলাম, এবং হলঘরের আলোগুলি জ্বলিয়া উঠিবার দশ-পনের মিনিট পর পুনরায় হলঘরে প্রবেশ করিয়া দেখিলাম, বিদেশিনী খাকি রঙের ট্রাউজার ও এতদ্দেশীয় কুর্তা পরিয়া লইয়াছেন ।

নির্মল রক্ষিত এইভাবে আমাদের পরিচয় করাইয়া দিল, ইনি ম্যাডেলিন করিয়েট, আমেরিকার ওহাবও শহর হইতে আসিয়াছেন । ওনার এক পূর্বপুরুষ ইংল্যান্ডের সমারসেট হইতে পায়ে হাঁটিয়া, ইউরোপ এশিয়া হইয়া আগ্রায় আসিয়াছিলেন, এবং সম্রাট জাহাঙ্গিরের দরবারে চাকরি পাইয়াছিলেন ; টমাস করিয়েটের আত্মজীবনীতে বর্ণিত স্হানগুলির বর্তমান সামাজিক অবস্হা ইত্যাদি সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহের জন্য ভারতবর্ষে আসিয়াছেন । আর ম্যাডেলিন, ইনি শিশির দত্ত, আমাদের প্রজন্মের খ্যাতনামা চিত্রকর ও গিটারবাদক ।

পরিচয় করাইয়া দিয়া নির্মল সদর দরজা খুলিয়া দিতে অথবা যাহারা ডাকাডাকি করিতেছিল, তাহাদের সহিত সাক্ষাৎ করিতে গেল ।

প্রাথমিকে এবং ভূগোলের মানচিত্র বভতীত আমি জীবনে কিছু আঁকিয়াছি বলিয়া মনে পড়ে না । একটিমাত্র কথার ঝাপটায় নির্মল আমাকে চিত্রকর বানাইয়া চলিয়া গেল , তাহাও আবার খ্যাতনামা । যদি ম্যাডেলিন এতদ্বিষয়ে কোনও সূত্র উথ্থাপন করে, তাহা হইলে ঘোর বিপদে পড়িব ।

বিপদে পড়িলাম না । তাহার পরিবর্তে ম্যাডেলিন লজ্জা দিয়া আমার মস্তকটি কাটিয়া লইল । সে জিজ্ঞাসা করিল, আমার দে্ কি কাম্য বলিয়া মনে ্‌ইল ? আপনি তো বহুক্ষণ যাবৎ বিস্তারিত পর্যবেক্ষণ করিতেছিলেন ।

ধরা পড়িয়া গিয়াছি । কিন্তু ম্যাডেলিনের কথায় চৌর্যবৃত্তির গ্লানি হইতে যেন মুক্ত হইলাম । তাহার ছোট-ছোট নীল চক্ষের দিকে তাকাইবার সাহস হইল।  বলিলাম, আমি এত সুন্দর দেহ,  সর্বাঙ্গসুন্দর দেহ,  ইতোপূর্বে দেখি নাই ।

ম্যাডেলিন কহিল, নির্মল ও তাহার চিত্রশিল্পী বন্ধুগণের মতো আপনি দাড়ি রাখেন না দেখিতেছি । ভাল করিয়াছেন । আমি যুবকদিগের দাড়ি রাখা পছন্দ করিনা । ছবি আঁকার সহিত দাড়ির কী করার আছে ? তবে, আপনার ওই ফাকিং চশমাটি পরিত্যাগ করুন । গিটার বাদনের সহিত এইরূপ নির্জীব-বুদ্ধিজীবী ফ্রেমের চশমা মানায় না । আপনি কাহার গিটার বাদন পছন্দ করেন ?

আমার নিজস্ব প্রসঙ্গ উথ্থাপিত হইতে আশ্বস্ত হইলাম । বলিলাম, আমি চাক বেরি, জিমি হেনড্রিক্স ও ডেভি জোনসের ভক্ত ।

ওঃ, জিমি হেনড্রিক্স ! ইনডিয়ায় আসিয়া এই প্রথম একজন ভারতীয়ের কন্ঠে জিমি হেনড্রিক্সের নাম শুনিলাম । গিটার তাঁহার হাতে যৌনতায় উত্তেজিত রমণীদিগের ন্যায় হইয়া উঠে ; যেনবা গিটারের অরগ্যাজম ঘটে ! শরীরে আনন্দের ঢেউ তুলিয়া ম্যাডেলিন কহিল । তদ্ব্যাতীত, অরগ্যাজম শব্দটি শুনিয়া প্রীত হইলাম । ইতোপূর্বে কোনো নারীর কন্ঠে এই শব্দটি শুনি নাই ; বস্তুত, ভাষার ভিতরে যে আরাম প্রদানের ক্ষমতা হাছে তাহা মাঝে-মধ্যে অন্যের কন্ঠস্বর নিঃসৃত শব্দে অনেকসময়ে ফুটিয়া উঠে ।

নির্মল তাহার  কতিপয় বন্ধুকে লইয়া স্টুডিও ঘরে প্রবেশ করিল । দাড়ি, দীর্ঘ অবিন্যস্ত চুল, খাদি ও জিনসের নোংরা পোশাক ও বাসি চেহারা দেখিয়া অনুমান করিলাম যে তাঁহারাও চিত্রশিল্পী । নির্মল পরিচয় করাইবার সময়ে উপেন সরদার, সুভাষ প্রতিহার, মোহিত  কর, উল্লাস মিত্র ও প্রণব ঘোষকে আমার সম্পর্কে বলিল যে ইনি শিশির দত্ত, অতুল মুখোর বাল্যবন্ধু, অতুলের নিকট এনার কথাই আমরা শুনিয়াছি, তোমাদিগের মনে আছে হয়ত ।

অতুল পোস্টকার্ডে নামস্বাক্ষর করিয়াছিল অতুল মূর্খ ; নির্মল উহাকে বলিল  অতুল মুখো । অতুল ছিল আমাদের ক্লাসের সর্বাধিক বয়সী ছাত্র । বছর-বছর ফেল করিয়া নাইনে আমাদের যৌন-জ্ঞানদাতারূপে শেষ বেঞ্চে বসিত । আমি তাহার অনুরোধে আমার হাতখরচ হইতে কিয়দংশ দিতাম । স্কুলে সে-ই কেবল সিগারেট ফুঁকিত । এখন কাশীতে আসিয়া ঢাক পিটাইয়া নিজেকে মুর্খরূপে প্রচার করিতেছে ! অদ্ভুত ।

অতুল যে কাশীতে রহিয়াছে, তাহা জানিয়াছি বৎসর দুয়েক পূর্বে । দাড়িগোঁফ কামাইতে-কামাইতে স্কুলপর্ব সম্পূর্ণ না করিয়া হঠাৎ সে একদিন উধাও হইয়া গেল । তাহার পর শুনিলাম অতুল নবদ্বীপে । অতুলচন্দ্র দাসরা জাতবৈষ্ণব । তুলসীর  কন্ঠী গলায় অতুলের ভুঁড়িদাস বাবা প্রায় সারাদিন খঞ্জনি বাজাইয়া নাম সংকীর্তন করিতেন । অতুলের মা অন্য আরেকজনের সহিত বৈষ্ণবীরূপে গৃহত্যাগ করিবার পর অতলের পিতা নতুন বৈষ্ণবীর সহিত কন্ঠীবদল করিয়া সংসার পাতিয়াছিলেন, এমনতর কানাঘুষা শুনিতাম । অতুলকে কন্ঠী পরিতে দেখি নাই কখনও । কিন্তু গৃহের কাহাকেও না জানাইয়া, পড়াশুনা ছাড়িয়া, উধাও হইবার পর, অতুলের পিতার নামগান ও খঞ্জনিবাদন মাস কয়েকের জন্য স্তব্ধ হইয়া গিয়াছিল । অথচ উহার পরিবারের সদস্যগণ, সহপাঠীরা এবং শিক্ষকবৃন্দ নিশ্চিত ছিলেন যে পড়াশুনায় ব্যর্থ ও অনাগ্রহী হইলেও, চনমনে করিৎকর্মা, শিক্ষকদিগের গৃহকর্মের জন্য সদাপ্রস্তুত অতুলচন্দ্র দাস একদিন যশস্বী কেউকেটা হইবে ।

অতুল মাঝে-মাঝে আমার মায়ের নিকট আসিত, বলিত কষ্টে আছে, নবদ্বীপে জীবনযাপন কঠিন । মা সাহায্য করিতেন । আমিও করিতাম । আমি বলিতাম, তোমাদের যৌনজীবন তো স্বাধীন, তাই না ? আমাকে তোমার সঙ্গিনীদিগের জমায়েতে লইয়া চলো, আমিও কিঞ্চিদধিক লীলাখেলা করিব ।

অতুল সেদিন কেবল হাসিয়াছিল । কাশী হইতে লিখিত পোস্টকার্ডে আমার সেই ঠাট্টাকে অনুরোধে রূপান্তরিত করিয়া রক্ষা করার প্রয়াস, এতদিন যে আর্থিক সাহাজ্য করিয়াছি, তাহার প্রতিদানের প্রয়াস, এইরূপ প্রতিভাত হইয়াছিল । তবুও, পোস্টকার্ডটি সিরিয়াসলি লিখিত কিনা সন্দেহ ছিল । ম্যাডেলিনের নগ্ন দেহের আভায় মোহিত হইয়া প্রথম দিনের সুখকর অভিজ্ঞতায় সেই সন্দেহের নিরসন হইল ।

নির্মল একটি চারমিনার ধরাইয়া, দীর্ঘ টান দিয়া, ধোঁয়া ছাড়িবার পরিবর্তে গিলিয়া, ম্যাডেলিনকে দিল, এবং কহিল, ঠিক আছে ম্যাডি, দ্বিপ্রহরে দেখা হইবে, এখন শিশিরকে একটি পছন্দমত হোটেলে লইয়া যাই ; অতুলও নিশ্চয় উহার জন্য অপেক্ষা করিতেছে ।

সিগারেটে নির্মলের চেয়ে দীর্ঘ টান দিয়া, নির্মলের ন্যায়ই ধোঁয়া গিলিয়া, তাহা আমাকে দিল ম্যাডেলিন । আমার ধুম্রপানের নেশা নাই । ম্যাডেলিন সিগারেটটি ঠোঁটের রসে আপ্লুত করিয়াছে । তাহার সুস্বাদ ছাড়িব কেন ! সিগারেটটি লইয়া একখানা বুকভরা টান দিলাম ।  উহাদের ন্যায় ধোঁয়া গিলিলাম না ।

ম্যাডেলিন আমার গালে গাল ঠেকাইয়া বিদায় জানাইল ও কহিল, আমরা নিশ্চয় পরস্পরের সহিত অচিরেই কোথাও আকস্মিক ধাক্কা খাইব , বেনারস বেশ ক্ষুদ্র শহর ।

আমি বাকরহিত । মোহিত মন্তব্য করিল, আমিও ভাবিতেছি দাড়িটি কামাইয়া ফেলিব । সবাই হাসিয়া উঠিল । গোল ঠোঁটে এক ঝিলিক হাসি খেলাইয়া ম্যাডেলিন চলিয়া গেল ; নিতম্বের ইতি-নেতি ঢেউ তুলিতে-তুলিতে । সে চলিয়া গেলে মোহিতকে প্রণব বলিল, কত গাল তো এতাবৎ ঘষিয়াছিস, মন শান্ত হয় নাই ?

নির্মল আমাকে উদ্দেশ্য করিয়া বলিল, এক্ষণে সুটকেস ও গিটার লইবেন না, কেবল টাকাকড়ি সুটকেসে রাখিবেন না, সেগুলি সঙ্গে রাখুন । রাত্রিতে কোথাও আস্তানা না জুটিলে, আমার গৃহের রেস্টরুম  চিত্রকর ও কবি-লেখকদিগের জন্য অবারিত । অদ্য রাত্রিতে আমাদের গেরিলা পেইনটার্স গোষ্ঠীর হ্যাপেনিং হইবে । আপনি তাহাতে অংশগ্রহণ করিলে অভূতপূর্ব আত্মিক আনন্দ পাইবেন ।

আমি শুধাইলাম, আমি তো শিল্পী অথবা কবি নহি ; আপনি ম্যাডেলিনের সহিত পরিচয় করাইলেন চিত্রকররূপে । পুনরায় সাক্ষাৎ ঘটিলে ঘোর বিপদে পড়িব ।

সবাই একযোগে অট্টহাস্য করিয়া উঠিল । উল্লাস কহিল, আপনার বালয়বন্ধু অতুল মুখার্জিও কবেই বা আর্টিস্ট ছিলেন ? অথচ বেনারস হইতে প্রকাশিত অধিকাংশ হিন্দি পত্রিকা ও গ্রন্হের প্রচ্ছদ অতুলের দ্বারা অঙ্কিত ।

সিগারেটে অথবা ম্যাডেলিনের লালায় এমন কিছু ছিল, যাহার কারণে মাথা ঘাড়ের উপর নাই বলিয়া প্রতীয়মান হইতেছিল । হৃৎস্পন্দন ক্রমে যেন পা হইতে উপর দিকে উঠিয়া আসিতেছে, এবং শীতল করিয়া তুলিতেছে । সিগারেটতি এক্ষণে বাকি তিনজনে ফুঁকিয়া ফিরাইয়া দিয়া থাকিবে , নতুবা আরেকফুঁক মারিয়া পরীক্ষা করিয়া লইতাম ।

আমি জিজ্ঞাসা করিলাম, সিগারেটের তামাকে কি কিছু মিশাইয়াছেন ? প্রত্যুত্তরে নির্মল রক্ষিত একটিই শব্দ উচ্চারণ করিল, চরস । মনে হইল, সাধারণ সিগারেটের তুলনায় চরস বস্তুটি শ্রেয় । সিগারেটের ধোঁয়া কিছুই ঘটায় না ।

উহাদের কথপোকথনের মাঝে গেস্টরুম বা রেস্টরুমে প্রবেশ করিয়া নির্মলের পিতার একটি ডায়েরি, যাহার পৃষ্ঠ তিনি কম ভরিয়াছেন, সুটকেসে পুরিয়া জামা-কাপড়ের তলায় লুকাইয়া রাখিলাম, আমার কাশীবাসের অভিজ্ঞতা লিখিবার অভিপ্রায়ে । ডায়েরিগুলি সুদৃশ্য ও মূল্যবান, সাধারণ খাতা নহে । টাকাকড়ি পূর্বাহ্ণেই রাখিয়া লইয়াছি ।

আমরা নির্মলের গৃহ হইতে ডান দিকের পথে হাঁটা আরম্ভ করিয়াচিলাম । পথিমধ্যে দেখিলাম, নোংরা পোশাক পরিহিত, পায়ে হাওয়াই চপ্পল, অবিন্যস্ত চুল বিদেশি যুবক যুবতী, একা অথবা জোড়ায়-জোড়ায় । কোনও-কোনও যুবক বা যুবতী আমাদের দলের কোনো সদস্যকে চিনিতে পারিয়া হাত নাড়িল বা মৃদু হাসির সহিত কহিল, হাই ।

চায়ের দোকানে ঢুকিয়া, ডিম-পাঁউরুটি খাইতে-খাইতে প্রসঙ্গটি উথ্থাপন করিলে, উল্লাস কহিল, ইহারা ভিয়েৎনাম যুদ্ধে যোগদানের আতঙ্কে অধবা তাহার বিরোধীতায় স্বদেশ ছাড়িয়া পলাইয়া আসিয়াছে । আমেরিকার সমাজটিতে ম্যাককার্থি নামক এক নেতা এমন শ্বাসরুদ্ধকর পরিবেশ গড়িয়া তুলিয়াছিল যে প্রথম সুযোগেই আত্মহারা হইবার সুযোগের সদ্ব্যবহার করিতেছে ।

মোহিত বলিল, ভারতের মতন খোলামেলা স্বাধীন দেশ আর নাই । তদ্ব্যতীত বেনারস যেহেতু সাধুসন্তদের শহর, হেথায় যে কেউ যে কোনও নেশা যথেচ্ছ করিতে পারে । শিব নেশা করিয়া তাণ্ডব নৃত্য করিতেন । ইহারা নিজেদের মস্তিষ্কে সেই প্রকার তাণ্ডবনাট্য ঘটাইবার প্রয়াসী ।

নির্মলের তৃতীয় বন্ধুটি, যাহার নাম উপেন সরদার, কহিল, কাশী বিশ্বনাথের দয়ায় এই তীর্থে কোনও কর্ম পাপ বলিয়া গণ্য হয় না । আমি এই তীর্থে যা ইচ্ছা করিয়া লউন । গ্লানি হইলে, দশাশ্বমেধে গিয়া গঙ্গাস্নান করিয়া লইবেন । ব্যাস , ছুটি ।

সনাতন সমাজে, জীবন ও আতিকথায় আদর্শ মূল্যবোধ জিতে যেত, আর আদর্শহীনতা হেরে যেত, যাকে বলা হয় ধর্মের জয় । আধুনিকতার জীবনদর্শন, প্রথমে ইউরোপে এবং তারপর উপনিবেশগুলোয়, ধর্মের মানে পালটে দিলে । ফলে, রাষ্ট্রের ক্ষমতাবিন্যাস থেকে বিচ্যুত ভাবুকরা, নিজেদের বৌদ্ধিক ও আত্মিক অধঃপতনকে বৈধতা দিতে, আক্রমণ করতে লাগলেন ‘ধর্মের জয়’ মূল্যবোধটিকে । আমরা দেখলুম উপন্যাসে, গল্পে, নাটকে, চলচ্চিত্রে নায়কোচিত সন্মান পাচ্ছে মূল্যবোউহীন সমাজবিরোধী চরিত্র , ইউরোপের প্রতিটি ভাষায় । আর গণসমাজ, মায় এদেশের ইংরেজি-জানা পাঠক, লুফে নিচ্ছে অমন নেতিবাচকতা । নানা কুকর্ম করে বেড়ায় কেন্দ্রচরিত্র, আর তার অধঃপতনে গরিমা আরোপ করেন লেখক । ভাবুক ও আলোচকগণ সেসব কাণ্ডকারখানার সঙ্গে পরিচিত হয়ে আহ্লাদে আটখানা  হন । তার কারণ লেখক ভাবুক সমালোচক নিজেরাই অধঃপতিত নষ্ট বিবেকহীন লোভী দুষ্কৃতী ।

একে তো কামুক ভোঁদাটা বিটকেল বাংলায় নিজের কাশীবাসের স্মৃতি লিখেছে, তাও আবার এমন ইজগুড়ি-বিজগুড়ি হাতের লেখায় যে তরতর করে পড়া যায় না ; তার ওপর মাঝে-মধ্যে ঢোকানো নির্মলের বাবার জ্ঞানবাক্যি ! হাতসাফাই যখন করলি, তখন ফাঁকা দেখে একটা খাতা নিতিস । নয়তো ছিঁড়ে ফেলে দিতিস নির্মলের বাবার লেখা জ্ঞানবাক্যির পাতাগুলো । ওনার দুয়েকটা পাতা পড়লুম । কী যা মাথামুন্ডু কিছুই তো বুঝলুম না । শিশির যেমন বাংলায় মাস্টারি ফলিয়ে কাব্যি করেছে, উনি তেমনি নিজেই নিজেকে জ্ঞান দিয়েছেন । অমন খাতার পর খাতা সারাজীবন ভরিয়ে কী হল ? একটা অন্তত কাজে লাগল, আমার আর শিশুর । বাকিগুলো তো গুষ্টির লোকেরা নিশ্চই বেচে দিয়েছে বাজে কাগজের দরে ।

ভারতে স্বদেশী আন্দোলনের নেতারা প্রায় সবাই আইন ব্যবসায়ী ছিলেন । আইন ব্যবসায়, ইংরেজি ভাষায় দখল না থাকলে, সম্ভব ছিল না । আমাদের জাতীয়তাবাদী নেতারা ইংরাজ শাসকদের বুঝতে-বোঝাতে সক্ষম ছিলেন । তাঁদের ওজস্বী বক্তৃতাগুলো মানুষ গড়ার বাগ্মীতায় গমগমে, ভারতীয়দের মানব বানাবার স্বপ্নে ঝিলমিল। এনারা লিখেছিলেন স্বাধীন ভারতের সংবিধান, যা আমাদের কিছু-কিছু দিলেও, এদেশে বহু সমস্যার উৎসসূত্র । আইনভঙ্গকারীরা ক্ষমতার অনুস্তর কেন্দ্রগুলোর দখল নিচ্ছে আজকের দিনে, তা কালক্রমে ভয়াবহ হয়ে উঠবে ; তখন কি তাকে সামাল দেবার মতো নেতা বা নেত্রী পাবে ভারতীয় সমাজ ? রাজনীতিক-আমলা-অপরাধী মাফিয়ার যে চক্রব্যুহ গড়ে উঠছে, তার বীজ পুঁতে গিয়েছেন উপরোক্ত আইনব্যবসায়ীরা ।

২. দেখা হয় নাই

আমরা ইঁটপাতা গলি, গলির ফ্যাঁকড়া, তস্য গলির ভিতর দিয়া অলস পদক্ষেপে হাঁটিতেছিলাম । এত সরু যে একটো গরুর যাত্রাপথ সহজ করিতে দেয়ালে পিঠ দিয়া থামিতে হইল । অপর দিক হইতে কোনও পথচারী আসিলে, পাশাপাশি দুইজন হাঁটাও বিরক্তিকর । আমি তিনজনের পিছনে । মিনিট কুড়ি অতিবাহিত হইয়া গিয়া থাকিবে ।

অগ্রগামী পথপ্রদর্শকের উদ্দেশে ক্লান্তকন্ঠে প্রশ্ন ছুঁড়িলাম, এ কোন এলাকায় বাসা লইয়াছে অতুল, যে টাঙ্গা বা রিকশাও প্রবেশ করে না ?

বাসা আবার কোথায় ? ছয়সাত বৎসর হইল, ফাঁকা  শিবমন্দির চত্ত্বরটিতে বউবাচ্চাসহ আশ্রয় লইয়াছিল । এক্ষণে তৎসংলগ্ন ঘরগুলি ও সমগ্র পরিসর দখল করিয়া ভাড়া খাটাইতেছে । তীর্থযাত্রী ও হিপিগণকে ভাড়া দেয়, এবং শিবরাত্রীতে ও অন্যান্য পূজাপার্বণে বেশ ভালোই আয় হয় । তবে, এই গলিটিতে প্রবেশ না করিয়া আন্য প্রশস্ত পথেও আসা যায়, উহা একটু দূর হইবে, এই যা । প্রত্যুত্তর শুনিয়া কন্ঠস্বরটি প্রণব ঘোষের বলিয়া আঁচ করিলাম । পেটে চা-ডিম-পাঁউরুটি প্রবেশ করিয়া গঞ্জিকা-চরসের সাময়িক রসায়নকে বিস্হাপিত করিয়া দিয়াছে । স্মৃতি স্বস্হানে ফিরিয়াছে ।

অতুল সম্পর্কে যতই শুনিতেছি, রহস্য ততই জট পাকাইতেছে । অতুলের চিত্রশিল্পী বন্ধুরা তাহার অতীত সম্পর্কে কিছুই জানে না । নবদ্বীপে গিয়া হয়ত বউ সংগ্রহ করিয়া থাকিবে । সন্তান লইয়া চলিয়া আসিয়াছে কাশী । তুলসিকাঠের কন্ঠী গলায় উহার তো যাওয়া উচিত ছিল মথুরা-বৃন্দাবন । তৎপরিবর্তে বেনারসে আগমন করিয়া হইয়া গিয়াছে শিবের ভক্ত । কখন এক ফাঁকে দাস পদবিটি বিষ্ণুকে অর্ঘ্য দিয়া শিবের নিকট মুখার্জি পদবি বর পাইয়াছে ।

চিন্তার রেশ বিঘ্নিত হইল উল্লাস মিত্রের কটাক্ষ-মিশ্রিত মন্তব্যে, অতুল মুখোর স্ত্রী কেকা বউদি অমন শেয়ানা না হইলে সামলানো কঠিন হইত; অন্য নারী হইলে কবেই দুরছাই করিয়া পলাইত ।

নির্মল কহিল, জোড়াতালি নাই এরূপ  মানবসম্পর্ক হয় না; ভাবমূর্তি ব্যাপারটিই নকল ; আমরা সবাই, অন্তরে ঝুঁকিয়া অন্বেষণ করিলে দেখিব হয় মনোগ্যামি হইতে পলিগ্যামির দিকে অগ্রসৃ হইয়াছি, অথবা পলিগ্যামিতে শুরু করিয়া শেষ আশ্রয় লইয়াছি মনোগ্যামিতে ।

সবাকার ওষ্ঠদ্বয়ে বেশ ভাল করিয়া লিউকোপ্লাস্ট সাঁটিয়া দিল নির্মল রক্ষিত ।

অতুলের আস্তানায় পৌঁছাইয়া যাহা দেখিলাম তাহা দেয়াল-ঘেরা একটি মন্দিরচত্ত্বর, পঞ্চাশ বৎসর পূর্বে রঙের শেষ পোঁচ পড়িয়াছিল । অযত্নে ও ঝড়বৃষ্টি-রৌদ্রের অবিরাম প্রহারে পাথুরে আকার পরিগ্রহ করিয়াছে । ইংরাজের স্নেহধন্য কোনো জমিদার কখনও পূণ্যলাভের আশায় তৈয়ারি করাইয়াছিল, যাহার ফল আজ অতুল ও তাহার পরিবার ভোগ করিতেছে ।

উল্লাস মিত্র, সম্ভবত তাহার কন্ঠস্বর বাজখাঁই বলিয়া, অতুলের নাম ধরিয়া ডাকিতে, বারো-তেরো বৎসরের এক কিশোরী, স্কুলের পোশাকে—বোধহয় স্কুল যাইবে বলিয়া প্রস্তুত হইতেছিল— ভিতর হইতে আসিয়া চৌকাঠে দাঁড়াইয়া বলিল, বাবা তো নাই, পাবলিশারের নিকট গিয়াছে ।

এই মুখটি পূর্বে দেখিয়াছি, এমনতর সন্দেহ হইল । কিন্তু অতুলের  কন্যা বারো-তেরো বৎসরের কী ভাবে হইয়া গেল, নাকি মেয়েটির গড়নপেটন দ্রুত পুষ্টিলাভ করিয়াছে, ভাবিতেছি, এমন সময়ে কিশোরীটি আমাকে দেখিয়া মুচকি হাসিল ও কহিল, শিশুদা না ? আমাকে কি চিনিতে পারিয়াছ ? তোমরা ঘরের ভিতরে আসিয়া উপবেশন করো, আমি মাকে ডাকিয়া আনিতেছি ।

আমি তবু কিশোরীটিকে মনে করিতে পারিলাম না । প্রবেশের পর, খোলা উঠানের প্রথম ঘরটিতে, কয়েকটি অতিপুরাতন চেয়ার ও খাটের উপর সতরঞ্চি পাতা । আমরা অতুলের স্ত্রীর জন্য অপেক্ষা করিতে লাগিলাম ।

পাটভাঙা কস্তাপেড়ে গরদের শাড়ি পরিতে সময় লাগিয়াছে । অতুলের কন্যাটি মায়ের সহিত আসিয়া দাঁড়াইল, ঠোঁটের চিলতে হাসি উহার চক্ষুদ্বয়কে উজ্জ্বল করিয়া তুলিয়াছে । তিরিশোর্ধ মহিলার মুখ এক মুহূর্তের জন্য দপ করিয়া নিভিয়া গিয়াছিল, সামলাইয়া সপ্রতিভ করিয়া তুলিলেন ।

দেখামাত্র অতুলের স্ত্রীকে চিনিতে পারিলাম । কল্যাণী বউদি , বেনারসে আসিয়া কেকা বউদিতে রূপান্তরিত । এয়েটি কুহু । বর্ধমানে অতুলদের পাড়ায় থাকিতেন প্রসন্নকান্তি মুখোপাধ্যায়, ডাকবিভাগে ডেডলেটার অফিসে নিত্যযাত্রী ; কল্যাণী তাহার স্ত্রী। অফিস হইতে ফিরিয়া প্রায় প্রতি সন্ধ্যায় স্ত্রী ও শিশুকন্যাকে নিষ্ঠুর প্রহার করিতেন । মদ্যপ অবস্হায় যুক্তির অতীতে থাকিতেন বলিয়া পাড়ার লোকে এক রবিবার প্রসন্নবাবুকে তিরস্কার করিয়াছিল । কোনও ফল হয় নাই । স্ত্রী ও কন্যার কান্না বরদাস্ত করিতে অভ্যস্ত হইয়া গিয়াছিল প্রতিবেশিগণ ।

একদিন প্রতিবেশিগণ জানিয়া স্বস্তি পাইলেন যে কন্যাকে লইয়া কল্যাণী বউদি বাপের বাড়ি চলিয়া গিয়াছেন । কেহ খোঁজখবর করিলে প্রসন্নবাবু, স্ত্রীর বিদায়ের পর যিনি পোসনে মাতাল হিসাবে খ্যাত হন, বলিতেন, মাগিটাকে ডিভোর্স দিয়াছি ।

সেই তখনই অতুল নবদ্বীপে চলিয়া গিয়াছিল বলিয়া প্রচারিত । সবই, অদ্য স্পষ্ট হইল , গল্প । বয়সে যথেষ্ট বড় কল্যাণী বউদি ও তাহার কন্যাকে লইয়া কাশী পলায়ন করিয়া ক্ষান্ত হয় নাই অতুল। প্রসন্ন মুখোপাধ্যায়ের পদবিটিও লুঠদখল করিয়াছে । বেচারা পোসনে মাতাল তিন বৎসর পর দ্বিতল বাড়ি সস্তায় বিক্রয় করিয়া কলিকাতা অভিমুখী হইয়াছিলেন ।

বাড়ির ভিতর হইতে শিশুর ক্রন্দনের শব্দ আসিতে থাকায় প্রণব জিজ্ঞাসা করিল, কী বউদি, আবার মা হইলেন, নাকি নূতন ভাড়াটিয়া ?

পূনর্বার দপ করিয়া নিভিয়া সামলাইল সুশ্রী তন্বী মহিলা । বলিল, ওটি আমার সতীনের পুত্র । অনামুখো সতীন উহাকে ফেলিয়া রাখিয়া পলাইয়াছে ।

নির্মল উল্লাস উপেন সুভাষ ও প্রণব একযোগে চিৎকার করিয়া উঠিল, কে? জোসেফিন ?

কল্যাণী বউদি, নাঃ, কেকা বউদিই লিখি, স্মিতহাস্যে কহিল, হ্যাঁ, অতুল দিল্লি এমব্যাসি আর এয়ারপোর্টে গিয়া সংবাদ আনিয়াছে, সে বেটি নিজের দেশে পলাইয়াছে ।

ছুঁচের আর কোকেনের নেশাখোর ধনী সতীনের চেয়ে সতীনপো মানুষ করা ভাল, প্রায় উপদেশাত্মক কন্ঠে নির্মল রক্ষিত মতামত জানাইতে, উল্লাস কহিল, মার্কিন কোটিপতির মেয়ে অতুলের হাত হইতে ফসকাইয়া গিয়াছে বটে, পুত্রটিকে সযত্নে প্রতিপালন করুন, ভবিষ্যতে বৈভবপ্রাপ্তি হইতে পারে ।

কুহুর একটি ফুটফুটে ভাই হইল, আমি তাহাতেই আনন্দিত । কেকা বউদি ছদ্ম গর্বের সহিত কহিল ।

আমার মুখমন্ডলে সংশয়, সন্দেহ, হয়ত বা আতঙ্ক খেলা করিতেছিল । বেনারস না আসিলেই ভাল হইত । কেকা বউদি আমার মনঃস্হিতি অনুধাবন করিয়া বলিল, চলো শিশু, তোমাকে শিবমন্দিরটী দেখাই, জাগ্রত দেবতা ।

গৃহের অভ্যন্তরটি দেখার আগ্রহ ছিল । কেকা বউদিকে অনুসরণ করিলাম। প্রশস্ত খোলা উঠানের দুই দিকে ছয়টি করিয়া ঘর । কয়েকটিতে দেশি-বিদেশি অতিথি আছে । তাহাদের জামাকাপড় তারে শুকাইতেছে ।

উঠানের কেন্দ্রস্হলে নির্মিত ছোট মন্দিরের শিবলিঙ্গটি এমনই অতিকায় যে প্রবেশমাত্র দেখা যায় । উঠান পার হইয়া গৃহের অন্দরমহলে প্রবেশমাত্র কেকা বউদি অকস্মাৎ আমার দুই হাত ধরিয়া অনুনয়ে কাতর হইয়া কহিল, প্লিজ প্লিজ প্লিজ শিশু, আমাদের অতীতের কথা কাহাকেও বলিও না ; আমি ঈশ্বরের নামে বলিতেছি কুহু অতুলেরই কন্যা । প্রসন্ন ছিল পুরুষত্বহীন, এবং জানিত কুহু তাহার সন্তান নহে, সে তো সন্তানোৎপাদনের অনুপযুক্ত ছিল, তাই আমাদের উভয়কে বেদম প্রহার করিত । কাহাকেও কিছু বলিও না , আমার ভরা সংসার ভাসিয়া যাইবে । মহিলার উষ্ণ নিঃশ্বাস আমার মুখমন্ডলে । মুখের এত নিকটে মুখ আনিয়া কথাগুলি বলিল কেকা বউদি, যে তাহার তপ্ত মুখগহ্বর হইতে ধুম্রপানের গন্ধ পাইলাম । গোলাপি আলজিভটুকু দেখিয়া অনভিপ্রেত অনুভূতি ঘটিল ।

আমি বলিয়া ফেলিলাম, এত সাহসী পদক্ষেপ লইয়াছেন, এর পর কলঙ্কের পরিমন্ডল গড়িয়া তন্মধ্যে সন্ত্রস্ত থাকিবার আর কোনও কারণ দেখি না ; স্বসৃষ্ট ভয় হইতে বাহির হইয়া আসুন ।  আমি আপনাদের কথা যে গোপন রাখিব সে বিষয়ে নিশ্চিন্ত থাকুন । বলিয়া, ধুম্রপায়ী ভক্তিমতীর নাকের পাটা, কানের লতি, ছোট্ট কপাল ,কোঁকড়ানো চুলের খোঁপা ও পাতলা ওষ্ঠাধর দেখতে দেখিতে বুঝিতে চাহিলাম ।

প্রচুর সিঁদুর, বড়সড় টিপ, শাঁখা-পলা, সোনার ভারি কন্ঠহারে আভূষিতা কেকা বউদি কিয়ৎ আশ্বস্ত হইয়া আমার হাত ছাড়িয়া দিলে, আমি তাহার মেঘলা মুখের দিকে তাকাইয়া জানিতে চাহিলাম, তাঁহার বাবা এখন কোথায় ? শুনিয়াছিলাম তিনি একমাত্র সন্তান ।

মা তো আমার সঙ্গেই এই মন্দির-বাড়িতে আছেন । বাবার মৃত্যু আমার বর্ধমানে থাকাকালীনই ঘটিয়াছিল । প্রসন্ন  যাইতে দেয় নাই । বেনারসে আসার দেড় বৎসর পর একরাত্রে আমি ও অতুল চাকুলিয়া গিয়া মায়ের সহিত গোপনে দেখা করিয়া লইয়া আসিয়াছিলাম । মা অমত করন নাই । প্রসন্নের সহিত বিবাহ দিয়া তাঁহারা যে জীবনের সবচেয়ে বড় ভুল করিয়া ফেলিয়াছিলেন তাহা মা স্বীকার করিয়া লইয়াছেন । বাবাও এই সম্পর্কে মানিয়া লইতেন বলিয়া অনুমান করি ।

তবে ? ইহার পরও অজানা আতঙ্কে বাস করার কারণ দেখি না । বলিলাম ।

আতঙ্ক বলো বা যাহাই বলো, তাহা অজানা নহে । অতুলের নিকট আমার আকর্ষণ ক্ষমতা বিলুপ্ত, অথচ অতলের যৌবনের চাহিদা এখনও তৃপ্ত হয় নাই ; একই নারীকে লইয়া সে প্রতিদিন কাটাইতে পারে না । কী কুক্ষণে বেনারস আসিয়াছিলাম, ঠিক এক্ষণেই, যখন সবকিছু গুছাইয়া তুলিয়াছি, ঝাঁক বাঁধিয়া স্বেচ্ছাচারিণীগণ বিদেশ হইতে নামিয়া আসিতেছে ; ইহারা স্বদেশ হইতে নির্ণয় লইয়া আসিয়াছে যে জীবনকে যথেচ্ছ উপভোগ করিবে, যাহার সহিত ইচ্ছা শুইবে, প্রতিটি মাদক সেবন করিবে, এক স্হানে মন ভরিয়া গেলে আরেক দেশে চলিয়া যাইবে ; আসে একজনের সহিত, শোয়  পাঁচ-সাতজনের সহিত, চলিয়া যায় আরেকজনের সহিত । মথুরা বা বৃন্দাবনে গিয়া সংসার পাতিলে হয়ত সংসার এরূপ খাঁড়ার ধারের উপর অষ্টপ্রহর থাকিত না । আমার সব আছে, কেবল মানসিক শান্তি নাই । প্রসন্নের দুর্ব্যবহারের প্রতিশোধ লইয়াছিলাম । অতুলকে কী করিয়া বাগে আনিব জানি না । ধুম্রপায়ীর পাতলা, বোধহয় হালকা লিপ্সটিক বুলাইয়া লহিয়াছে, ওষ্ঠাধর কাঁপিয়া কথাগুলি বাহিরিল ।

আমি দ্রুত কেকা বউদির আপাদমস্তক এক ঝলক দেখিলাম, নির্লজ্জের ন্যায়ই চোখ বুলাইলাম । চোখ ধাঁধানো ত্বক, পিচ্ছিল চটক আদল-আদরা, ধুন্ধুমার গা-গতর, উদ্দীপনাময় ভরপুর স্তন, যাহা প্রহারে জর্জরিত করিয়া প্রসন্নকান্তি নিজের অক্ষম ক্ষোভ উগরাইয়া দিত, যাহাতে স্ত্রীর দেহের মর্যাদায় ধুলা না জমিয়া যায়, কী করিয়া সেই দেহটিকে অনাদর করিতেছে অতুল, তা অতুলই বলিতে পারে । জড়াইয়া ধরিয়া ঠোঁটে ঠোঁট চাপিয়া আপাত-আবিল দুঃখের মোড়ক ছিঁড়িয়া বাহিরে টানিয়া আনার তীব্র ইচ্ছা সংবরণ করিয়া বলিলাম, অতুল যেমন আছে থাকুক, এই দেবোত্তর সম্পত্তি হইতে যথেষ্ট আয় হয় বলিয়া প্রতীয়মান হইতেছে । কথা, ছোঁয়া, চাহনি, দেহ দিয়া নির্বাচিত একজনের সহিত সম্পর্কের দানা বাঁধিতে হইবে, এমন বাধ্যবাধকতা আছে নাকি ? আর্থিক সচ্ছলতা দিয়াও সম্পর্ক আত্মিক হইতে পারে ।

হ্যাঁ, অতুলকে ওই ব্যাধি ধরিয়াছে , দ্রুত ধনী হইবার ব্যাধি । কথা কয়টি এমনভাবে উপস্হাপন করিল কেকা বউদি, যেন বর্ষাকালের নদীর গা-ছাড়া ভাব । আনচান হইলাম । কথাটিতে বোধহয় সত্যের সহিত বেশ কিছুটা মিথ্যার মিশ্রণ প্রয়োগ করিল মহিলাটি ।

ব্যাধি শব্দটি শুনিয়া পরিচিতির অদ্ভুত বাককৌশল আমায় চমকিত করিল । মনে হইল ব্যাধি থাকা ভাল; তাহা একাকীত্বের আরাম প্রদান করে । জিজ্ঞাসা করিলাম, কীভাবে দ্রুত বড়লোক হইবে ? ব্যবসায় করিতেছে নাকি ?

স্তম্ভিত করিয়া দিয়া কেকা বউদি কহিলেন, হ্যাঁ, গাঁজা-চরস-আফিমের ; নেপাল হইতে চোরাপথে ওই মাদকদ্রব্যগুলি সস্তায় কিনিয়া লইয়া আসে এক বিহারি দালাল, অতুল তাহা ডলারের অত্যুচ্চ দামে হিপি-হিপিনিগণকে বিক্রয় করে । ডলারের ভাল কালোবাজার রহিয়াছে বেনারসে । সন্দেহ হইল, আমি অতুলের বন্ধু বলিয়া কেকা আমায় অতুলের বিরুদ্ধে প্ররোচিত করিতেছে । কার্যকারণ ঠাহর করিতে পারিলাম না ।

নিজের জটিল জীবনে কিয়দংশ আমাতে সম্প্রচারিত করিতে সফল হইল কেকা বউদি । বরফের ঘাম ছাঁৎ করিয়া আমার অস্তিত্ব জুড়িয়া কুলকুলিয়া বহিয়া উঠিল । বলিলাম, চলুন, সবাই অপেক্ষা করিতেছে ।

ফুলকাটা পিতলের থালায় রক্ষিত কাজল ছাই ও চন্দন লইয়া আমার কপালে একটি টিপ আঁকিয়া কেকা বউদি কহিলেন, হ্যাঁ, চলো, কপালে দেখনসত্য লিখিয়া দিলাম, কেননা নির্মল রক্ষিত নামক যুবকটির দৃষ্টি ও বুদ্ধি অতীব তীক্ষ্ণ । কালক্রমে চিত্রশিল্পীরূপে খ্যাত হইবে, এখনই উহার আঁকা তৈলচিত্র প্রচুর দামে বিক্রয় হয় । আমাদের বাসায় মিনিট পনেরোর জন্য প্রথমবার আসিয়াছিল । ওইটুকু দেখিয়া আমার হুবহু পোরট্রেট আঁকিয়া পাঠাইয়াছিল; কেবল শাড়ির পরিবর্তে আমাকে কমলা রঙের শেমিজ পরাইয়াছিল এবং খোঁপার পরিবর্তে কাঁধের দুই পাশে সন্মুখদিকে চুল নামাইয়া দিয়াছিল । ভালো লাগিয়াছিল দেখিয়া যে শাড়ি খুলিয়া শেমিজ তো পরাইয়াছে, নিজ হাতে খোঁপাও হয়ত খুলিয়া দিয়া থাকিবে শিল্পীর কল্পনায় !

বৈঠকঘরের দিকে উঠানের ভিতর দিয়া যাইতে-যাইতে বলিলাম, তাই বুঝি ? কোথায় টাঙাইয়াছেন ?

অতুল উহাও বেচিয়া দিয়াছে । নির্মলকে বলি নাই, ক্ষেপিয়া রণক্ষেত্র সৃষ্টি করিবে । নির্মল অন্তত অতুলকে চিত্রশিল্পীর ভেক পরাইয়াছে । প্রচ্ছদ অঙ্কন হইল অতুলের জীবিকার সাইনবোর্ড ।

ভেক ? ও ! অতুল আপনার ছবিটিতে নিজ নাম স্বাক্ষর করিয়া বেচিয়া দিয়াছে ? ডলারের বিনিময়ে ! চমৎকার । আফশোষ রহিল যে নির্মল রক্ষিতের চক্ষের ভিতরে আপনার উপস্হিতি দেখিবার সুযোগ পাইলাম না ।

বৈঠকঘরে ফিরিয়া দেখিলাম যে কুহুর সহিত নির্মল, উপেন, সুভাষ, উল্লাস ও প্রণাব কথার খেলায় মশগুল । উল্লাস মিত্রকে উল্লু চাচা ও নির্মল রক্ষিতকে নিমকি চাচা বলিয়া খেপাইবার প্রয়াস পাইতেছে কুহু । বাবা ও মা তাহাকে স্ব-স্ব জটিল অন্তদ্বন্দ্ব হইতে দূরে রাখিতে সফল হইয়াছেন দেখিয়া অনুমান করিলাম অতুল ও কেকার ভিতর একটি শীতযুদ্ধ চলিতেছে ।

কেকা বউদির সপ্রতিভ ও থমথমে, এবং আমার চাপা বিচলিত মুখমন্ডল দেখিয়া আমাদের মস্তিষ্কের ভিতরে জায়মান চিন্তাপ্রক্রিয়াকে পড়িবার, এবং কোনও নির্ণয়ে পোঁছাইবার চেষ্টা করিল নির্মল রক্ষিত ।

প্রণব ঘোষ জিজ্ঞাসা করিল, জোসেফিন স্পার্কসের বাচ্চাটার কী নাম রাখিলেন বউদি ? দাড়ি গোঁফ কুঁকড়া চুলে ঢাকা প্রণবের কন্ঢস্বর মহিষাসুরি আদেশের মত শোনাইল । বর্ধমান শহরে একবার একটি যাত্রাদলে মহিষাসুরের অভিনয় দেখিয়াছিলাম ; স্বাস্হ্যের কারণে জনৈক অবাঙালি পালোয়ান মহিষাসুরের অভিনয় করিয়াছিল ।

কুহু লাফাইতে-লাফাইতে বলিল, উহার নাম কং ; জোসেফিন মাম্মি উহাকে কং বলিয়া ডাকিত ।

কং আবার কেমনতর নাম, এই প্রশ্ন কেহ তুলিবার পূর্বে কেকা বউদি কহিল, ভিয়েতকং হইতে কং নামকরণ । তবে আমি উহার নাম রাখিব গোরা, রবি ঠাকুরের গোরা । তারপর আমার দিকে ফিরিয়া, শিশু তুমি বাড়ি গিয়া ডাকযোগে আমাকে এককপি রবি ঠাকুরের উপন্যাসটি পাঠাইও । গোরা সাবালক হইলে বইটি পড়িয়া নিজের জন্মরহস্যের সূত্র পাইবে ।

আমি জিজ্ঞাসা করিলাম, গোরা মুখোপাধ্যায় ?

কেকা বউদি উত্তর দিল, হ্যাঁ, গোরাদাস মুখার্জি , অতুলদাস মুখার্জির সহিত সাযুজ্য রাখিয়া ; আমি জীবিত থাকিলে অনুরূপ মিল দিয়া উহাদের পুত্রদের নাম রাখিব কৃষ্ণদাস, শ্যামদাস, কালিদাস, এইরকম ।

আমি প্রস্তাবে সমর্টন জানাইলাম, সেই ভাল, পুরাতনের সহিত নূতন মিলিয়া-মিশিয়া থাকুক ।

খাটের উপর রাখা কাঁসার ফুলকাটা থালায় পেস্তা, কিসমিস, আখরোট, কাগজি বাদাম ও প্যাঁড়াগুলি দেখিয়া, যাহা সম্ভবত ভক্তগণ অর্ঘ্য দিয়া থাকিবে, এবং কুহু আনিয়া রাখিয়াছে, কেকা বউদি বলিল, ওমা, তোমরা কেহ পূজার প্রসাদ গ্রহণ করো নাই ? শিশু, তুমি তো প্রথমবার আসিয়াছ, মিষ্টিমুখ করিয়া যাও ।

আমি একটি প্যাঁড়া তুলিয়া লইয়া, আচ্ছা চলি বউদি, অতুলকে জানাইবেন, বলিয়া উঠিয়া পড়িলাম । আমার দেখাদেখি অন্যেরাও । অতুল হঠাৎ আসিয়া পড়িলে আরও না জানো কোন কোন সাপ-খোপ  বাহির হইবে , এবং সেসব সাপের স্মৃতি তাড়া করিয়া বেনারসে আগমনে উদ্দেশ্য মাটি করিয়া দিবে । এখনই কেমন যেন সন্দেহ হইতেছে যে বোকার মতো একখানি পোস্টকার্ডের ডাকে দিকবিদিক জ্ঞানহীন হইয়া চলিয়া আসিয়াছি ।

পথে নামিয়া, যে-গলি দিয়া আসিয়াছিলাম, তাহার পরিবর্তে ডান দিকের গলিতে বাঁক নিয়া মিনিট খানেকেই  দশাশ্বমেধ ঘাটে যাইবার পথে আসিয়া পোঁছাইলাম । স্নানার্থীগণের প্রত্যাবর্তনের পথ বলিয়াই, অতুলের শিবমন্দিরের অর্থকরী রমরমা । সন্ধ্যায় হয়ত ঘরপালানো সাহেবমেম ও গৃহবিতাড়িত বাঙালি বিধবাগণের ভজনকীর্তন হয় ।

ঘাটের সন্নিকটে আসিয়া ফুটপাতে ছায়ায় বসিলাম । সবাই চুপচাপ । প্রত্যেকে হয়ত কেকা বউদি ও অতুলের সম্পর্কের একটি অন্ধের হস্তিদর্শনের ন্যায় ছবি গড়িয়া চিন্তা করিতেছে । অথবা শিল্পীগণের বিপথগামী চিন্তাহীনতায় মগ্ন ।

তিনজোড়া যুবক-যুবতী, হয়ত আমেরিকার, হয়ত ইউরোপের, হাত ধরাধরি করিয়া অলস পদক্ষেপে হাঁটিবার সময়ে, চিত্রশিল্পীগণকে দেখিতে পাইয়া, হাই-হ্যালো করিয়া চলিয়া গেল । উহাদিগের মাঝে কালোচুল তরুণীটি দৌড়াইয়া আসিয়া নির্মলের গালে একটি স্পর্শচুম্বন দিয়া ফিরিয়া গেল । ইহারও চিত্র আঁকিয়া থাকিবে নির্মল, নিউড আঁকিয়া থাকিলে মেয়েটির সর্বস্ব দেখিবার সুবর্ণসুযোগ পাইয়াছে । গেরুয়া লুঙ্গি পরিহিত, খোঁচা-খোঁচা দাড়ি, মাথায় ছোট-ছোট কাঁচাপাকা চুল, আমাদের নমস্কার করিয়া স্নানার্থে জলে গিয়া নামিলে, নির্মল কহিল, ইনি হিন্দি ভাষার বিখ্যাত কবি নাগার্জুন, বৌদ্ধধর্ম গ্রহণ করিয়াছেন । আবার সবাই চুপচাপ ।

কিয়ৎক্ষণ পর আমার দিকে তাকাইয়া নির্মল রক্ষিত শুধাইল, অতুল যর চিঠিখানি আপনাকে লিখিয়াছিল, তাহা কি আপনার নিকটে আছে ? যদি থাকে তাহা ্‌ইলে আমি কি উহা পড়িতে পারি ?

আমার শঅর্টের বুকপকেটেই ছিল পোস্টকার্ডটি, যাহা আমি উল্লাসকে দিলাম, উল্লাস প্রণবেকে, প্রণব নির্মলকে ।  উহারা দুইজনে আমার ও নির্মলের মাঝে বসিয়াছিল । তিনজনে চিঠিটি পড়িয়া, হাসাহাসির পরিবর্তে, মুখ-চাওয়াচাওয়ি করিয়া গম্ভীর হইয়া গেল । চিঠিতে অতুলের বার্তাটি এইরূপ:

শিশির অফুরন্ত, ………………………………………………………………………………………………………..হ্যাশ ও হুস্ন ; মেরি এবং মেরিহুইনা ; পাতা আর পতন ; বিদেশিনী ও ছিনিমিনি । দুই মাসের মাইনে নিয়ে একমাসের জন্য চলে এসো । তাড়াতাড়ি । ………………………………………………………………………………………………………….. অতুল মূর্খ

চিঠিটি আমার হাতে ফিরত আসিয়া পুনরায় বুকপকেটে বিরাজ করিল, ও শুনিতে  লাগিল আমার উদ্বিগ্ন হৃৎস্পন্দন । উহারা কে্হই স্তব্ধতা ভাঙিল না । চিত্রশিল্পী । হয়ত নদীবক্ষে নৌকা, ঘাটের চ্যাঁচারির ছাতার তলায় পুরোহিত কর্তৃক সংস্কাররত যজমান, পূণ্যকামী স্নানার্থী, বাতাসে উড়ন্তচুল বধু, গঙ্গার  ওপারে আবছা-সবুজ পরিদৃশ্য পাঁচজনকে চিন্তামগ্ন ও আত্মহারা করিয়া তুলিয়াছে ।

আমার মাথায় এক ভিন্ন ভাবনা ।  কোন দেশের কে এক আইন ব্যবসায়ী ও উগ্র দক্ষিণপন্থী রাজনীতিক জোম্যাককার্থি, তদ্দেশে সাম্যবাদ-বিরোধীতাকে এমন পর্যায়ে লইয়া গেল যে আতঙ্কিত রাষ্ট্র তাহার নিজেরই স্বরাষ্ট্র দপ্তরের কর্মী, সেনা বিভাগ, বুদ্ধিজীবী, অভিনেতা, গণ্যমান্য ব্যক্তিগণের ভুতগ্রস্ত কালো তালিকা প্রস্তুত করিয়া হেনস্হা অপমান-যন্ত্রণার চূড়ান্ত করিয়া তুলিল, একঘরে ও কোণঠাসা করিয়া শ্বাসরুদ্ধকর পরিবেশ সৃষ্টি করিল । তাহাকে লাথি মারিয়া বিদায় করিবার পর কী হইল ? সীমালঙ্ঘনের বিস্ফোরণ, যাহার কয়েকটি ঢেউ অদ্য আছড়াইয়া পড়িয়াছে কাশীতে । যাঁহারা বার্ধক্য বারানসী শব্দবন্ধটির নিদান দিয়াছিলেন, তাঁহারা এক্ষণে এই শহরে আসিয়া চমকিত হইবেন । হিপি-হিপিনিগণ পধিমধ্যে পরস্পরকে টুকটাক চুমা খাইতেছে, স্হানীয় মানুষের ভ্রুক্ষেপ নাই ।

টেংরাগেঁটে আকৃতির যুবক, প্রণবের এই মন্তব্যে, শিশির আপনার ভাগ্য ভাল ; খুব জোর বাঁচিয়া গিয়াছেন, শুনিয়া চিন্তায় ছেদ পড়িল । প্রশ্নাতুর হইলাম ।

নির্মল, আমার দিকে না তাকাইয়া, নদীর সৌন্দর্য দেখিতে-দেখিতে বলিল, জোসেফিন স্পার্কস নামে যে যুবতীটির কথা শুনিলেন, তাহার পিতা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জর্জিয়া রাজ্যের ধনী গোমাংস ব্যবসায়ী । রাজ্যটিতে, এবং আমার সন্দেহ স্পার্কস পরিবারে, কু ক্লাকস ক্যানের ঘোর প্রভাব ছিল , যাহার সদস্যগণ ইহুদি, ক্যাথলিক ও কৃষ্ণকায়দের , খোলাখুলি ঘৃণা করার সংস্কৃতি লালন করে । জোসেফিন নিউ ইয়র্কে স্নাতক স্তরে পড়িতে গিয়া জনৈক ক্যাথলিক মেক্সিকান যুবকের প্রেমে পড়ে ও তাহাকে নিজের গৃহে লইয়া যায় । একে ক্যাথলিক তাহার উপর বিশুদ্ধ শ্বেতাঙ্গ না হওয়ায়, যুবকটি পরিজন প্রতিবেশিদের দ্বারা দ্বারা নির্মমভাবে প্রহৃত হয় । জোসেফিনকে স্বগৃহে বন্দি করিয়া রাখা হইয়াছিল ; তৎপশ্চাৎ উহাকে ব্রিটেনে অক্সফোর্ডে ভর্তি করা হইয়াছিল । পড়াশুনা জলাঞ্জলি দিয়া মেয়েটি ইসতানবুল কায়রো হইয়া বেনারসে আসিয়া যথেচ্ছাচার ও নিষেধভঙ্গের আস্তানা গাড়িয়াছিল ।

তুই কী করিয়া জানিলি, আমাকে তো বলিস নাই ? উল্লাস মিত্রের কথায় ব্যাঘাত ঘটিল কাহিনীতে, যাহার প্লটের ভিতর আমি কী ভূমিকা পালন করিতেছি, বোধগম্য নহে ।

নির্মলের জবাবদিহি, এতক্ষণ চিন্তা করিতেছিলাম, বলিব কি বলিব না । প্রণবের কথা শুনিয়া সাহস হইল । প্রণবকে আমি এতাবৎ এবিষয়ে কিছুই বলি নাই ।

প্রণব কহিল, আমাকে হিন্দি দৈনিক আজ পত্রিকার সাংবাদিক ও কার্টুনিস্ট বিক্রম পরিহার বলিয়াছে ।

নির্মল কাহিনী বজায় রাখিল, যাহা শিনিবার জন্য আমি যুগপৎ উৎকন্ঠিত ও উদগ্রীব ছিলাম ।

জোসেফিনের পিতামাতা প্রথমে কোতোয়ালিতে সন্ধান করিয়াছিলেন । কোতোয়ালি কর্তৃপক্ষ উহাদের আজ পত্রিকার বিক্রমের সহিত  দেখা করিতে বলে । বিক্রম হিপিগণের উপর নজর রাখে ও ভারতবিরোধী কার্য করিতে দেখিলে বা আড়িপাতিয়া শুনিলে, সেসব তথ্যাবলী কোতোয়ালিতে জানায় । বিক্রম হইল পুলিশের চর ।

তাহার পর কী হইল ? উ্ল্লাসের প্রশ্ন শুনিয়া মনে হইল সে  গল্পের রসে আমার চেয়েও বেশি জারিত ; সে তো শ্রোতামাত্র, যখন কিনা আমি গল্পের গোপন একটি পাত্র বলিয়া অনুমান ।

নির্মল বলিল, জোসেফিনের পিতামাতাকে আমার বাসায় লইয়া আসে বিক্রম, কেননা অতুল ও কেকা বউদির জাল হইতে জোসেফিনকে মুক্ত করার উপায় বিক্রম খুঁজিয়া পায় নাই । উল্লাস প্রশ্ন তুলিল, মুক্ত ? কী বলিতেছিস ? অতুলের সহিত তো স্বেচ্ছায় জোসেফিন বৎসরাধিক লিভ টুগেদার করিতেছে । কেকা বউদির সন্মতিক্রমে করিতেছে !

কন্ঠে শ্লেষ মিশাইয়া প্রণবের উত্তর, বাধ্যবাধকতা অধবা প্যাঁচ-পয়জার না থাকিলে কোনও স্ত্রী কি প্রতি রাত্রে তাহার নিজের ও সাড্ডল্য কন্যার চক্ষের সন্মুখে নিজের স্বামীর আরেক নারীর সহিত শয়ন সহ্য করিতে পারে ? সহ্য করিতে পারে কি যখন কয়েকমাস পর জানিতে পারিল জোসেফিন সন্তান-সম্ভবা, এবং কোনো শর্তে গর্ভপাত ঘটাইবে না বলিয়া প্রতিজ্ঞা করিয়াছে ? কেকা বউদির দেহের ছাঁদ ও কুখশ্রীর ধারেকাছে যাইবে না প্রায় হাড্ডিসার লম্বামুখ জোসেফিন স্পার্কস । হিপিগণের আগমনের পর হইতে অতুল শ্বেতাঙ্গ স্তন ও যোনির আসক্ত হইয়া পড়িয়াছিল ; তাহার নিকট একখানি শ্বেতাঙ্গিনী দেহ প্রতিরাত্রে পাইলেই হইল ।

আমি ভাবিতেছিলাম প্রতিবাদকে একজন বিদ্রোহী নারী কোথায় তুঙ্গে লইয়া যাইতে পারে । খ্রিস্টধর্মবিরোধী পৌত্তলিক প্যাগান ও কৃষ্ণকায় হিদেনের বিবাহ-বহির্ভূত সন্তান গর্ভে ধারণ, তাহাও মন্দির চত্ত্বরে ! এবং তাহার নাম কং ।

নির্মল কহিল, অতুলকে কেকা বউদি বাঁধিয়া রাখিয়াছিল জোসেফিনের উপস্হিত দ্বারা ।  জোসেফিনকে অতুল বাঁধিয়া রাখিয়াছিল উহার বিখ্যাত ফ্যাগ দ্বারা । কং-এর আগমনবার্তা সব ভণ্ডুল করিয়া দিল ।

ফ্যাগ কী ? আমি জানিতে চাহিলাম ।

নদীর দিকে দৃষ্টি আবদ্ধ রাখিয়া নির্মল উত্তর করিল, চারমিনার সিগারেটের ভিতর আফিম চরস ও গাঁজাপাতার মিশ্রণ , যাহার মৌতাতের নেশা হইতে জোসেফিনকে মুক্ত হইতে দেয় নাই অতুল । অষ্টপ্রহর উহাকে নেশায় আচ্ছন্ন রাখিত । ফ্যাগ বস্তুটির ফরমুলা প্রস্তুতকারক হইলেন স্বয়ং কেকা বউদি । জোসেফিনও অতুলের বিছানা ও নেশাজগত হইতে মুক্তি চায় নাই বলিয়া প্রতীয়মান হয় । পিতামাতা ও সমাজের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ তাহাকে আত্মধ্বংসে প্ররোচিত করিয়া থাকিবে । উহার পোশাকে লিখিত থাকিত, ফাক দি  ইনভেডার্স অব ভিয়েৎনাম বা লং লিভ ভিয়েৎকং ।

সে যাহা হউক, জোসেফিনের মাতাপিতা কী করিয়া বাচ্চাটিকে ফেলিয়া জোসেফিনকে লইয়া গেলেন ? জানিতে চাহিল উল্লাস ।

নির্মল বলিল, বিক্রমকয়েকদিনের মধ্যেই সংবাদ আনিল যে চোরাকারবারি সুখেশ্বর পাসোয়ানের সহিত অতুল গোরক্ষপুর গিয়াছি, চারপাঁচ দিন পর মালের কনসাইনমেন্ট লইয়া ফিরিবে । জানিতে পারিয়া জোসেফিনের মাতাপিতাকে তাঁহাদের হোটেল হইতে লইয়া গেলাম কেকা বউদির নিকট। দশ হাজার ডলার ক্যাশ লইয়া কংকে পোষ্য করিয়া নিজের পরিবারে রাখিতে রাজি হইলেন কেকা বউদি । নেশায় চুর করানো জোসেফিনকে কেকা বউদি ও কুহু ধরাধরি করিয়া গলির বাহিরে আনিল । পিতামাতা টাঙ্গা লইয়া অপেক্ষা করিতেছিলেন, দশাশ্বমেধের পূর্ববর্তী গোলচক্রে । তাঁহারা সম্ভবত সেইদিনই কলকাতা পাড়ি দিলেন । ঢাকা, কোলোম্বো না ব্যাংকক, তাহা আমাকেও জানান নাই ।

আমি বলিলাম , ঘরের মেয়ে ঘরে ফিরিল, কিন্তু আমি কী করিয়া খুব বাঁচিয়াছি, তাহা বুঝিলাম না ।

দ-শ-হা-জা-র-ড-লা-র ! উল্লাসের উচ্চারিত স্বগতোক্তিতে পথচারীগণ ফিরিয়া তাকাইলেও নির্মল এবং প্রণব প্রতিক্রিয়া অব্যক্ত রাখিল । বিপুল টাকা, সন্দেহ নাই । বারাণসীতে একটি বাগানবাড়ি অথবা মধ্য কলকাতায় তিনতলা সুদৃশ্য অট্টালিকা হইয়া যাইবে ।

নির্মলের কথার মুগুরে আমার মস্তিষ্কের চাক হইতে মৌমাছি বোলতা ভিমরুলের ঝাঁক অজানা ভয়ে আমাকে নিমেষে ঘর্মাক্ত করিল । ওই বিদেশিনী শাঁকচুন্নিকে আপনার ঘাড়ে চাপাইবার ষড়যন্ত্র পাকা করিয়া ফেলিয়াছিল আপনার বন্ধু ও তদীয় পত্নী ; উহারা জানে আপনি যেকোনো শ্বেতাঙ্গিনীর সহিত শয়ন করিবার জন্য লালায়িত ।

হ্যাঁ, আমি শুশ্ককন্ঠে প্রত্যুত্তর করিলা, অদ্যাবধি শ্বেতাঙ্গিনী দেহ আলিঙ্গনে পাই নাই ; সম্ভবত জোসেফিনকে পাইলে, আপনাদের বক্তব্য অনুযায়ী সুশ্রী ও মাংসল না হইলেও, যতদিন কাশীতে আছি, আহারে-বিহারে-শয়নে-স্বপনে গ্রহণ করিতাম । তবে, শিশু-সন্তানের ফ্যাঁকড়া ও দুগ্ধবতী স্তনসহ যুবতীকে লইতাম কিনা নিশ্চয় করিয়া বলিতে পারি না ।  মহিলাটিকে দেখিলে নির্ণয় লইতে পারিতাম । তেমন-তেমন দেখিলে স্বগৃহে লইয়া গিয়া বিবাহ করিতেও পারিতাম । কথাগুলি বলিতেছিলাম ও স্মৃতিতে ঝিলিক দিয়া উঠিতেছিল কাঁধ হইতে হাঁটু পর্যন্ত পীতাভ-গোলাপী দীপ্তিময় নারীদেহ । দীর্ঘশ্বাস সে কথার আনাচে-কানাচে, তাহা যথাসম্ভব চাপিয়া বলিলাম, মনে হইতেছে কল্যই ফিরিতে হইবে ।

নির্মলব্যাটা  ধরেছে ঙিক । কংকে পয়দা করার জন্যে জোসেফিন যেই গোঁ ধরল, তখন অতুলের অবস্হা খাঁচার ইঁদুরের মতন । বেশ এনজয় করেছি অতলের ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি দুরবস্হা । শিশির দত্তকে চিঠিটা আমিই লিখেছিলুম, আমার নিজের হাতের লেখায় । তা ধরতে পারেনি নির্মল, হাতের লেখাই  দ্যাখেনি কখনও ; অতুলের ইংরেজিতে সই দেখে থাকবে ওর তথাকথিত পেইনটিংগুলোয় ।

অতুল যেই বলল যে ওর বন্ধু শিশিরটা বেশ ছোঁক-ছোঁক টাইপের, আমি বললুম, তাহলে ওকেই লোভ দ্যাখাও । পরিকল্পনা বদলাতে হল জোসেফিনের বাপ-মা এসে পড়ায় । কিন্তু কংটাকে পোষ্য করতে যখন বাধ্য হলুম, তখন শিশিরকে বিকল্প এক ষড়যন্ত্রের তুরুপের তাস করব বলে ছকে নিয়েছিলুম । আসুক শিশির , টোপ তো ফেলাই আছে । এসে পড়ার পর বঁড়শিতে অন্য টোপ গিঁথে দেবো । শেষ পর্যন্ত মেরেও দিলুম বাজি । মানুষ মানুষের কাজে লাগবে বলেই তো মানুষকে মানুষ বলে । যারা কাজে লাগাতে পারে না তারা অমানুষ ।

শুধু জোসেফিনকে ঝেড়ে ফেলাটুকুই তো নয় । আমার মগজে যা চলছিল, তাকে বলা যায় বৃহত্তর ষড়যন্ত্র । ব্যাকঢ চুপচাপ টাকা জমিয়ে গেছি, আর তার গরমে তাপ খেয়েছে আমার মগজ । ওৎ পেতে অপেক্ষা করেছি সময়-সুযোগের ; ফাৎনা নড়ে উঠতেই, ব্যাস, ঘ্যাচাং ।প্রসন্নর সঙ্গে প্রেম করেই বিয়ে করেছিলুম, যখন ও চাকুলিয়ায় ডাকঘরে পোস্টেড ছিল । চিঠি ফেলতে গিয়ে আলাপ । ভেবেছিলুম, দেখতে-শুনতে লালটুশ, সরকারি চাকরি করে । কিন্তু তখন কী করে জানব যে ওর লেংটু নামক বস্তুটা অপদার্থ মাংসখন্ড ! ডাক্তারও হাল ছেড়ে দিলে । কুমারীই থেকে গিয়েছিলুম বিয়ের কত বছর পরও । অথচ হিজড়ে ইডিয়েটটা, প্রেম করেও, কুড়ি হাজার টাকা যৌতুক নিয়েছিল । প্রসন্নটা ছিল আস্ত অমানুষ আর আমি একজন জলজ্যান্ত মানুষ । প্রেমে পড়লে মেয়েদের উচিত প্রেমিকের পুরুষত্ব যাচাই করে নেয়া । নইলে কোনোদিন আঁওল ভাঙবে না ।

আতুলকে তো বলতে গেলে গেঁথে তুলেছিলুম । দুপুরে ওকে কয়েকদিন শরবত, পেঁয়াজের বড়া আর পিরিতের অগড়-বগড় খাইয়ে, ঘনিষ্ঠ হতেই, সদ্য গোঁফ-বেরোনো অতুল চলে এল আঁচলের নিয়ন্ত্রণে । প্রথম দুপুরের পর, রাস্তাঘাট ফাঁকা থাকলে, বারান্দায় দাঁড়াতুম আর অতুল চলে আসত । গোঁফ-দাড়ি কামিয়ে প্রেমিক-প্রেমিক চেহারা নিয়ে আসত ; হয়ত ভাবত ও কচি বলে আমি আবার ওর হাত থেকে ফসকে কোনো দরকচার পাল্লায় গিয়ে না পড়ি । সত্যি কত কচি ছিল অতুল, শেষে সেও দরকচা মেরে গেল । সব পুরুষই বোধহয় কিছুদিন ব্যবহারের পর দরকচা মেরে যায় । সাময়িক সম্পর্কই একমাত্র সম্পর্ক , আর যত কচি তত ভাল ।

যখন শুনল প্রসন্নটা পুরুষত্বহীন হিজড়ে আর আমি ওর বাচ্চার মা হতে চলেছি, ঘাবড়ে গিয়ে অতুল বর্ধমান থেকেই উধাও হয়ে গেল । ওর আড়পাগল বাবার সঙ্গে দেখা করতে, খঞ্জনি বাজানো থামিয়ে, বলেছিলেন অতল নবদ্বীপে । দিনভর হরিনাম গেয়ে-গেয়ে ওর বাবার ফুসফুস ওনার দেহটাকে চাঙ্গা রেখেছে দেখেছিলুম, গলায় কন্ঠী, কপালে চন্দনের তেলক । তখনই ভালো করে জানলুম যে অতুলরা বৈষ্ণব ।

উধাও হবার কিছুদিন পর দাড়ি-গোঁফ বাড়িয়ে অতুল এক দুপুরে এসে বলল, ও নবদ্বীপে নয়, বেনারসে আছে, একখানা দেবোত্তর সম্পত্তি দখলের তালে আছে । তারপর কয়েকবার এসে পথে দাঁড়িয়ে অতুল শুনে গেছে আমি আর আমার  মেয়ে মার খাচ্ছি । ত্রাহি কাঁদছি । রাস্তায় দাঁড়িয়ে ও বুঝতে পারত যে ওর দেয়া বাচ্চার জন্যেই মার খাচ্ছি :; শুধু ও জানত আর আমি জানতুম সেই বদম মার খাবার রহস্য । নমাসে-ছমাসে এসে ও দেখে যেত আমার মার খাওয়া দেহের দাগগুলো । ভাবতুম, মন রাখার জন্য অভিনয় করে সমবেদনা জানিয়ে চলে যায় ।

কুহুর যখন ছ’বছর বয়স, তখন পালিয়ে যাবার প্রস্তাব নিয়ে অতুল এলো । আমরা আলাদা-আলাদা হাওড়া স্টেশানে পৌঁছে সোজা মোগলসরাই , সেখান থেকে বেনারসের এই মন্দির চত্ত্বরে । মন্দিরের শিবলিঙ্গ পথচলতি আয়োসুয়োরা দেখতে পেত না বলে বিসর্জন দিয়ে বড় মাপের কালো গ্র্যানাইটের লিঙ্গ প্রতিষ্ঠা করলুম । আর দ্যাখে কে । শিব জাগ্রত হলেন, আর আমার নিজের নিয়মিত আয়ের ব্যবস্হা হল ।

ভালই চলছিল । কিন্তু প্রথম থেকেই বুঝতে পারছিলুম, আমার প্রতি অতুলের আর আকর্ষণ নেই । কিংবা আমাকে ছুঁতেই বোধহয় ভয় পায় । কচি মন নিয়ে যা করেছিল তা করার সাহস ফুরিয়ে গিয়ে ওর মধ্যে আমি হয়ে উঠেছি অন্যের পলাতকা স্ত্রী । একজন ভক্তের কাছে শুনলুম, বেনারসে এসে কোনো অবাঙালি হাত-ফেরতা যুবতীর সঙ্গে ও সম্পর্ক পাতিয়েছিল । মেয়েটা নাকি এই মন্দিরচত্ত্বরে অতুলের সঙ্গে দিনপনেরো ছিল । শেষে মেয়েটার অনোন্যপায় বাবা-মা ওকে ধরেবেঁধে বেনারস ছেড়ে নিজেদের গ্রামে চলে গেলেন ।  মেয়েটার সূত্রেই অতুল গাঁজা-চরস-আফিম কারবারিদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পেরেছিল । হাত-ফেরতা মেয়ে, কতজনের সেতুবন্ধন ঘটিয়েছিল কে জানে ।

অতুল সামনের ঘরটায় শুতো, যেমন ও প্রথম থেকে শুতো, আমরা আসার আগে থাকতে । আমার আর কুহুর বভবস্হা করে দিল পেছনের ঘরটায় । দুই ঘরের মাঝে উঠোনের পাশে অতগুলো ঘর ফাঁকা থাকলে অতুলের কান্ডকারখানা আমার আওতার বাইরে চলে যাবে ভেবে আমিই ঘরগুলো তীর্থযাত্রীদের ভাড়া দেয়া শুরু করলুম । তারপর হিপিরা একের পর এক আসা আরম্ভ করলে তাদের দিতে লাগলুম ; ভালো পয়সা দিত হিপিগুলো , চাইতে হত না আমাদের দিশি লোকেদের মতন ।  কিন্তু কে জানত হিপিগুলোর মধ্যে চরসের নেশায় মশগুল জোসেফিন স্পার্কস নামে ভয়ংকর বিপদ একদিন উদয় হবে আর সুখ-শান্তি নষ্ট করে দেবে, এমনকি জীবনের পথটাই বদলে দিয়ে চলে যাবে । এখন যদিও মনে হয় যে জোসেফিন এসেছিল, ভালই হয়েছিল, জীবনকে নিজের নিয়ন্ত্রণে করে নিতে পেরেছিলুম ।

লোচ্চা-লোফার শিশিরটা অকালের বাদলা জোসেফিনের চরিত্রে প্রতিবাদীর গুণ পেল । আরে ও তো আমেরিকান । আমি বাঙালি বউ হয়ে যে প্রতিবাদ সারাজীবন প্রতি পদে করে গেলুম, তা তোর নজর এড়িয়ে গেল কী করে !

ইউরোপে রেনেসঁসের হর্ষোল্লাসে ঈশ্বরপ্রণীত নিয়মশৃঙ্খলার ভাঙনকে মুক্তি হিসাবে গ্রহণ করা হয়েছিল । মৃত ঈশ্বরের সিংহাসনে বসানো হয়েছিল মানুষকে । পরিবর্তনটি ভূমিকম্প ঘটিয়ে দিয়েছিল মানবসমাজে; প্রথমে ইউরোপে, তারপর উপনিবেশগুলোয় । প্রায় প্রতিটি উপনিবেশে, সেখানকার ঈশ্বর এবং গোষ্ঠীগুলোর ইষ্টদেবতাকে, মেরে ফেলতে ইউরোপ যে সফল হয়েছিল, শুধু তা-ই নয়, সে-সমস্ত দেশের ইউরোপীয়-মুল্যবোধ প্রভাবিত ভূমিপুত্রদের মধ্যে এই চিন্তাচেতনাকে ইতিবাচক গরিমা দিতে পেরেছিল । তার আগে ইশহবর বা দেবী-দেবতার সঙ্গে তুলনা করে ব্যক্তিমানুষকে প্রতিষ্ঠা দেয়া হতো অমুক লোকটি দেবতুল্য, বা মহিলাটি সাক্ষাৎ ভগবতী ।

এই যে অটুলস ফ্যাগ নামের সিগারেটটা, ওটা আমিই মাথা খাটিয়ে আবিষ্কার করেছি । অতুল তো লুকিয়ে-চুরিয়ে আঁদরু পেঁদরু সেজে চরস আর আফিম বিক্রি করত । আমিই চারমিনার সিগারেটের তামাকের সঙ্গে গাঁজাফুল আর ডগার পাতা, শুখা চরস আর আফিমের মিশেল দিয়ে দশটা সিগারেট প্যাকের ভদ্রজামা পরালুম । বেরোতেই হিট । বিক্রি দেখে অতুলের চোখ ছানাবড়া । আমি নিজে অবশ্য ও ধোঁয়া গিলি না, আমাকে  অনেক বছর বাঁচতে হবে, বেঁচে থাকার আনন্দ নিতে হবে । ব্যর্থ প্রাণের আবর্জনা পুড়িয়ে ফেলতে হবে ।

তখন কোনো নিয়ম-নিষেধ ছিল না । আশির দশকের মাঝ থেকে সরকার আইন করে সব বন্ধ করে দিলে । আমি তার আগেই বন্ধ করে দিয়েছিলুম । হিপিরা আসা বন্ধ হল, আমার জীবনের পথও বদলে ফেললুম ।

৩. ঘর হতে শুধু

 

১০

নির্মল একটি চারমিনার ধরাইয়া, একটান ধুম্র গিলিয়া আমায় হস্তান্তর করিল, সম্ভবত আতঙ্কের হিমঘাম ও পরাজয়বোধের অসহায়তাকে দূরীভূত করিবার জন্য । জিজ্ঞাসা করিলাম, ইহাই কি অতুলের কুখ্যাত ফ্যাগ, যাহা সকালে ফুঁকিয়াছি ?

না না, নির্মলের দ্রুত উত্তর, সকালে যাহা পান করিয়াছেন ইহা সেই বস্তুই, তবে অতুলের ফ্যাগ নহে । ইহা চারমিনার তামাকের সহিত মিশ্রিত দেশজ গাঁজা ও সামান্যমাত্র চরসগুঁড়া দেয়া, মারিহুয়ানাও নহে । মণিকর্ণিকা যাইবার পথে লাইসেন্সপ্রাপ্ত দোকানে গাঁজার পুরিয়া সরকার নির্ধারিত দামে প্রতি সন্ধ্যায় বিক্রয় হয় , যদিও হিপিগণ ও ছাইমাখা সাধুগণ ওই দুই ঘন্টায় বিরক্তিকর ভিড় জমাইয়া তোলে । সংকটমোচনের নিকটবর্তী দোকানটি সে-তুলনায় শ্রেয় । কলকাতায় খালাসিটোলা নামক দেশি মদ্যের দোকানের পাশেও আছে একটি সরকারি দোকান, একবার গিয়াছিলাম কলকাতাস্হ চিত্রশিল্পীগণের সহিত, আমার সোলো প্রদর্শনীকালে ; লেডি রাণু মুখার্জি উদ্ঘাটন করিয়াছিলেন প্রদর্শনীটি ।

উপেন সরদার কহিল, প্রথমবার ফ্যাগ ফুঁকিলে, যদি অভ্যাস নাথাকে, ডিগবাজি খাইবেন । প্রথমবার আমিই দিব আপনাকে, একখানা পড়িয়া আছে, আইসক্রিম খাইতে-খাইতে ফুঁকিবেন, মহানন্দ পাইবেন । প্রণব কহিল, না না, এমনিই ফুঁকিবেন, নতুবা আইসক্রিমে অভিজ্ঞতা চাপা পড়িয়া যাইবে ; প্রথমবারটি সর্ববিষয়ে স্মরণীয় থাকা উচিত । প্রণবের ইশারা বুঝিতে পারিলাম ; আমার তো প্রতিবারই প্রথমবার প্রতীয়মান হয় , বলিলাম ।

কয়েকটি সুখটান দিবার পর আত্মস্হ হইলে, উল্লাসকে দিতে, সে প্রণবকে দিল এবং আমার দিকে তাকাইয়া বলিল, আমি নেশা-নারী ইত্যাদির গোলকধাঁধায় নাই ।

প্রণব ফুঁকিতে-ফুঁকিতে তাচ্ছিল্য করিল, ও এখনও ভারজিন ; ভারতবর্ষের একমাত্র চিরকুমার চিত্রকর  এবং ভাস্কর ।  সে কারণে নিউড আঁকে নাই আজও, নগ্ননারী মূর্তিও গড়ে নাই । উল্লাস কহিল, নগ্ন নারী দেখিতে-দেখিতে কী করিয়া আঁকিব জানি না, কেননা আমি উত্তেজিত হইয়া পড়িব, আমার দ্বারা আত্মনিয়ন্ত্রণ সম্ভব নহে, একাগ্র হইতে পারিব না । বিশ্বখ্যাত চিত্রকরগণ কী করিয়া আত্মনিয়ন্ত্রণ করিতেন জানি না ; হয়ত আমি দক্ষ চিত্রকর ও ভাস্কর হইতে পারিব না ।

আপাতত এশহরে থাকুন, তীর্থ করিতে আসিয়াছেন, পূণ্য লাভ না করিয়া ফিরিবেন কেন ? হোটেলে থাকা চলিবে না ; তাহা সম্ভবপর নহে । হোটেলগুলি দুই-তিন দিনের চেয়ে বেশি বসবাসযোগ্য নহে । ঘর ভাড়া করিতে হইবে । চওক, গোধোলিয়া, বাঙালিটোলা, মাহমুরগঞ্জ, কামাচ্ছা, সিগরা সর্বত্রই ঘর ভাড়া পাইবেন । শবদাহের গন্ধ সহ্য করিতে পারিলে মণিকর্ণিকা যাইবার পথে যে ঘরগুলি পাওয়া যায়,  তথায় থাকিলে পোস্টকার্ডে লিখিত ইষ্টলাভ করিবেন । ওই এলাকায় মাত্রাহীন যথেচ্ছাচারও স্বাভাবিকতার মাত্রা পাইয়া থাকে । আশ্বস্তকারী দীর্ঘ বক্তৃতার পর নির্মল কহিল, ঘর না পাওয়া পর্যন্ত আমার গেস্টরুমটিতেই থাকুন ; আমি ভৃত্যকে বলিয়া দিব, তাহাকে টাকা দিলে সে বাজার হইতে চা-খাবার আনিয়া দিবে । কলকাতা হইতে আমার পরিচিত চিত্রশিল্পী ও ভাস্করগণ আসিলে ওই ঘরটিতেই কয়েকদিন আশ্রয় লন ।

সবাই পুনরায় চুপচাপ । নেশা করিলে দেহের ভিতরেই বার্তার চোরাস্রোত বহিতে থাকে বলিয়া কাহারও সহিত সেসময়ে কথা বলিবার প্রয়োজন হয় না । বালকবয়স হইতে পূঞ্জীভূত কথাবার্তা ভাসিয়া উঠিতে থাকে সংলগ্ন দৃশ্যাবলীর সহিত ।  পনেরো মিনিট পরে উল্লাস বিদায়-সৌজন্য না জানাইয়া উঠিয়া চলিয়া গেল ।

হিন্দি ভাষার প্রখ্যাত কবি নাগার্জুন স্নান করিয়া ফিরিতে ছিলেন, যাঁহার সঙ্গী যুবগণের দিকে হাত তুলিয়া অভিবাদন জানাইল আমার সঙ্গী চিত্রকরগণ । নাগার্জুন বৌদ্ধ ধর্ম গ্রহণ করিয়াছেন, বলিল নির্মল । ভাবিলাম, ধর্মের কোনো প্রয়োজন আছে কি মানবজীবনে ! ধর্ম লইয়া কী করিব ? কেহই মহাপুরুষগণের ন্যায় হইতে পারে না, তাঁহাদের পদাঙ্ক অনুসরণ করিতে পারে না, কেবল পরস্পরের সহিত ঝগড়া করিয়া মরে ।

প্রণব বলিল, নাগার্জুনের সঙ্গীদের মধ্যে চশমা পরা যুবকটি কাঞ্চন মুখোপাধ্যায়, আমুখ নামে সশস্ত্র বিপ্লবপন্হী পত্রিকার সম্পাদক, সকলে উহাকে কাঞ্চনকুমার বলিয়া ডাকে ; নকশালপন্হীগণ পিতৃদত্ত নাম পরিত্যাগ করিয়া থাকেন, অনেকটা সন্ন্যাসীদের ন্যায় ; ময়লা কোঁকড়াচুল স্বাস্হ্যবান যুবকটি সুবিমল বসাক, আমাদের গেরিলা পেইনটার্সের হ্যাপেনিঙে কয়েকদিন পূর্বে অংশগ্রহণ করিয়াছিলেন ।

নির্মল কহিল, অদ্যরাত্রে তো আপনি আমার গেস্টরুমে থাকিবেনই, ইচ্ছে হইলে অংশগ্রহণ করিবেন ।

পাঁচজনে পুনরায় কথাবার্তার বিষয়হীনতায় আক্রান্ত হইয়া চুপচাপ বসিয়া রহিলাম । মানুষ একত্রিত হইয়া চুপচাপ বসিয়া থাকে । চুপচাপ বসিয়া থাকিবার জন্যই একত্রিত হয় । হয়ত ইহা আদি মানবের অবদান বা তাহারও পূর্বের স্মৃতিভার । তখন মানুষ মুখ বুজিয়া ঘাসে চরিত, হরিণের মতো, বা ডাঙায় রৌদ্রস্নানরত কুমিরের ন্যায় ।

বরুণা ও অসি নদীগুলি কোথায়, যাহাদের সঙ্গমে এই বারাণসী তীর্থ, বর্তমানে অর্ধচন্দ্রাকৃতি গঙ্গার তীরে অবস্হান করিয়া ভূখন্ডটি অতুল, কেকা বউদি, জোসেফিন, উপেন, মোহিত, নির্মল, প্রণব ও আমার মতো শতশত মানুষের কার্যকলাপে প্রশ্রয় দিতেছে ! একদা  ধন্বন্তরির পুত্র দিবোদাস এই শহরকে বৌদ্ধধর্মে দীক্ষিত করিয়াছিলেন । যখন এই এলাকাটি গৌড়ের রাজা মহীপালের রাজত্বের অন্তর্গত ছিল, কত বাঙালি বৌদ্ধ আসিয়াছিলেন । তাঁহাদের বংশধররা কোথায় ?  তীর্থটি কনৌজ-রাজ দখল করিলে, যে কনৌজিয়া বাঙালি শৈবধর্মীগণ আসিয়াছেলেন, তাঁহারা কোথায় ? কাঞ্চন মুখোপাধ্যায়, যিনি নকশাল কাঞ্চনকুমার নামে খ্যাত, তিনি কি সেই শৈবগণের বংশধর ? নির্মলের পুর্বপুরুষগণ কি বৌদ্ধ ছিলেন ? ধার্মিক রাজনীতি বোধহয় রাজনৈতিক ধর্মরূপে আত্মপ্রকাশ করিয়াছে ! যোনির ভিতর প্রবিষ্ট লিঙ্গ এ-শহরে পূজ্য । নিজের ইন্দ্রিয়গুলিকে প্রশ্রয় দিতে তাই থাকিয়াই যাইব এই তীর্থক্ষেত্রের প্রাচীন মানুষগণের ভিড়ে । এক মাস না হউক, অন্তত এক সপ্তাহ তো থাকিয়া যাইতেই পারি । কত যে দেবী-দেবতার মন্দির এই শহরটিতে নির্মাণ করা হইয়াছে, বোধহয় হাজার বৎসর ধরিয়া, তাহার ইয়ত্তা নাই । একজন খুচরো দেবতারূপে টকিয়া থাকিব কয়েকদিন, পিঁপড়া বা আরশুলা যেভাবে এই তীর্থক্ষেত্রে টিকিয়া আছে রাজা হরিশচন্দ্রেরও পূর্ব হইতে ।

নির্মলের কথায়, মিশ্র সিগারেটের নেশার তন্দ্রা বিঘ্নিত হইল । আমরা যাইতেছি শিশির ; আপনি ঘোরাঘুরি করিয়া অঞ্চলটি দর্শন করুন । ক্লান্ত হইলে নিকটবর্তী কোনো হোটেলে খাইয়া-দাইয়া রিকশয় চাপিয়া চলিয়া আসিবেন । গেস্টরুমে কতিপয় নেশার চারমিনার টেবিলের উপর রক্ষিত আছে ; ইচ্ছা হইলে ফুঁকিবেন, একা-একা নেশাচ্ছন্ন থাকিবার পরমানন্দের বৈশিষ্ট্যটি উপভোগ করিতে পারিবেন । উহারা সদলে উঠিয়া প্যান্টের পিছন দিক ঝাড়িতে ঝাড়িতে চলিয়া গেল ।  এদিক-ওদিক তাকাইয়া বুঝিলাম, আমরা ভিখারিগণের কাতারে বসিয়াছিলাম । এই স্হানটিও কোনো ভিখারির জন্য নির্দিষ্ট । ফুটপাতের ওই পারে দণ্ডায়মান ভিখারিটিকে দেখিয়া অনুমান করিলাম সে অপেক্ষা করিতেছে কখন আমরা তাহার সিংহাসনটি খালি করিব । লোকটি তো পঙ্গু নহে, কেন সে কাঞ্চনকুমারদের নকশাল আন্দোলনে যোগ দিতে চাহে নাই !  রাষ্ট্রের বিরোধীতা করা কি প্রতিটি ভিখারির জন্মসিদ্ধ অধিকার নহে ?

নির্মল প্রমুখ যাইবার কিয়ৎক্ষণ পর আমিও উঠিয়া পড়িলাম । নিচে নামিয়া গঙ্গার তীর ধরিয়া হাঁটিতে লাগিলাম । একটি ঘাটে দেখিলাম আকাশি রঙের সালোয়ার-কুর্তা পরিহিত এক যুবতী উপর হইতে দ্রুতবেগে আমার দিকেই ছুটিয়া আসিতেছে । কে মেয়েটি ! সে তো আমার পরিচিত নহে । বেনারসে চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের মানুষের অভাব নাই । এই মেয়েটিও অমন কোনো গোপন বৈশিষ্ট্য লইয়া তীর্থক্ষেত্রটিতে আসিয়া থাকিবে । প্রমাদ গণিয়া কয়েক পা পিছু হটিতে, মেয়েটি গঙ্গায় নামিয়া পাঁচ-ছয়বার ডুব দিয়া একইভাবে তড়বড় করিয়া উঠিয়া চলিয়া গেল । অজানা ভয়ে পুনরায় আক্রান্ত হইয়া সিঁড়ি বাহিয়া ঘাটের ছাউনিতে গিয়া চটি খুলিয়া মাটিতে বসিয়া পড়িলাম । মনস্হ করিলাম, ভয় ও নেশা কাটিয়া গেলে কোনো পরিচ্ছন্ন রেস্তরাঁয় গিয়া মাছ-ভাত খাইব । আমি মাত্র কয়েক ফুঁকেই নেশায় উড়িতেছি, মস্তিষ্কের ভ্রমরগুলি ভোঁ-ভোঁ করিতেছে, চক্ষের সন্মুখে অজস্র প্রজাপতি ভাসিতেছে, আতসবাজির ফুলকি ছড়াইয়া পড়িতেছে, অথচ নির্মলগণ কী করিয়া ফুঁকের পর ফুঁক মারিয়া সহজ-স্বাভাবিক আচরণ করিতে পারে !

ছাউনিতে পৌঁছাইয়া মনে হইল, এই ঘাটটি মহিলাগণের জন্য নির্ধারিত । শরীরের নিয়ন্ত্রণ হারাইয়া ফেলিয়াছি বলিয়া ঘাটটি ছাড়িয়া অন্যত্র যাইবার সাহস পাইলাম না । মহিলাগণ যাইবার-আসিবার সময়ে একপলক দেখিয়া ভ্রুপল্লবে সন্দেহের ঢেউ তুলিতেছেন । সেই আকাশবসনা সিক্ত দেহ লইয়া যে স্হলটিতে হয়ত ক্ষণিক স্হির হইয়া শ্বাস লইয়াছিল, আমি সেই লক্ষ-লক্ষ নারী পদচিহ্ণ-আঁকা ক্ষয়িত পাথরে বসিয়া পড়িলাম । য়ুঝিতে পারিলাম যে প্যান্টটি পিছনদিকে সম্পূর্ণ ভিজিয়া গেল । নেশাগ্রস্ত অবস্হায় পশ্চাৎদিক ভিজাইয়া ভালোই লাগিল । টের পাইলাম যে ক্লান্ত ও হাতাশাচ্ছন্ন আমার মাথাটি কাঁধ হইতে বিচ্ছিন্ন হইয়া, বাতাসে ভাসমান অবস্হায় ইতি-উতি তাকাইয়া মিটিমিটি হাসিতেছে । মাথাটি আর ঘাড়ের উপর ফিরিয়া না আসিলে কি করিয়া নির্মলের গৃহে যাইব সে দুশ্চিন্তায় পড়িলাম । বেনারস হইতে বাড়িই বা ফিরিব কী করিয়া ? কেবল ধড় দেখিয়া বাড়ির কেউ কি বিশ্বাস করিবে যে আমি শিশির !

দেখিলাম জনৈকা স্হূলকায়া প্রৌঢ়াকে, যাঁহার এক হস্তে গঙ্গাজল ভর্তি পিতলের চকচকে ঘটি ও অপর হস্তে ফুলে সজ্জিত রূপার ডালি, মুণ্ডটি তাঁহাকে প্রশ্ন করিয়া বসিল, মাতাজি আপনি তো প্রতিদিন আসিয়া, বহু বৎসর হইতে পূনভস্নান করিতেছেন ; আপনি কি ভাগবানকে দেখিয়াছেন ? হতচকিত পৌঢ়া সেদিকে চাউনি মেলিয়া প্রস্হান করিতে, মুণ্ডটি নিমীলিত চক্ষে আমার গলার উপর স্বস্হানে আসিয়া বসিতে আশ্বস্ত হইলাম ।

কিয়ৎক্ষণ পর যৎসামান্য সম্বিত ফিরিল, এবং মনে হইল, কেহ আমার কোলে মাথা রাখিয়া আমার দুই পা ধরিয়া আছে, ফোঁপাইতে-ফোঁপাইতে বলিতেছে, বাবা আমাকে ক্ষমা করুণ, আমি আপনাকে চিনিতে পারি নাই মহারাজ, কবে হইতে আমি আপনার দর্শনাভিলাষী, আপনার সাধারণ পোশাক দেখিয়া বুঝিতে পারি নাই আপনি নগন্য মানবদেহ আশ্রয় করিয়া আমার আস্হা পরীক্ষা করিবেন ।

বুঝিলাম আমার হিমঘাম ফিরিতেছে । শিরায় লুক্কায়িত আতঙ্ক মহাউল্লসে গিয়া আছাড় খাইতেছে হৃৎপিণ্ডে । কোলে রক্ষিত মাথার কম্পিত ক্রন্দন, ও ক্রমে উচ্চরবে ক্ষমা যাচনায় নেশা, অন্তত কিছুটা,  বিলীয়মান হইতে থাকিলে, বুঝিতে পারিলাম, সেই প্রৌঢ়া, ফিরিয়া আসিয়াছেন ; তাঁহার সিক্ত ও আলুলায়িত কাঁচাপাকা চুলে আমার ছাইরঙা প্যান্ট ও বুশশার্টের কিয়দংশ আরও ভিজিয়া গিয়াছে । ত্বকের উপরে চোরকাঁটার আকারে দেখা দিতেছে ত্রসন ।

নিজেকে ধাতস্থ করিবার প্রয়াস করিলাম । শুনিলাম, আমার সন্ত্রস্ত ও অভিশঙ্কিত কন্ঠ ভঙ্গ-হিন্দি মিশ্রিত বাংলায় বলিতেছে, মাতাজি, এ আপনি কী করিতেছেন, উঠুন, উঠুন, আপনি আমার দ্বিগুণ বয়সী, পায়ে হাত দিবেন না, উঠুন উঠুন, কাঁদিবেন না, কাঁদিবেন না, ছি ছি ছি, এ আপনি কী করিতেছেন !

আমার স্বকীয় অন্তর্কলহের কলুষ আমায় বারংবার এইরূপ বিপদে আনিয়া আছড়ায়, এবং ততই নিজেকে তামসিক অন্ধকারে আহ্লাদিত করিতে চাহিয়াছি । অসুখিত, বেদনাতুর, অভিসন্তপ্ত হইয়াছি তজ্জন্য , কিন্তু গ্লানি ও পাপবোধ হয় নাই । কিছু-কিছু কাজ কেন করি, সেই স্কুল জীবন হইতে, তাহার ব্যাখ্যা আমার নিকট কেবল একটিই । আমি অভিজ্ঞতার বুভুক্ষু । সকালে, সিগারেটে ম্যাডেলিনের লালায় আমি প্রাণোচ্ছল সজীবতা অর্জন করিয়াছিলাম । কেকা বউদির মুখ ্‌ইতে ধুম্রপানের গন্ধ নির্গত হওয়ায়, আমি ইশারা পাইয়াও, ঠোঁটে ঠোঁট চাপিয়া ধরি নাই– সে সময়ে নারীমুখ-গহ্বরের উৎকন্ঠিত শ্বাসে সিগারেটের সুবাসটিই ছিল আমার অভিজ্ঞতার কেন্দ্র ।

এই প্রৌঢ়ার ধর্মভাবনায় না জানি কোথায় আঘাত দিয়া ফেলিয়াছি যে তাঁহার পীড়া আমার কোলে ক্রন্দন হইয়া প্রকাশিত হইতেছে । এক্ষণে আমি কী করিব ! তাঁহার বাহু ধরিয়া তুলিবার প্রয়াসে বুঝিলাম, ইতোপূর্বে ডালির ফুলগুলি আমার মাথার উপর উপুড় করিয়া দিয়াছেন , গঙ্গাজলও যথাষ্ট ছিটাইয়াছেন আমার মাথায়, যাহা আমার নেশাকে ক্ষীণ করিতে সাহায্য করিয়া থাকিবে ।

প্রৌঢ়া একইপ্রকার অনুনয় ও ক্ষমা যাচনা করিতেছেন । স্নানার্থিনীদিগের ভিড় জমিতেছে আমাকে ঘিরিয়া । ইহার পর অসাধুবৃত্তির জন্য অবধারিত মার খাইব । প্যান্ট বুশশার্ট চশমা পরিহিত একজন ছিপছিপে বাঙালি যুবক কোন প্রক্রিয়ায় নমস্য ও শ্রদ্ধেয় হইয়া উঠিলেন , উপস্হিত সবায়ের মস্তিষ্কে অমন চিন্তা নিশ্চয়ই জাগিতেছে । প্রহার আরম্ভ হইলে আমার দুই পাশপকেট ও ওয়াচপকেটে রক্ষিত দুই মাসের মাহিনা লুন্ঠিত হইবে । নির্মলের গেস্টরুমে শতচ্ছিন্ন পোশাক ও প্রহারচিহ্ণ লইয়া ফিরিব ।

স্হূলকায়া প্রৌঢ়ার থলথলে বাহুদুটি তুলিতে আমি অক্ষম , তাঁহাকে দাঁড় করানো তো অসম্ভব । ক্রন্দন ও মর্মপীড়া তাঁহাকে আরও ভারি করিয়া তুলিয়াছে । হঠাৎ মাথা উঁচু করিয়া তিনি জানকীরাম জানকীরাম নামে কাহাকে চিৎকার করিয়া ডাকিতে লাগিলেন, এবং অজানা তরাসের চিত্তোদ্বেগে এবার আমিই মৃদু কাঁপিতে লাগিলাম ।

প্রৌঢ়া নিজেই উঠিয়া দাঁড়াইলেন এবং ডান হাত দিয়া আমার কোমর এমনভাবে ধরিলেন যেন আমি মুমূর্ষু বৃদ্ধ । অনাবিল সুগন্ধের মোড়াক খুলিয়া আমাকে তাহার ভিতর আশ্রয় দিলেন মনে হইল । কথা শুনিয়া আঁচ করিয়াছিলাম তিনি মারোয়াড়ি । তিনি যে অত্যন্ত ধনী পরিবারের সদস্যা, তাহা অনুমান করিলাম সুগন্ধ হইতে, যাহা গঙ্গাস্নান সত্ত্বেও ত্বকে মিশিয়া আছে । নিজের আনন্দবিহ্বলতায় তিনি আমার ঘর্মাক্ত পোশাক ও তামাকু-গঞ্জিকাদির দুর্গন্ধ সম্ভবত পাইতেছেন না ।

একজন শ্যামবর্ণ পালোয়ান, ধুতি-ফতুয়া পরহিত, সম্ভবত জানকীরাম, উদ্বিগ্ন মুখে ছুটিয়া আসিয়াছিল, এবং মাটি হইতে পিতলের ঘটি তুলিয়া রূপার সাজিতে রাখিতেছিল, তাহাকে প্রৌঢ়া নির্দেশ দিলেন অপরদিক হইতে আমাকে বেষ্টন করিয়া গাড়িতে লইয়া যাইতে । স্পষ্ট শুনিলাম, নেশার আলোছায়া সত্ত্বেও, প্রৌঢ়া আমার নামকরণ করিয়া ফেলিয়াছেন ভগবানজি মহারাজ ।

আমি বলিতে লাগিলাম, মাতাজি আমি রক্তমাংসের একজন নগণ্য মানুষ, ধর্মাধর্ম সম্পর্কে অজ্ঞ, আপনি ভুল করিতেছেন, এ জগতের কোনও ব্যক্তি আমার চেয়ে শতগুণে শ্রেয় । কিন্তু প্রৌঢ়ার কানে কিছুই যাইতেছে না । তৎপরিবর্তে তিনি জানকীরামকে বলিতেছেন, ভগবানজি মহারাজকে সাবধানে লইয়া যাইতে, কেননা সদ্য গঙ্গা হইতে আবির্ভূত  হইয়াছি । জানকীরামের মুখভাব দেখিয়া মনে হইল, সে প্রৌঢ়ার কথা বিশ্বাস করিতেছে ।

জানকীরাম, যদিও বাঁহাতে আমার কোমর আঁকড়াইয়া, আমাকে প্রায় দুই-তিন ইঞ্চ মাটি হইতে উপরে, ভাসাইয়া লইয়া যাইতেছিল । সঙ্গে ডানহাতে জাপটাইয়া প্রৌঢ়া । পলায়নের উপায় নাই । হয়ত সমবেত স্নানার্থী নারীগণের যৌথ প্রহারের তুলনায় ইহাই আপাতত ভালো । চটি জোড়া পড়িয়া রহিল । আমাকে ঢোকানো হইল একটি গাড়ির পিছনের সিটে, কালো রঙের শেভ্রলে বা ফোর্ড বা হিন্দুস্হান প্রতিভাত হইল । প্রৌঢ়া আমার পাশে বসিয়া, আমার কোমর দুই হাতে জাপটাইয়া, পুনরায় ক্রন্দন আরম্ভ করিলেন ।

অপ্রকৃতিস্হতার স্হিতি, নাকি ধর্মোন্মাদনার ভারসাম্যহীনতা, কিসে যে মহিলা আক্রান্ত ঠাহর করিতে না পারিয়া, সিক্ত মাথায় হাত বুলাইতে, তাঁহার ক্রন্দন প্রশমিত হইলেও, ফোঁপানির মৃদুমন্দ কম্পন বজায় রহিল । জানকীরাম গাড়িটি স্টার্ট করিলে, বুঝিলাম, সে-ই ড্রাইভার ।

মায়ের কথা মনে পড়িয়া গেল । একান্নবর্তী পরিবারে তাঁহার অধিকাংশ সময় রান্নাঘর ও তাহার যোগানের প্রয়াসে কাটিয়াছে । তাঁহার সিক্ত পাকা চুলের স্পর্শ ও সুবাস মনে নাই । একত্রে মাতা-পুত্রের বার্তালাপ ও ভালো-সময় শৈশবেও ঘটে নাই ।

কে জানে আমার কী করণীয় । জানি না কোথায় চলিয়াছি । আমার পকেটের পোস্টকার্ডটি নৈতিকতার পতাকারূপে বুকের উপর পতপত করিতেছে । এই পঁচিশ-ত্রিশ মিনিটের ভিতরই ভয়ানক হইয়া উঠিয়াছে আরেকজন মানুষের প্রশ্নাতীত-উত্তরহীন আনুগত্য ও শ্রদ্ধা ; প্রায় শ্বাসরুদ্ধকর ; আমার পায়ে বেড়ি । কাঁচের কারাগারে যেন আমি আবদ্ধ । এই তীর্থস্হানের প্রধান দেবতার মতোই মাটিতে চিরকালের জন্য প্রোথিত , পৃথিবীর শেষ পর্যন্ত একই স্হানে নির্বাক দাঁড়াইয়া থাকিতে হইবে ।

মোটরগাড়িটি কতক্ষণ চলিয়াছিল জানি না । আমার মনে হইতেছিল, এই ভুতগ্রস্ত পথের শেষ নাই । সারাজীবন চলিতে থাকিব । প্রকাশ টকিজের দরোজায় জনগণের মারকাট হইচই ; কোনও ভোজপুরি ফিলমের বিপুল দর্শনার্থী, পথে উপচাইয়া পড়িতেছে । গাড়ির গতি শ্লথ হইলে, চকিতে ভাবিলাম, নামিয়া দ্রুত পলাইয়া যাই । পুনরায় মনে হইল, জানকীরাম চিৎকারসহ  আমাকে ধরিতে ধাবমান হইলে, সিনেমা দর্শনার্থী জনগণের হাত হইতে, টিকিট পায় নাই বলিয়া যাহারা ফুঁসিতেছে, নিস্তার পাইব না ।

অদৃষ্টে আমার বিশ্বাস নাই , কিসে যে বিশ্বাস আছে তাহাই তো অন্তর্কলহের বিচার্য প্রশ্ন । একজন ঘোর অবিশ্বাসীকে আঁকড়াইয়া আছেন আরেকজন পরিপূর্ণ বিশ্বাসী । এই অভিজ্ঞতাও সংগ্রহযোগ্য । অজ্ঞান হইতে জ্ঞানের দিকে অজানা যাত্রা । আপাতত ইহাতে মজিয়া থাকি । ধুতি পরিহিত এবং কাঁধে একখানি উত্তরীয় থাকিলে অসততার ষোলোকলা পূর্ণ হইত ; শ্রীশ্রী একশতআট রাক্ষসজিউ অথবা খোক্কোসজি মহারাজ অথবা বাবাশয়তানশ্রী রূপে শিষ্যশিষ্যা পরিবৃত হইয়া শোষণ ও শাসন করিতাম । কিন্তি ওই গুরুজিউগুলিও তো স্বাধীনতাহীন— কীভাবে জীবন অতিবাহিত করে তাহারা ? ইচ্ছানুযায়ী চলার বলার স্বাধীনতা নাই ! আজীবন একটি নকল জোব্বায় নিজেকে পুরিয়া সকলের প্রণাম গ্রহন করিতে থাকো !

শেষাবধি গাড়িটি ঢুকিল একটি পুরাতন দোতলা প্রশস্ত অট্টালিকায়, হর্নের সতর্কবার্তায় দারোয়ান গেট খুলিয়া দিবার পর । জানকীরাম ও প্রৌঢ়া আমাকে এমনভাবে নামাইলেন যান আমি পালকে নির্মিত । পোর্টিকোর ভিতর পঁহুচাইবামাত্র ঘোমটাঢাকা দুইজন বধু, তাহারাও স্হূলকায়া, ঘটির জল ঢালিয়া আমার পা ধুইল এবং শাড়ির আঁচল দ্বারা পুঁছিয়া দিল । খালি পায়ে কিয়দ্দূর হাঁটিবার দরুণ পা নোংরা হইয়া গিয়াছিল, তবুও তাহাদের চোখেমুখে নোংরা পদদ্বয় সম্পর্কে অভক্তি দেখিলাম না । এবার তাহারাই আমাকে দুইদিক হইতে জাপটাইয়া প্রথম ঘরটিতে, যাহার মেঝেয়, সুদৃশ্য পুরু কার্পেট বিছানো, লইয়া গিয়া একটি পূজাসনে বসাইল । আসনের সন্মুখে কারুকাজ-করা জলচৌকি । বধুগণের তপ্ত, যদিও সুগন্ধী, দেহের চাপ হইতে মুক্ত হইয়া বরং ভালো লাগিল– এত নিকট হইতে দুই অচেনা নারী জাপটাইয়া ধরিয়াছিল, তবুও আমার সামান্যও যৌনতার উদ্রেক হইল না বলিয়া আশ্চর্য লাগিল । সত্যই কি দেবত্বে উন্নীত হইয়া গিয়াছি !

নির্ণয় লইলাম কোনও কথা বলিব না । কেহ কোনও প্রস্ন করিলে, সংক্ষিপ্ত উত্তর দিবার প্রয়াস করিব বা ঘাড় নাড়াইয়া ইশারা করিব । দুই চক্ষু মুদ্রিত করিয়া মস্তিষ্ককে ফাঁকা ও যাবতীয় চিন্তা হইতে মুক্ত করিবার চেষ্টা করিলাম । আকস্মাৎ মনশ্চক্ষে কন্ঠ ্‌ইতে হাঁটু পর্যন্ত পীতাভ, গোলাপী নারীদেহ ঝিলিক দিয়া উঠিল , বর্তুলাকার নিটোল দুই স্তনসহ, যাহা পার্থিব অভিকর্ষ এবং মানুষের হাত ও মুখের আদর সহ্য করিয়াও উদ্ধত । চোখ মেলিতে বাধ্য হইলাম ।

জলচৌকির উপর, সম্ভবত রূপার, বগিথালা । তাহাতে ধান্য দুর্বা হরিতকি হলুদ লালসুতা ইত্যাদি রাখা । কবেকটি বালক-বালিকা আসিয়া আমার শঅর্ট ও গেঞ্জি খুলিয়া লইল , বধু দুইজন মহার্ঘ মৃগতনাভিতে সিক্ত তোয়ালে দ্বারা হাতমুখ ও বুকপিঠ পুঁছিয়া দিল । প্রতিরোধ করিলাম না । নিজেকে মনে হইল অসহায় ও বোকা ক্রীড়নক বা পাথরের মূর্তি ।

এই গৃহের কর্ত্রী হয়ত কোনও বিকারে আক্রান্ত ; কিন্তু বালক-বালিকা হইতে চাকর-দারোয়ান সকলে সেই বিকারকে প্রশ্রয় দিতেছে কেন ? হয়ত ডাক্তার নিদান দিয়া থাকিবে । ঘরটিতে চক্ষু বুলাইলে পরিবারটির অপার বৈভবকে মনে হইল দৃষ্টিকটু । তাহা হইলে কিসের অভাব পূরণ করিতে না পারিয়া প্রৌঢ়া বিকারে আক্রান্ত ? হয়ত অভাবহীনতাই পরিবারটিকে আকুলতা আবিষ্কার করিতে শিখাইয়াছে, এবং দুর্ঘটনাক্রমে আমি সেই তোলপাড়ের কেন্দ্রে আসিয়া পড়িয়াসছি । অন্যান্য দিন কেহ না কেহ এই সংক্ষোভের শিকার হয় , প্রকৃত সাধুবৈরাগী ও গৃহত্যাগীর তো অভাব নাই এই তীর্থক্ষেত্রে, যাহারা জীবনের উদ্দেশ্যহীনতার উদ্দেশ্য খুজিয়া ফিরিতেছে, পথে নামিয়া জীবন নামক রহস্যটির চোরাসুড়ঙ্গে ঘুরিয়া ফিরিতেছে ।

আমার দাদু জীবিত থাকিলে যে বয়সের হইতেন, সেই বয়সের এক বৃদ্ধ ডানদিকের ঘর হইতে আসিয়া আমার সন্মুখের জলচৌকির পার্শ্বে উপবেশন করিয়া আমার দুই পা স্পর্শ করিয়া ডান হাতটি আমার দিকে আগাইয়া দিলেন । একজন বয়োবৃদ্ধ আমার পায়ে হাত দিয়া মাথায় ঠেকাইতেছে, এই অভিজ্ঞতা আমার নিকট বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হইবার ন্যায় । অগত্যা মুখ খুলিতে হইল, যদিও মনস্হ করিয়াছিলাম কোনও কথা কহিব না । এক পলক সবার দিকে তাকাইয়া গম্ভীরকন্ঠে বলিলাম, কেহ আমার পায়ে হাত দিবেন না ।

বৃদ্ধ মুষ্টিবদ্ধ ডান হাত আগাইয়া বসিয়াছিলেন । ইহার যেটুকু অর্থ আমার বোধগম্য হইল, তাহাই করিলাম । ধান্য যব দুর্বা তুলিয়া বৃদ্ধের পক্ককেশ মাথায় রাখিলাম, এবং একটি হলুদে লালসুতা জড়াইয়া ডান হাতে বাঁথিয়া দিলাম । বৃদ্ধ এবার পায়ে হাত না দিয়া মাটিতে গড় করিলেন এবং ধুতির ট্যাঁক হইতে কয়েকটি একশো টাকার নোট থালার উপর রাখিলেন । দেখিয়া, আমার মস্তিষ্কে পুনরায় অজানা আতঙ্কের দপদপানি শুরু হইল ।

এতক্ষণে গৃহের, হয়ত সকল সদস্যই, পুরুষ যুবতী কিশোর কিশোরী মিলাইয়া প্রায় দশবারোজন, আসিয়া জড়ো হইয়াছিল, যাহারা একে-একে গড় করিল, এবং আমি মাথায় ধানদুর্বা রাখিয়া হাতে হলুদ-লাল সুতা বাঁধিলাম । সকলেই প্রণামান্তে টাকা রাখিতেছিল । কেবল বধু দুইটি রাজার মুখ আঁকা এক-এক মুষ্টি রৌপ্যমুদ্রা রাখিল । উহাদের দেহ সেসময়ে তপ্ত ছিল অধচ এক্ষণে বধুদুইটির নরম হাত বেশ ঠান্ডা লাগিল । জানি না কেন, তাহাদের হাতে হলুদ-সুতা বাঁধিবার সময়ে যৎসামান্য কম্পন ঘটিয়া গেল দেহের কানাচে । তাহাদের ক্ষেত্রে দ্রুত বাঁধিয়া দিলাম, কম্পনটিকে সীমিত রাখিবার প্রয়াসে । থালার দিকে যাহাতে তাকাইতে না হয় তাই চক্ষু মুদ্রিত করিয়া রহিলাম ।

চক্ষু কিয়ৎক্ষণ মুদ্রিত রাখিবার পর পুনরায় স্পষ্ট হইয়া উঠিল ম্যাডেলিনের দেহখানি । বিভিন্ন নারী, অফিসের সহকর্মির্ণী, কলেজের সহপাঠিনী, বাংলা ও হিন্দি ফিলমের নায়িকাগণের নগ্নদেহ কল্পনায় আনার আপ্রাণ চেষ্টা করিয়াও সফল হইলাম না । পরিবর্তে ম্যাডেলিনের দেহ আরও দ্যুতিময় হইয়া উঠিল । হঠাৎ মনে হইল, উপস্হিত এই সকল মানুষের নিকট আমিই মনে-মনে নতজানু হইয়া প্রার্থনা করি । চক্ষু মুদিয়া হাতজোড় করিলাম, মৃদুস্বরে ম্যাডেলিন ম্যাডেলিন ম্যাডেলিন ম্যাডেলিন ম্যাডেলিন জপিতে থাকিলাম ।

আমার তো কোনো আদর্শ নাই, ঈশ্বর নাই ; আমি সার্বভৌম অবিশ্বাসী । হাত জোড় করিয়া মুদ্রিত চক্ষে, বৃদ্ধটি হইতে বালক-বালিকা, সকলের নিকট আমি জোড়াহাত ঘুরাইয়া প্রার্থনা করিতে লাগিলাম, এবার নিঃশব্দে, যাহাতে কেহ টের না পায় যে আমি তাহাদের আশীর্বাদ করিবার পরিবর্তে তাহাদের নিকট ভিক্ষা চাহিতেছি । আমাকে আরেকবার, অন্তত আরেকবার, ওই দ্যুতিময় দেহধারিণীর সংস্পর্শে লইয়া চলো ; আরেকবার তাহার দেহখানি আমার সন্মুখে, নাগালের ভিতর, স্পর্শানুভূতির আয়ত্বে, আনিয়া দাও । অনুভব করিলাম, আমার যৌনাঙ্গ সাড়া দিতেছে । হয়ত ইহাদের মর্মে-মর্মে আমার প্রার্থনা প্রবেশ করিয়াছে এবং ইহারা আমাকে নিঃশব্দে আশীর্বাদ করিতেছেন । যৌনাঙ্গ শিথিল না হওয়া পর্যন্ত চক্ষু মুদ্রিত করিয়া রহিলাম ।

চক্ষু মেলিয়া দেখিলাম যে তাঁহারাও আমার দিকে হাতজোড় করিয়া দাঁড়াইয়া আছেন । এই দেখিলাম যে জলচৌকির উপর, রূপার থালার পরিবর্তে, পিতলের ঝকঝকে বগিথালা, তাহাতে কয়েকটি ফুলকো লুচি, জাফরানি ভাত, ছোট-ছোট পাঁচটি পাত্রে তরকারি, একটি পাত্রে দইয়ের কঢ়ি, একটি পাত্রে পায়সান্ন এবং কাঁসার বড় গ্লাসে ঘোল । একজন যুবক একটি গামলা মেঝেয় রাখিয়া ঘটি লইয়া দাঁড়াইয়া ছিল । আমার অনুমতির পূর্বেই সে আমার হাত দুটি নিজহস্তে লইয়া এক এক করিয়া ধুইয়া দিল । একজন বধু তোয়ালে দিয়া হাত মুছিয়া দিলে, আমি বলিলাম, আমি এত বেশি আহার করিতে অভ্যস্ত নহি ।

বৃদ্ধটি কহিল, ভগবানজি মহারাজ, আপনি যতটা পারেন ভক্ষণ করুন, অবশিষ্টাংশ আমরা প্রসাদরূপে গ্রহণ করিব । শুনিয়া, কন্ঠে বাকহীনতার শ্লেষ্মা আটকাইয়া গেল । এক ঢোঁক জল খাইলাম । জলটি শীতল ও সুগন্ধিত । কুকুর-বিড়াল ব্যতীত আর কেহ কখনও আমার উচ্ছিষ্ট খাইয়াছে বলিয়া মনে পড়ে না । কাজের লোক জঞ্জালের সহিত আঁস্তাকুড়ে ফেলিয়া দিয়া আসে । হয়ত কুকুর-বিড়ালের সহিত স্বাধীন দেশের ভিখারি নাগরিকগণ আমার অজানিতে ভক্ষণ করিয়া থাকিলেও থাকিতে পারে । বঙ্গদেশে অমন নাগরিকের সংখ্যা তো বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হইয়াই চলিয়াছে , পঞ্চবার্ষিক যোজনার ঢালাও ব্যবস্হা সত্ত্বেও ।

কেন আমার সহিত এই গৃহে অঘটণগুলি ঘটিয়া চলিয়াছে, তাহা লইয়া চিন্তা করিব না মনস্হ করিয়াছি । খাওয়া আরম্ভ করিলাম । সন্দেহ নাই যে খাঁটি ঘিয়ে প্রস্তুত ; বেশ সুস্বাদু । সবায়ের সন্মুখে বসিয়া, যেহেতু রেস্তরাঁ নহে, খাওয়া কেমন যেন বিসদৃশ । আবার কখন খাওয়া হইবে নিশ্চিত নহি । পেট ভরিয়া খাইলাম । তিনচতুর্থাংশ অবশিষ্ট রহিল । পুনরায় একইভাবে মুখ ধোয়ানো হইল । শৈশবের পর এই প্রথম কেহ আমার হাত খাইবার আগে ও পরে ধুইয়া দিল । একটি বধু আসিয়া মুখও পুঁছিয়া দিল । অচেনা মনুষের যত্নআত্তি শরীরের কোন-কোন রসায়নে ক্রিয়া ঘটায় তাহা জানি না, তবে বহু প্রকার প্রতিক্রিয়া যে ঘটায় তা আজিকে জানিতে পারিলাম ।

এবার হয়ত কোনো ঘরে লইয়া গিয়া শয়ন করিতে বলিবে । অনুমান ঠিকই ।প্রৌঢ়া প্রস্তাব করিলেন, আমি পার্শ্ববর্তী শয়নক্ষে গিয়া বিশ্রাম লই । রাত্রে ট্রেনে তৃতীয় শ্রেণীর ঠেসাঠসিতে ভালো করিয়া ঘুম হয় নাই । তদুপরি সকাল হইতে আপাদমস্তক জারিত হইতেছি বহুবিধ ইন্দ্রিয়-রসায়নে । স্বাদুভোজ্যের লোভে আহারের পরিমাণ বেশি হইয়া গিয়াছে । কেন যে সর্ববিষয়ে আমি এমন লোভী তাহার ব্যাখ্যা নিজের নিকটও স্পষ্ট নহে । আত্মনিয়ন্ত্রণ করিতে পারি না । পদস্খলনের সম্ভাবনা রহিয়াছে জানিয়াও পা বাড়াইয়া দিই । স্খলনের আনন্দ উপভোগ করি ।

নির্মলের ভৃত্যটি দ্বিপ্রহরে থাকে কিনা জানা নাই । হয়ত নির্মল চিত্রকরসুলভ প্রয়াসে যত্রতত্র বিষয়ের সন্ধানে মাদাকাচ্ছন্ন হইয়া ঘুরিয়া বেড়াইতেছে ; তাহার গৃহে বৃদ্ধা মাতা ব্যতীত অন্যান্য আত্মীয় পরিজন কে কে আছেন জানি না ; আমার গেস্টরুমে উপস্হিতি সম্পর্কে তাঁহারা অবগত না-ও হইতে পারেন । এখানেই বরং আরাম করি ।

খালি গায়ে এতক্ষণ বিব্রত বোধ করি নাই । উঠিয়া দাঁড়াইয়া কিঞ্চিদধিক লজলায় আক্রান্ত হইলাম । বধু দুইটি দ্রুত নিকটে আসিয়া দুই পাশ হইতে পুনরায় সাহায্যার্থে আঁকড়াইয়া ধরিল । নিজের দেহভার তাহাদের নিয়ন্ত্রণে সমর্পণ করিলাম । মেদবহুল উন্মুক্ত কটিদেশ ও অন্তর্বাসহীন ব্লাউজে ঢাকা অতিকায় স্তনের স্পর্শ, যদিও এক্ষণে শীতল, স্পষ্ট অনুভব করিতেছি । অথচ দেহ উতরোল হইল না ।

বাম দিকের কক্ষটিতে আমাকে লইয়া যাওয়া হইল । বিশাল শয়নকক্ষের সর্বত্র অ্যঅন্টিক আসবাব, পালঙ্কটিও । প্রতিটি বস্তু প্রতিদিন ঝাড়পোঁছ হয় , পিত্তল ও রৌপ্যবস্তু পালিশ হয় । গ্রামোফোনের পিতলের চোঙা, আলমারির ধাতব হাতল, সবই পালিশে ঝকঝক করিতেছে । বিছানাটি মেরুন মখমলের চাদরে ঢাকা ছিল, যাহা একজন যুবক, সম্ভবত ভৃত্য, তুলিয়া ফেলিতে, অনুমান করিলাম, মাথার ও কোলবালিশ দেখিয়া, গৃহের সদস্যগণ ইহা ব্যবহার করেন না । হয়ত অতিথি আসিলে, বা আমার মতো আকস্মিকতায় নির্বাচিত আগন্তুক, নয়মাসে ছয়মাসে শয়ন করে ।

যেনবা আমি নব্বইকোঠার বৃদ্ধ, তেমন করিয়া আমায় উঁচু পালঙ্কে শয়ন করাইয়া, ফ্যান চালাইয়া দেয়া হইল । অতিনরম বিছানায়, শিমুলতুলোর বালিশে মাথা রাখিয়া, ভাবিতেছিলাম, এতক্ষণে একা হইবার ও গা ছাড়িয়া দিবার সুযোগ হইল, কিন্তু বধু দুইটি দুই দিকে গিয়া পা টিপিবার উপক্রম করিল । অপ্রীতিকর ঠেকিতেছিল বলিয়া বারণ করিতে উদ্যত হইয়াও নিষেধ করিলাম না । এত সেবা যখন গ্রহণ করিতেছি তখন পা-ও টিপাইয়া লই । আর কখনও তো এই কুকার্যের আংশভাক হইবার সুযোগ জীবনে আসিবা না ; এই লোভটিই বা ঠেকাই কেন ! বধু দুইটি আমারই বয়সী হইবে । ঘি-মাখন খাইয়া দেহের আদরাকে বেঢপ করিয়া ফেলিয়াছে । টিপিতে-টিপিতে হাঁটুর উপরেও তাহাদের হস্তচাপ পৌঁছাইলেও , তাহাদের স্পর্শ তো কোনও যৌনতা উদ্রেক করিতেছে না চক্ষু মুদ্রিত করিলাম ।

ঘুম ভাঙিতে, সন্মুখের দেয়ালঘড়িতে, রোমান সংখ্যাচিহ্ণে বৈকালের সাড়ে চার ঘটিকার নির্দেশ দেখিয়া বুঝিলাম, টানা আড়াই ঘন্টা ঘুমাইয়াছি , এবং এই পুরাসময় জুড়িয়া, ছাদপাখা ঘুরিতে থাকিলেও, আমার শিয়রের নিকট টুলে বসিয়া , প্রৌঢ়াটি, রেশমি ঝালরদেয়া তালপাখার বাতাস দিয়াছেন । বধু দুইটি আমাকে ঘুম পাড়াইয়া, চশমা খুলিয়া পাশ্ববর্তী টেবিলে রাখিয়া, হয়তো বহুক্ষণ চলিয়া গিয়াছে ।

১১

হিন্দু বাঙালির জীবনে আরাধ্যরূপে কোনো কিছু আর টিকে নেই । কেবল বাঙালিই বা বলি কেন ! বেনারসে তো ভারতের সবাই আসছেন । ব্রহ্মা, বিষ্ণু, শিব, কালী, দুর্গা, সরস্বতী, জগদ্ধাত্রী, বিশ্বকর্মা প্রতিটি প্রতিমার পুজোর চেয়ে তাদের প্যান্ডেল এখন অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ । সেসব প্যান্ডেল তৈরি, সাজানো, আলোকিত করার বিপুল খরচ তোলার জন্য ছলে-বলে-কৌশলে নাগরিকদের কাছ থেকে মোটা টাকা উশুল করা হয় । প্রাক-ঔপনিবেশিক কালখন্ডে, সামাজিক ও সাম্প্রদায়িক সীমা অতিক্রম করাটা ছিল নৈতিক অধঃপতনের লক্ষণ, ঠাকুরদেবতা নামক প্রকৃতিজগতের গড়ে-দেয়া ব্যবস্হার সঙ্গে ছেলে-খেলা । নৈতিকতার উৎস ছিল আত্মিক ও ঐশ্বরিক পূর্ণতাপ্রাপ্তির যৌথ ও একক প্রয়াস । ব্যক্তিস্তরে নিখুঁত হয়ে ওঠার সর্বজনীন নকশা ছিল না । আত্মগণ্ডী মুছে গেলে তবেই তো সর্বজনীনতার ও সমরূপতার সম্ভাবনা । বলা বাহুল্য যে উপরোক্ত সমগ্র প্রক্রিয়াটি আরম্ভ হয়ে গিয়েছিল বেশ আগেই । তাতে জড়বাদ, ভোগবাদ বা উপযোগিতাবাদ নয়, এক ভিন্ন দার্শনিকতা কাজ করছিল ।

দার্শনিকতার ভিত্তি অনেকটা এরকম :-

মানুষকে তার জন্মের পর থেকে সামাজিকভাবে গড়েপিটে তৈরি না করলে সে অপূর্ণ থেকে যায় । পূর্ণতা তাকে আহরণ করতে হয় । এই পূর্ণতা, সনাতন ভারতীয় দর্শনের পূর্ণতা নয় । উপনিবেশবাদী ইউরোপিয় ভাবনা অনুযায়ী, আপূর্ণতা ব্যাপারটি প্রাকৃতিক ও জীববিজ্ঞান সংক্রান্ত । মনুষ্যোচিত হয়ে ওঠা আদপে প্রকৃতি থেকে মুক্ত হয়ে বিশেষ শিক্ষাপ্রাপ্তির ফল , জ্ঞান যোগাড়ের ফল, প্রাকৃতিক প্রবৃত্তি দমনের ফল । একদিকে যেমন শিক্ষা গ্রহণের কথা ভাবা হয়েছে, আরেকদিকে তেমন শিক্ষা দানের প্রয়োজন অনুভূত । স্কুল শিক্ষকদের বলা হয়  মানুষ গড়ার কারিগর । গুরু-শিষ্যের সনাতন ভারতীয় ভাবনা আজ অবলুপ্ত । আমি তো সেসময়ে বেঁচে থাকব না , কিন্তু আমি নিশ্চিত, যে, স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর পর এই সমস্ত মানুষ গড়ার কারিগরদের অধিকাংশই নেতিমানুষরূপে ক্ষতিকারক হয়ে উঠবে । মানুষ গড়া একটি ঘোলাটে ভাবকল্প । প্রকৃত উদ্দেশ্য ছিল, কৌমবিশেষকে এবং ব্যক্তিকে ভূ-প্রকৃতি থেকে সংস্কৃতিতে স্হানান্তরণ । এই সাংস্কৃতিক প্রাণী অচিরে প্রকৃতিকে শোষণ, লুন্ঠন ও ধ্বংস করে ঘোর বিপদ ডেকে আনবে ।

১২

এক ফুঁক টেনেই বোকা গবেট শিশুর এই হাল, গলা থেকে মাথা ম্যাজিকে উড়ে গেল আর ফিরে এল । শৈয়ানা নাকি আগের জন্মের পুণ্যি ? ক্যাবলা কামুকটা আগরওয়াল বুড়ির নেকনজরে পড়ে গিয়েছিল । বেনারসে সবাই চেনে আগরওয়াল বুড়িকে । তবে ভাগ্য ভাল যে বোকাটা কামুক ; ধর্ম-ফর্মের পাশ কাটিয়ে ঘুরত ।

আমি বেনারসে আসার বছর দুয়েক পরের ঘটনা , কাগজে ফলাও করে বেরিয়েছিল । ঠিক যেন হিন্দি ফিলিম । সেই তখন থেকে, দুপুরে কাজকর্ম না থাকায়, ম্যাটিনি শো  দেখা আরম্ভ করেছিলুম, যাকে বলে সিনেমার পোকা, ওইরকম এঁটুলি হয়ে গিয়েছিলুম ফিলিম দেখার । কোনো ফিলিম বাদ দিইনি , রোদ ঝড় যাই হোক । এখন কেবল টিভি হয়ে কত আয়েশ ।

আগরওয়াল বুড়ির ছেলেটার নাম মনে আছে, অশোক । প্রেমে পড়ল ওদের জাতের বাইরে একটা গরিব মেয়ের, তার নাম নিশা । কাগজে লিখেছিল, মেয়েটা বিধবা । মন্দিরে যারা ওই সময়ে আসত তাদের কেউ-কেউ বলেছিল যে নিশা ছিল আগরওয়াল বাড়ির চাকরানি । অশোক গৌঁ ধরে বসল নিশাকেই বিয়ে করবে । শুনেই ওই বুড়ি, অশোকের মা, মাঝরাতেই এক কাপড়ে তাড়িয়ে দিলে নিশাকে, আর উঠে পড়ে লাগল অশোকের বিয়ে দেবার জন্যে । কোটিপতির ছেলে, মেয়ের কি আর অভাব ছিল ! মেয়ের বাপেদের গাড়ির লাইন লেগে যেত নাকি আগরওয়ালদের বাড়িতে । কিন্তু বেনারসি শিবলিঙ্গের ডায়রেক্টার ফিলিমের শেষটা অন্যরকম ভেবে রেখেছিল, যে ফিলিমে শেষে গিয়ে মিল হয় না তবুও ফিলিম হিট হয়ে যায়, এমন ।

অশোক আর নিশা দু’জনে গঙ্গার ধারে বসে বিষ খেল । হিন্দি দেণিক আজ-এ ওদের দুজনের জড়াজড়ি করে গঙ্গার ধারে পড়ে থাকা শবের ছবি বেরিয়েছিল ।

প্রেমে এরকম পাগল হবার কী আছে জানি না , যে আত্মহত্যা করতে হবে । আঞ্জাআঞ্জি করলি, হয়ে গেল, ব্যাস । দুজনে কিছুদিন সবুর করতে পারতিস তো । তারপর দেখতিস একজনকে আরেকজনের আর দরকার নেই । দিব্যি বেঁচে থাকতিস , আর জীবনের মজা নিতিস । জীবনের নানা মজার মধ্যে প্রেমও একটা মজা । সবরকম মঝা পাবার তো আর দরকার নেই ।

আগরওয়াল বুড়ি সেই থেকে পথেঘাটে কাউকে দেখে অশোকের মতন মনে হলে বাড়ি নিয়ে যায়, খাতির যত্ন করে, ক্ষমা-টমা চায় । বেচারি । বংশের নাম বাঁচাতে গিয়ে ডুবল । লোভী রাসকেলটার লেখা পড়ে বুঝতে পারছি কত আদর-ভক্তি পেয়েছে । অথচ সেখানেও শিশির ধ্যান করছে ল্যাংটো মেমের । হিপি মেমগুলো যবে থেকে আসা আরম্ভ করেছিল, এখানকার ভারতীয় মেয়েরা চোখেই পড়ছিল না ইডিয়েটগুলোর । লোকে বলে নারীমাংসের লোভী হয় পুরুষেরা । আমি বলব সেই মাংসের ওপর যে ত্বক, তার রঙেরও লোভ থাকে পুরুষগুলোর ।

অশোক মরে জামাই দুটোর পোয়া বারো । মেয়ে-জামাইরা বোধহয় বাধ্য হয়ে মা-বাপের পাগলামিতে অভিনয় করে, কেন না অশোক আর নিশাকে মেয়ে-জামাইরা ষড় করে মেরে ফেলে থাকতে পারে, এরকম সন্দেহ পুলিশের মাথায় এসেছিল । মেয়ে-জামাইরা হাজতেও ছিল দিনকতক ; পয়সা-ফয়সা খাইয়ে কেস চাপা দিয়ে দিয়েছে ।  সেই সুযোগে শিশিরটা বউ দুটোকে দিয়ে পা টিপিয়ে নিলে ; নিত্যি একখানা তরতাজা যুবক পেলে কেনই বা টিপবে না , তাও একেবারে কুঁচকি পর্যন্ত !  শিশিরটা দেখতে-শুনতেও তো মন্দ নয় ।

আগরওয়ালদের কাছ থেকে অন্তত একটা ভাল ব্যাপার শিখেছিল শিশির । অন্যের গায়ে পারফিউম মাখিয়ে তাকে সন্মোহন করার  মোক্ষম কায়দা । তখনকার দিনে বডি ডিওডোরেন্ট বেরোয়নি, রুম ফ্রেশেনার বেরোয়নি, রঙিন কনডোম বেরোয়নি, ফেলো কড়ি মাখো তেল ট্যাবলেট বেরোয়নি । এখন তো যেমন পরিবেশ চাই, তমনই সুগন্ধী একজন আরেকজনকে লাগাও । সেসময়ে মাউথওয়াশ বা মাউথস্প্রে ছিল না । কর্পূরজলে কুলকুচি করে ফোঁকার গন্ধ যেত না মুখ থেকে । এখন তো কাছাকাছি হবার জন্যে নানা সুগন্ধের মাউথসপ্রে ।

৪. চক্ষু মেলিয়া

১৩

ধড়মড় করিয়া উঠিয়া বসিলাম । এবার পলাইতে হইবে । রাত্রিবাস করিতে হইলে সত্যই বন্দী হইব ।  আমি বলিলাম, মাতাজি এবার আমাকে যাইতে হইবে । বলিয়াই, নির্ণয় লইলাম, নির্মলের গৃহ বাঙালিটোলা বলিব না । আমাকে যদি পরে আবার সেথায় খোঁজ করিতে যায়, হয়ত পুনরায় ধরিয়া আনিবে ।

প্রৌঢ়া জিজ্ঞাসা করিল, কোথায় যাইবেন ভগবানজি মহারাজ ? আমি বলিলাম, সংকটমোচন যাইব । তথায় পূন্যার্থীদের ভিড়ে মিশিয়া, কিয়ৎসময় অতিবাহিত করিয়া , নির্মল রক্ষিতের আস্তানার উদ্দেশ্যে রিকশায় যাত্রা করিব ।

মহিলা হাঁক পাড়িয়া  ভূষণ নামক কোনো ব্যক্তিকে ডাকিলে, জনৈক ভৃত্য রৌপ্যের ট্রেতে করিয়া এক গ্লাস জল আনিল । তৃষ্ণা ছিলই । পান করিয়া কেওড়ার সুগন্ধ পাইলাম ।

ভূষণকে প্রৌঢ়া নির্দেশ করিল আমার জামা-গেঞ্জি ইত্যাদি গাড়িতে রাখিয়া দিতে, এবং জানকীরামকে বলিতে ভগবানজিসংকটমোচন মন্দিরে যাইবেন ; তজ্জন্য গ্যারাজ হইতে গাড়ি বাহির করিতে ।

ভূষণ জানাইল, জানকীরাম তাহা করিয়া রাখিয়াছে, ভগবানজি মহারাজের জামা ইত্যাদি গাড়িতে রক্ষিত হইয়াছে এবং বড় ও ছোট মালকিন অঙ্গবস্ত্র লইয়া অপেক্ষা করিতেছেন ।

অঙ্গবস্ত্র শব্দটিশুনিয়া অস্বস্তি বোধ করিলাম । প্যান্টও খুলিয়া লইবে নাকি ইহারা ! অঙ্গবস্ত্রটি যে সিল্কের মহার্ঘ উত্তরীয় তাহা পরে বুঝিলাম, যখন প্রৌঢ়া ও ভূষণ আমাকে  আলোগোছে ধরিয়া সদর পর্যন্ত লইয়া গেল, এবং বধুদ্বয় আমার দেহে অঙ্গবস্ত্রটি জড়াইয়া গাড়ির পিছনের সিটে বসাইয়া দিল ।

গাড়ির দরজা বন্ধ হইতে, এবং জানকীরাম গাড়ি স্টার্ট করিলে, আশ্বস্ত হইলাম , যাক কেহ সঙ্গে যাইতেছে না । কিন্তু গাড়িটি স্টাটফ দিতেই বৃদ্ধ ব্যক্তিটি ও প্রৌঢ়া উচ্চকন্ঠে ক্রন্দন আরম্ভ করিল । তাহাদের দেখাদেখি অন্যান্য সদস্যগণও কাঁদিতে লাগিল ।

আমি স্তম্ভিত । উন্মাদনার কোন শিকড় আমার উপস্হিতি হইতে জীবনরস সংগ্রহ করিতেছে ? যত দ্রুত এই ভুতগ্রস্ত অট্টালিকা হইতে পলায়ন করা যায় ততই মঙ্গল । মনে হইতেছে, পাশে রাখা পুঁটুলির আকার চৌকো ; হয়ত জামাটি ইস্ত্রি করা হইয়াছে । জানকীরাম নামাইয়া দিয়া চলিয়া গেলে পথের এক কোনে দাঁড়াইয়া পরিয়া লইব ।

সংকটমোচন মন্দিরের নিকট নামিলাম । জামার পুঁটুলিটি আমাকে দিয়া জানকীরাম আমার হাঁতুতে মাথা ঠেকাইল এবং কাঁদিতে-কাঁদিতে গাড়ি চালাইয়া চলিয়া গেল । গাড়িচালকটিও কোন বশীকরণ মন্ত্রে এই পরিবারের মস্তিষ্কবিকৃতির অংশভাক হইয়াছে তাহার রহস্যসূত্র আঁচ করিতে পারিলাম না । জানকীরাম বেশ কিছুদূর চলিয়া গেলে , মন্দিরে প্রবেশ করিয়া দেখিলাম, উঠানটিতে তবলা হারমোনিয়াম বাজাইয়া তারস্বরে কীর্তন চলিতেছে ।

যাহারা কীর্তনের সহিত গলা মিলাইতেছে, বা হাততালি দিতেছে, তাহাদের মাঝে জনাকয় হিপিনি-অর্ধহিপিনি জনরে পড়িল । প্রত্যেককে বিশেষ দৃষ্টিতে নিরীক্ষণ করিলাম । না, ইহারা কেহই ম্যাডেলিন করিয়েটের নয়ায় পৃথুলা বা আকর্ষণীয়া মাংসল নহে , ত্বকে সে চনমনে তেজোময়তা নাই, রোদেলা ঔজ্জ্বল্য নাই ; রৌদ্রে পুড়িয়া এই শ্বেতাঙ্গিনীগণ পীতাভ-গোলাপি রঙ হারাইয়া ফেলিয়াছে ।

পুঁটুলি হইতে জামা-গেঞ্জি লইয়া পরিব, এবং অঙ্গবস্ত্রটি উহার ভিতর বাঁধিয়া রাখিব মনস্হ করিয়া গিঁট খুলিতেই, দেখিলাম, আমার আকাশি বুশ শার্ট-গেঞ্জি নাই । তাহার পরিবর্তে হালকা বেগুনি রঙের নূতন বুশশার্ট ও নূতন গেঞ্জি । জামার ভাঁজ খুলিতে, আমার চশমাসহ আমাকে উৎসর্গীকৃত অথবা প্রণামী রৌপ্যমুদ্রাগুলি ও একশোটাকার বেশ কয়েকটি নোট মাটিতে পড়িলেও , কীর্তনের জগঝম্পে কাহারও দৃষ্টি আকর্ষণ করিল না ।

অতুলের পোস্টকার্ডটি নূত বুশশার্টের পকেটে রক্ষিত দেখিয়া দুশ্চিন্তা দূর হইল । পরিবারে কেহ যে বাংলা পড়িতে পারে না সে ব্যাপারে আমি নিশ্চিত । রৌপ্যমুদ্রাগুলি চাদরের সহিত পুঁটুলিতে বাঁধিয়া , টাকাগুলি বুকপকেটে রাখিলাম, এবং রিকশায় চাপিয়া নিকটবর্তী জুতার দোকানের উদ্দেশ্যে চলিলাম । চশমাও পরিয়া নিয়াছি ।

বাটার দোকানে নামিয়া একজোড়া চটি কিনিয়া মনে হইল জামার সহিত ধুলামাখা নোংরা প্যান্ট খাপ খাইতেছে না । রাস্তার অপরদিকে রেডিমেড জামাকাপড়ের দোকান নজরে পড়িল । তথা হইতে কালো রঙের কর্ডুরয়ের নূতন একটি প্যান্ট কিনিয়া পরিলাম । দোকানটিতে আমার মাপের এই একটিই ফুলপ্যান্ট ছিল । পুরাতন প্যান্টের ওয়াচপকেট ও পাশপকেট হইতে টাকাগুলি নূতন প্যান্টে স্হানান্তরিত করিলাম ।

প্রণামীর দুটি একশত টাকার ও কয়েকটি দশ টাকার নোট তবু অবশিষ্ট রহিল । রিকশঅলাকে বলিলাম, মদ্যের বোতল কিনিব, নিকটে দোকান থাকিলে লইয়া চল । রিকশঅলা জানিতে চাহিল যে বিলাতি মদ্য নাকি দেশি মদ্য।  বলিলাম বিলাতি, দেশিও চলিত কিন্তু হাতে যখন টাকা রহিয়াছে তখন ভালো মদ্যই পান করি । রাত্রে আর কোথায় যাইব, ওয়াইন গিলিয়া শুইয়া পড়িব । রিকশঅলা জিজ্ঞাসিল, মদ্যের দোকানের নিকটে তন্দুরি মুর্গি ও রুমালি রুটির ঢাবা আছে, তথায়ও যাইব কি ? আমি উহার প্রেরণাদায়ী অনুরোধ মঞ্জুর করিলাম । পানীয় ও খাদ্যবস্তুগুলি লইয়া নির্মলের গৃহে পোঁছাইলে, দক্ষিণার দশ টাকাগুলি ও খুচরা মুদ্রা রিকশঅলার হস্তে অর্পণ করিয়া বলিলাম, যাও, আর আজিকে খাটিও না , তুমিও অদ্য সপরিবারে আয়েস করো । রিকশঅলা কহিল, পরিবার গ্রামে থাকে হুজুর; আপনার দেয়া মজুরি লইয়া গ্রামে ঘুরিয়া আসিব, ঈশ্বর আপনাকে শত সন্তান দিন ।

দরজা খুলিয়া দিয়া নির্মলের ভৃত্য কহিল, আপনাদিগের সহিত নির্মলবাবু গিয়াছিলএন, কিন্তু দ্বিপ্রহরের খাবার খাইতে আসেন নাই , এবং কোনো খবরও পাঠান নাই ; মা বেশ চিন্তিত । আরও অনেকে খোঁজ করিয়া গিয়াছেন ।

আমি বলিলাম, মাকে জানাইতে যে এগারো বা বারোটা পর্যন্ত নির্মল ও প্রণব প্রমুখ চিত্রকরগণ ছিল আমার সহিত । তারপর জানিতে চাহিলাম, নির্মলের ভাইবোন কেহ আছে কি ? ভৃত্য কহিল, নির্মলের মাতাই কেবল আছেন । পার্টিশান করিয়া গৃহের অন্য অংশে সপরিবারে নির্মলের কাকা থাকেন, কিন্তু তাঁহাদের সহিত সদ্ভাব নাই ।

ভৃত্য প্যাসেজের আলো জ্বালিয়া দিলে, হলঘরে প্রবেশ করিলাম । হলঘরটি অন্ধকার, কোথায় যে সুইচ তাহা জানি না । প্যাসেজে আসিয়া দেখিলাম সদর বন্ধ করিয়া ভৃত্য চলিয়া গিয়াছে । পুনরায় হলঘরে প্রবেশ করিয়া, নানা আসবাব ও তাহার উপর রাখা সমাপ্ত-অসমাপ্ত তৈলচিত্র এবং ফ্রেমে বাঁধা আনকোরা ক্যানভাস ইত্যাদির পাঁজা আন্দাজমতন ঠাহর করিয়ে গেস্টরুমের দ্বারে পৌঁছাইলাম । অদ্ভুত লাগিতেছিল, শিল্পীর পৃথিবীতে প্রাকৃতিক অন্ধকারে হাতড়াইতেছি অথচ শিল্পী কত কি আঁকিয়া চতুর্দিকে ছড়াইয়া রাখিয়াছেন।

দরজাটি ঠেলিয়া টের পাইলাম তাহা বন্ধ । নির্মল ফেরে নাই। আমিও বন্ধ করিয়া যাই নাই । তালা দেয়া নহে,  তালাটি আঙটায় ঝুলিতেছে, হাত দিয়া অনুমান করিলাম । পুরানো আমলের দরজা জ্যাম হইয়া গিয়া থাকিবে ; বিরক্ত লাগিল, ক্লান্তিতে অবসন্ন বোধ করিতেছিলাম । কোথায় সামান্য মদ্য পান করিয়া ঠ্যাং ছড়াইয়া আরাম করিব, এখন দরজা বন্ধের ঝক্কি । পুঁটুলি ও বোতল মেঝেয় রাখিয়া দুই আংটা ধরিয়া ঠেলিলাম , খুলিল না । আটকাইয়া গিয়াছে অনুমান করিয়া কাঁধ দিয়া ধাক্কা দিতেই খুলিয়া গেল ।

মুখ থুবড়াইয়া পড়িতাম । কিন্তু ঘরের ভিতরে লুক্কায়িত আগন্তুক, যাহার দেহে আমার তুলনায় অধিকতর শক্তি বলিয়া প্রতিভাত হইল, অক্টোপাসের ন্যায় আষ্টেপৃষ্টে আঁকড়াইয়া বিছানায় পটকাইয়া, উরুর উপর বসিয়া আমার গলা টিপিয়া ধরিল । আন্দাজ করিলাম, চশমাটি কোথাও ছিটকাইয়া পড়িল । ভয়ে আমার কন্ঠ শুকাইয়া গেল । আমার দেহে শক্তি কম নাই, আমি বেশ স্বাস্হ্যবান, কিন্তু আগন্তুক চোর বা ডাকাত আমার চেয়ে বলশালী বলিয়া তাহাকে কাবু করিতে পারিলাম না ।  অন্য কাহাকেও আক্রমণ করিবার পরিবর্তে আততায়ী ভুলবশত আমায় নিশানা বানাইয়া থাকিবে । হয়ত নির্মলের কাকা নির্মলকে শিক্ষা দিবার উদ্দেশ্যে কোনো ভাড়াটে গুন্ডা লেলাইয়া দিয়াছেন । কন্ঠ হইতে হাত দুইটা সরাইবার প্রয়াস করিতে, আততায়ী তাহা সরাইয়া আমার দুই গাল চাটিয়া দিল, এবং বেড সুইচ জ্বালাইয়া ঘর আলোকিত করিল ।

হতবাক হইয়া দেখিলাম ম্যাডেলিন করিয়েট , আমার উরুর উপরে বসিয়া, আমার মুখের উপর ঝুঁকিয়া, ভয় ও আশাপূর্তি মিশ্রিত আমার মুখের অভিব্যক্তি উপভোগ করিতেছে , ও খিলখিল করিয়া হাসিতেছে, ঝাঁকাইতেছে সোনালি চুল । অবিশ্বাস্য পরিস্হিতিতে আমার কন্ঠ হইতে কথা নির্গত হইল না ।

খাট হইতে লাফাইয়া নামিল ম্যাডেলিন । হ্যাঁচকা মারিয়া আমাকেও নামাইল, হলঘরে প্রবেশের মুখে, গেস্টরুমের পাশের দেয়ালগাত্রের সুইচ টিপিয়া আলো জ্বালাইল , এবং হিড়হিড় করিয়া আমাকে লইয়া চলিল সেই  অংশটিতে যেখানে দাঁড়াইয়া নির্মল তৈলচিত্র আঁকে । অনুমান করিলাম, ম্যাডেলিনের ছবির অবয়বে নির্মল জীবন্ত রঙ ভরিয়া ফেলিয়াছে, তাহাই দেখাইতে লইয়া যাইতেছে ।

দেয়ালে ঠেসান দেয়া একাধিক আঁকা তৈলচিত্রের পাঁজার প্রতি নির্দেশ করিয়া ম্যাডেলিন কহিল, ভালো করিয়া লক্ষ্য করো, ওইটি আয়নার কাঁচে অঙ্কিত, এবং এমনভাবে রক্ষিত যে, না-আঁকা অংশে আলো প্রতিফলিত হয় । পিছনে কী ঘটিতেছে, কে ঘরে প্রবেশ করিল ইত্যাদি ওই ফ্রেমটিতে দেখিয়া নির্মল জানিতে পারে । নির্মল যখন কহিল তুমি স্ট্যাচুর ন্যায় অন্ধকারে ঠায় বসিয়া আমার নগ্নদেহ দেখিতেছিলে, আমি তাহাকে জানাইলাম ঘটনাটি আমি বিলক্ষণ জানি, আমিও তোমায় আবছাভাবে নড়িতে দেখিয়াছিলাম । আমার দেহের প্রতি কেহ যে মুগ্ধ হইতে পারে তাহা অবহেলা করা আমার পক্ষে অসম্ভব ।  সেই দ্বিপ্রহর হইতে তোমার জন্য অপেক্ষা করিতেছি ।

স্বগতসংলাপের নিঃশব্দ প্রাগলভ্য ভেদ করিয়া আমার কন্ঠ হইতে এই কটি কথা নির্গত হহিল, আমার মধ্যে তুমি কী দেখিলে ? প্রশ্ন করাকালে মনের ভিতর দ্বিপ্রহরের দৈবত্বের কথা উঁকি দিল, সত্যই কি আমার ভিতর দৈবত্ব সঞ্চারিত হইয়াছে ! ম্যাডেলিন কোমর হইতে পা পর্যন্ত লাল-কালো বেড় দেয়া, কাঁচ বা প্লাসটিক বসানো রাজস্হানি ঘাগরা পরিয়া আছে, ঊর্ধ্বাংশে পুরুষালি পাঞ্জাবি, খাদির, যাহার কোমরের তলার অংশটি ছিঁড়িয়া ফেলা হইয়াছে । কোমরে পাসপোর্ট টাকা ইত্যাদি রাখার বেল্ট । পাঁচ ফিট আট-নয় ইঞ্চ তো হইবেই উচ্চতা ।

ম্যাডেলিন পাল্টা প্রশ্ন তুলিল, তুমি দীর্ঘ সময় লুকাইয়া আমার প্রতি তাকাইয়া থাকিবার মতো কী সৌন্দর্য দেখিলে ? আমার মুখ সুন্দর নহে । আমি চিত্রশিল্পীর নগ্নিকা মডেল হইবার অনুপযুক্ত, কেননা আমার দেহের সবকিছুরই পরিমাপ তুলনামূলকভাবে বেশি, নারীর বর্তমান মাপদণ্ডের অনুকূল নহে । হাত ও বাহুদুটি নিরীক্ষণ করো, পুরুষের ন্যায় চওড়া । নির্মল বলিয়াছে, সে আমার ত্বকের রঙে আগ্রহী । এই প্রকার রঙ প্রকাশ করা নাকি চিত্রশিল্পীর নিকট দুঃসাধ্য, প্যারি শহরে থাকাকালেও সে আমার রঙের তরুণীর দেখা পায় নাই । তাহার নিকট আমার আর প্রয়োজন নাই— আমি পরিত্যক্ত হওয়া সহ্য করিতে পারিনা, ভীষণ ক্রোধ হয় ; এই পটভূমিতে তুমি উপশমের কাজ করিয়াছ । নির্মল বলিয়াছে বিষয়বস্তুকে একবার দেখিলে সে স্মৃতিতে সম্পূর্ণ তুলিয়া লয় । কিন্তু তুমি একজন প্রথিতযশা শিল্পী হইয়াও কী কারণে আকৃষ্ট হইলে ?

আমি ম্যাডেলিনের চোখে চোখ রাখিয়া বলিলাম, এত দ্রুত ইংরাজিতে কথা বলিও না, দ্রুত বলিলে দুইবার করিয়া বলিবে ; সত্য কথাটি হইল, আমি ইতোপূর্বে নগ্ন শ্বেতাঙ্গিনী দেখি নাই ; দ্বিতীয়ত, তোমার দেহটি ক্লাসিকাল, অকেকাংশে খাজুরাহো কোনারকের নারীগণের মতন, বা প্রাচীন রোম ও গ্রীসের নারীপ্রতিমার ন্যায় মাংসল ; আমি একজন মাংসাশী শিল্পী ; সর্বোপরি, নির্মল ঠিকই কহিয়াছে যে তোমার দেহ দ্যুতিময়, ওই দেহের তেজোময়তায় আমি সমগ্র দিন আচ্ছন্ন রহিয়াছি , চক্ষু মুদিত করিলেই তোমার নগ্ন, জ্যোতিবিকিরণকারী দেহ, সোফায় অর্ধশয়ান অবস্হায় দেখিয়াছি । তোমার উরুদ্বয়ের আভায় যে মসৃণতা দেখিয়াছি তাহা তুলনাহীন । দেখিতে-দেখিতে তোমাকে খাইয়া ফেলিতে ইচ্ছা হইতেছিল ।

প্রখর দৃষ্টি মেলিয়া আমার বক্তব্যের সত্যতা যাচাই করিবার প্রয়াস করিল ম্যাডেলিন, এবং কহিল, ভারতীয়গণ,  বিশেষত যাহারা শ্বেতাঙ্গিনীর বিছানায় প্রবেশ করিতে চায়, তাহারা সচরাচর মিথ্যাবাদী, কেহ-কেহ বিশ্বাসঘাতক ।

হ্যাঁ, তুমি অনুমতি দিলে, আমি তোমার বিছানায় প্রবেশ করিব, চোখে চোখ রাখিয়াই বলিলাম, আপ্রাণ চেষ্টা করিলাম যাহাতে উহার বুকের দিকে দৃষ্টি না যায় । বক্ষ দুটি সকালেই  দেখিয়াছি , অতীব মনোলোভা ; তাহার উপর মাথা পাতিয়া শুইতে ডাক দিতেছিল অর্ধশয়ান যুবতীটি ।

তাহা হইলে আমার ঘরে চল , আমি কেবল এক সপ্তাহ থাকিব, একমাসের ভাড়া বাড়ির মালিককে অগ্রিম প্রদান করিয়াছি , আমি যাইবার পর তুমি থাকিতে পারিবে ; নির্মল কহিতেছিল, তুমি এক মাসের জন্য আস্তানা খুঁজিতেছ । আমার প্রস্তাব বুঝিতে পারিয়াছ নাকি পুনর্বার বলিব ? কাঁধ পর্যন্ত সোনালি চুল দুই হাতে পিছনে বিলি কাটিয়া শুধাইল ম্যাডেলিন ।

দ্রুত কথা বলার পরিবর্তে ম্যাডেলিন আমার পক্ষে বোধগম্য করিয়া বলিতেছিল । কিন্তু উহার প্রতিটি বাক্য ফাক, শিট. আসহোল, ব্যাস্টার্ড, সান অব আ বিচ ইত্যাদি শব্দের অলংকারে ভূষিত । আমি সেগুলির বঙ্গানুবাদ করিতে অক্ষম বলিয়া বর্জন করিতেছি । তদ্ব্যাতীত, বাংলায় শব্দগুলিকে অব্যর্থ প্রতীয়মান হয় না ।

আমি বলিলাম, মূর্খ হইলেও বিশ্বের কোনো যুবক এই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করিবে না । কিন্তু অদ্যরাত্রে গেরিলা পেইনটার্স গোষ্ঠীর হ্যাপেনিং নামক অনুষ্ঠান এই হলঘরে হইবার কথা আছে যে !

না না, তাহা বাতিল করা হইয়াছে , গম্ভীর মুখে ম্যাডেলিন কহিল । তাহার পর যোগ করিল, উল্লাসের গৃহে কলিকাতা হইতে কয়েকজন তরুণ বিপ্লবী আসিয়া দশবারো দিন লুকাইয়াছিল, উহাদের পুলিশ ধরিয়া লইয়া গিয়াছে । শুনিলাম, পশ্চিমবঙ্গে প্রবেশ কিয়া পুলিশ উহাদের হত্যা করিয়া যত্রতত্র দেহ ফেলিয়া দিবে । তাহা যাহাতে না ঘটে সেহেতু গেরিলা পেইনটার্সের সদস্যগণ বিভিন্ন সংবাদপত্রের বেনারসস্হিত প্রতিনিধিদের ধরাধরি করিতেছে ।

উহারা নকশালপন্হী,  মার্কসবাদী বিপ্লবী, আমি বলিলাম ।

আমার বগলের তলা হইতে নিজের দক্ষিণ হস্ত গলাইয়া, রেস্টরুমের দিকে হাঁটিতে-হাঁটিতে ম্যাডেলিন প্রশ্ন করিল, তোমাদিগের দেশেও এডগার হুভারের ন্যায় গুমখুনকারী প্রশাসক আছে নাকি ? সাম্যবাদ প্রতিরোধের নামে হুভার বহু মানুষকে লোপাট করিয়া দিয়াছে ।

আমি বলিলাম, তুমি এক কপি রামায়ণ ক্রয় করিও । ইংরাজিতে পাওয়া যায় । উহাতে বিভীষণ নামক একটি বাঙালি চরিত্র আছে ।

মাথা নাড়াইতে ম্যাডেলিনের সোনালি চুল দুই দিকে নাচিয়া উঠিল । কহিল, পড়াশুনা আমার একেবারে ভাল লাগে না । উহা জীবনকে উপভোগে ব্যাঘাত ঘটায় ।বহু গ্রন্হ পড়িবার পরও কত মানুষকে দেখিয়াছি, একেবারে মনুষ্যত্বহীন রহিয়া গিয়াছে ; অনেকে বোধহয় গ্রন্হ পড়িয়া দানবিক আকার লাভ করে, গ্রন্হ তাহাদের মাথায় অজগরের ন্যায় পাক খাইতে থাকে সারাটা জীবন ।

কিন্তু সকালে নির্মল পরিচয় করাইবার সময়ে যে বলিল তুমি তোমার পূর্বপুরুষ টমাস করিয়েট সম্পর্কে গবেষণা করিতে ভারতে আসিয়াছ ? মেঝে হইতে পুঁটুলি ও বোতল তুলিয়া প্রস্ন করিলাম । ঘরে প্রবেশ করিয়া ভাঙা চশমা মাড়াইয়া চূর্ণবিচূর্ণ করিলাম ।

ডাহা মিথ্যা, ঝুঁকিয়া উচ্চহাস্যে বলিল ম্যাডেলিন , ইমপ্রেস করিবার জন্য বলিয়াছিলাম । যে যুবক আমাকে বেনারসে আনিয়া অন্য এক ব্রিটিশ তরুণির সহিত আগ্রা বা দিল্লি পলাইয়াছে, সে ওই বিষয়ে গবেষণা করিতেছে । টমাস করিয়েটের পূর্বপুরুষগণ ভাইকিং যোদ্ধা ছিলেন । আমার দেহে ভাইকিংগণের রক্ত আছে । সেকারণেই তো দেহের কাঠামো ও রঙ এই প্রকার । দেহের চাহিদাও ভাইকিংগণের মতন ।

আমার চামড়ার স্যুটকেসে পুরানো প্যান্টটি রাখিয়া রেশমের চাদরটি ম্যাডেলিনের স্কন্ধে জড়াইয়া দিলাম । ছয়টি রৌপ্যমুদ্রা ছিল ; ম্যাডেলিনের হাতে দিয়া বলিলাম, মেমেন্টো, ফুটা করিয়া নেকলেস বানাইও । বোতল ও স্যুটকেস তুলিয়া লইতে, রৌপ্যমুদ্রাগুলি কোমরের ব্যাগে রাখিয়া ম্যাডেলিন কহিল, শুইবে বলিয়া অগ্রিম পাওনা মিটাইতেছ ! তাহার পর আমার হাত হইতে স্যুটকেসটি কাড়িয়া যোগ করিল, তোমার চেয়ে আমার দেহে বেশি শক্তি আছে । দৈঘ্যেও আমি তোমার চেয়ে তিন-চার ইঞ্চ লম্বা ।

রিকশয় বসিয়া আমার দিকে দৃষ্টি হানিয়া ম্যাডেলিন কহিল, তুমি ফোরপ্লে জানো ? উহাও শিল্প ! ভাইকিং রমণী ফোরপ্লের বৈভিন্নে জাগ্রত হয় ।

বলিলাম, ভয় দেখাইও না । কোনারক-খাজুরাহো ইউরোপ-আমেরিকায় অবস্হিত নহে । চুম্বন জিনিসটিও আমাদের দেশ হইতে বিভিন্ন দেশে গিয়াছে । আশ্চর্য, পথিমধ্যেই, ম্যাডেলিন পট করিয়া আমার ঠোঁটে ঠোঁট ঠেকাইল । মাথা ঘুরাইয়া দেখিলাম, আমাদের সম্পর্কর পথচারীগণ উদাসীন । সকলে নিজ-নিজ কর্মে  ব্যাপৃত । ভিয়েতনামের যুদ্ধ হইতে জন্ম লইয়াছে দেশ-পলাতক এই হিপিগণ এবং বেনারসের মতো তীর্থ ক্ষেত্রে দলে-দলে আগমন করিয়া স্হানীয় আচরণে ও দৈনিক সংস্কৃতিতে তুমূল পরিবর্তন ঘটাইয়া দিয়াছে । রক্ষণশীলতা বর্জন করিতে হইয়াছে ইহাদের ডলারের চাপে ।

ম্যাডেলিনের উৎসবমুখর নীলাভ চক্ষে চাউনি ফেলিয়া বুঝিলাম যে আমার অঙ্গপ্রত্যঙ্গে নিঃশব্দ হইচই বাধাইয়াও সে বেশ নির্লিপ্ত । সে শুধাইল, তুমি দেহে পারফিউম লাগাও , অদ্ভুত এক সুগন্ধ সেই তখন হইতে পাইতেছি , যখন অন্ধকারে তোমার লবণাক্ত গাল লেহন করিয়াছিলাম ।

তুমি যেরূপ ভাইকিং বংশের, আমি তাহার চেয়েও প্রাচীন এক ঋষির বংশধর, যাঁহার মন্ত্রবলে আমাদের নাভি হইতে হরিণের ন্যায় মায়াগন্ধ বিচ্ছুরিত হয় ।

আমার কথাগুলি বিশ্বাস করিবে কিনা সে চিন্তা মুহূর্তের জন্য ম্যাডেলিনের চোখেমুখে ভাসিয়া উঠিল । আমাকে আলিঙ্গন করিয়া, ছাড়িয়া দিয়া কহিল, মিথ্যাবাদী, কিশোর প্রেমিকের ন্যায় মিথ্যাকথা বলিতেছ ।

চুম্বন, জড়াজড়ি ইত্যাদির সহিত আমি চার দেয়ালের ভিতরই পরিচিত । পথচলতি এইরূপ ব্যবহারে কিঞ্চিৎ বিব্রত হইতেছিলাম বলিয়া, একটি বৃহৎ মণিহারি দোকান দেখিয়া রিকশ থামাইয়া ম্যাডেলিনকে আহ্বান করিলাম, এসো, ফোরপ্লের জন্য ঋষিগণের আবিষ্কৃত দুই প্রকার তরল ক্রয় করি ।

ক্রয় করিয়া, রিকশয় বসিয়া বলিলাম, এই ছয়টি শিশির নাম অগরু, উহার প্রলেপ সূর্যাস্তের পর তোমার সমগ্র দেহে লাগাইয়া ফোরপ্লে করিতে হইবে । এই ছয়টি মন্ত্রপূত শিশির নাম কান্তা ; উহার প্রলেপ সূর্যোদয় পরবর্তী ফোরপ্লের জন্য ।

হ্যাঁ, সে কহিল, বোকা প্রেমিকের আচ্ছন্নতা হইতে মুক্ত অভিজ্ঞ যুবকের ন্যায় এখন সত্য কথা বলিতেছ ।

রিকশঅলাকে কী নির্দেশ ম্যাডেলিন দিয়াছিল, ভাইকিং রমণীটির দেহৈশ্বর্য দেখিতে মগ্ন ছিলাম বলিয়া কানে যায় নাই । যে অঞ্চলে থামিল, তাহা মনে হহিল গোধোলিয়ার নিকটবর্তী । ম্যাডেলিন স্যুটকেস লইয়া নামিতে, আমি রিকশ ভাড়া মিটাইলাম , এবং অনুসরণ করিয়া শতবৎসরের পুরাতন চুনকামহীন একটি তিনতলা গৃহের প্রায়ান্ধকার প্যাসেজে প্রবেশ করিলাম ।

প্যাসেরজের দুইপাশে ঘরগুলির দরজা খোলা বা অর্ধেক-খোলা বা বন্ধ ; একা শ্বেতাঙ্গ যুবক বা যুবতী, যুবক-যুবতী জোড়া, যুবক জোড়া, যুবতী জোড়া দেখিয়া অনুমান করিলাম, বাড়িটি বিদেশিগণের প্রিয়, এবং গৃহকর্তা উহাদেরই ঘর ভাড়া দিয়া থাকেন । ধোঁয়ার সুবাসে প্রতিভাত যে মাদকের সন্ধ্যাহ্ণিক চলিতেছে । কোনো হর্ষকোলাহল নাই, কথপোকথন নাই, গুঞ্জরণ নাই; যে যার ব্যক্তিগত মায়াস্বপ্নের আলোকমালায় ডানা মেলিয়া বিহার করিতেছে ।

দ্বিতলে যাইবার সিঁড়িতে হলুদ টিমটিমে বাল্ব, ক্ষয়িত ধাপগুলি তুলনামূলকভাবে উঁচু । পুনরায় প্যাসেজ । প্রথম তলার ন্যায় ভাড়াটে ও ধোঁয়া । একটি ঘরে জনৈক ভারতীয় যুবক, কাঁধ পর্যন্ত দীর্ঘ চুল, দাড়িগোঁফ নাই, জিনস ও সবুজ টিশার্ট পরিহিত , গিটারে কোনো পাশ্চাত্য সুর তাহার শ্বেতাঙ্গিনী শ্রোতাকে শুনাইতেছে , যাহার সোনালি ঝাঁকড়া চুল-মাথা ঢলিয়া আছে গিটারবাদকের স্কন্ধে ।

হয়ত প্রয়োজন নাই বলিয়া ত্রিতলে যাইবার সিঁড়িতে বিজলি বাতির বালাই নাই । ছাদে উঠিয়া হাঁফ ছাড়িলাম । ফাল্গুনের আকাশে একটি-দুটি তারা আমাদের বেঢপ রাধাকৃষ্ণ জুটিকে দেখিবার জন্য উঁকি-ঝুঁকি মারিতেছে । পশ্চিম কোণে একটিই ঘর তৎসংলগ্ন, সম্ভবত, টয়লেট । পূর্বকোণে সিমেন্ট নির্মিত জলের ট্যাংক ।

তালা খুলিয়া বিজলিবাতি জ্বালাইল , এবং ঘরে প্রবেশ করিয়াই ঘাগরা ও কুর্তা ফেলিয়া দিল ম্যাডেলিন । আমি অপার আনন্দের রক্তসঞ্চালনজনিত ঠাণ্ডা ও দমিত উত্তেজনায় হতবাক । এই প্রকার অন্তর্বাসহীন পোশাকেই থাকো নাকি, প্রস্ন করিতে, বিস্ময়ে প্রীত আমার মুখের দিকে তাকাইয়া, ভাইকিং রমণী উত্তর দিল, অন্তর্বাস কাচিবে কে ? এই ঘর এই ছাদ সম্পূর্ণ আমার ; ছাদের দরজায় তালা দিয়া নগ্নই থাকি ।

টেবলফ্যানটি রিভলভিং করিয়া চালাইয়া দিলে, আমি কহিলাম, তোমার ত্বকের দ্যুতিতে এই কয়দিনে আমি অন্ধ হইয়া যাইব ; ইতিমধ্যেই আমার দেহে রসায়নের নদীগুলি বেচাল হইয়া সমুদ্র খুঁজিতে ছুটিতেছে ।

চতুর্দিকে চাহিয়া ঘরের যা অবস্হা প্রতিভাত হইল, অনুমান করিলাম, বড়ই অগোছালো মেয়েটি ; পোশাক হয়ত এক-দুইবার পরিয়াই ফেলিয়া দিয়াছে, পাউরুটি-বান পড়িয়া আছে অর্ধভূক্ত, জলের পরিবর্তে বিয়ার পান করিয়া বোতলের পাহাড় এককোণে গড়িয়াছে , অ্যাশট্রেতে গুঁজিয়া রাখিয়াছে সিগারেট অথবা ফ্যাগের শেষাংশ । নানা মাপের পকেটযুক্ত ঢাউস রাকস্যাক এক কোণায় ।

জাল লাগানো তিন দিকের জানালা খুলিয়া দরজা বন্ধ করিল মভাদেলিন এবং আমাকে হুকুম করিল, নাও, দ্রুত ওই পোশাক দেহ হইতে নামাও ; সূর্যাস্ত-পরবর্তী মন্ত্রপূত তরল লইয়া যুদ্ধক্ষেত্রে অবতীর্ণ হও । বিছানায় উঠিয়া চিৎ হইয়া শুইয়া পড়িল । একটি ট্যাবলেট, খাইল না, গর্ভদ্বারে ঠেলিয়া দিল ।

যদিও আমার শরীরের অকুস্হলে, মস্তিষ্কে ও হৃ৭পিণ্ডে রঙ্গনাট্য, ম্যাডেলিন ঘাগরা ছাড়িবামাত্র, অভিনীত হইতেছিল, অপেক্ষা করিতেছিলাম যে প্রথম আহ্বানটি সে-ই করুক । নির্মলের স্টুডিওয় বিশেষ দৃষ্টি-উন্মত্ত থাকার কারণে লক্ষ্য করি নাই যে তাহার গোপনাঙ্গে ও বাহুমূলেও সোনালি চুল রহিয়াছে । কখনও ভাবি নাই যে  নারীদেহের এই  অঞ্চলগুলোতেও সোনালি চুল থাকিতে পারে !

পোশাক ত্যাগ করিয়া, ঘরে রাখা মগের জলে অগরু শিশিটি উপুড় করিয়া আমার রুমালটি ভিজাইলাম, এবং পা হইতে কপাল পর্যন্ত বহুক্ষণ ধরিয়া প্রলেপ দিলাম । উপুড় করিয়া গলা ও কাঁধ হইতে একইভাবে প্রলেপ দিলাম । নিজের ভারসাম্য গড়িতে এইপ্রকার বিলম্ব জরুরি । প্রলেপ দিবার সময় ত্বকের গন্ধ হইতে আন্দাজ করিলাম যে ম্যাডেলিন প্রতিদিন স্নান করে না । স্নান না করিয়া ত্বক কী ভাবে এত আলোকময় রাখিয়াছে তাহাই বিস্ময়কর ।

ম্যাডেলিন অকস্মাৎ কাঁপিতে লাগিল । ত্রিশ-চল্লিশ মিনিটের সুখদায়ী প্রলেপ স্পর্শেই কি উহার উত্তেজনার পারদ শীর্ষে চলিয়া গেল ? সেশয় দূরীভূত হইল যখন সে চিৎ হইয়া মুখ ঢাকিয়া লইল । কাঁদিতে-কাঁদিতে বলিল, পুরুষ যে এইভাবে আদরের গোপনীয় বাল্যকালীন আকাঙ্খাকে নারীহৃদয়ে জাগাইয়া তোলপাড় ঘটাইতে পারে, এ অভিজ্ঞতা আমার ছিল না শিশির । আমাকে নিজের উপর টানিয়া অর্ধস্ফূটে ফোঁপানিমিশ্রিত কন্ঠে কহিল, অদ্য ফোরপ্লের প্রয়োজন নাই, আমার মন তৃপ্ত হইয়া গিয়াছে ; তুমি তোমার দেহ তৃপ্ত করিয়া লও ।

সংসর্গকে স্বচ্ছন্দ ও সুষম করিবার নিমিত্ত, তৎসত্ত্বেও, আমি মুখ ও করসেবা প্রয়োগ করিলাম , এবং নিজের দেহ ও মনকে তৃপ্ত করিলাম । ঘর্মাক্ত জাপটে আমাকে ভাইকিং বাহুদ্বারা পিষ্ট করিয়া ম্যাডেলিন কহিল, আমার দেহও তৃপ্ত হহিয়াছে । কিয়ৎক্ষণ ঘুমাইয়া পড় ।

পাশে শুইয়া, মিনিট কুড়ি পরই নাক ডাকার শব্দে বুঝিলাম ম্যাডেলিন ঘুমাইয়া পড়িয়াছে । আমার ঘুম আসিল না । চোখ বুজিয়াই হয়ত দেখিব, ম্যাডেলিন নাই, স্বপ্ন দেখিতেছিলাম । এই ভাইকিং রমণী স্বদেশে ফিরিয়া যাইবার পূর্বে, যতবার সংসর্গ সম্ভব হইবে, করিব ।

যানবাহনের শব্দ থামিলে অনুমান করিলাম বেশ গভীর হইয়াছে রাত্রি । জাগাইলাম ম্যাডেলিনকে । বলিলাম খাইয়া লও, ওয়াইন, চিকেন ও রুমালি রুটি আছে, হয়ত ঠান্ডা হইয়া গিয়াছে, কিন্তু পেট ভরিবে ।

মেঝেয় নামিয়া দুইজনে, আদিম মানব মানবীর ন্যায় পোশাকহীন, রুটি-মদ্য-মাংস খাইলাম । লঙ্কা দেয় নাই বলিয়া, মাংস, যদিও নরম, ছিঁড়িয়া-ছিঁড়িয়া খাইল ম্যাডেলিন , ছাড়া কাপড় টানিয়া হাত-মুখ পুঁছিল । ওই একই পরিত্যক্ত পোশাকে আমিও হাত-মুখ পুঁছিলাম । বলিল, মারিহুয়ানা ফুঁকিবে ? আমি বলিলাম, তখন প্রস্তাবটি ছিল তোমার ; আমার দেহ-মন এখনও তৃপ্ত হয় নাই । তোমাকে কি পুনরায় ট্যাবলেট প্রবিষ্ট করাইতে হইবে ?

আমাকে দুই হাতে জড়াইয়া, মেঝের উপরই শুইয়া পড়িয়া ম্যাডেলিন কহিল, এসো, ওই ট্যাবলেটের প্রভাব বাহাত্তর ঘন্টা পর্যন্ত থাকে ; আমাকে ম্যাডে বলিয়া ডাকিবে । এবার দীর্ঘস্হায়ী ফোরপ্লের সূত্রপাত ঘটাঈয়া আমি বলিলাম, আমাকে শিশু বলিয়া ডাকিবে।  ওঃ ,শিশ ইউ , বলিয়া উঠিল ম্যাডেলিন । আমাকে সে শিশ ইউ বলিয়াই ডাকিত । বলিয়াছিল, শিশ ইউ অনেকটা ফাক ইউ-এর বিপরীত ।

কার্যান্তে মেঝেতেই শুইয়া রহিলাম দুইজনে । ম্যাডেলিন ঘুমাইয়া পড়িলে, আমিও ঘুমাইবার প্রয়াস করিলাম , কিন্তু উহার মাংসল দ্যুতিময় বাহু আঁকড়াইয়া রহিলাম ।

সকালে আমার ঘুম ভাঙিয়া গিয়াছিল । ভাইকিং রমণীর ঘুম দুই ঘন্টার পর ভাঙিতেই আমি বলিলাম, বাহাত্তর ঘন্টা সমাপ্ত হইতে বাকি আছে, একদম উঠিবে না । বলিয়া সূত্রপাত করিবার উপক্রম করিয়াছিলাম । উচ্চস্বরে হাসিতে-হাসিতে ম্যাডেলিন কহিল, বেশ, সূর্যোদয়ের মন্ত্রপূত শিশিটির প্রলেপ দাও । দাঁড়াও, ছাদের দরজায় তালা দিয়া টয়লেট হইয়া আসি । আগের দিনের ঘাগরা গলা-কাঁধে পরিয়া আধঘণ্টা পরে ফিরিল ম্যাডেলিন ।

প্রাতঃকৃত্য সারিবার নিমিত্ত, স্যুটকেস হইতে তোয়ালে ও গায়ে মাখিবার সাবান লইয়া টয়লেটে প্রবেশ করিয়া দেখিলাম বক্ষের ও নিম্নাঙ্গের কয়েকটি অন্তর্বাস, শুকাইয়া-যাওয়া এক্সট্রা লার্জ স্যানিটারি প্যাড, ব্যবহৃত টয়লেট পেপার যত্রতত্র, যাহা, কোণে রক্ষিত নারিকেল ঝাড়ু দ্বারা একপাশে সরাইয়া স্নান করিলাম । মনে হইল, পুনরায় তরতাজা ও যুদ্ধক্ষেত্রে নামিবার জন্য আমার দেহশক্তি নবীকৃত । গা মুছিয়া, তোয়ালে সম্পূর্ণ সিক্ত করিলাম বালতিতে ডুবাইয়া ।

ঘরে প্রবেশ করিয়া দেখিলাম খাট হইতে তোষক টানিয়া মেঝেয় বিছাইয়াছে ম্যাডেলিন, ফ্যান শিয়রে টানিয়া আনিয়াছে এবং তোষকের উপর ছয়টি কলা, দুটি আপেল, চারটি ডোনাট, যেগুলি ঘরে  কোথাও চাপা পড়িয়াছিল, লইয়া বসিয়া আছে , পোশাকহীন ; পাশে অ্যাশট্রৈ এবং দুই বোতল বিয়ার ।

সিক্ত তোয়ালেতে কান্তা সুগন্ধী ছিটাইয়া ভালোভাবে পুঁছিলাম ম্যাডেলিনের দেহ । চোখ বুজিয়া শীতল স্পর্শের আরাম লইতে-লইতে বলিল, ব্রেকফাস্ট করিয়া, একটি অটুলস ফ্যাগ ফুঁকিয়া পরস্পরকে চতুষ্পদের মত রেপ করিবার লড়াই করিব, কী বল ?

অটুলস ফ্যাগ ? তুমি অতুলকে চেনো নাকি ? আমার স্বরযন্ত্র হইতে অতিসতর্ক প্রস্ন নির্গত হইল ।

অটুলকে চিনি না ; গৃহকর্তা মিস্টার গুপ্টা প্রতিটি ভাড়াটিয়াকে বিক্রয় করিবার জন্য সপ্তাহান্তে একবার আসেন । কত দাম জানো ? চার ডলার । আমার এই ঘরের ভাড়াও চার ডলার, সংলগ্ন টয়লেট এবং খোলা ছাদ কেবল আমার বলিয়া । দ্বিতলের ভাড়া ঘরপ্রতি আড়াই ডলার দেড় ডলার, প্রতি তলায় দুইটি মাত্র টয়লেট । তবু প্রত্যেকে অটুলস ফ্যাগের  ভক্ত , কারণ উহা লাইসার্জিক অ্যাসিডের চেয়েও মনোমুগ্ধকর, মাথা ও দেহকে ক্লান্ত করে না, প্রাতঃকালে ফুঁকিলে বিকাল পর্যন্ত এক ভিন্ন জগতে গিয়া স্বগীয় সুখ পাওয়া যায় । বেনারসে আসা কেন ? নেশার জন্যই তো । এই শহরের জনগণ সবাইকে গ্রহণ করিয়া লয়, তাহাদের কার্যকলাপকে অসামাজিক মনে করে না ; পথের ধারে বসিয়াও তুমি যথেচ্ছ ধোঁয়া ফুঁকিতে পারো । ম্যাডেলিনের দীর্ঘ ব্যাখ্যায় আশ্বস্ত হইলাম, যে, যাক, অতুলের সহিত উহার পরিচয় নাই ।

তোয়ালে উহার কপালে-চুলে জড়াইয়া দিয়া তোষকে বসিতে-বসিতে বলিলাম, তোমার ফুঁকিবার হয় ফুঁকিতে পারো, আমি পরে ফুঁকিব ; আমি সজ্ঞানে ম্যাড করিয়েটকে আলিঙ্গনে চাই । সংসর্গের সময় নেশাচ্ছন্ন হইয়া ভিন্ন জগতে বিচরণ করিব, তাহা চিন্তা করাও আমার পক্ষে অসম্ভব । প্রিয় ভাইকিং রমণী, দীর্ঘস্হায়ী নেশার নীহারিকায় প্রবেশের পূর্বে পেট ভরিয়া খাইয়া লও । তুমি ঢলিয়া পড়িবার পর আমি চার দিনের খাবার লইয়া আসিব ।

একটি কলা, একটি আপেল, একটি ডোনাট আমি খাইলাম । বাকিগুলি ম্যাডেলিন খাইল । তাহার ভোজন-আগ্রহে বুঝিলাম সে কেন অমন মাংসলতামায় আকর্ষণীয়া । বিয়ারের যে বোতলটি সে খুলিল, আমি এক ঢোঁক লইয়া কেবল গলা ভিজাইলাম । রাকস্যাকের পকেট হইতে একটি অটুলস ফ্যাগের কয়েকটান ধোঁয়া গিলিয়া আমার দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি মেলিয়া বলিল, আমার প্রেমে পড়িয়াছ মনে হইতেছে ; প্রেমে পড়িও না , প্রেম জিনিসটি তামাদি হইয়া গিয়াছে । দুটি দেহের মাঝে মনকে আনিও না ; মানসিক বিপর্যয় ও শোকে আক্রান্ত হইবে । কোনারক-খাজুরাহোর ভাস্করগণ ওই বিপর্যয়ে পড়িলে অমর কীর্তী গড়িতে পারিতেন না ।

আমি আপাতত নিজেকে বুঝিতে অক্ষঞ ল কিন্তু কোনো অর্থেই আমি জ্ঞান খোয়াইয়া তুরীয় অবস্হায়, মন যতক্ষণ না ভরিতেছে, সংসর্গ করিব না । পাল্টা তীক্ষ্ণ দৃষ্টি মেলিয়া উত্তর দিলাম ।

কয়েকটি দীর্ঘ সুখটান দিয়া ম্যাডেলিন অকস্মাৎ শুধাইল, তুমি আমার সহিত নিউইয়র্ক চলো, চারঘরের অ্যাপার্টমেন্টে একা থাকি । বাবা-মা পুনরায় বিবাহ করিয়া অন্যত্র থাকেন । কিন্তু আমার নামে যে নিবেশ আছে, কিছুই করিতে হইবে না সারাজীবন । চলো, আমি ভাড়া দিয়া লইয়া যাইব । পরস্পরের যৌন ক্রীতদাস রূপে অষ্টপ্রহর আনন্দ করিব, ঘরে, বারান্দায়, য়াকুজিতে, সন্ধ্যার সময়ে পার্কে, সমুদ্রতীরে, যত্রতত্র ।

আমি বলিলাম, তারপর কোনো দীর্ঘদেহী ভাইকিং একদিন তোমার বিছানায় প্রবেশ করিবে, এবং তুমি আমাকে লাথি মারিয়া খাট হইতে ফেলিয়া দিবে ।

কিয়ৎক্ষণ আত্মচিন্তায় মগ্ন থাকিবার পর ম্যাডেলিন কহিল, আমি কম বয়সে এইরূপ পৃথুলা ছিলাম না । তুমি মুলাঁ রুজ বা রেড উইন্ড মিল ক্যাবারের কথা শুনিয়াছ ?  কুড়ি বৎসর বয়সে আমি প্যারি গিয়াছিলাম মুলাঁ রুজের অডিশানের জন্য । উহারা .উনিশ শতকের ক্যান ক্যান নৃত্যের জন্য জগদ্বিখ্যাত । প্রায় একশটি তরুণী অডিশানের জন্য একত্রিত হইয়াছিল । আমাদের প্রত্যেককে একটি নৃত্যের ভঙ্গী দেখাইয়া বলা হইল, অভ্যাস করিয়া পাঁচ মিনিট পর আইস । ওই কঠিন নৃত্য কেহ কি পাঁচ মিনিটে শিখিয়া লইতে পারে ? অডিশানে বিফল হইলাম ; জীবনের একমাত্র আকাঙ্খা চরিতার্থ করিতে না পারিয়া আগ্রহ হারাইয়া দেহকাঠামো বজায় রাখার প্রয়োজন মনে করি নাই । তাই হিপি জীবনটিই আকর্ষনীয় প্রতিভাত হইয়াছে । যাহা ইচ্ছা করি, যে দেশে ইচ্ছা যাই, যাহাকে ভালো লাগে তাহার সহিত শুই, খাইতে ভালোবাসি বলিয়া প্রতিটি দেশের খাদ্য খাই । কথাগুলি বলিয়া বেশ কিয়ৎক্ষণ চুপ করিয়া রহিল ম্যাডেলিন ।

আমি বলিলাম, তুমি তাড়াহুড়া করিলে বলিয়া গিটারটি নির্মলর গৃহেই ফেলিয়া আসিলাম । নতুবা তুমি নৃত্য করিতে আর আমি গিটার বাজাইতাম ।

অকস্মাৎ সিগারেটটী দ্রুত দু-তিন টানে শেষ করিয়া অতর্কিতে আমার উপর ঝাঁপাইয়া ম্যাডেলিন কহিল, গিটারের নিকুচি করিয়াছে, নাচিবার-বাজাইবার সময় আর নাই ।আইস, এখন যাহা করিতে চাহি তাহাই করি ।

আমার  চেয়ে অধিক শক্তি ধরিলেও, আমার দেহে মাত্র একটি অকুস্হল, যখন কিনা উহার  দেহ জুড়িয়া আক্রমণযোগ্য সংবেদনস্হল, আনাচ-কানাচ, ঢেউ-পাটাতন । কাবু করিতে বিলম্ব হইল না । যৎসামান্য ফোরপ্লের পর ম্যাডি হাপরকন্ঠে কহিল, বাদ দাও, বাদ দাও, আমি চতুষ্পদ ঘোটকী হইতেছি, তুমি অশ্বের ন্যায় সংসর্গ করো, হ্রেষাধ্বনিও করো, খুরধ্বনি করো, অশ্বশ্বাসের ঝড় তোলো আমার চতুর্দিকে ।

এই অভিজ্ঞতা ইতিপূর্বে হয় নাই বলিয়া, ঘর্মাক্ত কর্ম সমাধার শেষে কহিলাম, তুমি নেশার ঘুমঘোরে থাকিবে বলিয়া আগেই সতর্ক করিয়া দিতেছি ; দ্বিপ্রহরে তোমাকে মাদি টিকটিকিতে রূপান্তরিত করিব, এবং আমি টিকটিকি-পুরুষ হইয়া তোমার ঘাড়ে কামড় দিয়া সংসর্গ করিব ।

যে রূপে ইচ্ছা ক্রীড়া করিও, কিন্তু যখন যাইবে তখন এই ঘরের শিকল তুলিয়া দিও, নহিলে বানর ঢুকিবে । কথা কয়টি বলিয়া, চক্ষের উপর বাম বাহু তুলিয়া পনেরো-কুড়ি মিনিটে নেশাচ্ছন্ন ঘুমের জগতে ঢুকিয়া পড়িল ম্যাডেলিন । উহার তুলতুলে  ও সুমসৃণ বাহুতে মাথা রাখিয়া মনে হইতেছিল, সংক্ষিপ্ত হইলেও, এইটুকুই আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ সময় ।

উঠিয়া বসিলাম । উহার সর্বাঙ্গ দেখিতে-দেখিতে ভাবিতেছিলাম যে হয়ত সত্যই এই যুবতী স্ক্যান্ডিনেভীয় মধ্যযুগের নৌযোদ্ধাগণের বংশজ, যাহারা ফ্রান্সের নর্মাণ্ডি, রাশিয়ার নোভগোরড, আইসল্যান্ড, আয়ারল্যান্ড, গ্রিনল্যান্ড এবং ইংল্যান্ডে আক্রমণ চালাইয়া দখল করিয়াছিল । বিজিত নারীগর্ভে বীজবপনের ক্ষুধায় তাহারা পরস্পর অসিযুদ্ধ করিত । রাজা ক্যানিউট তাহাদেরই সন্তান । এই যুবতী আমার চাহিদা মিটাইতে হয়ত সেকারণেই একপা অগ্রে ।

কীই বা করিব এক্ষণে । ঘর গোছাইতে আরম্ভ করিলাম । শুঁকিয়াও বোঝার উপায় নাই কোন পোশাকটি এক বার পরা, কোনটি বহুবার । পোশাকের নিম্নাঙ্গ একপাশে এবং ঊর্ধ্বাঙ্গ আরেকপাশে সাজাইলাম ; তিনটি করিয়া স্তুপ গড়িয়া উঠিল । কোণটি পোশাকমুক্ত হইলে বিদেশি পাউডার, লোমনাশক ও ইলেকট্রিক উনোন চোখে পড়িল । উনোনে বসানো ডেকচির জলে ডিম ডুবিয়া আছে, সম্ভবত সিদ্ধ করিবার সময় বা ইচ্ছা হয় নাই । মেয়েটি ভোজনবিলাসীই কেবল নহে, অলসও প্রতিভাত হইতেছে ।

ম্যাডেলিনের তরঙ্গায়িত নেশাঘুমন্ত দেহে পাউডার মাখাইয়া দিলাম । নারীদেহকে এইরূপে সুগন্ধিত করিয়া আনন্দিত বোধ করিলাম । উহার হুঁশ নাই । গোপনাঙ্গে ও বাহুমূলে লোমনাশক প্রলেপ দিলাম, বাজার হইতে ফিরিয়া পরিষ্কার করিয়া দিব । খালি বিয়ার বোতলের পাহাড় ভাঙিয়া দেয়ালের পাশে সাজাইলাম ; ষাটটি বোতল । পোশাকের নিম্নাঙ্গও ছিল প্রায় ষাটটি । তোষক টানিবার সময় গর্ভনিরোধক ও অন্যান্য ওষধ পড়িয়া গিয়াছিল মেঝেয়, সেগুলি তুলিয়া রাকস্যাকের নিকট রাখিলাম ।  তোষকটির জায়গায়-জায়গায় খাপচা দাগ ; একটি চাদর পাতিয়া দিলে ঢাকা পড়িবে । কতজন হিপি-হিপিনি এই তোষকের উপর তাহাদের প্রেমকাহিনি তরল অক্ষরে লিখয়া গিয়াছে তাহা বানোয়ারি গুপ্তাও জানে না মনে হয় । একদা হিপিগণের ইতিহাস লিখিতে হইলে এই তোষকটির আত্মকথার প্রয়োজন হইবে ।

টিশার্ট-প্যান্ট পরিয়া, পিচবোর্ডের বিয়ারবাক্সে অভুক্ত জিনিসগুলি ও টয়লেটের জঞ্জাল পুরিয়া ঘরে শিকল ও তিনতলার সিঁড়ির দরজায় তালা দিয়া নামিতে-নামিতে দেখিলাম বেনারস আগমনের উদ্দেশ্য পূরণার্থে নানা প্রকারে ধুম্রজাল বোনার কাজে যুবক-যুবতীগণ মগ্ন । পথে নামিয়া দেখিলাম অদূরেই আঁস্তাকুড়, যাহাতে নিক্ষেপ করিলাম বাক্সটি ।

একটি রেস্তরায় ঢুকিয়া রুটি ও মাংস খাইলাম । তাহার পর দুটি থলে কিনিয়া তাহাতে বান, পাঁউরুটি, নুডলস, কলা, আপেল, কমলালেবু, গোলমরিচ গুঁড়া, নুন ও একডজন ডিম লইয়া, পুনরাংয় ভিতর হইতে সিঁড়িতে তালা দিয়া যখন ঘরে প্রবেশ করিলাম, দেখিলাম, একই আঙ্গিকে শুইয়া আছে ভাইকিং রমণী ।

৫. একটি ঘাসের

 

১৪

শিশির নিজেকে জাহির করেছে ঋষিদের বংশধর বলে । আর ওই ধুমসি মেয়েটা, ম্যাডেলিন, নিজেকে বলেছে ভাইকিং । ভাইকিং ব্যাপারটা ঠিক জানি না । কিং-টিং মানে তো রাজারানির ব্যাপার । ওই মোটা মাগি কি না রানি । গাঁজার ধোঁয়ায় মগজে কত যে খেলা তৈরি হয় ! আমি তাহলে অক্ষয়-অব্যয় অপ্সরা, মধুবালা আর মাধুরী দীক্ষিতের মতন সমুদ্র মন্হন থেকে উঠেছি , তপস্যা নষ্ট করতে এক্সপার্ট । ঋষিগুলোও তো মুখিয়ে থাকত যাতে কোনো ল্যাংটো অপ্সরা এসে উইঘুম ভাঙায় । কিন্তু উর্বশী, মেনকা, রম্ভা, কাঞ্চনমালা অপ্সরারা কি বুক নাচিয়ে জিয়ারা ধক-ধক করে কিংবা চোলিকে পিছে কেয়া হ্যায় নাচতে পারত । কক্ষনো না । আমি পারি , আজও, যখন পঞ্চাশ পেরিয়েছি, দিদিমা হয়ে গেছি । তখন তো কথাই ছিল না । বেনারসে তখনও নকল আই ল্যাশ আসেনি । তাতে কী । আমার গায়ের রঙ আহ্লাদী পুতুল ম্যাডেলিনের মতন নয় । তাতে কী । আমি এমন পোড়খাওয়া অপ্সরা যার মুঠোয় আছে শকুনির পাশা । মুকখু চাষা শিশির কিছুই আঁচ করতে পারেনি । ম্যাডেলিনের শেখানো এলকুমি-বেলকুমিই পুঁজি ।

১৫

উৎপাদন ব্যাপারটাহয়ে উঠেছে সতত পরিবর্তনরত । আন্তর্জাতিক শ্রমবিভাজনের কারণে, প্রাযুক্তিক দ্রুতির কারণে, শ্রমের তুলনায় পুঁজি থেকে সর্বাধিক লাভের কারণে, এবং অবশ্যই ভোগ্যবস্তুর বিশ্বায়নের কারণে । আন্তর্জাতিক পুঁজিবাদের আদলটাই প্রতিনিয়ত পরিবর্তিত হয়ে চলেছে  । বহুজাতিক সংস্হা ও তার মালিকদের স্বদেশ বলে কিছু থাকছে না । আবির্ভাব হয়েছে বিশ্বব্যাপী মাফিয়া-ভাতৃত্বের । বাজারের কতৃত্ব হয়ে চলেছে বিকেন্দ্রিত । অথচ বহুজাতিকগুলোর কর্মকাণ্ড কেবলমাত্র পুঁজি, মাল এবং উৎপাদনের আনাগোনায় সীমাবদ্ধ নয় । তারা বিশ্বের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সাম্প্রদায়িক, সাংস্কৃতিক নকশাগুলোর হেরফেরকারীও বটে । ব্যক্তিমালিকের পক্ষে আর ঊৎপাদনের বিশাল কারবার চালানো সম্ভব নয় বলে, সমাজ-সম্প্রদায়-রাষ্ট্রের হাতে উৎপাদনকে নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা সীমিত । নিয়ন্ত্রণ, নিয়ম, নীতি এক্ষেত্রে হয়ে দাঁড়ায় টলমলে । সেহেতু সংস্কৃতির সনাতন ভৌগলিক বাঁধন আলগা হয়ে যায় । সংস্কৃতি হয়ে যায় ভাসা-ভাসা । সংস্কৃতি হয়ে গেছে ধাবমান ও যাযাবর । ক্লাব, সমিতি, গোষ্ঠী, যারা সংস্কৃতির ধারক-বাহক বলে নিজেদের মনে করে, আসলে তারা উত্তরদার্শনিকতার প্রতিভূ।

উৎপাদনের আন্তঃরাষ্ট্রিকতা একযোগে হয়ে উঠেছে অভূতপূর্ব বিশ্ব একতার সুত্র, আবার পুঁজিবাদের ইতিহাসে অচিন্ত্যনীয় ভঙ্গুরতার উৎস । পুঁজিবাদের এখনকার জায়মান গল্পটি আর ইউরোপীয় ইতিহাসের প্রসারিত গল্প নয় । এই গল্পের আর কেন্দ্র থাকছে না । অর্থনৈতক ভঙ্গুরতার শক্তিবিকিরণের সঙ্গে তাল মিলিয়ে এসেছে সাংস্কৃতিক ভঙ্গুরতা বা বহুসাংস্কৃতিকতা । এর ফলে ঘটছে সাংস্কৃতিক দেশান্তরণ, সীমানাগুলোর ( ভাষা, দেশ, জাতি, ধর্ম, গোষ্ঠী, লিঙ্গ ইত্যাদি ) অপলকাভাব, পার্থক্য ও অসাম্যের তৃণমূল পর্যন্ত প্রসার, সমাজের ভেতরে-বাইরে ওই পরিবর্তনের সঙ্গে খাপ খাইয়ে সমরূপী হবার চাপ, স্হানিক ও বিশ্বের পরস্পরের মধ্যে অনুপ্রবেশ । এগুলো উত্তরদার্শনিকতার লক্ষণ ।

১৬

শিশিরে বন্ধুনি ম্যাডেলিন করিয়েট যে কে, তা এখন মনে পড়ে গেছে । বানোয়ারি গুপ্তার দুটো বাড়িতে কোনো ঘর খালি ছিল না বলে মেয়েটাকে সঙ্গে এনেছিল আমার মন্দির চত্ত্বের ঘর ফাঁকা আছে কিনা খোঁজ করতে । একটাও ঘর তখন খালি ছিল না । শীত-বসন্তে এমনিতেই হাউসফুল যায় ।

মেয়েটা তো দানবকন্যা, খাবলা মারলে গা থেকে বাড়তি মাংস উঠে আসবে, এমনতর । শিশির সামলালো কীভাবে ! তবে এ-ব্যাপারে সন্দেহ নেই যে পাকিয়ে বিপাকে ফেলার কায়দা-কসরত, বেহেড-বেতাল কুলুপতোড় হামলা-হামলি, বেধড়ক এলোপাথাড়ি ধামসাধামসি, ইচ্ছুক-ইচ্ছুকনির তারিয়ে-তারিয়ে খোলতাই মেলতাই ধরতাই, সবই ওশিখেছে ময়াডেলিন করিয়েটের কাছে । ওসব না শিখলে মানুষ কি আর নিজেকে অপরিশোধিত তেল ছাড়ার বিরামহীন কারখানা বানিয়ে ফেলতে পারে !

আমাকে তো হিপি ছেলেছোকরাগুলো কখনো আকর্ষণ করেনি । মরদ বলে মনেই হয়না । পুরুষ মানুষ বলতে বোঝায় হিন্দি ফিলিমের ধর্মেন্দ্র, যেমন অনুপমায় । বিদেশিদের মধ্যে আমায় বাছতে বললে আমি বেছে নেব শক্তসমর্থ নিগ্রো । বেনারসে নিগ্রো হিপি মেয়ে একাধটা এসে  পড়ে, আর দেখেছি একলাই ঘুরে বেড়ায় , কিংবা বুড়ো ধরণের খ্যাংরা সায়েব যোগাড় করে ফোঁকাফুঁকির টাইমপাস করে । নির্মলদের দলটার কাউকে দেখিনি ওদের সঙ্গে বন্ধুত্ব পাতাতে, ফাঁসানো তো দূরের কথা । চৌকাঠেই যখন ফর্সা মেম হত্যে দিচ্ছে তখন কেলোকুচ্ছিতকে কেনই বা পুছবে !

বাংলা উপন্যাসে পড়িচি বেনারসে বাঙালি পরিবার কলকাতা থেকে বা বাংলাদেশ থেকে এসেছে । সেসব শুধুই দুঃখি-দুঃখি গল্প । আমার মতনও যে গল্প হতে পারে লেখকরা বোধহয় ভাবতেই পারে না । লেখকগুলো কি হিপি-হিপিনি দেখেছে ? মিশেছে ওদের সাথে ? শুয়েছে ওদের সঙ্গে ? ফুঁকেছে গাঁজা চরস হ্যাশিশ ওদের সঙ্গে ? নাহ , মনে তো হয় না ।

১৭

সিস্টেমকে উপড়ে ফেলার জন্য বিপ্লব জরুরি । ত্ত্বকে আঁকড়ে ধরলে বিপ্লবের সমূহ ক্ষতি অবশ্যম্ভাবী , কেননা নিখাদ হঠকারীতা ছাড়া বিপ্লব সম্ভব নয় । বিপ্লবে প্রাথমিক বিপর্যয় অনিবার্য ।

১৮

পোশাক ত্যাগ করিয়া, মগে টয়লেট পেপার ভিজাইয়া ভাইকিং রমণীর গোপনাঙ্গ ও বাহুমূল পরিষ্কার করিলাম । অভূতপূর্ব চুনিখচিত স্বর্ণখন্ড, যদ্দর্শনে হৃৎপিণ্ড চলকাইয়া উঠিল । স্পর্শের রকমফেরে দরাজ হইয়া উঠিল দেহকানাচ । আত্মনিয়ন্ত্রণ করিব মনস্হ করিয়া অটুলস ফ্যাগের অবশিষ্টাংশ ধরাইয়া দুফুঁক মারিলে, ফল বিপরীত হইল ।

নেশাচ্ছন্ন ম্যাডেলিনের দেহ বেশ ভারি । তবুও, চুনিখচিত স্বর্ণখণ্ডের দিকে দেখিব না ভাবিয়া দুই হাতে উপুড় করিয়া দিলাম । নিস্তার পাইলাম না । মাংসের ঢেউ আমাকে নৌকা ভাসাইতে আহ্বান করিল । কোনও দূর প্রান্ত হইতে সর্বসন্মত শরীরে ম্যাডেলিন কহিল, টিকটিকিটি এখনও ঘাড় কামড়ায় নাই কেন ! আমি ঘাড় কামড়াইয়া টিকটিকি-পুরুষের ভূমিকা পালন করিলাম , এবং মাংসল বিছানায় ঘুমাইয়া পড়িলাম ।

ঘুম ভাঙিল অন্ধকারে ; সন্ধ্যা উত্তীর্ণ হইয়া গিয়া থাকিবে । আমার মাথা কোলে লইয়া বসিয়া আছে ভাইকিং নারী ; ভারতীয় ধরণের কোল নহে, দুই পা ছড়ানো কোল । আমাদের মতো পা মুড়িয়া কোল গঠন করিতে পারেনা ম্যাডেলিন, বোধহয় কোনও বিদেশিনী । চোখ মেলিতে, মাদকে শুস্ক মুচমুচে ঠোঁটের স্পর্শের সহিত উষ্ণ নিঃশ্বাস ফেলিয়া শুধাইল, বহুক্ষণ যাবৎ তোমায় দেখিতেছি , এবং আফশোষ করিতেছি যে , রবিবার স্বদেশে রওনা দিব, অথচ আমার আগমনের প্রথম দিনই তোমার সহিত সাক্ষাৎ হইল না কেন ! চার বৎসর হইল প্রতি শীতে আমি দেড়-দুই মাসের জন্য বিশ্বভ্রমণ করি । কত যুবকের সহিত দেহসম্পর্ক ঘটিয়াছে, কিন্তু তোমার ন্যায় কেহ এইরূপ সম্পর্ক গড়িতে চাহে নাই । সে-সকল পুরুষগণের যেন প্লেন ধরিবার তাড়া ; দ্রুত কর্ম সমাধা করিয়া, নিজেকে তৃপ্ত করিয়া, অন্তর্ধান করিয়াছে ।

আমি বলিলাম, কোলে শুইয়া প্রশংসা শুনিতে বেশ ভালো লাগিতেছে ; অন্ধকারও আলোকিত হইয়া উঠিয়াছে তোমার উপস্হতির জন্য ।

আমার মুখমণ্ডল সুন্দর নহে , আমার দেহকাঠামোও আদর্শ নহে । তুমি প্রেমে পড়িয়া গিয়াছ ; উহার কার্যকারণ প্রয়োজন হয় না । তোমার মুখ দেখিয়া তো বটেই, টয়লেটে গিয়া, ঘরগোছানো দেখিয়া, পাউডার ও লোমনাশক প্রয়োগ দেখিয়া এই নির্ণয়ে আসিয়াছি । ইতোপূর্বে অন্যান্য পুরুষ আমার অগোছালো অভ্যাসে বিরক্ত হইয়াছে , আমার দেহকে মনে করিয়াছে নোংরা । আমি চলিয়া গেলে, আমার অনুপস্হিতির ফাঁক ভরাট করিতে না পারিলে, আত্মযন্ত্রণার সংকটে পড়িবে তুমি । মৃদুকন্ঠে কথাগুলি বলিল ম্যাডি ।

আমি তাই আমার অস্তিত্বে তোমাকে শুষিয়া লইতে চাই , বলিলাম ।

ম্যাডি কহিল, আমি সতত প্রস্তুত, আরও কয়েকটি আঙ্গিকের সহিত তোমার পরিচয় করাইব । নির্ভর করিতেছে তোমার শরীর কতটা দিতে পারিবে । উঠিয়া পুংযন্ত্র ধৌত করিয়া লও । সময় নষ্ট করিয়া লাভ কী । প্রাতঃকালের পূর্বে দুইটি আঙ্গিক অনায়াসে সম্ভব হইবে ।

বলিলাম, সত্যই, বাৎসায়ন গ্রন্হ লিখিয়াছিলেন ভারতীয়গণের জন্য ; আমি ভারতীয় হইয়া পশুর ন্যায় একটিমাত্র আঙ্গিকে নিজেকে সীমাবদ্ধ রাখিয়াছিলাম । মানবমাংস যে মানুষের মস্তিষ্ক নির্দেশিত হইতে পারে, আহ্লাদের উৎসসূত্র খুলিয়া দিতে পারে, গতানুগতিকতা অতিক্রম করিয়া দৈবত্বে তুলিয়া লইয়া যাইতে পারে, তাহা তোমার কাছেই শিখিলাম । শিখিলাম যে মাংসই প্রেমকে ক্ষুদ্রতায় আবদ্ধ করে ; সে-ক্ষুদ্রতা হইতে নিষ্কৃতি পাইতে হইলে মাংসের উপর মস্তিষ্ক প্রয়োগ করিয়া তাহাকে নবাঞ্চলে লইয়া যাইতে  হইবে ।

রবিবার সকাল পর্যন্ত পালাক্রমে অগরু ও কান্তা এবং নব নব আঙ্গিকে দেহকে যতবার প্ররোচিত করা সম্ভব হইল, এমনকি চব্বিশ ঘন্টায় ছয়বার, উন্মাদনায় কাটিল । ইহার পূর্বে এমন স্বতঃস্ফূর্ত আত্মবিশ্বাস জাগ্রত হয় নাই, বুঝিতে পারি নাই যে বিশেষ নারীসঙ্গ নিজেকেও ভালোবাসিতে শিখায়, নিজের সীমাকে লঙ্ঘন করিতে শিখায়, মাংসকে ঔদার্য প্রদান করে ।

শুক্রবার দ্বিপ্রহরে গৃহহ কর্তা আসিয়াছিল, ভাড়া উসুল করিতে ও অটুলস ফ্যাগ বিক্রয় করিতে । প্রায় পঞ্চাশটি চারমিনার প্যাকেট দেখিলাম । প্রচুর টাকা কামাইতেছে অতুল । ভাগ্য ভালো যে টয়লেটে গিয়াছিল বলিয়া গৃহকর্তার সন্মুখে ম্যাডির উর্ধ্ব-নিম্ন ঢাকা ছিল ।

গৃহকর্তা বানোয়ারি গুপ্তা ম্যাডির প্রদত্ত অগ্রিম ভাড়ায় আমাকে মাসের শেষ পর্যন্ত থাকিবার অনুমতি দিয়া কহিল, আমি যেন নতুন কোনও বিদেশিনী ফাঁসাইয়া উহার ঘরটিতে আমদানি করি; স্টেশানে, মণিকর্ণিকায়, দশাশ্বমেধে একা নিঃসঙ্গ বিদেশিনীর দেখা মেলে । আমি ফাঁসাইয়া আনিলে উহার সুবিধা, নতুবা আবার ভাড়াটে খুঁজিতে হইবে ; যতদিন এই বিদেশী-বিদেশিনীগণ বেনারসে আসিতেছে, ততদিন কামাইয়া লইবার সুযোগ আছে । বানোয়ারি গুপ্তার মতে এই বিদেশী যুবক-যুবতীরা সারস ঝাঁকের ন্যায়, কখন কোন দেশে যে দল বাঁধিয়া উড়িয়া চলিয়া যাইবে তাহা কেহই নিশ্চিত বলিতে পারে না । হয়তো কিয়দ্দিন পরে উহারা সুটবুট পরিয়া  চুল কাটাইয়া স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়া আবার টুরিস্ট সাহেব-মেমে রূপান্তরিত হইয়া যাইবে এবং ধনীগণের হোটেলে গিয়া উঠিবে ।

গৃহকর্তার কথাগুলি ম্যাডির কানে তুলিলে সে খিলখিল করিয়া, নগ্ন বুক কাঁপাইয়া, এবং আমার রক্ত সঞ্চালন দ্রুত করিয়া বলিল, তোমার বন্ধু নির্মল, মোহিত, প্রণব এবং কতিপয় স্হানীয় লেখক-চিত্রশিল্পী এই উদ্দেশ্যে হিপি অধ্যুষিত বাড়িগুলিতে যাতায়াত করে । কেহ-কেহ স্বগৃহে লিভ টুগেদার করিয়াছে অথবা হিন্দুমতে বিবাহ করিয়া বিদেশে চলিয়া গিয়াছে । তোমরা যেমন শ্বেত ও পীতাভ চামড়ার প্রতি আকৃষ্ট হও, আমরাও বাদামি ও পীতা্ভ বর্ণের পুরুষে আকৃষ্ট হই । এই স্বাধীনতা বিজ্ঞানের অবদান । নূতন গর্ভনিরোধক নারীকে নূতন দিগন্ত খুলিয়া দিয়াছে ।

নির্মলের সংস্পর্শে কি করিয়া আসিলে ? আমার প্রস্নের জবাবে ম্যাডি বলিল, সে আমার মুখের উপর বলিয়াছিল, আমি যূন আকর্ষণের অনুপযুক্ত । সত্য কথা । স্বদেশি-বিদেশি বহু নিখুঁত নগ্নিকাকে বসাইয়া বা দাঁড় করাইয়া সে অনেকানেক ছবি আঁকিয়াছে । প্যারিসেই নাকি এক বৎসর ছিল, ফরাসি কোনও সংস্হার স্কলারশিপ পাইয়া গিয়াছিল । উহার নিকট আমার ত্বকের রং চিত্রশিল্পীর জন্য চ্যালেঞ্জ হিসাবে প্রতিভাত হইয়াছিল ।

শনিবার সন্ধ্যা পর্যন্ত বিভিন্ন আঙ্গিক এবং চরস, আফিম, মারিহুয়ানা, এল এস ডি ক্যাপসুল এবং অটুলস ফ্যাগের পরিচয় করাইয়াছে ম্যাডি । মাদকগুলি আমাকে মধ্যবিত্তের নীতিবোধের ভ্রান্তি হইতে মুক্তি দিতে সাহায্য করিয়াছে । ম্যাডিই প্রস্তাব দিয়াছিল, সজ্ঞানে তো বহুবার হইল ; মাদকের অপার্থিব জগতে প্রবেশ করিয়া অভিজ্ঞতা সংগ্রহ করা উচিত আমার । বালকসুলভ যৌনতার সীমা অতিক্রম করা সম্ভব হইবে তদ্বারা ।

সে কি আলো বিচ্ছুরণ ! নিঃশব্দ ফুলকির বৃষ্টিফোঁটা রূপান্তরিত হইয়াছে নানা প্রকার ফুলে । ম্যাডিকে কখনও মনে হইয়াছে পালক, কখনও মাখন, কখনও অশরীরী অট্টালিকা, যাহার ভিতর প্রবেশ করিয়া পথ হারাইয়া সাঁতার কাটিতেছি ।

জিন্সের উপর সুতির রক্তবর্ণ টপ পরিয়া, পিঠে নীল রাকস্যাক বাঁধিয়া, ঘরে পরিত্যক্ত বস্তুগুলির দিকে তাকাইয়াও দেখিল না ম্যাডেলিন । জন্মনিয়ন্ত্রণের ট্যাবলেট, বন্ধ বিয়ার বোতল, বিভিন্ন মাদক, টেবিল ফ্যান, বৈদ্যুতিক উনোন, আমার গোছানো উহার নিজস্ব পোশাক, সবই পড়িয়া রহিল । লইয়াছে কেবল রেশমের চাদরটি ।

রবিবার প্রাতঃকালে আমরা গতানুগতিক মিশনারি আঙ্গিক অবলম্বনের পর আমি জোরাজুরি করিয়া ম্যাডিকে সাবান ও শ্যাম্পু মাখাইয়া স্নান করাইলাম ।  কত ময়লা যে চুলে ও ত্বকে জমিয়াছিল । ত্বকের ঔজ্জ্বল্যে চোখ ধাঁধাইয়া গেল । স্নানের পর একত্রে বাহির হইয়া পথে-পথে হাত-ধরাধরি করিয়া কিছুক্ষণ হাঁটিলাম । ম্যাডি নিশ্চুপ । আমি বলিলাম, চুপ করিয়া আছ কেন, আমার হাহাকার কি তোমাতে সঞ্চারিত হইয়াছে ?

আমার দিকে তাকাইল না ম্যাডি । স্বগতোক্তির ঢঙে বলিল, তোমার স্মৃতি আমার অঙ্গ হহিতে ধুইয়া দিয়া উপকার করিয়াছ । তৎসত্বেও এই সংক্ষিপ্ত সঙ্গদানের ভার আমাকে আজীবন বহিতে হইবে ।

স্টেশানে, দিল্লি অভিমুখী ট্রেনে চাপিয়া, আমি যখন শেষ বিদায় জানাইয়া নামিতে উদ্যত, একঝটকায় আমাকে লইয়া টয়লেটে প্রবেশ করিয়া, জড়াইয়া, কাঁদিতে লাগিল দীর্ঘাঙ্গী ভাইকিং রমণী । আমি দাঁত দিয়া উহার ঘাড়ে একটি রক্তাক্ত স্মৃতিচিহ্ণ আঁকিয়া দিলাম, তবু উঃ করিল না । কেন যে আমি অমন আচরণ করিলাম তাহা নিজের কাছেও অস্পষ্ট । বোধহয় এই প্রথম টের পাইলাম যে ম্যাডেলিন আমার চেয়ে উচ্চতায় বড় ।

চলিয়া গেল ম্যাডেলিন । ট্রেনের দরজায় দাঁড়াইয়া হাতও নাড়িল না । স্টেশান হইতে বাহির হইয়া, পথে নামিয়া, হাঁটিতে লাগিলাম । একটি নেড়ি পিছন-পিছন চলিতে আরম্ভ করিয়াছিল, হয়তো কিছু খাইবার আশায় ; কিয়ৎক্ষণ যাইবার পর মনোভঙ্গ হইতে আরেকজনের পিছু লইল । ভাবিলাম, ঘরে ফিরিয়া, মাসের শেষ পর্যন্ত অন্তত উহার অজস্র পোশাকের গন্ধের রঙের নকশার সহিত সময় কাটাইয়া দিব ।

ঘরে ফিরিয়া আরও ভারাক্রান্ত বোধ করিতে লাগিলাম । বিয়ার খাইলাম । পোশাকগুলি ঘাঁটিলাম । তবু মুহ্যমান রহিলাম । বড়ই বোকা-বোকা লাগিল নিজেকে । শুইয়া, মন যখন ইতি-উতি, হঠাৎ মনস্হির করিলাম ম্যাডেলিনকে আমার অস্তিত্বে  জীবন্ত রাখিবার জন্য কাশীর স্মৃতি লিখিব , তাহাই লিপিবদ্ধ করিয়া সময় অতিবাহিত করি ।

নির্মলের গেস্টরুম হইতে উহার পিতার যে জার্নালবহি বা ডায়েরিখানি হাতসাফাই করিয়াছিলাম, তাহা সুটকেস হইতে লইয়া এই রচনাটি লিখিতে বসিলাম । এই জার্নালবহির পৃষ্ঠায় আত্মস্খালন করিব, ঘটনাশৃঙ্খলা বর্ণনার দ্বারা নিজের  মুখোমুখি হইব, নিজেকে বুঝিবার প্রয়াস করিব । অতুলের পোস্টকার্ড প্রাপ্তি হইতে শুরু করিয়াছি । পৃষ্ঠা উলটাইয়া দেখিয়াছি, ইহা নির্মলের প্রয়াত পিতার । কোনও কোনও পৃষ্ঠায় তিনি নিজস্ব জ্ঞানবাক্য লিপিবদ্ধ করিয়াছেন, পাতা ছাড়িয়া-ছাড়িয়া কেন লিখিয়াছেন তাহা অজ্ঞাত । বেনারস হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয়ে দর্শনের  অধ্যাপনা করিতেন ।

এক নাগাড়ে লিখিয়া ক্লান্ত হইলে, পথে নামিয়া যত্রতত্র ঘোরাঘুরি করি । চাঙ্গা বোধ করিলে পুনরায় লিখি । তিন দিনে এতটা লিখিয়াছি । এখানেই শেষ করিয়া দিব । খাতাটিই বা কাহাকে দিব ? কেহ যদি পায়, ভাবিবে যে ইহা নির্মলের পিতার জীবনের সহিত জড়িত । কোনও হিপিনি শিকারের চেষ্টা করি নাই । করিলে হয়তো একজন প্রৌঢ়া হিপিনিকে শিকার করা যাইত ; সে যেভাবে আমাকে দেখিতেছিল, মনে হইল যে কোনো খুঁটি খুঁজিতেছে । আকৃষ্ট হইতে পারিলাম না ।

লেখা শেষ করিতে পারিলাম না । অদ্ভুত এক অবিস্মরণীয় ঘটনা ঘটীয়া গেল । ঘটনাটি ঘটিলে, মনে হইল, এইপ্রকার উপশমমূলক নাটকের জন্য আমি একটি সুপ্ত মঞ্চ পাতিয়া আড়ালে উদগ্রীব অপেক্ষা করিতেছিলাম ।

বিছানায় শুইয়া চিন্তা করিতেছি যে ফিরিয়া যাইব বটে, কিন্তু স্বগৃহে এই ডায়েরিটি লইয়া যাওয়া বিপজ্জনক । একমাত্র উল্লাসই ছন্নছাড়া নহে , যাহার নিকট নিশ্চিন্ত হইয়া এই খাতাটি গচ্ছিত রাখা যায় । কিন্তু নকশাল আন্দোলনকারী ভাইদের লইয়া সে হয়ত এমন বিপর্যস্ত যে তাহাকে বলা এই মুহূর্তে দায়িত্বজ্ঞানহীন ঠেকিবে ।

প্রাতঃকালের নয়টা-দশটা হইবে । লাল তাঁতের শাড়ি-ব্লাউজ পরিহিত, সম্পূর্ণ সিক্ত, চুল হইতেও জল ঝরিতেছে, এক ভারতীয় রমণী ঘরে প্রবেশ করিয়াই খিল তুলিয়া দিল । গঙ্গায় ডুব দিয়া ভিজিয়া গিয়াছি , শুকাইতে হইবে, বলিয়া এক-এক করিয়া সবকিছু পরিত্যাগ করিল, এবং আমার তোয়ালে লইয়া গা-মাথা পুঁছিতে লাগিল ।

এতই বিস্ময়াহত হইলাম যে, উঠিয়া, স্হিতি বোধগম্য হইতে সময় লাগিল । আত্মস্হ হইলে কন্ঠ ্‌ইতে নির্গত হইল, কেকা বোউদি, করিতেছেন কী, করিতেছেন কী ! বহিলা বলিল, বউদি শব্দটি বাদ দাও , এবং এগুলি ছাদে শুকাইয়া দিয়া আইস , তারপর বলিতেছি ।

শুকাইতে দিয়া ঘরে ফিরিয়া দেখিলাম , অতুলের স্ত্রী বিছানায় শুইয়া সিগারেট ফুঁকিতেছে । নারীর বহু পোশাক ঘরে মজুত । অথচ সে নগ্ন, কোনো লজ্জা-সংকোচ নাই । বুঝিতে পারিলাম আমার কন্ঠ শুকাইয়া গিয়াছে , মুখ দিয়া কথা ফুটিতে সময় লাগিবে ।

গত দুই দিন তোমাকে অনুসরণ করিয়া তোমার আস্তানা সম্পর্কে নিশ্চিত হইয়াছি ; নিজের সহিত ষড়যন্ত্র করিয়াছি কী করিলে তুমি তৎক্ষণাৎ ঘর হইতে তাড়াইতে পারিবে না , নগ্ন হইয়া তোমাকে আকৃষ্ট করিব । এই দেহ দেখিতেছ , বারো-তেরো বৎসর পূর্বে অতুল নামে এক অনভিজ্ঞ তরুণ সাত-আট দিন ভোগ করিয়াছে । অতুল আমাকে মন্দির বাড়িতে আনার পূর্বে এক অবাঙালি তরুণীর সহিত প্রেম করিয়াছে, প্রেম মানে ওই শোয়াশুয়ির সুযোগ লইয়াছে, যাহার-তাহার সহিত শয়ন করিয়াছে । এখন জুটিয়াছে বিদেশিনীগণ । আমাকে সে কেন কাম্য মনে করে নাই তাহা আমার জ্ঞানাতীত । সে আমাকে স্পর্শ করিতে ভয় পায় । জানি, তুমি ভাবিতেছ তোমার জন্যই কেন টোপটি ফেলিলাম , এবং এতকাল কাহাকেও গাঁথিয়া তুলি নাই কেন ? আমার এই ধ্যাবড়া সিঁদুর, টিপ, শাঁখা-পলা দেখিতেছ ? এই ভাবমূর্তি বিক্রয় করিয়া মন্দিরগৃহের শিবঠাকুরকে জীবনদান করিয়াছি । মাদকের ব্যবসায়ের পূর্বে মন্দিরের আয় হইতে ব্যয় নির্বাহ হইত । অদ্য আমার কাঁচা টাকা প্রচুর । অতুলকে মুম্বাই পাঠাইয়াছি জোড়া-ফ্ল্যাট অনুসন্ধান করিতে, কুহুর ও আমার নামে কিনিব । স্হানীয় কোনো যুবককে গাঁথিয়া ধরা পড়িয়া গেলে আমার ভাবমূর্তি বিধ্বস্ত হইত । এখনই সুবর্ণ সুযোগ, অতুল অন্তত পক্ষকাল আসিবে না । চিত্রকর-সাহিত্যিক-সাংবাদিকগণের গোঢ়্ঠীটি বেনারস ত্যাগ করিয়া পাটনা দিল্লি ভুপাল পলাইয়াছে , কেন না নকশাল নামে বদনাম দিয়া স্হানীয় পুলিশ কয়েকজনের উপর অত্যাচার করিয়া কলিকাতা পুলিশের হাতে তুলিয়া দিতেছে , এবং কয়েকদিনের অন্তরালে মিলিতেছে তাহাদের ছিন্নভিন্ন শব । অতুলের জারজ সন্তান কংকে পোষ্যরূপে গ্রহণ করিয়া আমার বাঁধ ভাঙিয়া গিয়াছে । তুমি মাত্র কিছু দিনের জন্য এই তীর্থক্ষেত্রে অবতীর্ণ হইয়াছ, অচিরে মিলাইয়া যাইবে । তোমার প্রতি দুই দিন লক্ষ্য রাখিয়া বুঝিয়াছি কোনও নারী জুটাইতে সক্ষম হও নাই, বা হয়তো  জুটাইয়াছিলে, এখন ফসকাইয়া গিয়াছে ; ওই বিপুল পোশাক-আশাক হয়ত এক বা একাধিক নারীর । সে যাহাই হউক, এখন তুমি টোপ গিলিবার উপযুক্ত । সিক্ত শাড়ি-ব্লাউজের জন্য চিন্তা করিও না । ষড়যন্ত্রের অঙ্গরূপে একসেট শাড়ি-ব্লাউজ আমার থলেতে ভরিয়া আনিয়াছি । কব্জিতে হাতঘড়ি দেখিতেছ ? উহা থলেতে ছিল । তুমি আর কতদিন আছ ?

কেকার কথা শুনিতে-শুনিতে মনে হইতেছিল, বহুকাল যাবৎ তাহা পূঞ্জীভূত ছিল, এবং ছিল শ্রোতার অপেক্ষায় । বা এমনও হইতে পারে যে যৌনসংসর্গের আকাঙ্খায় গল্প ফাঁদিতেছে । আমার নিকট তাহার দ্বারা উপস্হাপিত বক্তব্যের সত্য-মিথ্যার কোনো গুরুত্ব নাই । এই নারীদেহেটির রহস্য উদ্ঘাটনই  সত্য । কাঙ্খিত । বলিলাম, মাসের শেষ পর্যন্ত থাকিব । বলিয়া প্রশ্ন করিলাম, আপনার হাতে এক্ষণে কত সময় আছে ?

ওঃ! ওয়ান্ডারফুল , উঠিয়া বসিয়া কেকা আহ্লাদ ব্যক্ত করিল, এবং যোগ করিল, আপনি-আজ্ঞে করিও না ;  নগ্নতার ঘনিষ্ঠতায় উহা বেমানান । কুহুর স্কুল তিন ঘটিকা পর্যন্ত ; কংকে মা-ই ভালো সামলাইতে পারে । প্রতিদিন দুই ঘটিকা পর্যন্ত থাকিব । কুহুর যেদিন ছুটি থাকিবে, আড়াই ঘটিকা হহিতে সাড়ে ছয় ঘটিকা পর্যন্ত থাকিব । আমি হিন্দি ফিলিমের ম্যাটিনি শো দেখিতে ভালোবাসি , সবাই জানে । মাসের শেষ পর্যন্ত না হয় নায়িকার ভূমিকা আমিই পালন করি । তুমি নায়কের ভূমিকা পালন করিবে , খলনায়ক হহিতে পারিলে আরও ভালো, তাহারা অমিতবিক্রমে রেপ করিতে পারে । মন্দিরে যাহারা পূজা দিতে আসে তাহারা অনেকেই বলে আমাকে দেখিতে অনেকটা ওয়াহিদা রহমানের ন্যায় । তুমি গাইড ফিলিম দেখিয়াছ ? প্রশ্নের জবাবের অপেক্ষা না করিয়া , হাত দোলাইয়া নগ্ন নারী গাহিয়া উঠিল, আজ ফির জিনে কি তমন্না হ্যায়, আজ ফির মরনে কা ইরাদা হ্যায়…।

আমার দেহরসায়নে সাজো-সাজো রব পড়িয়া গিয়াছিল । আলিঙ্গনের ফাঁকা পরিসর ভরাট করিতে বারো বৎসর যাবৎ হাহাকারপূর্ণ আরেক আলিঙ্গন নিজেই ধরা দিতে আসিয়াছে । ম্যাডেলিনের অনুপস্হিতির ধ্বনি প্রতিধ্বনি হইয়া ফিরিয়া আসিয়াছে কেকার উদোম উপস্হিতিতে ।

সিঁড়ির দরজায় তালা দিয়া ছাদ হইতে শাড়ি শায়া অন্তর্বাস আনিয়া ঘরে রাখিলাম ; হিপি অধ্যুষিত গৃহের ছাদে শাড়ি-শায়া সন্দেহের উদ্রেক করিতে পারে কোনো প্রতিবেশির । ঘরের কপাট ভিতর হইতে বন্ধ করিয়া পোশাকমুক্ত হইলাম এবং সিক্ত শীতল নারীদেহে অগরু ও কান্তা শিশির তলানি ছিটাইয়া সুগন্ধিত করিলাম ।

আমার তপ্ত দেহ জড়াইয়া, চক্ষু মুদিয়া ফোরপ্লে উপভোগ করা কালে অবরুদ্ধ কন্ঠে কেকা কহিল, আমারই দেহে আহ্লাদের যে এতগুলি কেন্দ্র আছে , তাহা নিজেই জানিতাম না ; কাশী  বিশ্বনাথকে শতকোটি প্রণাম যে তিনি তোমাকে আমার নিকট সঁপিয়াছেন । ফোরপ্লের মাধ্যমেই কেকাকে চরমে লইয়া গেলাম । সে কহিল , এইরূপে দেহ যে আনন্দময় হয় তাহা অজ্ঞাত থাকিয়া যাইত যদি তোমাকে না জোটাইতাম ; জীবনকে তোল্লাই দিবার কোনো প্রয়োজন নাই , যেমন-যেমন পাও তেমন তেমন নিতে থাকো ।

প্রথম দিন বলিয়া আমরা গতানুগতিক মিশনারি আঙ্গিক অবলম্বন করিলাম । কেকাকে ক্রমশ উন্মোচন করিয়া লইব ; পরিচয় করাইব অনেকানেক আঙ্গিকের সহিত । অপরিচিত আঙ্গিকে ভয় পাইতে পারে, শরীরে দাগ তুলিলে বাড়ি প্রশ্নের মুখে পড়িবে ।

যাহা ফুঁকিতেছিল তাহা কি অটুলস ফ্যাগ ? প্রশ্ন করিতে কেকা উত্তর দিল, অটুলস ফ্যাগের সহিত পরিচয় ঘটিয়া গিয়াছে দেখিতেছি ; না, ইহা কেকাস ফ্যাগ, পানামা নামক একটি সিগারেট, মন বিক্ষিপ্ত হইলে দু-একটি পান করি । অটুলস ফ্যাগ বড়ই তীব্র এবং তাহা মাদক সেবনেচ্ছুগণের জন্য । তোমার গন্ধ লাগিতেছে ? কল্য হইতে কর্পূর জলে কুলকুচি করিয়া আসিব ।

আমি বলিলাম,  প্রয়োজন নাই ; নারীর মুখগহ্বর হইতে সিগারেটের গন্ধও ভিন্ন জগতে তুলিয়া লয়, সোহাগ তো কেবল মাংসের সহিত মাংসের নহে, তাহা গন্ধের স্বাদের স্পর্শের শ্রবণের চাহিয়া দেখিবারও । কেকা প্রত্যুত্তর করিল না । শুনিয়া মোহিত হইয়া গেল ; বলিল, আহা, আহা, প্রাণ জুড়াইবার মত এমন কথা কেহ তো কহে নাই। অনেক কিছুই জানো , আমি এতদ্বিষয়ে সম্পূর্ণ আকাট ।

নামিয়া, বিয়ার বোতল খুলিয়া কেকাকে দিলে ঢকঢক করিয়া পান করিল, থামিল, গিলিল, থামিল, গিলিল, খালি করিয়া বলিল, সাঁইত্রিশ বৎসরের জীবনে এই প্রথম বিয়ার পান করিলাম । কখনও মদ্য পান করি নাই । দশ ঘটিকায় পান করিলে দুই ঘটিকায় নেশা কাটিয়া যায়, এমন মদ্য কল্য আনিও, কেমন ? মদ মাংস মাগি মরদের ঘূর্ণিতে দুইজনে তলাইয়া যাইব এই কয়দিন । অধঃপতিত হইতে কেমন স্বর্গীয় অনুভূতি ঘটে তা অনুভব করিতে চাই ।

এক-দু পেগ পান করিলে প্রভাব থাকিবে না ; রাম হুইস্কি ব্র্যান্ডি জিন ভোদকা প্রতিটির কোয়ার্টার এবং সোডা লইয়া আসিব ; প্রতিদিন এক-এক প্রকারের নেশা করিও , তুমি বড়া কাবাব চানাচুর ডিম ইত্যাদি জাতীয় টাকনা আনিও । বাৎসায়নের নাম শুনিয়াছ তো ? তোমাকে সেই মিলনানন্দগুলির সহিত পরিচয় করাইব, যদিও সময় বড় কম, তবু যতগুলি সম্ভব হয় । কথাগুলি বলিয়া নিজের ইচ্ছাটি স্পষ্ট হইল । মাতাল আলিঙ্গনে মাতাল বাঙালি নারীদেহের অভিজ্ঞতা সঞ্চয়ের লিপ্সা ।

কেকা বলিল, আমার শরীরে এখনও যথেষ্ট সহনশক্তি আছে ;  তিরিশ পার করা কোনো বয়স নহে, অনেক খাটুনি খাটিতে পারি । সবই টাইট আছে এখনও, কোনো অঙ্গ ঢিলা হয় নাই । বলিয়া, দাঁড়াইয়া নিজেকে প্রদর্শন করিল ।

দেড়টা নাগাদ কেকাকে বলিলাম, তোষকটি মাটিতে নামাইতে সাহায্য করিতে । কারণ জানিতে চাহিলে ঘোটক-ঘোটকীর আঙ্গিক ব্যাখ্যা করিতে তৎক্ষণাৎ প্রস্তুত হইল । কর্ম সমাপনান্তে কহিল, কৈশোরে ব্লিস শব্দটি শুনিয়াছিলাম । অদ্য তাহার অর্থ বোধগম্য হইল । ঈশ্বর কেন বিভিন্ন প্রকারের প্রাণীর জন্ম দিয়াছেন তাহার যে ভিন্ন একটি রহস্য আছে , জানিলাম তোমার নিকট হইতে । আমার সতীত্ব যৎসামান্য সার্থক হইল ।

যাইবার সময়ে ম্যাডেলিনের উর্ধ্বাঙ্গের অনেকগুলি পোশাক নিজের ও আমার থলেতে ঠুসিয়া বলিল, এইগুলি যাইবার পথে ভিখারিদের বিলাইব । নিজের সিক্ত পোশাক লইল না ।

আমি বলিলাম, কল্য থলেগুলি আনিয়া নিম্নাঙ্গের পোশাকগুলিও বিতরণ করিয়া দিও । তোমার তো জন্মনিরোধক প্রয়োজন ? ওই যে, খাইবার ও প্রবিষ্ট করিবার দুই-ই আছে ।

চক্ষু বিস্ফারিত করিয়া আমার দিকে সরাসরি তাকাইল কেকা । পাতলা ঠোঁটের এককোণে ক্রুর হাসি মাখাইয়া কহিল, ওই ব্যাপারে চিন্তা করিও না ; আমি জানি কী করিতে হয় । পোশাকের বিষয়েও চিন্তা করিও না ; জানি না কোন মাগির ঢ্যাপলা পোশাক একত্রিত করিয়া ঘরটিকে নরক করিয়া রাখিয়াছ , যাহা তোমার নহে সবই এই ঘর হইতে লইয়া গিয়া বিলি করিয়া দিব । এঘরে এখন শুধু আমি আর তুমি ; ইচ্ছুক আর ইচ্ছুনি ।

কেকা চলিয়া গেলে স্নানাদি সারিয়া রেস্তরাঁয় ভাত-মাছ আহার করিলাম। হিন্দুস্হানি মশলা দেয়া রগরগে মাছ । পুনরায় একটি থলে কিনিয়া লোকমুখে মদ্যবিপণির পথনির্দেশ জানিয়া— তীর্থস্হান বলিয়া মদ্যবিপণীর প্রশ্নে যে লোকে ভ্রূভঙ্গী করিবে তাহা মনে হইল না— সকল প্রকার মদ্যের কোয়ার্টার, কয়েক বোতল সোডা ও লেমনেড, দুইটি গ্লাস ও বিভিন্ন চানাচুর তাহাতে ভরিয়া যখন ফিরিলাম, বেশ ঘুম পাইতেছিল । ম্যাডেলিনের পরিত্যক্ত একটি অটুলস ফ্যাগ সম্পূর্ণ ফুঁকিয়া সম্ভবত জ্ঞান হারাইলাম । মধ্যরাত্রে ঘুম ভাঙিলে বা জ্ঞান ফিরিলে, ম্যাডেলিনের মাংসল ঔজ্জ্ব্ল্যের অনুপস্হিতির হাহাকারে আক্রান্ত হইয়া পুনরায় ঘুমাইয়া পড়িলাম । স্বপ্নে অথবা নেশার প্রভাবে দেখিলাম সে নগ্ন হইয়া পরিরূপে মোগল সম্রাটের প্রাসাদে উড়িতেছে, দেয়ালগাত্রের কুচি-কুচি আয়নায় তাহার দেহবল্লরী প্রতিফলিত হইতেছে , মিহি-মিহি সুরে সানাই বাজিতেছে ।

দরজায় কড়া নাড়ানাড়ির শব্দে ঘুম ভাঙিতে কপাট খুলিয়া দেখি কেকা । আমাকে সরাইয়া ঘরে দ্রুত প্রবেশ করিল ও হাতের দুইটি থলে হইতে নানাবিধ বস্তু মেঝেয় রাখিয়া মাটিতে পাতা তোষকে বসিয়া কহিল, ব্রেকফাস্টের জন্য টোস্ট কলা ও ডিম সিদ্ধ আছে , এই হরলিক্সের শিশিতে বাদাম-পেষা দুধ, এবং দ্বিপ্রহরের জন্য পরোটা, আলুর দম ও কাবাব । তোমার দুর্বল হইলে চলিবে না ; শরীরকে বলশালী রাখিতে হইবে । তোমার কথা চিন্তা করিতে-করিতে আমার ভালো ঘুম হয় নাই ।

বলিতে-বলিতে তোষকে শুইয়া পড়িল আদুড়চুলি কেকা । স্পষ্ট যে রাতের সাধারণ শাড়ি বদলাইবার সময় পায় নাই । কহিল, সকালে সিগারেট খাই নাই, দাঁত মাজিয়া কর্পূরজলে কুলকুচি সারিয়া আসিয়াছি । আমি জানি, তোমারা নিমেষে নিজেকে অতিদাহ্য করিয়া কাজ সারিতে পারো । নাও, তাড়াতাড়ি করো । আমাকে চরমে না লইয়া গেলেও এখন চলিবে ।

নিমেষে অতিদাহ্য হওয়া স্বাভাবিক ছিল । কী করিতে হইবে নির্দেশ দিয়া টিকটিকি আঙ্গিক অবলম্বন করিয়া, তপ্ত নারীদেহ ও সংসর্গের মসৃণতায় বুঝিলাম, আসিবার সময় সত্যই আমার কথা চিন্তা করিয়া শরীরকে আগেভাগে প্রস্তুত করিয়া আনিয়াছে । বলিলাম, দাঁড়াও উঠিও না, লোমনাশক লাগাইয়া দিতেছি, স্নানের সময় ধুইয়া লইও ।লোমনাশক লাগাইয়া দিবার পর কেকা পুনরায় ইশারাপূর্ণ হাসিটি হাসিল ।

১৯

সমাজচিন্তার বহু এলাকায় ইতিহাসকে পুরুষের একচেটিয়া বলে মেনে নেয়া হয়েছিল, এবং নারীকে আবদ্ধ করা হয়েছিল অপরিবর্তনীয় গার্হস্হ জীবনে । যে-কোনো প্রসঙ্গই হোক না কেন, লিঙ্গবৈষম্যকে ওড়ানো হয়েছে তুড়ি মেরে । ইদানিংকালের কয়েকজন ভাবুক তাঁদের আলোচনায় লিঙ্গবৈষম্যকে বিশ্লেষণ করেছেন, কেবলমাত্র সন্দর্ভকে ব্যাপক করার উদ্দেশ্যে নয় । বহু নতুন প্রশ্ন তুলে, সমস্যাগুলো সর্বসমক্ষে তুলে ধরে, পূর্বানুমানকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে, চালু জ্ঞানকে সন্দেহ করে, বিষয়টিকে করে তুলেছেন বৈপ্লবিক । রমাবাঈ রাণাডে এবং লক্ষ্মীবাঈ তিলক তাঁদের রচনায় জানিয়ে গেছেন যে, তাঁদের স্বামী জনজীবনে ছিলেন আধুনিক, অথচ বাড়ির ভেতর ব্যক্তিগত সংসারে ছিলেন সনাতনপন্থী ও রক্ষণশীল ।

তবে কি তর্কটি রাজনৈতিক ? আমি বলব , হ্যাঁ । কেননা এই ধরণের আলোচনায় নিপীড়ন, দমন, নিগ্রহ ও অসাম্যের প্রত্যক্ষ-অপ্রত্যক্ষ উৎসকে শনাক্ত করার চেষ্টা রয়েছে । ভারতবর্ষে এমন কোনও সমাজ, সম্প্রদায়, বর্ণ, ভাষাভাষী নেই যেখানে নারী পুরুষের অধীন নয় , মানবিক গোলামক নয় । এই সূত্রে পিতৃতান্ত্রিক কাঠামোটি সম্পর্কে গবেষণা ও বর্তমান ব্যবস্হার প্রতিকার জরুরি হয়ে উঠেছে ।

২০

প্রথম দিনের ব্যাপারটা লিখতে গিয়ে শিশির কিছুটা বাদ দিয়ে ফেলেছে , বোধহয় উত্তেজনার বশে কিংবা নেশার ঘোরে লিখেছে বলে । আমার মনে হয়, ও হুহু করে লিখে গেছে, তারপর আর পড়ে দেখেনি । তার ওপর মাস্টারি-মার্কা বাংলা ।

ও যখন ঘরে ঢুকে খাটের পাশে এসে দাঁড়ালো, মুখচোখ দেখে বুঝলুম ভীষণ অপ্রস্তুত, কী করবে কী বলবে ভেবে পাচ্ছে না । একেবারে অস্হিরপঞ্চক । ওকে স্বাভাবিক করে তুলতে আমি সিগারেটের ধোঁয়ায় পর-পর দুটো রিং ওর দিকে উড়িয়ে বললুম, এই নাও বরমাল্য, তোমায় স্বয়ম্বর-সভায় বরণ করে নিচ্ছি ।

শিশির কিছুটা স্বাভাবিক হল , কিন্তু জিগ্যেস করে বসল, তুমি আর গান গাও না ? এরকম গাড়লপুরুষ যে হতে পারে জানতুম না । সামনে শুয়ে রয়েছে এক নগ্ন মহিলা , সেদিকে নজর দেবে, প্রশংসা করবে, তা নয়, গান !  তবে বুঝে নিতে অসুবিধা হল না যে বঙড়শিতে মাছ আটকে পড়েছে, এখন যদি আমি মুখ থেকে বঁড়শি খুলে নিই তবেই ছাড়া পাবে, নয়তো আটকে নিয়ে খেলাবো, খেলাতে থাকবো । পুরুষরা ভাবে যে তারাই বুঝি ছিপ ফেলে গিঁথে তুলতে পারে ।

প্রসন্নর বাড়িতে, তখনও কুহু হয়নি, বোরডাম কাটাবার জন্যে দুপুরে বা সন্ধ্যায় হারমোনিয়াম বাজিয়ে গান গাইতুম , রবীন্দ্রসঙ্গীত আর অতুলপ্রসাদ । সেই সূত্রেই ওর প্রশ্ন, যে প্রশ্নের মধ্যে শিশির আমাকে কচি যুবতী হিসেবে দেখতে পাচ্ছিল, হয়তো আমার নগ্ন দেহ থেকে গান ভেসে যাচ্ছিল ওর মাথাটাকে ঘিরে । গান সাধা কবেই চুকে-বুকে গেছে । বেনারসে আসার পর ইন্দি ফিলিম দেখতে-দেখতে গান বলতেই মাথায় আসে লতা মঙ্গেশকর-আশা ভোঁসলে ।

হিন্দি ফিলিমের গানে শিশির কতটা সড়গড় জানা না থাকায়, আমি উঠে বসে আরম্ভ করেছিলুম, আগুনের পরশমণি ছোঁয়াও প্রাণে…। শিশির আঁৎকে উঠল, না না না না না, এইভাবে কোনও জামাকাপড় না পরে, সিগারেট হাতে, ওই গান, বাপরে, গেও না, গেও না ।

না গাইবার কি কারণ জানি না , ঘরে তো কেবল আমরা দুজন, আমি তো ওকে বলছিলুম আগুনের পরশমণিটা দিয়ে আমায় ছুঁতে, তাও বুঝতে পারেনি কেন ক্যাবলাটা ! তাছাড়া আমার গলায় সাতভরি সোনার হার, হাতে শাঁখা-পলা, সোনার বালা, আর পায়ে রুপোর মল ছিল ।  মন্দিরগুলোয় তো এরকমই মূর্তি থাকে সেকালের মেয়েদের । তবে, আমি যা চাইছিলুম, ওকে টেনশানমুক্ত করতে, তাতে পুরোপুরি সফল । বাংলা গানও আর ওকে শোনাতে হয়নি ; আমরা দুজনেই তো হয়ে উঠেছিলুম বাজনার অর্কেস্ট্রা , ওই বাজনায় কেমন আস্তে সুরু হয়ে একেবারে ওপরে উঠে যায় । হিন্দি ফিলিমের গান আমার মগজে এমনভাবে ঢুকে গেছে যে মন্দিরের গর্ভগৃহে দাঁড়িয়ে, ভক্ত-ভক্তিমতীদের অর্ঘ্যদানের মাঝে মনে-মনে গুন-গুন করেছি, কভি আর কভি পার লাগা তীরে নজর, কিংবা জানে কেয়া তুনে কহা জানে কেয়া ম্যায়নে শুনা … ।  এতে আমি দোষ দেখি না , দেবী-দেবতাদেরও বলা যায় অমনকথা । আর আমি তো কালীঠাকুর পূজকদের বাড়ির মেয়ে, বিয়ে করলুম যাকে তাদের বাড়িতে সিংহবাহিনীর পুজো হয়, পালালুম যার সঙ্গে সে তো বোষ্টম, নিজে প্রতিষ্ঠা দিলুম শিবলিঙ্গকে, শিশির তো যা বুঝেছি কোনো দেবী-দেবতায় বিশ্বাস করে না ।

শিশির আমায় আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরতেই, প্রথম দিন প্রথম বার, একটা ভয়ংকর চিন্তার ঝাপটায় আমি অবাক হয়ে গেলুম । বুঝতে পারলুম, অতুলকে আমার অসহ্য মনে হয়, আমার জীবন থেকে ওকে তাড়াতাড়ি বিদায় করতে হবে ; ও মরে গেলেই ভালো হয়, ও স্রেফ একটা পরগাছা । শিশিরের গায়ের গন্ধে আমার শরীরের ভেতর কত রকমের রঙিন পরি যে উড়তে আরম্ভ করল তার কুলকিনারা নেই । অতুলের গায়ের গন্ধে আজকাল আমার বমি পায় ।

যতবার শিশির আমায় জড়িয়ে ধরেছে, এই ভাবনাটা খেলেছে মাথায় । কিছু-কিছু ভাবনা সারা  পৃথিবীকে চেঁচিয়ে-চেঁচিয়ে বলতে ইচ্ছে করে কিন্তু কাউকে বলা চলে না । অতুল এমনিতেই অটুলস ফ্যাগের নেশায় আটক । মাদকের মাত্রা বাড়িয়ে-বাড়িয়ে ওর স্বাস্হ্য খারাপ করে দিতে হবে । ওর জন্যে আলাদা ফ্যাগ বানাবো ।

মুম্বাইতে যে দুটো ফ্ল্যাট কেনার তোড়জোড় চলছে, তার একটা কুহুর আর একটা আমার নামে কেনার জন্যে রাজি করিয়েছি অতুলকে । ও ভেবেছিল দুটোতেই ও নিজের নাম ঢোকাবে । যখন বললুম, যে ও অতুল দাস না অতুল মুখার্জি না অতুলপ্রসাদ মুখার্জি, কোনটা ? শেষে কেউ কোথা থেকে এসে গোলমাল বাধালে সেই বিপত্তি সামলানো কঠিন হবে । ব্যাস, আর গুঁইগাঁই করেনি । প্রভাদেবী এলাকায় দুটো ফ্ল্যাট আমার আর কুহুর নামেই বুক করে ফিরবে । আমার নাম থাকবে অমুকের কন্যা শ্রীমতী কে মুখার্জি । অতল মরে গেলে তারপরেই পাত্তাড়ি গুটিয়ে মুম্বাই যাবো । মন্দিরচত্তরটা বেচে দিয়ে যাব ; মোটা টাকা পাওয়া যাবে ।

সিগারেট খাওয়াটা আমি ছাড়তে পারিনি  । ব্রেকফাস্ট, লাঞ্চ, ডিনারের পর একটা করে খাই । জামাই কিনে আনে, ফিলটারটিপ বিদেশি । ভালো জামাই পেয়েছি, ঘরজামাই, ওর মা-বাবা নাসিকে বাড়ি করেছে । জামাইয়ের বাবা এচ এ এল-এ ইনজিনিয়ার ।

২১

আজ ত্তত্ব ব্যাপারটিও সংকটমুক্ত নয় । প্রকৃতির জীব মানুষ এত জটিল ও তার কার্যকলাপ এমন ব্যাখ্যাহীন যে, তাকে নিয়ে কোনো সর্বজনীন তত্ব ফাঁদা যায় না । কেবল যে জ্ঞানই অনিশ্চিত, সেটুকুতে থেমে নেই সন্দেহের উপপাদ্য । জ্ঞানের বিভিন্ন আদলকে ও এলাকাকে কীভাবে বৈথতা দেয়া যায়, জ্ঞানের বিষয়বস্তুকে অকৃত্রিম বলে গ্রহণ করা যায় , সেসব সুদূরপ্রসারী প্রশ্ন মাথা চাড়া দিচ্ছে । জ্ঞানতাত্ত্বিক বৈধতার কোনও একটিমাত্র সন্তোষজনক উপায় হিসেবে তো আর কিছু, কোনও চিন্তা-নকশা, অবশিষ্ট নেই । মনোবিশ্লেষণের  নিত্যনব ধারণার আঘাতে জর্জরিত বিষয়বস্তুরূপে চেতনা ব্যাপারটি আজ ঘোর সন্দেহে আক্রান্ত । কেউ কি আজ দাবি করতে পারেন যে অমুক বিষয়বস্তুটি স্পষ্টভাবে ও সম্পূর্ণরূপে আমার বোধগম্য ?

‘আমি’ নামক নিবাসটি তো যাবতীয় সমস্যার আগার । তাকে সংজ্ঞায়িত করা অসম্ভব । কতরকম ‘আমি’ যে আছে — সবই অনির্ণেয়, তার ইয়ত্তা নেই ।

২২

প্রথম দিনের লাল শাড়ি-ব্লাউজ-শায়া ভেতরের জামা আমি ফেরত নিয়ে যাইনি । ওগুলো কী করল শিশির ?

আমি শিশিরের প্রেমিকা নই । শিশির আমার প্রেমিক ছিল না । তাহলে আমরা পরস্পরের কী ? আমি শিশিরের দেহটাকে ভালোবেসেছি । শিশির আমার দেহটাকে ভালোবেসেছে । সত্যি কথা বলতে কি, আমরা দুজনে যে-যার নিজেকে ভালবেসেছি । অথচ আমরা প্রেমিক-প্রেমিকা নই । এরকম  কাণ্ড তো সিনেমাতেও সম্ভব নয় । দেখাতেই পারবে না । আমি সত্যিই অপ্সরা, ঝড় দিয়ে গড়া অপ্সরা । আর শিশির হল বরফের মতন ঠান্ডা অন্ধকার দিয়ে গড়া বিশ্বামিত্র ।

২৩

সনাতন সমাজে মানুষের পরিচয় ও আত্মপরিচয় ছিল স্হির, অপরিবর্তনীয়, দৃঢ় ও বলিষ্ঠ । সংস্কৃত সাহিত্য, লোককথা, মিথ ইত্যাদি থেকে তা-ই মনে হয় । পূর্বনির্ধারিত সামাজিক ভূমিকা এবং সমাজসংসারে কৌমব্যক্তির স্হান নির্ণয়কারী ধার্মিক ও ঐতিহ্য-বিধিবিধানের বাধানিষেধ ইত্যাদির দ্বারা কেলাসিত হতো তার আত্মপরিচয় । ব্যক্তির চিন্তা ও আচরণকে এই প্রক্রিয়া সারাজীবন নিয়ন্ত্রণ করত । জাত, ধর্ম, ভাষা, গোষ্ঠী তাকে যে কৌমের অন্তর্গত করে রাখত, তার চৌহদ্দিতে সে জীবনযাপন করত । অর্থাৎ জীবন-পরিসরের মর্মার্থ অনিশ্চয়তায় আক্রান্ত হয়নি । সমাজে ও দর্শনে, পরিচয় ও আত্মপরিচয় ছিল সমাধানযোগ্য, বিতর্কবর্জিত ও মীমাংসিত ।

বৌদ্ধধর্মে আত্মপরিচয়কে বলা হয়েছিল অলীক ; ব্যক্তির বাস্তবসত্তা হয় না । রাম, শ্যাম, যদু, মধুর গঠণ হয় তাদের কর্মের কারণে । অদ্বৈত বেদান্ত ও তাওবাদ পুরোপুরি ঐকিকে সীমাবদ্ধ ছিল । এই সমস্ত ধর্মভাবনা, বৌদ্ধবিহার ও আশ্রম থেকে চুঁয়ে-চুঁয়ে সাধারণ কৌমসমাজের স্তরে আত্মপরিচয়কে ব্যক্তির নিজের কাছে সমস্যা হয়ে উঠতে দেয়নি ।

ব্যক্তির আত্মপরিচয়কে আবছা করে তুলতে অভিজ্ঞতার বিশিষ্ট উপাদান হিসেবে উদ্বেগ কবে থেকে স্হান করে নিল, তা নিয়ে অনেক ভেবেছি । কূল;কিনারা পাইনি ।

২৪

উল্লসিত হইয়া উঠিল কেকার মুখশ্রী । ঘড়ি দেখিয়া কহিল, সাড়ে সাতটা বাজে, এগারোটায় আসিব । শ্যাম্পু করিয়া , আবছামত লিপস্টিক লাগাইয়া আসিব , সতীত্বের কোনো ফাঁক রাখিব না । গয়নাগাটি কিচ্ছু পরিব না, কেবল খোঁপায় ফুল ও গলায় রুদ্রাক্ষের মালা থাকিবে । তুমি কোথাও যাইবে না , ঘরেই থাকিবে । কথা কয়টি বলিয়া, থলের ভিতর ম্যাডেলিনের কিছু পোশাক ঠুসিয়া লইয়া চলিয়া গেল । কেকা বোধহয় প্রতিদিন নিজের মুখ নতুন করিয়া আয়নায় দেখিতেছে ; এতকাল সে সম্ভবত আয়না-উপোসী রাখিয়াছিল নিজেকে । অন্তত অন্যের চোখে সুন্দরী প্রতিভাত হইবার আকাঙ্খা নবীকরণ করিয়াছে আমার স্পর্শে ও সোহাগে ।

এত ভোরে আগমন , অনুমান করিলাম, সন্দেহ নিরসনের জন্য যে এই ঘরে উহার কোনো প্রতিদ্বন্দ্বী রাত্রিবাস করে না । দখলিস্বত্বের একাগ্র আত্মচর্চায় শরীরকে উত্তপ্ত করিয়া ফেলিয়াছে । প্রতিদ্বন্দ্বী যদি থাকিত তাহা হইলে সেই মেয়েটিকে বোধহয় খুন করিতেও ইতস্তত করিত না কেকা, এমনই চক্রান্তে সে নিজেকে ঘিরিয়া ফেলিয়াছে ।

কোথাও ব্রেকফাস্ট করিতে যাইতে হইলে পোশাক পরো, পথে নামো, রেস্তরাঁয় যাও, অর্ডার দাও, অপেক্ষা করো, ইত্যাদি বহুবিধ প্রক্রিয়া । কেকার আনা স্বাস্হ্যবর্ধক ব্রেকফাস্ট করিয়া, এই ডায়েরি এই পর্যন্ত লিখিয়া ঘুমাইয়া পড়িলাম ।

খুটখাট শব্দে ঘুম ভাঙিতে দেখি কেকা, সবুজ শাড়ি-ব্লাউজ পাট করিয়া খাটের উপর রাখিয়া নগ্ন অবস্হায় গ্লাস, সোডা, কাবাব, চানাচুর সাজাইয়া বসিয়া আছে । চক্ষু মেলিয়াছি দেখিয়া কহিল, সিঁড়ির দরজায় তালা দিয়াছি, রাতের জন্য ফ্রায়েড রাইস ও মাংস আনিয়াছি ; কোন বোতলটি খুলিব ?

তোমার তো মদ্যপানের প্রথম দিন , রাম সহযোগে লেমোনেড পান করো, প্রস্তাব দিলাম । এক চোঁয়ে গ্লাস খালি করিয়া কেকা বিস্ময় প্রকাশ করিল, কই কিছু হইতেছে না তো , ইহার তুলনায় ছিলিমের নেশা অনেক দ্রুত মস্তিষ্কে ঘোর তোলে । পুনরায় এক-এক পেগ লইলাম । মদের স্বাদগন্ধে অভ্যাস নাই বলিয়া, অধিকাংশ চানাচুর ও কাবাব সে-ই খাইল । কিয়ৎক্ষণ পর নেশাচ্ছন্ন কন্ঠে কেকা কহিল, আমি বাঘিনী, আমার বাঘ আমাকে খাউক, হালুম, হালুম ; না আমি ঠগিনী আর তুমি আমার ঠগ, কেমন ঠকাচ্ছি নিজেদের, কেউ কিচ্ছুটি জানতে পারছে না, বলিতে-বলিতে আমার উপর ঝাঁপাইয়া পড়িল ।

মাতাল রমণীর পক্ষে বাঘের আঙ্গিক সম্ভব ছিল না । পোশাকমুক্ত হইয়া আমি তাহাকে শক্ত আলিঙ্গনে লইলাম । বলিলাম, অক্টোপাস সামুদ্রিক প্রাণির কথা জানো ? আমি অষ্টভূজা অক্টোপাস হইয়া তোমাকে পিষিয়া নিজের সহিত একাত্ম করিব । সে কহিল, আরও জোরে, আরো জোরে, হাড়-পাঁজর ভাঙিয়া দাও , চুলের মুঠি ধরিয়া টানো, যত্রতত্র দাঁতের দাগ বসাও, লিপ্সটিক লেহন করিয়া লও, আইস, শিশির, অবোধ-শিশু, তুমি কোথায়, আইস,  আট হাতের ঝড়ে বেষ্টন করিয়া চুরমার করিয়া ফ্যালো, ধ্বংস করিয়া ফ্যালো আমাকে, আট-হাতের আকাটপেষণ, আইস, ব্র্হ্মরন্ধ্র পর্যন্ত তোমার বিষ বিছাইয়া দাও ।

এই সময় তৃতীয় কোনো ব্যক্তি আমদের দেখিলে অক্টোপাসই মনে করিত, মানুষের দুই হাত ও দুই পা যুক্ত একটি মানব-অক্টোপাস, যাহার দ্বৈত বোধ ছড়াইয়া পড়িতেছে দুই দায়-দায়িত্বহীন মানুষ-মানুষীর কর্মকাণ্ডে । অন্যের দেহের তাপের জন্য আমরা দুইজনেই লালায়িত । আরেকজন জড়াইয়া ধরিয়া থাকুক, ইহাই প্রধান চাহিদা ; সেই সূত্রে যৌনকর্ম ঘটিয়া যাওয়া তত গুরুত্বপূর্ণ নহে ; প্রাণীজগতে জড়াইয়া ধরিয়া আদর আদানপ্রদান করিবার সুযোগ-সুবিধা প্রকৃতি তাবৎ জীবকে দেয় নাই ।

ফোরপ্লে করিয়া বুঝিলাম দেহ ভালোই সাড়া দিতেছে । অবচেতনে যে ইচ্ছাগুলি সে ঝিমকিনি অবস্হায় প্রকাশ করিয়াছে , তাহা চেতনা না ফিরিলে পূরণ করা বৃথা । গতানুগতিক আবাথাবা প্রথা অবলম্বন করিয়া, ঘন্টাখানেক পরে কেকা প্রকৃতিস্হ হইলে, দুইজনে আহার করিবার সময় উহার প্রলাপোক্তিগুলি ফাঁস করিলে কেকা দাবি জানাইল যে অদ্যই, যাইবার পূর্বে, উহা পূরণ করিতে হইবে । বুঝিতে পারিলাম যে জীবনের একটি পর্ব ফুরাইয়া যাইতে চলিয়াছে বলিয়া কেকা গোপন দুঃখে আক্রান্ত হইয়াছে ।

কিয়ৎক্ষণ পর এলোকেশ দুইহাতে ফাঁপাইয়া, মৎস্যকুমারীর ভঙ্গীতে পায়ের গোছের উপর পা রাখিয়া বলিল, আমার ঠোঁট দেখিতেছ, গাল দেখিতেছ, আমি মধুবালা । তুলনা এইখানেই শেষ হইল না ; অকস্মাৎ উচ্চস্বরে গাহিয়া উঠিল, পেয়ার কিয়া তো ডরনা কেয়া, পেয়ার কিয়া কোই চোরি নহিঁ কি, ছুপছুপ আহেঁ ভরনা কেয়া , পেয়ার কিয়া তো…

কন্ঠস্বরটি মধুর, সঙ্গীতশিক্ষকের নিকট নিয়মিত তালিম লইলে গায়িকার মর্যাদা পাইত । কন্ঠস্বর উচ্চগপঅমে উঠিতেছিল বলিয়ে মুখ চাপিয়া ধরিলাম । দ্বিতলের ভাড়াটেগণ শুনিতে পাইলেও ক্ষটি নাই, কিন্তু অন্যান্য বাড়ির হিন্দিভাষী প্রতিবেশিগণ শুনিতে পাইলে কেলেঙ্কারি । এতদঞ্চলের প্রতিবেশিগণের অন্তঃকলহকে প্রাণবন্ত রাখিবার জন্য গায়ে-গা বাড়ি ।

মুখে হাত-চাপা অবস্হাতেই কেকা কহিল, মুখ বাঁথিয়া দাঁতের কামড় দাও, এইখানে, এইখানে, বলিয়া বুক, উরু, নিতম্ব, কাঁধ, গাল, ঠোঁট নির্দেশ করিতে লাগিল । চকিতে মনে হইল, প্রসন্ন মুখোপাধ্যায়ের প্রহারের প্রতিশোধ এই প্রক্রিয়ায় লইতেছে নাকি এই নারী , যে কেবল নিজেকে ভালোবাসিয়াছে , অন্য পুরুষের আয়ত্বে নিজেকে সঁপিয়াছে নিজেকে ভালোবাসিবার উপায় হিসাবে । কিন্তু প্রসন্ন নামটি এই পরিবেশে, সম্পর্কে, ট্যাবু ; তাহা উথ্থাপনই আত্মঘাতী । সম্পর্ক শব্দটি লিখিয়া আশ্চর্য লাগিল । কী সম্পর্ক এই নারীর সহিত ? মস্তিষ্কের ভিতরে একটি গহ্বর তৈরি করিয়া চলিয়া যাইবে, এমনই এই মানবিক সম্পর্ক, সমাজের বাহিরে, লোকচক্ষুর অগোচরে । দৈহিক স্বাধীনতার সুখে সে নিজেকে ভালোবাসিতে আরম্ভ করিয়াছে , এবং আমার ফাঁকা আলিঙ্গনকে ভরাট করিতেছে । করুক, করুক ।

অন্যত্র কেহ দেখিতে পাইবে না, কিন্তু ঠোঁট ও গালের দাগ দৃষ্টি আকর্ষণ করিবে , মুখ হইতে হাত সরাইয়া আমি এভাবে নিরস্ত করিতে চাহিলে কেকা বলিল, তোমায় ওসব চিন্তা করিতে হইবে না , আমার দেহ আমি বুঝিব । আমার দেহে কে কবে আঁচড়-কামড় দিল তাহার জন্য অন্য লোকের মাথা ঘামাইবার প্রয়োজন নাই ; তোমাকে  আদেশ করিয়াছি, অনুরোধ করি নাই ।

প্রসঙ্গ ভিন্নপথে ঘুরাইবার জন্য আমি প্রস্তাব দিলাম, আমরা রাজকাপুর-নার্গিসের আর-কে ব্যানার আঙ্গিক অবলম্বন করিব । উছলিয়া উঠিয়া দাঁড়াইল কেকা ; বলিল, আমার দৃষ্টি লক্ষ করো, উহা নার্গিসের ন্যায় মাদকতাপূর্ণ ; কল্য পাতলা করিয়া কাজল পরিয়া আসিব । দম ভর যু উধর মু ফেরে, এককলি গাহিয়া সংযত হইল । হিন্দি ফিল্মসমূহের বায়বীয় চরিত্রগুলির ভিতর প্রবেশ করিয়া নিজের একটি প্রথক সত্তা গড়িয়া তোলে কেকা , এবং এই সত্তাটির রহস্য সে উপভোগ করে ।

যাইবার সময়ে থলে হইতে অঢেল পেস্তা, আখরোট, আঞ্জির, খোবালি, কাগজি বাদাম, কাজু, কিসমিস তোষকে উপুড় করিয়া কেকা কহিল, ফুরাইলে আরও আনিব ; দেওয়ালিতে যজমানগণ আমার ধর্মপরায়ণা পদপ্রান্তে রাখিয়া যায় । তুমি ভক্ষণ করিয়া দেহকে সুস্হ-সবল রাখিবে । কল্য দশটায় আসিয়া সন্ধ্যা ছয়টা পর্যন্ত থাকিব, কোনকোন ক্রীড়ায় লিপ্ত হইব, তাহা পরিকল্পনা করিয়া রাখিও ।

পরের দিন দশটা বাজিয়া গেলে, নিজের উৎকন্ঠার সহিত পরিচয়ে আশ্চর্য বোধ করিলাম যে কেকার অপেক্ষায় আমি উদগ্রীব । কেন ? ম্যাডেলিনের ক্ষত তো দূরীভূত হয় নাই । ভালোবাসা হইতে দেহের দিকে নাকি দেহ ইতে ভালোবাসার দিকে— এই দুই নারী আমাকে একটি হলাহলের স্বরূপের সহিত পরিচয় করাইয়া দিল । কতগুলি শিশির দত্তকে আমার অস্তিত্বে পুষিতেছি জানি না ।

২৫

রাস্তায় নেড়েদের জুলুস বেরিয়েছিল বলে শিসিরের ঘরে পৌঁছোতে আমার দেরি হয়ে গিয়েছিল সেদিন । ইহুদিরা নাকি মাত্র ছ’দিন যুদ্ধ করে নেড়েদের দেশের অনেকটা জায়গা-জমি দখল করে নিয়েছিল ; সেসব আর ছাড়বার নাম নেই ।  বেশ লেগেছিল শুনে । আমরা মন্দিরচত্ত্বর দখল করে নিয়েছি আর ওরা একটা দেশের অনেক জমি-জায়গা খামচে-খামচে নিয়ে নিয়েছে । যাদের জায়গাজমি দখল করেছিল তাদেই নাকি সেসব মোটা দামে বেচবে ।

শিশির আমার জন্যে অপেক্ষা করত জেনে এই লাইনগুলো অনেকবার পড়েছি ; ভিজিয়ে-দেয়া কথাবাত্রা । কয়েকটা কারণে রাগও হয়েছে । ম্যাডেলিন করিয়েটকে সাবান মাখিয়ে চান করিয়েছে অথচ আমাকে করায়নি। বাথরুমে দৈত্যকন্যাকে চান করাবার সময়ে কী-কী করেছে তা-ও লেখেনি । ও তো আর ওই দানবকন্যার দেহ পাঁজাকোলা করে তুলতে পারেনি, যেমনটা আমায় তুলত । দানবকন্যাই ওকে তুলে ক্যারদানি-কসরতগুলো শিখিয়েছে । ইংরিজিতে বলিয়ে-কইয়ে হবার পুরো ফায়দা লুটেছে কামুকটা ।

আর কী স্বপ্ন দেখেছে ও ? মোগল দরবারে পরি হয়ে উড়ছে ম্যাডেলিন ! তুই বাদলা পোকার মতন টুসকি মেরে ডানা খসিয়ে লুফে নিলে পারতিস তো । জাহাঙ্গিরের বউ নিশ্চয়ই ম্যাডেলিনের চেয়ে হাজারগুণ সুন্দরী ছিল  আর ফরসাও ছিল গোলাপিহলুদ। তবে ?

আতুলতো প্রায় বলতেই জানে না ইংরিজি ; তা সত্ত্বেও হিপিনি দেখলেই কীভাবে জাল বেছায় জানি না । জালে আটকেও যেত কেউ কেউ । শিশিরের লেখা পড়ে বুঝতে পারছি যে জাল না বিছিয়েও কাজ  হাসিল হয়েছে ।

নির্মল-প্রণবরা বেনারসি ইংরিজি বলত । ওদের সুবিধা ছিল যে ওরা চিত্রশিল্পী । পুলিশের ধরপাকড়ের ভয়ে উপেন সর্দার পাটনায় গিয়ে রঙিন মাছের দোকান খুলেছিল ; তারপর  বউবাচ্চা নিয়ে চলে গেছে দিল্লি । প্রণব একজন আমেরিকান বিয়ে করে চলে গিয়েছিলো, এখন শুনি একজন জার্মান মহিলার সঙ্গে দিল্লিতে থাকে । উল্লাসকে ধরে নিয়ে গিয়ে খুন করে দিয়েছে কলকাতার পুলিশ। আমি বেনারস ছাড়ার সময় ওরা কেউই ফেরেনি।

নকশাল আন্দোলন নিয়ে কত হ্যাঙ্গাম হয়েছিল , অথচ কিছুই তো হল না । কং নকশালবাড়ি গ্রামটায় গিয়েছিল, কোনো সিরিয়ালের শুটিং করতে । ফিরে এসে বলেছিল, কালো পাথরের থামে চারটে মূর্তি আর একটা নোংরা কাদামাখা শ্বেতপাথরে দশবারোজন শহিদের নাম লেখা । বাংলাদেশিরা রোজ লুকিয়ে-চুরিয়ে ঢুকে-ঢুকে, যারা আন্দোলন করেছিল সেসব বাড়ির লোকজনকে এলাকাছাড়া করেছে । কে জানে, তারা হয়তো কলকাতার কোনো  বন্ধ কারখানার গেটে দাঁড়িয়ে আন্দোলন করে এখন ।

কী লিখব বলে ভেবে কী সব আবোল তাবোল লিখছি ; ছবি আঁকিয়েদের মতন হয়ে গেছে কলমখানা, নিজেই নিজের ভাবনা লিখে চলেছে । যখন বেনারস ছাড়ি,  কাশী-বেনারস একেবারে বদলে গিয়েছে । বাড়ির বাইরে টুকটাক চুমু খেতে দেখলে বজরং দলের পালোয়ানরা আস্ত রাখবে না । নেড়ে পাড়ায় বোরখা পরে না গেলে মেয়েরা হেনস্হার একশেষ হবে ।

২৬

হলুদ-বেগুনি ফুল-আঁকা শাড়ি, স্লিভলেস হলুদ ব্লাউজ, উপরদিনে যুঁইফুল জড়ানো ফাঁপানো খোঁপা, চোখে কাজল, ঢোঁটে গল্সি লিপ্সটিক, কেকা এগারটা নাগাদ ঘরে প্রবেশ করিয়া গাহিয়া উঠিল, আজা, আআআ আজা, আব তো আজা, আআআ আজা, আবতো আ, আজা পেয়ার মেরা…। গান থামাইয়া, মেঝেয় থলে নামাইয়া কহিল, অদ্য আমি আশা পারেখ । আইস, আমরা কলেজ ছাত্রছাত্রীর ন্যায় পোশাক ত্যাগ না করিয়াই দ্রুত মিলিত হই ।

আমাকে জড়াইয়া নিজে দেয়ালে পিঠ দিয়া দাঁড়াইতে, বুঝিলাম সিগারেট ফুঁকিয়া আসিয়াছে । হয়ত আমার মুখে গন্ধের প্রতিক্রিয়া প্রতিফলিত হইল, যাহা দেখিয়া কেকা  মন্তব্য করিল, তোমার মনে ভয়, অথচ দেহ অকুতোভয়, এইরূপ কেন ? ভয় পাইবার কথা তো আমার !

মনে যে ভয় নাই তাহা অকুতোভয় দেহ দ্বারা অতিদ্রুত প্রমাণ করিয়া মুদ্রিতচক্ষু কেকাকে বলিলাম, আমি একটি খাতায় কাশীবাসের স্মৃতি লিখিতেছি । শুনিয়া, দপ করিয়া ভাস্বর চোখ মেলিল রুদ্রাক্ষ মালাধারিণী কেকা, মুখমণ্ডলে আতঙ্কমিশ্রিত বিচলন ছড়াইয়া পড়িয়াছে । শুধাইল, আমার কথাও লিখিতেছ ? প্রতিদিন যাহা করিতেছি সব সব সব ?

শক্ত আলিঙ্গনে আবদ্ধ রাখিয়া যখন বলিলাম, হ্যাঁ, সব, কিন্তু চিন্তা করিও না , একটি বন্ধ প্যাকেটে উহা উপহার দিয়া যাইব, কখনও সময় হইলে পড়িও ; উহা তোমার পক্ষে যতটা বিস্ফোরক, ততটা আমারও ।

আশ্বস্ত হইল কেকা, দ্বিধা-সংশয় ব্যক্ত করিল, না বাবা, আমি লইয়া কী করিব, কোথায় রাখিব ! বলিয়াই , সম্ভবত অনুধাবন করিল যে অন্যের হাতে পড়িলে ভয়ংকর বিপদ ঘটিতে পারে ; তাহার চেয়ে উহা নিজের নিয়ন্ত্রণে লওয়া শ্রেয় , সুযোগ বুঝিলে সংরক্ষণ করিয়া নিরালায় পাঠ করা যাইবে ; বিপদাশঙ্কা ঘটিলে খাম ছিঁড়িয়া  মন্দির চত্ত্বরের কুয়ায় বিসর্জন দেয়া যাইবে । বলিল, ঠিক আছে, দিও, শেষ দিন শেষ শিশিরফোঁটাগুলি ও স্মৃতিকথাটি দিও , সযত্নে রাখিব ।

সন্ধ্যা পর্যন্ত সময় ছিল বলিয়া সোডা সহযোগে ভোদকা পান করিয়া নিজেকে উদ্দাম করিয়া তুলিল কেকা । প্রণয় নিবেদনের গানের যে কলিগুলি মাছভাত খাইতে-খাইতে গাহিল, তাহা কোনও না কোনো হিন্দি ফিল্মের । এটি লিখিতে বসিয়া স্মৃতি হাতড়াইতেছি , লাইনগুলির সুর মনে পড়িতেছে, কথাগুলি মনে নাই । এমনকী সিংহ আঙ্গিকে সংসর্গের সময়ও গাহিতেছিল । সিংহ সংসর্গ বাঘ হইতে  পৃথক ; সিংহকে একটি সিংহিদলের দায় লইতে হয় ; বাঘ কেবল এক সময়ে একজন বাঘিনীর । আমার পালে দুইটি সিংহী লইয়া প্রেমের সমগ্র সাভানাভূমি আয়ত্ব করিয়া ফেলিয়াছি ।

যাইবার দিন পর্যন্ত এইরূপই চলিল প্রতিদিন । আমার স্বগৃহে প্রত্যাবর্তন যত নিকটতর হইতেছে , ততই তাহার আনন্দ উথলিয়া উঠিতেছে । আসিয়া এমন জোরাজুরি করিতেছে , যেন আমাকে সম্পূর্ণ নিংড়াইয়া লইবে । কুমকুম, মীনাকুমারী, শ্যামা, শাকিলারূপে ঘরে অবতীর্ণ হইয়াছে । একদিন স্তম্ভিত করিয়াছে পোশাক পরিত্যাগ করিয়া টু-পিস বিকিনিতে তোষকের উপর নর্তকীর ন্যায় অঙ্গভঙ্গী প্রকাশিয়া, যখন নিজেকে শর্মিলা ঠাকুররূপে ঘোষণা করিল । আমার বিস্মিত চাউনির প্রতি এইভাবে ব্যাখ্যা দিয়াছে , এই ইজের ও বডিস জোসেফিনের, সে পরার সুযোগ পায় নাই , প্যাকের ভিতর আনকোরা ছিল ।  স্পষ্টতই জোসেফিনের বুকের তুলনায় কেকার বুক ছোট ।

বিকিনি জিনিসটি ভারতের বাজারে এখনও আসে নাই । আসিলে নারীকে আমরা নবতর একটি কমনীয় নমনীয় বিস্ময়বাহী প্রাণীরূপে সমাদর করিব ।

আমার ভিতর যতগুলি শিশির দত্ত রহিয়াছে, মনে হইল, কেকার ভিতর তাহার বহুগুণ অধিক কেকা বিরাজ করিতেছে । প্রসন্নর প্রেমিকা কেকা, প্রসন্নর প্রহারে বিদ্রোহী কেকা, অতুলকে আঁকড়াইয়া মা হইবার প্রয়াসী কেকা, গৃহত্যাগী কেকা, শিবমন্দিরের পূজারিণি কেকা, ভক্তবৃন্দের শোষণকারিণি কেকা , বাড়িউলি কেকা, মাদক প্রস্তুতকারিণী কেকা, বৈভব সঞ্চয়প্রয়াসিনী কেকা, অতুলের রক্ষিতা হইয়াও না থাকা কেকা, টিপ সিঁদুর আলতা নোয়া পরিহিতা সতীসাধ্বী কেকা, উদ্দাম যৌনতায় আক্রান্ত কেকা, মদ্যপানে বেপরোয়া কেকা, সিগারেটপায়ী কেকা , যৌনসঙ্গীর প্রতি মমতাময়ী কেকা, যৌনসঙ্গীর অবর্তমান সঙ্গিনী সম্পর্কে ঈর্ষান্বিত কেকা এবং আরও গোপন কেকা হয়ত আছে যাহা আমার অজ্ঞাত । রক্তমাংসে গড়া আমরা দুইজন বায়বীয় আত্মপরিচয়ের বাহক ।

ম্যাডেলিনের সমস্ত পোশাক ভিখারিদের বিতরণ সমাধা হইলে, ফ্যান বিজলি-উনোন ও বিয়ার বোতলগুলিও একে-একে বিক্রয় করিয়া ঘরটিকে নিজস্ব শূন্যতা দ্বারা ভরাট করিয়াছে কেকা । সেই শূন্যতায় আছে কেবল গন্ধের সঙ্গীত ; রহস্যময়ী নারীর জিভের ঠোঁটের বুকের পাছার যোনির বাহুমূলের হাতের চেটোর গোড়ালির গন্ধের সঙ্গীত ।

ভিন্ন-ভিন্ন রূপগ্রহণকারিণী কেকা আমাকে মনে রাখিবে কিনা জানি না । কখনও আমার এই টুকরো-করা রচনা পড়িলে দুইজনে যে উনিশটি দিন একত্রে অতিবাহিত করিলাম, তাহা উহার স্মৃতিগহ্বরে আনন্দ বা গ্লানির ঘুর্ণি লইয়া জাগিয়া উঠিবে , হয়ত জলস্তম্ভের ন্যায় পাকাইয়া তুলিয়া দিবে অতীতের জটিলতাগুলিতে । উহার গঙ্গা-স্নান সিক্ত আগমনের পূর্বে  কাশীতে আমার কার্যকলাপ পড়িয়া, আমি নিশ্চিত, একযোগে ক্ষুব্ধ বিস্মিত ঈর্ষান্বিত  ও উদাসীন একাকীত্বে নিক্ষিপ্ত হইবে ।

ডাকিয়াছিল অতুল, অথচ উহার সহিত সাক্ষাৎ করিতে পারিলাম না । অতুল ও কেকার সহিত আর কখনও দেখা হইবে না , কেননা কাশীতে পুনরায় আসিব না । পরস্পরের ঠিকানা লওয়া হয় নাই বলিয়া ম্যাডেলিন করিয়েটের সহিত সাক্ষাতের সম্ভাবনা নাই । গেরিলা পেইনটার্স গোষ্ঠীর সদস্যগণ পশ্চিমবঙ্গ ব্যতীত অন্যান্য রাজ্যে পলাইয়াছে ; তাহাদের কারোর সহিত ভবিষ্যতে কোনও শহরে আকস্মিক মুখোমুখি হইতে পারি ।

কল্যই শেষদিন । কেকা ঘরে প্রবেশ করিলে তৎক্ষণাৎ এই স্মৃতিকাহন ও অতুলের লিখিত পোস্টকার্ডটি উহার হস্তে অর্পণ করিব , নয়ত ভুলিয়া যাইতে পারি ।

২৭

নির্মল রক্ষিতের বাবার এই বাঁধানো খাতাটা, যাকে শিশির কখনও বলছে ওনার জার্নাল আর কখনও ডায়েরি, শেষদিন একটা খামে ভরে দিয়ে দিয়েছিল বলে, ওই দিনকার ব্যাপার-স্যাপার লেখার সুযোগ-সময় ও পায়নি । এতদিন পর যা মনে পড়ছে লিখছি । তাছাড়া আমারও নিজের কিছু কথা বলার আছে । অতুল মরে আপদ গেছে । লিখে, ওরই তোরঙ্গে রেখে দেব খাতাটা । এখন আর ভয়-ফয় করি না কাউকে ; কখনও করেছিলাম বলে তো মনে হয় না । ভয় জিনিসটায় গান নেই, সঙ্গীত নেই, অন্ধকারময় । যা প্রকাশ্যে করা যায় না তাকেই তো ভয় পাবার কথা। আমার জীবনকে আমি চুবিয়ে নিয়েছি আলোয়-গানে-সঙ্গীতে ।

শেষদিন আমি বৈজবন্তীমালা সেজে গিয়েছিলুম । ঘরে ঢুকে গেয়েছিলুম, হোঁঠোপে অ্যায়সি বাত ম্যায় দাবাকে চলি আয়ি, খুল যায়ে ওয়হি বাত তো দুহাই হ্যায় দুহাই । অকূলকান্ডারী শিশু, বোকা-গঙ্গারাম, জানতে চাইল না যে সেইরহস্যটা কী !

ও যাকে বলে মিশনারি আঙ্গিক, আমরা সেই অলছ-তলছ কায়দায় খানিক কাদায় ঘামা রাক্ষুসে মাগুর সাজলুম । খানিক শালিক পাখির দ্বৈরথ । হিমসিমের মণ্ডামেঠাই খেয়ে খানিক জিরোবার পর ওকে আমি বললুম , চলো তোমায় বেনারস শহরটা দেখাই , তোমার তো তীর্থক্ষেত্র দেখাই হল না , আর মোগরসরাই রওনা দেবে তো চারটেতে ।

আমি সারাদিনের জন্যে একটা টাঙ্গা ভাড়া করলুম । আমার উদ্দেশ্য ছিল কাশী-বিশ্বনাথ ঘুরে অতুলের পরিচিত কয়েকজনের বাসায় ঢুঁ মারা , যাতে অতুল শুধু একজনকেই সন্দেহ করে । অতুল আমার কোলে ওর বাচ্চা কংকে ধরিয়েছে ; আমি ওর কোলে শিশিরের বাচ্চা বংকে ধরাব ।

কাশী-বিশ্বনাথে আমার জীবনের প্রথম সত্যিকার পুজো দিয়ে, পুরুতকে বলেছিলুম, আমরা দত্ত দম্পতি । গলি থেকে বাইরে বেরিয়ে ভাত-লস্যি খেলুম । গলিতে মুখচেনা কয়েকজনের সঙ্গে দেখা হয়ে ভালই হল । তারপর এক-এক করে গেলুম গেরিলা পেইনটার্সদের বাড়ি । তখনই জানলুম, উল্লাসকে কলকাতা পুলিশ ধরে নিয়ে গিয়ে খুন করেছে , আর বাদবাকি সবাই গা-ঢাকা দিয়েছে । সবায়ের আত্মীয়স্বজনের চোখমুখ থমথমে ।

উল্লসের বাবা বললেন, ওদের গেরিলা পেইনটার্সের হ্যাপেনিং আসলে ছিল রাতদুপুরে নকশালদের সভা । শুনে, মুখ চুপসে গেল শিশিরের । ও বোধহয় ভেবেছিল হইচই ধরণের আনন্দ । ম্যাডেলিনকে ধন্যবাদ দিই যে শিশিরকে বাঁচিয়ে নিজে টাকনা দিয়ে খেয়েছে, আর আমার জন্যে অক্ষত রেখে গেছে, শিখিয়ে-পড়িয়ে তৈরি করে দিয়ে গেছে ।

লোকাল ছাত্ররা কেউ-কেউ অতুলকে আমাকে চেনে বলে হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয়ের চত্ত্বরটা খানিক ঘুরে বানোয়ারি গুপ্তার বাড়ি গিয়ে ম্যাডেলিনের ছাদের চাবি দিয়ে দিলুম গুপ্তাজির বউকে । শিশুকে দেখিয়ে বললুম, অতুলের আত্মীয় , ঠোঁটে এক চিলতে হাসি ফুটিয়ে, যাতে বুঝতে পারে যে শিশির মোটেই আমার আত্মীয় নয় । গুপ্তাজির বউ ফেরত-হাসি হাসল । বেশ, অন্তরটিপুনি কেউ না কেউ তো ফাঁস করবে ।

ম্যাডেলিন ট্রেনের টয়লেটে শিশিরকে টেনে নিয়ে গিয়ে কাঁদো-কাঁদো বিদায় জানিয়েছিল । আমি টাঙ্গায় বসে শিশুকে জড়িয়ে ধরলুম, রাস্তা-জোড়া লোকের সামনে । এত আনন্দ আমার আর কখনও হয়নি ।  ওকে মাত্র ক’দিন পেয়ে, ব্যবহার করে, আমি আমার বাকি জীবনটা নিজের নিয়ন্ত্রণে করে ফেললুম ।

গায়নাকের কাছে অতুলকে সঙ্গে নিয়ে গিয়েছিলুম । ছেলে হবে শুনে সেই যে ভাঙাস্বাস্হ্য ডিপ্রেশানের খোলসে অতুল ঢুকল, তা থেকে ওকে বেরোতে দিইনি আমত্যু । আমি ভেবে রেখেছিলুম যে ছেলে হলে নাম রাখব বং । বম্বে এসে আশ্চর্য হলুম শুনে যে ওর স্কুলের বন্ধুরা ওকে বং বলে ডাকে । আসলে বাঙালিদের অবাঙালিরা বলে বং । আমার নতুন নামকরণ হল কং-বং এর মা।

অতুলের শ্রাদ্ধতে আমি একশো ব্রাহ্মণ আর দুশো কাঙালি খাইয়েছিলুম । মন্দিরচত্ত্বর জুড়ে শাদা ফুল আর শাদা শামিয়ানা । লোকদেখানোপনার কোনও কসুর রাখিনি । মুখও এমন করে রেখেছিলুম যান মাদার ইনডিয়ার নার্গিস ।

মন্দির আর চত্ত্বরটার দখলিসত্ত্ব বেচতে সাহায্য করেছিল বানোয়ারি গুপ্তা । ও-ই বলল যে, একা মেয়েমানুষ আমি, অতুলের অবর্তমানে, সামলাতে পারব না এতবড় দেবোত্তর সম্পত্তি, কেন না বেনারসের উঠতি মাফিয়াদের অনেকের নজরে আছে সম্পত্তিটা । তার কারণ এ–রাজ্য তো কাতলা-মারার দেশ হয়ে গেছে ।

বিক্রি হয়ে গেলে, ব্যাংকগুলো থেকে টাকাকড়ি ঝেড়েমুছে তুলে, সবাই মিলে চলে এলুম বম্বে । পাশের ফ্ল্যাটটা ভাড়া দিয়ে আরামে কেটে গেল জীবন । নির্মলের বাবার বাঁধানো খাতার মধ্যে অতীতকে ঢুকিয়ে রেখে দিচ্ছি । যদি কেউ কখনও পড়ে, আমার পরিবারের কেউ, তাহলে ওই অতীতরহস্য তাকেই বিষদাঁতে আক্রমণ করবে , আমাকে নয় ।

শিশির যে গিটারটা সঙ্গে এনেছিল, সেটা নির্মলের বাড়ি গিয়ে চেয়ে নিয়ে এসেছিলুম । আমার ঘরের দেয়ালে টাঙিয়ে রেখেছি । কাউকে হাত দিতে দিই না । শিশিরের ছেলেকেও নয় ।

২৮

ইন্দিরা : তাহলে ?

সুবীর : তাহলে কী ?

ইন্দিরা : দুটো অপশান আছে । আমাদের বিয়ের আগে, এই স্মৃতিকথা, এখনই গিয়ে ওরলির সমুদ্রে বিসর্জন দেয়া । কিংবা বিয়ের পর, এটাকে চুপচাপ স্বস্হানে রেখে দেয়া ।

সুবীর : দ্বিতীয় অপশানটাই প্রেফারেবল । আমাদের ছেলেমেয়ে হলে তাদেরও তো জানা দরকার যে তাদের শরীরে প্রেমিক-প্রেমিকাদের রক্তবীজ বোনা আছে । তাছাড়া আমরা দু’জনে এক নতুন মানবপ্রজাতির জন্ম দিতে চলেছি।


Comments

Popular posts from this blog

কফিহাউসে চেঙ্গিজদা, ল্যাঙড়াদা, গুলপিসি...অ্যান্টি-হিস্ট্রির আড্ডা : মলয় রায়চৌধুরী লিখিত পৃথিবীর ইতিহাস

প্রদীপ চৌধুরী, ফরাসি কবি, বাঙালি কবি, হাংরি আন্দোলনের কবি : মলয় রায়চৌধুরী

Malay Roychoudhury interviewed by Anupam Mukhopadhyay